কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের প্রতি
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আল্লাহ তাআলার শোকর যে, সম্প্রতি একটা জাগরণ লক্ষ করা যাচ্ছে- আমাদের আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর ছাত্রদের সামনে কুরআন-সুন্নাহর ইলম অর্জনের প্রয়োজনীয়তা এবং পশ্চিমা প্রতারক গোষ্ঠীর অন্ধ অনুকরণের কুফল পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই সচেতনতা এতটা শক্তি অর্জন করতে পারেনি যে, অধিকাংশ লোকের কর্ম ও চরিত্রকে প্রভাবিত করে। তাই অত্যন্ত দরদ ও সহানুভূতির সঙ্গে আমি আমার প্রিয় ছাত্রভাইদের একটি চিন্তাগত ও একটি কর্মগত ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন করতে চাই। কেননা সাফল্যের সকল উপাদান থাকা সত্ত্বেও এই দুর্বলতাগুলোই তাদেরকে কর্ম ও প্রচেষ্টার সুফল থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। আল্লাহ করুন, যুবক ভাইয়েরা যদি জীবন সায়াহ্নে উপনীত এক বৃদ্ধের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং গ্রহণ করেন তবে গোটা জাতিকে তারা ইসলামের রঙ্গে রাঙিয়ে দিতে পারবেন।
সালাফে সালেহীনের উপর আস্থা
প্রথম দুর্বলতা চিন্তাগত। এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে, আমাদের আধুনিক শিক্ষিত ভাইদের মধ্যে ইসলাম ও ইসলামিয়াত সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কিছু ভুলের কারণে তাদের লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়ে যায় বেশি এবং হেদায়েতের পরিবর্তে সূচনা হয় ফেৎনার। একটি ভুল এই যে, কুরআন ও সুন্নাহর ইলম অর্জনের জন্য ব্যক্তিগত অধ্যয়নই যথেষ্ট মনে করা হয়। প্রশ্ন হল, জগতের কোনো বিদ্যা কি শুধু ব্যক্তিগত অধ্যয়নের দ্বারা অর্জিত হয়? এমন একটি দৃষ্টান্তও কি দেখানো যাবে যে, শুধু ব্যক্তিগত অধ্যয়নের দ্বারা কেউ কোনো শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেছে? তাহলে কুরআন ও সুন্নাহর ইলম কীভাবে এত তুচ্ছ হয়ে গেল যে, কিছু বইপত্র পড়েই এ বিষয় পন্ডিত হওয়ার আশা করি? আমরা যদি সত্যিই কুরআনের ইলম অর্জনে আগ্রহী হই তাহলে শুধু নিজস্ব পড়াশোনার দ্বারা নয়; বরং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে নিয়ম অনুযায়ী শিখতে হবে এবং নিজস্ব ধারণার উপর তাদের সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে একটি জরুরি বিষয় এই যে, আস্লাফে উম্মত অর্থাৎ সাহাবা, তাবেয়ীন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীন যাঁরা সরাসরি কিংবা এক-দুই সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছাত্র বিশেষত সাহাবায়ে কেরাম যাদের সামনে কুরআন নাযিল হয়েছে এবং কুরআনের বিধান বাস্তবায়িত হয়েছে, তাদের দ্বীনদারী ও আমানতদারী সম্পর্কে অমুসলিমদেরও কোনো সংশয় নেই। আর কুরআন-সুন্নাহর বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনে তাদের অর্মতদৃষ্টির গভীরতা পরিমাপ করা আমাদের বিশেষজ্ঞদের পক্ষেও সহজ নয়। আমার-আপনার মতো সাধারণ পাঠকের তো প্রশ্নই অবান্তর। কুরআন মজীদের ইরশাদ-
صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ ۙ
মোতাবেক তাঁরাই হেদায়েতের মিনারা। আর তাদের ব্যাপারে আস্থা হারানো সকল গোমরাহীর সূচনা।
‘মতের স্বাধীনতা’র মোহনীয় শ্লোগানের আড়ালে আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থা এখানেই প্রথম আঘাত হেনেছে। পূর্বসূরীদের প্রতি ভক্তি ও আস্থা আমাদের অমূল্য সম্পদ। এটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে দ্বীনের স্বীকৃত ও সর্বসম্মত বিষয়গুলোতে সন্দেহ করা হচ্ছে। আমরা গবেষণার নামে পূর্বসূরীদের মত ও পথ পরিত্যাগ করে শুধু সংশয়ের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি।
যেসব বিষয়ে পূর্বসূরীদের মতভেদ রয়েছে সেখানে ইলম ও তাকওয়ার বিচারে যাকে আপনার অগ্রগণ্য মনে হয়, তাকে অনুসরণ করতে আপত্তি নেই কিন্তু অন্য মত পোষণকারীর প্রতি সামান্যতম বেআদবীও দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে যাবে।
কুরআন মজীদের ঘোষণা অনুযায়ী সর্বশেষ শ্রেণীর মুমিনদেরও বৈশিষ্ট্য এই যে, পূর্বসূরীদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসে তাদের অন্তর পরিপূর্ণ থাকবে। ইরশাদ হয়েছে : (তরজমা) ‘এবং যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, পরওয়ার দেগার! আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের ওই ভাইদেরকেও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছেন। আর আমাদের অন্তরে যেন না থাকে মুমিনদের সম্পর্কে কোনো বিদ্বেষ।’
মোটকথা, পূর্বসূরীদের প্রতি আস্থা ও ভালোবাসা হচ্ছে এমন এক রক্ষাকবচ যা আমাদেরকে চিন্তা ও জ্ঞানের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করতে পারে। একে সৌভাগ্যের বিষয় মনে করুন। তাঁদের রচনা ও গবেষণাকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সূত্র হিসেবে গ্রহণ করুন। তাদের সিদ্ধান্তকে নিজের ধারণার চেয়ে অগ্রগণ্য মনে করুন। ইনশাআল্লাহ এটা আমাদের চিন্তাকে ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবে।
যে কথাগুলো আপনাদের সামনে পেশ করেছি এটা মূলত শ্রেষ্ঠ তাবেয়ী হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ.-এর একটি চিঠির সারাংশ এবং আহলে ইলমের জন্য কর্মসূচি।
মতের স্বাধীনতা কিংবা রিসার্চ-গবেষণার আপাতসুন্দর শিরোনামে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা যদি পূর্বসূরীদের প্রতি আস্থা হারাই তাহলে বিশ্বাস করুন এটা হতে অত্যন্ত লোকসানের ব্যবসা।
এতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটিও যেমন আমাদের হাতছাড়া হবে তেমনি আসলাফের অনুসৃত মূল ধারা থেকেও আমরা দূবে সরে যাব।
দ্বিতীয় দুর্বলতা
দ্বিতীয় দুর্বলতা কর্মগত। এটা ওই পরিবেশের কুফল, যা প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। সত্য কথা এই যে, মুসলিম জাতির শক্তির উৎস দু’টি : ১. কুরআনী শিক্ষা। ২. সুন্নতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ। লেনদেন, কৃষ্টি-কালচার, বেশ-ভুষা সকল বিষয়ে ইত্তেবায়ে সুন্নত মুসলিম জাতির সৌভাগ্যের প্রথম শর্ত। মুসলমানের ভালো-মন্দে মাপকাঠি মদীনাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
কিন্তু এই নতুন আবহাওয়া আমাদের চিন্তাধারাকে এমন বিপরীতমুখী করে দিয়েছে যে, আমাদের কাছেও ভালোমন্দের মানদন্ড হয়ে দাড়িয়েছে ইউরোপ ও ইউরোপীয় ‘সভ্যতা’।
এভাবে আমরা মদীনা থেকে বিমুখ হয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স অতঃপর আমেরিকা অভিমুখী হয়ে পড়েছি, যেখানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং নগ্নতা ও অশ্লীলতা ‘সভ্যতা’র দ্বারা সংজ্ঞায়িত এবং মদ্যপান, নাচ-গান ও ভোগ-বিলাস প্রগতিশীলতার অন্তর্ভুক্ত। আমরা শিল্প ও সংস্কৃতির মোহনীয় নামে এমন সব অপরাধকে জাতীয় উন্নতির উপায় সাব্যস্ত করেছি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি-গোষ্ঠীর ধ্বংসের বীজ এগুলোতেই নিহিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক সত্য এই যে, আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক জীবনের ওই ছাঁচেই নির্মাণ করে নিয়েছি যা পশ্চিমা প্রতারক চক্র আমাদের সুপ্ত সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করার জন্য প্রস্ত্ততক করেছিল।
আমাদের সুরতে-সীরাতে এখন মদীনার ছাপ নেই। আছে প্যারিস ও লন্ডনের অন্ধ অনুকরণ।
এই আধুনিক বর্বরতা ঈমানের নূর ও আমলের তাওফীক থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে এবং গুনাহ ও পাপাচারের চোরাবালিতে আটক করে দিয়েছে। অন্যদিকে এই জীবন-ব্যবস্থায় খরচের উর্ধ্বগতি জাতিকে দেউলিয়া বানিয়ে ছেড়েছে। মানুষ যতই উপার্জন করুক, নিত্য পরিবর্তনশীল ফ্যাশন আর কুঠি-বাংলোর নিত্যনতুন সজ্জায় সবই খরকুটোর মতো ভেসে যায়। প্রগতিশীলতার স্বপ্নে বিভোর বন্ধুরা বৈধ উপার্জনের দ্বারা ‘প্রয়োজনীয়’ অপব্যয়গুলো সমাধা করে উঠতে পারেন না। ফলে অফিস-আদালতে ঘুষ ও দুর্নীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ভেজাল ও প্রতারণার সয়লাব অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
আপনারা দেখলেন, শয়তানের এই ‘মিঠাই’ পরিস্থিতিকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার ওই ছিদ্রপথে সকল অপরাধ-নগ্নতা, অশ্লীলতা, দুর্নীতি সবই ধীরে ধীরে ঢুকে পড়েছে।
আজ যখন ইউরোপের প্রতারণাগুলো এক এক করে আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরিয়ে দিয়েছে এবং আমরা পরিষ্কার বুঝেছি যে, তাদের মধ্যে আমাদের কোনো বন্ধু নেই; বরং জাতির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠূুকে দেওয়ার জন্যই তাদের সকল পরিকল্পনা প্রস্ত্তত হয়েছে তো এখনো কি আমাদের সময় হয়নি, ওই সব প্রতারকদের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসার, তাদের ‘সভ্যতা’ তাদের মুখে নিক্ষেপ করে দেওয়ার? এরপর নতুন করে মদীনাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিন্তা ও কর্মের আদর্শরূপে গ্রহণ করার? ইসলামের পরিচ্ছন্ন ও অনাড়ম্বর সহজ-স্বাভাবিক জীবন অবলম্বন করব, যা আমাদের কর্ম ও চরিত্রকেও শুদ্ধ করবে এবং ঈমানী শক্তি আমাদের মধ্যে জাগ্রত করবে? ইউরোপের আবিল ও খরুচে জীবনযাত্রা পরিত্যাগ করে।
আমি জানি এই কাজ দ্বীনী-দুনিয়াবী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল বিবেচনায় আমাদের জন্য যতটা জরুরি ঠিক ততটাই কঠিন। কেননা, গোটা জাতি ওই কলুষিত ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু মসজিদ-মিম্বারের আলোচনায় এই ধারার পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। এখন একটি আন্দোলন প্রয়োজন, যার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত শক্তি আমাদের ছাত্র সমাজ। অন্যদিকে এজন্যও এটা তাদের দায়িত্ব যে, এই নতুন ‘সভ্যতা’র প্রচলনও তাদের মাধ্যমেই আরম্ভ হয়েছিল। অতএব এর মুখ খুরিয়ে দিতে তারাও সহজে সফল হতে পারেন। কাজের সকল যোগ্যতাই আমি তাদের মধ্যে বিদ্যমান দেখছি শুধু একটি বিষয়ের অভাব, যা আমি আলোচনা করেছি। হযরত মাজযূব এর ভাষায়-
اوصاف حسن سب ہيں نہيں سوز عشق محتاج شمع ہے يہ بهرى انجمن ہنوز
সবশেষে দুআ করি, আল্লাহ তাআলা যেন আপনাদেরকে, আমাকে ও সকল মুসলমানকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ও পূর্বসূরীদের সুন্নত মোতাবেক চলার ও অন্যদের অনুকরণ করা থেকে বাঁচার তাওফীক দান করেন আমীন। #