মুহাররম ১৪৩০   ||   জানুয়ারী ২০০৯

সাহাবা-তাবেয়ীন বিদআতকে প্রশ্রয় দিতেন না

ড. মুশতাক আহমদ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবিয়ীর সকলে অভিন্নভাবে যে নীতি মেনে আসছেন সেটি ছিল বিদআতকে প্রশ্রয় না দেওয়া। তাঁরা সুন্নতের উপর আমল করতেন এবং সুন্নতের দাওয়াত দিতেন। পাশাপাশি বিদআত থেকে  বেঁচে থাকতেন। বিদআতের খারাবী বর্ণনা করতেন। তাদের উপরোক্ত সচেতনতার কারণে তাদের যুগ ছিল খাইরুল কুরূন। পরবর্তী সময়ে উম্মতের এ ব্যাপারে সচেতনতা হ্রাস পাওয়ার কারণে শিরক ও বিদআত ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে ।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সাহচর্যের ফলে শিরক ও বিদআত সম্পর্কে সাহাবীগণ অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন।   একটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। তাওয়াফের সময় হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করতে হয়। এটি শরীয়তের হুকুম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে চুম্বন করেছেন। কিন্তু এর মধ্যে তো ভালোমন্দের কোনো ক্ষমতা নেই। শরীয়তের বিধান হিসেবেই চুম্বন করা হয় এক শিশু কেউ যেন এখান থেকে কোনো ভুল ধারণায় পড়ে না যায় এজন্য হযরত উমর রা. সতর্ক করেছেন।

হযরত আবিস ইবনে রাবীযা রাহ. বলেন-আমি দেখেছি, হযরত  উমর ইবনুল খাত্তাব রা. হজরে আসওয়াদ চুম্বন করছেন আর বলছেন, আমি সুনিশ্চিত জানি, তুমি একটি পাথরমাত্র। তোমার মধ্যে না কোনো উপকার করার ক্ষমতা আছে আর না কোনো অপকার করার। যদি আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চুম্বন করতে না দেখতাম তাহলে কষ্মিনকালেও আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। -বুখারী, মুসলিম, সূত্র : আলমুনযিরী, হাদীস ৬৭

তিনি স্পষ্ট নির্দেশ করেন যে, ইট, পাথর, সেটি যদি হজরে আসওয়াদও হয় তবুও তার মধ্যে নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ রাববুল আলামীনের। হ্যাঁ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই পাথরকে চুম্বন করেছেন বিধায় এটি সুন্নত। আর সুন্নতের অনুসরণের মধ্যে বরকত আছে।

হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বৃক্ষের নীচে বসে সাহাবীদের বায়আত নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দেখা গেল লোকেরা বৃক্ষটিকে সম্মান করছে। আমীরুল    মুমিনীন হযরত ওমর রা. বিষয়টি খেয়াল করলেন এবং বৃক্ষটি কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। -মাজালিসুল আবরার পৃ. ১২১

সাহাবীগণ কোথাও বিদআত হলে সেখানে উপস্থিত থাকতেন না। যেন তাদের উপস্থিতিকে অন্যরা দলিল হিসাবে পেশ করার সুযোগ না পায়।

তাবিয়ী হযরত মুজাহিদ রাহ. বলেন, আমি সাহাবী হযরত ইবনে উমর রা.-এর সঙ্গে এক মসজিদে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি যোহর, কিংবা বলেছেন, আছর নামাযের জন্য ডাকাডাকি করছিল। তখন হযরত ইবনে উমর রা. বললেন, এই মসজিদ থেকে বেরিয়ে চল। এখানে বিদআত চলে। -আবু দাউদ হাদীস ৪৫৩

বিদআত পরিহার করে চলা পরহেযগারীর লক্ষণ

বর্তমানে মুসলিম সমাজে নানা ধরনের বিদআত চালু আছে। লোকেরা এগুলোকে নেক আমল হিসাবে করে ধর্মীয় তৃপ্তি লাভ করে। আবার কিছু মানুষ আছেন যারা বিদআত পরিহার করে চলেন। প্রশ্ন হল কোন দল পরহেযগার। গবেষক আলিমগণ বলেন, মুসলিম সমাজে বিদআত চালু হয়ে যাওয়ার পর বর্তমানে মুসলমানরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। এক শ্রেণী যারা বিদআত করে ও বিদআতের সমর্থক। অপর শ্রেণী যারা বিদআত পরিহার করে চলে ও প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে শেষোক্ত শ্রেণী ভালো। শেষোক্ত শ্রেণী পরহেযগার। কেননা, সাহাবা ও তাবেয়ীনের জীবনাদর্শ এই শেষোক্ত শ্রেণীর সঙ্গেই মিলে।

শেষ যমানায় মুসলিম সমাজে যখন নানা রকমের অনৈসলামিক কাজকর্ম ও বিদআত ছড়িয়ে পড়বে তখন যে মুসলমান এগুলো থেকে বেঁচে থাকবে, এবং  প্রতিরোধ করবে তাদের ছওয়াব ও পুরস্কার অপরিসীম। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, হযরত আবু সালাবা রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সম্মুখে এমন যুগ আসবে যখন সবর করা ছাড়া মুমিনের জন্য আর কোনো পথ থাকবে না। আর যে সবর করবে তার অবস্থা হবে হাতের তালুর উপর জ্বলন্ত অঙ্গার ধারণকারীর ন্যায়। সে যুগে যে ব্যক্তি শরীয়ত ও সুনাতের উপর নিজের আমল পূর্ণাঙ্গ রাখবে তাকে দেওয়া হবে  পঞ্চাশ জন আমলকারীর ছওয়াব। সাহাবীগণ বললেন-ইয়া রাসূলুল্লাহ ! তাদেরই পঞ্চাশ জনের সমপরিমাণ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। বরং তোমাদের (সাহাবীদের) পঞ্চাশ জনের সমপরিমাণ ছওয়াব প্রদান করা হবে। -তিরমিযী, ইবনে মাজা, মিশকাত পৃ. ৪৩৭

মোল্লা আলী কারী রাহ. লিখেছেন,সাহাবীগণের সাহাবী হওয়ার কারণে সকল উম্মতের উপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা বেশি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি তাদের সাধারণ মর্যাদা। কিন্তু শেষ যামানার কোনো কোনো উম্মতকে পঞ্চাশ সাহাবীর ছওয়াব প্রদান এটি একটি বিশেষ মর্যাদা ও ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমের কারণে সাহাবীগণের সাধারণ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুণ্ণ হয় না।

যারা বিদআত পরিহার করে চলে ও বিদআতের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন তাদের অল্প কাজেরও প্রতিদান অনেক।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন (হে আমার সাহাবীগণ) তোমরা এমন যুগে বাস করছ যে, তোমাদের কেউ (সৎকাজের আদেশ দান  ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার) এই বিধান থেকে যদি দশভাগের একভাগও ছেড়ে দেয় তাহলে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে তোমাদের পরে আসবে আরেক যুগ যখন তাদের কেউ ঐ বিধানের দশভাগের একভাগও পালন করবে সে নাজাত পেয়ে যাবে। -তিরমিযী, মিশকাত ৩১

উল্লেখ্য, সাহাবা যুগ ছিল ইসলামের উত্থানের যুগ।  চতুর্দিকে সকল উপকরণ ছিল উত্থানের পক্ষে। পক্ষান্তরে পরবর্তী যুগগুলো ইসলামের পতনের যুগ। চতুর্দিকের সকল উপকরণ পতনের পক্ষে। এমন যুগে শিরক ও বিদআতের বিপক্ষে কাজ করার অর্থ হল স্রোতের বিপরীতে অবস্থান করা। এ কারণে তাদের সাধ্যের মধ্যে আদেশ নিষেধও নাজাত প্রাপ্তির পক্ষে যথেষ্ট হবে। #

 

 

advertisement