মুহাররম ১৪৩০   ||   জানুয়ারী ২০০৯

তালেবান ও আলকায়েদা : একটি হাসির ঘটনা

ইসহাক ওবায়দী

এক ছেলে মুদি দোকানে গিয়ে দোকানদারের কাছে সুতা চাইল। দোকানদার তাকে ভালো একটি সুতোর বান্ডিল দিল। ছেলেটি বলল, হাতুড়ি মার্কা সুতা দিন। দোকানদার তাকে বুঝিয়ে বলল যে, এই সুতা খুব ভালো,  টেকসই, কিন্তু ছেলেটি তার কথায় কান দিল না। সে বলল, না আমাকে হাতুড়ি মার্কা সুতাই দিন। হাতুড়ি মার্কা সুতাই একমাত্র মজবুত ও টেকসই সুতা।

ছেলেটির এ অবস্থা কেন হয়েছে নিশ্চয়ই পাঠক তা বুঝতে পেরেছেন। পত্র-পত্রিকাসহ রেডিও-টেলিভিশনে সে সারাক্ষণ হাতুড়ি মার্কা সুতা সম্পর্কেই প্রচারণা শুনেছে ও দেখেছে। এই প্রচারণায় তার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে, হাতুড়ি মার্কা সুতাই একমাত্র মজবুত ও টেকসই সুতা।

নিম্নমানের কোনো পণ্যও প্রচারণার ফলে বাজার মাত করা পণ্যে রূপান্তরিত হয়ে যায়। অথচ পণ্যটির গুণগত মান ততোটা ভালো নয়। তার গুণ-কীর্তনের কথা ভোক্তাদের কানে বা চোখে বারবার পড়ার কারণে ভোক্তারা ঐ পণ্যটি ছাড়া অন্য কোনো পণ্য হাত লাগিয়ে দেখতেও রাজি হয় না। এটা শুধু প্রচারেরই কারিশমা।

বর্তমান যুগ প্রচার-প্রচারণার যুগ। অখ্যাত-কুখ্যাত কোনো বিষয়ও যদি প্রচারণায় একবার স্থান পেয়ে যায়, বাস, আর কিছু লাগবে না। বিশ্বব্যাপী তা নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যাবে। ইদানীং বিশ্ব মিডিয়ার বদৌলতে রয়টার্স, এএফপিসহ ইঙ্গ-মার্কিন ইহুদী-খৃষ্টান প্রচারণার কারণে তালেবান ও জিহাদ শব্দ দুটির ব্যাপারে সমগ্র বিশ্বেই মারাত্মক এক আতংক বিরাজ করছে। ইউরোপ-আমেরিকা তো বটেই আমাদের এসব অনুন্নত দেশগুলোতেও আতংকের শেষ নেই। বিষয়টি বাস্তবে যতোটা, প্রচারণার ফলে শতগুণ বেশি তাকে মনে  করা হচ্ছে। আবার ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবেও এ সকল নামের কিছু ভুয়া সংগঠন সৃষ্টি করা হয়েছে।  ইসলাম অশান্তি ও অরাজকতাকে কোনো দিন অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা বসে নেই। তারা নিজেদের তৈরি লোকদেরকে দিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করে। এরপর তল্লাশির নামে তাদের উদ্দিষ্ট শ্রেণীতে ফাঁসিয়ে দেয়। ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের কওমী মাদরাসাগুলোকেই  সেসবের প্রধান ঘাটি ও কারখানা রূপে চিহ্নিত করতে মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের আসল উদ্দেশ্য তালেবান-টালেবান কিছুই নয়, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, উপমহাদেশে পরিচালিত ইসলামী শিক্ষার সনাতনী দুর্গ এসব কওমী মাদরাসাগুলোকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া। তাই কদিন পর পরই অনেক  মাদরাসায় তদন্তের নামে তাদের কোনো এজেন্ট গিয়ে উপস্থিত হয়।

এমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাদরাসা চট্টগ্রামের জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ায়। মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম জনাব মাওলানা আবদুল হালীম বোখারী সাহেব কিছুদিন আগে ওসমানী মিলনায়তনে আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী এক সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, তালেবান, হরকত ও আল কায়েদা শব্দগুলো ভিন্ন কিছু অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যা আমাদের মিডিয়া জগত ও বিদেশী ভাইয়েরা মোটেও খবর রাখেন না। তারই একটি হাস্যকর ঘটনা ঘটে আমাদের মাদরাসায়। কিছুদিন আগে আমাকে খবর দেওয়া হল যে, মাদরাসায় একজন বিদেশী মেহমান এসেছেন, আপনার অপেক্ষায় আছেন। আমি মেহমানখানায় সাক্ষাত করার জন্য গেলাম। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, এখানে তালেবান আছে? আমি বললাম, অবশ্যই আছে। তিনি তো হতচকিত হয়ে গেলেন এবং বললেন, কতজন আছে? আমি বললাম, প্রায় তিন হাজারের মতো। এতো সংখ্যা শুনে তিনি আরো চমকে গেলেন এবং বললেন, তাদের কাজ কী? আমি বললাম, কায়দা বোগদাদী থেকে নিয়ে ইসলামী শিক্ষার শেষ স্তর পর্যন্ত পড়া। মেহমান এবার আরো চমকে গেলেন এবং প্রশ্ন করলেন, তাহলে এখানে আলকায়েদাও আছে? আমি বললাম, জ্বী হাঁ, অবশ্যই আছে। আলকায়েদার কাজ কী? আমি বললাম, হরকত ও শব্দ শিক্ষা দেওয়া। তিনি এবার আরো চমকে গেলেন এবং বললেন, তাহলে এখানে হরকতও আছে? আমি বললাম, জ্বি, অবশ্যই।  হরকত-সাকিন ও তাশদীদ সবই এখানে আছে। কথাবার্তার ফাকে তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে, ছাত্রদেরকে ফার্সী ভাষায় তালেবান বলা হয় আর তাদের পাঠ্যতালিকায় সর্বপ্রথম যে বইটি পড়ানো হয় তার নাম কায়েদা বোগদাদী। আর কায়েদা বোগদাদীর পাঠ শুরু হয় যের, যবর ইত্যাদি দিয়ে যাকে আরবীতে হরকত বলা হয়। তিনি তখন হাসতে লাগলেন। এই হল আমাদের মিডিয়া ও বিদেশী ভাইয়ের অবস্থা। তাদেরকে হয়তো শত্রুরা বলে দিয়েছে যে, এ সকল মাদরাসায় প্রচুর তালেবান রয়েছে। তারা তাই বারবার তদন্ত করতে বিভিন্ন মাদরাসায় যাতায়াত শুরু করে দেয়।  আর মাদরাসায় তালেবান (ছাত্র) থাকবে না তো থাকবেটা কী? এখন কেউ যদি এ সব না বুঝে বলে দেয় যে, এখানে আফগান  মুজাহিদ তালেবান আছে এবং আরব মুজাহিদ আলকায়েদা ও তাদের সমর্থক হরকত ইত্যাদি রয়েছে তাহলে এটাকে গাঁজাখুরি ছাড়া আর কী বলা যবে?

আমাদের কওমী মাদরাসাগুলো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ। খাঁটি ইসলামের শিক্ষাগার ছাড়া আর কিছুই নয়। এখানে সন্ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টি করার মতো কোনো যুদ্ধাস্ত্র রাখা বা তার প্রশিক্ষণ দেওয়া কস্মিনকালেও হয়নি। এবং এসবের সুযোগই নেই। শুধু শুধু হয়রানি করা ও পেরেশান করার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরাই দেশী-বিদেশী মিডিয়াতে এসকল মাদরাসার বিরুদ্ধে নানা কল্প-কাহিনী প্রচার করে বেড়াচ্ছে।

আফগান মুজাহিদ তালেবানদেরকে যদি কেউ সমর্থন করে সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতার সুফলেই হতে পারে। যে কেউ তা করতে পারে। কিন্তু তাই বলে এখানে শান্তিপূর্ণ একটি দেশে বিভিন্ন নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার মতো সংগঠন সৃষ্টি করা কোনো বিবেকবান ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা হচ্ছেন এ দেশের সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার অতন্দ্রপ্রহরী। তারা যুগে যুগে ইসলামের জন্য যেমন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন অকাতরে, ঠিক তেমনি দেশের জন্যও তাদের চেয়ে বেশি ত্যাগ ও কোরবানী আর কেউ দিতে পরেনি। বৃটিশ যুদ্ধে দীর্ঘ দুশ বছরের ইতিহাস এ কথাই বলে। এটাই সত্যিকার ইতিহাস। আল্লাহ সকলকে বোঝার তৌফিক দিন। আমীন। #

 

 

advertisement