রবিউল আউয়াল ১৪৩১   ||   মার্চ ২০১০

নারী নির্যাতনঃ নির্যাতনের কবল থেকে নারীদের কে রক্ষা করবে?

আমাদের দেশের সামাজিক পরিস্থিতি কখনো ভালো থাকে না। সন্ত্রাস, হত্যা, নির্যাতন সব সময় চলতেই থাকে। কখনো মাত্রা কমে, কখনো বাড়ে। ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হলে জনগণ কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়, অন্যথায় এই পরিবেশেই তারা অভ্যস্ত। তবে যারা ভুক্তভোগী তাদের জন্য সন্ত্রাসের মাত্রা বাড়া-কমায় কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্যটা উপলব্ধি করেন যারা ভুক্তভোগী নয় তারা। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদগণও যেহেতু এদেশেরই সন্তান, এদেশের আলো-বাতাস গ্রহণ করেই তাদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ঘটেছে তাই তারাও সহজে উদ্বিগ্ন হন না। চরম অরাজক অবস্থায়ও নিরুদ্বিগ্নভাবে বলতে পারেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।’ অর্থাৎ এ দেশের জন্য এটাই তো স্বাভাবিক! তাছাড়া পরিস্থিতির যতই অবনতি ঘটুক তাদের তো কেশাগ্রও বাঁকা হচ্ছে না। এদেশের আরেকটি শ্রেণী হচ্ছে ‘সুশীল সমাজ।’ যারা বিভিন্ন টিভি-চ্যানেলে টক শো করেন, মাঝে মাঝে অভিজাত হোটেলে সেমিনার করেন এবং পত্রিকার পাতায় লেখালেখি করেন। তারাও এদেশের নাগরিক, তবে তাদের একটি নিজস্ব বলয় আছে, সেই বলয়ের ভিতর ‘প্রবাসী’ জীবন যাপন করেন। এজন্য দেশের নাগরিকদের চেয়ে তারা বিভিন্ন ‘দাতা-দেশের’ অধিকতর নিকটবর্তী এবং দেশের বাস্তব সংকট ও সম্ভাবনার চেয়ে দাতাদের এজেণ্ডা বাস্তবায়নে অধিক আগ্রহী। তাই তাদের কর্ম-তৎপরতার নির্ধারিত মৌসুম রয়েছে এবং তা উর্ধ্বতন সূত্র থেকেই নির্ধারিত হয়।

এদেশের তৃতীয় শ্রেণীটি বাস্তবিকপক্ষেই ‘তৃতীয় বিশ্বে’র প্রতিনিধি। এরা পরিস্থিতির শিকার হয় এবং এদের দুঃখ-দুর্দশা কখনো শেষ হয় না। রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত এদের অশ্রু ঝরে এবং রক্ত ঝরে। এদের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কেউ কাজ করে না। এরা নিহত হলেও কারো কপালে ভাঁজ পড়ে না। সম্মান ও সম্ভ্রম হারালেও কারো কিছু যায় আসে না। আমাদের দেশে বেশ কিছু নারীবাদী সংগঠন আছে, তবে নারীর চেয়ে, ‘নারীবাদ’ তাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সকল নারী তাদের সহানুভূতির উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না।
দেশে এখন নারী-নির্যাতনের হার যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা কোনো বিবেকবান মানুষ বরদাশত করতে পারেন না। প্রকাশ্য রাস্তায় মায়ের কাছ থেকে স্কুল-পড়ুয়া কন্যাকে ছিনিয়ে নেওয়ার সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ছে একের পর এক হত্যা-ধর্ষণ ও প্রতারণার মর্মান্তিক সব খবর। ইদানীং একটি নতুন বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নেকাব ও বোরকা পরিহিতা মেয়েরা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পাইকারিভাবে তাদেরকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থক বলে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ সকল দাড়ি-টুপিওয়ালা যেমন ওই দলের কর্মী-সমর্থক নয় তেমনি সকল বোরকা পরিহিতা মেয়েও তাদের অনুসারী নয়। আর প্রকৃতপক্ষেই কেউ সে দলের কর্মী বা সমর্থক হলেও সুনির্দিষ্টি ও সুপ্রমাণিত অপরাধ ছাড়া অন্যায়ভাবে কাউকে হয়রানী ও নির্যাতন করার অবকাশ নেই। শুধু রাজনৈতিক বা দলীয় আক্রোশের কারণে নিরপরাধ মেয়েদের প্রতি নির্যাতন চালানোর মতো ন্যাক্কারজনক বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যেসব সংগঠন নারীর অধিকার রক্ষার ঠিকাদার হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করে থাকে তাদেরকে টুঁ শব্দটি করতে দেখা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক সকল পর্যায়ে নারী-নির্যাতনের অবসানের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা কর্তব্য। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বস্তরে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া এই জাহেলী বর্বরতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার এবং সমাজের সকল স্তরে আল্লাহ-ভীতি ও আখিরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টির সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করা ছাড়া এই অন্ধকার থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ নেই।

 

advertisement