মেহরে নবুওয়ত
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৮) রোম-সম্রাটের উপাধী হল কায়সার। সে সময় হিরাকল ছিল রোমের কায়সার। তিনি প্রথমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্পর্কে জানলেন এবং দরবারের লোকদেরকে বললেন, আমাদের ইসলাম গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু যখন দেখলেন যে, তারা এ প্রস্তাব মানছে না এবং তাদের বিদ্রোহী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন।
কায়সার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে যেভাবে অবগত হয়েছিল তার বিবরণ এই যে, তিনি আদেশ দিলেন, মক্কার কোনো মুসাফিরকে যদি শামে পাওয়া যায় তবে তাকে যেন দরবারে হাজির করা হয়। ঘটনাচক্রে সে সময় মক্কাবাসীদের নেতা আবু সুফিয়ান শামে অবস্থান করছিলেন। তিনি তখনও মুসলমান হননি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘোরতর দুশমন ছিলেন।
কায়সারের সঙ্গে তার কথোপকথনের বিবরণ তিনি নিজেই প্রদান করেন যে, আমাকে ‘ইলিয়া’ শহরে নিয়ে যাওয়া হল। দরবার গমগম করছিল। কায়সার মুকুট মাথায় সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। হিরাকল দোভাষীকে বলল, এদের জিজ্ঞাসা কর, কে এদের মধ্যে বংশের দিক থেকে ওই ব্যক্তির নিকটবর্তী যিনি নবুওয়ত দাবি করেছেন?
আবু সুফিয়ান : আমি। কেননা ওই কাফেলায় আব্দে মানাফ গোত্রের কেউ ছিল না।
হিরাকল : তোমাদের মধ্যে কী ধরনের সম্বন্ধ?
: তিনি আমার চাচাতো ভাই।
: তাকে সামনে আসতে বল এবং তার সঙ্গীদেরকে তার পিছনে দাড়াতে বল। আমি তাকে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করব। তার সঙ্গীদের বল, সে যদি মিথ্যা বলে তাহলে যেন তারা তা প্রকাশ করে। আবু সুফিয়ান বলেন, সঙ্গীরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে-এ আশংকায় আমি সত্য বললাম। তা না হলে অনেক কথা বানিয়ে বলতাম।
: তাঁর নসব কেমন?
: তিনি অভিজাত বংশে এসেছেন।
: তার পূর্বে কি অন্য কেউ এ ধরনের দাবি করেছিল?
: জ্বী না।
: তার ব্যাপারে মিথ্যা বলার অভিযোগ রয়েছে?
: জ্বী না।
: তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ বাদশাহ ছিল?
: জ্বী না।
: সমাজের ধনাঢ্য ও ক্ষমতাশালী শ্রেণী তার আহবান গ্রহণ করছে, না দুর্বল শ্রেণী?
: দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণী।
: তার অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে না হ্রাস পাচ্ছে?
: বেড়ে চলেছে।
: তার দ্বীন গ্রহণ করার পর সেই দ্বীনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কেউ তা পরিত্যাগ করেছে?
: জ্বী না।
: তিনি কি অঙ্গিকার ভঙ্গ করেন?
: জ্বী না। তবে বর্তমানে তার ও আমাদের মাঝে একটি সন্ধি চুক্তি হয়েছে। এ বিষয়ে সে কী করবে তা আমাদের জানা নেই। আবু সুফিয়ান বলেন, শুধু এই কথাটুকু ছাড়া আমি তার সম্পর্কে এমন কিছুই বলতে পারিনি, যা তার মর্যাদাকে খাটো করে অথচ সঙ্গীরাও আমাকে মিথ্যাবাদী বলার সুযোগ না পায়।
: কখনও কি তাঁর ও তোমাদের মধ্যে লড়াই হয়েছে?
: জ্বী হাঁ।
: ফলাফল কী হয়েছে?
: কখনও তিনি জয়লাভ করেছেন, কখনও আমরা।
: তিনি কী শিক্ষা দিয়ে থাকেন?
: তিনি বলেন, এক আল্লাহর ইবাদত করবে, কাউকে তাঁর সঙ্গে শরীক করবে না। বাপ-দাদার ঠাকুর-দেবতার পূজা করবে না। ছদকা করবে, মুত্তাকী-পরহেযগার থাকবে, অঙ্গীকার পূর্ণ করবে, আমানতে খেয়ানত করবে না।
কায়সার দোভাষীকে বললেন, তাকে বল:
তুমি বলেছ, ‘তিনি বংশীয় আভিজাত্যের অধিকারী’। নিঃসন্দেহে আল্লাহর নবীগণ উত্তম বংশেই এসে থাকেন।
তুমি বলেছ, ‘তাঁর পূর্বে কেউ এমন দাবি করেনি।’ যদি কেউ ইতোপূর্বে এমন দাবি করত তাহলে বলা যেত, তিনি ওই ব্যক্তির অনুকরণ করছেন।
তুমি বলেছ, ‘নবুওয়ত দাবি করার আগ পর্যন্ত কেউ তাকে মিথ্যা বলতে দেখেনি।’ তাহলে এটা কীভাবে হতে পারে যে, যে ব্যক্তি কোনো মানুষের ব্যাপারে কখনও মিথ্যা বলেননি তিনি আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবেন?
তুমি বলেছ, ‘তাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ বাদশাহ ছিল না।’ যদি থাকত তবে আমি বুঝতাম তিনি এইভাবে বাপ-দাদার বাদশাহী পুনরুদ্ধার করতে চান।
তুমি বলেছ, ‘তাঁর ধর্মে গরীব-অসহায় লোকেরাই বেশি প্রবেশ করছে।’ নিঃসন্দেহে এমন লোকেরাই প্রথমে নবীদের দাওয়াত গ্রহণ করে থাকে।
তুমি বলেছ, ‘মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
নিঃসন্দেহে ঈমানের প্রভাব এমনই হয়ে থাকে যে, তা দিন দিন প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
তুমি বলেছ, ‘কেউ তার দ্বীনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে দ্বীন পরিত্যাগ করেনি।’ নিঃসন্দেহে ঈমানের বৈশিষ্ট্যই এই যে, যখন তা অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে তো সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না।
তুমি বলেছ, ‘লড়াইয়ে কখনও তিনি বিজয়ী হয়েছেন, কখনও তোমরা।’ জেনে রেখো, নবীদেরকেও আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় নবীরই হয়ে থাকে।
তুমি বলেছ, ‘তিনি এক আল্লাহর ইবাদত করার এবং শিরক না করার আদেশ দিয়ে থাকেন। তিনি বাপ-দাদার মিথ্যা উপাস্যকে পরিত্যাগ করতে বলেন। নামায আদায় করতে, সততা রক্ষা করতে, তাকওয়া-পরহেযগারী অবলম্বন করতে, অঙ্গীকার পূরণ করতে এবং আমানত রক্ষা করতে বলেন। জেনে রেখো, এগুলোই নবীদের শিক্ষা।
এরপর কায়সার বললেন, আমার জানা ছিল, একজন নবীর আবির্ভাব হবে কিন্তু এই ধারণা ছিল না যে, তিনি আরব দেশে আবির্ভূত হবেন। শুনে রাখো, যদি তোমার কথা সত্য হয় তবে এই স্থানেরও মালিক তিনি একদিন হবেন। আহা! আমি যদি তাঁর কাছে পৌঁছতে পারতাম! আহা! যদি তাঁর পদযুগল ধুয়ে দেওয়ার সৌভাগ্য আমি লাভ করতাম!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)