অনাহূত ভাবনা ও তার প্রতিকার
অনাহূত চিন্তা-ভাবনার চিকিৎসা হল ভ্রুক্ষেপ না করা
হযরত থানভী রাহ. এক মালফূযে একটি ব্যাপক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। মানুষের মনে বিভিন্ন মন্দ ভাবনা আসে। কখনও এমনসব অবাঞ্ছিত চিন্তাও তার মনে উদয় হয় যে, ঈমান সম্পর্কেই সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যায়। সম্ভবত এমন কোনো মানুষ নেই, যার মনে এ ধরনের চিন্তা কখনই আসে না। সবার মনেই তা আসে এবং এর কারণে মানুষ পেরেশান হয়। বিশেষত যে ব্যক্তি দ্বীনের পথে চলার ইচ্ছা করেছে এবং চলতে আরম্ভ করেছে তার মনে এ ধরনের চিন্তা খুব বেশি আসে।
অন্যদিকে দ্বীনদারীর দিকে যাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সারা দিন দুনিয়াবী কাজকর্মে মগ্ন, গুনাহর কাজে লিপ্ত তাদের মনে এই সব চিন্তা আসে না। এগুলো তাদের মনেই আসে যারা আল্লাহর রাস্তায় চলতে আরম্ভ করেছে। কোনো কোনো চিন্তা তো এতই ভয়াবহ যে, মানুষ তার ঈমানের ব্যাপারেও আশংকায় পড়ে যায়। কখনও আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে প্রশ্ন-সংশয় আসে, কখনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, কখনও কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ সম্পর্কে, কখনও বা শরীয়তের বিধিবিধান সম্পর্কে। এ সময় সঠিক নির্দেশনা না পেলে গোমরাহীর মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন।
ওই দিকে ভ্রুক্ষেপ করবেন না
হযরত রাহ. বলেন, এ সমস্যার সমাধান হল ভ্রুক্ষেপহীনতা। মন্দ চিন্তা যদি আসে তবে আসুক। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই। এই চিন্তাই করবেন না যে, কী চিন্তা আসছে আর কী যাচ্ছে।
এই সব চিন্তাও ঈমানের আলামত
এখানে মনে রাখতে হবে যে, এই সব অবাঞ্ছিত চিন্তাও ঈমানের আলামত। হাদীস শরীফে এসেছে, এক সাহাবী হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আল্লাহর রাসূল! অনেক সময় আমার মনে এমন সব কথা আসে, যা মুখে উচ্চারণ করার চেয়ে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়াও আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়। আমি কী করতে পারি? দেখুন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী জওয়াব দিলেন! তিনি বললেন-‘এটা তো খাঁটি ঈমানের আলামত।’ (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, বাবু বয়ানিল ওয়াসওয়াসা ফিল ঈমান)
অর্থাৎ এই সব অবাঞ্ছিত চিন্তা তো ঈমানের চিহ্ন। কেননা, এসব চিন্তা শুধু মুমিনের মনেই আসে, পাপাচারীর মনে আসে না।
চোর ওই ঘরেই সিঁধ কাটে যাতে ধন-সম্পদ আছে
হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, চোর ওই গেরস্তের বাড়িতেই যায় যার মালদৌলত আছে। যে ঘরে কিছু নেই সেখানে চোর কেন যাবে? তো এই চোরও (শয়তান) ওই অন্তরেই কুমন্ত্রণা দেয় যাতে ঈমানের দৌলত আছে। অন্তরে যদি আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান না থাকত তাহলে শয়তানের সেখানে যাওয়ার ও কুমন্ত্রণা দেওয়ার প্রয়োজনই হত না। এজন্য এইসব অনাহূত চিন্তা যখন মনে আসে তো প্রথম কর্তব্য হল আল্লাহর শোকর গোযারী করা যে, আলহামদুলিল্লাহ, আমার অন্তরে ঈমান আছে। তা না হলে এই সব চিন্তা আমার মনে সৃষ্টি হত না।
মন্দ চিন্তায় উদ্বিগ্ন হওয়া ঈমানের আলামত
এটা ঈমানের লক্ষণ এই ভাবেও যে, আপনার মনে এই সব কথা আসলে আপনি উদ্বিগ্ন হন। আপনার কাছে এগুলো মন্দ চিন্তা বলে মনে হয়। ভেবে দেখুন, অন্তরে যদি ঈমান না থাকত তাহলে কি আপনি উদ্বিগ্ন হতেন না কিংবা একে মন্দ বলে মনে করতেন? বোঝা গেল যে, অন্তরে ঈমানের দৌলত রয়েছে।
মন্দ চিন্তা কেন আসে
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে সান্তনাবাণী শুনিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা) আর যদি শয়তানের প্ররোচনা তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে আল্লাহর শরণাপন্ন হও। -সূরা আ‘রাফ ২০০
অর্থাৎ শয়তানের পক্ষ হতে যে সব মন্দ ভাবনা সৃষ্টি হয় এগুলো প্রকৃতপক্ষে শয়তানের কুমন্ত্রণা। এভাবে সে মুমিনদেরকে পেরেশানীতে ফেলতে চায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, এই কুমন্ত্রণা মুমিনদের চুল পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। এজন্য এইসব অনাহূত ভাবনা যখন আপনাকে বিরক্ত করে তখন স্মরণ করুন যে, এটা ঈমানের আলামত। শয়তান তার উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। তাকে বলে দিন, ঠিক আছে তুমি তোমারা মতো চেষ্টা কর, আমিও আমার মতো চেষ্টা করছি। এরপর নিজ কাজে মগ্ন হয়ে যান। এদিকে বেশি মনোযোগ দিবেন না। কেননা, এইসব অবাঞ্ছিত চিন্তাকে গুরুত্ব দিয়ে কীভাবে তা দূর করা যায় এ চিন্তায় পড়ে গেলে আপনি এখানেই আটকা পড়ে যাবেন। সামনে অগ্রসর হওয়া আর সম্ভব হবে না। এভাবে শয়তানের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাবে।
একটি দৃষ্টান্ত
হযরত থানভী রাহ. একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বিষয়টা বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, ধর, কারো কাছে বাদশাহের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ এসেছে যে, অমুক সময় দরবারে উপস্থিত হবে। তোমাকে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হবে এবং পুরষ্কৃত করা হবে। আমন্ত্রিত ব্যক্তি প্রস্ত্তত হয়ে দরবারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। পথিমধ্যে দুটি কুকুর রাস্তার দুই পার্শ্বে দাড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। এখন তার কী করা উচিত? যথাসময়ে দরবারে পৌঁছার জন্য কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত পথ চলা উচিত, না ওই কুকুরগুলোর চিৎকার বন্ধ করার চেষ্টায় লেগে যাওয়া উচিত? বুদ্ধিমানের কাজ কী হবে? যদি সে কুকুর তাড়ানোর জন্য সেগুলোর পিছনে পিছনে ছুটতে থাকে তাহলে তো সময়মতো দরবারে পৌঁছা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এজন্য বুদ্ধিমানের কাজ এটাই যে, কুকুরগুলো চিৎকার করতে থাকুক, তুমি যেখানে যেতে মনস্থ করেছ সেখানে কীভাবে দ্রুত পৌঁছা যায় সেই চিন্তা কর। তুমি যদি কুকুরের চিৎকার থামানোর চিন্তায় পড়ে যাও তাহলে দরবারে পৌঁছার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
একইভাবে তোমরা যে ইবাদত করছ এটা হল আল্লাহর দরবারে উপস্থিতি। এই সৌভাগ্যের মুহূর্তে যেসব বিক্ষিপ্ত ভাবনা তোমার অন্তরে সৃষ্টি হচ্ছে এগুলো হল কুকুরের চিৎকার। যদি তোমরা সেদিকে মনোযোগ দাও এবং তা দূর করার চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড় তাহলে শয়তানের উদ্দেশ্য হাসিল হবে আর তোমরা সাক্ষাতের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হবে।
নিজ কাজে মশগুল থাকুন
এজন্য এই সমস্যার সমাধান হল, ভ্রুক্ষেপ না করা। অর্থাৎ কী চিন্তা আসল, কী চিন্তা গেল-তা না ভেবে নিজের কাজে মশগুল থাকুন। যেমন এখন আপনার নামায পড়ার সময়, আপনার মনে যে ভাবনাই আসুক আপনি নামাযে মশগুল হয়ে যান। আপনার এখন তেলাওয়াতের সময়, মনে যত চিন্তাই আসুক আপনি তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে যান। এভাবে অন্য কোনো কাজের সময় হয়ে থাকলে তাতে লেগে যান। মোটকথা, এদেরকে আপনার নির্ধারিত কাজে প্রতিবন্ধক হওয়ার সুযোগ দিবেন না। এটাই সমাধান। তা না করে আপনি যদি চিন্তা দূর করার চিন্তায় পড়ে যান তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
আরেকটি পদ্ধতি
আমার ওয়ালিদ ছাহেব বলতেন, যদি কোথাও অন্ধকার হয়ে আসে তবে তার সমাধান এই নয় যে, তুমি লাঠি নিয়ে অন্ধকার তাড়াতে নেমে পড়বে। কেননা, এভাবে অন্ধকার দূর হবে না। অন্ধকার দূর করার পন্থা এই যে, তুমি একটি বাতি জ্বালিয়ে দাও। বাতির আলো যেখানে পৌঁছবে সেখান থেকে অন্ধকার বিদায় নিবে।
মানুষের মনে শয়তানের পক্ষ থেকে যেসব কুচিন্তা, প্রশ্ন-সংশয় সৃষ্টি হয় সেগুলোও এক ধরনের অন্ধকার। একে তাড়ানোর চেষ্টায় লেগে যাওয়া সমাধান নয়; বরং তোমার মন-মস্তিষ্কে আল্লাহর স্মরণের বাতি জ্বালিয়ে দাও। বন্দেগী ও আনুগত্যের চেরাগ জ্বালিয়ে দাও। দেখবে আঁধার দূর হয়ে গেছে।
অন্য চিন্তায় মগ্ন হও
এ ধরনের চিন্তা যদি বেশি আসে তাহলে এর সমাধান হযরত থানভী রাহ. এভাবে দিয়েছেন যে, এ ক্ষেত্রেও তা দূর করার চিন্তা ঠিক নয়। কেননা, যতই দূর করার চেষ্টা করবে ততই তা জোরদার হবে। এ সময় অন্য কাজে মনোনিবেশ কর কিংবা ভিন্ন চিন্তায় মশগুল হও।
দর্শন শাস্ত্রে আছে-মানুষের চিন্তা এক মুহূর্তে দুই বিষয়ে নিবদ্ধ হয় না।
তুমি যদি নিজেকে ভিন্ন কাজে বা ভিন্ন চিন্তায় মশগুল কর তাহলে প্রথম চিন্তা এমনিই দূর হয়ে যাবে।
চিন্তা দূর করার কোনো অযীফা নেই
উপরের আলোচনায় হযরত রাহ. এই কথাটাই বলেছেন যে, ‘অনাহূত ভাবনার সমাধান ভ্রুক্ষেপহীনতা ছাড়া আর কিছু নয়।’ অর্থাৎ এর অন্য কোনো সমাধান নেই। লোকেরা আবেদন করে যে,নানা ধরনের ভাবনা মনে আসে, কোনো অযীফা দিন, যাতে এগুলো দূর হয়। তো হযরত বলছেন যে, এমন কোনো অযীফা নেই। এর একমাত্র সমাধান হল চিন্তা তাড়ানোর চিন্তা না করা।
ঔষধ উদ্দেশ্য নয়, সুস্থতা উদ্দেশ্য তবে
এরপর একটি সূক্ষ্ম কথা বলা হয়েছে। তা এই যে, ‘ভ্রুক্ষেপহীনতাকে মাধ্যম মনে করবে না, একেই মূল কাজ বলে মনে করবে। ভ্রুক্ষেপহীনতার দ্বারা চিন্তা-খেয়াল দূর হোক বা না হোক।’ অর্থাৎ উপরে যে বলা হয়েছে ভ্রুক্ষেপহীনতাই চিন্তা দূর করার উপায়। এর অর্থ এই নয় যে, ভ্রুক্ষেপহীনতা ঔষধের মতো নিছক উপায় মাত্র। দেখুন, মানুষ যখন কোনো রোগের জন্য ঔষধ ব্যবহার করে তখন তার মূল উদ্দেশ্য থাকে আরোগ্য লাভ করা। যেহেতু ঔষধ সেবন আরোগ্য লাভের উপায় তাই অবশ্যই এর গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু তার গুরুত্ব আরোগ্য লাভের উপায় হিসেবেই, উদ্দেশ্য হিসেবে নয়। মূল উদ্দেশ্য তো আরোগ্য লাভ করা। এজন্য ঔষধ সেবনের পর মানুষ সুস্থতার অপেক্ষায় থাকে। একদিন, দুইদিন, তিন দিন ঔষধ সেবনের পরও যদি সুফল না আসে তাহলে মানুষ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়।
এই সমাধান নিছক ঔষধ নয়
হযরত রাহ. বলছেন যে, অনাহূত ভাবনা দূর করার জন্য যে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করা-এটাকে নিছক ঔষধ মনে করবে না। অর্থাৎ এই ব্যবস্থা প্রয়োগের পর চিন্তা দূর হল কি হল না এই অপেক্ষায় না থেকে নিজ কাজে মশগুল থাকবে। মনে রাখতে হবে যে, এটা নিছক মাধ্যম নয়, এটাই মূল কাজ। অতএব একদিন, দুইদিন, তিন দিন এই পন্থা অনুসরণের পরও যদি দেখা যায়, অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না তবুও তা পরিত্যাগ করা যাবে না। চিন্তার সমস্যায় সেদিকে মনোযোগ না দেওয়াই মূল কাজ। অতএব জীবনভর অবাঞ্ছিত চিন্তা থেকে নিষ্কৃতি না পেলেও এই পন্থাই অনুসরণ করে যেতে হবে। চিন্তা আসুক আপনি অন্য দিকে মনোযোগ দিন। আবার আসুক, আবার অন্য চিন্তায়, অন্য কাজে ব্যস্ত হোন। এটাই সমাধান এবং এটাই করণীয়।
মানসিক প্রশান্তি উদ্দেশ্য নয়
এরপর হযরত রাহ. আরেকটি সূক্ষ্ম কথা বলেছেন। তা এই যে, ‘মানসিক প্রশান্তি লাভকে মূল লক্ষ বানাবে না।’ অর্থাৎ এই সব ভাবনা দূর হোক-এটা আপনি কেন কামনা করছেন? মানসিক প্রশান্তির জন্য? এই সব চিন্তা সর্বদা আপনার মন-মস্তিষ্ককে অস্থির করে রাখে, তাই স্থিরতা ও প্রশান্তির জন্য তা থেকে নিস্তার পাওয়া দরকার? এই সম্পর্কে হযরত রাহ.-এর বক্তব্য এই যে, প্রশান্তি লাভকে উদ্দেশ্য বানোনো যাবে না; বরং উদ্দেশ্য এই হবে যে, ওইসব ভাবনা থেকে মনকে মুক্ত করে প্রয়োজনীয় কাজে মনোনিবেশ কর। যদি প্রশান্তি লাভই কাম্য হয় তবে তো মনের চাহিদা পূরণই উদ্দেশ্য হল।
আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকুন
ভ্রুক্ষেপ না করা সত্ত্বেও যদি চিন্তার উৎপাত বন্ধ না হয় তাহলে এই কষ্টের উপরই সন্তুষ্ট থাকুন। কেননা, আপনার সম্পর্কে এটাই আল্লাহর ফয়সালা। এটাই আপনার তাকদীর। আল্লাহ যদি চান, আমি জীবনভর এই অবস্থায় থাকি তবে তো আমার অসন্তুষ্ট হওয়ার উপায় নেই। আমার এই কষ্টভোগই যদি আল্লাহর মর্জি হয় তবে এতেই আমি সন্তুষ্ট। কবি বলেন-
‘না মিলন উত্তম না বিচ্ছেদ। প্রিয় যাতে সন্তুষ্ট, উত্তম তাই।’
আল্লাহ যে হালতে রাখেন তাই আমার জন্য ভালো। অতএব চিন্তা-ভাবনায় জর্জরিত হয়েও আমি খুশি। কবির ভাষায় : তোমার এই এখতিয়ার নেই যে, পরিবেশিত শরবত সম্পর্কে মন্তব্য কর-তা স্বচ্ছ কি ঘোলা; বরং সাকী তোমার পেয়ালায় যা কিছু ঢেলে দিয়েছে তাই তার করুণা।
তাৎপর্য বুঝে আসুক বা না আসুক, কারণ পরিষ্কার হোক বা না হোক আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্বাচন করেছেন তা-ই তাঁর করুণা।
তোমার জন্য এটাই মুনাসিব
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে যে, অমুকের তো এই সমস্যা নেই। সে কত শান্তিতে আছে। অমুক শায়খের সঙ্গে তার সম্পর্ক! আর আমি এই সব অনাহূত ভাবনায় জর্জরিত। এই হালতের জন্য কি আমিই উপযুক্ত ছিলাম? এই অস্থিরতার অনলে আমাকেই কেন দগ্ধ হতে হবে?
মনে রাখতে হবে যে, এটা অস্থিরতা ও ধৈর্য্যহীনতা। ভাই, তোমার সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে এটাই তোমার জন্য উপযোগী আর তার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা তার জন্য উপযোগী। এটাও তাঁর দান, ওইটাও তাঁর দান। তার জন্য ওই অবস্থাটা ভালো, তোমার জন্য তোমার অবস্থা। তুমি যদি এই কষ্টের উপর ধৈর্য্য ধারণ করতে পার তবে আল্লাহর কাছে তোমার কি সমুচ্চ মর্তবা হাসিল হবে তুমি কি তা কল্পনাও করতে পার? অতএব অন্যের দিকে তাকাবে না। তুমি যা পেয়েছ তা তোমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।
আমার পেয়ালায় রয়েছে পানশালার সারাৎসার
আমাদের হযরত ডা. আবদুল হাই ছাহেব রা. একটা পংক্তি পড়তেন-
যার অর্থ : কে কী পেল, কতটা পেল তাতে আমার কী আসে যায়। আমার পেয়ালায় আল্লাহ যা দিয়েছেন আমার জন্য তো এটাই পানশালার সারবস্ত্ত।
সবরের আলাদা ছওয়াব রয়েছে
মোটকথা, নিজের দায়িত্ব পালন করতে থাকুন। আর যেসব ভাবনায় আপনার ইখতিয়ার নেই তাতে মনোযোগ দিয়েন না। আর এ কারণে যে কষ্ট হয় তার সম্পর্কে ভাবুন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। এটা তাঁরই ফয়সালা। তাকদীর। অতএব আমি এতে সন্তুষ্ট। এর ফলাফল এই হবে যে, এই সব চিন্তা আপনার কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না; বরং কষ্টের উপর সবর করার কারণে ছওয়াব পাওয়া যাবে এবং আল্লাহর কাছে মর্তবা বুলন্দ হবে। অতএব এতে সুফলই সুফল, ক্ষতি কিছুমাত্রও নেই।
আপনি যখন ভাববেন যে, আল্লাহ আমার জন্য যা ফয়সালা করেছেন তাতেই আমি রাজি এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট তো ‘রিযা বিলকাযা’ (আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকার) ছওয়াব আপনার আমল নামায় যুক্ত হবে। এছাড়া সবরের ছওয়াব তো আছেই।
দুনিয়াতে তো কষ্ট হয়েই থাকে
দুনিয়াতে মানুষ যতই সাধ্য-সাধনা করুক, যতই যে বাদশাহ-আমীর হোক, পূর্ণ শান্তি কেউ পায় না। কেননা, দুনিয়া পূর্ণ শান্তির স্থানই নয়।
আল্লাহ তাআলা তিনটি জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এক জগত, যেখানে শুধু শান্তি আর শান্তি, দুঃখ-কষ্ট, চিন্তা-পেরেশানী কিছুই নেই। এটা হল জান্নাত। দ্বিতীয় জগত যেখানে শুধু অশান্তি আর অশান্তি, শান্তির লেশমাত্রও নেই। এই জগত জাহান্নাম। আর তৃতীয় জগত হল দুনিয়া, যাতে আমাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। এতে শান্তি যেমন আছে তেমনি অশান্তিও আছে। সুখের সঙ্গে দুঃখ আছে। এখানে কোনো আনন্দই নিরঙ্কুশ নয়, বিপদের কাঁটা তার সঙ্গে যুক্ত আছে। অতএব কেউ যদি কামনা করে, আমি শুধু শান্তিই পাব, দুঃখ ও পেরেশানী যেন আমাকে স্পর্শ না করে তবে তা কখনও পূরণ হবে না। যত বড় পুঁজিপতি হোক, শাসক হোক, সম্পদশালী হোক, জ্ঞানী-গুণী হোক, আলিম-ফাযিল হোক তাকে জিজ্ঞাসা করুন, কখনোই কি কোনো কষ্ট তোমার হয়নি? তার পক্ষে না বলা কখনো সম্ভব হবে না। অবশ্যই কোনো না কোনো কষ্টের স্বাদ তাকে আস্বাদন করতে হয়েছে।
অতএব এই দুনিয়াতে কষ্ট ভোগ করতেই হবে। এখন ইচ্ছা হলে এতে সবরও করা যায়, ইচ্ছে হলে বেছবরীও করা যায়। বান্দা যদি আল্লাহর ফয়সালায় এই বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে যে, যে কষ্ট তাঁর পক্ষ থেকে এসেছে আমি তাতে রাজি। তাহলে সে আল্লাহ তাআলার শুভ সংবাদকে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা) ‘নিশ্চয়ই সবরকারীদেরকে দেওয়া হবে অগণিত বিনিময়।’
এজন্য এই পৃথিবীতে যত শান্তি ‘রিযা বিলকাযা’র দ্বারা পাওয়া যায় তত আর কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।
হযরত বাহলূল মাজযূব এর ঘটনা
হযরত বাহলূল মাজযূব রাহ.কে কেউ জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন? তিনি বললেন, খুব ভালো আছি। অত্যন্ত শান্তিতে আছি। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, কেমন শান্তি? তিনি বললেন, আরে ভাই, ওই লোকের শান্তির পরিমাপ কে করতে পারে যার ইচ্ছার বিপরীতে কিছুই পৃথিবীতে হয় না! জগতের সকল বিষয় তো আমার ইচ্ছা মাফিক হচ্ছে! লোকেরা বলল, জনাব, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কেউ আসেনি, যার ইচ্ছে মাফিক সবকিছু হয়েছে। এমনকি নবীগণেরও ইচ্ছা-বিরোধী অনেক কিছু ঘটেছে। আপনার এমন কোন মাকাম হাসিল হয়ে গেল যে, আপনার ইচ্ছে বিরোধী কোনো কিছুই ঘটে না? তিনি বললেন, প্রকৃত বিষয় এই যে, আমি নিজের ইচ্ছাকে মাওলার ইচ্ছায় বিলীন করে দিয়েছি। তাঁর যা ইচ্ছা সেটাই আমার ইচ্ছা। তিনি যাতে খুশি আমিও তাতে খুশি। আর যেহেতু বিশ্বজগতে কোনো কিছুই তাঁর ইচ্ছার বিপরীতে ঘটে না তাহলে আমারও ইচ্ছার বিরোধী কোনো কিছু নেই। সমর্পণের এই শান্তি নিজ ফযল ও করমে আল্লাহ তাআলা আমাকে দান করেছেন।
‘রিযা বিলকাযা’ তে রয়েছে প্রশান্তি
মোটকথা, রিযা বিলকাযার চেয়ে বড় শান্তির উপায় আর নেই। এখন বান্দা এই পন্থায় শান্তি লাভ করতে পারে কিংবা শান্তির অন্বেষায় জীবনভর ছটফট করতে পারে।
হযরত রাহ.-এর উপরোক্ত মালফুযের সারকথা এই যে, ভ্রুক্ষেপহীনতা সত্ত্বেও যদি এই সব অনাহুত ভাবনা দূর না হয়; বরং যথারীতি তা আসতেই থাকে তাহলেও ভীত ও পেরেশান হওয়ার কারণ নেই। এক্ষেত্রে এই ভেবে হালতের উপর সন্তুষ্ট থাকাই কাম্য যে, আল্লাহ যখন আমার জন্য এটাই পছন্দ করেছেন তো আমি তাতে খুশী। তবে ওই সব ভাবনা মোতাবেক কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং আপনাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
অনুবাদে : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ