বাইতুল্লাহর মুসাফির-১৮
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তায়েফকে বলা হয় শৈল শহর। পুরো শহরটা ছড়িয়ে আছে পাহাড়ের উপর উঁচুতে ঢালুতে, চড়াইয়ে উৎরাইয়ে অপূর্ব এক তরঙ্গ সৃষ্টি করে। সে তরঙ্গ যেন দৃষ্টির-পথে প্রবাহিত হয়ে হৃদয়ের সবুজ ভূমিতেও তরঙ্গ আনে।
যদি বলি, তায়েফ হলো শিল্পীর নিপুণ তুলিতে অাঁকা একটি শহর, তাহলে তায়েফের সৌন্দর্যকে অসম্মান করা হবে। তায়েফ আসলে শিল্পীর তুলিতে অাঁকা ছবির চেয়েও সুন্দর এক শহর।
পথের দু’পাশের সবুজ-সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম তায়েফের প্রবেশদ্বারে।
আমাদের নবীজী এসেছিলেন এই তায়েফ শহরে। তখন নিশ্চয় এত সম্প্রসারিত ছিলো না শহর; অনেক ছোট ছিলো এবং খুব সাধারণ ছিলো। কিন্তু এখন?! তায়েফ এখন চৌদ্দশ বছর আগের ‘পল্লীশহর’ নয়; আধুনিক স্থাপত্যের স্বাক্ষর বহনকারী উঁচু উঁচু ইমারতবেষ্টিত সম্পূর্ণ নতুন এক শহর।
তায়েফ নামটুকু ছাড়া অতীতের আর কিছু কি আছে এখানে? হয়ত নেই। সবকিছু হারিয়ে গেছে আধুনিকতার স্রোতে; সবকিছু চাপা পড়ে গেছে বড় বড় দালানকোঠার নীচে।
কিংবা হয়ত আছে কিছু কিছু , এমনকি অনেক কিছু, তাদের জন্য যারা সামনের চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় পিছনে; দূরে, বহু দূরে! নইলে কেন আসতে চায় মানুষ তায়েফে! কিসের টানে! কোন আকর্ষণে! আধুনিকতার জৌলুসের জন্য নয়; সুদূর অতীতের ‘ঐটুকু’ স্মৃতির প্রতি ভালোবাসার কারণে! কী ক্ষতি ছিলো এদেশের সরকারের, যদি তায়েফের দুয়ার খোলা রাখতো সবার জন্য! যদি অতীতের কিছু স্মৃতি অক্ষত রেখে দিতো আমাদের জন্য!
প্রবেশপথ থেকেই অবাক হওয়ার পালা। আমি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করিনি, তবে ভ্রমণকাহিনী পড়েছি প্রচুর। পথের এমন অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা আমি পাইনি কোথাও। শহরের প্রবেশপথ থেকেই যেন রোমাঞ্চের শুরু। এঁকে বেঁকে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে পথ উঠে গেছে উপরে, অনেক উঁচুতে। ইঞ্জিন যেন গাড়ীকে টেনে তুলতে হাঁপিয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও পথ এত সরু যে, রীতিমত বিপজ্জনক। একটু অসতর্ক হলেই গড়াতে গড়াতে গাড়ী গিয়ে পড়বে কয়েকশ ফুট নীচে। ভয়ে যে কারো বুক দুরু দুরু করবে, তবু সৌন্দর্যের আকর্ষণ তাকে প্রলুব্ধ করবে উপরে উঠে যেতে। আমার চেহারায় ভয়ের ছাপ পড়েছিলো কি না জানি না, আবুল কালাম আমার দিকে তাকিয়ে অভয় দিয়ে বললো, এপর্যন্ত তেমন কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি এখানে।
একসময় এত উপরে উঠলাম যেন মেঘেরা আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে আলতোভাবে আদর করে যায়!
গাড়ী থামিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ালাম। অপূর্ব! সত্যি অপূর্ব! মনে হলো, তন্ময় হয়ে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকা যাবে এই সৌন্দর্যকে সামনে রেখে। পাহাড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে পুরো শহর যেন সবুজের তরঙ্গে তরঙ্গায়িত। শুধু সবুজ আর সবুজ, যেন সবুজের ছায়ায় পুরো শহর বিশ্রামরত।
জানি না কেন, হয়ত সবুজের ছোঁয়া লেগে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সবুজ বাংলাদেশের কথা!
মনে পড়েই ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো এক অব্যক্ত বেদনায়। কারণ দুই সবুজের মাঝেই রয়েছে ছোপ ছোপ লাল।
এই তো সেদিন বাংলাদেশের মাটিতে শহীদ হলেন আওলাদে রাসূল সৈয়দ মোস্তফা হোসায়নী আলমাদানী। বাংলাদেশকে তিনি ভালোবেসেছিলেন অন্তর থেকে। সেখানেই কেটেছে তাঁর জীবন। ইসলামের খিদমত এবং কোরআন-সুন্নাহর প্রচার-প্রসারই ছিলো তাঁর জীবনের লক্ষ্য। এজন্য তিনি জীবনের সব সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়েছিলেন।
ফিরেশতা-ছুরত ও ফিরেশতা-সীরত এই মানুষটিকে একবার যে দেখেছে সেই তাঁকে ভালোবেসেছে এবং শ্রদ্ধা করেছে। মানুষ তো নিষ্পাপ হতে পারে না; তবে তাঁকে দেখে সবাই একবাক্যে বলতো, জেনেশুনে ইনি কোন পাপ করতে পারেন না। সবসময় এমন স্নিগ্ধ হাসি ফুটে থাকতো যেন ঠোঁট দু’টো তার সাদা গোলাবের দু’টি পাপড়ি।
আওলাদে রাসূলের বুক লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হয়নি, গুলি ছোঁড়া হয়েছিলো এবং তিনি শহীদ হয়েছিলেন। সবুজ মাটিতে তাঁর বুক থেকে ঝরেছিলো লাল রক্ত। আমি নিজের চোখে দেখেছি তাঁর রক্তাক্ত জানাযা। বিনা গোসলে, বিনা কাফনে, শহীদী লেবাসে তাঁকে দাফন করা হয়েছিলো। সেদিনই আমি প্রথম জেনেছিলাম, শহীদানকে কীভাবে দাফন করতে হয়! আমি তাঁর জানাযা পড়েছি। হাজার হাজার মানুষ ছিলো সে জানাযায়। এমন কান্নার রোল আর কখনো শুনিনি; এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্যও আর দেখিনি। তিনি শুয়ে আছেন লালবাগ শাহী মসজিদের ছোট্ট নিরিবিলি কবরস্তানে।
সেবছর আল্লাহর এক প্রিয় বান্দা মদীনা শরীফে আল্লাহর নবীকে স্বপ্নে দেখেছিলেন। যিন্দা কলব যারা এ স্বপ্ন তাদেরকে খুব বিচলিত করেছিলো। থাক এখানে সেই স্বপ্নের কথা।
আমার চোখদু’টো বোধহয় ঝাপসা হয়ে উঠেছিলো। আবুল কালাম অবাক হয়ে জানতে চাইলো কী হয়েছে! আমি ম্লান হেসে বললাম, কত কিছু হয়! চলুন, যাওয়া যাক।
গাড়ী আবার চলতে শুরু করলো। এবার পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে নীচে নামার পালা। নীচে নামার অনুভূতিটাও কম উপভোগ্য নয়। তবে উপভোগ করার মত মনের অবস্থা তখন ছিলো না।
আমার বন্ধু আবুল কালামের বাড়ীতে খুব শান্তির পরিবেশ মনে হলো। সুখ-শান্তির এমনই এক স্বর্গীয় স্নিগ্ধতা রয়েছে যে, মানুষ কোন সুখী গৃহে প্রবেশ করে সহজেই তার পরশ অনুভব করতে পারে, হোক না তা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আসবাববর্জিত।
আবুল কালামের স্ত্রী ও দুই
সন্তানের ছোট্ট পরিবার। পনের দিন অন্তর একবার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আবুল কালাম মক্কা শরীফ যায় ওমরা করার জন্য। একদিন হারাম শরীফে অবস্থান করে ফিরে আসে তায়েফে। ছেলেটির বয়স সাত আট। মেয়েটির পাঁচমাস।
আবুল কালাম মেয়েটিকে আমার কোলে এনে দিলো, আর আমার মন কেমন করে উঠলো। পৃথিবীর সব শিশুই কি জাদু জানে, বিশেষ করে কোলের শিশু!
এমন অবাক চাহনি, এমন সুন্দর হাসি, এমন মধুর কান্না কে দেয় তাদের চোখে, ঠোঁটে, গলায়! তাদের হাসি-কান্না কীভাবে এমন মধু বর্ষণ করে আমাদের কানে! তাদের অবাক চাহনি কীভাবে এমন মুগ্ধ করে আমাদের হৃদয়কে! কী আছে তাদের অবোধ হাসিতে, অবুঝ কান্নায় এবং অবাক চাহনিতে!
আমার কোলে তো ছিলো আবুল কালামের মেয়েটি, কিন্তু তার হাসিতে, কান্নায় এবং চোখের অবাক চাহনিতে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম অন্যকিছু!
আশ্চর্য! একটি শিশুর চোখে-মুখে কীভাবে ফুটে ওঠে অন্য শিশুর মুখাবয়ব! একটি শিশুর হাসিতে কান্নায় এবং চোখের চাহনিতে কীভাবে মানুষ শুনতে পায় নিজের শিশুর হাসি-কান্না! দেখতে পায় নিজেরই শিশুর চোখের চাহনি!
আদর করে মেয়েটির গালে কপালে চুমু খেলাম, কিন্তু স্বাদ পেলাম সুদূর বাংলাদেশে রেখে আসা নিজের মেয়েকে আদর করার এবং চুমু খাওয়ার। আসলে পৃথিবীর সকল শিশু অভিন্ন একটি সত্তার অধিকারী; অভিন্ন তাদের পরিচয়। আমার শিশু, তোমার শিশু, অন্য কারো শিশু; সবাই তারা মানবশিশু। তাই সবশিশুর চোখে তুমি দেখতে পাবে তোমার শিশুর চোখের চাহনি। সবশিশুর মুখে তুমি শুনতে পাবে তোমার শিশুর মুখের হাসি ও কান্না।
শিশুরা কারো নয়, সবার। শিশুরা মানবজাতির। পৃথিবীর সবশিশুর অভিন্ন পরিচয়; তারা মানবশিশু। এজন্যই যে কোন শিশুকে কোলে নিয়ে মনে হবে যেন তোমারই শিশু তোমার কোলে দোল খায়। আরব শিশুকে হাতছানি দাও; কেন তোমার কোলে ঝাঁপ দেয়?! ইংরেজ শিশুকে আদর করো; কেন তোমার আদর গ্রহণ করে?! কারণ সে মানবশিশু। পৃথিবীর যে কোন মানবশিশুকে শুঁকে দেখো, তার মাঝে তুমি পাবে তোমারই ফুলশিশুর ঘ্রাণ! তাই কখনো কোন মানবশিশুকে অসম্মান করো না; তোমার শত্রুর শিশুকেও কোলে নিতে ভুল করো না।
কোলে নিয়ে দোল তো দিচ্ছিলাম একটি অবোধ শিশুকে, কিন্তু এটা ছিলো বাইরের দৃশ্য; অন্তর্জগতে আসলে আমি নিজেই দোল খাচ্ছিলাম ভাবের এবং আবেগের আশ্চর্য এক তরঙ্গে! আমার কোলে দোল খাওয়া আবুল কালামের শিশুটি, সুদূর বাংলাদেশে মায়ের কোলে রেখে আসা আমার নিজের শিশুটি এবং পৃথিবীর সকল মানবশিশু আমার চোখে তখন একাকার হয়ে গিয়েছিলো। সব যেন বেহেশ্তি বাগানের একেকটি ফুল! সবার মুখে যেন বেহেশ্তি ফুলের হাসি! সবার দেহে যেন বেহেশ্তি ফুলের ঘ্রাণ! সবার কান্নায় যেন বেহেশ্তি পাখীর গান!
ছাবিবশ বছর আগে তায়েফে আমার কোলে দোল খাওয়া সেই শিশুটি কি এখনো সেই শিশুটিই আছে! অন্তত মুখের হাসিতে, চোখের চাহনিতে! আমার মেয়ের কোল যেমন আলো করেছে জান্নাত থেকে নেমে আসা একটি আলোকশিশু তেমনি তার কোলেও কি ফুটে আছে কোন বেহেশ্তি ফুল!
যেখানেই তুমি থাকো মা, আমার হৃদয়ের শিশিরসিক্ত কল্যণকামনা থাকবে তোমার সঙ্গে। কারণ আমার কোলে দোল খেয়ে সেদিন তুমি আমার অন্তরে ভাবের অপূর্ব এক তরঙ্গদোলা সৃষ্টি করেছিলে। তোমাকে কোলে নিয়েই আমি শিখেছিলাম প্রতিটি মানবশিশুকে বেহেশ্তি ফুলের মত ভালোবাসতে। সে শিক্ষা এখনো জীবন্ত রয়েছে আমার আত্মার গভীরে। তুমি সুখী হও মা, সুখী হও!
প্রিয় পাঠক! তোমার কি মনে হয় আমি দূরে সরে পড়েছি হজ্বের পরিবেশ থেকে? বাইতুল্লাহর ছায়া থেকে? সবুজ গম্বুজের স্নিগ্ধতা থেকে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। কারণ বিবি হাজেরার কোলের শিশুটি তো হজ্বেরই অংশ! এবং যমযমের ফল্গুধারা তো তারই দান! জাহেলিয়াতের বর্বরতা থেকে শিশুকন্যাদের মুক্তি পাওয়া, সে তো সবুজ গম্বুজেরই অবদান! সুতরাং কোন শিশুকে এবং শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে ইচ্ছে করলে তুমি পেতে পারো যমযমের শীতলতা এবং সবুজ গম্বুজের স্নিগ্ধতা!
তায়েফে আমার শৈশবের বন্ধু আবুল কালামের গৃহে প্রবেশ করেছিলাম শূন্য হাতে, কিন্তু বের হলাম একটি অবোধ শিশুর কাছ থেকে হৃদয় ও আত্মার অনেক সম্পদ অর্জন করে।
আবুল কালাম গাড়ী নিয়ে বের হলো আমাকে তায়েফ শহর দেখাতে। সারা পথে সবুজ গাছের ছায়া। তার উপরে আকাশে কালো মেঘের ছায়া। আর আমার হৃদয়াকাশে ছিলো বেদনা ও বিষণ্ণতার অন্যরকম এক ছায়া। ধীরে ধীরে আমি যেন ফিরে গেলাম সেই সুদূর অতীতে। এখানে এই তায়েফে এসেছিলেন আমেনার দুলাল। মক্কা তার হৃদয় থেকে রক্ত ঝরিয়েছিলো; তিনি আশা করেছিলেন তায়েফ তাঁর হৃদয়ের ক্ষতে সান্ত্বনার শীতল প্রলেপ বুলিয়ে দেবে। কিন্তু! মক্কা তাঁর হৃদয় থেকে রক্ত ঝরিয়েছিলো, আর তায়েফ তাঁর দেহ থেকেও রক্ত ঝরালো। যে মেহমানকে ভালোবাসার ফুল দিয়ে বরণ করা উচিত ছিলো তাঁকে তায়েফের পথে পথে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করা হলো! সেই নূরানি রক্তের ঘ্রাণ এখনো যেন পাওয়া যায় তায়েফের পথে পথে।
সমতল এলাকায় একটি মসজিদের সামনে এসে আবুল কালাম বললেন, লোকমুখে প্রচলিত আছে, এখানেই ছিলো সেই আঙ্গুর বাগান, যালিমদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য আল্লাহর নবী যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমরা মসজিদে প্রবেশ করলাম বেদনায় বিগলিত হৃদয় নিয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুর নাযরানা পেশ করে। নবীর উম্মত কেন আসে না তায়েফে সেই নূরানি রক্তের ঘ্রাণ পেতে এবং দু’ফোঁটা অশ্রুর নাযরানা পেশ করতে! কেন আসে না দ্বীনের জন্য পাথরের আঘাত বরণ করার এবং রক্ত ঝরানোর শিক্ষা গ্রহণ করতে! কেন আসে না? কেন আসতে দেয়া হয় না?
মসজিদটি খুব বড় যেমন নয়, তেমনি খুব ছোটও নয়। দেয়ালে এবং ছাদে সেগুন কাঠের ভাবগম্ভীর সাজসজ্জা। পুরো সফরে আর কোন মসজিদে এমন কাঠের কারুকাজ আর দেখিনি। মনের ভিতরে অন্যরকম একটি ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হলো। মনে হলো, কী যেন এখানে আছে, যা অন্যখানে নেই! আমার খুব ইচ্ছে হলো একথা ভাবতে যে, লোকমুখে যা প্রচলিত সেটাই সত্য। নাহলে আমার মনের এমন কেন অবস্থা হবে? আমার যে ইচ্ছে করছে এখানে সবুজ কার্পেটের উপর লুটিয়ে পড়তে! চিরকালের জন্য পড়ে থাকতে!
দু’রাকাত নামায আদায় করে মসজিদ থেকে বের হলাম। মনে হলো, সত্যি সত্যি আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে বের হলাম! আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, তায়েফের শিক্ষাকে নিজের মাঝে ধারণ করার জন্য সারা জীবন অন্তত চেষ্টা করে যাওয়ার।
গাড়ী কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ আমি আবুল কালামকে অনুনয়ের স্বরে বললাম, আপনি আমাকে নিয়ে যেতে পারেন ঐখানে, আল্লাহর নবী যেখানে মুনাজাত করেছিলেন, অশ্রুমাখা ও রক্তভেজা মুনাজাত যা কম্পন সৃষ্টি করেছিলো আল্লাহর আরশে! আমি দেখতে চাই সেই পবিত্র স্থানটি যেখানে আল্লাহর হুকুমে আমার পেয়ারা নবীর খেদমতে হাযির হয়েছিলেন পাহাড়ের হেফাযতকারী ফিরেশতা এবং অনুমতি চেয়েছিলেন দুই পাহাড় একত্র করে তায়েফীদের হালাক করে দেয়ার। কিন্তু দয়া ও রহমতের নবী অস্থির হয়ে বলেছিলেন, ‘না না; আমি তো আশা করি, ওরা না হলেও ওদের সন্তানসন্ততি আমার দাওয়াত কবুল করবে।’
আমি দেখতে চাই সেই পবিত্র স্থান যেখান থেকে আমার হৃদয় শিক্ষা গ্রহণ করবে পাথরের আঘাত খেয়েও বিভ্রান্ত মানুষকে ভালোবাসার এবং ক্ষমা করার। এ শিক্ষার আজ বড় প্রয়োজন উম্মতের। এই ক্ষমাসুন্দর চরিত্র তো নবীজীবনেরই আদর্শ! এটা তো নববী জিহাদেরই অংশ!
আবুল কালাম বুঝতে পেরেছিলেন আমার হৃদয়ের ব্যথা এবং আবেগের গভীরতা। তিনি আফসোসের স্বরে বললেন, কিন্তু এই হতভাগারা হিজাযের পবিত্র ভূমিতে তাদের নবীর কোন চিহ্নই যে অবশিষ্ট রাখেনি! এক এক করে সব মুছে ফেলেছে!
আমি বললাম, থাক, মুছে ফেলেছে তো কী হয়েছে! হৃদয়ের অনুভব থেকে তো আর মুছে ফেলতে পারে না! হৃদয়ের গভীরেও তো অনুভব করা যায় সুদূর অতীতকে! আমাদের শিক্ষা তো এই মাটি থেকে নয়, আমাদের শিক্ষা তো সেই পবিত্র জীবন থেকে! আর সেই জীবন তো আমাদের সামনে চিরজীবন্ত!
মসজিদে ইবনে আববাস (রা)- এর কথা শুনেছিলাম হযরত হাফেজ্জী হুযূরের কাছে এবং পড়েছিলাম শায়খুল হিন্দ (রহ)- এর সফরনামা আসীরে মাল্টায়। সেই মসজিদে ইবনে আববাসে দাখেল হওয়ার খোশকিসমত হলো আমার আজ।
ইসলামী খেলাফাতের আখেরি ‘পাসবান’ তুর্কীদের সঙ্গে যখন বেদুঈন আরব বিদ্রোহীদের ঘোরতর যুদ্ধ চলছিলো তখন রামাযান মাসে এই তায়েফে অবস্থান করছিলেন শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসান এবং তাঁর ‘জানেছার’ খাদেম শায়খুল ইসলাম মাওলানা হোসায়ন আহমদ মাদানী (রহ)। তখন দিন-রাত প্রচ গুলিবৃষ্টি হতো উভয় পক্ষের মাঝে। সেই গুলিবৃষ্টি উপেক্ষা করে শায়খুল হিন্দ (রহ) এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা মসজিদে ইবনে আববাসে হাযির হতেন। অথচ তাঁদের অবস্থানক্ষেত্রের নিকটেই ছিলো মহল্লার মসজিদ। এটা শরীয়াতের মাসআলা নয়, এটা হলো ইশক ও মুহববতের তাকাযা।
আগের যুগের বিভিন্ন সফরনামায়, এমনকি শায়খুল হিন্দ (রহ)-এর আসীরে মাল্টায় যেমন পড়েছি, সেই মসজিদে ইবনে আববাসের চিহ্নমাত্র এখন নেই। মসজিদে ইবনে আববাস এখন অতি শানদার ও কারুকার্যময় বিরাট মসজিদ। কিন্তু এটা তো শুধু চোখের বিভ্রম! মানুষ যদি ইচ্ছে করে, খুব সহজেই ফিরে যেতে পারে অতীতের কোলে, যেখানে সবকিছু সহজ-সরল এবং সবকিছু হৃদয়ের খুব নিকটবর্তী; যেখানে বিজলী বাতির ঝলমলতা নেই, কিন্তু আছে নূর ও নূরানিয়াত। আমি চেষ্টা করলাম একটু একটু করে সময়ের সিঁড়ি বেয়ে সুন্দর অতীতের ছায়ায় ফিরে যেতে। আমি যেন দেখতে পেলাম মুসলিম উম্মাহর ভাগ্যবিপর্যয়কারী সেই যুদ্ধের বিভীষিকা। অল্পসংখ্যক জানবায তুর্কী সিপাহী এবং ইংরেজের ক্রীড়নক শরীফের বেদুঈন বাহিনীর মাঝে চলছে ঘোরতর যুদ্ধ। প্রচ গোলাগুলিতে রাতের অন্ধকারে তায়েফের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। মসজিদের মিনার ভেঙ্গে পড়েছে। ভেতরেও এসে পড়ছে একটা দু’টো গোলা। মসজিদে কোন মানুষ নেই। এশার নামাযেও কোন মানুষ আসেনি। ঘর থেকে বের হওয়াই তো সম্ভব নয় কারো পক্ষে। সেই সুনসান মসজিদে পড়ে আছেন তিনচারজন
হিন্দুস্তানী মুসাফির। ঐ তো শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসান (রহ)! প্রচ গোলাগুলি এবং মৃত্যুর বিভীষিকা, কিন্তু তিনি দাঁড়িয়ে আছেন জায়নামাযে, পূর্ণ আত্মসমাহিত! নামায শেষে ঐ যে তিনি হাত তুলেছেন আল্লাহর দরবারে মুনাজাতে! জারজার হয়ে কাঁদছেন আর ফরিয়াদ করছেন, আল্লাহ যেন রক্ষা করেন মুমূর্ষ ইসলামী খেলাফতকে ইংরেজ হায়েনাদের হামলা থেকে। কারণ শত দুর্বলতা সত্ত্বেও এই তুর্কী খেলাফতটুকুই এখন ইসলামী উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক এবং গৌরবময় অতীতে ফিরে যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন। তিনি জানতেন এটা, আর জানতো মুসলিম উম্মাহর জানি দুশমন সুচতুর ইংরেজ; জানতো না শুধু আরবনামের কলঙ্ক ইংরেজের হাতের পুতুল শরীফ।
ঐ যে শায়খুল ইসলাম হোসায়ন আহমদ মাদানী (রহ)! প্রাণপ্রিয় শায়খকে যেন আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেন। অজ্ঞাত কোন গুলি যদি আসে, শায়খের গায়ে নয় তা যেন লাগে নিজের বুকে!
সময়ের অনেক সিঁড়ি পার হয়ে, বহু নূরানি মানুষের উপস্থিতি অবলোকন করে করে আমি যেন প্রবেশ করলাম সেই নূর ঝলমল ছোট্ট মসজিদটিতে যেখানে নামায পড়ছেন নবীজীর অতি আদরের ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা)। আমরাও সৌভাগ্য লাভ করলাম সেই মসজিদে দু’রাকাত নামায পড়ার। সেই দু’রাকাতের আত্মিক প্রশান্তি ও রূহানি সুকূন আজ এত বছর পর এখনো যেন অনুভব করা যায়।
সেদিনই সন্ধ্যায় তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরে এলাম। আবুল কালাম তার গাড়ীতে করে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন। সেই যে গেলেন, আর না হলো দেখা, না থাকলো কোন যোগাযোগ। যেমন হারিয়ে ছিলেন তখন পর্যন্ত তেমনি হারিয়ে আছেন এখন পর্যন্ত। মাঝখানে যেন শুধু আসমানের ইশারায় একদিনের জন্য উদিত হয়েছিলেন তায়েফের আলোতে আমাকে আলোকিত ও প্লাবিত করার জন্য! তিনি হারিয়ে গেছেন আমার দিন-রাতের জীবন থেকে, তবে আমার হৃদয়ের স্পন্দন থেকে নয়। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এখনো আমি স্মরণ করি তাকে। কে জানে, হয়ত হঠাৎ করে কোন একদিন ..!
কোন কিছুই তো অসম্ভব নয়! কত বিস্ময়, কত আনন্দ এবং বেদনা লুকিয়ে থাকে আমাদের জীবনে আগামী দিনের পর্দায়, আগে থেকে আমরা তো তার কিছুই জানি না! অজানার এই ঝুলন্ত পর্দাটুকুর জন্যই হয়ত জীবনের প্রতি আমাদের এত অনুরাগ, এত ভালোবাসা!
একদিন তাহাজ্জুদের সময় হুইলচেয়ারে করে হযরতকে হারাম শরীফে নিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ তিনি বললেন, মিয়াঁ আবু তাহের! আমি তোমাকে জান্নাতুল মুআল্লার যিয়ারাতে নিয়ে যাবো, তবে একটি শর্ত!
এমন অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যের কথা শুনে আমি তো অভিভূত এবং আনন্দে আত্মহারা! হযরত বলছেন ‘শর্ত’! আশ্চর্য! মেঘ যদি বলে তৃষ্ণার্ত ভূমিকে, তোমার বুকে আমি বারিবর্ষণ করবো, তবে একটি শর্ত; তোমাকে সবুজ ফসল দান করতে হবে পৃথিবীর মানুষকে! মেঘ যদি মাটির কাছে দাবী করে এমন মধুর শর্ত তাহলে কেমন হয়! আমার অবস্থাও হলো সেই শুকনো ভূমির মত; কারণ তেমনি একটি মধুর শর্তের কথা বললেন হযরত আমাকে! বললেন... থাক সে কথা।
ফজরের পর হযরতের সঙ্গে রওয়ানা হলাম। কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে এবং কিছুটা পথ হুইল চেয়ারে করে হযরত পৌঁছলেন জান্নাতুল মুআল্লায়।
জান্নাতুল মুআল্লা মক্কা শরীফের প্রাচীনতম কবরস্থান। হারাম থেকে এক মাইলের দূরত্বে মক্কার উর্ধ্বভূমিতে তার অবস্থান।
জান্নাতুল মুআল্লার পরিচয়ের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এখানে শায়িত আছেন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তমা স্ত্রী, আমাদের আম্মা হযরত খাদীজাতুল কোবরা (রা); বিবাহকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সুখে-দুঃখে, বিপদে-দুর্যোগে যিনি নবীজীর পাশে ছিলেন। জীবন ও সম্পদ, সর্বস্ব যিনি আল্লাহর নবীর কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। পরবর্তীকালে আল্লাহর নবী যাঁর সম্পর্কে বলেছেন, যখন মানুষ আমাকে অবিশ্বাস করেছে তখন খাদীজা আমাকে বিশ্বাস করেছেন। যখন লোকেরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তখন খাদীজা আমাকে গ্রহণ করেছেন। যখন লোকেরা আমাকে কষ্ট দিয়েছে তখন তিনি আমাকে সমবেদনা জানিয়েছেন।
আল্লাহর নবীর পবিত্র যবানে যখন তিনি নবুয়তপ্রাপ্তির কথা শুনলেন তখন একেবারে নির্দ্বিধায় পরম নির্ভরতায় তিনি তা বিশ্বাস করলেন এবং কৃতার্থ কণ্ঠে মধুর মমতায় এই বলে আল্লাহর নবীকে সান্ত্বনা দিলেন, ‘আপনার ভয় কি! আপনি তো দুর্বলকে সাহায্য করেন, নিঃস্ব অসহায়কে আশ্রয় দান করেন। বিপদে-দুর্যোগে সবার পাশে দাঁড়ান সুতরাং আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন এবং আশ্রয় দান করবেন। কিছুতেই আল্লাহ আপনাকে পরিত্যাগ করবেন না।’
প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনীর মুখে এই যে সুমধুর সান্ত্বনা, তা কেমন প্রশান্তি দান করেছিলো আমাদের পেয়ারা নবীকে!
আবির্ভাবের চরম দুর্যোগকালে ইসলাম একজন নারীর কাছেই পেয়েছিলো এমন মমতা! এমন সান্ত্বনা! সেই নারীর প্রতি কি ইসলাম কৃতজ্ঞ না হয়ে পারে! ইসলামের চেয়ে আর বেশী কে চাইতে পারে সেই নারীর কল্যাণ?!
আজ কার ভুলে, কাদের মূর্খতায় ইসলামের প্রতি নারীসমাজের এমন ভীতি-ভয় ও দ্বিধা-সংশয়?!
জান্নাতুল মুআল্লার প্রবেশদ্বার খোলাই ছিলো এবং যিয়ারতকারীদের আসা-যাওয়া অব্যাহত ছিলো। হযরত হুইলচেয়ার থেকে নেমে ধীর পদক্ষেপে জান্নাতুল মুআল্লায় প্রবেশ করলেন।
কিছুক্ষণ সাধারণভাবে সকল কবরবাসীর জন্য দু‘আ করলেন। তারপর ধীরে ধীরে একটি কবরের সামনে হাজির হলেন এবং আমাকে সতর্ক করে বললেন, খুব আদবের সাথে দাঁড়াও। এটা আম্মাজান হযরত খাদিজা (রা)-এর কবর, স্বয়ং আল্লাহ যাঁকে সালাম পাঠিয়েছেন এবং সালাম পাঠিয়েছেন হযরত জিবরীল আলাইহিস-সালাম!
হযরতের তখন এমন ‘বে-খোদ’ অবস্থা হলো যে, তিনি জারজার হয়ে কাঁদলেন। সে কান্নায় কোন শব্দ ছিলো না, ছিলো শুধু অশ্রুর বর্ষণ।
হযরতের কান্না দেখে আমারও কান্না পেলো এবং আমারও চোখ দু’টো কিছু না কিছু সিক্ত হলো।
এর পর একে একে হযরত বিভিন্ন কবরের সামনে দাঁড়ালেন এবং যিয়ারাতের হক আদায় করলেন। আমি অভিভূত চিত্তে হযরতের পিছনে পিছনে অগ্রসর হলাম। তিনি যখন যে কবরের সামনে দাঁড়ান আমিও তাঁর পিছনে দাঁড়াই এবং যিয়ারত করি। সব এখন মনে নেই, তবে এইটুকু মনে আছে যে, ইমামুল আকাবির হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ)-এর কবরের সামনে তিনি মোরাকাবার অবস্থায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই মোরাকাবার কী হাকীকত এবং কী তাঁর প্রাপ্তি? আমার মত
অন্তর্চক্ষুর অন্ধ কীভাবে তা জানবে বা বোঝবে ! আমার জন্য তো এতটুকুই যথেষ্ট যে, অমি তখন ছিলাম সেখানে আমার হযরতের পিছনে।
যিয়ারত থেকে ফারিগ হয়ে জান্নাতুল মুআল্লা থেকে বের হওয়ার সময় হযরত আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মিয়াঁ আবু তাহের, কিছু হালাত পয়দা হইছে নি?’
অকপটে আরয করলাম, হযরত! আমি কিছু বুঝতে পারিনি। তবে চোখ দু’টো একটু ভিজেছে এবং কয়েক কাতরা আঁসু এখানে রেখে যেতে পেরেছি।
ফেরার পথে পুরোটা সময় হযরত হুইলচেয়ারে ছিলেন, আর আমি পরম আনন্দে সেটা চালিয়ে এনেছি। সারা পথে হযরত কোন কথা বলেননি, একেবারে নীরব ছিলেন এবং সেই আধ্যাত্মিক ভাবেই আত্মনিমগ্ন ছিলেন যা তিনি জান্নাতুল মুআল্লার যিয়ারত থেকে অর্জন করেছেন।
হারাম শরীফ থেকে বাবে উম্মে হানি দিয়ে বের হয়ে মিসফালায় যাওয়ার মুখে বাম দিকে যে ছোট পাহাড়টি, তার উপর রয়েছে তুর্কী আমলের দুর্গ। প্রতি দিনই আসা-যাওয়ার পথে দুর্গটি আমার নযরে পড়ে। কখনো কখনো দুর্গের দিকে তাকিয়ে আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। আমার হৃদয় অবর্ণনীয় এক বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে। তুর্কীদের উছমানী খেলাফাতই ছিলো মুসলিম বিশ্বে ইসলামী খেলাফাতের সর্বশেষ প্রতিনিধি। হারামাইন, হিজায ও আরববিশ্ব ছিলো বিশাল উছমানী খেলাফাতের অন্তর্ভুক্ত। এটা যে খেলাফাতে রাশেদা ছিলো না তা তো আর বলার প্রয়োজন নেই, তারপরো তা ইসলামী খেলাফাতের অবশিষ্ট ছিলো এবং ছিলো মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও শক্তির প্রতীক। তাই ইহুদি-খৃস্টান চক্র শুরু থেকেই তৎপর ছিলো উছমানী খেলাফত ধ্বংসের কূট চক্রান্তে। শেষ দিকে উছমানী খেলাফত যখন বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত তখন ইহুদিদের
আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদল তুর্কী খলিফা সুলতান আব্দুল হামীদ খানের কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসে যে, খেলাফতের সকল বৈদেশিক ঋণ তারা পরিশোধ করবে, তদুপরি জঙ্গি নৌবহরের আধুনিকায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করবে; বিনিময়ে বেশী কিছু নয়, শুধু ফিলিস্তীনে একখ বাসভূমি তাদেরকে দান করতে হবে।
সুলতান আবদুল হামীদের অনেক দোষ ছিলো, দুর্বলতা ছিলো, কিন্তু এ প্রশ্নে তিনি মর্দে মুমিনের পরিচয় দিয়েছিলেন। ইহুদিদের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেছিলেন ..। যা বলেছিলেন তা ইতিহাসে এখনো স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, আমার দুর্বলতা তোমরা বুঝতে পেরেছো, তাই অর্থের প্রলোভন দেয়ার দুঃসাহস করেছো, কিন্তু আমি তো এর বিনিময়ে ফিলিস্তীনের একমুঠ বালুও তোমাদের দেবো না!
প্রলোভনে যখন কাজ হলো না তখন ইহুদিচক্র চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, যে কোন মূল্যে উছমানী খেলাফত ধ্বংস করেই তারা ক্ষান্ত হবে। শেষ পর্যন্ত তাদের চক্রান্ত সফল হলো আরব শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে হিজায, শাম, ফিলিস্তীন, মিশর, জর্দানসহ সমগ্র আরববিশ্ব তুর্কী খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। ইংরেজ-ইহুদিচক্র আরবদের মাঝে আরব
জাতীয়তাবাদের অভিশপ্ত বীজ ছড়িয়ে দেয় এবং তাদেরকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উছমানী খেলাফত অনেক চিন্তাভাবনার পর একান্ত অনন্যোপায় হয়েই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানদের পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করেছিলো। তখন মক্কা-মদীনা ও জিদ্দা-তায়েফে মাত্র পাঁচহাজারের মত প্রশিক্ষিত সৈন্য ছিলো। আরব বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তারা মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছিলো, কিন্তু বৃটিশ গোলন্দায বাহিনী যখন আরবদের সাহায্যে এগিয়ে এলো তখন তুর্কীদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লো এবং শৌর্যবীর্যের চরম পারাকাষ্ঠা প্রদর্শনের পরও তুর্কী বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। এভাবে মক্কা-মদীনাসহ সমগ্র হিজায তুর্কীদের হাতছাড়া হয়ে গেলো।
তুর্কীদের শোচনীয় পরাজয় হলেও আরবদের দিবাস্বপ্ন আর পূর্ণ হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আরববিশ্বকে টুকরো টুকরো করে গ্রাস করে নেয়। ফিলিস্তীনও আরবদের হাতছাড়া হয়ে যায়। সুলতান আবদুল হামীদ শত প্রলোভনের মুখেও ফিলিস্তীনের একমুঠ বালু বিক্রি করতে রাজী হননি, সেই
ফিলিস্তীন আরবরা একরকম উপহাররূপেই দুশমনদের হাতে তুলে দেয়, আর সেখানে জন্ম নেয় সাম্রাজ্যবাদের বিষফোঁড়া অভিশপ্ত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। আরবরাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা বলতে আজ কিছুই নেই। সউদি রাজবংশও তার জন্মলগ্ন থেকেই টিকে আছে ইঙ্গমার্কিন শক্তির দয়ায়। মার্কিন প্রভূর মর্জির বাইরে একটি কদমও রাখার শক্তি নেই তাদের। কয়েক লাখ ইহুদির হাতে কয়েক কোটি আরব আজ যে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে তা কিন্তু আরবদেরই কর্মফল। তুর্কীদের দোষত্রুটি ছিলো সীমাহীন সন্দেহ নেই, কিন্তু মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও শক্তির শেষ ভরসাস্থল উছমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহ ছিলো এমন এক অপরাধ যা ইতিহাস কখনো ক্ষমা করবে না। আল্লাহ যদি ক্ষমা করেন তাহলেই শুধু আরবজাহানের মুক্তি হতে পারে ইতিহাসের অভিশাপ থেকে।
যখনই আমি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত তুর্কী আমলের জরাজীর্ণ দুর্গটির দিকে তাকাই আমার মন এই সব চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং আমি বেদনাভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। আমার মনে হয় পাহাড়ের চূড়ায় জীর্ণদশার এই দুর্গটি একদিকে যেন মুসলিম উম্মাহর হারানো শক্তি ও গৌরবের নীরব সাক্ষী, অন্যদিকে তা আরব শাসকদের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের বেদনাদায়ক নিদর্শন।
হায় আরব! তোমরা ছিলে ইসলামী খেলাফতের রক্ষক। গোটা বিশ্ব ছিলো তোমাদের ভয়ে কম্পমান। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! তোমাদেরই বিশ্বাসঘাতকতায় রচিত হলো মুসলিম খেলাফাতের শেষ চিহ্নটির কবর, আর এখন তোমরা লাঞ্ছনা ভোগ করছো অভিশপ্ত ইহুদিদের হাতে।
শোনা যাচ্ছে, সউদি সরকার দুর্গটি ভেঙ্গে ফেলার চিন্তাভাবনা করছে। করারই কথা। কলঙ্কের সাক্ষ্য কেই বা রাখতে চায়!
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সময় সবসময় দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। আর সৌভাগ্যের সময় তো আরো দ্রুত ফুরিয়ে যায়। তাই দিন-রাতের যতটা সময় সম্ভব হারাম শরীফেই কাটানোর চেষ্টা করছি। হযরত যখন উম্মে হানিতে বসেন, তাঁর ছোহবতে থাকি। তাঁর কথা ও উপদেশ শুনি। যখন নীরব থাকেন, তাঁকে অবলোকন করি। যখন তাওয়াফ করেন, সেই তাওয়াফে শরীক হই। যমযমের পানি প্রাণভরে পান করি। তাতে প্রাণ যেন একেবারে শীতল হয়ে যায়। কিন্তু যখন মনে পড়ে, এ সৌভাগ্য মাত্র দু’দিনের তখন বিষাদের কালো মেঘ হৃদয়-মন যেন আচ্ছন্ন করে ফেলে। আল্লাহর ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, আমার মত না-পাক ও গান্দা ইনসানকেও ডেকে আনা হয়েছিলো আল্লাহর ঘরের মেহমানরূপে। কোন যোগ্যতা ছিলো না, শুধু আল্লাহর রহমত ছিলো। কিন্তু আমি পারিনি আল্লাহর ঘরের কোন আদব রক্ষা করতে। যেমন এসেছিলাম গাফেল তেমনি ফিরে যাচ্ছি গাফেল। তাহলে আমার কী উপায় হবে? মাহরূমি ও বঞ্চনাই কি আমার ভাগ্য?
আবার ভাবি, না না, আমার মাওলা তো বড় মেহেরবান। মরুভূমির বালুকণার শেষ আছে, সাগর-মহাসাগরের জলরাশির সীমা আছে, কিন্তু আমার মাওলার দয়া ও রহমতের, করুণা ও করমের কোন শেষ নেই। এ ঘর তাঁর এবং তিনিই এ ঘরের দয়ালু মেযবান। আমি তো তাঁরই দাওয়াতি মেহমান! তাঁর দান তো যোগ্যতার বিচারে হয় না, দয়া রহমতের ভিত্তিতে হয়। ভাব ও আবেগের এমন সব তরঙ্গদোলায় হৃদয় যখন উদ্বেলিত হয় তখন ঘরের গিলাফ ধরে ঘরের মালিকের কাছে অন্তরের সবটুকু আকুতি ঢেলে দিয়ে এই মিনতি জানাই-
‘আয় বান্দা নাওয়ায! মেরী মিন্নাত কি লাজ রাখলে/ মেরী নেহী তো আপনি রাহমাত কি লাজ রাখলে।
(ওগো দয়াময়, রক্ষা করো বান্দার মিনতির লাজ/ বান্দার না হোক, রক্ষা করো আপন রহমতের লাজ।)
হে আল্লাহ! তুমি তো বলেছো, বান্দা যদি গোনাহ দিয়ে আসমান-যমিন ভরে ফেলে, আমি মাগফিরাত দিয়ে আসমান-যমিন ভরে ফেলবো। বান্দা যদি হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসে, আমি বান্দার দিকে দৌড়ে দৌড়ে আসবো। হে আল্লাহ! তোমার রহমতের আশায় তোমার দিকে আমি হেঁটে হেঁটে এসেছি; বার বার হোঁচট খেয়েছি, তবু এসেছি। তুমি তোমার গোনাহগার বান্দার দিকে হে আল্লাহ দৌড়ে দৌড়ে আসো এবং তোমার রহমতের ছায়ায় তাকে আশ্রয় দান করো।
বিরাট আমার গোনাহর বোঝা, অসংখ্য আমার পাপের কলঙ্ক, কিন্তু তোমার রহমত থেকে আমি নিরাশ নই হে আল্লাহ! কারণ তোমার হাবীব বলেছেন, তোমার রহমত আমাদের গোনাহ থেকে প্রশস্ত। হে আল্লাহ! আমলের উপর আমার কোন ভরসা নেই, আমার ভরসা শুধু তোমার রহমতের উপর।
মেহমানদারি হয়ে গেছে। আল্লাহর মেহমানগণ এখন নিজ নিজ দেশে ফিরে চলেছেন। হারাম ও মাতাফ অনেক হালকা হয়ে এসেছে। এখন মানুষ আছে, কিন্তু জনস্রোত নেই। এখন সহজেই মুলতাযামে বুক লাগানো যায় এবং ঘরের চৌকাঠ ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়, এমনকি একদিন সামান্য চেষ্টাতেই হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের খোশকিসমতও হয়ে গেলো। আমি নিজে তো চুমু খেলামই, এক বুড়ো হাজীকেও দু’হাতে আগলে রেখে চুমু খেতে সাহায্য করলাম। বুড়ো মিয়াঁ কী যে খুশী! যাকে বলে আনন্দে আত্মহারা! আমার হাতে কপালে চুমু খেলেন, আর অজানা-অচেনা এক ভাষায় মনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। মুখের ভাষা তো বুঝলাম না, তবে চেহারার ভাষা বুঝলাম, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। বুড়ো মিয়াঁর চুমো খাওয়া আমার ভালো লাগলো এ কথা ভেবে যে, এই ঠোঁট দু’টো এই মাত্র হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেছে।
আল্লাহর বান্দাদের সামান্য একটু খেদমত দ্বারা দিলের কত দু‘আ যে পাওয়া যায়! এসব দু‘আই হলো জীবনপথের পাথেয়। কিন্তু আমরা খুব কমই চিন্তা করি এসব বিষয়। প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করে আমরা আল্লাহর ঘরে আসি আল্লাহকে পাওয়ার জন্য, অথচ কেয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, তুমি যদি ঐ ক্ষুধার্তকে এক লোকমা খাবার দিতে, কিংবা ঐ পিপাসার্তকে একঢোক পানি দিতে, অথবা ঐ অসুস্থ লোকটিকে একটু সেবা করতে তাহলে সেখানে তুমি আমাকে পেয়ে যেতে! হজ্বের সফরে এধরনের অনেক সুযোগ আসে আল্লাহকে কাছে পাওয়ার, কিন্তু আমরা আল্লাহকে তালাশ করি শুধু তাওয়াফের ভিড়ে এবং হাজরে আসওয়াদের হুজুমে মানুষকে কষ্ট দেয়ার মাঝে।
মুমিন ভাইয়ের সামান্য একটু সেবা-সাহায্য তো দূরের কথা, মক্কায়, মিনায়, আরাফায় সর্বত্র আত্মকেন্দ্রিকতার এমন সব দৃশ্যের অবতারণা হয় যে, হজ্বের মূল উদ্দেশ্যই যেন প হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাযত করুন এবং তাওফীক দান করুন, আমীন।
একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। মদীনা শরীফে অহুদের ময়দানে। গরম ছিলো প্রচন্ড। এক হাজী, কোথায় তার দেশ, কী তার ভাষা আমি জানি না; দূর থেকে দেখলাম, তিনি বোতল থেকে ঠান্ডা পানি পান করছেন। কাছেই এক বৃদ্ধা মহিলা সেদিকে তাকিয়ে আছেন তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে। হাজী ছাহেব হঠাৎ দেখতে পেলেন এবং বোতলটি বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে দিলেন। কয়েক ঢোক পান করার পর মহিলার বার্ধক্যপীড়িত চেহারায়ও সজীবতা ফিরে এলো। দৃশ্যটি দেখে আমি খুব আপ্লুত হলাম। আমার মন বললো, অচীন দেশের অচীন হাজী যেন আল্লাহকে পেয়ে গেলেন। কেয়ামতের দিন আল্লাহ যখন বলবেন, হে বান্দা! আমি পিপাসার্ত হয়ে তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, তুমি .. আল্লাহর এই পেয়ারা বান্দা তখন জলদি করে বলে ওঠবে, আমি তোমাকে পানি দিয়েছিলাম হে আল্লাহ! ঐ যে অহুদের ময়দানে! তখন কি আল্লাহ হেসে দেবেন না; তখন কি আল্লাহ বলে ওঠবেন না, আচ্ছা, যাও বান্দা, জান্নাতে যাও!
এমন আনন্দদায়ক দৃশ্য দেখেছি কিছু কিছু। তবে বিপরীত দৃশ্য চোখে পড়েছে অনেক। কিন্তু মন্দের উদাহরণ তুলে ধরে কী লাভ! কবির ভাষায়-
বুলবুলির মত শুধু গেয়ে যাও শুভ ও কল্যাণের গান/ অশুভ অসুন্দর যা, মুছে যাক তোমার গানের সুরে।
শুধু কামনা করি, আমি, তুমি- আমরা সকলে যেন চলতে পারি কল্যাণের পথে, আল্লাহকে পাওয়ার পথে।
তাওয়াফের পর মাকামে ইবরাহীমে দু’রাকাত আদায় করে যমযমের পাড়ে গেলাম এবং প্রাণভরে যমযম পান করলাম। পবিত্র যমযমের স্রোতধারা যেমন কখনো শেষ হবে না তেমনি যমযমের প্রশস্তিও বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না। যত বলবে, মনে হবে শেষ কথাটি এখনো বলা হয়নি। যত লিখবে মনে হবে এখনও রয়ে গেছে আরো কিছু লেখার। যখনই যমযম পান করি, পিপাসায় শুকিয়ে যাওয়া কলজে যেমন ভিজে শীতল হয় তেমনি হৃদয় ও আত্মাও যেন অপার্থিব এক প্রাপ্তিতে পরিতৃপ্ত হয়ে যায়। যখনই যমযমের পূর্ণ পাত্র আমার ঠোঁট স্পর্শ করে তখনই কল্পনায় ভেসে ওঠে সেই পবিত্র দৃশ্য! যমযমের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন আল্লাহর পেয়ারা নবী। তিনি যমযম পান করছেন, করেই চলেছেন। যমযমের পানি মুখে নিয়ে তিনি কুলি করছেন এবং সেই কুলির পানি যমযমের কূপে নিক্ষেপ করছেন। যাতে ছাহাবা কেরাম যেমন পেয়ারা নবীর পবিত্র থুথু থেকে বরকত লাভ করতেন, আনেওয়ালা উম্মতও যেন সে বরকত লাভ করতে পারে এই যমযমের পানি থেকে কত। আহা! কত দয়ার নবী! কেমন রহমতের নবী! যখনই যমযমের পানি পান করি, আমার সামনে সেই পবিত্র দৃশ্য ভেসে ওঠে এবং আমি অনুভব করি যমযমের পবিত্র পানির এবং পেয়ারা নবীর পবিত্র থুথুর মিশ্র স্বাদ! যমযমের পানিতে আমি যেন পাই সেই থুথুর আলাদা ঘ্রাণ!
যমযমের পানি পান করে ফেরার পথে সিঁড়ির মাথায় হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেলো মক্কা বালাদিয়ার প্রধান শায়খ আব্দুল আযীযের সঙ্গে। কয়েকদিন আগে হযরতের অনুগামীরূপে তার বাড়ীতে দাওয়াত খেয়েছিলাম। তিনি আমাকে চিনতে পেরে নিজেই এগিয়ে এলেন এবং উষ্ণ আন্তরিকতার সাথে মুছাফাহা করলেন। হযরতের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, ভালো আছেন। তিনি আপনাকে স্মরণ করেন, আপনার খুলুছ ও
আন্তরিকতার কথা আলোচনা করেন এবং আপনার জন্য দু‘আ করেন।
শায়খ আব্দুল আযীয আমাকে বললেন, তোমার কোন প্রয়োজন থাকলে নিঃসংকোচে বলো, সৌভাগ্য মনে করে আমি তোমার খেদমত করবো।
আরবের শরীফ মেযবান মেহমানকে এধরনের কথা বলে থাকেন। সবসময় বলে এসেছেন, এখনো বলেন এবং
আন্তরিকভাবেই বলেন। এটা তাদের আরবীয় মেহমানদারির অংশ।
সত্যি বলতে কি! আমার একটা প্রয়োজন ছিলো। গতকাল এমদাদিয়া কুতুবখানায় কাশফুযযুনূন কিতাবটি দেখেছিলাম। পয়সার জন্য নিতে পারিনি। আরো কয়েকটি কিতাব দেখেছি, শুধু আফসোসের দেখা। একবার মনে হলো, বলি তাকে কিতাবের প্রয়োজনের কথা। কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্য। বাইতুল্লাহ ছিলো আমার সামনে। লজ্জিত হলাম এবং মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করলাম। শায়খকে বললাম, আপনার এ মহানুভবতার জন্য জাযাকাল্লাহ। কিন্তু জনাব, আপনি নিজেই তো প্রয়োজনগ্রস্ত। আপনিও তো এই ঘর তাওয়াফ করে এসেছেন ঘরের মালিকের কাছে নিজের প্রয়োজন চাওয়ার জন্য! তাহলে আমি কেন এক প্রয়োজনগ্রস্তের কাছে আমার প্রয়োজন পেশ করবো! আমার প্রয়োজনও তিনি পুরা করবেন যিনি আপনার প্রয়োজন পুরা করেন।
আবেগের সাথে দিল থেকেই এসেছিলো কথাগুলো এবং মনে হলো শায়খের অন্তরকেও তা স্পর্শ করেছে। তিনি জাযাকাল্লাহ বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন যমযমের উদ্দেশ্যে।
আমার অন্তর কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হলো আমার আল্লাহর প্রতি। কালো গিলাফের পর্দায় ঢাকা বাইতুল্লাহর দিকে তাকালাম কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে। তোমার শোকর হে আল্লাহ! গোনাহগার বান্দাকে তুমি রক্ষা করেছো তোমার ঘরের সামনে বান্দার কাছে হাত পাতার লজ্জা থেকে।
ঐ সফরে ঐ কিতাবগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি সত্য। তবে
অন্তরে পূর্ণ আশ্বস্তি ছিলো যে, কিতাবের আসল যে উদ্দেশ্য তা অবশ্যই আল্লাহ আমাকে দান করবেন।
বাইতুল্লাহর দিকে তাকিয়ে ছিলাম অশ্রুসিক্ত চোখে সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে। তখন মনে পড়লো অনেকবার কিতাবে পড়া সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি। মুসলিম জাহানের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী খলিফা হারুন রশীদ হজ্বের সফরে আসছেন। খবর শুনে বিভিন্ন এলাকার প্রয়োজনগ্রস্ত লোকেরাও মক্কায় জমায়েত হতে লাগলো। এই সুযোগে খলিফার কাছে তারা নিজ নিজ অভাব-অভিযোগ তুলে ধরবে। অভাবগ্রস্ত এক বেদুঈনও নিজের বালকপুত্রকে সঙ্গে করে মক্কায় হাজির হলো। বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করার সময় সে দেখতে পেলো অভাবিতপূর্ব এক দৃশ্য। বাইতুল্লাহর গিলাফ ধরে জারজার হয়ে কাঁদছেন খলিফাতুল মুসলিমীন বাদশাহ হারুন রশীদ! আরব বেদুঈনের অন্তরে যেন একটি আলোর ঝিলিক খেলে গেলো! তার চোখ থেকে যেন মাদ্দিয়াতের পর্দা সরে গেলো এবং হাকীকতের নূর দৃষ্টিকে আলোকিত করলো। অভাবগ্রস্ত আরব বেদুঈন মুহূর্তের মাঝেই যেন হয়ে গেলো বাদশাহ হারুন রশীদের চেয়ে ধনবান।
আসলে অভাব কাকে বলে? অভাব তো বলে হৃদয়ে ভাবের অনুপস্থিতিকে! হৃদয় যখন ভাবে পূর্ণ হয় তখন কোন অভাব থাকে না। সব অভাব মুহূর্তে দূর হয়ে যায়। ভাবের অভাবই আসল অভাব। বাইতু্ল্লাহর গিলাফ ধরে বাদশাহ হরুন রশীদের কান্নার দৃশ্য অবলোকন করে আরব বেদুঈনের হৃদয়রাজ্যে ভাবের এমন তরঙ্গ সৃষ্টি হলো যে, মুহূর্তে তার সব অভাব দূর হয়ে গেলো। আপন পুত্রকে সম্বোধন করে আবেগ-উদ্দীপ্ত কণ্ঠে সে বলে উঠলো-
‘উনযুর ইয়া বুনাইয়া! কাইফা ইয়াতাদাররা‘উ জাববারুল আরদি ইলা জাববারিস-সামাই’
(দেখো হে প্রিয় পুত্র! যমিনের বাদশাহ কিভাবে আসমানের বাদশাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করে!)
আরব বেদুঈন ভাবতে লাগলো, তাহলে আমি কেন এসেছি দুনিয়ার বাদশাহর কাছে আসমানের বাদশাহকে ভুলে! যে দরবারের ভিখারী স্বয়ং হারুন রশীদ, সেই দরবার ছেড়ে আমি কেন হাত বিছাবো এক কাঙ্গালের দরবারে!
আরববেদুঈন এভাবে নিজেই শুধু শিক্ষা লাভ করলো না, নিজের আগামী প্রজন্মের সামনেও তুলে ধরলো এক পরম শিক্ষা। পুত্রকে সঙ্গে করে আরববেদুঈনও জড়িয়ে ধরলো বাইতুল্লাহর গিলাফ। একাকার হয়ে গেলো রাজা ও প্রজা রাজাধিরাজের ঘরের গিলাফ ধরে। হে আল্লাহ! আমার প্রয়োজন তোমার কাছে, শুধু তোমার কাছে; কোন বান্দার কাছে নয়, নয় বাদশাহ নামের কোন ফকীরের কাছে।
হজ্ব শেষে আরববেদুঈন দিলের ধনে ধনী হয়ে ফিরে গেলো বাদশাহ হারুন রশীদের সঙ্গে দেখা না করে। এভাবে শুধু নিজেই ধনী হলো না সে, ইতিহাসের পাতায় আমাদেরও জন্য রেখে গেলো অমূল্য এক সম্পদ। আল্লাহর নবী সত্যই বলেছেন-
‘লাইসাল গিনা গিনাল মাল, ইন্নামাল গিনা গিনান-নাফসি’
(সম্পদের প্রাচুর্য প্রাচুর্য নয়, আসল প্রাচুর্য হলো হৃদয়ের প্রাচুর্য)
কত শত বছর আগের আরববেদুঈন আমারও হৃদয়ে ভাবের এক তরঙ্গ সৃষ্টি করলো। আমিও এগিয়ে গেলাম বাইতুল্লাহর দিকে নতুন ভাবে, নতুন অনুভূতিতে উদ্দীপ্ত হয়ে এবং জড়িয়ে ধরলাম বাইতুল্লাহর গিলাফ। হে আল্লাহ! আমার প্রয়োজন যেন হয় শুধু তোমার কাছে। আমার মিনতি ও প্রার্থনা যেন হয় শুধু তোমার দরবারে।
হে আল্লাহ! তুমি যা পূর্ণ করবে সেটাই হলো আমার প্রয়োজন; তুমি যা পূর্ণ করবে না সেটা আমার প্রয়োজন হতে পারে না, সেটা হবে প্রয়োজনের ভ্রান্তি। হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রয়োজন পূর্ণ করো এবং প্রয়োজনের ভ্রান্তি থেকে আমাকে রক্ষা করো।
হে আল্লাহ! আমার প্রয়োজন তো কিতাবের নয়, ইলমের। তুমি আমাকে ইলমের নূর দান করো কিতাবের পাতা থেকে, কিংবা তোমার কোন বান্দার সিনা থেকে, অথবা সরাসরি তোমার ইলমের খাযানা থেকে।
বাইতুল্লাহর গিলাফ ধরে মুনাজাত আরো অনেক করেছি, কিন্তু সেই মুনাজাতের শান্তি ও প্রশান্তি ছিলো অন্যরকম। তাতে শুধু প্রার্থনার আকুতি ছিলো না, ছিলো প্রার্থনা শ্রবণকারীর পক্ষ হতে কবুলিয়াতের আশ্বস্তি। এমন একটি মুনাজাতের সৌভাগ্য লাভ করার ওছিলা ছিলেন শায়খ আব্দুল আযীয, যিনি আমাকে দিতে চেয়েছিলেন কিছু অর্থসম্পদ, কিন্তু তার মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে দান করলেন প্রাপ্তি ও পরিতৃপ্তির এমন অমূল্য সম্পদ যার জন্য আমি হাসিমুখে উৎসর্গ করতে পারি পৃথিবীর সব সম্পদ। সেই উপকারী বন্ধুকেও আল্লাহ সম্পদশালী করুন, আমীন।
পরে হযরতকে আমি এ ঘটনাটি সবিস্তারে বলেছিলাম। তুমি খুব খুশী হয়ে বলেছিলেন, তুমনে বহুত আচ্ছা কিয়া। হযর সেদিন আমাকে অনেক দু‘আ দিয়েছিলেন।
ঘড়ির কাঁটা এবং সময়ের চলন্ত চাকা থেমে নেই। আরেকটি সূর্য অস্ত গেলো। জীবনের সৌভাগ্য থেকে আরেকটি দিন কমে গেলো। আর আছে মাত্র দু’টি দিন। মদীনা থেকে বিদায়ের সময় সান্ত্বনা ছিলো যে, এখন আমাদের মন্যিল হবে মক্কা। সবুজ গম্বুজ হয়ত আর দেখবো না, কিন্তু আমার চক্ষুকে শীতল করবে বাইতুল্লাহর কালো গিলাফ। তখন বিদায়ের বেদনায় ছিলো আরো বড় মিলনের আনন্দ-হিল্লোল। কিন্তু এবার! এবার কিসের মাঝে পাবো
সান্ত্বনার একটু পরশ!
হঠাৎ মনে হলো, কোন একটি শীতল পরশ যেন হৃদয়ের সবটুকু দহন শুষে নিলো। এই তো আমার সান্ত্বনা! ঘর এখানে, কিন্তু ঘরের মালিক তো সময় ও সীমানার উর্ধ্বে! তিনি তো বান্দার স্কন্ধশিরারও নিকটে। হয়ত ঘরের সান্নিধ্যের ইতি হবে, কিন্তু ঘরের মালিকের সান্নিধ্য তো থাকবে চিরকাল। মৃত্যুর এপারে এবং মৃত্যুর ওপারে। ঘরের দীদার শুরু হয়, আবার শেষ হয়, কিন্তু জান্নাতে ঘরের মালিকের দীদার যখন শুরু হবে, শেষ হবে না কোন দিন। সেই মহাদীদারের অস্থির প্রতীক্ষার মধুর বেদনা আমি বহন করবো চিরকাল। আসলে এখানে এসেছিলাম কী জন্য?! আমি তো এসেছিলাম ঘরের দীদারের মাধ্যমে ঘরের মালিকের মহাদীদারকে স্মরণ করার জন্য। এই দীদারের আনন্দ-বেদনা দ্বারা সেই দীদারের ব্যাকুলতাকে আরো সজীব করার জন্য, যা এগিয়ে আসছে একটু একটু করে, একদিন একদিন করে! হজ্বের সফর তো ছিলো সেই মহাসফরকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য, যার পরিণতি হবে ইনশাআল্লাহ ঘরের মালিকের মিলন ও দীদার! সেই মিলনের স্বাদ ও শান্তি, সেই দীদারের
লয্যত ও প্রশান্তি এখন তুমি বোঝবে না হে বান্দা! এখন তুমি বোঝবে না! এখন শুধু অনুভব করতে চেষ্টা করো অস্থির প্রতীক্ষার মধুর বেদনার অপূর্ব স্বাদ। ঘর থেকে তোমার বিদায় হবে, ঘরের মালিকের সান্নিধ্য থেকে তো বিদায় হবে না, যদি নিজে তুমি বিদায় না হও। তিনি তো আছেন তোমার সঙ্গে, তুমি যখন জাগ্রত তখনো, তুমি যখন ঘুমন্ত তখনো! তুমি যখন তাঁকে স্মরণ তখনো, তুমি যখন তাঁকে ভুলে যাও তখনো!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)