রবিউল আউয়াল ১৪৩০   ||   মার্চ ২০০৯

উ ম্মা হ : শান্তিচুক্তিতে মোড়লদের উদ্বেগ দেখুন!

আবু তাশরীফ

পাকিস্তানের একটি বিশাল উপত্যকার নাম সোয়াত। দেশটির উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এই উপত্যকার অবস্থান। পাহাড় ও সবুজ সমতল ভূমিবেষ্টিত এই প্রদেশটিতে বহু লড়াই-সংগ্রাম,

অভিযান-আক্রমণের পর গত মধ্য ফেব্রুয়ারিতে শরীয়া আইন চালুর চুক্তি হয়েছে। চুক্তি হয়েছে আঞ্চলিক ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে। কিন্তু এর সঙ্গে পাকিস্তান সরকারেরও সম্পর্ক ও সমর্থন রয়েছে। এ চুক্তির ভিত্তিতে সেখানে সশস্ত্র ও সংগ্রামরত তালেবানপন্থী ইসলামী শক্তি ও   পাকিস্তান আর্মির মাঝে চলমান সশস্ত্র লড়াই বন্ধ হয়েছে। ইসলামী শরীয়াভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও বাস্তব হয়ে উঠেছে।

পাকিস্তানের একটি প্রদেশে, যেখানে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় রয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি, সেখানে ইসলামী বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া যে কোনো দেশের যে কোনো মুসলমানের জন্যই আনন্দদায়ক সংবাদ। যে অঞ্চলটিতে পাক আর্মি আর স্থানীয় জনতার মাঝে বন্দুক লড়াইয়ে প্রতিদিন হতাহতের ঘটনা ঘটতো, একটি চুক্তির মাধ্যমে সেখানে শান্তি স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনাও যে কোনো পাকিস্তানী নাগরিকের জন্য এবং  যে কোনো মানবতাবাদী মানুষের জন্যও সুখবর হতে পারে। কিন্তু এ ঘটনাটি নিয়ে দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো এবং পশ্চিমা মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট সংশয়পূর্ণ, নিরুৎসাহব্যাঞ্জক ও হতাশাজনক। এমনকি এ বিষয়ে বর্তমান পাকিস্তান সরকারের ওপর পশ্চিমাদের চাপ ও উদ্বেগের বিষয়টিও গোপন থাকেনি। এ কারণে চুক্তির পরও সোয়াতে শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা ও শান্তিস্থাপনের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানামুখি সংশয় ফুটে উঠছে।

১৭ ফেব্রুয়ারির বিবিসি অন লাইনের খবরে প্রকাশ-অবশেষে পাকিস্তান সরকার ও তালেবানের মাঝে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী  পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ইসলামী শরীয়া কার্যকর করা হবে।এই চুক্তির কথা ঘোষণার পর একদিকে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছে, অপরদিকে ব্যাপকভাবে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। প্রদেশসূত্রে বলা হয়েছে, এই বিচারব্যবস্থা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের মালাকান্দ বিভাগে কার্যকর করা হবে। মানবাধিকার গ্রুপগুলো অবশ্য আশংকা প্রকাশ করেছে, সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা সামাজিক  বিশৃঙ্খলা বাড়িয়ে তুলবে এবং একসময় সুশীল সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করবে। একই দিন ও তারিখে নয়াদিল্লী থেকে রয়টার্স জানিয়েছে-ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শীর্ষনিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুক বলেছেন-পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার জঙ্গিরা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তানের জন্য হুমকি। ভারত ও পাকিস্তান সফরের সময় দু দেশের নেতাদের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং নিরাপত্তা বিষয়ে তার উদ্বেগের কথা তাদের অবহিত করেছেন বলে জানিয়েছেন হলব্রুক। নয়াদিল্লীতে সাংবাদিকদের তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার ৬০ বছরের মধ্যে আপনাদের দেশ,   পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র সবাই এই প্রথম এমন কোনো শত্রুকে মোকাবিলা করছি যারা আমাদের নেতৃত্ব, আমাদের সরকার ও আমাদের জনগণের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। পাকিস্তানের একসময়ের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র সোয়াত উপত্যকাকে ইঙ্গিত করে হলব্রুক এ কথা জানিয়েছেন। সোয়াতে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর পশ্চিমা নেতা ও মিডিয়াগুলোর এ ধরনের উদ্বেগ-বিষোদগারে মনে হতে পারে সাম্প্রতিক কালে এই উপমহাদেশে কোনো সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন এবং তাদের দিয়ে প্রশাসন কিংবা নেতৃত্ব চালানোর মতো ঘটনা এটাই প্রথম। এবং এমন চুক্তি করা আসলে উচিত নয়। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে নেপালে দীর্ঘকাল সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত মাওবাদীদের নেতা প্রচন্ড শান্তিচুক্তিতে এসে নির্বাচন করে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন-এখনও দুবছর হয়নি।  সে ধাক্কায় নেপালে রাজতন্ত্রেরও অবসান হয়েছে। সেটা নিয়ে পশ্চিমা শক্তি ও মিডিয়াগুলো কোনো আপত্তি-উদ্বেগের কথা তো বলেইনি, উল্টো উচ্ছাস প্রকাশ করেছে। কিন্তু সোয়াতের বেলায় এসে তারা বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এটা কি কেবল এজন্যই যে, পশ্চিম থেকে আসা কোনো মতাদর্শ ও ব্যবস্থার পরিবর্তে সোয়াতে কার্যকর করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ইসলামী শরীয়া আইন? এ প্রশ্নের উত্তর যাদের দেওয়ার কথা, তারা কখনই হয়তো সে উত্তর দিবেন না, কিন্তু সাদা চোখে এর ভালো উত্তর হ্যাঁ ছাড়া আর কী পেতে পারি? সোয়াতচুক্তি ও পরিস্থিতি নিয়ে মোড়লদের এত নড়াচড়া-উদ্বেগ ও পেরেশানী লক্ষ্য করলে এ আশংকাই চেপে বসে যে, সোয়াতে শান্তি ও শরীয়ার বাস্তবায়ন মোড়লরা হয়তো শেষ পর্যন্ত হতে দিবে না।

পাক রাজনীতি ও পাকিস্তানে মার্কিনী আক্রমণ নীতির বিশ্লেষকদের অনেকেই আবার আশংকা প্রকাশ করছেন যে, সোয়াতকে মার্কিনীদের গুপ্ত খুন ও হামলার একটি বধ্যভূমি বানানোর জন্য চুক্তির এ ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। সোয়াতের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ যখন শান্তির প্রতি পূর্ণ আস্থা ও অঙ্গীকার নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে নেমে আসবেন তখনই আগ্রাসী শকুনের ছোবল পড়তে পারে সেখানে। এমনতর বহু শংকা ও দুর্ভাবনার মধ্যেও শান্তি ও  ইনসাফের দিকে উপমহাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশের অভিযাত্রা যেন নিরাপদ ও সাফল্যময় হয় উম্মাহর একেকজন বন্ধনভুক্ত সদস্য হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই সেই মুনাজাত করি।

 


 

 

advertisement