মহানবী যখন এলেন
একটি মরুময় দেশ। প্রতিদিন সে দেশে একটি রক্তিম সূর্য ওঠে। খেজুর গাছের পাতায় তার কিরণ পড়ে। মানুষের ঘুম ভাঙে। সে দেশের মানুষ পরিশ্রমী এবং কর্মঠ। বেলা বাড়তেই তাদের কর্মচাঞ্চল্যও বাড়ে। একসময় দুপুর হয়। সূর্যের প্রখর তাপে মরুর বালুকারাশি যেন আগুন হয়ে যায়। বিকেল গড়িয়ে গেলে সবাই ঘরে ফিরে আসে। সন্ধ্যায় উন্মুক্ত আকাশের নিচে তাদের আসর বসে। আনন্দ-ফূর্তিতে, ঠাট্টা-রসিকতায় সবাই সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে যায়। সে আসরে কবিতা পাঠ হয়। মদ্যপান হয়। যারা দূর দেশে যান ব্যবসা করতে; তারা শোনান বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। আবার সমাজের নানা বিষয়ে আলাপ হয়। বিচার-মীমাংসাও হয়। একসময় সবাই ঘরের দিকে পা বাড়ায়। বিশাল বিপুল মরুদেশ নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
সে দেশের নাম আরব উপদ্বীপ। সে দেশের মানুষ দুর্দান্ত সাহসী এবং নির্ভীক। সামান্য বিষয় নিয়েও তারা তুমুল লড়াই করতে দ্বিধা করে না। নিজের সম্মানে সামান্যতম আঘাত তারা সহ্য করে না। কোনো দিগ্বিজয়ী সম্রাটই আরব দেশ পদানত করতে পারেনি। আরবরা বীরত্ব ও সাহসিকতায় যেমন শ্রেষ্ঠ; তেমনি শ্রেষ্ঠ দানশীলতা ও সহমর্মিতায়। তাদের দানশীলতা সবাইকে হতবাক করে। অভাবীর প্রয়োজনে তারা নিজের ঘর পর্যন্ত খালি করে দেয়। তারা মহৎপ্রাণ। তারা বীরপুরুষ। আরো অনেক গুণ তাদের।
কিন্তু নানা রকম চারিত্রিক ত্রুটিও তাদের আছে। তারা বিনা কারণে খুন খারাবি, লুটতরাজ করে। জৈবিক আহবানে তারা পশুবৃত্তি করে। আরব মদ্যপান করে। সুদ খেয়ে খেয়ে গরীবের অভাব আরো বাড়িয়ে দেয়। তারা কলহপ্রিয়। ক্ষমা করতে জানে না। আর ...।
আর তারা মূর্তির উপাসনা করে। তিন শ ষাটটি মাটির পুতুলের সামনে মাথা ঝুকিয়ে মানবের সম্মান ভুলুন্ঠিত করে। আরবরা অশিক্ষিত, বর্বর। বিদ্যাচর্চা তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। ইত্যাদি কারণে আরবদেশে যেন চলছে এক গভীর আঁধার যুগ।
হঠাৎ এই ভয়াবহ আঁধারে একটি ছোট্ট আলোকশিখা জ্বলে উঠল। গভীর বনের মধ্যে যেন একটি প্রদীপের আলো। আলোকশিখাটি যে-ই জ্বলল, শুরু হল প্রচন্ড বাতাস। শোঁ শোঁ বাতাসে প্রদীপটি যেন নিভেই যাবে। বিক্ষুব্ধ ঝড়ো হাওয়া চায় না এই নিশ্ছিদ্র আঁধারে কোনো আলো জ্বলুক। সেই ঝড়ো হাওয়ার এক কথা, এত দিন তো আমরা অন্ধকারই দেখেছি। অন্ধকারই তো ভালো। এই নতুন আলো কোত্থেকে উদয় হল? সে কেন আমাদের এতদিনের আঁধার দূর করতে চায়? কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে আলোটি জ্বলেই রইল।
একদিন সেই ঐশী প্রদীপের আলোয় মরুবাসী আরবের হৃদয়ে আলো জ্বলল। তাদের রুক্ষ অন্তর প্রেমরসে সিক্ত হল। অশিক্ষিত আরব জ্ঞান লাভ করল। তারা মারামারি হানাহানি ভুলে গেল। ভাই ভাই হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। মদ্যপান ত্যাগ করল। মাটির পুতুল ভেঙ্গে চুরমার করল। দিকে দিকে মানবের মহিমা উচ্চকিত হল।
আরব এখন ধোকা দেয় না। মিথ্যা বলে না। জুলুম করে না। খেয়ানত করে না। দ্বিধাবিভক্ত আরব সম্মিলিত একটি শক্তি হয়ে উঠল। সেই শক্তি মহানবীর আনীত নবধর্মের শক্তি। সে শক্তি কী করল? কায়সার ও কিসরার সিংহাসন কাঁপিয়ে দিল। আধা জাহান জয় করল। তারা ছড়িয়ে দিল সত্যের সওগাত, ভ্রাতৃত্বের পয়গাম, জ্ঞানের আলো এবং মানবতার শাশ্বত জয়গান।