রবিউল আউয়াল ১৪৩০   ||   মার্চ ২০০৯

মেহরে নবুওয়ত

কাযী মুহাম্মাদ সুলায়মান সালমান মনসুরপুরী রাহ.

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ষষ্ঠ হিজরীর পর আরো অনেক প্রসিদ্ধ ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তাঁরা প্রথমে ইসলাম সম্পর্কে শুনেছেন এরপর নিজেরা খোঁজ-খবর নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে জেনেছেন। যখন ইসলামের সত্যতা তাদের সামনে পরিষ্কার হয়েছে তখন তারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কিছু প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নাম এই :

* ছুমামা। নজদের শাসনকর্তা। ৬ষ্ঠ হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

* জাবালা। গাসসানের অধিপতি। ৭ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

* ফারওয়া ইবনে আমর খুযায়ী। কায়সারের পক্ষ থেকে শাম অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। ৭ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

কায়সার তাকে ইসলাম ত্যাগ করার আদেশ দিল কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করলেন। এতে তাকে বন্দী করার আদেশ দেওয়া হল। এরপরও তিনি অবিচল থাকলেন। পরিশেষে কায়সার তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দিল। ফাঁসির মঞ্চে দাড়িয়েও তিনি আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করলেন যে, মুসলমান হিসেবে আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু দিচ্ছেন।

* খালেদ ইবনুল ওয়ালীদ রা., উছমান ইবনে আবু তলহা রা., আমর ইবনুল আস রা. ছিলেন মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। ৮ম হিজরীতে তাঁরা স্বেচ্ছায় মদীনা মুনাওয়ায় পৌঁছলেন এবং মুসলমান হলেন।

* ইসলামের প্রসিদ্ধ দুশমন আবু জাহল-এর পুত্র ইকরামা ছিলেন মক্কার প্রসিদ্ধ নেতা ও বীর পুরুষ। ৮ম হিজরীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

* আদী তাঁর অঞ্চলের সর্দার এবং বীর পুরুষ ছিলেন। প্রসিদ্ধ দানবীর হাতেম তাঈ তাঁর পিতা। ৯ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

* উকায়দার। দুমাতুল জানদাল-এর প্রশাসক ছিলেন। ৯ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

* যুলকিলা। তায়েফ ও ইয়ামানের কিছু অংশ এবং হিময়ারের গোত্রসমূহের সর্দার। তাকে খোদা বলা হত এবং সিজদা করা হত। ৯ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলমান হওয়ার পর রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করে দরবেশের জীবন ধারণ করেছিলেন।

বিভিন্ন গোত্রের ইসলাম গ্রহণ

রাজা-বাদশাহ, শাসক-প্রশাসক ছাড়াও আরবের বড় বড় কবীলা, যারা ইসলামের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং দূর-দূরান্ত থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাতে মদীনা মুনাওয়ারায় আগমন করেছে তাদের সংখ্যাও কম নয়। এ সম্পর্কে রহমাতুল্লিল আলামীন গ্রন্থে অধ্যয়ন করা চাই।

৮ম হিজরী

এই বছর মক্কা-বিজয় হল। যে নগরী ত্যাগ করতে কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাধ্য করেছিল, যেখানে অসহায় মুসলমানদের টিকে থাকা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং যেখানে ইসলামের কথা বলাও কঠিন ছিল আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে সে নগরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর করতলগত হল। কাবা শরীফ থেকে ৩৬০ টি মূর্তি, যা কাফেররা প্রতিষ্ঠিত করেছিল, বের করা হল এবং চার হাজার বৎসর পূর্বে যে উদ্দেশ্যে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল, অর্থাৎ এক আল্লাহর ইবাদত,  পুনরায় সেখানে হতে থাকল।

৯ম হিজরী

১. এই বছর হজ্ব ফরয হল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.কে হাজীদের কাফেলার আমীর নিযুক্ত করলেন। কয়েক শত মুসলিম এ বছর হজ্ব আদায় করলেন।

২. হজ্বের ময়দানে হযরত আলী রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশে ঘোষণা করলেন যে, আজ থেকে কোনো মুশরিক কাবা ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। কোনো নারী বা পুরুষ উলঙ্গ হয়ে কাবা ঘর তাওয়াফ করতে পারবে না। যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে তাদের সঙ্গে কোনো চুক্তি বহাল থাকবে না।

গযওয়াসমূহ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনা আগমন করেন তখন কাফেররা তাদের সকল শক্তি একত্র করে কয়েকবার মুসলমানদের উপর আক্রমণ করেছিল। চার বছর পর্যন্ত মুসলিমগণ ধৈর্য্য ধারণ করেন। এরপর তারাও কয়েকবার আক্রমণ করে শত্রুবাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করেন।* যুদ্ধের এই ধারাবাহিকতা দ্বিতীয় হিজরী থেকে আরম্ভ হয়ে নবম হিজরী পর্যন্ত মোট সাত বছর অব্যাহত ছিল। প্রসিদ্ধ যুদ্ধগুলো হচ্ছে :

১. গযওয়ায়ে বদর : ২ হিজরী।

২. গযওয়ায়ে উহুদ : ৩ হিজরী।

৩. গযওয়ায়ে খন্দক : ৫ হিজরী।

৪. গযওয়ায়ে খায়বর : ৫ হিজরী।

৫. গযওয়ায়ে ফতহে মক্কা : ৮ম হিজরী।

৬. গযওয়ায়ে হুনায়ন : ৮ম হিজরী।

৭. গযওয়ায়ে তবূক : ৯ম হিজরী।

১০ম হিজরী

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্ব করলেন। এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার মুসলিম তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। এই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের সকল মৌলনীতি বুঝিয়েছেন। জাহেলিয়াতের রসম-রেওয়াজ, শিরকের রীতি-নীতি বিলুপ্ত করেছেন এবং উম্মতকে বিদায় জানিয়েছেন।

১১শ হিজরী

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২৩ বছর পাঁচ দিন পর্যন্ত আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বান্দাদের কাছে পৌঁছিয়ে, সরল সঠিক পথ দেখিয়ে ৬৩ বছর পাঁচ দিন বয়সে বার রবীউল আউয়াল সোমবার দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

খুতবা

(ওয়াহিদী বর্ণনা করেন,) ওফাতের এক মাস পূর্বে সবাইকে একত্র করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুসলমানরা! আল্লাহ তোমাদেরকে নিরাপদে রাখুন, তোমাদের প্রতি রহমত নাযিল করুন, তোমাদেরকে রিযিক দান করুন এবং  তোমাদের সাহায্য করুন। তোমাদেরকে উচ্চতা দান করুন এবং নিজের আশ্রয়ে স্থান দান করুন,  তোমাদেরকে তাকওয়া ও খোদাভীতির উপদেশ দিচ্ছি। তোমাদেরকে আল্লাহর সোপর্দ করছি এবং তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে সাবধান করছি। তোমরা আল্লাহর যমীনে ও আল্লাহর বান্দাদের উপর জুলুম করো না। আখিরাতের ঘর তাদেরই জন্য, যারা দুনিয়াতে দম্ভ ও জুলুম করে না এবং ফাসাদ ছড়ায় না। শুভ পরিণাম একমাত্র মুত্তাকীদের জন্য।

আরো ইরশাদ করেন-তোমরা যে বড় বড় সাম্রাজ্য লাভ করবে তা আমি দেখেছি। আমি এই আশঙ্কা করি না যে, তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে। তবে আশঙ্কা করি, দুনিয়ার লোভ-লালসা ও ফিৎনা-ফাসাদের মধ্যে জড়িয়ে ধ্বংস হয়ে যাও কি না, যেভাবে পূর্বের উম্মতরা ধ্বংস হয়েছে।

ইন্তেকালের কিছু দিন আগে সকল মুসলমানকে একত্র করলেন এবং আনসার ও মুহাজিরদের সম্পর্কে বিভিন্ন নির্দেশনা দিলেন ও নসীহত করলেন। এরপর বললেন, কারো কোনো হক যদি আমার উপর থাকে তাহলে সে যেন তা প্রকাশ করে। এক সাহাবী বললেন, হুজুর, এক মিসকীনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে তিন দিরহাম দিয়েছিলেন, তা আমি পাইনি। সঙ্গে সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পরিশোধ করলেন। এরপর অনেকের জন্য দুআ করলেন।

অসুস্থতার দিনগুলোতে বলেছেন, লোকেরা! দাস-দাসীর বিষয়ে আল্লাহকে স্মরণ রেখো। তাদের অন্ন-বস্ত্রের বিষয়ে যত্নবান থেকো এবং তাদের সঙ্গে সর্বদা নম্র ব্যবহার করো।

 জীবনের অন্তিম মুহূর্তে তাঁর পবিত্র বাণী ছিল-নামায! নামায! দাসের অধিকার! সর্বশেষ শব্দ যা আকাশের দিকে চোখ তুলে ইরশাদ করেছেন তা ছিল-আল্লাহুম্মা ফির রাফীকিল আলা।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* টীকা : এ প্রসঙ্গে সীরাতের বিশদ গ্রন্থাবলি অধ্যয়ন করা চাই।

 

 

advertisement