আরবের চাঁদ
গুনাহ ও অবাধ্যতা, কুফর ও ভ্রষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, পথভোলা আরবজাতি আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কৃত অঙ্গিকার বেমালুম ভুলে গিয়ে আল্লাহর ঘরকে মূর্তির ঘরে পরিণত করেছিল।
আফসোস! যে কপাল সৃষ্টি হয়েছিল শুধু আল্লাহর সামনে সেজদাবনত হওয়ার জন্য তা আজ নিষ্প্রাণ, জড় মূর্তির সামনে অনবরত ঝুকে সৃষ্টির সেরা মানবকে সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টিতে পরিণত করেছিল।
আহা! এটাই তো সেই বাইতুল্লাহ, যা পবিত্র রাখতে ইবরাহীম খলীলুল্লাহ ও ইসমাঈল যাবীহুল্লাহ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আদিষ্ট ছিলেন। সেই বাইতুল্লাহ যখন মূর্তির ঘরে পরিণত হল ও তাতে ৩৬০টি মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল তখন তাদের আত্মা কতই না ব্যাথিত হয়েছিল!
ভ্রষ্টতা ও গোমরাহীর এই তিমির রাতে পৃথিবীর কোথাও সভ্যতা ও মানবতার কোনো আলোকরেখা চোখে পড়ছিল না। ভদ্রতা ও শরাফত যেন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। স্বভাবের প্রকৃত সৌন্দর্য ও সরলতা এবং আত্মার শাশ্বত রূপ-কোমলতা কুফরী ও গোমরাহীর আঁধারে হারিয়ে গিয়েছিল। এহেন অবস্থায় যখন অবিশ্বাস ও অবিচারের অশুভ প্রেতাত্মা সাড়া দুনিয়ায় কালনাগিনীর মতো তার বিষাক্ত কুন্তলরাশি বিছিয়ে দিয়েছিল আর মানুষ আল্লাহর শক্তি ও মর্যাদা ভুলে সেই প্রেতাত্মার প্রণয়ভিখারী হয়ে অবাধ্যতা ও মূর্তিপূজার অভিশপ্ত শিকলে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছিল তখন মানবতা একবার মৃত্যুর পর যেন পুনরায় জীবন লাভ করল। সেই ইতিহাসটাই একটুখানি বলি।
আজ থেকে তেরো শত বছর পূর্বে আরব দেশের মক্কা শহর থেকে একটি নব বিপ্লবের শ্লোগান ভেসে এল, যা অন্যায় ও অবিচারের জগতে যেন ঘটিয়ে দিল মহাপ্রলয়। আর হেদায়েতের প্রশ্রবণ প্রবাহিত হল, যা হৃদয়ের বিরাণ ভূমিকে সবুজ-শ্যামল উদ্যানে পরিণত করল। এই মরু-উদ্যানেই আধ্যাত্মিকতার ঐ ফুল ফুটে উঠল, যার চিত্তাকর্ষক সুরভি ধর্মহীনতার পুঁতি গন্ধময় মস্তিষ্ককে সুবাসিত ও বিমোহিত করে তুলল।
ওই মরুপ্রান্তরের নিকষ কালো দিগন্ত থেকে মূর্খতা ও বিপথগামিতার তিমির রাতে সততা ও সত্যের ঐ চন্দ্র উদিত হল, যার জোৎস্নাধারায় সকল আঁধার দূর হয়ে আরবের মরুভূমি যেন তূর পর্বতের জন্যও হয়ে উঠল ঈর্ষণীয়। যেন হেমন্তের স্থলে বসন্তের আগমন ঘটল। শয়তানের প্রভুত্ব দূর হয়ে দুনিয়াজুড়ে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত হল। সত্যের বিজয় ঘটল আর মিথ্যা বিদূরিত হল। একটু পিছনে যাই।
কুরাইশের উচ্চ মর্যাদাবান ও শীর্ষস্থানীয় নেতা আবদুল মুত্তালিব এর বিবাহ হয়েছিল একজন সতী, গুণবতী নারী বিবি ফাতেমার সাথে। তাদের ভালোবাসার বাগানে ফুটন্ত ফুল ও কলির মধ্যে একটি ফুল ছিল একটু বিশেষ সৌন্দর্যমন্ডিত। যার জন্য হাজার বুলবুল ছিল প্রাণ-বিসর্জিত। এই ফুল হলেন আবদুল্লাহ। তিনি আবদুল মুত্তালিবের সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ছিলেন। কুদরত তাকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যে মন্ডিত করার জন্য যেন বদ্ধ খাজানার মুখ খুলে দিয়েছিল। রূপ-সৌন্দর্যের জাদুমাখা টান তো অস্বীকার করা যায় না। তাঁর উজ্জ্বল তারুণ্য ও জাদুময়ী বচনভঙ্গি লৌহতুল্য অনঢ় হৃদয়কেও চুম্বকের মতো তাঁর প্রতি আকর্ষণ করত। আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী রমনীরাও, যারা নিজেদের রূপ-সৌন্দর্যে দম্ভভরে চলত তারাও তাঁর জীবনসাথী হওয়াকে পরম সৌভাগ্য বলে মনে করত। কত রূপসী তরুণী তাঁর প্রেমে পাগল ও বিচলিত ছিল। যখন তিনি যুহরা গোত্রের সর্দার ওয়াহহাব ইবনে আবদ মানাফ এর কন্যা বিবি আমিনার সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হলেন তখন দুঃখে ও আক্ষেপে তাদের কতজন জীবন থেকেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
বিবাহের সকল কার্য সম্পন্ন হয়ে গেলে আবদুল্লাহ নিজের পূতঃপবিত্র ও প্রাণাধিক স্ত্রী আমেনার সাথে অল্প কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। এ অল্প সময়ের মধ্যেই আ আমিনা নূরে মুহাম্মাদীর আমানতদার হয়ে গেলেন।
(কথিত আছে যে,) এ সময় আবদুল মুত্তালিব একটি স্বপ্ন দেখলেন। একটি লাল উজ্জ্বল তারকা ভূমির নিম্নাঞ্চল থেকে উদয় হয়ে উচ্চাকাশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। যার রশ্মি চাঁদ-তারকার রশ্মিকেও ম্লান করে দিল। সৃষ্টিজগতে সে আলোর বন্যা বইয়ে দিল এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম তার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল।
স্বপ্নের তাবীরকারী ব্যাখ্যা করে বলল, এই উজ্জ্বল নক্ষত্র হল সে সম্মানিত নবী, যিনি হযরত আবদুল্লাহর ঔরষে জন্মলাভ করবেন। যার সত্য ধর্মের আলো পৃথিবীর সকল ধর্মকে আচ্ছন্ন করে দিবে। আর গোটা দুনিয়ায় তা বিস্তৃত হবে এবং এই ধর্মে মানুষের প্রয়োজনগুলোর সমাধান থাকায় তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে।
অবশেষে একদিন সেই শুভ মুহূর্তটি এল যার অপেক্ষায় নভোমন্ডল-ভূমন্ডলের প্রতিটি ক্ষুদ্রকণা পর্যন্ত অধীর ছিল। তখন বসন্তের ছিল নব যৌবন। বাগ-বাগিচায় ছিল ভোমরের ঝাঁক। পৃথিবীর চারদিকে দৃষ্টির সীমানাজুড়ে শুধু ফুলের পাপড়ি অবলোকিত হচ্ছিল। ভোরের বাতাস ফুলের সুবাসে বিমোহিত ছিল।
সৃষ্টিজগতের প্রতিটি কণা এই সদ্যভূমিষ্ট সৌভাগ্যবান শিশুর আগমনে খুশিতে ছিল আত্মহারা। আর ফেরেশতাগণ দুনিয়াবাসীদের মোবারকবাদ জ্ঞাপনের জন্য যেন আকাশ থেকে ফুলবৃষ্টি বর্ষণ করছিলেন।
(অনুবাদে : আবদুল্লাহ ফাহাদ)