রবিউল আউয়াল ১৪৩০   ||   মার্চ ২০০৯

নতুন মতাদর্শিক চ্যালেঞ্জের মুখে আলেমসমাজের করণীয়

শরীফ মুহাম্মদ

এ যুগের সবচেয়ে বড় সমস্যা সেই সব চিন্তা ও মতবাদের, যেগুলো এ যুগে মানবসমাজের মধ্যে ধর্মের মতো জায়গা করে  নিয়েছে।  ইসলাম এমন একটি স্পষ্ট চিন্তা ও বিশ্বাস রয়েছে, যা তার নিজস্ব সরলতা, সত্যতা, স্বভাবধর্মীতার কারণে এবং সুস্থ বিবেকবুদ্ধির পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি হওয়ার কারণে নিজের মাঝে প্রচন্ড আকর্ষণ ও শক্তি ধারণ করে। ইসলাম-দুশমনরা সব সময় ইসলামের দাওয়াত ও চিন্তার এ শক্তিটির প্রতি ভীত-সন্ত্রস্ত। ক্রুসেড যুদ্ধের দীর্ঘ পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর ইউরোপ এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল যে, ইসলামকে না চিন্তা ও আদর্শের অঙ্গনে পরাজিত করা সম্ভব, না প্রকাশ্য রণাঙ্গনে। তাই কয়েক শতাব্দীর চিন্তা-ভাবনা, পাঠ ও গবেষণার পর তারা মুসলমানদের কাবু করতে একটি অভিনব পথ অবলম্বন করল। ইসলামের চতুর শত্রুরা মুসলমানদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে ইসলামবিরোধী চিন্তা ও মতবাদকে সুদৃশ্য মোড়কে নতুন ধারায় এমনভাবে ছেড়ে দিল যে, সে সবকে একবার গ্রহণ করে নেওয়ার পর মানুষ আপনা থেকেই ইসলামের সততা ও সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয়ে পড়ে যায় এবং এভাবে ইসলামের সব মৌলিক সততা ও ভিত্তি সম্পর্কে একদম বেগানা বনে যায়।

তাদের কর্মপদ্ধতিটি  হচ্ছে, যেনতেনভাবে ইসলামের খুল্লামখোলা প্রতিদ্বন্দ্বী সাজার পরিবর্তে ধর্মের এমন একটি ধারণা বা রূপরেখা উপস্থাপন করা এবং চারদিক থেকে ধর্মের ওপর এমন মতাদর্শিক ও চিন্তাগত আক্রমণ রচনা করা, যা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও চিন্তাধারাকে নড়বড়ে করে দেয়, আবার মুসলমানদের মাঝে এ বিষয়ে ন্যূনতম সংশয়ও না জাগে যে, তারা ইসলামের বিপরীত দিকে সরে যাচ্ছে। কেননা, শত্রুরা এ বাস্তবতাটি সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিল যে, মুসলমানরা নিজেদের ধর্মের বিষয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে স্পর্শকাতর এবং ইসলামের ছোট থেকে ছোট কোনো বিষয়ের জন্যও সবকিছু বিসর্জন দেওয়া তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার। এ কারণেই বিগত দেড়-দ শতাব্দী ধরে তাদের আক্রমণটি আসছে এমন একটি দিক থেকে, যে দিকটি সম্পর্কে অতীতকালের মুসলমানরা সম্পূর্ণই অনবহিত ছিল। তাদের মাঝে এ অনুভূতিটি জাগার ফুরসতই ঘটেনি যে, তারা ধীরে ধীরে ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে এমন সব চিন্তা ও মতাদর্শকে আঁকড়ে ধরতে পারে, যার ফলে মানুষ ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও চিন্তা থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইসলামী বিশ্বে ইউরোপের রাজনৈতিক ও সমরনৈতিক পরিকল্পনার আওতায় এই নিঃশব্দ চিন্তাগত হামলা গত দুশতাব্দী জুড়ে চলেছে। এ বিষয়টি ইসলামের সঙ্গে যে কোনো সংঘর্ষ এড়িয়ে অত্যন্ত নীরবতার সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা ও নতুন   চিন্তা-দর্শনের নামে ঢুকে পড়েছে। এখন পশ্চিমের সে আক্রমণ পুরো মাত্রায় সক্রিয়। পশ্চিমের টেকনিক ও কর্মকৌশল হচ্ছে, সরাসরি কিংবা আড়াল নিয়ে তারা কখনও ইসলামের মোকাবেলায় নামে না এবং স্পষ্ট ভাষায় ইসলামকে রদ করতে উদ্যত হয় না; বরং দৃশ্যত দেখা যায় ইসলামের সঙ্গে সেসব চিন্তা-দর্শনের কোনো প্রকার সম্পর্ক বা পরিচিতিই নেই। ইসলামকে এমনভাবেই পাশ কাটিয়ে যায় যে, যেন তারা জানেই না,  তাদের পরিবেশিত এসব চিন্তা-দর্শন ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। তারা জ্ঞান, গবেষণা, যুক্তি-বুদ্ধির চর্চা এবং নতুন মতাদর্শের নামে মানুষ এবং বিশ্বজগতের এমন ব্যাখ্যা বিবরণ উপস্থাপন করে যে, তার ফলে খোদা, রিসালাত, আখেরাত এবং আদ্যান্ত ধর্মেরই কোনো স্থান ও প্রয়োজনীয়তা বজায় থাকে না। অপরদিকে সাধারণ জ্ঞানের কোনো মুসলমানের অন্তরেও বিন্দু পরিমাণ সন্দেহের উদ্রেক হয় না যে, এসব চিন্তা-দর্শনের পক্ষ গ্রহণ করা এবং এগুলোকে মেনে নেওয়া ইসলামকে অস্বীকারেরই নামান্তর।

ইউরোপের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং অন্যান্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অঙ্গনে তাদের নিরবচ্ছিন্ন সাফল্য ও অগ্রসরতায় ইসলামী বিশ্ব তটস্থ ও প্রভাবিত হওয়ার কারণে জ্ঞান-বুদ্ধিকে শরীয়তের মাপকাঠিতে মাপা ছাড়াই এসব ধারণা ও কল্পনাকে জ্ঞান-বুদ্ধি, উপলব্ধি, সচেতনতা ও উন্নয়নের নামে শিক্ষিত মুসলিম সমাজ গ্রহণ করে নিয়েছে। যখন কোনো মুসলমান এসব চিন্তা-দর্শনকে গ্রহণ করে নেয় তখন সে ভাবে যে, সে জ্ঞান ও উপলব্ধি এবং প্রগতিশীল মতাদর্শ ও নতুন দর্শনকেই গ্রহণ করেছে। এভাবেই এসব ইসলামবৈরী বাতিল চিন্তাধারাকে গ্রহণ করে নেওয়া হয় যে, গ্রহণকারীদের    অন্তরে এ বিষয়ে কোনো খটকাও জাগে না যে, এসব গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সে ইসলামকেই অস্বীকার করে বসছে। মোটকথা, এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য যে, এভাবে প্রচলিত এই ধরনের ফেৎনাকে একটি নতুন ধরনের ইরতিদাদ বা ধর্মচ্যুতি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

এই মডার্ন ইরতিদাদের টেকনিক ও উপস্থাপন কৌশল সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানরা এ পরিমাণ অসচেতন যে, এ বিষয়ে তাদের মাঝে এতটুকু চিন্তা-চেষ্টাও নেই, যতটুকু ছিল বিগত দিনে কিছু মুসলমানের খৃষ্টান কিংবা হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়ায়। এতে বোঝা যায়, তারা এই তুফানের বিষাক্ততা, মন্দ প্রভাব এবং এর গভীরতা ও বিপর্যয় সম্পর্কে যথাযথ অনুভব-উপলব্ধি করতে পারেননি। জ্ঞান ও নতুন চিন্তার এই মতাদর্শগত বিষোদগারকে যথাযথ কারণেই নতুন ইরতিদাদ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মচ্যুতির ইতিহাসের মনোযোগী অধ্যয়ন এ তথ্যই উপস্থাপন করে যে, কোনো একটি সমাজে ইরতিদাদ মুহূর্তের মধ্যেই চলে আসে না; বরং তার ফল-প্রতিক্রিয়া ধাপে ধাপে প্রকাশ হয়ে থাকে। ইসলামের বুনিয়াদী আকীদা-বিশ্বাস ও ধারণাসমূহের ব্যাপারে আস্থা নড়বড়ে হতে থাকে। ঈমানিয়াতের মাঝে সন্দেহ-সংশয়ের অনুপ্রবেশ ঘটে। এরপর এসবের প্রতিক্রিয়া পড়ে আমলের ওপর। সামাজিক ও সংঘবদ্ধতার ক্ষেত্রগুলোতে (অর্থনীতি, রাজনীতি, শাসন-প্রশাসন এবং আইন-কানূন) ইসলামকে আর আমলযোগ্য মনে হয় না। অতঃপর ইবাদতসমূহ : নামায-রোযা ইত্যাদির মাঝেও দুর্বলতা ও আলস্য জন্ম নেয়। শেষ পর্যন্ত মুখের ভাষাতেও সে অবিশ্বাস প্রকাশ হতে থাকে। অর্থাৎ মৌখিক ধর্মচ্যুতির আগেই আত্মিক ও আমলগত ধর্মচ্যুতি চলে আসে।

এখন পশ্চিমের নতুন সব টেকনিক ও কৌশল কিছু সহজ ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। ধর্মচ্যুতির বিষয়টি এখন আর যবানে প্রকাশ করার দরকার নেই, তাদের দৃষ্টিতে মুসলমানদের সমাজে অবস্থান করেও তাদের উন্নত সেবা আঞ্জাম দেওয়া যায়। প্রথম যুগগুলোতে যখন কোনো মুসলমান কোনো বাতিল ধর্মের প্রভাব গ্রহণ করত তখন তার জন্য প্রয়োজন হত কোনো গির্জা অথবা মন্দিরে গিয়ে শুদ্ধি অথবা ব্যাপ্টিজমের প্রথাগত কর্মকান্ড সম্পন্ন করে গলায় ক্রুশচিহ্ন লাগানোর কিংবা মাথায় প্রতীক ধারণের। এরপর সে মুসলমানদের দল থেকে ভিন্ন হয়ে যেত এবং ইসলামের সঙ্গে তার দূরত্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসত। এতে অন্য মুসলমানরা তার ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক হয়ে যেত। কিন্তু ইসলামের ওপর এই নতুন হামলা অন্য কোনো ধর্মের নামে হচ্ছে না, হচ্ছে জ্ঞান, বিজ্ঞান, সচেতনতা, প্রগতি, দর্শন ও মতবাদের নামে। আর এসব বিষয় তাদের অনুসারী ও পুজারীদের অনুমতি দিয়ে রেখেছে যে, তারা কেবল ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে মুসলিম সমাজে মুসলমান পরিচয়ে বাস করতে পারবে, মুসলমানদের মাঝে বিয়ে শাদি করতে পারবে, নিজেদের মাঝে আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব, মেলামেশা ও খাওয়া-দাওয়ার সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে এবং কখনও কখনও রেওয়াজ হিসেবে মুসলমানদের ইবাদতসমূহে (ঈদ-জুমা) উপস্থিতও হতে পারবে। মুসলিমসমাজে এসব ধর্মচ্যুত লোককে তাদের বিশেষত্বের কারণে শিক্ষা, বুদ্ধি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী মনে করা হয়। সোসাইটিতে বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়। বড় শান-শওকতের সঙ্গে তারা মুসলিম ঘরানার মাঝে আনন্দ-স্ফূর্তি নিয়ে বসবাস করে থাকে। মৃত্যুর পর বড় বড় মজমায় তাদের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামের এসব মডার্ন ইরতিদাদ অবলম্বনকারীরা কেবল নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের সীমানা পর্যন্তই ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী পন্থা গ্রহণ করে ক্ষান্ত হয় না। বরং আরো সামনে বেড়ে এসব ব্যক্তিরা শিক্ষা ও রাজনীতিতে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হওয়ায় রাজনীতি প্রশাসন, কাউন্সিল, সংসদ, মন্ত্রণালয় এবং উঁচু উঁচু পদে সমাসীন হয়ে এবং উঁচু উঁচু চেয়ারে বসে নিজেদেরকে মুসলমানদের প্রকাশ্য প্রতিনিধি ঘোষণা করে থাকে। মুসলমানদের স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নিজেদের মতাদর্শ ও নীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করে। এরা ইসলাম-দুশমনদের (ইহুদী, খৃষ্টান, হিন্দু) সঙ্গে রাজনীতি ও প্রশাসন, সংস্কৃতি ও কালচার, অর্থনীতি ও ব্যবসায় এবং শিক্ষা ও শিল্পের ক্ষেত্রে গভীর যোগাযোগ রাখে।

অপরদিকে বাইরের ইসলামবৈরী  শক্তিগুলো তাদেরকে নিজেদের প্রতিনিধি বানাতে পেরে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে সম্বর্ধনা দিয়ে থাকে। কেননা, এসব লোক মৌলিকভাবে বড় শক্তিগুলোর পক্ষেই কাজ করে থাকে। পশ্চিমা মিডিয়া এদের সাধু বানিয়ে উপস্থাপন করে থাকে আর বড় শক্তিগুলো তাদের সাহায্যে উন্নতি ও স্বচ্ছলতার শ্লোগান নিয়ে মুসলিম দেশ ও সমাজে নিজেদের পলিসি ও সংস্কৃতি পুরোপুরি স্বাধীনতা ও সহজতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে। সরাসরি মুসলিম জাতি ও দেশকে গোলাম বানিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার হাজারো কাঠিন্য ও পেরেশানি বোধ করার পরিবর্তে বাইরের শক্তিগুলোর জন্য এ পথ অবলম্বন করাকে অনেক বেশি সহজতাপূর্ণ, স্বল্পব্যয়ের এবং বিপদমুক্ত মনে করে। এরপর যখনই ইসলামবৈরী শক্তিগুলো এটা দেখে যে, এসব লোকের কেউ জনসাধারণের মাঝে ধরা পড়ে গেছে এবং তাকে নিয়ে নিজেদের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক পলিসি অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে গেছে, জনসাধারণ তার প্রতি বিরক্ত হয়ে ইসলামের দিকেই প্রত্যাবর্তন করছে, তখন বড়ই দ্রুততা ও সাবধানতার সঙ্গে এই পুতুলকে সরিয়ে তারা অন্য পুতুল টেনে নিয়ে আসে, যে পুতুল তাদের শেখানো পদ্ধতি অনুযায়ীই কখনও কখনও দরূদ পড়ে এবং প্রয়োজন হলে ওমরা করে। অপর দিকে ইসলামবৈরী শক্তি প্রভাবিত মিডিয়াগুলো তার ইমেজ গড়ার ভূমিকা গ্রহণ করে। এভাবে মুসলিম জাতি ও দেশ এই দ্বিতীয় পুতুলটির পিছনে চলতে শুরু করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কব্জা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের কাহিনী এটাই যে, শাসক ও নেতা শ্রেণীর অন্তর ও দেমাগে কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবর্তে পশ্চিমা চিন্তাধারা ও মতাদর্শের রাজত্ব বসে গেছে। মুসলিম দুনিয়ার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ যে অংশ ইসলাম ও কুরআনের ওপর অবিচল বিশ্বাস ও ঈমান পোষণ করেন তারা তাদের সারল্য ও অকপটতার কারণে মনে করে থাকেন যে, কয়েক বছর যদি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্বচ্ছলতা চলে আসে তাহলে আমাদের শাসকরা আপনা থেকেই কুরআন ও সুন্নাহর মহাসড়কে উঠে আসবেন। এই খোশ ফাহমী নিয়ে জনগণ পায়ে পায়ে সেসব নেতাদের সঙ্গেই চলতে থাকেন।

মুসলিম দেশগুলোতে যদিও পশ্চিমা সংস্কৃতি ও মতাদর্শের প্রতিনিধিদের সংখ্যা দু-চার শতাংশের চেয়ে বেশি নয়, কিন্তু সেই কজনের শক্তি ও সম্প্রসারিত সামর্থের চিত্রটি এই যে, তারা রাজনীতি-প্রশাসন, ব্যবসা-অর্থনীতি এবং শিক্ষা-সংবাদমাধ্যমের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রক হতে পারার কারণে ইসলামের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা পোষণকারী দল গোষ্ঠী, সংগঠন ও ওলামায়ে কেরামকে অতি সহজেই দাবিয়ে রাখতে পারে। নতুন নতুন সংবাদ মাধ্যমের প্রোপাগান্ডার জোরে তারা ইসলামপ্রেমী মহলকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, উন্নয়ন ও স্বচ্ছলতার শত্রুরূপে চিহ্নিত করে পেছন দিকে ঠেলে দেয়। দ্বীনী সংগঠনসমূহ ও ওলামায়ে কেরাম সংবাদমাধ্যমে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিটাকেও প্রকাশ করতে পারেন না। উপরন্তু এমন ষড়যন্ত্রমূলক উপায়ে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয় যে, দেয়ালে তাদের পিঠ ঠেকে যায়।

মতাদর্শিক বিচ্যুত মহল তাদের এ জাতীয়  কর্মকান্ডে বাইরের ইসলামবৈরী শক্তি এবং বিশ্ব মিডিয়ার পুরোপুরি আশির্বাদ পেয়ে থাকে। এভাবেই তারা বাইরের পৃষ্ঠপোষক ও অনুসরণীয়দের স্বার্থ পূরণ করার পেছনে লেগে যায়।

একথা পরিপূর্ণ আস্থার সঙ্গেই বলা যায় যে, এর আগে কখনও এ ধরনের পরিস্থিতি এবং এ ধরনের চিন্তা ও মতাদর্শিক হামলার মুখে ইসলামকে পড়তে হয়নি। এই চিন্তাগত আক্রমণ যতটুকু ব্যাপক ও সর্বাত্মক, দৃশ্যত তাকে ততটুকুই সরল ও ধর্ম বিষয়ে সম্পর্কহীন মনে করা হয়। কেননা, ইসলামের চিন্তানীতি ও বুনিয়াদী আকীদাসমূহের ওপর আক্রমণ রচনাকারী এসব কুফুরি চিন্তা ও মতাদর্শ কোনো ধর্মের নামে প্রবেশ করেনি, প্রবেশ করেছে জ্ঞান-বুদ্ধি এবং নতুন থিউরি ও দর্শনের নামে। এই চিন্তা-দর্শনের প্রভাব এত গভীর হয়ে পড়েছে যে, কোটি কোটি মুসলমান এই দূষিত স্রোতের শিকার হয়ে ইসলামের ভিত্তি  ও ভিত্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপারেই অপরিচিত হয়ে গেছেন। তাদের খবরও নেই যে, মডার্ন মতাদর্শের নামে কত জবরদস্ত ধস মিল্লাতে ইসলামিয়ার মাঝে ঘটানো হচ্ছে।

এই বিপর্যয়ের প্রতি অর্ধ শতাব্দী আগে  ড. রফীউদ্দীন মরহুম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এরপর মাওলানা মানাযির আহসান গিলানী রাহ. এ বিষয়ে লিখেছেন। দামেশক থেকে প্রকাশিত আলমুসলিমুন-এ ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. রিদ্দাতুন জাদীদাতুন (নতুন ধর্মচ্যুতি) নামে দুই কিস্তিতে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এরপর তিনিই স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থ রিদ্দাতুন ওয়া লা আবা বাকরিন লাহা (ধর্মচ্যুতির এমন ফেৎনা, যা প্রতিরোধে নেই কোনো আবু বকর) লিখেছেন। এ গ্রন্থটির উর্দু তরজমা করেছেন মাওলানা আতীকুর রহমান সম্ভলী নয়া তুফান আওর উসকা মুকাবালা নামে। এরপর আবার সবাই খামোশ হয়ে আছেন। অথচ রোগের সঠিক নির্ণয় পর্যায় সম্পন্ন হওয়ার পর এ যুগে কয়েকটি ইসলামী ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের জন্য জরুরি ছিল আধুনিক শিক্ষিতদের মন-মনস্তত্ত্ব সামনে নিয়ে যুগোপযোগী আঙ্গিকে শক্তিশালী লিটারেচার পেশ করা। এভাবে নতুন ইলমে কালামের (ইসলামভিত্তিক যুক্তি ও তর্কশাস্ত্রের) একটি আস্ত কুতুবখানাই সামনে এসে যাওয়া দরকার ছিল।

চিন্তা ও বিশ্বাসগত এ বিপর্যয় রুখে দিতে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ওলামায়ে কেরামের এগিয়ে আসা। নতুন প্রজন্ম কেবল নয়, নতুন যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দাবি এবং তা অনুধাবনে ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব হচ্ছে, বিরাজমান চিন্তা-দর্শনগত চ্যালেঞ্জসমূহ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া। ইউরোপিয়ান ভাষা, বিজ্ঞান ভিত্তিক রচনারীতি ও সংবাদ মাধ্যমের কৌশল সম্পর্কেও পূর্ণ সচেতন হওয়া দরকার। মধ্যযুগের দর্শন ও মানতেক এবং সেযুগের গ্রীক ও ইরানী চিন্তাদর্শনের বৃত্তের বাইরে বের হয়ে আসতে হবে। আধুনিক যুক্তিতর্কের রীতি ও আধুনিক আঙ্গিকে কুরআন ও সুন্নাহর নীতিভিত্তিক যু&&ক্তমালা দিয়েই এ যুগের সব গুমরাহী ও বিপর্যয়ের উপযুক্ত জবাব দেওয়া সম্ভব। কারণ প্রতি যুগের বক্রতা, বিভ্রান্তি ও মতাদর্শগত গুমরাহী থেকে বের করে এনে মানুষকে হেদায়েতের রাজপথের সন্ধান দিতে কুরআন ও সুন্নাহর প্রাচুর্যই বিকল্পহীন ভাবে যথেষ্ট।[উর্দূ মাসিক আযানে বিলাল রা. এপ্রিল ২০০৬ সংখ্যায় মুদ্রিত বৃটেনের মাওলানা ঈসা মনসূরীর একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে লিখিত]

 

 

 

 

advertisement