বাইতুল্লাহর মুসাফির-১৯
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমার পরিচিত এক ব্যক্তি, অনেক দিন মক্কায় আছেন, তাকে বললাম, নবীজীর জন্মস্থান কোথায়, আমাকে কি নিয়ে যেতে পারেন? তিনি নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন, তা তো জানি না! আমি এখানে বাড়ীর ব্যবসা করি, আর এবার আমার মাথায় পড়েছে বাড়ি! লাভ দূরের কথা, লোকসান সামাল দেয়াই মুশকিল।
আমি অবাক হলাম, লজ্জিত হলাম এবং ব্যথিত হলাম। সমবেদনা প্রকাশ করে বললাম, আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করুন সবরকমের লোকসান থেকে।
আমার সামনে অনেকবারের মত আবারও উদ্ভাসিত হলো দূর ও নিকটের দর্শন। অনেকে দূরে আছে কিন্তু দূরে থাকে না; অনেকে কাছে আছে, কিন্তু কাছে থাকে না।
অন্য একজন খুব আগ্রহের সঙ্গে আমাকে নিয়ে গেলেন। ছাফা পাহাড়ের দিক থেকে বেশ কিছু ঘর পার হয়ে একটি দোতলা বাড়ীর সামনে এসে বললেন, এখানে ছিলো মা আমেনার ঘর।
কল্পনার চোখে আমি দেখতে চেষ্টা করলাম, কেমন ছিলো মা আমেনার ঘরখানি! পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী এবং সবচেয়ে দুঃখিনী ছিলেন মা আমেনা। এখানে একটি ঘরে, জানি না কেমন ছিলো সে ঘরখানি, জগতের শ্রেষ্ঠ মানব একটুকরো চাঁদ হয়ে এসেছিলেন মা আমেনার কোল আলো করে। সুতরাং তাঁর চেয়ে সৌভাগ্যবতী মা আর কে হবেন, কে হতে পারেন! কিন্তু সেই চাঁদের টুকরোকে কোলে নিয়ে দোল দেয়ার এবং আদর করে চুমু খাওয়ার সুযোগ হলো না মা আমেনার। কোলের সন্তানকে তাঁর তুলে দিতে হলো তায়েফের বিবি হালিমার কোলে। মাতৃহৃদয় ও মাতৃমমতার জন্য এর চেয়ে দুঃখের, এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে!
তার পর যখন কোলের চাঁদকে কোলে ফিরে পেলেন তখন তিনি নিজেই চলে গেলেন মৃত্যুর কোলে! মদীনা থেকে মক্কায় ফিরে আসার পথে নির্জন মরুভূমিতে মৃত্যুর কালো পর্দা যখন নেমে এসেছিলো তাঁর চোখে তখন কি এই জনমদুঃখিনী মায়ের শোকে মরুভূমির বালু কাঁদেনি! আকাশের চোখে তখন কি অশ্রু ঝরেনি! কিংবা মৃত্যুর ফিরেশতা আযরাঈলের কি বুক কাঁপেনি!
আমি তো জানি না মৃত্যুর ফিরেশতার বুক আছে কি না; সেই বুকে হৃদয় আছে কি না; যদি থাকে তাহলে বলতেই হবে, মা আমেনার রূহ ধরে টান দিতে আযরাঈলের বুকেও কষ্ট হয়েছিলো, তার হৃদয়েও বেদনা জেগেছিলো। নির্জন মরুভূমিতে কলিজার টুকরোকে একা ফেলে যাকে বিদায় নিতে হয় দুনিয়া থেকে, তার চেয়ে দুঃখিনী মা আর কে হতে পারেন!
নবীজীর জন্মস্থান যে ঘর তা তো আর নেই। যুগে যুগে অনেক পরিবর্তনের পর এখন তা হয়েছে একটি আধুনিক ভবন। তাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। আমরা পরম ভক্তি মুহববতের সাথে ভবনটিতে প্রবেশ করলাম। হৃদয়ে ভাবের সাগরে তখন অদ্ভূত এক তরঙ্গ-দোলা অনুভব করলাম। কল্পনার চোখে আমি যেন দেখতে পেলাম সামান্য উপকরণের সেই অসামান্য ঘরটি যেখানে ছিলো মা আমেনার সুখের সংসার; স্বামীর মৃত্যুর পর যেখানে কেটেছে তাঁর দুঃখের দিনরাত; যে ঘরে মা আমেনার কোলে পুর্ণিমার আলো এসেছিলো দুনিয়া উজালা করে; চাঁদশিশুকে কোলে নিয়ে যে ঘরে কেটেছে মা আমেনার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের অল্প ক’টি দিন। কলিজার টুকরোকে বিবি হালিমার কোলে তুলে দিয়ে এখানেই কেটেছিলো মা আমেনার অস্থির প্রতীক্ষার কয়েকটি বছর। কোন্ পাষাণ হৃদয় এখানে এসে ভক্তিরসে সিক্ত হবে না! মা আমেনার প্রতি এবং তাঁর আদরের দুলালের প্রতি ভালোবাসায় আপ্লুত হবে না! কিন্তু যাদের হাতে এই সব পবিত্র স্থান হেফাযতের দায়িত্ব তারা তাদের বুদ্ধি বিবেচনা মত যা ভালো মনে করেছেন করেছেন। সেটা ভালো হয়েছে কি না তা আল্লাহ জানেন।
যিনি পাঠাগারের দায়িত্বে ছিলেন তার কাছে বিনয়ের সাথে নিবেদন করলাম, ভাই, আমি একজন আলিমে দ্বীন। শিরক ও বিদ‘আত এবং ইশক ও মুহাববাতের পার্থক্য আমি বুঝতে পারি। আপনি কি দয়া করে আমাকে ঠিক সেই স্থানটি দেখাবেন যেখানে আল্লাহর নবী জন্মগ্রহণ করেছেন?!
ভদ্র লোকের দয়া হলো; তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আসুন। তিনি আমাকে একটি বদ্ধ কামরার সামনে নিয়ে গেলেন এবং দরজা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য রকম একটি সুবাস পেলাম। যেন বর্তমানের কোন সুবাস নয়, অতীতের কোন খোশবু।
পাঠাগারের তত্ত্বাবধায়ক বললেন, এই হলো সেই পবিত্র স্থান। এখানেই আল্লাহর নবী পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন।
অপলক দৃষ্টিতে আমি তাকিয়ে থাকলাম সেই পবিত্র ভূমির দিকে, বিশ্বজাহান উজালাকারী আলোর প্রথম স্পর্শধন্য ভূমির দিকে। আমার অন্তরে তখন ভাব ও আবেগের অপূর্ব এক আলোড়ন! আমার হৃদয়ের গভীরে তখন অপার আনন্দের আশ্চর্য এক শিহরণ! দু’জাহানের সরদার সাইয়েদুল মুরসালীন, ফাখরুল আওয়ালীন ওয়াল আখেরীন, আল্লাহর পেয়ারা হাবীব মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এ ঘর একদিন আলোকিত হয়েছিলো আমার পেয়ারা হাবীবের নূর নূরানিয়াতের প্রথম স্পর্শে।
চারদিকে এত যে খোশবু তা কিসের! গোলাব-আতরের! জাফরান-মিশকাম্বরের! হতে পারে, কারণ আতর ও মিশকাম্বর ছিলো সেই পবিত্র কক্ষে কিন্তু বন্ধু! আমাকে বিশ্বাস করো, আতরের ঘ্রাণ এবং মিশকের সুবাস আমি চিনি। আমার চিরদিনের পরিচিত সেই আতর ও মিশকাম্বরের ঘ্রাণকে ছাড়িয়ে সেখানে সেই পবিত্র কক্ষে সত্যি সত্যি আমি পেয়েছিলাম অন্য এক সুবাস, যার তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না পৃথিবীর কোন সুবাসে। হয়ত পাওয়া যাবে জান্নাতের বাগিচায় ফুলের পাপড়িতে।
আমার পেয়ারা নবীর শুভাগমনের স্মরণে বাংলাদেশের কবি কী অপূর্ব সুরে প্রকাশ করেছেন তার হৃদয়ের আনন্দ-উচ্ছ্বাস-!
‘আয়রে সাগর, আকাশ-বাতাস, দেখবি যদি আয়। ত্রিভূবনের প্রিয় মুহাম্মাদ এলো রে দুনিয়ায়।’
পেয়ারা নবীর শুভাগমনের আনন্দ প্রকাশে এর চেয়ে সুন্দর সুর পৃথিবীর আর কোন ভাষায় রচিত হয়েছে কি না আমার জানা নেই। সত্যি সেদিন সাগরের তলদেশে মহাআলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিলো, আকাশে-বাতাসে আশ্চর্য এক আন্দোলন শুরু হয়েছিলো এবং পৃথিবীর বুকে দেখা দিয়েছিলো প্রবল কম্পন। তাই তো নাকি নিভে গিয়েছিলো অগ্নিপূজকদের হাজার বছরের অগ্নিকুন্ড এবং ভেঙ্গে পড়েছিলো পারস্যের রাজপ্রাসাদের মজবুত গম্বুজ!
পাঠাগারের তত্ত্বাবধায়ক ভদ্রলোক উৎসাহ দিয়ে বললেন, ইচ্ছে করলে তুমি ভিতরে যেতে পারো। কিন্তু সাহস হলো না। আমার ভিতর থেকে কে যেন সাবধান করে দিলো, এ পবিত্র কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছো, অনেক করেছো; আর আগে বেড়ো না। তোমার ‘কাদামাখা’ পায়ের কালো দাগে এ কক্ষের পবিত্রতা কলঙ্কিত করো না। এ কক্ষ তোমার নবীর মায়ের কক্ষ! তুমি যার শাফা‘আতের তামান্না করো এ কক্ষ তাঁর ভূমিষ্ঠ হওয়ার স্মৃতিবিজড়িত কক্ষ! কিছুটা
অন্তত হায়া শরম করো! নিজের অপবিত্রতা থেকে এ ঘরের পবিত্রতা রক্ষা করো!
ভিতরের সাবধানবাণীতে শঙ্কিত হয়ে আমি দু’কদম পিছিয়ে এলাম। আজ উম্মত কোথায়, আর উম্মতের নবী কোথায়! আজ উম্মতের জীবন কোথায়, আর নবীর সুন্নত কোথায়! আজ উম্মতের দিল আর নবীর মুহাববাত কোথায়! জীবন থেকে নবীর সুন্নত হারিয়ে গেছে এবং হৃদয় থেকে মুছে গেছে নবী-প্রেম। এখন শুধু আছে রাজপথের জশনেজুলূস, আছে মিলাদুন্নবী নামের জন্মোৎসব, কিংবা সীরাতুন্নবী নামের আলোচনা। হায়রে উম্মত, তোমার নবী কি এজন্য এসেছিলেন দুনিয়ায়? তুমি কি এজন্যই আসো প্রতিবছর এই পবিত্র ভূমিতে?
হঠাৎ যেন আমার ভিতরের আমি আমাকে প্রশ্ন করে বসলো তিরস্কারের সুরে, তুমি! তুমি কেন এসেছো এ পবিত্র ভূমিতে, এখানে এই পবিত্র ঘরের দুয়ারে?
আমি নির্বাক!
ভিতরের আমি যেন আমাকে বললো, এখানে এই পবিত্র ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আজ শপথ নাও, যত দিন বেঁচে থাকবে নবীর সুন্নতের উপর অবিচল থাকবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে নবীর সুন্নতকে যিন্দা করার মেহনতে নিবেদিত থাকবে। নবীর শাফা‘আত লাভের এবং আবে কাউছারের পেয়ালা হাছিলের এছাড়া অন্য কোন পথ নেই।
পবিত্র কক্ষের দ্বারপ্রান্তে এসেছিলাম অভূতপূর্ব এক ভাবতন্ময়তা নিয়ে, এখান থেকে বিদায় নিলাম নতুন এক ভাবনা ও চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে।
হযরত হাফেজ্জি হুযূরের সান্নিধ্যের পর এই সফরে আমার আরেকটি সৌভাগ্য ছিলো বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের বড় হুযূর হযরত মাওলানা আব্দুল আযীয ছাহেবের হজ্বের আমল দেখতে পাওয়া। হজ্বের আগে ও পরে কয়েকবার তিনি আমাদের হযরতের সঙ্গে দেখা করেছেন। এমন আদব ও বিনয়ের সঙ্গে তিনি হযরতের সামনে বসতেন যে, উপস্থিত সবাই অবাক হতো। ঐ সফরেই হযরতকে আমি বলতে শুনেছি, এই মিয়াঁ আমার খুব পেয়ারা শাগরিদ। আমি এবং ছদর ছাহেব এই মিয়াঁকে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে শামিল হওয়ার হুকুম করেছিলাম। এই মিয়াঁ বড়ই নেক ইনসান ও সাদা দিল।
সফরে বিভিন্ন উপলক্ষে যখনই ছদর ছাহেবের প্রসঙ্গ এসেছে, দেখেছি হযরতের চোখ ছলছল করে উঠেছে। তাতে আমি সামান্য হলেও অনুভব করতে পেরেছি, কী গভীর মুহববত ছিলো তাঁদের মাঝে এবং হযরতের অন্তরে তিনি কতটা জাগরূক ছিলেন। ছদর ছাহেবের সঙ্গে হযরতের যে হজ্বসফর হয়েছিলো তার স্মৃতিচারণ করে হযরত বলেছিলেন, ‘সেই হজ্বের লয্যত ও রূহানিয়াত এখন আর কোথায় পাওয়া যাবে!’
হযরত আরো বলেছিলেন, ‘ছদর ছাহেবের সারা যিন্দেগি ছিলো মেহনত-মোজাহাদার যিন্দেগি, তবে হজ্বের সফরে তিনি যে মোজাহাদা করতেন তার নমুনা শুধু সালাফে ছালেহীনের মাঝেই পাওয়া যায়। আসলে সব বিষয়েই তিনি ছিলেন সালাফের নমুনা। ছদর ছাহেবের কাওম ছদর ছাহেবকে চিনতে পারে নাই। খুব কাছের মানুষেরাও চিনতে পারে নাই।
এমন এমন চিন্তা তিনি পেশ করতেন যা আমরা বুঝতে পারতাম না। যেমন উঁচা দেমাগ, উঁচা চিন্তা তেমনই বে-ইনতেহা দরদ-ব্যথা।’
হযরত আরো বলেছিলেন, ‘সিয়াসাত সম্পর্কে ছদর ছাহেবের চিন্তাই ছিলো সঠিক। আমি যা অনেক পরে বুঝেছি তিনি তা অনেক আগেই বুঝেছিলেন। এখন আমার যেমন সঙ্গী-সাথী নাই তখন তাঁরও সঙ্গী-সাথী ছিলো না।’
আরো অনেক কথা হযরত বলেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, তা‘লীমের ময়দানে তুমি ছদর ছাহেবের চিন্তা-ফিকির অনুসরণের চেষ্টা করবা।
বলছিলাম কাকরাইলের বড় হুযূরের কথা। হজ্বের সফরে তাঁকে ‘বিস্তারিতভাবে’ দেখার সুযোগ হয়েছিলো। হারাম শরীফে দেখেছি, কখনো তিলাওয়াত করছেন, কখনো বাইতুল্লাহর দীদার করছেন, কখনো উপস্থিত লোকদের দাওয়াত বা উপদেশ দিচ্ছেন। তাওয়াফের হালাতে যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি মুলতাযামে বুক লাগিয়ে আহাযারি করতে।
একদিন মুলতাযামের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি, আমার সামনে আল্লাহর যে বান্দা তিনি পিছিয়ে এলে আমি সুযোগ গ্রহণ করবো। আল্লাহর সেই বান্দা এমন জারজার হয়ে কাঁদছিলেন যে, তার কান্না আমারও অন্তরকে ভিজিয়ে দিলো। আমি সিক্ত হৃদয়ে তার রোনাযারি শুনছিলাম। তিনি বলছেন, হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া উম্মতে মারহূমার দেখভাল করার কেউ নাই। হে আল্লাহ! তুমি ইয়াতিম নবীর ইয়াতিম উম্মতকে রহম করো। ....
আল্লাহর বান্দার সমস্ত কাকুতি মিনতি ছিলো উম্মতের জন্য, নিজের জন্য নয়। তিনি যখন মুলতাযাম থেকে সরে এলেন তখন দেখি, আমাদের কাকরাইলের বড় হুযূর! অশ্রুবিধৌত তার নূরানি চেহারাকে তখন মনে হচ্ছিলো ফিরেশতার চেহারা!
আরেকদিন দেখি, মাকামে ইবরাহীমের বেশ পিছনে নামায শেষে তিনি দু’হাত তুলে মুনাজাত করছেন। দূর থেকে ঐ নূরানি দৃশ্য আমার অন্তরে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিলো যে, মনে হয় এখনো চোখের সামনে তা দেখতে পাচ্ছি।
আমরা সাধারণ মানুষেরাও মুনাজাত করি, আল্লাহর পেয়ারা বান্দারাও মুনাজাত করেন। উভয় মুনাজাতের দৃশ্য হয়ত এক, কিন্তু অদৃশ্যে অনেক পার্থক্য। সে পার্থক্য ভাবের, অভিব্যক্তির, বিশ্বাসের এবং আত্মনিবেদনের। মুনাজাতের মাঝে তারা মাওলার সঙ্গে যে অন্তরঙ্গতা ও আপনত্ব বোধ করেন আমাদের তা নছীব হয় না; তারা যেভাবে নিমগ্ন ও আত্মসমাহিত হন আমরা তেমন হতে পারি না। পার্থক্য আরো একটি আছে, তবে তা শব্দের অলঙ্কারে সাজিয়ে পরিবেশন করার বিষয় নয়, তা হৃদয় ও আত্মায় অনুভব করার বিষয়।
বড় হুযূরকে সেদিন মুনাজাতের অবস্থায় দেখে মনে হয়েছিলো, তাঁর দেহসত্তা থেকে যেন আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে। সে আলোর উদ্ভাসে চারপাশের মানুষও যেন উদ্ভাসিত। কিংবা আকাশ থেকে যেন তাঁর উপর আলোর শিশির বর্ষিত হচ্ছে।
মুনাজাতের এই নূরানি রূপ সময়ের ব্যবধান যত বাড়ছে, তত কমে আসছে। হয়ত এক সময় এমন মুনাজাতের একটিও যিন্দা নমুনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই সেদিন পর্যন্ত দেখতে পেতাম আমার আববার মুনাজাত। নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হতো। বড় শক্তি ও সান্ত্বনা লাভ করতাম একথা ভেবে যে, এ মুনজাত তো আমাদের ঘরের সম্পদ! এ মুনাজাতের কাকুতি-মিনতির বিরাট অংশ তো আমাদেরই জন্য!
এখন আববা নেই, আববার মুনাজাতও নেই!
একদিন দেখি, যমযমের পাড়ে দাঁড়িয়ে বড় হুযূর নল থেকে গ্লাস ভরে ভরে হাজীদের যমযম পান করাচ্ছেন। ক্লান্তিহীনভাবে তিনি গ্লাসের পর গ্লাস বিতরণ করে চলেছেন। বারবার নল চেপে ধরা বেশ কষ্টকর। তিনি গ্লাসের পর গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছেন, আর হাতের পর হাত তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তাঁর চোখেমুখে ছিলো আত্মিকতৃপ্তির অপূর্ব এক উদ্ভাস। তিনি যেন তখন লাভ করেছিলেন যুবকের উদ্যম। আমি চেষ্টা করলাম তাঁকে অনুকরণ করার, কিন্তু অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠলাম।
মিনায় হযরতের তাঁবুতে বড় হুযূর কয়েকবার এসেছেন। প্রত্যেকবার হযরতের জন্য কিছু না কিছু ফল অবশ্যই আনতেন। হযরতও যখন যা থাকতো তাই দিয়ে সস্নেহে তাঁকে আপ্যায়ন করতেন।
মনে হতে পারে, এগুলো তো সচরাচর দৃশ্য এবং খুব সাদামাটা বিষয়। কিন্তু যদি অনুভবের দৃষ্টিতে দেখা যায় তাহলে এই সব সাধারণ দৃশ্যের মাঝেই লুকিয়ে থাকে অসাধারণ কিছু ‘অ-দৃশ্য’। এখানে তুমি যেমন পাবে বেতাকাল্লুফ এবং অনাড়ম্বর মেহমানদারির শিক্ষা তেমনি পাবে বিনয় ও কৃতার্থতা প্রকাশ করার শিক্ষা; আরো পাবে আল্লাহর ওয়াস্তে একে অন্যকে মুহববত করার শিক্ষা।
মোটকথা, এই সফরে বড় হুযূরকে বিভিন্ন হালাতে দেখে দেখে জীবনের মূল্যবান কিছু শিক্ষা আমি অর্জন করেছিলাম। হজ্বের কোন সফরে আমি হয়ত তেমন হতে পারবো না, কিন্তু হজ্বের সফরে কেমন হতে হয় তা আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিলাম।
আরেকটি সূর্যের অস্ত হলো, আর আছে মাত্র একটি দিন। সম্ভবত আর মাত্র দু’টি সূর্যোদয় এবং একটি সূর্যাস্ত আমি দেখতে পাবো মক্কার দিগন্তে। তারপর আমাকে বিদায় নিতে হবে আল্লাহর ঘর থেকে, মাকামে ইবরাহীম থেকে, বীরে যমযম থেকে এবং পবিত্র হারাম ও মক্কা থেকে।
শেষ দিন হিসাবে যত বেশী সম্ভব তাওয়াফ করলাম। যত বেশী মানে আমাদের হযরতের অর্ধেক বা আরো কম। আমি আরয করলাম, হযরত, এর রহস্য কী? আপনি পারেন, আমরা কেন পারি না? তিনি মৃদু হেসে বললেন, এ প্রশ্ন সব যামানায় ছিলো। আমারও মনে হতো, হযরত হাকীমুল উম্মত পারেন, আমরা কেন পারি না? মিয়াঁ, মেহনত করতে থাকো; আমি দু‘আ করি, আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন।
শেষ সূর্যোদয়ও হয়ে গেলো। মক্কার দিগন্তে আমি আর সূর্যের উদয় বা অস্ত দেখতে পাবো না। যোহরের পর হযরত বিদায় তাওয়াফ করবেন। হযরতকে হুইল চেয়ারে করে আনতে গেলাম। পথের সেই পরিচিত দোকান থেকে শেষবারের মত হযরতের জন্য মুশাক্কাল নিলাম। দোকানদারের সাথে মোটামুটি পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো, বললাম, আমাদের তো আজ বিদায়। দো‘আ করবেন, আল্লাহ যেন পবিত্র ভূমির এই দিনগুলো কবুল করেন।
দোকানদার দু‘আ তো করলেন, কিন্তু মুশাক্কালের পয়সা না নিয়ে আমাকে অপ্রস্ত্তত করলেন; তদুপরি জোর করে আরো কয়েকটি দিয়ে দিলেন। আমি জাযাকাল্লাহ বলে এর বিনিময় আল্লাহর হাওয়ালা করলাম। আফসোস, এই সব আচরণ পবিত্র ভূমিতেও ধীরে ধীরে কমে আসছে। হাজীরা যেমন বদলে যাচ্ছে তেমনি বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু।
যোহরের পর হযরতের সঙ্গে তাওয়াফুল ওয়াদা করলাম। এতদিনের তাওয়াফে ছিলো মিলনের আনন্দ, আজকের তাওয়াফে অনুভব করলাম বিচ্ছেদের বেদনা। বিদায়ের তাওয়াফ যে এত কষ্টের তা আগে এমনভাবে অনুভব করিনি। বুকের প্রতিটি পাঁজর যেন ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়। হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রী যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়। আল্লাহর ঘর থেকে সত্যি কি আজ আমার বিদায়! এ ঘর তাহলে আর দেখা হবে না আগামীকাল! আমি কি তাহলে হারিয়ে যাবো তাওয়াফের জনস্রোত থেকে জীবনের ঘুর্ণীস্রোতে! এই মুলতাযাম আমি আর পাবো না বুক লাগাতে! এই দুয়ারে আমি আর দাঁড়াবো না অশ্রু ঝরাতে! এটা কি আমার দুর্ভাগ্য, না এটাই আল্লাহর ঘরের আদব!
হে আল্লাহ, বিদায় যদি হয় তোমার ঘরের আদব তাহলে বেদনায় হৃদয় যতই বিক্ষত হোক, আমি বিদায় গ্রহণ করবো হাসিমুখে। তোমার দরবারে আমার শুধু এই মিনতি হে আল্লাহ, যা কিছু ভুল ও বিচ্যুতি সব তুমি মাফ করে দাও।
হে আল্লাহ, এ বিদায় যেন হয় শুধু তোমার ঘর থেকে, তোমার সঙ্গ থেকে নয়। হে আল্লাহ, আমাকে তোমার সঙ্গ দান করো চিরকাল, জীবনে এবং মরণে, বিচারের ময়দানে এবং জান্নাতের বাজারে।
হে আল্লাহ, আমি তোমাকে চাই, শুধু তোমাকে। আমার সব প্রয়োজনে কাছে যেন পাই তোমাকে।
হে আল্লাহ, তোমার পেয়ারা হাবীব তো বলেছেন, কখনো কখনো তুমি হেসে দাও। তুমি তো দেহ ও দেহাকৃতির সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে তুমি! তোমার যাত ও ছিফাতের হাকীকত শুধু তুমি জানো, আমরা জানি না। তোমার হাসি কেমন তুমিই জানো, আমরা জানি না। হে আল্লাহ, আমার এইটুকু মিনতি রক্ষা করো, তোমার অবুঝ বান্দাকে তোমার একটি পবিত্র হাসি উপহার দাও। মেহমানের বিদায়কালের মিনতি রক্ষা করো হে দয়াল মেযবান! তোমার হাসি আজ দেখতে পাবো না, কিন্তু অনুভব যেন করতে পারি হে চিরসুন্দর! হে চিরমহান!
মুলতাযাম থেকেও বিদায় গ্রহণ করলাম। মাকামে ইবরাহীমে নামাযের পর হযরতের সঙ্গে মুনাজাত করলাম। কিছু অশ্রু তো ঝরেছে প্রতিদিন, চোখ দু’টো আজ যেন সঞ্চিত সব অশ্রু ঢেলে দিলো মাকামে ইবরাহীমের শেষ মুনাজাতে। দয়াময় দাতা বিদায়কালেও দানের ভান্ডার বন্ধ করেন না। এখানেও তিনি সৌভাগ্য দান করলেন তাঁর পেয়ারা বান্দার কৃতজ্ঞতার অশ্রুর সঙ্গে অধম বান্দার অনুতাপের অশ্রুকে মিশ্রিত করার।
মুনাজাত শেষে হযরত বললেন, মিয়াঁ আবু তাহের, আল্লাহ তা‘আলা আমার একটি আরযু পুরা করেছেন, তোমাকে আমার সঙ্গে হজ্ব করানোর আরযু। এখন আমি দু‘আ করছি, আল্লাহ যেন তোমাকে খানাকা‘বায় আরো হাযির হওয়ার তাওফীক দান করেন। তখন যদি আমি না থাকি, আমার নামে কিছু না কিছু তাওয়াফ অবশ্যই করবা। এটা তোমার কাছে আমার দরখাস্ত।
এমন ‘দরখাস্ত’-এর উত্তরে তো আর কিছু বলা যায় না, শুধু পায়ের ধুলো নেয়া যায়। হযরতের পায়ে ধুলো ছিলো না, তাই নীরবে শুধু পায়ের স্পর্শ গ্রহণ করলাম।
এবার এই সফরের শেষ যমযম। প্রাণভরে পান করলাম। আর সবকিছুতে গাফলত তো ছিলোই, যমযমের মত এমন মযাদার ইবাদতেও আমি গাফলতের শিকার ছিলাম। কত সুযোগ ছিলো পান করার, করিনি। আর তো সুযোগ নেই, তাই এবার একেবারে আকণ্ঠ পান করলাম। যখন মনে হলো আর সম্ভব নয়, তখন একটু বিরতি দিয়ে আরো এক গ্লাস পান করলাম।
যমযম থেকে এসে হযরত বসলেন তাঁর প্রিয় স্থান উম্মে হানিতে। আছর পর্যন্ত তিনি শুধু তাকিয়ে ছিলেন বাইতুল্লাহর দিকে। আমি কখনো বাইতুল্লাহর দিকে, কখনো আশিকে বাইতুল্লাহর দিকে। হযরতের দৃষ্টি কখনো ছলছল, কখনো জ্বলজ্বল, কখনো ঝলমল। বোঝা যায়, তাঁর অন্তর্জগতে এখন কতরকম ভাবের তরঙ্গ খেলা করছে! হয়ত কখনো বিদায়ের বেদনা, কখনো কবুলিয়াতের সান্ত্বনা, আর কখনো আগামী মিলনের সুরমূর্ছনা।
বিদায়ী মুসাফিরের চোখের দৃষ্টিতে হৃদয়ের ভাবতরঙ্গের এই যে অপূর্ব ছায়াপাত, খুব নিকট থেকে তা অবলোকন করার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো সেদিন বাইতুল্লাহ থেকে বিদায়ের বিষণ্ণ মুহূর্তে। প্রেমিক হতে না পারার দুর্ভাগ্য যদি বা হয়, প্রেমিক-দৃষ্টির সৌন্দর্য ও মাধুর্য অবলোকন করার সৌভাগ্য থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়।
আছরের পর হারাম শরীফের সর্বত্র বিদায়ের বিষণ্ণ দৃষ্টি শেষবারের মত একবার বুলিয়ে নিলাম। সব কিছু যেন এখন অন্যরকম। মিলনের প্রথম দৃষ্টির সময় হৃদয়ের স্পন্দন আরো তীব্র হয়েছিলো, এখন বিদায়ের শেষ দৃষ্টির সময় হৃদয়ের স্পন্দন যেন থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো।
এবার আমি তাকাবো প্রিয় বাইতুল্লাহর দিকে, কালো গিলাফের পর্দায় লুকিয়ে থাকা সেই পবিত্র ঘরের দিকে যে ঘরের দিদার ছিলো আমার সারা জীবনের স্বপ্ন, হৃদয়ের গভীরে যে স্বপ্ন লালন করে বেঁচে ছিলাম এত দিন, যে স্বপ্নপূরণের আনন্দদোলায় কেটে গেলো মহাসৌভাগ্যের এই অল্পক’টি দিন, যে স্বপ্নের স্মৃতিচারণের সুখানুভূতিই হবে আমার বিরহদগ্ধ আগামী জীবনের অবলম্বন।
প্রিয় বাইতুল্লাহর প্রতি এখনই হবে আমার বিদায়দৃষ্টি, কিন্তু তার আগে হে ঘরের মালিক, হে আল্লাহ, তোমার কাছে আমার মিনতি, এ দেখা যেন না হয় শেষ দেখা, এ বিদায় যেন না হয় শেষ বিদায়। আবার যেন আসা হয়, বারবার যেন আসা হয়!
আবার যেন দেখা হয়, বারাবার যেন দেখা হয়!
আমি চাইনি বিদায় মুহূর্তে আমার চোখে অশ্রু আসুক, অশ্রুজলে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হোক, কিন্তু চোখদু’টো ছলছল করে উঠলোই। চোখের কী দোষ! হৃদয় যদি বেদনায় বিগলিত হয় চোখ থেকে অশ্রু তো ঝরবেই। আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরলো। বাইতুল্লাহকে তার অক্ষম এক মুসাফিরের শেষ অশ্রুনিবেদন। আমি তাকালাম ঝাপসা দৃষ্টিতে আমার প্রিয় বাইতুল্লাহর দিকে, ‘শেষ বিদায়ের’ আগে আবার দেখার স্বপ্ন নিয়ে। যেন একটি স্বপ্নের ইতি হলো আরেকটি স্বপ্নের কলি ফুটিয়ে। স্বপ্নই তো মানুষের জীবন! স্বপ্নই তো জীবনে বেঁচে থাকার অবলম্বন!
ইরাকের দূতাবাস থেকে এক পদস্থ কর্মকর্তা গাড়ী নিয়ে এসেছেন হযরতকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়ার জন্য। রাষ্ট্রদূত ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন অনিবার্য অপারগতার কারণে বিমানবন্দরে নিজে উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে।
গাড়ী রওয়ানা হলো জেদ্দার পথে। মক্কা শহরের ঝলমল আলো তখনো দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম জানালাপথে নির্নিমেষ নয়নে। একসময় তাও মুছে গেলো দৃষ্টিপথ থেকে।
প্রশস্ত মসৃণ পথে গাড়ী চলছে তীব্র গতিতে। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর ঘর চলে যাচ্ছে দূরে আরো দূরে, কিন্তু তা শুধু চোখের দৃষ্টি থেকে, হৃদয়ের দৃষ্টি থেকে নয়। আমার দেশের কবি বলেছেন, ‘বক্ষে আমার কাবার ছবি, নয়নে মুহম্মদ রাসূল’।
আমি যেখানেই থাকি, যে ভূমিতেই বাস করি, আমার হৃদয় তো বিচরণ করবে মক্কায়, মদীনায়; আমার চোখের তারায় তো স্বপ্ন থাকবে কালো গিলাফের এবং সবুজ গম্বুজের। সুতরাং এ দূরত্ব তো দূরত্ব নয়। বিরহের কালো মেঘই তো বয়ে আনবে মিলনের বৃষ্টিজল!
জেদ্দা বিমানবন্দর এসে গেলো। হিজাযভূমির প্রবেশদ্বার জেদ্দা। কিন্তু লোহিত সাগরের কন্যা আলোঝলমল জেদ্দা আমাদের জন্য প্রবেশদ্বার ছিলো না, ছিলো নির্গমনদ্বার। একদিন এ পথ দিয়েই হয়েছিলো পবিত্র ভূমিতে আমাদের আনন্দ-আগমন, আজ এ পথেই হবে পবিত্র ভূমি থেকে আমাদের বিষণ্ণ নির্গমন।
আল্লাহর কত আশিক বান্দা পৃথিবীর কত দূর দেশ থেকে বারে বারে হাযির হবে পবিত্র ভূমিতে এই পথ দিয়ে; আর কখনো আমি কি শামিল হতে পারবো সেই নূরানি কাফেলায়! আবারও কি ধ্বনিত হবে আমার কণ্ঠে লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইকের সুমধুর ধ্বনি!
মনকে প্রবোধ দেয়ার জন্য মানুষ কত রকম ছল ও ছলনার আশ্রয় নেয়, আমিও নিলাম। অবুঝ মনকে এই বলে প্রবোধ দিলাম, যদিও আজ হিজাযের পবিত্র ভূমি থেকে বিদায়, তবু গন্তব্য তো আমার আরবেরই একটি দেশে! হেজাযের ঘ্রাণ কিছু কি পাবো না সেখানে! ইরাক তো শুনেছি খেজুরের দেশ, মদীনার খেজুরের কিছু কি স্বাদ পাবো না সেই খেজুরে! দজলা-ফোরাতের পানিতে কিছু কি শীতল হবে না এ মন, এ প্রাণ!
এশার নামায আদায় করে আমরা প্রস্ত্তত হলাম। বাস অনেক দূর পথ অতিক্রম করে আমাদের পৌঁছে দিলো ইরাকি এয়ার লাইনসের বিশাল বিমানের সামনে। যাত্রীরা আরোহণ করছে। হযরত আমাদের বললেন, বিমানে আরোহণের আগে সম্ভব হলে দু’রাকাত ছালাতুল হাজাত পড়ে নাও এবং খাছ করে দু‘আ চাও, আমাদের এ সফর যেন আল্লাহ কবুল করেন; সফরের মাকছাদ যেন আল্লাহ কামিয়াব করেন।
বলেই হযরত জায়নামায বিছিয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমাদের সঙ্গে তো আর জায়নামায থাকে না, আমরা খালি যমিনেই দাঁড়ালাম। রাতের ঝিরঝির বাতাসে হিজাযের পাক যমিনে সেটাই ছিলো আমাদের শেষ নামায।
ইরাকি বিমান সংস্থার এই বিমানটি ইরাকি হাজীদের বাগদাদ নিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত আমাদের কারণে কয়েকজন ইরাকি হাজীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত হলো। কথাটা ভেবে একটু খারাপ লাগলো।
আমরা বিমানে আরোহণ করলাম। রাত তখন এগারটার মতো হবে। বিমান আকাশে উড্ডীন হলো। আমাদের গন্তব্য ইরাকের বাগদাদ, হযরত আলীর কুফা এবং ইমাম হোসাইনের কারবালা।
আসলে ইরাকসফরের কথা আলাদা করে আমি কখনো ভাবিনি। যদিও বোগদাদি কায়দা পড়েছি এবং কারবালার মর্মন্তুদ কাহিনী শুনেছি সেই সুদূর শৈশবে। তখন পুঁথিপাঠের প্রচলন ছিলো। কারবালার পুঁথি শুনে আমাদের শিশুহৃদয়েও কান্নার ঢেউ উঠতো, আমাদেরও চোখ থেকে অশ্রু ঝরতো।
দজলা-ফোরাত নামদু’টির একত্র উচ্চারণ আমার কাছে মেঘনা-যমুনার চেয়ে কম প্রিয় ছিলো না, বরং একটি যুক্তিহীন বিশ্বাস ছিলো, ইরাকের দজলা-ফোরাত বাংলাদেশের মেঘনা-যমুনার চেয়ে অনেক সুন্দর, উদ্দাম, উচ্ছল, তবে অনেক শান্ত। মেঘনা-যমুনার মত দজলা-ফোরাত কুল ভাঙ্গে না এবং মানুষের সর্বনাশ করে না। দজলা-ফোরাত কারো সুখের সংসার ভাসিয়ে নেয় না। তাই দজলা-ফোরাতের প্রতি আমার আলাদা একটি পক্ষপাতিত্ব ছিলো, যেমন ছিলো মিশরের নিলনদের প্রতি।
আমার অন্তরে বাগদাদ ছিলো, কারবালা ছিলো, কুফা-বছরা ছিলো, দজলা-ফোরাত ছিলো, সবই ছিলো; তবু ইরাকের স্বপ্ন ছিলো না। যাকে বলে স্বপ্ন সেটা ছিলো শুধু হিজাযের স্বপ্ন, যা আল্লাহ মেহেরবান এবার পূর্ণ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ইরাকসফরের এবং কারবালা যেয়ারতের সুযোগ দান করছেন, এটা অবশ্যই বড় নেয়ামত। সুতরাং সেজন্য আল্লাহর শোকর।
গভীর রাত্রে বিমান বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করলো।
যদিও ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলছিলো, তবু বাগদাদ বিমান্দরের পূর্ণ জৌলুস অক্ষুণ্ণ ছিলো। যুদ্ধপরিস্থিতির কারণে স্বাভাবিক আলোকসজ্জা অবশ্য ছিলো না, কিন্তু বিশাল ব্যাপ্তি ও আভিজাত্য অনুভব করতে কোন অসুবিধা হলো না। বিমানবন্দর দেখেই বুঝতে পারলাম, আমরা এক আধুনিক ও সমৃদ্ধ আরবদেশে উপস্থিত হয়েছি।
প্রিয় পাঠক এটা হলো সেই সময়ের কথা যখন আমরা ইরাক সফর করেছিলাম, কিন্তু আজ পঁচিশ বছর পর যখন এই সফরনামা লিখছি তখন বাগদাদ বিমানবন্দর এক বিরানভূমি এবং ইরাক এক মৃত্যুপুরি ছাড়া আর কিছু নয়।
সাদ্দাম তখনো আমার প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন না, এখনো আমার পছন্দের মানুষ নন। কিন্তু বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের মত আমারও অন্তরে তার প্রতি রয়েছে গভীর সমবেদনা।
অনেক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন অন্যান্য দেশের একনায়কদের মত ইরাকের এই একনায়ক। ইসলামের প্রতিও খুব একটা বিশ্বস্ততার পরিচয় তিনি দিতে পারেননি। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার প্ররোচনায় ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ যেমন তিনি শুরু করেছেন তেমনি নির্বোধের মত একই ফাঁদে পা দিয়ে কুয়েত দখল করেছেন, যার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিলো উপসাগরীয় যুদ্ধের বিভীষিকা এবং ইরাক ও ইরাকি জনগণের সর্বনাশ। এমনকি নিজের মর্মন্তুদ পরিণতির জন্যও তিনিই দায়ী, অন্য কেউ নয়। সন্দেহ নেই তার অপরাধের পাল্লা অনেক ভারী। কিন্তু সাদ্দামের চরম শত্রুও একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, নির্বোধ হলেও তিনি সাহসী পুরুষ ছিলেন। স্বদেশভূমি ইরাককে তিনি ভালোবাসতেন। ক্ষমতার বিনিময়ে, এমনকি জীবনেরও বিনিময়ে দেশের তেলসম্পদ সভ্যযুগের লুটেরাদের হাতে তুলে দিতে রাজি হননি। শত্রুর হাতে বন্দী অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি তাই করেছেন যা একজন মুমিনের শান-উপযোগী। ফাঁসির রজ্জু গলায় পরেও তিনি ভীরুতার পরিচয় দেননি। বীরের মত মৃত্যু বরণ করেছেন এবং মৃত্যুর মাধ্যমে জীবনব্যাপী সকল ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছেন।
অন্তত আরব ও মুসলিম উম্মাহর সাহস ও বীরত্বের যে গৌরবময় ইতিহাস, শত্রুর সামনে তিনি তা কলঙ্কিত করেননি। আরব শায়খদের মত মসনদ রক্ষার জন্য মার্কিন হায়েনাদের পদসেবায় লিপ্ত হননি, বরং ঘৃণাভরে তাকে পদাঘাত করেছেন। শহীদের মর্যাদায় আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন, আমীন।
প্রিয় পাঠক, হঠাৎ করে ভিতরের তাজা জখম থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়লো, কিন্তু কী লাভ তাতে! তার চেয়ে চলো আমরা ফিরে যাই পঁচিশ বছর আগে আমাদের ইরাকসফরে।
ইতিহাসের পাতায় একটি সত্যকে সংরক্ষিত করে রাখার জন্য শুরুতেই কিছু কথা বলে রাখতে চাই। ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ গোড়া থেকেই আমাদের হযরতের অন্তরে বিরাট বেদনা সৃষ্টি করেছিলো। সমৃদ্ধিশালী এবং সামরিক শক্তিতে বলীয়ান দুটি মুসলিম দেশ চরম ধ্বংসের পথে ধেয়ে চলেছে, এটা হযরতকে অস্থির করে রেখেছিলো। এ অবস্থায় যখন তাঁকে জানানো হলো যে, ইরান ও ইরাক উভয় দেশ যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা করার জন্য তাঁকে দাওয়াত দিয়েছে এবং তাঁর মধ্যস্থতা মেনে নিতে সম্মত হয়েছে তখন মুসলিম উম্মাহর এক বিরাট খেদমত আঞ্জাম দেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। এত দীর্ঘ ও জটিল সফরের জন্য বয়স, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য পরিস্থিতি মোটেই উপযোগী ছিলো না, কিন্তু তিনি ভেবেছেন, যুদ্ধরত ‘দুই ভাই’ ডাকার পরও যদি তিনি সন্ধিপ্রচেষ্টায় উদ্যোগী না হন তাহলে এজন্য আখেরাতে আল্লাহর কাছে তাঁকে জবাবদেহী করতে হবে। এ মহাদায়িত্ববোধ তাঁকে এমনই বিচলিত করেছিলো যে, বয়স ও স্বাস্থ্যের অক্ষমতা এবং নিজ দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির নাযুকতার কোন পরোয়া না করে ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধের কথিত সফরে তিনি আগ্রহী হলেন। নিঃসন্দেহে এটা তাঁর জন্য ছিলো বিরাট জিহাদ এবং এমন পরিস্থিতিতে এমন কঠিন জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়া তাঁর পক্ষেই শুধু সম্ভব ছিলো।
কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, ইরান বা ইরাক কোন সরকারই এ উদ্দেশ্যে হযরতকে দাওয়াত দেয়নি। ইরানের দাওয়াত ছিলো আগাগোড়া প্রচারণাকেন্দ্রিক। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো কথিত ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে হযরতের মাধ্যমে বাংলাদেশে অনুকূল জনমত তৈরী করা। হযরত যখন ইরান সফর করছেন তখন বাংলাদেশস্থ ইরানি দূতাবাসের বাংলা বুলেটিনের একটি সংখ্যার শিরোনাম ছিলো, ‘মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুযূরের নেতৃত্বে একদল দর্শনার্থীর ইমাম খোমেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ’।
পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্য এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট।
পক্ষান্তরে ইরাকী দূতাবাস এগিয়ে এসেছিলো শুধু ইরানি দূতাবাসের পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে। সবচে’ বড় কথা, উভয় দেশের দাওয়াতনামাতেই শুধু সফরের আমন্ত্রণ ছিলো, যুদ্ধ বন্ধের কোন প্রসঙ্গই ছিলো না।
তাছাড়া হযরতের কোন কোন সফরসঙ্গীর আচরণ ও বক্তব্য ছিলো কথিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এবং প্রকাশ্য সভায় তারা ইরান সরকার ও তার ইসলামী বিপ্লবের এমন একতরফা প্রশংসা করে চলেছিলেন যা মধ্যস্থতাকারীদের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিলো না কিছুতেই।
বস্ত্তত হযরতের ইরান-ইরাক সফরই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনপূর্ণ আন্দোলনের জন্য কাল হয়েছিলো। যারা এটা করেছেন, কেন করেছেন তা ভেবে তখনো আমি অবাক হয়েছি, এখনো অবাক হই।
এখানে আরেকটি বিষয় বলতে হয়, জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছে আমরা জানতে পারি, একই বিমানে বাংলাদেশের আরেকটি প্রতিনিধিদল ইরাক সরকারের দাওয়াতে বাগদাদ যাচ্ছে। প্রতিনিধিদলের নেতা হলেন জমিয়াতুল মুদাররিসীনের সভাপতি (মরহুম) ‘মাওলানা’ আব্দুল মান্নান। সর্ষিণার পীর সাহেবও প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
সুনির্দিষ্ট কোন কারণ ছাড়াই বিষয়টি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালো। পরবর্তীতে অবশ্য পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, আমাদের অস্বস্তি অমূলক ছিলো না।
যাই হোক জেদ্দা থেকে আমরা উভয় প্রতিনিধিদল একসাথে বিমানে আরোহণ করলাম এবং বাগদাদ বিমানবন্দরে একই সাথে অবতরণ করলাম। হযরতের মেযবান ছিলো ইরাকের তথ্য ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় দলটির মেযবান ছিলো ওয়াকফ ও ধর্মমন্ত্রণালয়। একারণেই হযরতকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রণালয়ের সচীব, পক্ষান্তরে দ্বিতীয় দলটির জন্য উপস্থিত ছিলেন ধর্মমন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা।
উভয় প্রতিনিধিদল একই বাসে আরোহণ করে বিমানবন্দরভবনের ভি আই পি লাউঞ্জে এলো। বাসে আমরা উভয়দল এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে বসেছিলাম যেন ভিন্ন দুই দেশের বাসিন্দা, কেউ কাউকে চিনি না, জানি না। আমার মনে হলো, অবস্থাটা অাঁচ করতে পেরে উভয় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করলেন। নিজেকে আমার তখন খুবই ক্ষুদ্র মনে হলো। কী ক্ষতি হতো যদি বিদেশী মেযবানদের সামনে
অন্তত ন্যূনতম সৌজন্যটুকু আমরা রক্ষা করতাম!
জেদ্দা বিমানবন্দরেও একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো। সেখানে অবশ্য মাওলানা মুহিউদ্দীন খান আগে বেড়ে কুশল জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিন্তু অপর পক্ষ হতে কেউ এ সৌজন্যটুকুও রক্ষা করেননি। অথচ আমরা উভয় দল হজ্জ করে এসেছি। একই বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করেছি, একই যমযমের শীতল পানি পান করেছি, একই আরাফার ময়দানে অকূফ করেছি, একই মুযদালিফায় খোলা আকাশের নীচে রাত যাপন করেছি, একই মিনার প্রান্তরে রামী ও নহর করেছি, কিন্তু এক হতে পারিনি।
যদি মনে করি, আমাদের মাঝে আদর্শের ভিন্নতা রয়েছে তো থাক না, কিন্তু পরস্পর সৌজন্যবোধ! কুশলবিনিময়! ইসলামি ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে না হলে অন্তত সাধারণ ভদ্রতার দাবীতে, যা কাফির মুশরিকরাও করে থাকে! এতটুকু যদি না পারলাম তাহলে হজ্ব থেকে আমরা কী নিয়ে ফিরলাম?
আমাদের হযরত তো ছিলেন অন্য জগতে বিভোর। তিনি বিমান থেকে নামার সময় একবার শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কি ইরাকে পৌঁছে গেছি? তারপর থেকেই তাঁর চক্ষু ছিলো নিমিলিত এবং তাসবীহ ছিলো সচল। আমাদের মাঝে থেকেও যেন আমাদের মাঝে তিনি অনুপস্থিত!
এবার শুনুন হযরত আমাদের উভয় দলকে কী শিক্ষা দিলেন? যখন তাঁকে বলা হলো, একই বিমানে বাংলাদেশের আরেকটি প্রতিনিধিদল এসেছে এবং তাতে শর্ষিণার পীর সাহেব রয়েছেন, তখন হযরত আচ্ছা! আচ্ছা! বলে উঠে দাঁড়ালেন এবং অনেক দূর হেঁটে গিয়ে পীর সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় করলেন। পীর সাহেব এবং তার সফরসঙ্গীরা অপ্রস্ত্তত অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়ে হযরতের সঙ্গে মোছাফাহা করলেন। আমরাও সকলের সঙ্গে মোছাফাহা করলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, উভয় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণ আবার দৃষ্টিবিনিময় করলেন। তথ্যমন্ত্রণালয়ের সচীব পরে গাড়ীতে আমাকে বলেছিলেন, ‘শায়খুকুম আ‘যামু মাশীখাতান ওয়া ইনসানান’ ( তোমাদের শায়খ শায়খ হিসাবে এবং মানুষ হিসাবেও অনেক বড়।)
তথ্যমন্ত্রণালয়ের সচীব আধুনিক বেশভূষার সম্পূর্ণ কেতাদুরস্ত এবং নিপাট এক ভদ্র লোক। বাইরে থেকে ধর্ম ও ধার্মিকতার কোন ছাপ নেই, কিন্তু হযরতের সঙ্গে তিনি অত্যন্ত ভক্তি ও তাযীমের আচরণ করলেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সারতে কিছু সময় লাগবে। তাই তিনি সে দায়িত্ব অন্যদের হাতে দিয়ে হযরতকে নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। হযরত আমাকে সঙ্গে নিলেন।
বিমানবন্দর থেকে বাগদাদ বেশ দূরে। গভীর রাত বলে রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। সচীব ভদ্রলোক নিজেই গাড়ী চালাচ্ছিলেন। আমার প্রথম বিস্ময় ছিলো এই যে, ইঞ্জিন চালু করার সময় তিনি বিশুদ্ধ উচ্চারণে দু‘আ পড়লেন, ‘সুবহানাল্লাযী সাখ্যারা লানা হাযা ....
পুরো পথ তিনি হযরত সম্পর্কে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করলেন। এক পর্যায়ে বললেন, আমার দাদা এখনো জীবিত এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক, দেখতে অনেকটা তোমাদের শায়খের মত
অল্পক্ষণেই ভদ্রলোক বেশ
আন্তরিক হয়ে উঠলেন। এই মানুষটির বাইরের রূপকে তো আমি গ্রহণ করতে পারি না, কিন্তু তার ভিতরের যে রূপটি দেখলাম সেটাকে কীভাবে অস্বীকার করি?
হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী (রহ) সত্যই বলেছেন, ‘কলব ও কালিব’-এর মাঝে যখন বৈপরিত্য দেখা দেয় তখন কলবকে কালিবের উপর অগ্রাধিকার দিতে হবে, কারণ যে কোন সময় কলব থেকে কালিবের মাঝে পরিবর্তন আসতে পারে।
উম্মতের বর্তমান বদহাল অবস্থায় হযরত নদবীর এ উপদেশ অত্যন্ত মূল্যবান।
আমি ভদ্রলোককে নামায-রোযার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি মৃদু হেসে বললেন, রোযায় আমার কোন ত্রুটি নেই, আর নামায পড়তে চেষ্টা করি।
তারপর যেন কিছুটা লজ্জা ঢাকার মত করে বললেন, আমার ‘ওয়ালিদায়ন’ কিন্তু নিয়মিত নামায পড়েন এবং কোরআন তিলাওয়াত করেন।
আমি বললাম, আল্লাহ তোমাকে তোমার মা-বাবার মত করে দিন।
ভদ্রলোক খুব আন্তরিকভাবে বললেন, আমীন।
হোটেল মেরিডিয়ান রাজধানী বাগদাদের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। বাগদাদের সবচে’ অভিজাত হোটেল। সফরের নয়দিন এ হোটেলেই আমরা ছিলাম। শুরু থেকে শেষ, হোটেলের সবকিছুতে এমনই সীমাহীন প্রাচুর্য ছিলো যে, হযরত তো বটেই, আমরাও কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেছি।
হোটেলে পৌঁছার পর অভ্যর্থনাকক্ষের কর্মকর্তার সঙ্গে সচীব ভদ্রলোক ফরাসীতে কথা বললেন। এ হোটেলে আরবী ও ইংরেজী দুটোই চলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা। ফরাসী বেশ সাবলীল।
হযরতকে তাঁর কক্ষে পৌঁছে দেয়া হলো। তিনি ফারিগ হয়ে শুয়ে পড়লেন এবং সবসময় যেমন দেখেছি, সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। সফরসঙ্গীরাও কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছলেন। সচীব ভদ্রলোক সকালে আসার কথা বলে উষ্ণ আন্তরিকতার সাথে করমর্দন করে বিদায় নিলেন।
হযরতের জন্য ছিলো আলাদা কক্ষ। আমাদের প্রত্যেক দু’জনের জন্য একটি করে কক্ষ। মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব এবং আমি একটি কক্ষে। কিন্তু হযরতের আরামের কথা চিন্তা করে ঠিক হলো, তিনি হযরতের সঙ্গে থাকবেন। ফলে আমি একা ছিলাম এবং আমার জন্য স্বস্তিদায়ক হয়েছিলো।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)