মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ. (১৩১০ হি.-১৩৯৬ হি.) : কিছু শিক্ষণীয় ঘটনা (২)
দেওবন্দ গমন
একুশ বছর বয়সে হযরত মুফতী ছাহেব মিশকাত জামাত সমাপ্ত করেন। মিশকাত পড়ার পর স্বীয় উস্তাযগণের পরামর্শে দেওবন্দ যাওয়ার ইচ্ছা করেন। সে বছর রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফ করেন নিজের জায়গির এলাকা রংগীপাড়া মসজিদে। ইতেকাফ শেষে বাড়ী যান। তারপর দেওবন্দের উদ্দেশ্যে বের হন। পরিবার ও আত্মীয় স্বজন ও উস্তাযগণ থেকে বিদায় নিয়ে সবশেষে তাঁর খাস উস্তায মাওলানা আবদুল হামীদ ছাহেব থেকে বিদায় নেন। বিদায়কালে তিনি তাকে এ বলে শেষ নসহিত করেন, ‘যেখানেই যাও চাই আরশেও উঠে যাও, যদি ইত্তেবায়ে সুন্নাত ও দ্বীনদারি না হয় তাহলে আত্মা খুশি হবে না।’
দেওবন্দ যাওয়ার কালে হযরত মুফতী ছাহেবের একনিষ্ঠ সাথী জনাব মাওলানা আবদুল মাজীদ ছাহেব রাহ. তাঁর সহগামী ছিলেন। তিনিও একই উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। সন্ধ্যার দিকে দেওবন্দ পৌঁছেন এবং চট্টগ্রামের এক ছাত্র মাওলানা যাকেরের কামরায় উঠেন। ভর্তি ও নিজস্ব কামরা পাওয়া পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করেন এবং বিভিন্ন সুযোগে আসাতেযায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মুফতী ছাহেব বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, আসাতেযায়ে কেরাম অত্যন্ত প্রশস্তচিত্তে আমাদেরকে সময় দেন। আমরা খুব অবাক হতাম। এত বড় বড় ব্যক্তিগণ হাজারো ব্যস্ততা সত্তে¡ও আমাদের মত নগণ্যদেরকে সাক্ষাৎ দিচ্ছেন!
এ সময়েরই ঘটনা, এখনো তিনি ভর্তি হননি এবং চট্টগ্রামের ঐ ছাত্রের কামরায়ই অবস্থান করছেন। ঐ কামরার উপরের তলায় উস্তাযুল ফুনূন মাওলানা গোলাম রসূল ছাহেব রাহ. থাকতেন। একদিন আসরের পর হযরত মুফতী ছাহেব সেই ছাত্রের কামরায় বসে মুখতাসারুল মা‘আনী মুতালাআ করছেন, ইত্যবসরে হযরত মাওলানা গোলাম রসূল ছাহেব কামরা থেকে বের হলেন এবং হযরত মুফতী ছাহেবের উপর তাঁর দৃষ্টি পড়ল। তিনি হযরত মুফতী ছাহেবকে ডেকে নিলেন এবং খোঁজ খবর নিলেন। তারপর বললেন, মুখতাসারুল মা‘আনীর কোনো একটি স্থান থেকে আমাকে পড়ে শোনাও। মুফতী ছাহেব শোনাতে শুরু করলেন। ইবারত পড়া শুনেই হযরতের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং আনন্দের আতিশয্যে বলতে লাগলেন তুমি দেওবন্দ থেকে কোথাও যাবে না। এখানেই পড়বে। ইনশাআল্লাহ তুমি বাংলার ফাযেল হবে।
অতপর দারুল উলূমে ভর্তি হলেন। মোল্লা হাসান, মায়বুযী, মাকামাত, মুখতাসারুল মা‘আনী ঐ বছরের পাঠ্য কিতাব ছিল। মুফতী ছাহেব বলেন, (স্মরণ আছে) মাকামাতে মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী ছাহেব আমার সহপাঠী ছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমি প্রবল আগ্রহের সাথে পড়তে থাকলাম। নিয়মিত দৈনিক সবক পড়তাম। সামনের সবক বাধ্যবাধকতার সাথে কয়েকবার পড়তাম। ব্যস, এটাই আমার ব্যস্ততা। কারোর সাথে না আসা যাওয়া ছিল, না মেলা-মেশা। সবসময় পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকতাম। আসল কথা হল অন্য কিছু করার সময় কোথায়? কিছুদিনের মধ্যেই দেশী-বিদেশী সকল ছাত্র আমার ইলমী যোগ্যতার কথা বুঝতে পারল, স্বীকৃতি দিতে লাগল। বিদেশী ছাত্রের মধ্যে পাঞ্জাবের ডেরাগাজী খানের মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুফতী ছাহেবের ভাষায়- তিনি আমার بڑے معتقد تھے । সকল কিতাব বিশেষভাবে ফুনূনাতের কিতাবসমূহ আমার সাথেই তাকরার করতেন। তার কোনো সাথী একবার এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলল যে, তুমি তো একজন বাঙালীর সাথে তাকরার করছ। তিনি উত্তরে বললেন, সে এমন এক বাঙালী যে তোমাদের সকল পাঞ্জাবীদেরকে পড়াতে পারবে।
আমার পড়াশোনা পুরো বছর এক ধারাতেই ছিল। সামনের সবক খুব গুরুত্বের সাথে বার বার দেখতাম। পুরাতন সবকও সর্বদা মুতালাআ করতাম। এজন্য পরীক্ষার সময় আমার বাড়তি কষ্ট করতে হত না, যা প্রায় সব ছাত্রদের করতে হয়।
একবার পরীক্ষা আসন্ন এমন সময় চট্টগ্রাম ফটিকছড়ির ছাত্র জনাব মাওলানা ইলাহী বখশ এক সকালে এসে বললেন, ফয়যুল্লাহ! আজ রাতে আমি তোমার সম্পর্কে একটি স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখলাম জনাব মাওলানা গোলাম রসূল ছাহেব একটি মাঠে সকল ছাত্রদের একত্রিত করলেন এবং নিজের তত্ত¡াবধানে দৌড় প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলেন। যখন সকল ছাত্র দৌড়ের জন্য কাতারবন্দী হল তখন তুমি আমার নিকট এসে বললে, ভাই! আমার কাপড়গুলো একটু রাখো, আমিও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করব। এ বলে তুমি দৌড় দিলে এবং সবাইকে ছাড়িয়ে গেলে। স্বপ্নটি বলার পর স্বয়ং স্বপ্নদ্রষ্টাই এর ব্যাখ্যা করলেন যে, পরীক্ষায় তোমার শানদার কামিয়াবী হবে। আলহামদুলিল্লাহ, আমার সকল কিতাবের পরীক্ষা ভালো হল। বিশেষভাবে মুখতাসারুল মা‘আনীর পরীক্ষা তো বেশ শানদার হল। পরীক্ষার পর মুখতাসারুল মা‘আনির উস্তায হযরত মাওলানা আবদুস সামী ছাহেব সবকে এসে উত্তরপত্রসমূহ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বললেন, অমুক এমন লিখেছে, অমুক এমন লিখেছে। শেষে বললেন, একটি খাতা পেলাম যা আরবীতে ছিল এবং খুবই শানদার। নাম দেখলাম, ফায়যুল্লাহ চাটগামী। অতপর উস্তাযে মুহতারাম খুব শাফকাতপূর্ণ ভাষায় বললেন, ছাত্রটি কে? আমি তাকে দেখতে চাই। মুফতী ছাহেব বলেন, উস্তাযের এমন আবেদনে আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। সাথীরা আমাকে জোর করে দাঁড় করিয়ে দিল।
আরেকদিনের ঘটনা। উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা আবদুস সামী সাহেবই সবকে এসে সবার সামনে বললেন, ফয়যুল্লাহ চাটগামীর ‘মোল্লা হাসানে’র পরীক্ষার খাতা দেখে হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী বললেন, মনে হচ্ছে, এ ছাত্রটি মুসান্নিফ থেকেও ভালো বুঝে। ছাত্রটিকে দেখার আমার খুব আগ্রহ। মোল্লা হাসানের পরীক্ষা উসমানী রাহ.-এর নিকটই ছিল। মাওলানা আবদুস সামী ছাহেব আরেকদিন ছাত্তা মসজিদে ইশার নামাযের ওযু করার সময় হযরত মুফতী ছাহেবকে বললেন, হযরত উসমানী তোমার উপর বেশ খুশি হয়েছেন।
হযরত মুফতী ছাহেব বলেন, এতসব সত্তে¡ও আমি দরসগাহের যে কোনো এক জায়গায় চুপচাপ বসে যেতাম। মতন পড়া নিয়ে কিছু বিশৃংখলা হত, আমি সেগুলো থেকে দূরে থাকতাম। একমাত্র আল্লাহর মেহেরবানী আমার এত লুকিয়ে থাকার পরও আমার প্রতি আসাতেযায়ে কেরামের শফকতের দৃষ্টি পড়ে যেত।
হযরত মুফতী ছাহেব তার স্বরচিত জীবনীতে লেখেন, ছাত্র যামানায় ও তার পরে হাটহাজারী কিংবা দেওবন্দে সবসময় আসাতেযায়ে কেরাম এবং বড়দের ‘মনযূরে নযর’ ছিলাম। পরীক্ষায় অধিকাংশ সময় প্রথম হতাম। ছাত্ররাও আমাকে বেশ সম্মান করত।
দেওবন্দ আসার ছয় মাসের মাথায় তার পিতা ইনতেকাল করেন। এটা তার জন্য মাথায় আসমান ভেঙ্গে পড়ার ঘটনা। কারণ, এর অর্থ তিনি দেওবন্দে বেশিদিন থাকতে পারবেন না। অবস্থাটি নিজেই বর্ণনা করেন- ‘একদিন সকালের সবক শেষ করে দুপুরের খাবার খেয়ে আরাম করছি এমনসময় ডাক পিয়ন এসে আমার নাম ধরে হাঁক দিল। সাথে সাথে অন্তরে এমন ভয় ছেয়ে গেল, না জানি কী সংবাদ আসে। খাম খুলে দেখি জিরি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আহমদ হাসান ছাহেবের চাচাত ভাই মাওলানা আব্দুল জাব্বার ছাহেব-এর চিঠি। তিনি তখন হাটহাজারী মাদরাসায় হিসাব বিভাগে কর্মরত ছিলেন। চিঠিতে দীর্ঘ সান্ত¦না দিয়ে ওয়ালিদে মারহুমের ওফাতের সংবাদ দিলেন। তার বয়স তখন ছিল ষাট বছর। পিতার মৃত্যু সংবাদ এবং না বালেগ ভাইবোনদের অসহায়ত্ব ও তাদের দেখভাল ভরণ-পোষণের কথা মনে পড়ে মনে এত বড় আঘাত লাগল যে, ঐ দিন যোহরের পরের সবকে উপস্থিত হতে পারিনি। অথচ পূর্বে কয়েকবার কঠিন অসুস্থতা সত্তে¡ও কখনো সবক বাদ দেইনি। ঐ সময় আমার এক বোনের বয়স মাত্র তিন মাস। আরেক ভাইয়ের মাত্র তিন বছর। আরেক ভাইয়ের নয় কি দশ বছর। তাদের ভরণ-পোষণের আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না । কারণ আমি সবার বড়। তারপরও এদের এবং জমিজমার দেখাশোনার দায়িত্ব ছোটভাই (মাস্টার) নাযীর আলীর যিম্মায় দিয়ে নিজে পড়াশোনায় অটল থেকে একটি সময়সীমা পর্যন্ত থেকেছি এবং ইলমের তৃষ্ণা নিবারণ করেছি।
পিতার বিয়োগের পর পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ এল, পড়ালেখা সংক্ষিপ্ত করতে। তাই দ্বিতীয় বছর ফুনূনাত-এর বাকী কিতাবাদী না পড়ে শুধু ‘কাযী’ নিয়েছি এবং দাওরায় সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিযী ও দুই মুয়াত্তা নিয়েছি। ঐ সময় হযরত শায়খুল হিন্দ জীবিত থাকলেও বার্ধক্যের দরুণ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আমরা তাঁর নিকট বরকত হিসেবে তিরমিযীর কয়েক সবক পড়ে রেওয়ায়েতে হাদীসের ইজাযত নিয়ে নিই।
অতপর হযরত কাশ্মীরী রাহ.-এর নিকট তিরমিযী পড়া শুরু করি। তিরমিযী খতম হলে সহীহ বুখারী শুরু করি। ঐ সময় চতুর্দিকে হযরত শাহ ছাহেবের দরসে হাদীসের ডঙ্কা বাজছিল। হযরত উসমানী রাহ.-এর নিকট সহীহ মুসলিম পড়ি। আর মুয়াত্তা পড়ি হযরত মুফতী আযীযুর রহমান ছাহেবের নিকট।
এদিকে পরিবারের কী অবস্থা ও দুর্দশা হচ্ছে যদিও আমি ভালভাবে বুঝতাম, তদুপরি তৃতীয় বছরও নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা শুরু করে দিই এবং দাওরায়ে হাদীসের বাকী কিতাবগুলো পড়ি। কিন্তু তিনবছর যাওয়ার পর পরিবারের, বিশেষকরে চাচা এবং ভাই নজীর আলীর পিড়াপিড়িতে বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হই। ফলে ১৩৩৪ হিজরীর মুহাররম মাসে পুনরায় দেশে চলে আসি। ঐ সময় আমার বয়স চব্বিশ বছর।
দেওবন্দে এক স্মরণীয় দুআ
দেওবন্দে থাকাকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর স্বরচিত জীবনীতে এবং মৌখিকভাবেও বলেন যে, দেওবন্দে এক শবে বরাতে আমি মসজিদে গেলাম। যতটুকু ভাগ্যে ছিল নামায-যিকির আদায় করলাম। অতপর অত্যন্ত কাকুতি-মিনতি ও কান্নাকাটি করে হাত উঠালাম এবং দুআ করলাম- হে আল্লাহ! আপনার এ পাপী বান্দাটিকে আপনার একমাত্র অনুগ্রহ ও অসীম দয়ায় দুনিয়ার সকল পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রেখে জীবনের শেষ পর্যন্ত ইলমী খেদমত করার তাওফীক দিন।
আলহামদুলিল্লাহ, ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ আমার প্রবল ধারণা যে, আল্লাহ তাআলা আমার এ দুআ কবুল করেছেন। আজ জীবনের সত্তর বছর অতিবাহিত হচ্ছে, তিনি আমাকে ঐভাবে রেখেছেন যেমনটি আমি দুআ করেছিলাম। (উল্লেখ্য, হযরত মুফতী ছাহেব এ থেকে আরো ষোল বছর পর ইনতেকাল করেন)
একবার তার নাতনী-জামাতা মুফতী ইযহারুল ইসলাম দামাত বারাকাতুহুম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, শৈশবে পড়ালেখার সময় আপনার কী নিয়ত ছিল। উত্তরে হযরত মুফতী ছাহেব বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, শৈশব থেকে ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমার উদ্দেশ্য ছিল, অন্য কোনো উদ্দেশ্য ও স্বার্থ, নফসের খায়েশ, মর্যাদার লোভ আমার ছিল না; যশ খ্যাতির আকাঙ্খার নিয়ত তো দূরের কথা। আল্লাহ তাআলা আমাকে সর্বদা মাহফ‚য রেখেছেন। উপরের জামাতে উঠে আমার এ নিয়ত আরো বেশি পাকাপোক্ত হয়েছে। অতপর দেওবন্দের শবে বরাতের দুআটির কথা বললেন।