বাইতুল্লাহর মুসাফির-২০
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
সফরের প্রথম দিবসে প্রবেশ করার পূর্বে আমি চাই, নয়দিনের সংক্ষিপ্ত সময়ে আমার দেখা ইরাক সম্পর্কে এখানে সামান্য কিছু আলোকপাত করতে।
একজন মানুষকে যেমন, একটি পরিবারকে যেমন, কোন দল ও গোষ্ঠীকে যেমন তেমনি একটি দেশকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য শুধু বাইরে থেকে দেখা যথেষ্ট নয়। বাইরের সঙ্গে ভিতর থেকেও দেখা আবশ্যক, কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই আমার সে সুযোগ কম ছিলো। তবু চেষ্টা করেছি যদ্দুর সম্ভব আমার দেখা যেন অন্তর্মুখী হয়। এজন্য সফরের সুনিদির্ষ্ট কর্মসূচীর বাইরেও আমি বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছি। এ বিষয়ে জনাব মাওলানা মহিউদ্দীন খান ছাহেব আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তার সহযোগিতা ছাড়া বাগদাদ যাদুঘর ও বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করা আমার পক্ষে হয়ত সম্ভব হতো না।
গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা অর্জন করার জন্য গ্রামেও গিয়েছি এবং গ্রাম ও গ্রামের মানুষকে কাছে থেকে দেখেছি। এছাড়া রাজধানী বাগদাদে কয়েকটি সম্ভ্রান্ত পরিবারেও খুব অন্তরঙ্গ পরিবেশে কিছু সময় যাপন করেছি। একারণে বলা যায়, নয়দিনের সফরে ইরাককে আমি শুধু বাইরে থেকে নয়, ভিতর থেকেও দেখার সুযোগ পেয়েছি। ফলে দেশটির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে প্রায়
বাস্তবানুগ ধারণা অর্জন করতে পেরেছি বলে আশা করা যায়। যদিও ইরাকের আসমান থেকে যমিন সবকিছু এখন বদলে গেছে, সবকিছু সারখার হয়ে গেছে এবং তখনকার সমৃদ্ধ এই মুসলিম দেশটি এখন শাব্দিক অর্থেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, তবু মনে হয় আমাদের আলোচনা একেবারে নিরর্থক হবে না। ‘ফানা হবে সবকিছু, থাকবে তো শুধু আল্লাহর নাম।’
ইরাকে প্রথমেই যা আমার নযরে পড়েছে তা হলো পর্দা, অর্থাৎ পর্দার অনুপস্থিতি। পর্দাহীনতা এখন অবশ্য সব মুসলিম দেশেরই সাধারণ ব্যাধি। ইরাকও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে অবনতিটা এখানে আমাদের চেয়ে কিছু বেশী এদিক থেকে যে, ইরাকী মেয়েরা মিনিস্কার্টে অভ্যস্ত এবং
মস্তকাবরণের সাথে অপরিচিত; অথচ ইউরোপের নগ্ন পরিবেশেও মুসলিম নারীরা স্কার্ফের দাবীতে সোচ্চার। বোরকার পর্দা ইরাকে একেবারে নেই বললে ভুল হবে। আছে শুধু মাযারে বয়স্কা ও বৃদ্ধাদের মাঝে। বাগদাদে, এমনকি আধুনিক বোরকা, যাকে আমরা এরাবিয়ান বোরকা বলি, নযরে পড়েনি একটিও। তবে আবরুহীনতা বা লজ্জাহীনতা দেখিনি কোথাও। নির্দিষ্ট মাত্রায় আরবীয় শালীনতা এখনো তাদের মাঝে রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এবং অফিসে দফতরে যেখানেই গিয়েছি মহিলা কর্মকতাদের মুখেও ‘ইনশাআল্লাহ’ ‘মাশাআল্লাহ’ ‘সুবহানাল্লাহ’ প্রচুর শুনতে পেয়েছি। তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে এক মহিলা কর্মকর্তার ডেস্কে কোরআন শরীফ এবং হাদীছের কিতাব রিয়াযুছ্-ছালিহীন দেখে ভালো লেগেছে। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেছি। শিক্ষকদের সঙ্গে এবং বিভিন্ন ছাত্রাবাসে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেছি। সামগ্রিক বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খারাপ কিছু দেখিনি। অতিরিক্ত যা পেয়েছি তা হলো শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও পাঠমনস্কতা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘যুগলসংস্কৃতি’ একেবারেই নযরে পড়েনি।
ইরাকের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে দুঃখকজন বিষয় এই যে, তাতে ধর্মীয় শিক্ষার কোন স্থান নেই। ফলে তরুণ প্রজন্ম স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ধর্মনিস্পৃহরূপে গড়ে ওঠছে, তবে পারিবারিক পর্যায়ে কিছুটা হলেও ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন এখনো বহাল রয়েছে, যার ছাপ এমনকি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের মাঝেও প্রত্যক্ষ করেছি। ধর্মাচরণে ‘নিজস্ব ত্রুটি’ ঢাকা দেয়ার জন্য সলজ্জ হাসি হেসে অনেকেই বলেছে, ‘আমার মা-বাবা/দাদা-দাদী কিন্তু খুব ধার্মিক’।
হক্কানী আলেম যাদের বলা হয় তারা বেশ কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। সরকারী বিধিবন্ধনের বাইরে হক কথা বলার কোন সুযোগ নেই। বরং অপ্রিয় হক কথার পরিণতি খুব কঠিন। তাই তারা উপায়হীন নীরবতার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তবে কয়েকজন সাহসী ও প্রাজ্ঞ আলিমের নযিরবিহীন কোরবানির ফলে দ্বীনী শিক্ষার অপ্রাতিষ্ঠানিক একটা ক্ষীণ ধারা এখনো প্রবাহিত রয়েছে। আমাদের উপমহাদেশের মত দ্বীনী শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখানেও যদি কায়েম রাখা সম্ভব হতো তাহলে অবশ্যই পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। দ্বীন, ইলমে দ্বীন এবং উম্মতের উপর ওলামায়ে হিন্দ-এর ইহসান ও অবদান যে কী বিরাট তা ইরাকে এসে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। মিসর, তিউনেশিয়া, আলজিরিয়া এবং পরবর্তীতে সোভিয়েট রাশিয়া থেকে মুক্ত দেশগুলো যারা সফর করেছেন তাদের মুখেও একথা শুনেছি।
ইরাক শিয়াপ্রধান দেশ। জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ শিয়া। তাই মাযারপ্রীতি সেখানে অসম্ভব রকম বেশী এবং যথারীতি তা শিরক ও বিদ‘আতে জর্জরিত। মাযারে প্রবেশের আগে মেয়েরা মিনিস্কার্টের উপর বোরকা বা চাদর চড়িয়ে নেয়, মাযার থেকে বের হয়ে আবার খুলে ফেলে। সন্তান লাভের জন্য মাজারে সুতা বাঁধার বিদআত এবং কবরে সিজদা করার শিরক সেখানেও আছে।
ইরাক বেশ আগে থেকেই পূর্ণ একনায়কতন্ত্রের দেশ। এর শুরু সাদ্দাম থেকে নয়, তিনি এর ধারাবাহিকতা মাত্র। তবে দেশ পরিচালনায় পূর্বসূরীদের তুলনায় তিনি যথেষ্ট গতিময়তা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন এবং আমার ধারণা, অন্যান্য একনায়কদের মত সাদ্দামের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নয়। এর কারণ সম্ভবত তার ব্যক্তিগত সততা, দেশপ্রেম এবং সুশৃঙ্খল জীবনাচার।
ইরাকের অখন্ডতা রক্ষার জন্য তিনি শুধু কঠোর হস্তে নয়, বরং বলতে গেলে নিষ্ঠুর হস্তেই দেশ শাসন করছেন। হিযবুল বা‘ছ (বাথপার্টি) হলো ইরাকে একক রাজনৈতিক দল। মাইকেল আফলাক নামে এক ইহুদি কমিউনিস্ট ছিলেন বাথপার্টির প্রতিষ্ঠাতা। আরব ওলামাদের যথাসাধ্য প্রতিরোধ সত্ত্বেও মাইকেল আফলাক ও তার বাথপার্টি শিক্ষিত আরব তরুণদের মাঝে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং একসময় সিরিয়া ও ইরাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। বস্ত্তত মাইকেল আফলাক এবং তার প্রতিষ্ঠিত বাথপার্টি ছিলো আরববিশ্বের জন্য মূর্তিমান অভিশাপ, যেমন তুরস্কে মুস্তফা কামাল এবং তার প্রতিষ্ঠিত নাহদা পাটি। পার্থক্য শুধু এই যে, দ্বিতীয়জন পৈত্রিক সূত্রে মুসলিম নাম ধারণ করতো। ফলে ইসলামী খেলাফতের বুকে খঞ্জর চালানো তার জন্য সহজেই সম্ভব হয়েছিলো। অবশ্য ‘আতাতুর্ক’ নামের এই বিষকাঁটা তৈরী করার পিছনেও যথারীতি ইহুদি মগজই সক্রিয় ছিলো।
বাকস্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের অধিকার সাদ্দামের ইরাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। বাথপার্টিই সেখানে রাজনীতির শুরু এবং শেষ এবং সাদ্দাম হোসায়নই বাথপার্টির ‘আওয়াল-আখের’। তবে এটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, শিয়া, সুন্নী, কুর্দী- এই তিন জনগোষ্ঠীর দেশ ইরাকের অখ তা এখনো টিকে আছে সাদ্দামের কঠোর শাসনের ফলেই। আমাদের দেশের মত গণতন্ত্রের চাষ যদি ইরাকের মাটিতে করা হতো তাহলে অখন্ড ইরাক হতো এতদিনে ইতিহাসের বিষয়। অবশ্য একটি প্রশ্ন যে কেউ করতে পারে, ইরাকের মুসলিম জনসাধারণের হৃদয়ের ভাষা যদি সাদ্দাম বুঝতেন, ইরাকের পুণ্যভূমিতে যদি ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো এবং জাতিগত সমস্যার ইনসাফভিত্তিক সমাধানের চেষ্টা যদি করা হতো তাহলে ফলাফল কী হতো?
আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী ইরাক গড়ে তোলার পিছনে সাদ্দামের অবদান অনস্বীকার্য। সামরিক শক্তিতে তিনি দেশকে যেমন এগিয়ে নিয়েছেন তেমনি দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদও মযবূত করেছেন। শেখশাসিত উপসাগরীয় আরবদেশগুলোর বিপরীতে ইরাকী জনগণকে তিনি এবং তার পূর্বসূরীরা কর্মঠ ও উদ্যমীরূপে গড়ে তুলেছেন। ইসলাম ও আরববিশ্বের শত্রুদের চক্রান্তজালে পা দিয়ে ইরানের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধের আবর্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পরও সাদ্দাম ইরাকের অর্থনীতি সচল রাখতে পেরেছেন। এটা শুধু তেলের জোরে নয়, এর পিছনে রয়েছে হাতেরও জোর। এটা অবশ্যই বিস্ময়কর যে, এত বড় যুদ্ধের মাঝেও ইরাকী জনগণের কর্মচাঞ্চল্যে ভাটা পড়েনি।
সারা ইরাক জুড়ে ‘সাদ্দাম জিন্দাবাদ’-এর একটা আবহ তৈরী করে রাখা হয়েছে এবং সাধারণ চোখে এটা যথেষ্ট দৃশ্যমানও। তবে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সাদ্দামপ্রীতির চেয়ে সাদ্দামভীতিই এখানে প্রবল। আর ভীতি কখনই প্রীতির মত স্থায়ী ফলদায়ক ঔষধ নয়, তবে তাতে সাময়িক উপশম অবশ্যই হয়। ইরাকের অখন্ডতার ক্ষেত্রে সাদ্দামভীতি সাময়িক উপশমেরই কাজ করেছে। সাদ্দাম যদি তার বিদেশী ‘বন্ধুদের’ থেকে নযর হটাতে পারতেন এবং ইসলামের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতেন, যেমন করেছেন শাহাদাতের আগে তাহলে আল্লাহ তাকে ব্যক্তিত্বের যে কারিশমা দান করেছিলেন তাতে খুব সহজেই তিনি আপন জনগণের অন্তরের মাঝে ভীতির পরিবর্তে প্রীতির স্থান লাভ করতে পারতেন।
বাগদাদের পুণ্যভূমিতে আমাদের প্রথম রাত ভোর হলো। বরাবরের মত বুড়ো মানুষটিই আমাদের ঘুম থেকে জাগালেন। তাঁর আদেশে আমি কামরায় কামরায় গিয়ে সবাইকে জাগালাম। একটি দৃশ্য আমাকে চমৎকৃত করেছিলো। হযরতের পাশের কামরায় আওয়ায দিতেই মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেছবাহ দরজা খুললেন। মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব মুনাজাত করছেন। তাঁর কান্নার মৃদু আওয়ায কানে আসছে। মাওলানা মেছবাহর মুখমন্ডলও ‘অশ্রুধোয়া’। জিজ্ঞাসা করলাম, ঘুমাননি? তিনি কিছু বললেন না, শুধু মৃদু হাসলেন।
হযরতের কামরায় নামায হলো। নামাযের পর হযরত আমাদেরকে যে নছীহত করেছিলেন, আজ এত বছর পরও আমার অন্তরে তা তরতাজা রয়েছে, যেন কালকের কথা! তিনি বলেছিলেন, ‘গতকাল পর্যন্ত আমরা এক পরিবেশে ছিলাম, এখন এসে পড়েছি অন্য পরিবেশে, হারামের পরিবেশ থেকে হোটেলের পরিবেশে। সুতরাং গাফলাত যেন আমাদের জন্য হারামের খায়র ও বরকত থেকে মাহরূমি ডেকে না আনে, বরং আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে হোটেলের পরিবেশ হারামের পরিবেশে পরিবর্তিত হয়ে যায়।’
হযরত আরো বলেছিলেন, ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য ‘আযমাইশ’ যে, আমরা হজ্ব থেকে কী পরিমাণ তারবিয়াত ও নূরানিয়াত হাছিল করেছি। মুখে দায়েমি যিকির এবং ইস্তিগফার জারি রাখেন, আর চলতে ফিরতে নযর নীচে রাখেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ হেফাযতে থাকবেন।’
হযরতের নছীহতের উপর আমল করা ছাড়া উপায়ও ছিলো না। কারণ শোরেশ কাশ্মীরের ভাষায়, চারদিকে ছিলো ‘হূরানে দুনিয়ার’ এমন চাহাল-পাহাল যে, নযর নীচু রাখলেই শুধু ঈমান রক্ষা পায়, হজ্ব নিরাপদ থাকে, অন্যথায় সব যেন বরবাদ হওয়ার জোগাড়!
ইরাক সফরের দ্বিতীয় রাতটি আমার জন্য ছিলো এক স্মরণীয় রাত। না, সফরের কোন ঘটনার জন্য নয়। স্মরণীয় এজন্য যে, সে রাত আমার ভোর হয়েছিলো এক মধুর স্বপ্নের জগতে বিচরণ করে। দেখি, আমি আল্লাহর ঘরে। মাতাফে মানুষজন নেই, শুধু আলো আর আলো! সেই আলোর বন্যায় ডুবন্ত হয়ে এবং অপার্থিব এক আনন্দে বিভোর হয়ে আমি হযরতের সঙ্গে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করছি। আমার চারপাশে আলোর ফোয়ারা, আর সর্বাঙ্গে ইহরামের শুভ্র লেবাস। বাইরের আলো ও শুভ্রতায় হৃদয়ও যেন হয়ে উঠেছিলো শুভ্র ও আলোকিত। আমার ইহরাম বারবার অবিন্যস্ত হয়ে যায়, আর হযরত ঠিক করে দেন। আমার দু’হাত যেন দু’টি ডানা। মাঝে মাঝে উড়ে উড়ে তাওয়াফ করছি। মুলতাযামে কেউ নেই। আমি একা বুক লাগিয়ে কাঁদছি, আর মুনাজাত করছি।
আবার দেখি, যমযমের পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে যমযম পান করছি। সেখানে শত শত মানুষ! আমি আনন্দিত চিত্তে পেয়ালা ভরে ভরে সবার মাঝে যমযম বিতরণ করছি!
ঘুম থেকে জেগে স্বপ্নের আবেশেই কেটে গেলো অনেকক্ষণ। স্বপ্নের ঘোর যখন কাটলো তখন বুঝতে পারলাম, মক্কা শরীফে নই, আমি এখন সুদূর ইরাকে বাগদাদের অভিজাত হোটেলে সুসজ্জিত কক্ষের কোমল শয্যায়। বাইতুল্লাহর তাওয়াফ ছিলো শুধু স্বপ্ন, মধুর এক স্বপ্ন! অনির্বচনীয় এক আনন্দে, পুলকে, শিহরণে আমার হৃদয়-মন আপ্লুত হলো। মনে হলো স্বপ্নের চেয়ে বড় নেয়ামত জীবনে আর কিছু নেই। বিরহের যে বেদনা ভিতরে ভিতরে হৃদয়কে দগ্ধ করে, একটি মধুর স্বপ্নের শীতল পরশ মুহূর্তের মাঝে সেই দহনজ্বালা জুড়িয়ে দেয়।
এমন মধুর স্বপ্ন আরো কয়েকবার দেখেছি ইরাকের সফরে। কখনো উটের কাফেলা, কখনো বিমানের যাত্রা; কখনো মিনা-আরাফার সমাবেশ, কখনো আল্লাহর ঘরের কালো গিলাফ, কখনো মসজিদে নববীর সবুজ গম্বুজ! এই সব মধুর স্বপ্ন ইরাকের পুরো সফরে আমার বিরহী হৃদয়কে অনাস্বাদিতপূর্ব এক প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ করে রেখেছিলো। আল্লাহ যদি বান্দাকে আনন্দ দিতে চান, আল্লাহ যদি বান্দার হৃদয় ও আত্মায় প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে চান, কতভাবেই তিনি তা পারেন! কখনো কাছে নিয়ে, কখনো দূর থেকে মধুর স্বপ্ন দেখিয়ে! হযরতকে স্বপ্নের কথা জানাতাম, তিনি খুশী হয়ে বলতেন, বহুত মোবারক খাব। একটি স্বপ্নের তা‘বীর করে হযরত বলেছিলেন ..... এবং যা বলেছিলেন, হযরতের ইনতেকালের পর বড় কষ্টকরভাবে তা বাস্তব হয়েছিলো; কষ্টকরভাবে, তবে অত্যন্ত কল্যাণপ্রসূরূপে।
হযরতের এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ইরাক-ইরান ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধের আলোচনার সুযোগ লাভ করা। শুরু থেকেই হযরত এ বিষয়ে তাঁর ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা প্রকাশ করে আসছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন যথাসম্ভব দ্রুত সরাসরি প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছাহেব সাধ্যমত যোগাযোগ করছেন, কিন্তু সন্তোষজনক ফল আসছে না। ইরাকী তথ্যমন্ত্রণালয় থেকে শুধু জানানো হচ্ছে, যুদ্ধপরিস্থিতির কারণে প্রেসিডেন্ট ভীষণ ব্যস্ত। সীমান্ত এলাকায় আবার ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আশ্বাস দিয়েছেন, প্রথম সুযোগেই তিনি হযরতকে সাক্ষাৎ দান করবেন।
হজ্বের কারণে সাময়িক বিরতির পর এবার কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়েছে ইরানের পক্ষ হতে। কারণ কোন দিক থেকেই ইরাক যুদ্ধ করার মত অবস্থানে ছিলো না, বরং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় সে যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো; এমনকি নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতিতেও তার আপত্তি ছিলো না, কিন্তু ইরান ছিলো তার একতরফা শর্তগুলোর বিষয়ে অনড়।
এখানে আমার মনে একটি বিরাট প্রশ্ন দেখা দিলো; ইরান সফরে যারা হযরতের সঙ্গী ছিলেন তাদের বক্তব্য মতে, ইরান হযরতকে একজন রাষ্ট্রপতির মর্যাদায় বরণ করেছে। ইরানের আধ্যাত্মিক নেতা যেখানে উপসাগরীয় শান্তি-প্রচেষ্টায় নিয়োজিত আমাদের মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আছরের নামাযের পর শুধু মোছাফাহার অনুমতি দিয়েছিলেন সেখানে হযরতের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ একঘন্টা অত্যন্ত অন্তরঙ্গ পরিবেশে আলোচনা করেছেন এবং হযরতের যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন। আমার প্রশ্ন হলো, ইরান সরকার এবং ইরানের ধর্মীয় নেতারা তো জানেন, হযরত এখন যুদ্ধ বন্ধের ইরানী প্রস্তাব নিয়ে ইরাকসফরে রয়েছেন। তো ইরান কি হযরতের শান্তিমিশনের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ হজ্ব-মৌসুমের যুদ্ধবিরতিকে আরো কয়েক দিন বহাল রাখতে পারতো না!? অন্তত হযরতের ইরাকে অবস্থানকালীন সময় পর্যন্ত!? যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবরে হযরত নিজেও অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। কিন্তু তাঁর ইরানসফরের সঙ্গীদের কাছে এ প্রশ্নের কোন জবাব ছিলো না। না মাওলানা আযীযুল হক ছাহেবের কাছে, না জনাব আখতার ফারূক সাহেবের কাছে। আখতার ফারূক সাহেব বরং আমাকে অবাক করে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কী প্রমাণ আছে যে, এ হামলা ইরান শুরু করেছে? ঠিকই তো, কোন প্রমাণ নেই! কারণ আমরা তো যুদ্ধক্ষেত্রের প্রত্যক্ষদর্শী নই। তবে জানতে ইচ্ছা করে, সাদ্দাম যে শুরু থেকেই যুদ্ধের জন্য খোমেনিকে দায়ী করে আসছেন তার বিপক্ষেই বা আমাদের কাছে কী চাক্ষুষ প্রমাণ আছে?
যাক, হোটেলের কামরায় নিশ্চেষ্ট সময় কাটানো ছাড়া আমাদের করারও কিছু ছিলো না। হযরতের কামরায় জামাতের সাথে নামায হয়। নছীহত ও হেদায়াতের বয়ান হয়। আর সফরের উদ্দেশ্যের কাছাকাছিও আসতে পারছেন না বলে হযরত অস্থিরতা প্রকাশ করেন। আমরা মোটামুটি খেয়ে-দেয়ে বেশ আরামেই ছিলাম।
হোটেল কত প্রকার ও কী কী, তা তখনো আমার জানা ছিলো না, এখনো নেই। তবে হোটেল মেরিডিয়ানের হাম্মাম বা বাথরুমটি আমার জন্য ছিলো চমকপ্রদ এক অভিজ্ঞতা। আগের যুগের রাজা-বাদশাহদেরও সম্ভবত এত আরামের গোসলখানা ছিলো না। মেরিডিয়ানের বাথরুমেই শ্যাম্পু নামের পদার্থটির সাথে আমার পরিচয় হয়। বাথটাবটি ছিলো এত বিরাট যে, দিবিব ডুব দিয়ে থাকা যায়।
হজ্বের সফরনামা না হলে এখানে বাথরুমের যথেষ্ট উপভোগ্য বর্ণনা দেয়া যেতো। কিন্তু ঐসব বেহুদা কথায় কী লাভ!
তবে হোটেলের নয়দশতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের বাগদাদ দেখার কথা আমি কখনো ভোলবো না। সত্যি বড় অপূর্ব ছিলো অত উঁচু থেকে রাতের দেখা বাগদাদ! সে যুগের আলফে লায়লার রহস্যময়ী নগরী এ যুগেও যেন স্বগৌরবে বিরাজমান। যুদ্ধ চলছে; তার মাঝেও পুরো বাগদাদ যেন আশ্চর্য আলোকসজ্জায় সজ্জিত এক স্বপ্নপুরী! রাতের তারাখচিত একটুকরো আকাশ যেন এখানে নেমে এসেছে! উপরে আকাশের দিকে তাকাও, তারকার আলোকসজ্জা তোমার দৃষ্টিকে অভিভূত করবে; নীচে মাটির দিকে তাকাও, মনে হবে, কোন শিল্পী রাতের আকাশ দেখে মনোরম এক ছবি এঁকে রেখেছে!
দজলা-ফোরাতের দেশ ইরাককে বলা হয় বিলাদুর-রাফেদাইন বা দুই নদীর দেশ। ইরাকের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের নাম মাছরিফুর-রাফেদাইন। এ থেকেই ইরাকের জন্য দজলা-ফোরাতের গুরুত্ব বোঝা যায়।
বাগদাদ এখন দজলা নদীর উভয় তীরে বিস্তার লাভ করেছে। এখন মানে, সেই আববাসী আমল! তখনই বাগদাদের উভয় অংশকে যুক্ত করার জন্য দজলা নদীর উপর সেতু স্থাপন করা হয়েছিলো। প্রাচীন সেতুর দু’একটি নমুনা এখনো রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। তার পরিবর্তে বেশ ক’টি আধুনিক সেতু নির্মিত হয়েছে, যা দেখলে সত্যি অবাক হতে হয়! সেতু তো নয় যেন রংধনু! দজলা নদীর সেতুর উপর দিয়ে যখন গাড়ী ছুটে যায়, মনে অদ্ভূত এক ভাবের উদয় হয়। পোলের নীচে পানির স্রোত যেন অতীত বাগদাদের প্রতিবিম্ব, আর পোলের উপর গাড়ীর স্রোত যেন আধুনিক বাগদাদের গতিময়তার গর্বিত প্রতীক!
রাজধানীর কেন্দ্রস্থলের অভিজাততম হোটেল মেরিডিয়ানের উঁচু বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আমি যে আলোকিত বাগদাদ দেখছি, তার আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য এক বাগদাদ; সেটি ইতিহাসের বাগদাদ, কখনো আলোকিত, কখনো কলঙ্কিত; ইসলামী উম্মাহর অসংখ্য জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের আলোকে যেমন আলোকিত তেমনি দুনিয়ার কুকুরদের লোভ-লালসা, হিংসা-প্রতিহিংসা, হানাহানি-ছিনাছিনি, ভোগ-বিলাস ও অনাচার-পাপাচারের কলঙ্কে কলঙ্কিত। বাগদাদ কখনো ছিলো মাদীনাতুস্সালাম- শান্তির শহর, কখনো হালাকু খার ধ্বংসযজ্ঞের অসহায় শিকার।
ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো আধুনিক আলোকসজ্জার বাগদাদ এবং ইতিহাসের পাতা থেকে জেগে উঠলো সুদূর অতীতের বাগদাদ। খলীফা আলমানছূর, হারুন রশীদ ও আলমু‘তাছিমের বাগদাদ যেমন আমি দেখতে পেলাম, যার অখন্ড প্রতাপে কম্পমান সমকালীন বিশ্বমানচিত্র, তেমনি দেখতে পেলাম দুর্বলচিত্ত, দুর্বলচরিত্র, সুর ও সুরায় মত্ত খলীফাদের বাগদাদ, যা ভোগের সাগরে মদের শ্রোতে ভেসে চলেছে চরম ধ্বংসের দিকে। দেখতে পেলাম আল্লাহর গযবরূপে ধেয়ে আসা তাতার-বাহিনীর ধূলিঝড়; দেখতে পেলাম রক্তের নদীতে ভেসে যাওয়া লাশের পর লাশ; শুনতে পেলাম কেয়ামতের শোরগোল এবং লুণ্ঠিতা নারীদের বুকফাটা চিৎকার!
একদিকে যেমন দেখতে পেলাম ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের দরসে ফিকাহ ও দরসে হাদীছ, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের বিচার-মজলিস, তেমনি দেখতে পেলাম গ্রীক দর্শন ও যুক্তিশাস্ত্রের সর্বপ্লাবী জোয়ার ও জয়জয়কার, দেখতে পেলাম খলীফাদের দরবারে ভূলুণ্ঠিত ন্যায় ও ইনছাফের গর্দানে জল্লাদের তলোয়ার। একদিকে যেমন দেখতে পেলাম শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী ও জোনায়দ বোগদাদীর নূরানী মাহফিল, যেখান থেকে উৎসারিত হচ্ছে আত্মশুদ্ধির অনিঃশেষ আলোকধারা এবং মা‘রিফাতের অন্তহীন শ্রোতধারা, তেমনি দেখতে পেলাম কবি আবু নাওয়াস ও আবুল আতাহিয়ার কাব্যসভা, তেমনি শুনতে পেলাম ইসহাক ইবনে ইবরাহীম ও আবুল ফারাজের সুর ও সঙ্গীতের ঝংকার।
ইতিহাসের বাগদাদ সত্যি যুগপৎ কল্যাণ ও অকল্যাণ, ন্যায় ও অন্যায় এবং শুভ ও অশুভের আশ্চর্য এক উদাহরণ। সেখানে একদিকে যেমন আবাদ ছিলো ইলম ও জ্ঞানচর্চার এবং মারিফাত ও আধ্যাত্মিকতার বহু মজলিস, অন্যদিকে তেমনি জমজমাট ছিলো সুর ও সঙ্গীতের, সুরা ও কাবাবের এবং নৃত্য ও নুপুরঝংকারের অসংখ্য ‘মায়ফিল’। এখানে যেমন ছিলো তাকওয়া ও খোদাভীতি এবং মুজাহাদা ও আধ্যাত্মসাধনার সুউচ্চ আলোকমিনার, যেমন ছিলো ন্যায় ও ইনছাফ এবং সততা ও সুবিচারের প্রজ্বলিত মশাল, তেমনি ছিলো ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তিপূজা এবং আনন্দ-উল্লাস ও ইন্দ্রিয় উন্মত্ততার নিশান-বরদার, তেমনি ছিলো অনাচার ও পাপাচার এবং শয়তানিয়াত ও জাহেলিয়াতের কালো কালো পাহাড়। এখানে রাতের অন্ধকারে জায়নামাযে অসংখ্য চোখ থেকে যেমন অশ্রু ঝরতো তেমনি শরাবের মজলিসে অসংখ্য পেয়ালা থেকে রঙ্গীন মদ উপচে পড়তো। বাগদাদ ছিলো এমনই আশ্চর্য এক শহর যে, ইমাম শাফেয়ী (রহ) তাঁর এক প্রিয় শাগরিদকে বলেছিলেন, ‘তুমি বাগদাদ দেখোনি! তাহলে তো পৃথিবীর কিছুই দেখোনি!’
পারস্যযুগে বাগদাদ ছিলো দজলা নদীর পশ্চিম তীরে ছোট্ট এক বস্তি। কথিত আছে, পারস্য-সম্রাট খসরু তার এক মূর্তিপূজক ক্রীতদাসের প্রতি খুশী হয়ে এ অঞ্চলটি তাকে দান করেছিলেন। আর সে তার উপাস্য মূর্তি ‘বাগ’-এর দাদ বা দানরূপে এর নাম রেখেছিলো বাগদাদ (বাগদেবতার দান)।
এমনও কথিত আছে যে, পারস্য- সম্রাট নওশেরাওয়াঁ এখানে বসে ন্যায় ও ইনছাফের বিচার করতেন বলে এর নাম হয়েছে বাগদাদ। বাগ মানে বাগান বা উদ্যান, আর দাদ মানে সুবিচার, সুতরাং বাগদাদ মানে সুবিচারের বাগান বা ন্যায়-উদ্যান।
দ্বিতীয় আববাসী খলীফা আলমানছুর ১৪০ হিজরীতে বাগদাদে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। কারণ এর একদিকে ছিলো দজলা নদী। এ নৌপথে সুদূর চীনদেশের সাথেও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিলো, অন্যদিকে ছিলো ফোরাত নদী। ঐ পথে সিরিয়া ও রাক্কার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাও সহজ ছিলো।
খলীফা আলমানছুর বাগদাদের নতুন নাম রাখেন মাদীনাতুস্-সালাম বা শান্তির শহর। এই শান্তি-শহরের চমকপ্রদ কাহিনী এই যে, দীর্ঘ বহু শতাব্দী যাবৎ একটি মুসলিম খেলাফতের রাজধানী হলেও কোন খলীফার মৃত্যু এখানে হয়নি। সবারই মৃত্যু হয়েছে কোন না কোনভাবে বাগদাদের বাইরে।
সেই অতীতকাল থেকে এখন পর্যন্ত দজলা নদীর পশ্চিম তীরের বাগদাদ রুছাফা নামে এবং পূর্বতীরের বাগদাদ কারখ নামে পরিচিত। এভাবেই ইতিহাসের অসংখ্য স্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তি কারখী ও রছাফী নামে পরিচিত হয়েছেন।
তথ্যমন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে ঐতিহাসিক স্থান ও মাযার যিয়ারাতের একটি কর্মসূচী আমাদের দেয়া হলো। গাইডরূপে মন্ত্রণালয়ের যে সিনিয়র কর্মকর্তা নিযুক্ত হলেন তার নাম মুহসিন বিন মুকাররাম, অত্যন্ত সপ্রতিভ, চৌকস ও মার্জিত রুচির নিপাট ভদ্রলোক। উদ্ভাসিত মুখমন্ডলের এই ভদ্রলোকের ঠোঁটে একটি অমায়িক হাসি সবসময় লেগে থাকতো। দেখলে যে কারো বিশ্বাস হবে সরলতা ও আন্তরিকতা হচেছ তার স্বভাবজাত। পুরো সফরে তিনি আমাদেরকে খুব আনন্দদায়ক সঙ্গ দান করেছেন; বিশেষ করে হযরত হাফেজ্জীহুযূরের যাবতীয় সুবিধা-অসুবিধার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন এবং তাতে যতটা না ছিলো দায়িত্বপালন তার চেয়ে বেশী ছিলো অন্তরের আকর্ষণ।
আমার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সখ্যও গড়ে উঠেছিলো। সেই সুবাদে তিনি আমাকে বাগদাদ থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরে তার গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে, তার সৌজন্যে ইরাকের গ্রামীণ জীবনের অন্তত একটি খন্ড চিত্র দেখার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। সে সম্পর্কে যথাস্থানে আলোচনা করার ইচ্ছে আছে।
আমাদের কর্মসূচীর প্রথম পর্বে ছিলো সে যুগের আধ্যাত্মিক জগতের শ্রেষ্ঠ পুরুষ হযরত শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী (রহ)-এর মাযার যিয়ারাত, পাকভারত ‘সারযামিনে’ যিনি ‘বড় পীর’ নামে সুপরিচিত।
সেদিন ছিলো শুক্রবার। নাস্তার পর হযরত হাফেজ্জীহুযূরের সঙ্গে হোটেল থেকে রওয়ানা হলাম। বাগদাদ তখন একটি কর্মচঞ্চল রাজধানীর রূপ নিয়ে জেগে ওঠেছে। পথে অবশ্য কোন পথচারী নেই। প্রশস্ত সড়কে শুধু গাড়ী আর গাড়ী! তবে সুশৃঙ্খল এবং গতি সুনিয়ন্ত্রিত। সবকিছু ছবির মত ঝকঝকে তকতকে!
আমি আমার দেশের বাইরে এসেছি জীবনে এই প্রথম এবং আমার সফর ছিলো আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে, দেশভ্রমণের উদ্দেশ্যে নয়; যদিও দেশভ্রমণে রয়েছে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের অবারিত সুযোগ। তাই মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার আদেশ হলো, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো, আর দেখো, কেমন ছিলো অপরাধীদের পরিণাম!
কিন্তু আমার এই সামান্য জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে সফর ও দেশভ্রমণের তেমন কোন সুযোগ আসেনি। আমি ইউরোপ- আমেরিকার কোন শহর দেখিনি। প্যারিস ও ভেনিস আমার অজানা, রোম ও নিউইয়র্ক আমার অচেনা, এমনকি বৈরুত ও দামেস্কও আমার অদেখা। সুতরাং পৃথিবীর উন্নত সব নগর-শহরের সৌন্দর্য বিচার করা এবং রূপজৌলুস তুলনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিভিন্ন ভ্রমণ কাহিনী পড়ে পৃথিবীর সুন্দরতম শহরগুলোর সৌন্দর্যের একটি কল্পরূপ আমি অর্জন করেছি এবং বলতে দ্বিধা নেই, বাগদাদের সৌন্দর্য আমার সেই কল্পনাকে অতিক্রম করেছে। বাগদাদ শুধু আধুনিক স্থাপত্যের দৃষ্টিনন্দন সুউচ্চ ইমারত ও ভবনের শহর নয়, বাগদাদ সবুজ বৃক্ষেরও শহর। সবুজ বিভিন্ন শহরে আছে, তবে সবুজের এমন শান্তশীতল ছায়া শুধু গ্রামেই কল্পনা করা যায়, শহরে নয়। পথের দু’পাশে যেমন খেজুরবৃক্ষের সারি, তেমনি সড়কদ্বীপগুলোতে আশ্চর্য সুন্দর ফুলের কেয়ারি। আবার শহরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ছোট বড় অনেক বৃক্ষ-উদ্যান। সবুজের নির্জনতা যেন শহরের সকল শব্দ ও কোলাহল শোষণ করে নেয়। তাই বাগদাদ এত কর্মমুখর, অথচ এমন শান্ত-নীরব! বাগদাদের একমাত্র অসৌন্দর্য যা আমার নযরে এসেছে তা হলো বিভিন্ন সড়ক-মোড়ে স্থাপিত প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের মূর্তি। বড় পীরের শহরে আর যাই হোক, মূর্তি বড় বেমানান। সাদ্দাম কী চান, জনপ্রিয়তা? মানুষের ভক্তি-ভালোবাসা? সে জন্য রাস্তার মোড়ে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কি খুব বেশী বুদ্ধির পরিচয়!
রাজধানীর আধুনিক এলাকা অতিক্রম করে অবশেষে আমাদের গাড়ী পুরোনো শহরে প্রবেশ করলো। এতক্ষণ দেখেছি আধুনিকতার চোখ ধাঁধানো রূপ, এখন দেখছি প্রাচীনতার বিমর্ষ মলিন চেহারা। আধুনিক বাগদাদ যেন যৌবনের বসন্তকাল, আর প্রাচীন বাগদাদ যেন যৌবনের পড়ন্ত বিকাল। তবে এই জীর্ণতা ও প্রাচীনতার মাঝে রয়েছে অন্যরকম এক মাদকতা, যার স্বাদ গ্রহণ করতে পারে শুধু অতীতমুখী মানুষের ইতিহাস-কাতর হৃদয়। শহরের অপ্রশস্ত পথ, প্রাচীন ভবন এবং আরবী জুববা যেন নীরব ভাষায় আমাকে বলছে, আমি তোমার হারানো বাগদাদ! আমি তোমার অতীত ইতিহাস! আমি তোমার লুণ্ঠিত গৌরবের মলিন চিহ্ন! আমাকে চোখ মেলে দেখো এবং হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করো। তুমি তো তালিবে ইলম! তুমি তো নিযামিয়ার উত্তরাধিকারী! আধুনিক বাগদাদে কিছু নেই তোমার জন্য; তোমার যা কিছু তা এখানে এই সব প্রাচীন ভবনের ইট-গাঁথুনিতে!
একটি পুরোনো সড়কের মাথায় এসে আমাদের গাড়ী থামলো। হযরত অবতরণ করলেন, আমরা নামলাম। এখানে মুহসিন আমাকে মুগ্ধ করলেন এবং লজ্জিত করলেন। আমরা কেউ অবতরণকালে হযরতের হাত ধরার কথা ভাবিনি। এটা প্রয়োজন নয়, এটা হলো সম্মান প্রদর্শন। মুহসিন দ্রুত এগিয়ে এলেন এবং হযরতের হাত ধরে সহায়তা দিলেন, আর হযরত মৃদু হেসে জাযাকাল্লাহ বললেন। ঘটনাটি ছোট্ট, কিন্তু এখনো আমার মনে আছে, কারণ পরদেশী মানুষটির সামনে নিজেকে সেদিন খুব লজ্জিত মনে হয়েছিলো।
এ ঘটনাটি হতে পারে হযরতের প্রতি নিকটবর্তী ও দূরবর্তীদের আচরণ ও অভিব্যক্তির একটি সুন্দর প্রতীক! আর নিকটবর্তীদের থেকে নিজেকে আমি বাদ দেবো কেন!
একটি অপ্রশস্ত গলি পার হয়ে আমরা মসজিদের প্রবেশদ্বারে উপস্থিত হলাম। বিরাট মসজিদ, তার পাশে মাদরাসা এবং বড় পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ)-এর মাযার। শায়খ তাঁর জন্মভূমি উত্তর ইরানের জিলান প্রদেশ থেকে মাত্র আঠারো বছর বয়সে বাগদাদে এসেছিলেন। তাঁর ইলমচর্চা ও আধ্যাত্মিক সাধনার গৌরবময় জীবন এই মসজিদ-মাদরাসাকে কেন্দ্র করেই অতিবাহিত হয়েছে। এখনও তিনি এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত।
মাজারের খুব কাছেই ছিলো প্রাচীন বাগদাদের নগরপ্রাচীর। মসজিদ, মাদরাসা ও মাযার তো এখনো আছে, কিন্তু মাটির সাথে মিশে গেছে নগরপ্রাচীরের সব চিহ্ন। ইট-পাথরের চিহ্ন মুছে যায়, থেকে যায় শুধু আলোর নিশান। এটাই আল্লাহর চিরন্তন বিধান। বাগদাদের নগরপ্রাচীর যেমন আজ বাকি নেই তেমনি নেই সে যুগের খলিফার রাজপ্রাসাদ, কিন্তু রূহানি জগতের বাদশাহ শায়খ জিলানী এখনো জীবন্ত, তাঁর মসজিদ এখনো আবাদ। জীবনকালে যেমন তিনি হেদায়াতের আলো ছড়িয়েছেন মানুষের হৃদয়রাজ্যে, তেমনি মৃত্যুর পর যুগ যুগ ধরে সারা মুসলিম জাহানে প্রবাহিত রয়েছে তাঁর রূহানি ফয়য ও ফায়যানের কল্যাণধারা এবং এ ধারা ইনশাআল্লাহ অব্যাহত থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। দুনিয়ার বাদশাহ মৃত্যুর পর মরে যায়, আর রূহানিয়াতের বাদশাহ মৃত্যুর পর হন অমর। তবু মানুষ পেতে চায় দুনিয়ার বাদশাহি, সোনার সিংহাসন এবং মণিমুক্তার মুকুট! তবু মানুষ গ্রহণ করে না রূহানিয়াতের তাজ এবং হতে চায় না ‘জাহানে কলবের সারতাজ’!
হযরত হাফেজ্জীহুযূর শায়খ জিলানী (রহ)-এর মাযারে উপস্থিত হলেন, যিয়ারাত করলেন, কিবলামুখী হয়ে এবং দীর্ঘ সময় মোরাকাবায় আত্মনিমগ্ন থাকলেন। আমরা তাঁর সঙ্গে ছিলাম এবং এই সঙ্গটুকুই এখন জীবনের বড় সম্পদ।
এই মহান সাধকের পবিত্র জীবনের টুকরো যে সকল ঘটনা জানা ছিলো সেগুলোর কিছু কিছু তখন আমার স্মৃতির আকাশে যেন খন্ড খন্ড মেঘের মত ভেসে বেড়াতে লাগলো। তিনি যখন অল্প বয়সের বালক তখনো তাঁর সত্যবাদিতা ও নির্ভীকতা ডাকাত-সরদারের কঠিন হৃদয় বিগলিত করেছিলো! তিনি যখন মাত্র যুবক তখনো তাঁর ওয়াযের মাহফিলে মুরদা দিল যিন্দা হতো এবং কান্নার রোল উঠতো। পাপাচারী ও যালিম দুষ্কর্ম থেকে তাওবা করতো, আর শরাবী নেশার শরাব ছেড়ে মা‘রেফাতের শরাব পান করে ধন্য হতো।
শায়খের একটি ঘটনা খুব প্রসিদ্ধ। তিনি যখন ইবাদত ও রিয়াযাত-মুজাহাদার উচ্চতম সোপানে উপনীত তখন একবার তাঁর সামনে একটি আলো উদ্ভাসিত হলো। সেই আলোর মাঝে একটি আলোকিত আকৃতি আত্মপ্রকাশ করলো। শায়খ জিলানী (রহ) আলো ও আলোকিত আকৃতি দেখতে পেলেন; দেখে চমকিত হলেন। এমন তো কখনো হয়নি! এ কিসের আলো! কে এই আলোকিত আকৃতি! শায়খকে আল্লাহ নূরানি কলব দান করেছিলেন। আল্লাহর সঙ্গে যার তা‘আল্লুক হয়, তার কলবে নূরানিয়াত পয়দা হয়। তা‘আল্লুক যত গভীর হয়, নূরানিয়াত তত উজালা হয়। হতে হতে একসময় বান্দা আল্লাহর ইশক ও মুহাববাতে সম্পূর্ণ ফানা হয়ে যায়, তখন বান্দার কলব আর শুধু গোশতের পিন্ড থাকে না, পূর্ণ নূর হয়ে যায়। ‘নাস্তি ও হাস্তির’ সমস্ত হাকিকত ও রহস্য তার সামনে তখন পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হয়ে যায়। ঐ বান্দা তখন কোন কিছুতে আর বিভ্রান্ত হয় না। শয়তান তখন যুলমানি ও নূরানি কোন অস্ত্র দ্বারাই তাকে আর ঘায়েল করতে পারে না। সে তখন ঐ বান্দার নিকটে আসা দূরের কথা তাকে বরং সভয়ে এড়িয়ে চলে।
শায়খ জিলানী (রহ)-কে আল্লাহ তা‘লা ফানা ফিল্লাহর সেই মাকাম দান করেছিলেন; তাই মুহূর্তের মাঝে ঐ আলো এবং আলোকিত আকৃতির হাকীকত তাঁর সামনে খুলে গেলো। তাই যখন সেখান থেকে আওয়ায এলো, হে আব্দুল কাদির, আমি তোমার রবব, খোশখবর কবুল করো, তোমার ইবাদত-মুজাহাদায় এবং বন্দেগি-মুরাকাবায় আমি খুশী। যাও, আজ থেকে তুমি ইবাদতের এবং হালাল-হারামের কয়েদ থেকে আযাদ। সুতরাং খুশী হও এবং শোকর করো হে আমার প্রিয় বান্দা!
‘গায়বি’ আওয়ায এলো, শায়খও বুঝলেন। তিনি খুশী হলেন এবং শোকর করলেন, আল্লাহর। তিনি গযবের স্বরে বললেন, বাবা আদমের দুশমন! দূর হ! দূর হ!
মুহূর্তে দূর হয়ে গেলো সেই আলো এবং আলোর মাঝে প্রকাশিত ‘আলোকিত’ সত্তা। সবকিছু যেন ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেলো। কিন্তু ঘটনার সেখানেই শেষ নয়। শয়তানের হামলা কখনো একবারে শেষ হয় না। বারবার সে হামলা করে এবং হামলার রূপবদল হয়। একভাবে ব্যর্থ হয়ে আরেকভাবে হাযির হয়। ক্রমে তার হামলা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম হয়। তাই কোরআনে মানুষকে আল্লাহ শয়তানের হামলা সম্পর্কে বারবার হুঁশিয়ার করেছেন, আর বলেছেন, ‘তুমি অভিশপ্ত শয়তানের (ধোকা) হতে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করো।’
আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করলেই শুধু তুমি নিরাপদ। শয়তানের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম হামলা থেকে তোমার জ্ঞান ও বিদ্যাবুদ্ধি তোমাকে রক্ষা করতে পারে না, তোমার সাধনা ও মুজাহাদা এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তোমাকে রক্ষা করতে পারে না; পারে শুধু আল্লাহর হেফাযত।
এখানেও তাই হলো, ‘ইবলীস কা বাচ্চা’ পাঁয়তারা বদল করে আরো সূক্ষ্ম হামলা চালালো, ‘গায়ব’ থেকে সে আওয়ায দিলো, আফসোস, আমার হামলা থেকে তোমার ইলম তোমাকে বাঁচিয়ে দিলো। নইলে আমি তো কম সে কম সত্তর জন সাধকের সাধনা নস্যাৎ করেছি এ অস্ত্র দ্বারা।
কিন্তু শয়তানের দুর্ভাগ্য, এবার তার পাল্লা পড়েছিলো জিলানের আব্দুল কাদিরের সঙ্গে! তিনি চিৎকার করে উঠলেন, দূর হ, মরদূদ, খবীছ! ইলম নয়, আমাকে তো রক্ষা করেছেন আল্লাহ।
আধ্যাত্মিকতার পথে যারা অনভিজ্ঞ পথিক, এ ঘটনায় তাদের জন্য রয়েছে বিরাট শিক্ষা। তাদের বুঝতে হবে যে, তরীকাত বা মা‘রেফাত শরীয়ত থেকে আলাদা হতে পারে না এবং কোন বান্দা, মা‘রেফাতের যত উচ্চ স্তরেই ঘটুক তার উত্তরণ, শরীয়তের ইবাদত ও হালাল-হারামের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। আগুনের আলো এবং নূরের আলোর মাঝে যারা পার্থক্য করতে পারে না তারাই বিভ্রান্ত হয় এবং ভ্রষ্ট হয়।
হযরত হাফেজ্জীহুযূর তখনো তাঁর মোরাকাবায়। কী রহস্যের লীলা-খেলা চলছে তখন তাঁর কলবের জগতে, তা বোঝার সাধ্য আমাদের কোথায়! হঠাৎ মনে হলো, আমি যেন একটি সতর্কবাণী শুনলাম- ‘সাবধান, সাবধান! এ অকুল দরিয়ায় নৌকা ডুবেছে কত সাধকের, কত সওদাগরের! নিরাপদে দিতে হলে পাড়ি, মা‘রেফাতের নৌকায় পাল তোলো শরীয়তের।
আমি তখন আল্লাহর কাছে
অন্তরের আকুতি নিবেদন করলাম এভাবে- হে আল্লাহ, তোমার অনুগ্রহে তোমার বান্দা তোমার ঘর তাওয়াফ করে এসেছে, তোমার হাবীবের রাওযা যিয়ারাত করে এসেছে। হে আল্লাহ, তোমার ঘরের ওছীলায়, তোমার হাবীবের ওছীলায় এবং তোমার রহমতের ওছীলায় আমাকে হেফাযত করো শয়তানের সব রকম ধোকা হতে।
হযরতের মোরাকাবা শেষ হলো, তিনি চোখ মেলে তাকালেন। মনে হলো, বহু দূরের সফর থেকে ফিরে এলেন। আসলে এ জগতের সফর তো চলতে থাকে জীবনভর; এ সফরের শেষ মানযিল তো মওতের আখেরি লামহা। মসজিদের সামনের দিকে একটি প্রাচীরের আড়ালে ছিলো শায়খ জিলানী (রহ)-এর মাযার। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা মাদরাসার অঙ্গনে চলে এলাম।
এ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হলেন শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী (রহ)-এর শিক্ষক শায়খ কাযি আবু সা‘আদ মুখার্রিমী (রহ)। তাঁর মৃত্যুর পর হযরত জিলানী (রহ) এ মাদরাসাকেই তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা ও তা‘লীম-তারবিয়াত এবং জ্ঞান-গবেষণা ও আধ্যাত্মিক সাধনার কেন্দ্ররূপে গ্রহণ করেন। তাঁর মাওয়াইয বা ওয়াযসংকলনকে উচ্চতর আরবী সাহিত্যের আদর্শ নমুনা মনে করা হয়। তাতে দেখা যায়, তাঁর শিক্ষার মূল কথা হলো, মা‘রেফাতের সাধককে অবশ্যই শরীয়তের অনুগত এবং সুন্নাতের অনুসারী হতে হবে।
শায়খ জিলানী (রহ)-এর শিক্ষাকেন্দ্র এ মহান মাদরাসাটি যুগের শত দুর্যোগ মুকাবেলা করে আজো টিকে আছে। মাদরাসার প্রাঙ্গনে কালের এই নীরব সাক্ষীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি অভিভূত হলাম। আমার হৃদয় ও আত্মা ইলমের সাধনার পথে অদম্য এক উদ্দীপনা লাভ করলো। কল্পনার জগতে আমি দেখতে চেষ্টা করলাম মাদরাসার সেই নূরানি হুজরাটি যেখানে এই মহান সাধকের কলম নূরের হরফে লিখতো ইলমের বাণী। আমি যেন দেখতে পেলাম একটি উজ্জ্বল ছবি, ধ্যানমগ্ন সাধকের ছবি, যার ডান হাতের কলম দ্রুত সঞ্চালিত হচ্ছে ডান থেকে; একবার দোয়াতে ডুব দেয়, আবার কাগজের পাতায় সাঁতার কাটে। সেই ছবিটি কখনো দেখলাম দিনের আলোতে, কখনো রাতের অাঁধারে, আবার কখনো মোমের বাতিতে। তখন আমি সমগ্র অন্তর দিয়ে আল্লাহর কাছে কামনা করলাম, সেই নূরানী কলমের ফায়য ও ফায়যান আমার দুর্বল কলমও কিছু না কিছু যেন অর্জন করতে পারে।
জিলানী-মাদরাসার এখন যিনি প্রধান তাঁর নাম শায়খ আব্দুল কারীম আলমুদাররিস। নূরানি চেহারার সহজ-সরল এই বুযুর্গ আমাদের হযরতকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন। তথ্যমন্ত্রণালয় থেকে হযরতের আগমন-সংবাদ আগেই তাঁকে অবহিত করা হয়েছিলো এবং সাক্ষাতের অনুমতি নেয়া হয়েছিলো। আমাদের গাইড মুহসিন জানালেন, ইনি সাধারণত সরকারী মেহমানদের সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। কিন্তু তোমাদের শায়খের কথা শুনে সানন্দ-সম্মতি প্রকাশ করেছেন।
শায়খে ইরাক ও শায়খে বাঙ্গাল, উভয়ের মাঝে দীর্ঘক্ষণ আন্তরিক আলাপ-আলোচনা হলো। আমি তরজমার দায়িত্ব পালন করলাম। প্রাচীন যুগের স্রোতধারার অনুসারী এই নূরানি মানুষটিকে আমাদের হযরত খুব পছন্দ করলেন। তাঁর কাছে আধুনিক কোন বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নেই, কিন্তু সাদ্দামের মত কঠিন একনায়কও তাঁকে সমীহ করেন। মুহসিনের কাছেই জানা গেলো, শায়খ কখনো প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে যাননি, প্রয়োজনে প্রেসিডেন্ট নিজে সময় চেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। এমনই হয়, যুগে যুগে এমনই হয়েছে এবং এমনই হবে। এ ধারা যত ক্ষীণ প্রবাহেই হোক, এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে।
আজ দীর্ঘ সাতাশ বছর পর যখন এই সফরনামা লিখছি তখন ঐ মহান আলিম ও শায়খে কামিল হয়ত দুনিয়ায় নেই; সেই বাগদাদও তো এখন নেই! নেই বাগদাদের ‘লৌহমানব’ সাদ্দাম হোসায়ন! কিন্তু শায়খের নিবেদিতপ্রাণ ছাত্ররা?! সেদিন জিলানী-মাদরাসার প্রাঙ্গনে তাঁর যে অল্প ক’জন তরুণ ছাত্রকে দেখেছিলাম তারা এখন কোথায়?! আশা করবো, তারা এখন জিহাদের ময়দানে যামানার হালাকু খার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এবং দুশমনের বুক ছিদ্র করে, আর দুশমনের গুলিতে ছিদ্রবুক নিয়ে শাহাদাত বরণ করছেন।
শায়খ নিজে ঘুরে ঘুরে হযরতকে মাদরাসার কুতুবখানা দেখালেন। তিনি বললেন, ‘হযরত জিলানীর মাযারের বয়স যত, এ কুতুব-খানার বয়স তার চেয়ে বেশী।’
বিশাল সংগ্রহ! দেখে অবাক হওয়ার মত! আধুনিক যুগের মুদ্রিত কিতাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রাচীন যুগের হাতে লেখা বহু কিতাব। সেই কিতাবের ঘ্রাণ সহজেই অনুভব করা যায়, তখন মনের অবস্থা কেমন হয় তা নিষ্প্রাণ কিছু শব্দ দিয়ে কীভাবে বোঝাবো!
এরপর আমাদের সামনে এলো তাতারীদের হাতে বাগদাদের ধ্বংসযজ্ঞের মর্মন্তুদ ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী! শায়খ আমাদের হযরতের হাতে একটি হস্তলিখিত জীর্ণদসাগ্রস্ত কিতাব তুলে দিয়ে বললেন, ‘তাতারীদের হাতে বাগদাদের বরবাদির পর এই কিতাবটি দজলা নদীর পানি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো।’
আমি চমকে উঠে কিতাবটির দিকে তাকালাম। আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। চোখের সামনে গোটা কুতুবখানা যেন দুলতে লাগলো। কম্পিত হাতে হযরতের কাছ থেকে কিতাবটি নিলাম। কিছু কিছু লেখা মুছে গেছে। কিতাবের শেষ পৃষ্ঠায় নীচের দিকে অন্য একটি হাতের লেখা দেখতে পেলাম। লেখাটি আমি পড়লাম আমার দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বুকের উপর হাত রেখে-
‘৫৫৬ হিজরীতে এই কিতাব আমি দজলা নদীর পানি থেকে উদ্ধার করেছি। আমাদের সব কিতাব তাতারীরা দজলা নদীতে ফেলে দিয়েছিলো।
লেখাটির নীচে উদ্ধারকারীর স্বাক্ষর ছিলো। আফসোস, কিতাব এবং তার উদ্ধারকারীর নাম এখন আমার মনে নেই।
বাগদাদের বরবাদির ইতিহাস আমি পড়েছি। লক্ষ লক্ষ মানুষের গণহত্যার পর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে, বাগদাদ শহরে কোন জীবিত মানুষ আর চোখে পড়ে না। কিন্তু হালাকু খান অত সহজে ছাড়ার পাত্র
ছিলো না; সে তো এসেছিলো বাগদাদে আল্লাহর গযব হয়ে। তার হুকুমে সব মসজিদে আযান দেয়া হলো। সেই আযানের ধোকায় যে হতভাগারা রাস্তায় বের হলো তাদেরও কতল করা হলো। প্রত্যক্ষদর্শী ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, ‘বাগদাদ তখন রক্তের বন্যায় ভাসছিলো।’
তারপরো হালাকু খার সন্দেহ হলো, হয়ত কিছু মানুষ এখনো রয়ে গেছে মাটির নীচে গোপন কুঠুরিতে। হুকুম জারি হলো, ‘দজলা নদীর বাঁধ কেটে দাও।’ বাগদাদ শহর তলিয়ে গেলো দজলানদীর পানিতে। এরপর আর একজন মানুষও বাগদাদে জীবিত ছিলো না। ঐতিহাসিকদের মতে বিশলাখের বেশী মানুষ নিহত হয়েছিলো বাগদাদে তাতারীদের হাতে। সেদিন দজলার পানি যেভাবে ছুটে এসেছিলো, বিশলাখ বাগদাদী যদি খালি হাতেই সেভাবে ছুটে যেতো তাতারীদের দিকে তাহলে মুসলমানদের বদলে তাতারীদেরই লাশের স্তূপ তৈরী হতো বাগদাদের বাইরে। কিন্তু হায়, স্বয়ং খলীফাতুল মুসলিমীন তখন ডুবে ছিলেন শরাবের পেয়ালায়! তাতারীদের রক্তের নেশা যখন পূর্ণ হলো তখন তারা মেতে উঠলো কুতুবখানা ধ্বংসের পৈশাচিকতায়। গোবি মরুভূমির এই যাযাবর পশুদের বুঝে আসেনি যে, ‘কাগজের বান্ডিল’ কেন এভাবে আলমিরাতে তুলে রাখা হয়! তাদের প্রতিহিংসা এমনই ভয়ংকর ছিলো যে, যেখানে যত ‘কাগজের বান্ডিল’ ছিলো, সব তারা দজলার পানিতে ফেলে দিয়েছিলো। স্পেনে ‘সভ্য’ খৃস্টানদের হাতে জ্বলেছিলো ‘কুরতুবা’র কুতুবখানা, আর বাগদাদে বর্বর তাতারীদের হাতে দজলার পানিতে ডুবেছিলো ‘কাগজের বান্ডিল’!
আমি লক্ষ্য করলাম, কিতাবের শেষ পৃষ্ঠার সেই লেখাটিরও একদু’টি হরফ পানির দাগে ঝাপসা হয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত, এটা দজলার পানির দাগ নয়; কিতাবটি উদ্ধার করে এই লেখাটি যিনি লিখেছেন এটা তার চোখের পানির দাগ। হাজার বছর পর আরো দু’ফোঁটা চোখের পানি সেই কিতাবের আরো কিছু লেখা ভিজিয়ে দিলো। আমি জামার কাপড় দিয়ে চোখের পানিটা মুছে কিতাব ফিরিয়ে দিলাম শায়খের হাতে।
পরে বাগদাদ জাদুঘরেও দজলার পানি থেকে উদ্ধার করা আরো কিছু কিতাব আমি দেখেছি। সেসব কিতাবের লেখা আর পড়ে দেখিনি, তবে যা লেখা ছিলো না তা আমি পড়েছিলাম; পড়তে পেরেছিলাম। তাতে যা লেখা ছিলো না তা হলো-
‘ইলমের খাযানা এবং কিতাবের ভান্ডার উম্মাহকে রক্ষা করতে পারে না, যদি ইলমের নূর থেকে কলবের জাহান মাহরূম হয়ে যায়, যদি ‘সীনা ও সাফীনার’ রিশতা ছিন্ন হয়ে যায়। কলম ও তলোয়ার যখন আলাদা হয়ে যায় এবং চোখের পানি থেকে যখন বুকের লাল রক্তের গন্ধ হারিয়ে যায় তখন উম্মাহর ভাগ্যবিপর্যয় অনিবার্য হয়ে যায়।
আজ সাতাশ বছর পর যখন এ সফরনামা লিখছি তখন হাজার বছর আগের বাগদাদ আবার জ্বলছে নয়া যামানার হালাকু খার হাতে। আমি জানি না, হাজার বছর পর আবার কোন মুসাফির বাগদাদের জাদুঘরে হাযির হবে কি না এবং আগুনে পোড়া কোন কিতাবে সে এমন লেখা দেখতে পাবে কি না- ‘১৪২৭ হিজরিতে এই কিতাব আমি বাগদাদের জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড থেকে উদ্ধার করেছি। মার্কিন হায়েনাদের জ্বালানো আগুনে আমাদের সবকিছু সারখার হয়ে গেছে। এই কিতাবের পোড়া দাগে হে পাঠক, তুমি পাবে আমার পোড়া কলজের গন্ধ!’
আমি জানি না, হাজার বছর পরের কোন পাঠক চোখের পানিতে সেই কিতাবের লেখা ভিজিয়ে দেবে কি না! আমি জানি না! তবে আমি জানি, বাগদাদ আবার জেগে ওঠবে। আগুনে জ্বলে পুড়ে সারখার বাগদাদ আবার সবুজ হবে। হারুন রশীদের বাগদাদ ধ্বংস হয়েছিলো, সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে শায়খ আব্দুল কাদির জিলানীর বাগদাদ জেগে উঠেছিলো। আজ সাদ্দামের বাগদাদ জ্বলে সারখার হতে পারে, কিন্তু ‘শায়খ আব্দুল কারীম আলমুদাররিস’-এর বাগদাদ অবশ্যই আবার জেগে ওঠবে, আবার সবুজ সজীব হবে। দুই বাগদাদের আবাদি ও বরবাদির এ মর্মন্তুদ লীলা-খেলা হয়ত তত দিন চলতে থাকবে যত দিন উম্মাহর কলবের জাহানে আবাদি ও বরবাদির ‘আফসানা’ বন্ধ না হবে।
জুমার সময় হয়ে এলো। শায়খ বাগদাদের তাজা খেজুর দ্বারা আমাদের আপ্যায়ন করলেন। আমরা শায়খের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মসজিদে হাজির হলাম। আমি বুঝতে পারিনি, কুতুবখানার সেই কিতাব হযরতের কলবকে এতটা যখমি করেছে! কিছুটা বুঝলাম যখন মসজিদে বসে হযরত আমাকে বললেন, ‘মিয়াঁ আবু তাহের, আমাদের সালাফের কত অসংখ্য কিতাব তাতারীদের হাতে বরবাদ হয়েছে! কারণ তো আর কিছু না; কিতাব ছিলো, কিতাবের খরিদ্দার ছিলো, কিন্তু কিতাবের ‘নযরদার’ ছিলো না। এজন্যই বুযুর্গানে দ্বীন বলেছেন, ‘ইলম দর সীনা, না দর সফীনা।’
মিয়াঁ আবু তাহের! আমার তামান্না এই যে, তুমি সাফীনার ইলমের পরিবর্তে সীনার ইলমের দিকে বেশী করে আগে বাড়ো।’
এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে, হযরত যখন কথাগুলো বলছেন, তাঁর চোখ দু’টো ছলছল করছে। কথাগুলো বলে তিনি বড় দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছেড়েছিলেন। সে নিঃশ্বাসের উত্তাপ আমি অনুভব করেছিলাম এবং অনুভবের এই পাথেয়টুকু আছে বলেই আমার জীবনের সফর এখনো আছে পশ্চিমমুখী। ব্যথিত হৃদয়ের গভীর থেকে বের হয়ে আসা সেই দীর্ঘনিঃশ্বাস এখনো আমি যেন শুনতে পাই যখন তাঁর কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াই!
হযরত জায়নামাযে তিলাওয়াতে মশগুল ছিলেন, আমরা মশগুল ছিলাম আমাদের ‘তিলাওয়াতে’। এখানে জমিয়াতুল মুদাররিসীনের জনাব আব্দুল মান্নান সাহেবের নেতৃত্বাধীন দলটির সাথে দেখা হয়ে গেলো। তিনি বিখ্যাত মানুষ, তবে এই সফরের আগে তাকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। তিনি পিছনের কাতারে ছিলেন। আমি পিছনে ফিরে মুছাফাহা করলাম এবং একটু সরে সামনের কাতারে জায়গা করে দিলাম। তিনি সামনে এসে আমার পাশে বসলেন এবং একটি কথা জানতে চাইলেন। তাতে আমি যেমন অবাক হলাম তেমনি ব্যথিত হলাম; সত্যি সত্যি খুব ব্যথিত হলাম।
অনেক ভেবেছি, হজ্বের সফরনামায় তা লিখবো কি লিখবো না; শেষ পর্যন্ত লিখলাম, এ আশায় যে, হয়ত তা আমাদের জন্য শিক্ষার খোরাক হবে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘খাওয়া-দাওয়া কেমন চলছে!’
আমি অবাক হলাম এবং ব্যথিত হলাম, কারণ তিনি তো অনেক উচ্চ স্তরের ব্যক্তি, অতি সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও তো এমন স্থানে এমন কথা আশা করা যায় না। বয়সে এবং যোগ্যতায় আমি অনেক ছোট; তাই ভিতরের কষ্টটুকু আমাকে চেপে যেতেই হলো, কটাক্ষের তিক্ততাটুকুও হযম করে নিতে হলো। আমি সরলভাবে বললাম, একটু আগে জিলানীর কুতুবখানায় বড় বিস্বাদ খাবার গ্রহণ করেছি।
কিছু বুঝতে না পেরে তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, এমন একটি কিতাব যিয়ারাত করেছি যা তাতারীদের হাতে বাগদাদের বরবাদির পর দজলা নদীর পানি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো।
তার সাথে আর কোন কথা হলো না, তবে সেই ঘটনা আমার অন্তরে স্থায়ী ব্যথা হয়ে থেকে গেলো। এ দুঃখ আমার মনে সবসময় বাজে, আমরা অনেক বড় হয়েও অনেক ছোট থেকে যাই কেন?!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)