রবিউল আখির ১৪৩০   ||   এপ্রিল ২০০৯

কয়েকজন আকাবিরের ইন্তেকাল : আল্লাহই আমাদের রক্ষাকর্তা, আমাদের অভিভাবক

গত কয়েক মাসে আমাদের আকাবির ও বুযুর্গানে দ্বীনের মধ্যে কয়েকজন একের পর এক ইন্তেকাল করেছেন। বড়দের বিদ্যমানতা অনেক বড় রহমত এবং অনেক ফিৎনা-ফাসাদের জন্য প্রতিবন্ধক। তাঁদের তিরোধান অনেক সময় বড় বড় ফিৎনার পথ সুগম করে। আমাদের স্বভাব হল,-এবং তা অত্যন্ত মন্দ স্বভাব-বড়দের বিদ্যমান থাকা অবস্থায় তাঁদের মূল্য দেই না, তাঁদের দুর্বলতাগুলোর দিকে তাকিয়ে, তাদের গুণাবলি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে থাকি। ফলে তাঁদের দ্বারা উপকৃত হওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কিন্তু যখন তারা বিদায় নিয়ে চলে যান তখন তাদের মূল্য অনুধাবন করে আফসোস করতে থাকি।

খতীব ছাহেব রাহ. চলে গেলেন। এখন বাইতুল মুকাররমের মিম্বার-মিহরাব নিয়ে যা কিছু হচ্ছে তা সবার সামনে। আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হল, আমরা যেন বর্তমান আকাবিরের মূল্য দেই এবং সর্বদা তাঁদের সুস্থতা ও দীর্ঘ হায়াতের জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করি। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদেরকে তাঁদের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করেন এবং নির্ধারিত সময়ে তাদের বিদায়ের পর তাদের যোগ্য উত্তরসূরী তৈরি করে দেন।

বুযুর্গের বিদায়ের পর স্বভাবতই অন্তরে যে কষ্টের অনুভূতি সৃষ্টি হয় এবং তাদের শূন্যতা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত চিন্তা-চেতনায় বিরাজ করতে থাকে তাকে কাজে লাগানো উচিত। যার একটি পদ্ধতি এই যে, তাঁদের জীবনের অনুসরণীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা এবং নিজের জীবনে তা প্রতিফলিত করা। এজন্য পূর্বসূরীদের জীবনী বিষয়ে কখনো বিস্তারিত, কখনো সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রকাশ করার ধারা প্রচলিত রয়েছে। মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী রাহ.-এর ইয়াদে রফতেগাঁ’’, মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর পুরানে চেরাগ, মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী রাহ.-এর শখসিয়্যাত এবং উস্তাদে মুহতারাম মাওলানা মুহাম্মাদ তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর নুকূশে রফতেগাঁ এই ধরনের প্রবন্ধ-নিবন্ধের চমৎকার সংকলন।

তবে স্মরণ ও শোক প্রকাশের শিল্পসম্মত ধারা আছে। তার শর্ত-শারায়েতগুলো রক্ষা করার জন্য এবং এ ধরনের আলোচনা যে উদ্দিষ্ট সুফলে সফল হয় সেজন্য যোগ্যতারও প্রয়োজন। বলাবাহুল্য যে, এখনো আমরা সেসব বিষয় থেকে অনেক দূরেই অবস্থান করছি। তবুও যতটুকু আমাদের দ্বারা সম্ভব সে অনুযায়ী অতিসম্প্রতি বিদায়গ্রহণকারী আমাদের যে আকাবিরের বিযোগ ব্যাথা আমরা হৃদয়ে বহন করছি তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন জনের লেখা কিছু অনুভূতি পাঠকবৃন্দের সামনে তুলে ধরছি।

হযরত মাওলানা মুফতী আহমদুল হক ছাহেব রাহ.-সম্পর্কে আশা করি হাটহাজারী মাদরাসা থেকে স্বতন্ত্র গ্রন্থ অবশ্যই তৈরি হবে। এখানে মুহতারাম  মাওলানা আবদুর রহমী ইসলামাবাদী ছাহেব অত্যন্ত সংক্ষেপে কিছু তথ্য পেশ করেছেন। হযরত রাহ. আমার ওয়ালিদ ছাহেবেরও উস্তাদ ছিলেন এবং আমার বড় ভাইজানেরও। ঘটনাক্রমে দুজনের ভর্তি পরীক্ষাও তাঁর কাছেই হয়েছিল। সে হিসেবে তিনি আমার দাদা উস্তাদ, কয়েকবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছে। প্রতিবারই তাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়-এর দৃষ্টান্ত সামনে এসে যেত। 

হজ্বের পূর্বে দেশের প্রাচীন দরসগাহ দারুল উলূম বড়ুরা মাদরাসার মুহতামিম বর্ষীয়ান বুযুর্গ হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব রাহ.ও আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। তাঁর সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা সামনের কোনো সংখ্যায় প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ।

আমার অনুরোধে মরহুম হযরত মাওলানা ড. এছহাক ছাহেব সম্পর্কে তাঁর ছাহেবযাদা মাওলানা যাকারিয়া ছাহেব কিছু বিষয় লিখে পাঠিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ তাতেও পাঠকবৃন্দের  জন্য কিছু উপকারী কথা এসেছে। যদিও ডক্টর ছাহেবের জীবন এতই বৈচিত্রময় যে, তাঁর জীবনের উপর স্বয়ংসম্পূর্ণ কাজ হওয়া দরকার। মারকাযুদ দাওয়াহর সঙ্গে তাঁর গভীর অনুরাগপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মারকাযের কাজগুলোকে তিনি উৎসাহিত করতেন।

মারকাযের দারুত তাসনীফ থেকে প্রকাশিত কিতাব-আহলে হাদীস সে যুগে এ যুগে’’ পড়ে তিনি খুব প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁর পরিচিতজনদেরকে তা পড়ার জন্যও বলতেন। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর সঙ্গেও তাঁর মুলাকাত ছিল এবং হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ.-এর সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে তিনি আমাকে ভালবসাতেন এবং দুআ দিতেন।

হযরত মাওলানা নিযামী রাহ. সম্পর্কে লিখেছেন তাঁর একজন নওজোয়ান শাগরিদ। তিনি প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন, তাই অধমও তার সম্পর্কে জানতাম, তবে মুলাকাত শুধু একবার হয়েছিল, যখন হযরত মাওলানা হাকীম মাযহার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সফর হল এবং জামিল মাদরাসাতেও যাওয়া হল। সে সময় জেনেছি, মরহুম যরীফুল উম্মত, বাকিয়্যাতুস সালাফ হযরত মাওলানা মুফতী মাহমুদ হাসান গংগুহী রাহ.-এর খলীফায়ে মুজায ছিলেন।

হযরত মাওলানা নূরদ্দীন রাহ. সম্পর্কে লিখেছেন ভাই মনসুর আহমদ শরীয়তপুরী। সরকার যদি মাওলানা নূরদ্দীন ছাহেবকে খিতাবতের দায়িত্বে বহাল রাখত, অন্তত এই জন্য যে, তিনি পূর্ব থেকেই পেশ ইমাম এবং অন্তবর্তীকালীন সময়ে ভারপ্রাপ্ত খতীবের দায়িত্ব পালন করেছেন তাহলে অন্তত এই প্রকাশ্য খিয়ানতের মধ্যে তাদের লিপ্ত হতে হত না, বর্তমান খতীবকে বাইতুল মুকাররমের মতো মসজিদের মিম্বার-মিহরাব সোপার্দ করে যা তারা করেছে। সন্দেহ নেই, এটা সরকারের জন্য একটা কালে দাগ হয়ে থাকবে যদি তারা এই দায়িত্ব কোনো যোগ্য ব্যক্তির হাতে অর্পণ না করেন।

মরহুমের সঙ্গে আমার এজন্যও হৃদ্যতা ছিল যে, পাকিস্তান বিফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া-এর প্রধান এবং জামিয়া ফারুকিয়া করাচির মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা সলীমুল্লাহ খান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম তাঁকে পছন্দ করতেন। তিনি যখনই বাংলাদেশে এসেছেন তো অপরিহার্যভাবেই মাওলানা মরহুমের মেহমান হয়েছেন। হযরত মাওলানার এবং জামেয়া ফারুকিয়ার সঙ্গে মাওলানা মরহুমের গভীর সম্পর্ক ছিল।

এরপর তাঁর প্রতি মুহববত আরো বৃদ্ধি পেল যখন মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দামাত বারাকাতুহুম-এর কাছ থেকে শুনলাম যে, তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। তাঁর পুত্র এখানে (মাদরাসাতুল মদীনায়)পড়ত। আমরা তাঁর মধ্যে একজন উত্তম অভিভাবককে পেয়েছি। তিনি আরো বলেছেন, তাঁর পুত্র দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করার পর তিনি তাকে পত্র দিয়ে পাঠালেন, যাতে লেখা ছিল, তাকে শুধু এজন্য পাঠাচ্ছি যে, আপনার জুতোগুলো সোজা করবে।’’

মরহুমের এই আচরণে তালিবে ইলম ও তাদের অভিভাবকের জন্য অনেক বড় শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কিন্তু এই বিষয়গুলো গ্রহণ করার মতো মানুষও তো আজকাল দুর্লভ হয়ে যাচেছ। আল্লাহ তাআলা আমাদের অবস্থার উপর রহম করুন।

দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত পাঠকদের আবদ্ধ রাখার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। তাঁরা যে এতক্ষণ আমাকে সময় দিয়েছেন এজন্য তাদের প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। -তত্ত্বাবধায়ক

 

 

 

 

চলে গেলেন বাংলাদেশের প্রবীণতম ইলমী ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা মুফতী আহমদুল হক রাহ.

মুহাম্মাদ আবদুর রহীম ইসলামাবাদী

গত ১১ রবীউল আউয়াল ১৪৩০হি. মোতাবেক ৯ মার্চ ২০০৯ ঈ. সোমবার ভোর ৪:২০ মিনিটে আমাদেরকে এতিম বানিয়ে চলে গেলেন খ্যাতনামা আলেমে দ্বীন উপমহাদেশের প্রবীনতম মুফতী হযরত মাওলানা মুফতী আহমদুল হক সাহেব (রাহ.)। বাংলাদেশের মুফতীয়ে আজম হিসেবে তিনি সকলের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। সুদীর্ঘ ৭০ বছর যাবৎ তিনি ফতোয়া প্রদান এবং  হাদীস, তাফসীর, ফিকহ ইত্যাদি শাস্ত্রের অধ্যাপনা করেছেন। একজন পীরে কামেল হিসেবেও তিনি ষাট বছর খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন।

ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মুফতী  আহমদুল হক রাহ. ছিলেন হাটহাজারী দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসার শিক্ষা বিভাগীয় প্রধান। সদরুল মুদাররেসীন, শায়খুল হাদীস ও মুফতীয়ে আজম হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ইন্তেকালের পূর্বে ১০৩ বছর বয়সেও বুখারী শরীফের আংশিক (মাগাজী অংশের) দরস দিতেন।

তাঁর দরসের কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। ক) খুব ভাবগম্ভীর পরিবেশে তিনি দরস দিতেন। খ) তার হাদীসের দরসে ফিকহ ও ফতোয়ার রং থাকত। বিশেষত হানাফী মাযহাবের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্বের যৌক্তিক কারণগুলো আলোচিত হত। গ) শিরিক, বিদআত ও শরীয়ত বিরোধী রসম-রেওয়াজ বিরোধী গ্রহণযোগ্য যুক্তি তুলে ধরা হত। ঘ) সুন্নতের আলোচনা হত। ঙ) হাতে কলমে আমলের প্রশিক্ষণ দিতেন।

বিগত ৩ বছর তিনি বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী ছিলেন। যখনই কিছুটা সুস্থতা বোধ করতেন বুখারী শরীফের দরস দান করতেন এবং ফতোয়া প্রদান করতেন। এর সঙ্গে তরীকতের কাজও চালিয়ে যেতেন।

আল্লামা মুফতী আহমদুল হক রাহ. ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশসহ বহু সংখ্যক ইসলামী সংগঠন, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ছারপুরস্ত বা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

তিনি শায়খুল ইসলাম কুতবে আলম আল্লাম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর প্রবীনতম খলীফা এবং বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের প্রবীন ছাত্র ছিলেন। দারুল উলূম দেওবন্দ ও দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল মুফতী আহমদুল হক সাহেবের। দেওবন্দে শায়খুল ইসলাম আল্লামা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ., আল্লামা সৈয়দ মিয়া আছগর হুসাইন রাহ., আল্লামা ইবরাহীম বলিয়াবী রাহ., শায়খুল আদব ওয়ালফিকহ  আল্লামা এজাজ আল রাহ. মুফতী ছাহেবের উস্তাদ ছিলেন।

মুফতী আহমদুল হক রাহ. শতাধিক বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। আনুমানিক ১৩২৭ হি. সনে তিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন। সে হিসেবে তার বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। কারো কারো মতে, খ্রীষ্টীয় হিসেবে তাঁর জন্মতারিখ ১৯১১ ইং সনে।

তিনি চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার সুয়াবিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মাওলানা মীর মুহাম্মাদ ইসমাঈল রাহ., মাতার নাম জামিলা খাতুন, দাদার নাম মীর হুসামুদ্দীন রাহ.।

মুফতী আহমদুল হক রাহ. আপন দাদীর কাছে পবিত্র কুরআন শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর ফটিকছড়ি বিবিরহাট জামেউল উলূম সিনিয়র মাদরাসা ও চট্টগ্রাম শহরস্থ দারুল উলূম আলিয়া মাদরাসায় কয়েক বছর শিক্ষা লাভ করেন। চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরায় ১৯১৩ ইং সনে হাজী চান্দমিয়া সওদাগর রাহ. দারুল উলূম আলিয়া মাদরাসা কায়েম করেন। এ মাদরাসা চট্টগ্রামে আলিয়া মাদরাসার উম্মুল মাদারিস। ফটিকছড়ি বিবিরহাট জামেউল উলূম মাদরাসা ফটিকছড়ির প্রাচীন সিনিয়র মাদরাসা। অতঃপর তিনি আল্লামা শাহ জমীরুদ্দীন রাহ.-এর অনুপ্রেরণায় দেশের প্রাচীন ও বৃহত্তম ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র চট্টগ্রাম হাটহাজারী দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসায় ভর্তি  হন এবং ৬ বছরে জামাতে উলা পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। হাটহাজারী মাদরাসায় মুফতী আহমদুল হক ছাহেবের রাহ. উস্তাগণের মধ্যে ছিলেন বানিয়ে মাদরাসা আল্লামা হাবীবুল্লাহ রাহ., মাদরাসার পৃষ্ঠপোষক হযরত আল্লামা শাহ জমিরউদ্দীন রাহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা সাঈদ আহমদ সন্দিপী রাহ., মুফতীয়ে আজম আল্লামা মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ., খতীবে আজম আল্লামা সিদ্দীক আহমদ রাহ., হযরত আল্লামা মুফতী আফাজউদ্দীন রাহ., আল্লামা আবদুল জলীল রাহ. প্রমুখ।

এরপর উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি তদানন্তীন ভারত বর্ষের বৃহত্তম ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন।

সেখানে তিনি ৪ বছর শিক্ষা লাভ করেন। ১৩৫৮ হিজরী সনে দাওরা হাদীস ও ১৩৫৯ হিজরী সনে দাওরায়ে তাফসীর পাস করেন। দারুল উলূম দেওবন্দে লেখাপড়া কালেই তিনি নিয়মিত পড়াশোনার মাঝে গভীর মনোযোগ ও চর্চার মধ্য দিয়ে কালামে পাক হেফয করেন। দাওরায়ে তাফসীর অধ্যয়ন কালে দরুল উলূমের কেরাত বিভাগের সুখ্যাত উস্তাদ ক্বারী মুহাম্মাদ মিয়াঁ রাহ.-এর কাছে ইলমে কেরাতের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

চট্টগ্রাম প্রত্যাবর্তনের পর প্রথমে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় ৩ বছর শিক্ষকতা করেন। অতঃপর হাটহাজারী মাদরাসায় যোগদান করেন। সুদীর্ঘ ৭০ বছর কাল হাটহাজারী মাদরাসাতেই শিক্ষকতা করেন। আল্লামা মুফতী আহমদুল হক রাহ. নিজ উস্তাদ ও শায়খ শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর নেতৃত্বে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে শরিক ছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফত আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল বিভিন্ন সময়ে।

একজন ওলিয়ে কামেল ও বরেণ্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সকলের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। সকল প্রকারের বিদআতের বিরোধী এবং সুন্নতে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনুসারী ছিলেন। শায়খুল ইসলাম আল্লামা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. ও মুফতীয়ে আজম আল্লামা মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ. ছিলেন তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব। কর্মজীবনে এই দুই মনীষীর জীবন ধারা তার মাঝে প্রতিফলিত হত।

মুফতীয়ে আজম আল্লামা মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ. একজন মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকল প্রকার বিদআত ও শরীয়তবিরোধী রসমরেওয়াজকে খন্ডন করে তিনি সুন্নতী আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করেন। বাস্তব জীবনেও তা কার্যকর করেন। মুফতী আহমদুল হক ছাহেব রাহ. ছিলেন মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ. এর জানশীন বা স্থলাভিষিক্ত।

মুফতী আহমদুল হক রাহ.-এর জীবনের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি একই সাথে ছিলেন মুফাসসির, মুহাদ্দিস, মুফতী, পীরে কামেল, হাফেযে কুরআন, কারী, দায়ী এবং সুন্নতে রাসূলের অনুসারী। ৭০ বছরেরও বেশী সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। শত বছর বয়সেও তাঁর চশমা ব্যবহার করতে হত না। খুবই সহজ সরল  ও সাদামাটা ছিল তাঁর জীবনযাপন। দ্বীনের খেদমতে তিনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন।

৯ মার্চ সোমবার বিকেল ৩টায় হাটহাজারী মাদরাসা ময়দানে মরহুমের বিশাল জানাযা নামায অনুষ্ঠিত হয়। এতে সর্বস্তরের লক্ষাধিক জনতা অংশগ্রহণ করেন। জানাযায় লোকসমাগম এত বেশি ঘটে যে, চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক প্রায় এক ঘন্টা যাবত বন্ধ হয়ে থাকে। জানাযা নামাযে ইমামতি করেন মরহুমের পীর ভাই ও প্রিয় শাগরিদ হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা শাহ আহমদ শফী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম।

হাটহাজারী মাদরাসার সন্নিকটস্থ হাবীবী-জমিরী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, মাকবারায়ে হাবীবী এক বিখ্যাত কবরস্থান, যেখানে দাফন করা হয়েছে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম কয়েকজন মনীষীকে। যাদের মধ্যে আছেন শায়খুল মাশায়েখ কুতবে আলম হযরত আল্লামা শাহ জমিরউদ্দীন রাহ. (আল্লামা মুফতী রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-এর বিখ্যাত খলীফা), শায়খুল ইসলাম আল্লামা হাবীবুল্লাহ রাহ. প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, হযরত আল্লামা হাফেয আফাজ উদ্দীন রাহ.,  হযরত আল্লামা আবদুল ওয়াহহাব রাহ. (হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর বিখ্যাত খলীফা ও হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক মুহতামিম), শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল কাইয়ুম রাহ. (হযরত শাহ জমিরউদ্দীন রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা ও হাটহাজারী মাদরাসার ৪র্থ শায়খুল হাদীস), হযরত আল্লামা হাফেযুর রহমান-পীর সাহেব হুজুর রাহ. (শাহ জমিরউদ্দীন রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা ও হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক সদর মুহতামিম), শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল আজিজ রাহ. (শাহ আবদুল ওয়াহহাব রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা ও হাটহাজারী মাদরাসার ৫ম শায়খুল হাদীস), হযরত আল্লামা মুহাম্মাদ হামেদ রাহ. (মুফতীয়ে আজম আল্লামা মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ.-এর খলীফা ও হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক মুহতামিম), হযরত মাওলানা মুতীউল্লাহ মিয়াজী রাহ. (হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ রাহ.-এর পিতা), হযরত মাওলানা কারী হাফেয ফয়েয আহমদ ইসলামাবাদী রাহ.।

হযরত ইন্তেকালের সময় ৮ ছেলে ৮ মেয়ে, অসংখ্য ছাত্র, মুরীদ, ভক্ত রেখে গেছেন। তাঁর ৩২ জন খলীফা রয়েছেন।

খলীফাগণের তালিকায় ২৪ জন বিশিষ্ট আলেমের নাম পাওয়া যায় যারা প্রত্যেকেই আপন আপন ক্ষেত্রে উজ্জ্বল অবস্থান নিয়ে আছেন।#

 

মাওলানা ড. মুহাম্মাদ এছহাক রাহ.

মুহাম্মাদ যাকারিয়া

আমার পিতা মাওলানা প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ এছহাক রাহ. গত ৮ জিলহজ্ব (মক্কা মুকাররমার চাঁদ অনুযায়ী হজ্বের দিন) ১৪২৯ হিজরী মোতাবেক ৭ ডিসেম্বর ২০০৮ ইং রবিবার সকাল সাড়ে আটটায় ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানার ধানঘরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মাওলানা  আবদুল কুদ্দুস ছিলেন একজন আলেমে দ্বীন। তিনি তদানন্তীন ভারতের বাঁসব্রেলী শহরের একটি মাদরাসায় শিক্ষা লাভ করেন।

ড. মুহাম্মাদ এছহাক রাহ. সিরাজগঞ্জ থেকে হাই মাদরাসা ও ইন্টারমিডিয়েট (নিউস্কীম) পাশ করে ১৯৩৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে যাদের নিকট তিনি হাদীস অধ্যয়ন করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর সুযোগ্য খলীফা হযরত মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী রাহ.। ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। অতঃপর কিছুদিন ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। যার বিষয়বস্ত্ত ছিল-ওহফরধহং পড়হঃৎরনঁঃরড়হঃড়ঃযব ঐধফরঃয ষরঃবৎধঃঁৎব (হাদীস শাস্ত্র অধ্যয়নে ভারতীয় উপমহাদেশের অবদান)। তাঁর পি.এইচ.ডি-র এই থিসিস একমাত্র থিসিস, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থানুকুল্যে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি ভাষায় লিখিত এই থিসিসটি পরবর্তীকালে উর্দু ভাষায় অনুবাদ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয়দেশ থেকে প্রকাশিত হয় এবং আরব বিশ্বে এর আরবী অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে। হাল আমলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে এর বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক ছাত্র পি.এইচ.ডি এবং এম.ফিল ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি উপমহাদেশের উঁচু মানের বিভিন্ন সাময়িকীতে ইংরেজি ভাষায় হাদীস ও ফিকহের উপর অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখেন। যা ইসলামী শিক্ষা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে। তাঁর সকল লেখা ছিল গবেষণাধর্মী। এমনকি তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তান থেকে তাঁর যে সকল কথিকা প্রচারিত হয়েছে সেগুলোও ছিল গবেষণামূলক। এ কথিকাগুলো রেডিও পাকিস্তান কর্তৃক প্রকাশিত মাসিক এলান পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হত। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিশ্বকোষের এডিটরিয়াল বোর্ডের সদস্য ছিলেন। সেখানে তিনি তার জ্ঞানের অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন।

বস্ত্তত : তাঁর জীবনটাই ছিল অধ্যয়নের জীবন। রাতের পর রাত তিনি পড়তেন। পড়ালেখায় তার কোনো ক্লান্তি ছিল না। তার অধ্যয়নের যে ক্ষেত্র ছিল বা যে সকল বিষয় নিয়ে তিনি পড়াশোনা করতেন বাংলাদেশ তো বটেই মুসলিম বিশ্বে তার জুড়ি কমই পাওয়া যায়। ইলমে হাদীস ও ইতিহাস তার অধ্যয়নের প্রধান বিষয় ছিল। বিশেষ করে মুহাদ্দিসীন (হাদীস বিশারদগণ) ও উলামায়ে উম্মত তাদের জ্ঞান চর্চায় এবং ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তথা ইসলামী সভ্যতার বিকাশে তাদের অবদান এককথায় আলহাযারাতুল ইসলামিয়া-তার অধ্যয়নের বিশেষ ক্ষেত্র ছিল। তাঁর থিসিসের মধ্যে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী রাহ. যে বাণী লিখেছেন তাতে তিনি বলেন-এই থিসিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি বৃদ্ধি করবে।

 ড. মুহাম্মাদ এছহাক ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘ ৩৭ বছরের শিক্ষকতাই তার প্রমাণ। এই সাইত্রিশ বছরে তিনি বহু ছাত্র-ছাত্রীকে আরবী সাহিত্যসহ ইসলামী শিক্ষার  বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করেন। শুধু আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগই নয়; বরং অন্যান্য বিভাগের ছাত্ররা যাদের সাবসিডিয়ারির বিষয় আরবী বা ইসলামিক স্টাডিজ থাকত তারাও তার নিকট শিক্ষা লাভ করেছেন। এতে দেখা যায় যে, তাঁর ছাত্ররা (অন্যান্য বিভাগের) দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসর গ্রহণ করার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক পরিপূর্ণভাবে বজায় ছিল। তিনি তাঁর দুজন ছাত্রের পি.এইচ.ডি ডিগ্রির গাইড ছিলেন। তাছাড়া একাধিক ছাত্রের এম.ফিল-এরও গাইড ছিলেন। এ সকল গবেষণা কাজের জন্য তাকে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছিল তা না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।

তিনি ক্লাশে যাওয়ার পূর্বে পাঠদানের বিষয়টির উপর প্রচুর পড়াশোনা করতেন। আমার নিকট হাদীস শরীফের যে সকল নোট ছিল, যা আমার উস্তাদগণ হতে লিপিবদ্ধ করেছিলাম, যাদের মধ্যে অন্যতম হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নুরী রাহ. সেগুলোও তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। তাঁর পাঠদান পদ্ধতি হত গবেষণাধর্মী। তিনি ইলমে তাফসীর, ইলমে হাদীস, ইলমে ফিকহ, ইলমে উসূলে ফিকহ ও আরবী সাহিত্যের উঁচুমানের বিভিন্ন কিতাব পড়িয়েছেন। ত্বহাবী শরীফ তিনি দীর্ঘ দিন পড়িয়েছেন। আমি দেখেছি, তিনি এর জন্য হযরতজী হযরত মাওলানা ইউসুফ রাহ. প্রণীত ত্বহাবী শরীফের বিখ্যাত শরহ-আমানিল আহবার প্রকাশিত হওয়ামাত্র সংগ্রহ করেন।

বিভাগীয় প্রধান হিসেবে তিনি নিজ কক্ষে অনেক ক্লাশ নিতেন। সেখানে যে ব্ল্যাকবোর্ড ছিল তাতে ক্লাশ নেওয়ার সময় অনেক আরবী শব্দের সঠিক উচ্চারণ ও তাহকীক লিখতেন। ক্লাশ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি সেগুলো মুছে ফেলতেন না; বরং পরে যারা ক্লাশে আসত বা তাঁর বিভাগের শিক্ষকগণ যখন আসতেন তারাও অনেক অজানা জিনিস জানতে পারতেন। তাঁর পাঠদান শুধু ক্লাশেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং ছাত্রদের সাথে যখনই একত্রিত হওয়ার সুযোগ হত তখনই তিনি শিক্ষামূলক কিছু না কিছু আলোচনা করতেন। একবার ছাত্ররা পিকনিকে যাচ্ছিল। সে সময় ছাত্রদেরকে বিদায় দেওয়ার সময় যে কটি কথা তিনি বলেছিলেন তা আজও আমার মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন-তোমাদের এই ভ্রমণটি যেন রিহলাতুন ফী তালাবিল ইলম হয় (অর্থাৎ ইলম শিক্ষার সফর) হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখবে। সেখানে গিয়ে তোমরা একত্রিত হয়ে শিক্ষামূলক আলোচনা করবে। জামাতের সাথে নামায পড়বে। আশেপাশের লোকদের খোঁজখবর নিবে।

আরেকটি কথা না বললেই নয়। তিনি শিক্ষকদের খুবই মূল্যায়ন করতেন। তিনি মকতবেরই শিক্ষক হন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিভাগের হন। যে কারণে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের কাছে শ্রদ্ধাভাজন। এমনকি মত ও পথের ভিন্ন মেরুতে অবস্থানকারী শিক্ষকরাও আমার মরহুম আববাজানকে ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দাপ্তরিক কাজের জন্য ভিসির অফিস থেকে শুরু করে যেখানেই তিনি যেতেন সকলেই তাকে সহযোগিতা করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসংখ্য বই-পুস্তক রয়েছে। শিক্ষকতা জীবনের বিরাট একটি অংশ তাঁর এ লাইব্রেরিতে কেটেছে। কোন দুষ্প্রাপ্য কিতাব কোন আলমারিতে রয়েছে এটা যেন তাঁর মুখস্ত ছিল। বহুবার তিনি আমাকে সে লাইব্রেরিতে নিয়ে গেছেন এবং দুর্লভ অনেক কিতাবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতেও অনেক দুষ্প্রাপ্য কিতাব রয়েছে। প্রাচীন আরবী পান্ডুলিপির অনেক ফটোকপি তাঁর সংগ্রহে রয়েছে।

শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বলতে গেলে তিনি অধ্যাপনার পর যে সময়টুকু পেতেন তার অধিকাংশই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে ব্যয় করতেন। এককথায় বলা যায়, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে তিনি নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন। যে কারণে সমসাময়িক তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুববীগণের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল। হযরতজী হযরত মাওলানা ইউসুফ রাহ., হযরতজী হযরত মাওলানা এনামুল হাসান রাহ., মরহুম শফি কুরাইশি রাহ., বাবু বশীর রাহ., ভাই আবদুল ওয়াহহাব (মু.জি), হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ খুলনাবী রাহ., হযরত মাওলানা আলী আকবর রাহ. এবং হযরত মাওলানা মুনীর রাহ., প্রমুখ বুযুর্গের সাথে তাঁর যে কি মুহাববতের তায়াল্লুক ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। উপরোক্ত বুযুর্গদের মাঝে হযরত মাওলানা ইউসুফ রাহ. ছাড়া অবশিষ্ট সকলেই তার বাসায় বহুবার তাশরীফ এনেছেন। মোটকথা, আকাবিরে নিজামুদ্দীন ও আকাবিরে রায়বেন্ড সকলের সাথে তাঁর গভীর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল।

১৯৪৬ সালে তিনি তাঁর পি.এইচ.ডি, থিসিসের মৌখিক পরীক্ষার জন্য দিল্লীর জামিয়া মিল্লিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আলেম মাওলানা সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী রাহ. (যার সাথে পূর্ব হতে তার যোগাযোগ ছিল)-এর সাথে সাক্ষাত হলে তিনি তাকে বলেন, এখানে নিজামুদ্দীনে দাওয়াত ও তাবলীগের নামে মাওলানা ইলিয়াস সাহেব একটি কাজ শুরু করেছেন। আমরা তিন দিনের জন্য মুরাদাবাদ যাচ্ছি। আপনিও আমাদের সাথে চলুন। আমার আববাজান আমাকে এ ঘটনাটি শুনিয়ে বলেন যে, সে জামাতে অন্যদের মধ্যে জামিয়া মিল্লিয়ার ভাইস চ্যান্সেলর ড. জাকির হোসাইন (পরবর্তীকালে যিনি ভারতের প্রেসিডেন্ট হন) ও ছিলেন। এ ঘটনা থেকেই বুঝা যায় যে, তিনি (তাবলীগ জামাতের পরিভাষায়) কত পুরান মুরুববী ছিলেন। যে কারণে তাবলীগ জামাতের সাথে জড়িত আলেম-ওলামাসহ সর্বস্তরের লোক তাকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালবাসতেন।

দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে তিনি বহুদেশ সফর করেছেন। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার অনেক দেশে তিনি গেছেন। ১৯৫৭ সালে তিনি জাপান যান। সেখানে অনেক জাপানি তার নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। যুগোশ্লাভিয়ার বসনিয়া হার্জেগোভিনিয়া গেলে সেখানে ব্যাপকভাবে উলামা ও সাধারণ মুসলমানদের সাথে গণসংযোগের মাধ্যমে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করেন। তিনি কোনো মুসলিম দেশে গেলে সেখানকার ইসলামী কৃষ্টি ও কালচারের প্রতি গভীর মনোযোগ দিতেন এবং দেশে এসে এগুলোর উপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতেন।

তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ ও আলেম হয়েও দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে নিজের ব্যক্তিসত্ত্বাকে ভুলে যেতেন। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করার সময় (তিনি সব সময়ই রিকশা চালককে প্রাপ্যের চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিতেন) তার নাম জিজ্ঞাসা করতেন এবং নামাযের কথা বলতেন। গায়ে হাত বোলাতেন। ঠিক তেমনিভাবে সমাজের উচুস্তরের এমন সব লোকদের নিকট গাশত করতেন যাদের ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরাগ কম থাকত বা মোটেও থাকত না। তারাও তাঁর কথা শুনতেন। তাবলীগের বয়ানে কেউ যদি ভুল কথা বলতেন (বা তাবলীগের বয়ানের বাইরের কোনো কথা বলতেন) তখন তিনি তাকে তাৎক্ষণিক শুধরে দিতেন। আবার কখনও কখনও তাৎক্ষণিকভাবে না বলে মাশওয়ারায় বিষয়টি উপস্থাপন করতেন।

মোটকথা, তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। এই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের বরকতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হয়েও হক্কানী আলেমদের সাথে তার খুবই আন্তরিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। এ প্রসঙ্গে তার সমসাময়িক উপমহাদেশের প্রথম সারির বিখ্যাত উলামায়ে কেরামের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের হযরত মাওলানা মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ., ফখরে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম রাহ., হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ., হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ., হযরত পীরজী হুযুর রাহ., মাওলানা আতহার আলী রাহ., হযরত মাওলানা আবদুল করীম শায়খে কৌড়িয়া রাহ., ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম হযরত মাওলানা কারী তৈয়ব সাহেব রাহ., ফেদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা আসআদ মাদানী রাহ., হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ., পাকিস্তানের হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নুরী রাহ., হযরত মাওলানা মুফতী মাহমুদ রাহ., ভাওয়ালপুরের মুফতী ফারুক আহমদ আম্বেঠবী রাহ. (দেওবন্দ মাদরাসার সাবেক মুফতী) প্রমুখ উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দ্বীনের সাথে তার আন্তরিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রাহ.-এর হাতে তিনি বাইয়াত ছিলেন। তাঁর থিসিস হাদীস শাস্ত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের অবদান-এর উর্দূ অনুবাদটি হযরত শায়খুল হাদীস রাহ. বাদ আসর তাঁর খুছুছী মজলিসে পড়িয়ে নিজে শুনতেন এবং সবাইকে শুনাতেন।

হযরত মাওলানা ড. মুহাম্মাদ এছহাক রাহ. খুবই সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। পুরাতন কাপড় সেলাই করে এমনকি তালি দিয়ে পরিধান করাকে তিনি গৌরবের বিষয় মনে করতেন। দীর্ঘ দিন তিনি সাইকেলে চড়ে কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করেছেন। বাড়ির আসবাবপত্র সাদামাটা রাখতে ভালবাসতেন।

পিতা তো পিতাই হয়ে থাকেন। সন্তান পিতার কাছ থেকে শিক্ষা ও দীক্ষা পেয়ে থাকে। কিন্তু আদর্শ পিতা খুবই বিরল। আমার পিতা মাওলানা ড. মুহাম্মাদ এছহাক রাহ. একজন আদর্শ পিতা ছিলেন। আমরা তার সন্তানরা তার জীবনযাত্রাকে আদর্শ হিসেবে মনে করতাম ও আজও করি। তার প্রতিটি আচার-আচরণ আমাদের নিকট শিক্ষণীয় ছিল। আদব-কায়দার এত খুটিনাটি বিষয় তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা আমরা কোনো বই-পুস্তকে বা অন্য কারো কাছে পাইনি।

আদর্শ পিতার সাথে সাথে তিনি একজন ভাগ্যবান পিতাও ছিলেন। আমাদের এগার ভাই ও এক বোনের মধ্যে একভাই ও এক বোন মারা যায়। আল্লাহর রহমতে আববা আমাদের সকলকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আমাদের ভাইদের মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং ফার্মাসিস্ট রয়েছে। একজন পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেছে। ফার্মাসিস্ট ভাইটি আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এই অধমকে আববা সঠিক ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের উন্নতমানের মাদরাসাসমূহে পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকে দাওরা হাদীস সমাপন করে বর্তমানে মসজিদ ও মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত আছি। পাঁচ ভাই বিদেশে কর্মরত আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সন্তান-সন্ততি দিয়েছেন। আমাকে আল্লাহ তাআলা নাতি-নাতনিও দিয়েছেন। আমাদের মরহুম আববাজান আমাদের এই সুন্দর সংসার দেখে যেতে পেরেছেন। তার জীবনের শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমাদের সবাইকে সার্বক্ষণিকভাবে দেখাশুনা করতেন এবং সবার জন্য দোআ করতেন।

আল্লাহ তাআলা তার কবরকে নূর দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিন এবং তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে সুউচ্চ মাকাম নসীব করুন। আমীন।#

 

 

হযরত মাওলানা ইউসুফ নিজামী : এক দানবীর আলেমের প্রস্থান

আলী হাসান মুহাম্মদ তৈয়ব

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/ এ জীবন মন সকলি দাও/তার মতো সুখ কোথাও কি আছে/আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

তিনি এমন এক আলেমে দ্বীন যিনি জীবনভর উপরের চরণটিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে গেছেন। দয়া-দান এবং উদারতা ও বদান্যতাই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সারাটি জীবন তিনি গেয়ে গেছেন মানব প্রেম এবং অন্যের প্রতি ভালোবাসার জয়গান। জানিয়েছেন অপরের হিত সাধনের মাঝেই আপন সুখ খোঁজার আহবান। তিনি হলেন উত্তরবঙ্গের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামী বিদ্যাপিঠ, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মাদরাসা জামেয়া ইসলামিয়া কাসেমুল উলুম (জামিল মাদরাসা) বগুড়ার প্রিন্সিপাল, শত শত মাদরাসার সক্রিয় পৃষ্ঠপোষক, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের দরদী অভিভাবক, সুন্নতে রাসূলের বিনম্র অনুসারী, বিদআত নির্মূলের সপ্রাণ শিক্ষালয় খানকায়ে মাহমুদিয়া বগুড়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইউসুফ নিজামী সাহেব রাহ.।

নিজেকে বিলিয়ে আনন্দ খোঁজা এ মহাপুরুষ গত মার্চ মাসের প্রথম দিন চলে গেলেন চির সুখের ঠিকানা জান্নাত অভিমুখে। সমগ্র উত্তরবঙ্গবাসীসহ সারা দেশের অসংখ্য মানুষকে কাঁদিয়ে গমন করলেন প্রেমময় মাওলার ইপ্সিত সান্নিধ্যে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪। রেখে গেছেন স্ত্রী, তিন ছেলে এবং ছয় মেয়েসহ সহস্রাধিক ভক্ত-মুরিদান। লাগাতার কয়েক বছর ধরে পাইল্স, ডায়াবেটিস, কিডনি ডিজিজ এবং উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জটিল রোগে ভুগে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু।

শিক্ষা জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় জামিলে কাটানোর সুবাদে হুজুরকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। যত রাতেই ঘুমান না কেন শেষ রাতে তাঁকে ঠিকই দেখা যেত জিকিরে-তাহাজ্জুদে। রাতের শেষ প্রহরে মাদরাসার যে কোনো প্রান্ত থেকে কান পাতলেই শোনা যেত পরম তৃপ্তি ও গভীর ভক্তিসহ হৃদয় জুড়ানো সুরে জপে চলেছেন আলাহু আলাহ আলাহু আলাহ শব্দ। বিবিধ রোগে নাকাল হওয়ার আগ পর্যন্ত মাদরাসায় থাকলে সুবহে সাদেক এর পূর্বক্ষণে তিনি সারা মাদরাসায় ঘুরে ঘুরে সবাইকে তাহাজ্জুদের জন্য ডেকে তুলতেন।

দুনিয়ার প্রতি নির্লোভ এই মানুষটি সব সময় বলতেন, সম্পদ জমিয়ে রাখার জিনিস নয়; এক হাতে টাকা আসবে তো অপর হাত দিয়ে তা বিতরণ করবে, নিজের দিকে টেনে নেবে না কখনো। এমন কথা শুধু বলতেনই না বাস্তবে তার চর্চাও করতেন। তাঁর দান-দাক্ষিণ্য ছিল কিংবদন্তি তুল্য। নিন্দুকেরাও তা অস্বীকার করত না। সবসময় তাঁর দরোজায় লেগে থাকত বিভিন্ন শ্রেণীর অভাবী ও সঙ্কটগ্রস্ত লোকের ভিড়। খুব কম লোকই তাঁর কাছে গিয়ে বিফল হয়ে ফিরত। ঋণ-কর্জ করে হলেও কিছু না কিছু দিয়ে দিতেন।

অন্যসব প্রকৃত অলিদের মতো তিনিও ছিলেন শত্রু-মিত্র সবার শ্রদ্ধাভাজন। শুধু আলেম বা তালেবে এলেমই নয়; জনপ্রিয় ছিলেন তিনি সারা উত্তরবঙ্গের সবার কাছে। এলাকার অস্থির তরুণরা পর্যন্ত তাকে দেখলে শান্ত হয়ে যেত। পথভ্রষ্ট যুবকদেরকে তিনি মৃদু ভৎর্সনা করে নিজের খরচে পাঠিয়ে দিতেন তাবলীগ জামাতের চিল্লায়। তার হাতে দীক্ষা নিয়ে বদলে গেছে অনেক বিপথগামী যুবক। শিক্ষিত লোকদের অনেকেই তাঁর মুরিদ হয়ে যাপন করছেন পূর্ণ ইসলামী জীবন।

তিনি অশ্লীলতা মোকাবেলা করতেন ভদ্রতা দিয়ে, শত্রুতার বদলে বাড়িয়ে দিতেন বন্ধুত্বের হাত। তাঁর সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখানন দেখে গোমূর্খ লোকেরা পর্যন্ত বুঝে ফেলত তিনি একজন অলিয়ে কামেল। একবার যিনি তাঁর অতিথি হয়েছেন আজীবন ভুলতে পারেন নি তাঁর আতিথেয়তার কথা।

অন্যকে ঠকানোর প্রতিযোগিতার এ যুগে তিনি ছিলেন একেবারে সহজ-সরল।  তিনি সবাইকে ভালোবাসতেন। বুযুর্গ এবং আলেমদের তিনি যে সম্মান করতেন তা ছিল অনুসরণীয়। উত্তরবঙ্গে যে কোনো বড় আলেমের আগমন ঘটলে তিনি ছুটে যেতেন তাঁর কাছে। মুগ্ধ করতেন তাঁকে সহৃদয়তা ও অতিথিপরায়ণতা দিয়ে।

তিনি ছিলেন বিরলপ্রজ ছাত্র দরদী শিক্ষক। ছাত্রদের ডেকে তার বাড়ির হাল-অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয় তাদের বিভিন্ন উপলক্ষে সাহায্য করতেন। ছাত্রদের বাবা-মা এবং ঘরের পর্যন্ত খোঁজ-খবর রাখতেন। যার কথা একবার শুনতেন তাকে আর ভুলতেন না। মাদরাসা যখন ছুটি হত দরিদ্র ছাত্ররা তাঁর কাছে ভিড় করত। তিনি তাদের বাড়ি যাবার খরচ দিতেন। কারো চুল বড় দেখলে ছোট না করার কারণ জিজ্ঞেস করতেন। যদি বলত টাকা নেই, সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে টাকা দিয়ে দিতেন। টাকা একবার দিলে সে টাকা আর ফেরত নিতেন না।

১ লা মার্চ ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের খুররমওয়ালা গ্রামস্থ মুনির আহমদের ঘরে জন্ম নেয়া এ আলেম ১৯৭৪ সনে বগুড়া জামিলে প্রথমে যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। ১৯৭৭ সালে এর মুহতামিম নিযুক্ত হন। মৃত্যু পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করে যান বিস্ময়কর দক্ষতায়। তার হাতে গড়ে উঠতে থাকে একেরপর এক সুদৃশ্য ইমারত। জামিল মাদরাসার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে। বর্তমানে এটি চট্টগ্রামের পটিয়া ও হাটহাজারীর পরে বাংলাদেশের অন্যতম বড় মাদরাসা।

আমরা বিনম্র চিত্তে দুআ করি, আলাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। তাঁর সন্তানাদিকে ধৈর্য ধরার এবং সহকর্মীদের তাঁর মিশন এগিয়ে নেয়ার তাওফীক দিন। আমীন। #

 

 

 

মুফতী নুরুদ্দীন রাহ. : মুগ্ধতার স্মৃতি

খন্দকার মনসুর আহমদ

দ্বীনের মহান খাদেম আমাদের প্রিয়ভাজন মুফতী মুহাম্মাদ নুরুদ্দীন রাহ.ও আখেরাতের সফরে চলে গেলেন। গত ৭ মার্চ দুপুর বেলা তার মেঝো ছেলে আমাদের ছাত্র স্নেহভাজন শাকের আবদুল্লাহ ফোন করে বেদনার্ত কণ্ঠে জানাল, আববুর অবস্থা ভালো নয়। সে দুআ চেয়ে কথা শেষ করার পর থেকেই একটি শংকা আমার মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। আমাদের একান্ত আপনজন এই মহান আলেমেদ্বীনকে এই সময়েই হারাতে হবে নাতো? একটু পরেই  শাকেরের দ্বিতীয় ফোন এল। দুরুদুরু বুকে ফোনটি রিসিভ করতেই যখন ওর বুকভাঙ্গা কান্নার আওয়াজ ভেসে এল তখন আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে, আশংকাই সত্যি হয়েছে, আমাদের মুফতী মুহাম্মাদ নুরুদ্দীন আর নেই।

আমার মনে হল এ মুহূর্তে তার মৃত্যু সংবাদ শুনতে দ্বীনদার মহল একেবারেই প্রস্ত্তত ছিল না। কিন্তু প্রজ্ঞাবান মহামহিম আল্লাহ তাআলার বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া পথ কোথায়? তাঁর কোনো ফয়সালাই প্রজ্ঞাশূন্য নয়। আমাদের এ দুঃসময়ে হকপ্রিয় মানুষের দ্বীনী আশা-আকাংখার প্রতীক মুফতী মুহাম্মাদ নুরুদ্দীনকে আপন সান্নিধ্যে ডেকে নেওয়ার মধ্যেও অবশ্যই তার কোনো হিকমত আছে, রহস্য আছে।

মূলত মানুষের বিনয় ও মহত্বই তার ব্যক্তিত্বের যথার্থ পরিচায়ক। আর মহান ব্যক্তিদের মহত্তের ছোয়া পায় ছোট বড় সকললেই। মুফতী নুরুদ্দীনও একজন মহৎ মানুষ ছিলেন। দ্বীনী খিদমতের সূত্রে তার স্নেহ ও মমতা লাভের সুযোগ হয়েছিল এই নগণ্যের। আমি মুফতী নুরুদ্দীনের মহত্ব ও হৃদয়বৃত্তির পরিচয় পেয়েছিলাম। ছোটদেরকেও যিনি সম্মান করতে জানেন তিনি মহৎ না হলে আর কে হবেন? আল্লাহ তাআলা তাকে অর্ন্তগত সৌন্দর্যের পাশাপাশি বাহ্য সৌন্দর্যও দিয়েছিলেন। আমি যতবার তাকে দেখেছি, তার মধ্যে কোনো জীর্ণতা অনুভব করিনি। একটি সজীবতা ও দ্বীপ্তি তার চেহারায় সর্বদা লক্ষ্য করেছি।

মুফতী নুরুদ্দীন রাহ.-এর যে বিষয়টি সকলকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করত তা হল, তার ওই বিনয় ও কোমল ব্যবহার। খ্যাতি ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, কিন্তু ভেতরে অহমিকাবোধ ছিল না। সহকর্মী ও সমকক্ষদের সঙ্গে তো বটেই অনুজদের সঙ্গেও তার আচরণ ছিল অত্যন্ত অমায়িক।

তিনি সর্বদা সন্তানদের যথার্থ দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করে দ্বীনের খাদেম বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। সন্তানদেরকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তোলার জন্য কী গভীর আগ্রহ আর ব্যাকুলতা তাঁর মধ্যে কাজ করতো। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁর আচার-আচরণে তা ফুটে উঠতো। একজন সাধারণ শিক্ষকের কাছেও একজন অভিভাবকের সে যত বড়ই হোক না কেন দায়বদ্ধতা কতটুকু আমি তাঁর কথাবার্তা ও আচার-আচরণ থেকে তা অনুধাবন করতাম। প্রায়ই ফোন করে তাঁর আত্মজের লেখাপড়া তত্ত্বাবধানের অনুরোধ করে আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলতেন, আমার পুরা পরিবার আপনার কাছে ঋণী থাকবে। কথা শেষ হলে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় দুআ দিয়ে বলতেন, আল্লাহ আপনার ভালো করুন। সত্যি বলতে কি আমার একযুগের শিক্ষক-জীবনে আমি মুফতী নুরুদ্দীনের মতো এমন ছাত্র অভিভাবক আর দেখিনি।

এ কথা সত্য যে, ধৈর্য্য ও অল্পতুষ্টিই প্রধানত দ্বীনের পথ। তবে সততার সঙ্গে দ্বীনের পথে থাকলে আল্লাহর অনুগ্রহে কখনো কখনো দুনিয়াও এসে পদচুম্বন করে। তার দৃষ্টান্তও মুফতী নুরুদ্দীনের জীবনে কম নয়। তার সেজো ছেলে ফাহিম আবদুল্লাহ আন্তর্জাতিক কিরাত প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকার করে তার জন্য যে নিয়ামত ও মর্যাদা বয়ে এনেছে তা গোটা বাংলাদেশের গৌরব। কিন্তু সে মর্যাদা ও স্বাচ্ছল্য তাকে দ্বীনের পথ থেকে বিচ্যুত করে কথিত আধুনিক জীবনের দিকে ঠেলে দেয়নি-এটাই শিক্ষা গ্রহণের বিষয়।

তিনি জন্মেছিলেন ১৯৫৪ সালের ২ মার্চ শরীয়তপুর জেলার উকিলপুর গ্রামে। শিক্ষাজীবনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য অংশ অতিবাহিত করেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহি লালবাগ মাদরাসায়। শিক্ষাজীবন শেষ করে মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে দ্বীনী খেদমত ও কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৮৪ সালের জুন মাসে জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমের পেশ ইমাম হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৭ সালের ১০ অক্টোবর দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন আল্লামা ওবায়দুল হক রাহ.-এর ইন্তেকালের পর তিনি তাঁর স্থলবর্তী হন এবং গত জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্বের পাশাপাশি অন্যান্য দ্বীনী কর্মকান্ডের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। নানা সংকটময় মুহূর্তে জুমার পূর্বে তার প্রদত্ত সাহসী, সাবলীল ও প্রমাণভিত্তিক জোরালো বক্তব্য দেশবাসীকে ইসলামের পক্ষে উদ্বীপ্ত করেছে। বিশেষভাবে দ্বীনী আন্দোলনের কর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কথিত নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রসঙ্গে নারী অধিকারের বিষয়ে কুরআন-হাদীসের সঠিক বক্তব্য তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার দ্বীনী খিদমতের মধ্যে দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। ডেমরায় তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও অন্য দুটি দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুফতী নুরুদ্দীন বেশ কয়েকটি ধর্মীয় গ্রন্থও রচনা করেন। আধার কেটে আলো (অনুবাদ), হাফেযে কুরআনের ফযীলত ও মাহাত্ম, ফেরেশতারা কাদের জন্য দুআ করেন এবং কাদের জন্য বদ দুআ করেন, আয়াতুল কুরসী ইত্যাদি তার প্রণীত গ্রন্থ। এছাড়া কিছু কাল দৈনিক ইত্তেফাকের ধর্মচিন্তা পাতায় তিনি পাঠকদের ধর্মীয় জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন। মুফতী নুরুদ্দীন আন্তর্জাতিক ধর্মীয় অঙ্গনেও আমাদের জন্য গৌরব বয়ে এনেছেন। কিছুদিন পূর্বেও তিনি সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কিরাত প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করে দেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করেন।

মুফতী নুরুদ্দীনের ইন্তেকাল নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দেশের শীর্ষস্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকগুলো তার ইন্তেকালের সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে ছেপেছে। তার জীবন ও অবদানের কথা সংক্ষেপে তুলে ধরার পাশাপাশি দেশের প্রায় সর্বস্তরের সুধী ও নেতৃবৃন্দের গভীর শোক, সমবেদনা, শুভকামনা ও ইতিবাচক মতামতের কথাও তুলে ধরেছে। শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক আমার দেশ সংক্ষেপে মন্তব্য করেছে-মুফতী নুরুদ্দীন বাইতুল মুকাররমের সিনিয়র পেশ ইমামের দায়িত্বের পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত খতীব হিসেবেও দুবছর দায়িত্ব পালন করে সর্বস্তরের মুসল্লীদের মন জয় করেন। যুগান্তরের ভাষ্য ছিল-প্রখ্যাত আলেম মাওলানা উবায়দুল হকের মৃত্যুর পর বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুফতী নুরুদ্দীন ধর্মীয় ক্ষেত্রে জাতিকে দিক নির্দেশনা দেন এবং অনেক জটিল পরিস্থিতিতে আলেম-ওলামাদের নেতৃত্ব দেন। তিনি অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং ইসলামের সঠিক পথ নির্দেশনা প্রদান করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন। এমন একজন আলেমের মৃত্যুতে দেশ একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান মুরবিবকে হারাল। আমার দেশ ও নয়া দিগন্তসহ বেশ কটি জাতীয় দৈনিক তার ইন্তেকাল সংবাদ ছেপেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটি জাতীয় দৈনিক এ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপতে পারেনি।

মৃত্যুর কয়েকদিন পর বাইতুল মুকাররম থেকে তার সব কাগজপত্র আনা হলে তাতে একটি বিস্তারিত অসীয়তনামা পাওয়া যায়। তাতে তার সংশ্লিষ্ট সব ধরনের হক্কুল ইবাদের সমাধানসহ তার সম্পদ বিক্রি করে তিন লাখ টাকা আল্লাহর পথে দানের এবং সর্বদা তিলাওয়াতে কুরআন জারি রাখার ওসীয়ত করে গেছেন তিনি। তার বংশে হাফেয ও আলেম তৈরির ধারা এবং তার ও তার পিতার জন্য ঈসালে সওয়াব যাতে কখনো বন্ধ না হয়, তার অনাগত সকল সন্তান যাতে হাফেয ও আলেম হয় সে ব্যবস্থা জারি রাখারও ওসীয়ত করেছেন। সন্তানদের এ ধরনের ওসীয়ত লিখে যেতে পারা কত সৌভাগ্যের ব্যাপার! সত্যিকারের জ্ঞানীরা তা বুঝতে পারেন।

মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি যে দুঃখদায়ক অনর্থের শিকার হয়েছিলেন তা মনে হলে হৃদয়টা কেঁদে ওঠে। তার বিভিন্ন তকলীফ পাওয়ার কথা জেনেছিলাম। কিন্তু দুআ ছাড়া করার কিছু ছিল না। বাইতুল মুকাররমের একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর তাকে ফোনে খুবই ভারাক্রান্ত মনে হল। অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন। সে-ই শেষ আলাপ, আর কথা হয়নি। মুফতী নুরুদ্দীন এখন ক্লেদাক্ত পৃথিবীর সব জঞ্জাল থেকে মুক্ত। তিনি এখন আমাদের সব অনাচারের উর্ধ্বে। মসজিদের মিহরাব থেকে এক অবিনশ্বর শান্তিলোকের হাতছানিতে তিনি এখন অন্তহীন আলোয় পৌঁছে গেছেন। মহান আল্লাহ তাঁকে একান্ত সান্নিধ্যবর্তী করুন। আমাদের শোকাকুল হৃদয়ের এ-ই প্রার্থনা। #

 

 

advertisement