সফর ১৪৩১   ||   ফেব্রুয়ারী ২০১০

তলাবায়ে কেরাম ‘তালিবে ইলম’ হয়ে যান

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

আল্লাহ তাআলা আমাদের যেমন ‘তলাবা’র কাতারে শামিল করেছেন তেমনি একটি গুণবাচক নামও আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তা হচ্ছে ‘তালিবুল ইলম’। অর্থাৎ ইলমে ওহী বা ইলমে নবুওয়ত অন্বেষণকারী। ফার্সী, উর্দূ বা বাংলা উচ্চারণে শব্দটি ‘তালিবে ইলম।’ এটি এক গভীর, ব্যাপ্তিময় ও সুমহান বৈশিষ্ট্য। কোনো তালিবে ইলম যদি তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় তাহলে সে প্রকৃত অর্থেই তালিবে ইলম হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, আমাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই তা অনুধাবন করি। আমরা যদি এই উপাধির তাৎপর্য অনুধাবন করতাম তাহলে আমাদের মাঝে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ লক্ষ করা যেত : ১. আমরা ‘উতলুবুল ইলমা মিনাল মাহদি ইলাল লাহ্‌দ’ নীতি অনুসরণ করতাম। আমাদের ইলম-অন্বেষণ শুধু নির্ধারিত নেসাব পূর্ণ করার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকত না; বরং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলম ও তাহকীকের আগ্রহ ও অভিনিবেশও বৃদ্ধি পেত। ২. আমরা ‘তালিবে ইলম’ উপাধিকে নিজেদের জন্য উচ্চমর্যাদার বিষয় মনে করতাম। এই উপাধি থাকা অবস্থায় অন্য কোনো উপাধি ধারণ করা আমরা পছন্দ করতাম না। কিন্তু প্রত্যেকেই চিন্তা করে দেখি তো, আমাদের মধ্যে ক’জন এমন আছে, যাকে ‘তালিবুল ইলম’ নামে সম্বোধন করা হলে তা তার কাছে ‘মুফতী’, ‘মুহাদ্দিস’, ‘মুফাসসির’ ইত্যাদি উপাধী শোনার চেয়ে অধিক প্রীতিকর মনে হয়। ৩. আমাদের মাঝে আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি হত। মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নু’মানী রাহ. ও মাওলানা আলী মিয়া রাহ. তাদের বক্তৃতা ও লেখনীর দ্বারা তালিবে ইলমের যে মাকাম ও মর্যাদা চিহ্নিত করেছেন তা আমাদের চিন্তা-চেতনায় বদ্ধমূল থাকত। আমাদের অনুভব-অনুভূতি এবং আচরণ-উচ্চারণ এমন হত যা এই বিভাগে বিগত দুই সংখ্যায় হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর বয়ানে উল্লেখিত হয়েছে। ৪. ইলমের পক্ষে ক্ষতিকর সকল বিষয় আমাদের নিকট নিষিদ্ধ হত এবং গায়রে ইখতিয়ারী প্রতিকূলতার ক্ষেত্রেও পেরেশানী ও অস্থিরতা প্রকাশ পেত। তদ্রূপ ইলমের পক্ষে অনুকূল ও সহায়ক সকল বিষয় আমাদের মহব্বত ও অনুরাগ লাভ করত। ইলম হাসিলের সকল সুযোগকে আমরা শুধু মূল্যায়নই করতাম না; বরং অধীর চিত্তে তার প্রতীক্ষায় থাকতাম। পক্ষান্তরে কোনো সুযোগ হাতছাড়া হলে আমরা দুঃখিত হতাম। ৫. সময়কে সংরক্ষণ ও ফলপ্রসূ করার জন্য সচেষ্ট থাকতাম এবং সময় নষ্ট করা থেকে পরহেয করতাম। এমনকি অনিচ্ছাকৃতভাবে সময় নষ্ট হলেও আমাদের মনে দুঃখ ও আফসোস সৃষ্টি হত। ৬. ইলমের আদবসমূহ আমাদের মাঝে বিদ্যমান থাকত। যেখানেই যাই না কেন এবং যে কাজেই থাকি না কেন, আমাদের পরিচয় হত তালিবে ইলম। একজন প্রকৃত তালিবে ইলম শুধু দরসগাহেই তালিবে ইলম নয়, খাবারের দস-রখানে এবং অযুখানা, গোসলখানা ও বিশ্রামের জায়গাতেও তালিবে ইলম। তদ্রূপ শুধু মাদরাসার সীমানার ভেতরই তালিবে ইলম নয়, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই সে তালিবে ইলম। উস্তাদের সামনেও তালিবে ইলম, সহপাঠীদের সঙ্গেও তালিবে ইলম। আলিমদের সঙ্গেও তালিবে ইলম, আম মানুষের সঙ্গেও তালিবে ইলম। তা’লীমী ও ইসলাহী মুরব্বীর সঙ্গেও তালিবে ইলম, পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গেও তালিবে ইলম। পদস্থ ও আমীর-উমারার সঙ্গেও তালিবে ইলম এবং শ্রমজীবী ও মযদুরদের সঙ্গেও তালিবে ইলম। তেমনিভাবে সুস্থতা, অসুস্থতা, সফর-হযর, স্বচ্ছলতা-অস্বচ্ছলতা, মোটকথা অনুকূণ-প্রতিকূল সকল অবস্থায় সে তালিবে ইলম। তার আচার-ব্যবহার, চালচলন সবকিছু হবে একজন প্রকৃত তালিবে ইলমের মতো। কেননা, যে ইলমে অহীর অন্বেষী তার পক্ষেই তো সম্ভব ইসলামী আদব-আখলাক এবং মুয়াশারার আদব-কায়েদা সম্পর্কে অবগত থাকা। উস্তাদগণের নেগরানীতে, সঙ্গী, সহপাঠী ও অগ্রজদের সহযোগিতায় আজীবন এই আদব-কায়েদারই তো অনুশীলন সে করেছে। অতএব তার নিকট থেকেই তো তালিবে ইলম-সুলভ আচরণের আশা করা যেতে পারে। ৭. আমরা ‘তালিবে ইলমে’র মর্মার্থ অনুধাবন করলে অবশ্যই ইলমের আদবসমূহ অনুসরণ করতাম এবং ইলম-সংক্রান্ত শরীয়তের বিধান ও নবী-নিদের্শনা আমাদের দ্বারা পালিত হত। আলকাউসার রবীউল আওয়াল ও রবীউছ ছানী ১৪২৬ হি. (এপ্রিল ও মে ২০০৫ ঈ.) এই বিভাগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সীরাত ও তালীমাত-এর আলোকে নয়টি বিষয় আরজ করা হয়েছিল। তন্মধ্যে একটি কথা পুনরায় পেশ করছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোটা জীবন মোতাবেক অতিবাহিত হয়েছে। উম্মতের জন্যও এই মূলনীতি কথায় ও কাজে বারবার পুনরাবৃত্তি করেছেন। ইরশাদ করেছেন আরো বলেছেন, এর দ্বারা নিজের ফন ও শাস্ত্রের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে অনুপ্রবেশ না করা এবং অজানা বিষয়ে ‘লা-আদরী’ বলার অপরিহার্যতা প্রমাণ হয়। অথচ আজকাল ইলমে দ্বীনের ছাত্রদের মাঝেও এই নবী-আদর্শের মারাত্মক অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। অনেকের অবস্থা থেকে তো প্রতীয়মান হয় যে, তারা উপরোক্ত মূলনীতিকে শুধু আম মানুষ ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণীর জন্যই অপরিহার্য মনে করেন। অতএব সাধারণ মানুষের যদিও দ্বীনিয়াত বিষয়ে ফতোয়া দেওয়ার বা মন্তব্য করার অধিকার নেই, কিন্তু তাদের জন্য সব পথ খোলা! তারা জগতের সকল শাস্ত্রে এবং সকল বিষয়ে বিনা দ্বিধায় প্রবেশ করতে পারেন! এতে কোনো শরঈ বিধান বা কোনো স্বীকৃত নীতি লঙ্ঘিত হয় না! কারো কারো আচরণ থেকে মনে হয় যে, তারা ইলমে দ্বীনের সকল বিষয়কে এক ও অভিন্ন মনে করেন। অতএব কোনোভাবে দ্বীনিয়াতের একটি নেসাবের নির্ধারিত সময় সমাপ্ত করার পর মনে করেন, দ্বীনের সকল বিষয়ে আলোচনা করার অধিকার তার হাসিল হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার এই পরিমাণ যোগ্যতা তৈরি হয়নি, যা আলোচনার জন্য অপরিহার্য। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, উপরোক্ত দুটি ধারণাই ভুল। আমরা যদি প্রকৃত তালিবে ইলম হতাম তাহলে মোতাবেক চলতাম এবং ‘লা-আদরী’র সুন্নত অনুসরণ করতাম। এজন্য আমি নিজেকে এবং আমার সকল তালিবে ইলম ভাইকে শুধু এই অসিয়ত করছি যে, আমরা যেন তালিবে ইলম হয়ে যাই। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দিন। আমীন

 

advertisement