দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণকামিতা
খুতবায়ে মাসনূনার পর,
وَ اِذْ قَالَ اِبْرٰهِیْمُ رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا الْبَلَدَ اٰمِنًا وَّ اجْنُبْنِیْ وَ بَنِیَّ اَنْ نَّعْبُدَ الْاَصْنَامَ. رَبِّ اِنَّهُنَّ اَضْلَلْنَ كَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِیْ فَاِنَّهٗ مِنِّیْ وَ مَنْ عَصَانِیْ فَاِنَّكَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ رَبَّنَاۤ اِنِّیْۤ اَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّیَّتِیْ بِوَادٍ غَیْرِ ذِیْ زَرْعٍ عِنْدَ بَیْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِیُقِیْمُوا الصَّلٰوةَ فَاجْعَلْ اَفْىِٕدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِیْۤ اِلَیْهِمْ وَ ارْزُقْهُمْ مِّنَ الثَّمَرٰتِ لَعَلَّهُمْ یَشْكُرُوْنَ.
সূরায়ে ইবরাহীমের কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা নিজ বান্দা ও খলীল হযরত ইবরাহীম আ.-এর একটি দুআ এখানে বর্ণনা করেছেন। এ দুআ যে গভীর শিক্ষা ও চেতনার ধারক তা প্রত্যেক মুমিনের উপলব্ধি করার বিষয়। কুরআন চায়, প্রত্যেক তিলাওয়াতকারী তা উপলব্ধি করুক এবং শিক্ষা গ্রহণ করুক।
দুআ সম্বলিত আয়াতগুলোর সূচনা-অংশটি লক্ষ্য করুন- وإذ قال إبراهيم -এর শাব্দিক অর্থ, ‘যখন ইবরাহীম বললেন।’ আরবী বাকরীতি অনুসারে এখানে একটি ফেয়েল বা ক্রিয়া উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ اذكر (স্মরণ কর)। তাহলে বাক্যটির সারমর্ম হচ্ছে, ইবরাহীমের (আ.) ঐ অবস্থাটি স্মরণ কর ও আলোচনা কর যখন তিনি আল্লাহর কাছে দুআ করছিলেন। তার ঐ অবস্থাটি কত সুন্দর, কত প্রশংসনীয়!
কুরআন মাজীদের অনেক জায়গায় এ উপস্থাপনা-রীতিটি পাওয়া যায়। এতে আলোচিত ঘটনা বা অবস্থা গভীরভাবে উপলব্ধি করার ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার নির্দেশনা থাকে।
সুতরাং আমাদের কর্তব্য দুআটি গভীরভাবে বোঝা এবং তা থেকে নূর ও আলো গ্রহণ করা। প্রথমে দুআটির সরল অনুবাদ পেশ করছি। এরপর কিছু শিক্ষা ও নির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।
‘পরওয়ারদেগার! এ ভ‚খণ্ডকে নিরাপদ করুন এবং আমাকে ও আমার পুত্রদেরকে প্রতিমা-পূজা থেকে দূরে রাখুন। পরওয়ারদেগার! এসকল (প্রতিমা) তো বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে! তো যে আমার অনুসরণ করবে সে তো আমারই আর কেউ আমার অবাধ্য হলে আপনি তো অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
‘হে আমাদের পরওয়ারদেগার! আমি আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করালাম এক অনুর্বর উপত্যকায়, আপনার পবিত্র ঘরের কাছে- হে আমাদের পরওয়ারদেগার!- যেন তারা সালাত কায়েম করে। সুতরাং কিছু মানুষের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করুন এবং তাদের ফলফলাদির রিযক দান করুন যেন তারা আপনার শোকরগোযারি করে। ... -সূরা ইবরাহীম ১৪ : ৩৫-৩৭
আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম আ.-এর এ দুআয় মৌলিক তিনটি বিষয় পাওয়া যায়।
এক. আমন ও নিরাপত্তা প্রার্থনা
ইবরাহীম আ. মক্কা নগরী ও এর অধিবাসীদের জন্য নিরাপত্তার দুআ করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর খলীলের এ দুআ কবুল করেছেন এবং বিভিন্ন দিক থেকে মক্কা নগরীকে ‘নিরাপদ’ নগরী বানিয়েছেন। হাদীস, তাফসীর ও ফিকহের কিতাবসমূহে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে।
দুই. প্রতিমা-পূজা থেকে মুক্ত থাকার প্রার্থনা
আল্লাহর খলীল প্রতিমা-পূজা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন! নিজের জন্যও, সন্তানদের জন্যও! সাথে সাথে একথাও বলছেন যে, পরওয়ারদেগার! এ সকল প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। অর্থাৎ, বহু মানুষের বিভ্রান্তির কারণ হয়েছে।
বিষয়টি খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করা দরকার। আমরা জানি যে, ইবরাহীম আ.-এর কওম ছিল প্রতিমা-পূজারী। স্বয়ং ইবরাহীম আ.-এর পিতা আযরও এ গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল। আপন পিতা ও নিজ কওমকে পৌত্তলিকতার অসারতা তিনি অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এটি কুরআন মাজীদের এক বিশেষ প্রসঙ্গ। কুরআন যেহেতু তাওহীদের কিতাব এবং এর প্রথম সম্বোধিত ছিল আরবেরা যারা ইসমাইল আ.-এর বংশধর হওয়ার সূত্রে ‘ইবরাহীমী’ হওয়ার দাবিদার, তাই ইবরাহীম আ.-এর প্রকৃত পরিচয় এবং শিরক ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তাঁর প্রবল সংগ্রামের বিবরণ অতিপ্রাসঙ্গিকভাবেই কুরআন মাজীদে এসেছে। এ বিষয়ে পিতা আযর-এর প্রতি হযরত ইবরাহীম আ.-এর শক্তিশালী কিন্তু সশ্রদ্ধ সম্বোধন (দ্র. সূরা মারইয়াম ১৯ : ৪১-৫০), স্বজাতিকে বিভিন্ন অকাট্য যুক্তি ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কৌশল দ্বারা তাওহীদের পথে আনার প্রচেষ্টা (দ্র. সূরা শুআরা ২৬ : ৬৯-৮৩; সূরা আনকাবূত ২৯ : ১৬-২৬; সূরা আম্বিয়া ২১ : ৫১-৭১; সূরা সাফফাত ৩৭ : ৮৩-৯৯) এবং পৌত্তলিক স্বজাতির সাথে তাঁর সম্পর্কহীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা (দ্র. সূরা যুখরুফ ৪৩ : ২৬-২৮; সূরা মুমতাহিনা ৬০ : ৪) ইত্যাদি হচ্ছে হযরত ইবরাহীম আ.-এর জীবনের এমন কিছু ঈমান-উদ্দীপক অধ্যায় যা কুরআন মাজীদের কোনো পাঠকেরই অজানা থাকা উচিত নয়।
তো ইবরাহীম আ.-এর খুব ভালোভাবে জানা ছিল, এসকল অসার প্রতিমা গোমরাহীর কত মারাত্মক অনুষঙ্গ এবং কত অসংখ্য মানুষকে তা বিপথগামী ও চিরজাহান্নামী করে ছেড়েছে। সুতরাং হেদায়েত ও গোমরাহী যাঁর হাতে সেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন, নিজের জন্যও; নিজের সন্তানদের জন্যও।
ইবনে জারীর তবারী রাহ. ইমাম ইবরাহীম আততাইমী রাহ. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি তাঁর ওয়াযে বলতেন-
من يأمن من البلاء بعد خليل الله إبراهيم، حين يقول : رب "اجْنُبْنِیْ وَ بَنِیَّ اَنْ نَّعْبُدَ الْاَصْنَامَ".
অর্থাৎ ইবরাহীম আ.-এর মতো ব্যক্তিও যখন আল্লাহর কাছে দুআ করেছেন, পরওয়ারদেগার, আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে প্রতিমা-পূজা থেকে দূরে রাখুন, তখন কে আছে, যে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে? (তফসীরে তবারী ১/৪৬০)
তাহলে প্রতিমা-পূজার ছিদ্রপথগুলোর ব্যাপারে ঈমানদারদের কত সতর্ক হওয়া উচিত!
সাহাবী আবু বাকরা রা.-এর পুত্র মুসলিম বলেন, তিনি তার বাবাকে নামাযের পর এ দুআ পড়তে শুনতেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكُفْرِ وَالْفَقْرِ، وَعَذَابِ الْقَبْرِ.
(ইয়া আল্লাহ! আপনার আশ্রয় নিচ্ছি কুফর থেকে, দারিদ্র থেকে ও কবরের আযাব থেকে।) তিনিও তা পড়তে আরম্ভ করলেন। একদিন বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, বেটা! এ বাক্যগুলো কোথায় পেলে? তিনি বললেন, আব্বাজান! আপনাকে নামাযের পর এ বাক্যগুলো পড়তে শুনেছি। বাবা বললেন-
فالزمهن يا بني فإن نبي الله صلى الله عليه وسلم كان يدعو بهن في دبر الصلاة.
এগুলো নিয়মিত পাঠ কর। কারণ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের পর এ বাক্যগুলো দ্বারা দুআ করতেন। -সুনানে নাসায়ী ৮/২৬২; মুসতাদরাক, হাকিম ১/৩৫
তো এই হচ্ছে সালাফের অবস্থা। কুফর-শিরকের বিষয়ে তাঁরা কত সতর্ক ছিলেন। শঙ্কিত ছিলেন। তাহলে এখন কে আছে যে এই মহাফিতনা সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে? মূলত যে ভয় করে সে আত্মরক্ষার চেষ্টায় থাকে। আর যে আত্মরক্ষার চেষ্টায় থাকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন। এ বাস্তবতা কী সুন্দর করেই না বর্ণনা করেছেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে । তাঁর ইরশাদ-
من خاف ادلج ومن ادلج بلغ المنزل
অর্থাৎ, যে (শত্রুর আক্রমনের) ভয় করে সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। আর যে দ্রুত (আশঙ্কার) স্থান ত্যাগ করে সে (নিরাপদে) ঘরে পৌঁছে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫০
নবীগণ যেহেতু আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি চেনেন তাই তাঁরাই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করেন। এই সর্বোচ্চ ভয় তাঁদের ‘ইসমত’ ও নিষ্পাপতারই এক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ।
তিন. সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতার প্রার্থনা
হযরত ইবরাহীম আ. মক্কাবাসীর জন্য রিযকের দুআ করেছেন এবং তারা যেন আল্লাহর শোকরগোযারি করে-এ প্রত্যাশা করেছেন।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহয়ও বিষয়টি পাওয়া যায়। অনেক হাদীসেই আছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনার জন্য দুআ করেছেন।
সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, মৌসুমের নতুন ফল এলে সাহাবীগণ তা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে আসতেন, তিনি সেই ফল হাতে নিয়ে দুআ করতেন-
اللهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي ثَمَرِنَا، وَبَارِكْ لَنَا فِي مَدِينَتِنَا، وَبَارِكْ لَنَا فِي صَاعِنَا، وَبَارِكْ لَنَا فِي مُدِّنَا، اللهُمَّ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ عَبْدُكَ وَخَلِيلُكَ وَنَبِيُّكَ، وَإِنِّي عَبْدُكَ وَنَبِيُّكَ، وَإِنَّهُ دَعَاكَ لِمَكَّةَ، وَإِنِّي أَدْعُوكَ لِلْمَدِينَةِ بِمِثْلِ مَا دَعَاكَ لِمَكَّةَ، وَمِثْلِهِ مَعَهُ
আয় আল্লাহ! আমাদের ফল-ফসলে বরকত দিন। আমাদের শহরে বরকত দিন। আমাদের ‘ছা’-এ বরকত দিন। আমাদের ‘মুদ্দ’-এ বরকত দিন। ইয়া আল্লাহ! ইবরাহীম আপনার বান্দা, আপনার খলীল ও আপনার নবী আর আমি আপনার বান্দা ও নবী। ইবরাহীম মক্কার জন্য আপনার কাছে দুআ করেছেন, আমি মদীনার জন্য আপনার কাছে ঐসব কিছু চাইছি যা তিনি মক্কার জন্য চেয়েছেন এবং তার সাথে আরো অনুরূপ চাইছি। অর্থাৎ দ্বিগুণ চাইছি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৭৩
ছা এবং মুদ্দ দুটি পাত্রের নাম, আরবে শস্য পরিমাপ করার যে পাত্রগুলো ছিল, এর একটির নাম ছা’। আর তরল কিছু মাপার যে পাত্রগুলো ছিল এর একটির নাম মুদ্দ। তো রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাকের নিকট দুআ করছেন, আমাদের লেনদেনে যে সকল পাত্র ব্যবহৃত হয়, ছা, মুদ্দ ইত্যাদি, আয় আল্লাহ! এগুলোতে বরকত দান করুন।
‘ছা’ এবং ‘মুদ্দে’ বরকত দান করার অর্থ কী? এর অর্থ, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে, আমাদের লেনদেনে বরকত দান করুন।
বরকত কাকে বলে? ‘বারাকা’ শব্দের অর্থ, প্রাচুর্য। প্রাচুর্য দুইভাবে হয়, পরিমাণগত দিক থেকে কোনো কিছু বেড়ে যাওয়া। এটাও প্রাচুর্য, আবার বস্তুর যে উদ্দেশ্য তা ভালোভাবে পূর্ণ হওয়া, এটাও প্রাচুর্য। একজনের অর্থ বৃদ্ধি পেল। যদি তা হালাল পন্থায় হয় তাহলে তা বরকত। এটা দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রাচুর্য। দেখা যায়, গণনা করা যায়। আরেকজনের অর্থ হয় তো সংখ্যায় ও পরিমাণে বৃদ্ধি পেল না তবে অর্থের যে উদ্দেশ্য তা পুরা হয়ে গেল। অল্প অর্থে সকল প্রয়োজন পুরা হল। বিপদ-আপদের শিকার হল না। বড় বড় চিকিৎসায় অর্থ ব্যয় হল না। মামলা-মুকাদ্দমায় পয়সা খরচ হল না। যতটুকু হালাল উপার্জন তা দিয়েই জীবন সুন্দরভাবে কেটে গেল। এটাও প্রাচুর্য ও বরকত। তবে তা আগেরটির মত প্রত্যক্ষ নয়। এটা উপলব্ধির বিষয়। ঈমানদার যখন চিন্তা করেন তখন এ বরকতের উপস্থিতি বুঝতে পারেন।
তো রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার ব্যবসা-বাণিজ্যের বরকতের জন্য, সমৃদ্ধি ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেছেন। সুতরাং মুমিনের কর্তব্য, দেশ ও জাতির উপার্জনে যেন সমৃদ্ধি আসে, তারা যেন স্বাবলম্বী হয়, অন্যের মুখাপেক্ষী না হয় এবং তারা যেন তাদের উপার্জনের মাধ্যমে আখেরাতের পথে, আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে যেতে পারে- এ দুআ করতে থাকা।
এরপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইবরাহীম আ.-এর দুআর উল্লেখ করেছেন, ইয়া আল্লাহ! ইবরাহীম আপনার বান্দা, আপনার খলীল, আপনার নবী, আর আমি আপনার বান্দা, আপনার নবী’। দেখুন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয় দেখার মত। হাদীস শরীফে দুআর বাক্যগুলোতে তাঁর যে বিনয় পাওয়া যায়, অতুলনীয়। হাদীসের এ বর্ণনায় দুআটি যেভাবে আছে এটিই যদি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাআহি ওয়াসাল্লামের শব্দ হয় তাহলে এর তাৎপর্য এই হতে পারে যে, ইবরাহীম আ. যেহেতু প্রাচীন ও বংশীয় দিক থেকে পিতা, তাই তাঁর বৈশিষ্ট্য যা উল্লেখ করেছেন, নিজের বৈশিষ্ট্য তার চেয়ে একটা কম উল্লেখ করেছেন। ইবরাহীম আপনার বান্দা, আপনার খলীল, আপনার নবী আর আমি আপনার বান্দা, আপনার নবী। আল্লাহর রাসূল তো বলতে পারতেন, আমি আপনার হাবীব। কারণ হাদীস শরীফেই তাঁর এ বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে-
ألا وأنا حبيب الله، ولا فخر
(আমি আল্লাহর হাবীব, গর্ব নয়)। কিন্তু তিনি তাঁর বৈশিষ্ট্য কম উল্লেখ করেছেন, এ তাঁর বিনয়।
আর এখানে এসকল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার উদ্দেশ্য, আল্লাহ পাকের রহমত আকর্ষণ করা। আপনিই তো নবী বানিয়েছেন, আপনিই তো দয়া করে নৈকট্যের মর্যাদা দিয়েছেন। সুতরাং আরো দয়া করুন। আমি তো আপনারই দাস, আপনারই গোলাম, আপনার কাছেই তো প্রার্থনা করব, আর কার কাছে করব? তো আল্লাহ পাকের রহমত আকর্ষণ করার জন্য তাঁর বান্দা ও নবী হওয়ার উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন আল্লাহ! ইবরাহীম আ. মক্কার জন্য দুআ করেছেন, আমি আপনার বান্দা মদীনার জন্য দুআ করছি। আপনি মদীনাতেও ঐ সকল বৈশিষ্ট্য দান করুন যা ইবরাহীম আ. মক্কার জন্য চেয়েছেন এবং তার সাথে আরো অনুরূপ দান করুন।
এরকম আরো দুআ আছে। একটি দুআ এই-
اللهم ضع في أرضنا بركتها وزينتها وسكنها
‘হে আল্লাহ! আমাদের মাটিতে প্রাচুর্য দিন, শোভা ও শ্যামলিমা দিন, শান্তি ও নিরাপত্তা দিন’।
সুবহানাল্লাহ! কোনো জনপদের জন্য এর চেয়ে বড় দুআ কী হতে পারে? প্রাচুর্য, শোভা ও শান্তির পর কোনো শহর-নগরের আর কীসের প্রয়োজন থাকতে পারে?
মানুষ মনে করে ইসলাম বোধ হয় শুধু কঠিন কঠিন কথা বলে, শোভা ও সৌন্দর্যের কোনো কথা, আনন্দের কোনো কথা বোধ হয় ইসলামে নেই। এ আমাদের জানার কমতি। এখানে হাদীসের দুআয় শোভা ও শ্যামলিমা চাওয়া হয়েছে।
এরপর আছে سكنها আরবী ভাষা হিসাবে سَكَن শব্দের দুই অর্থ হয়। শব্দটি سكون (সুকূন) থেকেও আসে। সুক‚ন মানে প্রশান্তি। এ হিসেবে ‘সাকান’ শব্দের অর্থ শান্তি, প্রশান্তি। আবার শব্দটি سكنى (সুকনা) থেকেও আসে। ‘সুকনা’ মানে, আবাস। ‘সাকান’ শব্দটি যখন ‘সুকনা’ থেকে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হয়, জীবনোপকরণ তথা খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি। নাগরিক জীবনে যা কিছুর প্রয়োজন হয় সব কিছু ‘সাকান’ শব্দে শামিল। কারণ মানুষ সেখানেই বসবাস করে যেখানে তার জীবনোপকরণ আছে, যেখানে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ আছে। সুতরাং দুআটির এ অর্থও হতে পারে যে, আয় আল্লাহ! আমাদের এই মাটিতে প্রাচুর্য দিন, শোভা ও শ্যামলিমা দিন এবং পর্যাপ্ত জীবনোপকরণ দিন।
এ দুআর পরের বাক্য দুটি আরো চমৎকার-
اللهم لا تحرمني بركة ما أعطيتني ولا تفتني فيما أحرمتني
‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যা দান করেছেন, তার বরকত থেকে আমাকে বঞ্চিত কোরেন না।’ অর্থ-বিত্ত অনেক হল, কিন্তু অর্থ-বিত্তের যে উদ্দেশ্য, দুনিয়ার জীবনটা শান্তিতে কাটানো, তা-ই হল না। তাহলে এই অর্থ-বিত্তের কী মূল্য? তো আল্লাহ পাকের কাছে দুআ করা হচ্ছে, আপনি আমার জন্য যা ফায়সালা করেছেন, তার বরকত থেকে আমাকে বঞ্চিত কোরেন না। যা কিছু দান করেছেন তার সুফল ও কল্যাণও দান করুন।
‘আর যা কিছু থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছেন তার বিষয়ে আমাকে পরীক্ষাগ্রস্ত কোরেন না।’ অর্থাৎ যা আমাকে দেননি, আশা ছিল, আকাঙ্খা ছিল, কিন্তু পূরণ হয় নি, সে ব্যাপারে আমাকে পরীক্ষায় ফেলে দিয়েন না। অর্থাৎ এমন যেন না হয় যে, অস্থিরতার কারণে গুনাহয় লিপ্ত হলাম, পাপাচারে জড়িয়ে গেলাম, আপনার না-শোকরী ও নাফরমানীতে পড়ে গেলাম।
তো যা দিয়েছেন তাতে কল্যাণ ও বরকত দিন আর যা দেননি তার কষ্ট ও অনিষ্ট থেকে নাজাত দিন। এই যে দুআ, এরচেয়ে বেশি কিছু দুনিয়ার জীবনে একজন বান্দার আর কী চাই?
হাদীস শরীফের দুআগুলোতে নিজের ভ‚মি ও সেই ভ‚মির অধিবাসীদের জন্য, আপন মুসলিম ভাইদের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে আফিয়াত ও নিরাপত্তা এবং রহমত ও বরকত প্রার্থনার শিক্ষা রয়েছে।
সারকথা: উপরের আলোচনা থেকে কুরআন সুন্নাহর আলোকে তিনটি বিষয় পাওয়া গেল।
এক. মুমিনের কর্তব্য, ঈমান ও ইসলামের কেন্দ্র মক্কা-মদীনার জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করতে থাকা।
দুই. নিজ ভ‚খণ্ডের জন্যও আল্লাহর দরবারে রোনাযারি করা, দেশবাসীর জাগতিক ও আদর্শিক নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতার জন্য আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করা।
আর এ যেহেতু দ্বীন-ধর্মের দাবি আর দ্বীনদারগণই হচ্ছেন দ্বীনের প্রকৃত অনুসারী তাই এখান থেকে তৃতীয় যে বিষয়টি বোঝা যায় তা হচ্ছে, কোনো ভুখণ্ডের সর্বোত্তম অধিবাসী হচ্ছে ঐ ভ‚খণ্ডের ঈমানদার, খোদাভীরু ও কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিগণ। এরাই ঐ ভ‚খণ্ডের শান্তি ও নিরাপত্তার সূত্র। এদেরই কর্ম ও প্রচেষ্টায় ঐ ভ‚খণ্ডে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে এবং এদেরই দুআ ও রোনাযারিতে ঐ ভ‚খণ্ডে আল্লাহর রহমত আসে। পক্ষান্তরে দাম্ভিক অনাচারী সম্প্রদায় যেকোনো ভ‚খণ্ডের জন্য আযাব স্বরূপ। এদের মাধ্যমে অনাচারের বিস্তার ঘটে এবং এদের অপকর্ম আল্লাহর আযাবকে ত্বরান্বিত করে। কুরআন মাজীদের ইরশাদ-
وَ اِذَاۤ اَرَدْنَاۤ اَنْ نُّهْلِكَ قَرْیَةً اَمَرْنَا مُتْرَفِیْهَا فَفَسَقُوْا فِیْهَا فَحَقَّ عَلَیْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنٰهَا تَدْمِیْرًا
আমি যখন কোনো জনপদ ধ্বংস করতে চাই তখন তার সমৃদ্ধশালীদের (সৎকর্মের) আদেশ করি, কিন্তু ওরা ওখানে অসৎকর্ম করে। ফলে ওখানে দম্ভাজ্ঞা ন্যায়সংগত হয়ে যায়, পরিশেষে আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি। -সূরা বানী ইসরাইল ১৭ : ১৬
সুতরাং যার অন্তরে ঈমানের কিছুমাত্রও আলো রয়েছে তার কর্তব্য এ কুরআনী সত্য উপলব্ধি করা। প্রত্যেক ভ‚খণ্ডের অধিবাসীদের কর্তব্য, কোন পথে দেশ ও জাতির প্রকৃত কল্যাণ, আর কোন পথে অনিষ্ট-অকল্যাণ, কারা জাতির প্রকৃত মিত্র ও কল্যাণকামী আর কারা দুশমন ও অনিষ্টকামী তা সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া। দেশ ও জাতির উন্নয়ন-প্রচেষ্টা সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার এ পূর্বশর্ত।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দিন, আমীন।