খায়ের-বরকত ও নেক আমলের বসন্ত :আছি কেউ কদর করার
الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد
আমরা এখন রজব মাস কাটাচ্ছি। এ মাস ‘আরবাআতুন হুরুম’ বা সম্মানিত চার মাসের শেষ মাস। এরপর আসছে শাবান। শাবান মাস যেন রমযান মাসের ‘সুবহে সাদিক’। এরপর রমযানুল মুবারক। রমযান শেষ হলেই শুরু হবে শাওয়াল, যা হজ্বের মাসসমূহের প্রথম মাস। আর এ মাসের প্রথম দিন ঈদুল ফিতর। পরবর্তী মাস যুলকা‘দা, যা আশহুরে হুরুমের প্রথম মাস। এরপর যুলহাজ্ব। হজ্ব ও কুরবানীর মাস, আশহুরে হুরুমের দ্বিতীয় মাস এবং ফযীলতপূর্ণ দশ দিন ও দশ রাতের মাস। যুলহাজ্ব মাস শেষ হলে একটি চান্দ্রবর্ষের সমাপ্তি ঘটে, কিন্তু খায়ের ও বরকতের সমাপ্তি ঘটে না। কারণ এর পরবর্তী মাস হল, মুহাররমুল হারাম। যে মাসকে হাদীস শরীফে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলা হয়েছে। এটি চান্দ্র বছরের প্রথম মাস, আশহুরে হুরুম বা সম্মানিত চার মাসের তৃতীয় মাস এবং আশুরা’র মাস।
মোটকথা, আমাদের সামনে এখন ফযীলতপূর্ণ মাস ও দিবস-রজনীর এক নূরানী ধারা এবং খায়ের ও বরকতের এক আশ্চর্য বসন্তকাল। কিন্তু এগুলোর কদর বোঝার মত কি কেউ আছি? আমাদের বদ কিসমত যে, আমরা ফযীলতপূর্ণ সময়গুলো গাফলত ও অলসতায় পার করে দিই। নির্বিকারচিত্তে সময় নষ্ট করতে থাকি। অথচ শুধু ফযীলতপূর্ণ সময় নয়, অন্যান্য সময়ও আল্লাহ তাআলার বিশেষ নিআমত। আমি যদি কদর করতে পারি তাহলে প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি মাস, প্রতিটি বছর আমার জন্য খায়ের ও বরকত বয়ে আনবে।
ہر شب شب قدر است اگر قدر میداني
‘সব রাতই কদরের রাত, যদি কদর করতে পারো’। কিন্তু আমাদের অবস্থা হল, সাধারণ সময় তো দূরের কথা, বিশেষ সময় এমনকি বিশেষতর সময়েরও আমরা কদর করি না।
সময়ের কদর হবে কীভাবে?
সময়ের কদর করার বিভিন্ন দিক আছে। যেমন-
১. আল্লাহর নাফরমানির কাজে সময় ব্যয় না করা
আল্লাহর নাফরমানির কাজে সময় ব্যয় করা সময়ের সবচেয়ে বড় অবমূল্যায়ন। তাই কোনো সময় যেন আল্লাহর নাফরমানির কাজে ব্যয় না হয়- এ বিষয়ে সতর্ক থাকা ফরয। সময়ে গুনাহের কোনো হিসসা থাকতে পারে না। গুনাহ কোনোভাবেই সময়ের ব্যয়খাত হতে পারে না। আমরা যদি নাফরমানি থেকে সময়কে বাঁচাতে পারি তাহলে তা হবে সময়ের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন ও সর্বোচ্চ শোকরগোযারি।
২. নির্দিষ্ট সময়ে পালনীয় ইবাদতসমূহ গুরুত্ব ও যত্নসহকারে আদায় করা
যে সময়গুলোতে শরীয়তের পক্ষ থেকে নির্ধারিত কোনো ইবাদাত আছে সে সময়গুলোর সর্বোচ্চ মূল্যায়ন হল, নির্ধারিত ইবাদতগুলো গুরুত্ব সহকারে সুচারুরূপে পালন করা। সেগুলো যেন ছুটে না যায় তার প্রতি খেয়াল রাখা। ফরয ও ওয়াজিব তো কাযা হওয়ার প্রশ্নই আসে না সুন্নাতে মুয়াক্কাদার ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে, অলসতা-অবহেলার কারণে যেন সেগুলো ছুটে না যায়। সুন্নাতে মুআক্কাদা’র অর্থ হল, তাকিদপূর্ণ সুন্নাত। সালাফের যুগে এটি ‘সুন্নাতে রাতেবাহ’ নামে অধিক প্রসিদ্ধ ছিল। এর অর্থ, এমন সুন্নাত যা নিয়মিত আদায় করা হয়, ছেড়ে দেওয়া হয় না।
আর যে সময়গুলোতে কোনো নফল ইবাদাত (নফল নামায, তিলাওয়াত, দুআ ও যিকির) পালনের প্রতি হাদীসে উৎসাহিত করা হয়েছে সেগুলোর কিছু কিছু নফল আমল নিজের দৈনিক আমলে শামিল করে নিব এবং এই নববী মুলনীতি خير العمل ما ديم عليه (সর্বোত্তম আমল হল যা নিয়মিত করে যাওয়া হয়)-অনুসারে সেগুলো আমি নিজ ইচ্ছায় নিয়মিত পালন করে যাওয়ার চেষ্টা করব। সাময়িক কোনো প্রয়োজনে (দ্বীনী বা দুনিয়াবী) কিংবা অলসতার কারণে কখনও যদি এ ধরনের আমল ছুটে যায় তাহলে অন্য সময় কাযা করে নেওয়া ভালো। হাদীস শরীফে আছে-
مَنْ نَامَ عَنْ حِزْبِهِ، أَوْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ، فَقَرَأَهُ فِيمَا بَيْنَ صَلَاةِ الْفَجْرِ، وَصَلَاةِ الظُّهْرِ، كُتِبَ لَهُ كَأَنَّمَا قَرَأَهُ مِنَ اللَّيْلِ
যে তার নির্ধারিত আমল বা তার কিছু অংশ আদায় না করে ঘুমিয়ে পড়ে, এরপর ফজর-যোহরের মাঝে তা পড়ে নেয় তার সম্পর্কে লেখা হবে যেন সে রাতেই তা পড়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৪৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৮১
৩. কর্তব্য কর্মে নির্ধারিত সময় ব্যয় করা
আমার দায়িত্বে যে কাজ ও যিম্মাদারি আছে এবং সেগুলো পালনের জন্য যে সময় নির্ধারিত আছে, যেমন আমি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করি বা বিনিময় নিয়ে খেদমত আঞ্জাম দেই এবং আমার দায়িত্ব পালনের সময় নির্ধারিত, এই নির্ধারিত সময়ে আমার ফরয হল, সে সময়ের নির্ধারিত জিম্মাদারী যথাযথ আদায় করা। এখানে নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করাই এই সময়ের মূল্যায়ন। অন্য কোনো কাজে এই সময় ব্যয় করা যেমন সময়ের অবমূল্যায়ন তেমনি তা আমানতেরও খেয়ানত।
৪. অতিরিক্ত সময় অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক উপকারী কাজে ব্যয় করা
নির্দিষ্ট সময়ে পালনীয় ইবাদাত, নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও যিম্মাদারী, বিভিন্ন সময় আসা তাৎক্ষণিক পালনীয় কাজ ইত্যাদি সম্পন্ন করার পর হাতে যে সময় থাকে সাধারণত এই সময়গুলো বেশি অবহেলার শিকার হয়। তাই এ খেয়াল রাখা অতি জরুরি যে, এ সময়গুলো যেন অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক উপকারী কাজে ব্যয় হয়। প্রয়োজনে বড়দের সাথে, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকদের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত। সৌভাগ্যবশত আমার জীবন যদি কোনো মুত্তাকী আলেমে দ্বীন বা মুত্তাবিয়ে সুন্নাত (সুন্নাহর অনুসারী) শায়খের নেগরানি ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় তাহলে তাঁর সাথেই এ ব্যাপারে পরামর্শ করে নেওয়া অধিক শ্রেয়।
৫. নেক কাজ ও সওয়াবের কাজ কী কী তা বিশদভাবে জানা
নেক কাজ ও সওয়াবের কাজের মাশাআল্লাহ আনেক শাখা। সেগুলো বিশদভাবে জানলে দেখা যাবে সব ধরনের মানুষের জন্য তার স্ব স্ব যোগ্যতা ও অবস্থা অনুসারে নেক কাজ করার ও সওয়াব অর্জন করার অনেক রাস্তা খোলা আছে।
দুঃখজনক বাস্তবতা এই যে, আমাদের সমাজে এমন একটি শ্রেণী আছে যাদের পরিচয় হল ‘অবসরপ্রাপ্ত’। এই অবসরকে যদি আল্লাহ তাআলার নিআমত মনে করা হত, অবসর সময়ের সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার হত এবং একে অপব্যবহার থেকে রক্ষা করা হত, তাহলে তা উম্মত ও মিল্লাতের জন্য অনেক কল্যাণ বয়ে আনত।
কিন্তু সাধারণত দেখা যায়, এর অপব্যবহারই বেশি হয়। আমার দৃষ্টিতে এর মারাত্মক অপব্যবহার এই যে, নিজের গণ্ডি ও সামর্থ্যরে বাইরের কাজে এই সময় ব্যয় করা। যেমন কোনো আলেম চিকিৎসা-শাস্ত্রের কয়েকটি বই পড়েই চিকিৎসালয় খুলে বসল অথবা কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সাহিত্যিক কিছু কিতাবের অনুবাদ পড়ে দ্বীনী বিষয়ে গবেষণা শুরু করল।
নেক কাজ, সওয়াবের কাজ, দ্বীনের খেদমতের বিভিন্ন পথ ও পন্থা সম্পর্কে বিশদ জানাশোনা না থাকার কারণে এবং পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার না করে এমনি এমনি ‘খাদেমে দ্বীন’ বনে যাওয়ার অভিলাষে গুটিকয়েক কাজ ও গুটিকয়েক পন্থাকেই সবাই নেক কাজ বা দ্বীনী কাজ মনে করে। তাই অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ অবহেলার শিকার। খিদমতে দ্বীনের বিস্তৃত অঙ্গনে শুধু শূন্যতা আর শূন্যতা। তবে দ্বীনের যা কিছু খেদমত হচ্ছে তার জন্য আল্লাহর দরবারে লাখো শোকর। আল্লাহর যেসকল বান্দা এতে কাজ করে যাচ্ছেন তাদেরও শোকর আদায় করছি। আল্লাহ তাআলা সবাইকে আপন শান মোতাবেক জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন।
মোটকথা অবসর সময়ের সঠিক ব্যবহারের জন্য (তা ছাড়া এমনিতেও বিষয়টি জরুরি) আমাদের নেক কাজের ক্ষেত্র, সওয়াব অর্জনের বিভিন্ন আমল এবং খেদমতে দ্বীনের নানা পথ ও পন্থা সম্পর্কে বিশদ জ্ঞানার্জন করা জরুরি।
এখানে সহজে বোধগম্য একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করা একটি ইবাদত। কুরআনে কারীমের মর্ম বোঝার চেষ্টা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল। তিলাওয়াত করতে হলে তাজবীদসহ কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত শেখা জরুরি। আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছেন যিনি কুরআনের মর্ম বোঝার জন্য সময় বের করতে প্রস্তুত, কিন্তু কুরআনে কারীমের সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখার জন্য সময় বের করতে প্রস্তুত নন।
আরেকটি উদাহরণ, এমন অনেক লোক আছেন, যাদের ধারণায় আলেমরা দৃষ্টি না দেওয়ার কারণে ইলমী কাজে অনেক শূন্যতা রয়েছে। তাই সেসব শূন্যতা পূরণের জন্য তারা উঠে পড়ে লাগেন এবং কাজ করার জন্য ময়দানে নেমে আসেন। অথচ তারা আরবী ভাষা শিখতে রাজী নন। যদিও শুধু ভাষা শিক্ষাও ‘আলেম’ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। নতুবা আরবীভাষী সবাই ‘আলেম’ হয়ে যেত।
তৃতীয় উদাহরণ, কিছু সূ² মাসআলায় অপরিণামদর্শী লোকেরা ঝগড়াঝাটি ও তর্ক-বিতর্কের পথ খুলে রেখেছে। কিছু লোক আছে যারা এ ধরনের মাসআলায় দখল দিতে গিয়ে প্রচুর সময় ব্যয় করেন তাদেরকে যদি বলা হয়, ভাই! গুরুত্বের বিচারে স্বাভাবিক নিয়মে প্রথমে আপনি ‘জরুরিয়্যাতে দ্বীনের’ ইলম হাসিল করুন, ফরযে আইন পরিমাণ ইলম হাসিল করার পর আরো ইলম হাসিল করতে চাইলে আপনি মাআরেফুল কুরআন ও মাআরেফুল হাদীস মুতালাআ করুন, الطريق إلى العربية দরসে পড়–ন, الطريق إلى العربية শেষ হলে الطريق إلى القرآن الكريم পড়–ন, তাহলে দেখা যায় তারা এই নির্দেশনা মানতে প্রস্তুত হন না।
এখানে তো ইলমে দ্বীনের কথা আলোচনা করা হল। খেদমতে দ্বীন এবং নেক আমলের অন্যান্য ক্ষেত্রের অবস্থাও এ রকম। অল্প কিছু কাজ নিয়েই সবাই ব্যস্ত অথচ অন্য অনেক ময়দানে শূন্যতা বিরাজ করছে। সেগুলোতে কাজ করার উদ্দেশ্যে যোগ্যতা অর্জনের জন্য সময় ব্যয় করতে কেউ প্রস্তুত নয়।
৬. অনর্থক ও বে-ফায়দা কাজ থেকে বেঁচে থাকা
চিন্তা করলে দেখা যাবে, আমাদের বড় একটা সময় অনর্থক ও বে-ফায়দা কাজে ব্যয় হয়। অথচ মুমিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ, বে-ফায়দা কাজ থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَۙ الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْن
‘নিশ্চয় সফলতা অর্জন করেছে মুমিনগণ, যারা তাদের নামাযে বিনীত এবং যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে।’... -সূরা মুমিনূন : ১-৩
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه
ব্যক্তির সুন্দর মুসলিম হওয়ার এক নিদর্শন, অর্থহীন কাজ ত্যাগ করা। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩১৭
অনর্থক ও বে-ফায়দা কাজের মধ্যে ঐসকল কাজও অন্তর্ভুক্ত যেগুলো করলে কোনো সওয়াবও হয় না এবং দ্বীনী বা দুনিয়াবী কোনো ফায়দাও হয় না। কোনো কাজ যদি বাহ্যত ‘মুবাহ’ হয় কিন্তু সে কাজ করলে দ্বীনী বা দুনিয়াবী কোনো ক্ষতির আশংকা থাকে তাহলে সে কাজও لغو বা অনর্থক কাজ বলে বিবেচিত হবে।
আর নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্যরে ঊর্ধ্বের কাজে নাক গলানো শুধু অনর্থক কাজ নয়; বরং গুনাহ।
সময় ও অবস্থাভেদে মন্দ কাজেরও তারতম্য হয়। সাধারণ সময়ে অনর্থক কাজ করা আর ফযীলতপূর্ণ সময়ে অনর্থক কাজে লিপ্ত হওয়া এককথা নয়। ফযীলতপূর্ণ সময়ে অনর্থক ও অহেতুক কাজে লিপ্ত থাকা খুবই নিন্দনীয়।
তদ্রƒপ সকলের অনর্থক কাজের হুকুম এক নয়। কোনো তালিবে ইলমের অনর্থক কাজে পাঁচ মিনিট নষ্ট করা কারো কারো ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট করার চেয়েও দোষের।
আর ‘অনর্থক’ একটি আপেক্ষিক বিষয়ও। সময়ের চাহিদার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করে কিংবা অধিক উপকারী ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে নিজের মনমতো কোনো নেক কাজে লেগে যাওয়াও একদিক থেকে বে-ফায়দা কাজেই লেগে যাওয়া। বিশেষ করে তা যদি তালিবে ইলমদের পক্ষ থেকে হয়।
এখানে প্রসঙ্গত এ বিষয়টিও উল্লেখ করে দেওয়া মুনাসিব মনে হচ্ছে যে, শরীরের হক আদায় করা এবং শরীর-মনে উদ্যম ফিরিয়ে আনার জন্য তালিবে ইলমের শান মোতাবেক জায়েয ও ‘মুহায্যাব’ খেলাধুলা বা শরীর চর্চা অনর্থক কাজের মধ্যে পড়ে না; বরং এটা কাম্যও এবং সুন্নাতসম্মতও। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা আজর ও পুরস্কারও দিবেন।
৭. টুকরো সময় কাজে লাগানো
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফযীলতপূর্ণ সময়ের টুকরো অংশগুলোকে যিকির, দুআ এবং তিলাওয়াতে ব্যয় করা উচিত। এক আয়াত বা এক লাইন তিলাওয়াতও তিলাওয়াত।
টুকরো সময়ের গুরুত্ব ও কাজে লাগানোর উপায় সম্পর্কে হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুম-এর একটি বয়ান আল কাউসারে শিক্ষার্থীদের পাতায় ছাপা হয়েছে। ‘তালেবানে ইলম : পথ ও পাথেয়’তেও বয়ানটি আছে।
৮. নেযামুল আওকাত মেনে চলা
সময় নষ্ট হওয়ার বা সময় ফলপ্রসূ না হওয়ার যত কারণ আছে তার মধ্যে একটি বড় কারণ,
اوقات کے حسن تنظیم اور حسن تقسیم کا فقدان
সময়ের সুষম বন্টন ও সুষ্ঠু বিন্যাস না থাকা। কাগজে নেযামুল আওকাত লেখার প্রচলন হয়ত পরবর্তীতে শুরু হয়েছে, কিন্তু সারাদিনের সময় একটি নির্দিষ্ট নিয়মে বণ্টন করে সে অনুযায়ী চলা- এ তো শরীয়তের এক গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং সালাফে সালেহীনের শিআর। বিশেষ করে সব যুগের আকাবির উলামা ও মাশায়েখের কাছে এ বিষয়টির বেশ গুরুত্ব ছিল। চিন্তা করলে হাদীস শরীফে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতে এর অনেক দলীল পাওয়া যাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের এই সুন্নাতটি যথাযথ গুরুত্বের সাথে পালন করার তাওফীক দিন।
সামনে রমযান মাস আসছে। রমযান মাসকে ইসতিকবাল করার এক উপায় এই যে, রমযান আসার আগেই তার জন্য নেযামুল আওকাত তৈরি করা এবং অন্যান্য যিম্মাদারির প্রতি লক্ষ্য রেখে যথাসম্ভব রমযানের হক আদায়ের এবং রমযানের আমলের জন্য বেশির থেকে বেশি সময় নির্ধারণের চেষ্টা করা।
৯. আমলে নূর ও রূহ তৈরি করার চেষ্টা করা
সম্ভবত সময়কে ফলপ্রসূ বানানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হল, উক্ত সময়ে কৃত আমল ও কাজে রূহানিয়্যাত ও নূরানিয়্যাত সৃষ্টির চেষ্টা করা। যখন একটি কাজে সময় ব্যয় হচ্ছেই তখন তা যথাযথভাবে হওয়া উচিত। কাজটি অবহেলাভরে করা, মনোযোগ না দেওয়া, নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা না করা- একটি ভুল কর্মপন্থা। এর মাধ্যমে আমরা সময়েরও অবমূল্যায়ন করি এবং কাজটিরও হক নষ্ট করি। কোনো কাজে রূহানিয়্যাত ও নূরানিয়্যাত আনার উপায় হল, গুরুত্বের বিচারে কাজটি যে মনোযোগ, অভিনিবেশ ও নিষ্ঠার দাবি রাখে তা পুরণের চেষ্টা করা। মাসনূন তরিকায় কাজ করা, সুচারুরূপে করা, ‘ইহসান’-এর প্রতি লক্ষ্য রেখে আমল করা, প্রশস্ত ও গভীর নিয়ত করা, ইহতিসাব ও সওয়াবের কথা খেয়াল রাখা, সিদক ও সততা এবং ইখলাস ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করা- প্রভৃতি গুণাবলিই কাজে রূহানিয়্যাত ও নূরানিয়্যাত আনে। তাছাড়া এ তো সবারই জানা যে, এই গুণগুলো আলাদাভাবেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রত্যেকটিই মুমিনের মাকসাদ ও মানযিল।
১০. সময়ের বরকত নষ্ট করে দেয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা
সৃষ্টির সূচনা থেকে সময়ের একই নিয়ম ও ধারা চলে আসছে। আল্লাহ আআলা বলেন-
تَبٰرَكَ الَّذِیْ جَعَلَ فِی السَّمَآءِ بُرُوْجًا وَّ جَعَلَ فِیْهَا سِرٰجًا وَّ قَمَرًا مُّنِیْرًا وَ هُوَ الَّذِیْ جَعَلَ الَّیْلَ وَ النَّهَارَ خِلْفَةً لِّمَنْ اَرَادَ اَنْ یَّذَّكَّرَ اَوْ اَرَادَ شُكُوْرًا.
‘মহিমাময় সেই সত্তা, যিনি আকাশে বুরূজ বানিয়েছেন এবং তাতে এক উজ্জ্বল প্রদীপ ও আলোকিত চাঁদ সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই সেই সত্তা যিনি রাত ও দিনকে পরস্পরের অনুগামী করে সৃষ্টি করেছেন- (কিন্তু এসব বিষয় উপকারে আসে কেবল) সেই ব্যক্তির জন্য, যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়।’ -সূরা ফুরকান : ২৫ : ৬১
সৃষ্টির সূচনা থেকে সময়ের একই ধারা ও নিয়ম জারি থাকার পরও আমাদের আর সালাফের মাঝে এত পার্থক্য কেন? কেন আমরা সবসময় সময়স্বল্পতার অভিযোগ করি? অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্নদের বক্তব্য হল, তাঁদের সময়ে বরকত হত, আমাদের সময়ে বরকত হয় না। হলেও কম হয়। তাই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের সময়ও যেন বরকতশূন্য না হয়ে যায়। যে সকল বিষয় সময়ের বরকত নষ্ট করে দেয় তন্মধ্যে এই চারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-
ক. আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করা। বিশেষ করে অশ্লীল কথা বলা বা অশ্লীল কোনো কাজ করা। এটি সময়কে একেবারেই নূর ও বরকতশূন্য করে দেয়। এ থেকে বেঁচে থাকা খুব জরুরি। খালেস দিলে তওবা করে হিম্মত করে এ থেকে বাঁচার চেষ্টা করা কর্তব্য। গীবত, শেকায়েত, মন্দ কথা, মন্দ ধারণা, সমসাময়িক বিষয়ে ‘¯্রফে মন্তব্যের জন্য মন্তব্য’- ইত্যাদি কাজও সেই গুনাহের অন্তর্ভুক্ত, যা সময়ের বরকত নষ্ট করে দেয়।
খ. দিল-দেমাগ ও মন-মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত করে এমন সকল আচার-আচরণ ও চিন্তা-ফিকির। এটি সময়ের বরকত ও নূরানিয়্যাতের জন্য বিষতুল্য।
গ. অনর্থক ও বে-ফায়দা কাজকর্মে সময় নষ্ট করা।
ঘ. আল্লাহ তাআলা আমাকে যে কাজের তাওফীক দিয়েছেন তা ছেড়ে এমন কাজ করতে যাওয়া, যা করার সামর্থ্য বা যোগ্যতা আমার নেই।
এগুলো এবং এগুলো ছাড়া আরো যেসকল কাজের কারণে সময়ের নূর ও বরকত নষ্ট হয়ে যায়- সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।
বিশেষকরে কিছু কাজ এমন আছে যার কারণে মানুষের গোটা জীবনটা বরকতশূন্য হয়ে যায়। এগুলো থেকে সাবধান থাকা উচিত। যেমন পিতা-মাতাকে কষ্ট দেওয়া, আসাতিযায়ে কেরামের সাথে বেআদবি করা, সহপাঠীদের সাথে অহংকার করা, খাবার-খাদ্য, ঘর-বাড়ি, প্রয়োজনীয় বাহন প্রভৃতিতে হারাম অর্থ শামিল থাকা।
১১. কৃত নেক আমল হেফাযতের প্রতি খেয়াল রাখা
সময়ের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যে কথাটি সর্বশেষ আরয করতে চাই তা হল, সময় ব্যয় করে যে নেক কাজ করা হল তার হেফাযতের প্রতি খেয়াল রাখা কর্তব্য। এমন কথা ও কাজ-কর্ম থেকে বেঁচে থাকতে হবে যার কারণে নেক আমল বাতিল হয়ে যায় বা নেক আমলের বরকত নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ঈমানের উপর অটল রাখুন। সর্বদা ইসলামের ছায়াতলে রাখুন। সব ধরনের ইরতিদাদ ও ধর্মহীনতা থেকে আমাদের রক্ষা করুন।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ َمِنَ الْحَوْرِ بَعْدَ الْكَوْرِ.
হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে ভালোর পর মন্দে পতিত হওয়া থেকে পানাহ চাই। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৩৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৮৮৮
তো দ্বীনে হককে ত্যাগ করে ‘মুরতাদ’ হয়ে যাওয়া কিংবা আল্লাহর সাথে শিরক করা- এ দুই কারণে মানুষের আমল বরবাদ হয়ে যায় তা সবাই জানে এবং এটি একটি প্রসিদ্ধ বিষয়। কিন্তু এ ছাড়াও আরো কিছু কাজ আছে যেগুলোর কারণে আমল বরবাদ হয়ে যায় কিংবা আমলের সওয়াব ও ফায়দা শেষ হয়ে যায়। যেমন-
ক. রিয়া বা লোক দেখানোর নিয়ত।
খ. অনুগ্রহ করে খোঁটা দেওয়া।
গ. সদকা দিয়ে খোঁটা দেওয়া।
ঘ. হিংসা-বিদ্বেষ।
ঙ. পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়া।
কিছু রেওয়ায়েত থেকে অনুমিত হয়, কবীরা গুনাহ বেশি করতে থাকলেও অন্যান্য আমল বরবাদ হয়ে যায়।
কিছু বিষয় এমন আছে যেগুলোর কারণে আল্লাহর দরবারে দুআ ও ইবাদত কবুল হয় না। সেগুলো থেকে বেঁচে না থাকলে ব্যয়কৃত সময়, মেহনত-মোজাহাদা সবই বিফলে যাবে। যেমন-
ক. খাবার-দাবার, ঘর-বাড়ি, ব্যবহারের বাহন হারাম অর্থের বা হারাম উপার্জনের হওয়া।
খ. আকীদা বা আমলে বিদআতে লিপ্ত হওয়া।
কিছু গুনাহ এমন আছে হাশরের ময়দানে যেগুলো বড় বড় আবেদ ও যাহেদকেও ‘ফকির’ বানিয়ে দেবে। যখন নেকআমলের প্রচণ্ড প্রয়োজন পড়বে তখন এ গুনাহগুলোর কারণে নেক আমল কোনো কাজে আসবে না। এটা হয়ে থাকে আল্লাহর মাখলূক ও আল্লাহর বান্দাদের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াদির ক্ষেত্রে। যেমন কারো গীবত করা, কারো উপর অপবাদ আরোপ করা, কাউকে গালি-গালাজ করা, কাউকে না-হক কষ্ট দেওয়া, কারো হক মেরে দেওয়া, এতিমের সম্পদ গ্রাস করা, হকদারকে মীরাছের সম্পদ না দেওয়া, রক্ত-সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা, নিরীহ পশু-পাখিকে কষ্ট দেওয়া। মোটকথা আল্লাহর মাখলূক বা আল্লাহর বান্দাদের হক নষ্ট করার কারণে যে গুনাহ হয় তার কারণে মানুষ ঐ সময় তার কৃত নেক আমল থেকে বঞ্চিত থাকবে যখন কৃত আমলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়বে। তার সকল নেক আমল চলে যাবে সেই লোকদের আমলনামায় যাদের হক সে নষ্ট করেছিল। এর দ্বারাও যদি হক আদায় না হয় তাহলে তাদের গুনাহ তার আমলনামায় দিয়ে দেওয়া হবে। সেই ভয়াবহ অবস্থা থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের রক্ষা করুন।
দুনিয়া থেকে যাওয়ার আগেই সবার প্রাপ্য হক আদায় করে দিয়ে যাওয়ার তাওফীক দিন। আমীন।
শেষকথা
বাহ্যিকভাবে মনে হতে পারে প্রবন্ধ নির্দিষ্ট বিষয়ে থাকেনি। বিষয় ছিল ফযীলতপূর্ণ সময়ের কদর করব কীভাবে? কিন্তু আলোচনা হল সময়ের কদর কীভাবে হবে সে সম্পর্কে। বস্তুত ফযীলতপূর্ণ সময় তো সময়েরই অংশ। যে উপায়ে সময়ের মূল্যায়ন হবে, সেভাবেই ফযীলতপূর্ণ সময়েরও মূল্যায়ন হবে। ফযীলতপূর্ণ সময়ে এই মূলনীতিগুলো অধিক গুরুত্বের সাথে পালন করা আবশ্যক।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়ে গেছে। তা হল, সময়ের মূল্যায়ন করতে হলে সময়ের চাহিদা বোঝাও জরুরি। ফযীলতপূর্ণ সময়ের ক্ষেত্রে এই মূলনীতির গুরুত্ব আরো বেশি। ফযীলতপূর্ণ সময়ে কী করণীয় এবং সময়গুলোর বিশেষ আমল কী তা সঠিকভাবে জেনে তার উপর আমল করা এবং এর মাধ্যমে এই সময়গুলোকে বেশি ফলপ্রসূ করাই এ সময়গুলোর যথাযথ মূল্যায়ন। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিন।
১৬/০৭/১৪৩৬ হিজরী