শাবান-রমযান ১৪৩৬   ||   জুন-জুলাই ২০১৫

ভূমিকম্প : আল্লাহকে স্মরণ করুন, ঈমানী যিন্দেগী অবলম্বন করুন

মানুষের চারপাশে ছোট-বড় যা কিছু ঘটে তার অনেক কিছুই মানুষের জন্য আকস্মিক। তা নিয়ন্ত্রণ করা তো দূরের কথা, বিজ্ঞানের যুগে তার পূর্বাভাসও মানুষের ক্ষমতার বাইরে। একটি, দুটি বিষয় নয়, মানুষের জীবনের অনেক কিছুই এমন। এ মানুষের দুর্বলতা ও জ্ঞানস্বল্পতার এক দৃষ্টান্ত। মানুষকে তো অতি অস্পষ্ট জ্ঞান দেওয়া হয়েছে আর তাকে সৃষ্টিও করা হয়েছে দুর্বল করে।

কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যিনি এই জগতের স্রষ্টা, এই প্রকৃতি ও প্রকৃতির নিয়মের সৃষ্টিকর্তা, তাঁর কাছে কোনো কিছুই আকস্মিক নয়। সবকিছুই তাঁর ইচ্ছাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন। প্রকৃতির  যে সূ² ও শক্তিশালী নিয়ম তা তাঁর অসীম জ্ঞান ও কুদরতের প্রমাণ। তাঁর ইচ্ছায় এ নিয়মের গতি ও পরিণতি। সুতরাং জীবন ও জগতে যা কিছু ঘটে তা সেই মহাজ্ঞানী মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। সুতরাং ছোট-বড় সকল ঘটনার বার্তা-আল্লাহকে স্মরণ করা এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করা।

কিন্তু যুগযুগ ধরে মানুষ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। কুরআন মাজীদে খুব পরিষ্কারভাবে এ দুই শ্রেণীর মানুষের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের কর্তব্য, কুরআনের আয়নায় নিজেদের দেখে নেওয়া।

এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা) যারা আমার সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না এবং পার্থিব জীবনেই সন্তুষ্ট এবং এতেই পরিতৃপ্ত থাকে এবং যারা আমার নিদর্শনাবলী সম্বন্ধে গাফিল, ওদেরই আবাস অগ্নি, ওদের কৃতকর্মের কারণে। যারা মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ, তাদের রব তাদের ঈমান হেতু তাদের পথনির্দেশ করবেন; তাদের (বাসস্থানের ) পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে। -সূরাইউনুস ১০ : ৭-৯

তো যারা আখিরাতে বিশ্বাসী নয়, আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা ও ভয় যাদের অন্তরে নেই, যারা পার্থিব জীবনেই তুষ্ট ও নিমগ্ন এদের স্বভাব, আল্লাহ তাআলার কুদরতের বিভিন্ন নিদর্শন সম্পর্কে উদাসীন থাকা। অর্থাৎ তা থেকে  যে শিক্ষাগ্রহণ কাম্য ছিল তা না করা।

কুরআন মাজীদের আরো ইরশাদ- (তরজমা) আর আমি তোমার পূর্বেকার জাতিসমূহের কাছে অনেক রাসূল পাঠিয়েছি, (কিন্তু নবীগণকে অমান্য করার কারণে) আমি তাদের প্রতি ক্ষুধা, দারিদ্র্য রোগ-ব্যাধি চাপিয়ে দিয়েছি, যেন তারা নম্রতা প্রকাশ করে আমার সামনে নতি স্বীকার করে। সুতরাং তাদের প্রতি যখন আমার শাস্তি পৌঁছল, তখন তারা কেন নম্রতা ও বিনয় প্রকাশ করল না? বরং তাদের অন্তর আরও কঠিন হয়ে পড়ল, আর শয়তান তাদের কাজকে তাদের চোখের সামনে শোভাময় করে দেখাল।

অতঃপর তাদের যা কিছু উপদেশ ও নসীহত করা হয়েছিল তা যখন তারা ভুলে গেল তখন আমি তাদের জন্যে প্রতিটি বস্তুর দরজা উম্মুক্ত করে দিলাম, শেষ পর্যন্ত যখন তারা তাদেরকে দানকৃত বস্তু লাভ করে খুব আনন্দিত ও উল্লসিত হল, তখন হঠাৎ একদিন আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম, আর তারা সেই অবস্থায় নিরাশ হয়ে পড়ল। অতপর অত্যাচারী সম্প্রদায়ের মূল শিকড় কেটে ফেলা হল। ... -সূরা আনআম ৭ : ৪২-৪৫

আল্লাহর পক্ষ হতে ছোট-ছোট বিপদাপদরূপে কিছু শাস্তি যখন আসে তখন আল্লাহর কথা স্মরণ হওয়া, অন্তরে তাঁর ভয় জাগা এবং তাঁর দিকে ফিরে আসা কাম্য। তাহলে মৃত্যুর আগেই মানুষ তাঁর রবের পরিচয় পেয়ে যায় এবং আখিরাতের শাস্তি থেকে নাজাত পেয়ে যায়। পক্ষান্তরে ছোট-ছোট বিপদে মানুষ যদি সাবধান না হয়, এমনকি অন্যের উপর পতিত বড় বড় বিপদ বা প্রাণঘাতী বিপদেরও নানা সত্য-মিথ্যা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে আল্লাহকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে, তো এটা সেই কসওয়াতে কলব অন্তরের কাঠিন্য যা মানুষের জন্য অতি বড় বিপদ এবং আরো ভয়াবহ বিপদের ভমিকা। এই অবস্থার আরেক নাম আলআমনু মিন মাকরিল্লাহ- আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে নির্ভয় ও বেপরোয়া হওয়া। সূরা আরাফে ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা) আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে নির্ভয় তো হয় শুধু ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা।  (সূরা আরাফ ৭ : ৯৯) এর আাগের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলা কত স্পষ্টভাবে তাঁর বান্দাদের সাবধান করেছেন- (তরজমা) রাত্রিকালে যখন তারা ঘুমন্ত থাকে তখন আমার শাস্তি এসে তাদেরকে গ্রাস করে ফেলবে এটা হতে কি জনপদের অধিবাসীগণ নির্ভয় হয়ে পড়েছে? অথবা জনপদের লোকেরা কি এই ভয় রাখে না যে, আমার শাস্তি তাদের উপর তখন আপতিত হবে, যখন তারা পূর্বাহ্নে আমোদ-প্রমোদে রত থাকবে?

তারা কি আল্লাহর পাকড়াও  থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে? সর্বনাশগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেউই নিঃশঙ্ক (নিরাপদ) হতে পারে না। -সূরা আরাফ ৭ : ৯৭-৯৯

তো আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ও বেপরোয়া হওয়া কাফির কওমের স্বভাব, ইসলামে তা সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহসমূহের একটি।

বিখ্যাত মনীষী সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, সবচেয়ে বড় গোনাহ চারটি: আল্লাহর সাথে শরীক করা, আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে বেপরোয়া হওয়া, তাঁর ক্ষমা ও করুণা সম্পর্কে নিরাশ হওয়া, তাঁর দয়া ও দান সম্পর্কে আশাহীন হওয়া। -আল মুসান্নাফ, আব্দুর রাযযাক হাদীস ১৯৭০১; আল মুজামুল কাবীর, তবারানী হাদীস ৮৭৮৩, ৮৭৮৪, ১৯৭০১

পক্ষান্তরে আখিরাতমুখী জীবন ধারার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ঈমান ও আমলে সালেহ, আল্লাহর দিকে রুজু করা এবং আল্লাহর নিদর্শনসমূহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা । ইরশাদ হয়েছে - (তরজমা) তিনিই তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী দেখান এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য রিযক বর্ষণ করেন। উপদেশ তো শুধু সে-ই গ্রহণ করে যে আল্লাহ-অভিমুখী। -সূরা গাফির ৪০ : ১৩

সূরাতুর রাদ-এ ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা) তোমার রবের নিকট থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যে সত্য বলে জানে আর যে অন্ধ তারা কি সমান? উপদেশ তো গ্রহণ করে শুধু বুদ্ধিমানরাই, যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না। আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার আদেশ করেছেন তা অক্ষুণ্ন রাখে। আর ভয় করে আপন রবকে, ভয় করে কঠোর হিসাবকে...। -সূরা রাদ ১৩ : ১৯-২১

এ হচ্ছে আখিরাতমুখী জীবন ধারার অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য। এঁদের আল্লাহ সকল ক্ষেত্রে সঠিকভাবে পরিচালিত করেন। এঁরা সকল ঘটনায়, সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহকে স্মরণ করেন আর আল্লাহ বিস্মৃতির যত উপায় ও অনুষঙ্গ আছে সেগুলোকে গাফলত ও বিস্মৃতি বলে চিহ্নিত করতে পারেন।

মুমিনের কর্তব্য, ঈমানী বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া আর কুফরী স্বভাব সম্পর্কে সাবধান হওয়া এবং নিজের চিন্তা ও কর্মকে এর কলুষ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

 

 

advertisement