সংস্কৃতি : সম্ভ্রমের নৈবেদ্য
আবারো বর্বরোচিত নারী-নিগ্রহের ঘটনা ঘটলো। পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অঞ্চলে। দীর্ঘ সময় নিয়ে। দলবদ্ধ আয়োজনে। ভিড়ের মধ্যে। বর্ষবরণ উৎসবে যুক্ত হওয়া একেকজন নারীকে টার্গেট করে হেনস্থা করা হল। বিবস্ত্র করা হল। বর্তমান সময়ের ক্ষমতাদর্পী যুবকেরাই এসব করল। পুলিশের সামনে। ক্যামেরার সামনে। ধিক্কার ও চিৎকারের মধ্যে। তবে প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো শুরুতেই ঘটনাটি এড়িয়ে যেতে চাইল। বিকল্প গণমাধ্যমে প্রমাণসহ প্রতিবাদ আর শাহবাগী এক তরুণীর সংগঠনের ছেলেদের হৈচৈয়ে ১০/১২ ঘণ্টার মধ্যেই ঘটনাটি অবশ্য প্রকাশ্যে চলে এল।
পয়লা বৈশাখের ঘটনা তো। ইজ্জতে লেগে গেল একসঙ্গে কয়েকটি মহলের। ঘটনার ভয়াবহতা নিয়ে তারা চিন্তিত কম হল। বরং তার প্রকাশ ও বিচার নিয়েই তারা বেশি শংকিত হয়ে পড়ল। প্রথমত যারা বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে যে কোনো রকম শিরিকী ও নগ্নতামুখি সংস্কৃতির বিকাশের পক্ষে চিৎকারের দায়িত্ব পালন করে-তাদের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। এ ঘটনায় তাদের দুষ্ট সাংস্কৃতিক লক্ষ্য হুমকির মুখে পড়ে যাওয়ায় তারা ঘটনাটি পারলে ‘ডিলিট’ করে দিতে চাইল। পান থেকে চুন খসলে প্রতিবাদের ডংকা বাজানো যাদের স্বভাব, বিশেষত ইসলাম চর্চা ও পালনকারীদের বেলায়- এ ঘটনায় তারা অদ্ভুৎ রকম ‘কৃচ্ছতাবাদী’ ও ‘উচ্চবাচ্যহীন’ বৈরাগীতে পরিণত হল। এর মধ্যে রয়েছে প্রভাবশালী পথভ্রষ্ট গণমাধ্যম। রয়েছে চিৎকারবাদী নারী ও মানবাধিকারবাদী সংগঠন এবং রয়েছে পক্ককেশী অথবা সটাক সুশীলদের কিছু মঞ্চ। তাদের স্বতঃস্ফ‚র্ত দৃষ্টিভঙ্গি, এটি নিয়ে কথা বললে তো পয়লা বৈশাখের সাংস্কৃতিক ইজ্জতের তলা ফুটো হয়ে যাবে। সুতরাং চুপচাপ থাকাই শ্রেয়। বর্ষবরণের মহান পূজোময় সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় দু-চারশ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে কী বা আসে যায়। সুরসুরির সংস্কৃতির বেদিতে সম্ভ্রমের নৈবেদ্য তো কিছু দিতেই হবে।
দ্বিতীয় মুখে কুলুপ আাঁটা বলয়টি হচ্ছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক। আহা! যেসব সোনার ছেলে এসব ফ‚র্তিফার্তা করেছে, তাদের সে কাণ্ড কীর্তি কী ফাঁস করা যায়। তারা তো পশ্চাৎপদ ধর্মপালনকারী সমাজের কেউ নয়। তারা হচ্ছে প্রগতি ও ক্ষমতার সঙ্গী। মহান বাঙ্গালী সংস্কৃতি আর বন্দিত মুক্তচিন্তার অনুরাগী। তারা না হয় কিছু মেয়েকে বিবস্ত্র করেছেই। সেটা প্রকাশ করা আর তাদের বিপদে ফেলার চেষ্টা কেন? এভাবে বিরুদ্ধবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে সুবিধা দেয়া একদম ঠিক নয়। এ বলয়ে রয়েছেন দলবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনাধারী এক শ্রেণীর মহান শিক্ষকমণ্ডলী। ‘স্বাধীনতার পক্ষের তরুণদের’ বিব্রত না করার ব্রত নিয়েই তারা নীরবতার কৌশল গ্রহণ করলেন। পুলিশের এক কর্মকর্তা বললেন, বস্ত্রহরণের কোনো ঘটনা সেদিন ঘটেনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নাকি কোনো অভিযোগ এখনো পাননি।
মুখ অন্ধকার করা তৃতীয় বলয়টির কাণ্ডকারখানা প্রকাশ হতে শুরু করল ঘটনার দু’দিন পর থেকে। প্রভাবশালী সততাভ্রষ্ট সংবাদপত্রটিতে হঠাৎ বলা হল, ঘটনাস্থলের সিসি টিভির ফুটেজে কিছু দাড়িওয়ালা তরুণের চেহারা বার বার ভেসে উঠেছে। এভাবে ক্ষমতাদর্পী ‘ধর্ষণসেঞ্চুরিদের’ থেকে ঘটনায় সম্পৃক্ততার তীর ‘ধার্মিক মহলের’ দিকে ঘুরানোর একটা কসরত শুরু হল। এই কসরতে এরপর মতাদর্শিক হিংস্র একটি টিভি চ্যানেল এবং আরো কিছু অনলাইন সংবাদপত্র বাতাস সরবরাহের দায়িত্ব নিল। ওই ঘটনায় হেনস্থার শিকার ও হেনস্থাকারী উভয় পক্ষই ছিল বর্ষবরণে নিমজ্জিত। এ সংস্কৃতির কোনো অংশের সঙ্গেই ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এসব গণমাধ্যম হঠাৎ করেই ইসলামের বিধান-পর্দার বিরুদ্ধে উঁচু গলায় কথাবলা শুরু করল। তাদের ভাবসাব এমন, যেন পর্দার পক্ষের লোকেরা টিএসসিতে গিয়ে এসব কাণ্ড করে এসেছে। একটি জাতির গণমাধ্যমের বিভ্রান্ত ও ধর্ষিত চরিত্র এর চেয়ে নিচে আর কীভাবে নামতে পারে! এই তৃতীয় মহলের কাজ হয়ে গেল বিব্রতকর নীরবতা ভেঙ্গে ইনিয়ে বিনিয়ে ঘটনার দায় ইসলাম-অনুসারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া। গায়ের জোরে অব্যাহতভাবে এ জঘন্য কাজটি করতে তারা যেন পণ করেই বসল।
তারই একটি বড় আলামত দেখা গেল ঘটনার সাত দিন পর। জাতীয় মানবাধিকার (বক্তৃতা) কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের ঘুম ভাঙল। দোষী-নির্দোষ নির্ধারণ এবং বক্তব্যের ‘লাইন’ ঠিক করতেই তার সপ্তাহ পার হয়ে গেল। তিনি তার বক্তব্যে উদ্ভাবনী এক তথ্য দিলেন। বললেন, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে যারা সুবিধা নিতে চায়, যারা জনপরিসরে নারীর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না।... তারা মনে করে পয়লা বৈশাখ উদযাপন ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। যারা এই সর্বজনীন রূপকে পছন্দ করে না, তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’ (প্রথম আলো ২১ এপ্রিল ২০১৫--৭-এর পাতা।)
মানবাধিকারের এই ‘বক্তৃতাবিদকে’ নিয়ে বাজারে অনেক কথা চালু আছে। তার বিশ্বাস ও চরিত্র এবং নেশা ও পেশা নিয়ে রটনার তো অভাব নেই। সেসবের দিকে যাওয়া আমাদের কাজ নয়। কিন্তু আমরা জানতে তো চাইতে পারি, এ কী কথা তিনি বললেন? মতাদর্শিকভাবে চরম বিভ্রান্তির শিকার, একটি মহান ধর্মাচারের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, ধর্ম বিদ্বেষী মগজধারী এই মহান ব্যক্তি কি লোকজনের হাতে-পায়ে ধরেও ভারসাম্যপূর্ণ ও সত্যের কাছাকাছি একটি বক্তব্যের খসড়া তৈরি করাতে পারলেন না? তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে নারীর বস্ত্র হরণকারী ও মতলবী ধর্ষকদের প্রতি সহানুভূতিশীলের খাতায় নিজের নাম লেখালেন। ধর্মহীন মতাদর্শের জয়গান গাওয়ার জন্য তার ওই চেয়ার কি খুব ভালো জায়গা? অন্য দলবাজ-মতবাজরা যখন কিছুটা বিব্রত ও চুপচাপ তখন তিনিই ‘ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের’ দায়ী করে একটি উদ্ভাবনী বক্তব্য বাজারে ছেড়ে দিলেন। তার এসব কথায় গোটা জাতি কৌতুকের উপাদান পেল। কোনো লাভ হলো না তার। লাভ হলো না সমাজ ও মানবাধিকারের। পয়লা বৈশাখ হচ্ছে বছরের প্রথম দিন। ওই দিনে নগরীর একশ্রেণীর মানুষের সাংস্কৃতিক অধঃপতন ও ক্ষয়ের কারণে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে- এ সতর্ক সংকেত এবারের পয়লা বৈশাখ বড় রকমভাবে দিয়ে গেল। তা না হলে সত্য হচ্ছে, এ রকম ঘটনা এর আগেও প্রতি বছর শত শত ঘটেছে। গণমাধ্যমে কিছু এসেছে, কিছু আসেনি। এরপরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান আর কীভাবে আসবে! মা-বোন, স্ত্রী-কন্যার পোশাকখোলা সম্ভ্রমের উন্মুক্ত রক্তাক্ত হাট বসানোর পরও কি নগরবাসীর হুশ হবে না?