রজব ১৪৩৬   ||   মে ২০১৫

সন্তানদের কিসের উপর রেখে যাচ্ছি

আবূ আহমাদ

আদরের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে মা-বাবার চিন্তার অন্ত নেই। বর্তমান সমাজের দিকে তাকালেই বিষয়টি আমরা আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারি। পিতা-মাতার অর্থ, চিন্তা, মেধা ও শ্রম-এর বড় অংশ, বরং সিংহভাগ ব্যয় হয় সন্তানের ভবিষ্যত বিনির্মাণে। সন্তানের ভবিষ্যতের স্বার্থে মা-বাবা সবকিছু বিসর্জন দেন। এটাই স্বাভাবিক, এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু সন্তানের ভবিষ্যত-চিন্তার সবগুলো দিক নিয়ে কি আমি যথাযথ ভাবছি এবং সঠিক মাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছি?

সেদিন কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করছিলাম। সেখানে একটি আয়াত তিলাওয়াত করছিলাম, যেখানে পিতা তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করছেন এবং সন্তানদের নসীহত করছেন-

...إِذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ إِذْ قالَ لِبَنِيهِ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ بَعْدِي قالُوا نَعْبُدُ إِلهَكَ وَإِلهَ آبائِكَ إِبْراهِيمَ وَإِسْماعِيلَ وَإِسْحاقَ إِلهاً واحِداً وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ.

...যখন ইয়াকূবের মৃত্যুর সময় এসে গিয়েছিল; যখন সে তার পুত্রদের বলেছিল, আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা সকলে বলেছিল, আমরা সেই এক আল্লাহরই ইবাদত করব, যিনি আপনার মাবূদ এবং আপনার বাপ-দাদা ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকেরও মাবূদ। আমরা কেবল তাঁরই অনুগত। -সূরা বাকারা ২ : ১৩৩

আয়াতটি আমার অন্তরকে আলোড়িত করল; তাইতো! এটিই তো সন্তানের ভবিষ্যত-চিন্তার সবচেয়ে বড় দিক। একজন নবীর জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণের জন্য কত সুন্দর করে আল্লাহ তাআলা বিষয়টি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

সন্তানের ভবিষ্যতের কত দিক নিয়েই তো আমরা চিন্তা করি, পরিকল্পনা করি, এবং বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করি। আমি কি এ দিকটি নিয়ে যথাযথ চিন্তা ও পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি? মনে রাখা দরকার, সন্তান আমার হাতে আল্লাহর আমানত!

এ আয়াতটি নিয়ে ভাবতে ভাবতে এ বিষয়ে আরো কিছু আয়াত মনে পড়ল। আয়াতগুলোতে কত সুন্দর করে সন্তানের ভবিষ্যত-চিন্তার এ দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখিত আয়াতের আগের আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَوَصّى بِها إِبْراهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفى لَكُمُ الدِّينَ فَلا تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ.

ইবরাহীম তাঁর সন্তানদের একথারই অসিয়ত করলেন এবং ইয়াকুবও (তাঁর সন্তানদেরকে) যে, হে আমার পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দ্বীন মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমাদের মৃত্যু যেন মুসলিম অবস্থায়ই হয়। -সূরা বাকারা ২ : ১৩২

আজ চারিদিকে শয়তানের দোসররা আমাদের সন্তানদের মিল্লাতে ইবরাহীম থেকে-ইসলাম থেকে বঞ্চিত করার জন্য নানা ফাঁদ পেতে চলেছে। আলো নাম দিয়ে বিভিন্ন অন্ধকারের দিকে তাদের ঠেলে দিচ্ছে। সংস্কৃতির শিরোনামে তাদেরকে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত করছে। বাঙালী সংস্কৃতির নাম নিয়ে তাদের পৌত্তলিকতা ও পূজা-পার্বণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ঈমান হরণ করছে। আমরা কি তাদের জন্য এ পরিমাণ দ্বীনী ইলমের (জ্ঞানের) ব্যবস্থা করে যেতে পেরেছি, যার দ্বারা তারা ঈমানের উপর টিকে থাকতে পারে? আমরা কি তাদের সামনে আলো-আঁধার স্পষ্ট করে যেতে পারছি?

হাঁ, অবশ্যই প্রতিটি মা-বাবা বিষয়টি নিয়ে ভাবেন। এ আয়াতগুলো আমাদের শিক্ষা দেয় সে ভাবনার মাত্রা কেমন হবে। মৃত্যুর সময় সন্তানের ভবিষ্যতের যে দিকটি নিয়ে আল্লাহর নবী ইয়াকব আ. ভাবলেন, সন্তানের ভবিষ্যত-চিন্তায় আর দশটি বিষয়ের সাথে এটিকে সর্বাগ্রে ভাবতে হবে। তা নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে- এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন আল্লাহর নবী ইয়াকব আ. ও মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম আ. ।

দ্বীনী শিক্ষা বলতে আমরা অনেকে বুঝি, কুরআন তিলাওয়াত করতে পারা ও নামাযটা কোনোরকম পড়তে পারা। একটু চিন্তা করি, শুধু এতটুকু দ্বারা কি আমার সন্তান ইসলামের আলো গ্রহণে ও গোমরাহীর নানা অনুষঙ্গ থেকে বাঁচতে সক্ষম হবে?

সন্তান কাদের সাথে চলছে, কাদের পথে চলছে তা নিয়ে ভাবি এবং সন্তানকে নূহ আ.-এর মত দরদের সাথে সঠিক পথ দেখিয়ে যাই। নূহ আ. আপন সন্তানকে বলেছিলেন-

يَا بُنَيَّ ارْكَبْ مَعَنا وَلا تَكُنْ مَعَ الْكافِرِينَ.

হে বৎস! আমাদের সাথে কিশতীতে আরোহণ কর, কাফেরদের সাথে থেকো না। -সূরা হূদ ১১ : ৪২

আমাদের সন্তানগণও যেন ইসলামের কিশতীতে আরোহণ করে কুফরীর সয়লাব (প্লাবন) থেকে বাঁচতে পারে- আমরা তার জন্য ভাবনা-পরিকল্পনা করি।

আরেকটি আয়াতে সন্তানের প্রতি  লুকমান হাকীমের উপদেশবাণী বিবৃত হয়েছে-

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ.

এবং স্মরণ কর, যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশচ্ছলে বলেছিল, ওহে আমার বাছা! আল্লাহর সাথে র্শিক করো না। নিশ্চিত জেন, র্শিক চরম জুলুম (সবচেয়ে মারাত্মক অন্যায়)। -সূরা লুকমান ৩১ : ১৩

অনেক সময় আমরা পড়াশুনা ভালো হয়- মনে করে সন্তানকে খ্রিস্টানদের মিশন স্কুলে বা ক্যাথলিক স্কুলে বা এনজিও স্কুলে দিই। কিংবা হিন্দুদের কোনো স্কুলে দিই। আচ্ছা! শুধু পড়া-লেখা ভালো হওয়াই কি সন্তানের ভবিষ্যত বিনির্মাণের একমাত্র বিষয়? আদর্শ কি গৌণ বিষয়? আদর্শই তো শিক্ষা। আর সেসব স্কুলে কি পড়া- লেখার বাইরে আর কিছু হয় না?  (সেদিন আমার পরিচিত একজন বলছিল, সে এক শিশুকে পড়ায়। তার পাঠ্যবইয়ের একটি নাকি, ছোটদের রামায়ন। একটি মুসলিম শিশুর পাঠ্যবই?! ভাবতেই অবাক লাগল!!) আমরা ভাবি না, যারা আল্লাহর সাথে র্শিক করে, তাদের সংস্রবে সন্তানের মাঝে যদি র্শিকের বীজ রোপিত হয়, এর দায় কার ঘাড়ে আসবে। অথবা জেনে-শুনে আদর্শচ্যুত কোনো পরিবেশে যদি আমি সন্তানকে ছেড়ে দিই আর সে পথহারা হয়, কাল কিয়ামতের দিন কি সেজন্য সন্তান আমাকে দায়ী করবে না?

এক্ষেত্রে কুরআনুল কারীমের একটি আয়াত স্মরণ হয়-

...رَبَّنا أَرِنَا الَّذَيْنِ أَضَلاَّنا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ نَجْعَلْهُما تَحْتَ أَقْدامِنا لِيَكُونا مِنَ الْأَسْفَلِينَ.

 ...(বিপথগামীরা বলবে,) হে আমাদের রব! জিন ও মানুষের যারা আমাদের বিপথগামী করেছিল তাদেরকে আমাদের দেখিয়ে দাও। আমরা তাদেরকে আমাদের পায়ের নিচে রেখে এমনভাবে দলিত করব, যাতে তারা চরম লাঞ্ছিত হয়। -সূরা হা-মীম সাজদা ৪১ : ২৯

আমি যদি আমার সন্তানের গোমরাহীর কারণ হই তখন!

পক্ষান্তরে সন্তানকে যদি সঠিক পথে পরিচালিত করে যাই তাহলে সে জীবদ্দশায় অনুসরণ করবে-

إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ...

(পিতা-মাতার কোনোও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না এবং তাদের ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল -সূরা ইসরা ১৭ : ২৩)

আর মা-বাবার মৃত্যুর পর দুআ করে বলবে- رَبِّ ارْحَمْهُما كَما رَبَّيانِي صَغِيراً

(হে আমার রব! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন। -সূরা ইসরা ১৭ : ২৪)

সুতরাং আমরা আমাদের সন্তানদের সেভাবে গড়তে চেষ্টা করি, যাতে তাদের ভবিষ্যত (দুনিয়া-আখেরাত) নিম্নের আয়াতের মত হয়-

إِنَّ الَّذِينَ قالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلائِكَةُ أَلاَّ تَخافُوا وَلا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ  نَحْنُ أَوْلِياؤُكُمْ فِي الْحَياةِ الدُّنْيا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيها مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيها مَا تَدَّعُونَ  نُزُلاً مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ  وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً مِمَّنْ دَعا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صالِحاً وَقالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ.

যারা বলেছে, আমাদের রব আল্লাহ। তারপর তারা তাতে থাকে অবিচলিত, নিশ্চয়ই তাদের কাছে ফিরিশতা অবতীর্ণ হবে (এবং বলবে) যে, তোমরা কোনো ভয় করো না এবং কোনো কিছুর জন্য চিন্তিত হয়ো না, আর আনন্দিত হয়ে যাও সেই জান্নাতের জন্য, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেওয়া হত। আমরা পার্থিব জীবনেও তোমাদের সাথী ছিলাম, আখেরাতেও থাকব। জান্নাতে তোমাদের জন্য আছে এমন সবকিছুই, যা তোমাদের অন্তর চাবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আছে এমন সবকিছুই যার ফরমায়েশ তোমরা করবে। এসব সেই সত্তার পক্ষ হতে প্রাথমিক আতিথেয়তা, যিনি অতি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।

তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি মুসলিমদের একজন। -সূরা হা-মীম সাজদা ৪১ : ৩০-৩৩

সন্তানের বিষয়ে আল্লাহর মনোনীত বান্দা-নবীগণের চিন্তা আমাদের জন্য আদর্শ। সে আলোকে যেন আমরা নিজেদের সন্তানের বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে পারি সে উদ্দেশ্যেই এ লেখার অবতারণা।

                                                                

 

 

 

advertisement