রজব ১৪৩৬   ||   মে ২০১৫

সংবাদ-মাধ্যমের রূপরেখা : ইসলামী কাঠামো

খালিদ বেগ

 কয়েকবছর আগের কথা, ভারতের একজন খ্যাতিমান ইসলামী পণ্ডিত ও লেখকের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য টাইম ম্যাগাজিন-এর একজন ভারতীয় রিপোর্টার আসলেন। সাক্ষাৎকারের মূল বিষয় ছিল, ইসলামে নারীর মর্যাদা। সচরাচর যেসব কথা জানতে চাওয়া হয়, রিপোর্টার ভদ্রমহিলা সেইসব প্রশ্নই উত্থাপন করলেন এবং মাওলানার প্রতিটি বক্তব্য রেকর্ড করে নিলেন। কয়েকসপ্তাহ পর পূর্ববর্তী সাক্ষাৎকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার অছিলায় ভদ্রমহিলা আবার এলেন; এবং সেই একই প্রশ্ন অনেকটা বক্র ও বিকৃতভাবে মাওলানার কাছে তুলে ধরলেন। এটাই শেষ নয়, মহিলা আবারও আসলেন। মাওলানা এবার বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন, ব্যাপার কী? মহিলা কিছুটা গর্বের সঙ্গে বললেন, আমরা আসলে কোনোরূপ ভুল রাখতে চাই না। এই জবাবে মাওলানা এতবেশি মুগ্ধ ও অভিভূত হন যে, তিনি সত্যানুসন্ধানে নিখুঁত ও নিষ্পাপ পেশাদারিত্বের উদাহরণ হিসেবে এই ঘটনার কথা মুসলমানদের কাছে প্রায়ই বর্ণনা করতেন। অবশ্য, ইসলামে নারীর কী অবস্থান, এ সম্পর্কে লেখাটি যখন প্রকাশিত হল, দেখা গেল, ইসলামের বিরুদ্ধে নারী-বিষয়ক সকল অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অনেক শ্রম স্বীকার করে রিপোর্টার যে জবাবগুলি একজন মুসলিম পণ্ডিতের নিকট থেকে সংগ্রহ করেছিলেন, তার কোনো একটি কথাও লেখাটির মধ্যে নেই।

আসলে টাইম ম্যাগাজিনটি প্রপাগান্ডার সেই চিরাচরিত নীতিই অনুসরণ করেছে : প্রথমে সত্যগুলিকে পুরোপুরি জানো, তারপর যতটা সম্ভব ইচ্ছামত বিকৃত করো। ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে অদ্ভুত ও চিত্তাকর্ষক। বর্তমান বিশ্বে কতিপয় সফলতম সাময়িকীর অন্যতম হল টাইম ম্যাগাজিন। যদিও এই ম্যাগাজিন ইসলামবিরোধী প্রচার-প্রচারণা নিয়ে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে, কিন্তু এতদসত্ত্বেও সারা বিশ্বে, এমনকি মুসলিম দেশসমূহেও তাকে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। এখানে প্রকাশিত কোনো বিশেষ পরিচ্ছেদ অথবা নির্দিষ্ট প্রবন্ধ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে কখনো কখনো বিবাদ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু তারপরও তাদের কাছে এই ম্যাগাজিন সাংবাদিকতার সার্বিক আদর্শস্বরূপ।

প্রশ্ন না উঠে পারে না, আসলে কীভাবে কী চলছে?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমাদেরকে প্রবেশ করতে হবে শিল্পবিপ্লব-উদ্ভুত সমাজমানস ও সেইসমাজ থেকে সাংবাদিকতার বিবর্তনের মধ্যে। দুটি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলস্বরূপ আধুনিক সাংবাদিকতার শুরু ও বিকাশ : একটি হলো মুদ্রণব্যবস্থা এবং অপরটি টেলিগ্রাফ। এই দুইয়ের সম্মিলনে মুদ্রিত তথ্যসমূহ অসম্ভব দ্রুতগতিতে দূরে-দূরান্তরে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়ে উঠল। প্রথমটির সূত্রপাত জার্মানীতে এবং দ্বিতীয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। নেইল পোস্টম্যান তাঁর ÔAmusing ourselves to DeathÕ (১৯৮৫) বইটিতে বর্ণনা করেন, এটা মার্কিন অগ্রগতি ও উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত; যা সারা পৃথিবী থেকে প্রসঙ্গ-বিবর্জিত তথ্য আহরণ করে দৈনিকসংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যাকে অভাবনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেল এবং এটাই হয়ে উঠল প্রাত্যহিক সংবাদ `The news of the day'। পোস্টম্যান-এর যুক্তি, টেলিগ্রাফই অপ্রাসঙ্গিক ও অসত্য তথ্যকে এক ধরণের বৈধতা দান করল; অর্থাৎ এমন ধারণাকে প্রবল করে তুলল যে, তথ্যের যে মূল্যমান, তার সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বা সিদ্ধান্তের কোনো সংযোগ রক্ষার প্রয়োজন পড়ে না; তাকে শুধু অভিনবত্ব ও আগ্রহ ও কৌতহল সৃষ্টি করতে হবে

টেলিগ্রাফ এমন এক সমাজে বিকাশ লাভ করল, যেখানে তার ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণরূপে অবাধ; যাকে গালগল্প, অসার-কথাবার্তা, মিথ্যা-কলঙ্কলেপন, অপবাদ-পরনিন্দা ইত্যাদি নিয়ে কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি। বরং এই সব নিয়েই শোষণের এক বিশাল বাজার গড়ে উঠল। এক্ষেত্রে সমাজ যেরকম চেয়েছিল, টেলিগ্রাফ তাকেই সহজ করে তুলল। এই বাজার স্বাভাবিক নিয়মে প্রথম উদ্যোক্তারাই দখল করে তুললো; যাদের মধ্যে একজন ছিলেন জোসেফ পুলিৎজার। পুলিৎজার পুরস্কার আজ একজন সাংবাদিকের জন্য আমেরিকার সর্বাপেক্ষা সম্মানজনক স্বীকৃতি। এই পুলিৎজার দায়িত্বগ্রহণের পর New york worldÕ-এর প্রচারসংখ্যা মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১৫ হাজার থেকে আড়াইলাখে উন্নীত করেছিলেন, যা ছিল তৎকালীন বিশ্বে সর্বোচ্চ।

কিন্তু কীভাবে তার পক্ষে এটা সম্ভব হল? ব্রিটানিকা বলছে,চমক সৃষ্টি এবং ধারাবাহিক উদ্দেশ্যমূলক অভিযানকে অবলম্বন করে পুলিৎজার আবেগ ও আদর্শের সমন্বয়ে এতদিনের প্রতিষ্ঠিত রীতি ও নিয়মে নতুন প্রাণশক্তি জাগিয়ে দিলেন। এক্ষেত্রে অন্য একজন সফল পথিকৃৎ উইলিয়াম হার্স্ট। ব্রিটানিকার মতে,তিনি যে কোনো মূল্যে প্রচারসংখ্যা বাড়িয়ে তুলতে ছিলেন সংকল্পবদ্ধ, এমনকি এজন্য সংবাদের মোড়কে মিথ্যা ও জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করতেও তিনি দ্বিধা করতেন না।

পেনি প্রেস এবং ট্যাবলয়েডও বিস্ময়কর বাণিজ্যিক সাফল্যলাভের উদ্দেশ্যে একই নীতি ও কৌশল অবলম্বন করে। এবং এইভাবেই আধুনিক প্রচারযন্ত্রের বিকাশ সাধিত হয়, যেখানে উত্তেজনাকর আবেগপ্রবণতা এবং বিনোদনই মুখ্য হয়ে ওঠে; পক্ষান্তরে মানুষের উপযোগী কর্মপ্রবাহের জন্য যে সকল তথ্য আবশ্যক, সেই বিষয়টি মারাত্মকভাবে স্তিমিত হয়ে আসে। পোস্টম্যান লিখেছে, ... আমাদের অধিকাংশ প্রাত্যহিক সংবাদই জড় ও নিষ্ক্রিয় প্রকৃতির, সেখানে এমনসব তথ্যের সমাবেশ ঘটে যা শুধু অর্থহীন কথা সৃষ্টি করে, কিন্তু কোনোরূপ তাৎপর্যময় কর্মপ্রবাহের দিকে পরিচালিত করে না

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির একটি শক্তিশালী ভমিকা ও কার্যক্রম বিদ্যমান। অনেকটা যেন বিমানবালাদের (Airhostess) মত, মুসলিম দেশে দেশে যাদের আনাগোনার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই, কোনো প্রশ্নও ওঠে না। সংবাদপত্রও এইরকমই, যাকে তার অন্ধ ও আগ্রহী অনুসারীদের দ্বারা অভ্যর্থনা ও অভিনন্দন লাভ করতে কোনো প্রশ্নেরই সম্মুখীন হতে হয় না।

বৃটিশ-ভারতে সংবাদ সরবরাহের ক্ষেত্রে পেনি প্রেস-এর একটি প্রেরণাদায়ক ভমিকা ছিল। তখন সমগ্র মুসলিম বিশ্বে কোথাও না ছিল ছাপাখানা, না ছিল টেলিগ্রাফ-ব্যবস্থা (আর অন্য ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির তো কোনো কথাই ওঠে না)। কিন্তু সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে নাম ও দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিম থেকে ঠিকই গৃহীত হয়েছে। আরো বড় কথা, পশ্চিমাদের নিকট থেকে সংবাদ-এর সংজ্ঞাও (Definition) মুসলমান গ্রহণ করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, পাশ্চাত্যে সংবাদ-এর সংজ্ঞা বহুলাংশে অদ্ভত ও অভিনবত্বের সঙ্গে যুক্ত (মানুষ কুকুরকে কামড়ে দিয়েছে); আর যুক্ত ছিল কৌতহলের সঙ্গে (আজকে আমরা যা জানি, গতকাল তা জানতাম না)।

এই নিশ্চিত বক্তব্য যে কত সত্য, সেটা পরীক্ষা করার জন্য মুসলিম বিশ্বে প্রকাশিত অদ্যকার যে কোনো সংবাদপত্র এবং সংবাদ সাময়িকীর প্রতি শুধু একবার দৃষ্টিপাত করাই যথেষ্ট। অবশ্যই এটা সত্য যে, মাঝে মধ্যে আমরা কিছু ধর্মীয় প্রবন্ধ এবং কিছু রাজনৈতিক মতামতও দেখতে পাই; কিন্তু সেটা নিতান্তই আমাদের মুসলমানিত্বের শ্লাঘা রক্ষার্থে। কিন্তু আমাদের তো গভীরভাবে এই চিন্তা ও বিবেচনাও করা আবশ্যক যে, সাংবাদিকতার লক্ষ্য, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? এবং সাংবাদিকতার গঠন-কাঠামো কেমন হওয়া উচিত? নিশ্চয়ই এই প্রশ্নগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদ ও সাংবাদিকতা একটি প্রতিষ্ঠান সদৃশ; কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের অন্তর্বস্তু ও আত্মিক মান কী? এবং কী কারণে এই প্রতিষ্ঠান শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়? সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী? কোনো বিষয়ে ইসলামী পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এর অবস্থান কোথায়? লেখা ও লেখা ছাপানোর প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? সংবাদ যে সংবাদ, এটা কীভাবে নিরূপিত হয়? মুদ্রণের যোগ্য কি অযোগ্য এটাই বা কীভাবে নির্ধারিত হয়, এবং তার সঠিক মাপকাঠি কী? মুসলিম সমাজে একজন সাংবাদিকের প্রকৃত অধিকার ও দায়িত্ব কতখানি? সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায়? ইত্যাদি ইত্যাদি

৫০ বছরেরও অধিককাল পূর্বে মুফতী মুহাম্মাদ শফী (পাকিস্তানের মুফতি) আদাবুল-আখবার (The News Protocol) শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ইসলামী চিন্তা ও পঠনকাঠামো সম্পর্কে প্রবন্ধটি ছিল একটি বিরল ও মূল্যবান আলোচনায় সমৃদ্ধ। তৎকালীন সময়ে মুসলিম সাংবাদিকদের যে আবেগ ও সংবেদনশীলতা সে সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, এমন অনেকে আছেন যারা এটাকে (সাংবাদিকতা) হারাম বা নিষিদ্ধ বিবেচনা করেন; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের উচিত এই পেশার হালাল ও হারাম অর্থাৎ বৈধ-অবৈধ উভয় দিক নিয়েই উদ্বিগ্ন হওয়া

যারা এ বিষয়ে যথার্থই উদ্বিগ্ন, তারা এই শক্তিশালী পেশা সম্পর্কে মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর প্রবন্ধ থেকে উপযুক্ত পথনির্দেশনা লাভ করতে পারেন, যা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ইসলামী গঠন কাঠামো নির্মাণে সহায়ক হতে পারে। মুফতী মুহাম্মাদ শাফী রাহ. দুটি হাদীস উল্লেখ করেন, যা থেকে সাংবাদিকতায় ইসলামী রূপরেখার একটি ভিত্তি তৈরী করা সম্ভব। উদ্ধৃত প্রথমাংশটি  তিরমিযী শরীফ-এর একটি দীর্ঘ হাদীস থেকে গৃহীত, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম-এর প্রাত্যহিক কর্মসূচীর কথা বর্ণিত হয়েছে। একজন সাহাবী রা.-এর উক্তি থেকে বর্ণিত, আমি জানতে চাইলাম, গৃহের বাইরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম-এর ব্যবহার ও কার্যকলাপ কেমন ছিল? হিন্দ বিন হালা জবাবে বললেন, উপকারী ও প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া তিনি সর্বদা নীরবই থাকতেন। ...এবং তিনি তাঁর অনুসারী-সঙ্গীসাথীদের খোঁজখবর নিতেন। আর জনগণের মধ্যে কোথায় কী ঘটেছে, সে বিষয়েও জানতে চাইতেন। সবকিছু জানার পর কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, সে বিষয়ে মন্তব্য করতেন

দ্বিতীয় হাদীসটি হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম যখন কোনো সাহাবীকে পরপর তিনদিন দেখতে না পেতেন, তিনি তাঁর সম্পর্কে খবর নিতেন। সেই সাহাবী যদি দূরবর্তী কোনো সফরে থাকতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম তার জন্য দুআ করতেন; আর যদি শহরেই থাকতেন, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম তাঁকে দেখতে যেতেন। যদি দেখতেন যে, তিনি অসুস্থ তাহলে তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইতেন-কানযুল উম্মাল, হাদীস ১৮৪৮৩

এই দুটি হাদীসের আলোকে মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. বলেন, মুসলিম উম্মাহর অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত ওয়াকিফহাল থাকা সুন্নত। আজকের দিনে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের ওপর বিশেষভাবে এই দায়িত্ব এসে পড়েছে। অধিকন্তু সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের অভাব অভিযোগ তুলে ধরা, মুসলমানদের দাবি ও অধিকারসমূহ উত্থাপন করা এবং ইসলামের পয়গামকে জনসমক্ষে পৌঁছে দেয়াও সংবাদপত্রের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আসলে যে বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা আবশ্যক তা হল, শুধু পেশা নয়, সাংবাদিকতা একটি দায়িত্ব। আর এই দায়িত্বপালনে নির্যাতিতের জন্য ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করা, দুর্বল ও দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য করা, এবং পীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো একজন সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এসব কোনো কিছুই যদি করা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত বিপদাপন্ন মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা উচিত। এ থেকে বোঝা যায়, সংবাদ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মের মধ্যে একটি নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ আনুপাতিক সমন্বয় বিদ্যমান থাকা জরুরি ও সমীচীন। অথচ বর্তমান যে প্রচারজগৎ, সেখানে প্রচার ও কর্মের সম্পর্ক একেবারে শূন্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। শুধু চমক ও চোখ ঝলসানো নব নব প্রযুক্তির কারণে এই কঠিন বিভেদ ও শূণ্যতার দিকে আমরা খুব কমই দৃষ্টিপাত করি। মুফতী মুহাম্মাদ শফী ইসলামের মৌলিক নীতির কথাও বর্ণনা করেছেন, যা সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট যেকোনো সমস্যা ও আলোচনার জন্য ফলপ্রসূ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে পারে : লিখিত বক্তব্যও মৌখিক কথাবার্তার মত একই নিয়মের অধীন। এবং সাধারণত মৌখিক বা লিখিত দুটি ক্ষেত্রেই একই নির্দেশ, সে সাংবাদিকই হোক আর যে-ই হোক। কোনো কিছু যদি পুণ্যকর্ম হয়, সেটা লিখিত বা মৌখিক উভয়ত, একইরকম পুণ্যকর্ম। আর যা হারাম বা নিষিদ্ধ তা সর্বাবস্থায়ই নিষিদ্ধ। অবশ্য লিখিত বক্তব্য যেহেতু অধিকতর স্থায়ী এবং তার বিস্তৃতির মাত্রাও অধিক, অতএব তার ভালোমন্দের স্থায়িত্ব এবং বিস্তৃতিও বাস্তবক্ষেত্রে অধিক। অর্থাৎ ভাল হলে খুবই ভালো। আর নিকৃষ্ট হলে খুবই নিকৃষ্ট। আর এক্ষেত্রে পুরস্কার ও শাস্তির মাত্রাও আনুপাতিকভাবে অধিক।

স্বাভাবিক নীতি ও আচরণ, যা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সেখানে সাংবাদিকদের জন্য ইসলামী শরীআহ কিছুটা শৈথিল্য বা অব্যাহতির অবকাশ রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, সাধারণভাবে কারো অসাক্ষাতে নিন্দা সবার জন্যই সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ; কিন্তু সাংবাদিকরা এ-ক্ষেত্রে কিয়ৎপরিমাণে মুক্ত। কতটা এবং কীভাবে মুক্ত সে কথায় পরে আসছি। কারণ সর্বাগ্রে আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, সকল মুসলমানের বাক্যালাপ ও কথাবার্তা কী নিয়মে নিয়ন্ত্রিত, সে বিষয়ে ইসলামী শরীয়াহ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কাউকে উপহাস বা বিদ্রƒপ করা আল কুরআনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে:

হে ঈমানদারগণ, তোমরা একে অপরকে উপহাস করো না। কারণ, হতে পারে দ্বিতীয় ব্যক্তি (যাকে উপহাস করা হচ্ছে) প্রথম ব্যক্তির তুলনায় উত্তম। কোনো নারী অন্য কোনো নারীকে বিদ্রƒপ করবে না; হতে পারে দ্বিতীয় জন প্রথম জন অপেক্ষা উত্তম। কারো দুর্নাম করো না এবং কাউকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা থেকে বিরত থাকবে; এবং একে অপরকে নিন্দা ও অবজ্ঞাসূচক নামে সম্বোধন করবে না। -সূরা আল হুজুরাত  ৪৯  : ১১

এটা সাধারণভাবে অনুসরণীয় আবশ্যকীয় নীতি; যা থেকে সংবাদপত্রের কোনো কলামিস্ট তার নিজস্ব কোনো গুণ বা দক্ষতা প্রদর্শনের অছিলায় নিজেকে মুক্ত ভাবতে পারে না। অধিকন্তু, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এমন একটি পবিত্র মানবাধিকার, যা কেউই লঙ্ঘন করতে পারে না, সাংবাদিক হলেও পারে না। আল্লাহর বিধান সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য; সে রাজপুত্রই হোক আর দুঃস্থ অনাথই হোক। কারণ আলকুরআন আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে : হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কারো গৃহে অনুমতি ছাড়া এবং সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যাতে করে তোমরা মনে রাখতে পারো। -সুরা আননূর  :২৭

একইভাবে কারো প্রতি মিথ্যা দোষারোপ একটি পাপ, যা সাধারণ মানুষের জন্য যেমন সত্য, লেখকদের জন্যও সত্য। আরেকটি কথা, অন্যের দোষ ও পাপকে আড়াল করা সবারই অবশ্যকর্তব্য। রিপোর্টার বা সংবাদপত্রের কোনো প্রতিবেদকের কাছে মুসলমান ভাইয়ের কোনো দোষ গোপন করার এই বিষয়টি আরো বেশি গুরত্বের সঙ্গে গৃহীত হওয়া আবশ্যক। কিন্তু আজ এই কথাটি বিশেষভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে; যদিও ইসলামী শরীআহ বিষয়টির প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। একটি হাদীস বলছে : হে সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা, তোমরা ঈমানের প্রতি মৌখিক স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছো, কিন্তু যাদের অন্তরে ঈমান এখনো প্রবেশ করেনি, তারা যেন কোনো মুসলমান ভাইয়ের পশ্চাতে নিন্দা করা থেকে বিরত থাকে, কারো দোষ অনুসন্ধান না করে। কারণ কেউ যদি  অন্যের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করবেন। আর আল্লাহ যদি কারো দোষ অনুসন্ধান করেন তাহলে তিনি (আল্লাহ) তাকে তার নিজ গৃহেই অসম্মানিত করবেন-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৩৬

এই একটি হাদীসই যথেষ্ট যা সমস্ত ট্যাবলয়েড-সাংবাদিকতার ভিত্তি ধুলিসাৎ করে দিচ্ছে। এখানে একটি মাত্র ব্যতিক্রম, এবং তা হল কোনো ব্যক্তির আপত্তিকর আচরণ যদি অন্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে; এই ধরণের ক্ষেত্রে অন্যদেরকে সতর্ক করা শুধু অনুমোদনযোগ্য নয় রীতিমত প্রয়োজনীয়।

আদাবুল আখবার-এ আরো কতিপয় দিকনির্দেশনা রয়েছে। মুসলিম-অমুসলিম যে-ই হোক কাউকে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা নিষিদ্ধ। আর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির এই অধিকার আছে যে, সে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য-জনসমক্ষে অভিযোগ তুলে ধরতে পারে। আল কুরআনও এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে অনুমোদন করেছে। বলা হচ্ছে : আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্যভাবে মন্দকথা বলা পছন্দ করেন না; তবে যে ব্যক্তির উপর অবিচার করা হয়েছে তার কথা আলাদা। আল্লাহ তাআলা ভালোভাবেই শোনেন ও জানেন। -সুরা আন নিসা ৪ : ১৪৮

অতএব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য-প্রতিবাদে কোনো বাধা নেই; এবং এটা যদি অত্যাচারিত ব্যক্তির জন্য সহায়ক হয়, তাহলে তা করা সংবাদপত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কোনো রিপোর্ট বা প্রতিবেদন যদি সত্যও হয়, তাহলেও তা প্রকাশ করা উচিত নয়, যদি তা সমাজ ও সামাজিক স্বার্থে আঘাত করে। এমন কোনো বস্তু বা কাজের বিজ্ঞাপন প্রচার করা ঠিক নয়, যা শরীআহর বিবেচনায় উক্ত বস্তু বা বিষয় নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। অপরাধ সংক্রান্ত রিপোর্ট, যা বর্তমান সংবাদপত্রের একটি সরস অংশ, মুফতী শফী রাহ. এ বিষয়ে অন্যত্র ঘোষণা করেন যে, এই ধরণের রিপোর্ট চলতি রীতিতে প্রকাশ করা আদৌ অনুমোদনযোগ্য নয়। কারণ অপরাধ কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা অপরাধ-প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। অপরাধ সংক্রান্ত রিপোর্ট বা প্রতিবেদন এমনভাবে প্রকাশিত হওয়া উচিত, যাতে সমাজ অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং অপরাধকর্ম দমিত ও নিরুৎসাহিত হয়।

সাংবাদিকতার জন্য একটি কার্যকর ইসলামী কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। মুসলমানদের প্রশ্নে টাইম (The time) এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিডিয়ার কার্যক্রমে যে নীতি অনুসৃত হয় তা হল প্রীতি ও বিদ্বেষ নীতি (Love-hate Relationship)। অর্থাৎ প্রয়োজনবোধে ভালোবাসা দেখাও কিন্তু ভেতরে ভেতরে পোষণ করো বিদ্বেষ। এ থেকে সম্যক অনুধাবন করা যায় আসলেই পশ্চিমা সাংবাদিকতার লক্ষ্য ও আদর্শের কী স্বরূপ! মুসলমানদের উপর যখন এই অনুচিত নীতি গর্হিতভাবে নেমে আসে তখন তারা শুধু যন্ত্রণাই অনুভব করে; কিন্তু জবাব দেবার মত তাদের তো নিজস্ব কোনো সাংবাদিকতার গঠন কাঠামো নেই, সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজস্ব নিয়ম রীতি ও মানদণ্ডও নেই। এ সব ক্ষেত্রে তারা একেবারে পুরোপুরি পশ্চিম থেকে ধার করা নীতি নিয়ম ও আদর্শের অনুগামী। অবশ্য তারা এটা সততই মর্মে মর্মে অনুভব করে যে, নিশ্চয়ই কোথাও কোনো গুরুতর ভুল হচ্ছে; কিন্তু ধার করা মানদণ্ড ব্যবহারের কারণে ভুলগুলি তারা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে না।

অতএব এমতাবস্থায় বর্তমান মুসলিম উম্মাহর যে বহুমুখী সমস্যা তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে সাংবাদিকতা। উল্লেখ করা আবশ্যক, এই সমস্যার সমাধানকল্পে প্রয়োজন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং পেশাজীবী সাংবাদিকদের মিলিত প্রচেষ্টা। আশা করা যায়, যারা ইসলামের প্রতি অকুণ্ঠ সেই সব উলামা এবং সাংবাদিক নিয়ে ইসলামী সাংবাদিকতার একটা ফলপ্রসূ ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং এইভাবেই ইসলামী সাংবাদিকতার গঠন কাঠামো নির্মাণে পণ্ডিত ও পেশাজীবী সাংবাদিকদের মধ্যে ইতিবাচক মতবিনিময়ের কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হতে পারে। কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন মুসলমানরাও অনেক সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশ করবে সত্য কিন্তু যাকে বলে ইসলামী মিডিয়া, সেটা আর হবে না। এবং এতে শুধু মুসলিম উম্মাহ নয় পুরো পৃথিবীকেই বিরাট ক্ষতি ও অনিষ্টের গুরুভার বহন করে যেতে হবে। 

ইংরেজি থেকে অনুবাদ :  অধ্যাপক আবু জাফর

 

 

 

advertisement