জীবন সম্পর্কে
জীবন আল্লাহর দান। তিনিই এর স্রষ্টা, তিনিই এর মালিক। আর প্রত্যেকের জীবনসীমা তাঁরই পক্ষ থেকে নির্ধারিত। কারো জীবন ফুরিয়ে যায় তাড়াতাড়ি, কারো দেরিতে।
তবে সবার আশা, জীবন যতদিনেরই হোক, সুখের হোক, দুঃখের না হোক। আর এ লক্ষে কারো চেষ্টারও কোনো কমতি নেই। কিন্তু পার্থিব জীবনের প্রকৃতি এই যে, এ জীবন সর্বদা অনুকূল হয় না। মাঝেমধ্যে প্রতিকূলে বয়ে চলে। সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সুস্থতা-অসুস্থতা, স্বচ্ছলতা-অস্বচ্ছলতার মধ্য দিয়েই জীবনের গতিপ্রবাহ। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াকে এভাবেই বানিয়েছেন। এখানে এ-ই তাঁর নিয়ম। জনৈক কবি জীবনের যথার্থ ছবি এঁকেছেন, ‘মানুষ যা কামনা করে তার সবটাই সে পায় না / বাতাস জাহাজের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়।’
পরিস্থিতি অনুকূল হোক বা প্রতিকূল, জীবন বয়ে চলে বহতা নদীর মত। তার চলা কখনো বন্ধ হয় না। এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকে না। যদিও অনেক সময় মনে হয়, সুখের সময় বড় দ্রুত কেটে যায় আর দুঃখের সময় কাটতেই চায় না- এ সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার।
আল্লাহ-অবিশ্বাসীর জন্য এসব পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। কারণ সুখের সময় তার বিশ্বাস হয়, শান্তি তার অর্জিত। আর পার্থিব শান্তিই তার কাছে চ‚ড়ান্ত। তাই সে সুখে উল্লসিত হয়ে উঠে এবং একেই তার প্রাপ্য মনে করে। আর দুঃখে সে দিশাহারা হয়ে পড়ে এবং ভাবে তার প্রাপ্য তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
একমাত্র মুমিনেরই পক্ষে সম্ভব জীবনের নানামুখী পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন। কারণ তার বিশ্বাস সঠিক ও স্বচ্ছ। সে বিশ্বাস করে, চ‚ড়ান্ত শান্তির জায়গা জান্নাত। আল্লাহ তায়ালা তাতে এমন সব নেয়ামত রেখেছেন, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এমনকি কারো কল্পনায়ও আসেনি। দুনিয়াতেও তিনি বান্দাদের সুখেশান্তিতে রাখেন। এ কেবলই আল্লাহর দয়া, বান্দার প্রাপ্য না। বান্দা ইবাদত-বন্দেগীর যত উচ্চস্তরেই উপনীত হোক আল্লাহর কাছে তার কোনো পাওনা নেই, যা আল্লাহর তাকে অবশ্যই দিতে হবে। কারণ এই কর্ম আল্লাহর দেওয়া তাওফীকেরই ফল। সুতরাং বান্দার শান্তিলাভ আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া কিছু নয়। এজন্য হাদীস শরীফে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কাউকেই তার আমল জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে না। কেউ জিজ্ঞাসা করল, আপনিও না? বললেন, আমিও না, যদি না আল্লাহ তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে আবৃত করেন...। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৬৭৩)
এজন্য মুমিন অহংকার করে না। আল্লাহর শোকর করে। সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। আর বলে, ‘ইয়া আল্লাহ! সকালে যত নেয়ামত আমি পেয়েছি কিংবা পেয়েছে তোমার কোনো সৃষ্টি তা তোমারই দান। তোমার কোনো শরীক নেই। সুতরাং তোমারই হামদ, তোমারই শোকর।
ইয়া আল্লাহ! সন্ধ্যায় যত নেয়ামত আমি পেয়েছি কিংবা পেয়েছে তোমার কোনো সৃষ্টি তা তোমারই দান। তোমার কোনো অংশীদার নেই। সুতরাং তোমারই হামদ, তোমারই শোকর।
اللَّهُمَّ مَا أَصْبَحَ بِي مِنْ نِعْمَةٍ أو بأحد من خلقك , فَمِنْكَ وَحْدَكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ , فَلَكَ الْحَمْدُ , وَلَكَ الشُّكْرُ. اللَّهُمَّ مَا أمسى بِي مِنْ نِعْمَةٍ أو بأحد من خلقك , فَمِنْكَ وَحْدَكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ , فَلَكَ الْحَمْدُ , وَلَكَ الشُّكْرُ
আমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামত এত বিপুল, যা গণা সম্ভব না। আমরা দিনরাত তার নেয়ামতে ডুবে থাকি। সব নেয়ামত তো দূরের কথা একটি নেয়ামতেরও যথাযথ শোকর আদায় করা সম্ভব না। তাই বান্দার একান্ত কর্তব্য, বেশির চেয়ে বেশি শোকর আদায় করা। এর উপকার অনেক। সওয়াব অর্জিত হয়। নেয়ামত বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
এসব নেয়ামতের আসল শোকর হল বান্দা তার গোটা জীবন আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করে দিবে। তাঁর বিধানমতো জীবনযাপন করবে। প্রকাশ্যে-গোপনে সর্বাবস্থায় তাঁর অনুগত হবে। একই সাথে তার দিল ও যবান শোকরে পরিপূর্ণ থাকবে। এক্ষেত্রে উপরের দুআটি উত্তম সঙ্গী। হাদীস শরীফে এসেছে, যে সকালে এ দুআ পড়ে সে দিনের শোকর আদায় করল। আর যে সন্ধ্যায় পড়ে সে রাতের শোকর আদায় করল। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫০৭৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস : ৮৫৮; শুআবুল ঈমান, হাদীস : ৪০৫৯)
দুঃখকষ্টের আসল জায়গা জাহান্নাম। গোনাহের প্রকৃত শাস্তি সেখানেই। মুমিন গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। আল্লাহ গোনাহের শাস্তি কখনো দুনিয়াতেই আস্বাদন করান। কখনো পরীক্ষা করেন। আর তিনি সর্বদা বান্দার কল্যাণ চান। বিপদেও নিশ্চয় তার কোনো কল্যাণ রয়েছে। এতে তার গোনাহ মাফ হয় কিংবা মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তাই তার মন ব্যথিত হলেও, চোখ অশ্রুসিক্ত হলেও আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর কোনো অভিযোগ তোলে না। তাঁর রহমত থেকে নিরাশ হয় না। বরং বুদ্ধিগতভাবে তাতে সুষ্ট থাকে। সবরের পরিচয় দেয়। গোনাহের জন্য তাওবা-ইস্তিগফার করে। কর্মসংশোধনে দৃঢ়সংকল্প হয়। বিপদমুক্তি চায় এবং বৈধতার ভেতরে থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আর বলে, ‘আমরা সকলেই আল্লাহরই এবং আমাদেরকে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে’।
এ দুআ বিপদে ও বেদনায় অতি প্রাসঙ্গিক। এতে আছে সান্তনা। এতে আছে এ সত্যের স্মরণ ও স্বীকারোক্তি যে, আমরা আল্লাহরই মালিকানাধীন, তাই আমাদের ব্যাপারে তাঁর যেকোনো সিদ্ধান্তের অধিকার আছে। এবং সেটা অবশ্যই আমাদের কল্যাণার্থে হবে। কেননা কেউ আপন জিনিসের অকল্যাণ চায় না। তবে হ্যাঁ, এমন হতে পারে যে, তাৎক্ষণিকভাবে সেটা আমাদের বুঝে আসছে না। দ্বিতীয়ত, আমরা যখন তাঁর কাছে ফিরে যাব তিনি আমাদের এর উত্তম বিনিময় দান করবেন।
তাই মুসিবত-কালে এ দুআ অধিক পরিমাণে পড়া চাই এবং মন থেকে। এমন মুমিনদের সম্পর্কে কুরআন মাজীদের ইরশাদ, এরাই সে লোক যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বিশেষ করুণা ও দয়া রয়েছে এবং এরাই আছে হেদায়াতের উপর। (সূরা বাকারা ২ : ১৫৭)
হাদীস শরীফে এসেছে, যে-কেউ মুসিবতের শিকার হয় আর বলে-
إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ , اللَّهُمَّ أْجُرْنِي في مُصِيبَتِي , واخلف لِي خَيْرًا مِنْهَا
‘আমরা সকলেই আল্লাহরই এবং আমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। ইয়া আল্লাহ! তুমি আমাকে এতে সওয়াব দান কর এবং এর চেয়ে উত্তম প্রতিদান দাও, আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই এর সওয়াব দান করবেন এবং এর চেয়ে উত্তম প্রতিদান দেবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৯১৮)
এ হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত উম্মে সালামা রা. এর নিজের জীবনের ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। তার স্বামী হযরত আবু সালামা রা. মৃত্যুবরণ করলে তিনি খুব চিন্তিত হন। বললেন, আবু সালামার চেয়ে উত্তম মুসলিম আর কে আছে? তখন তিনি এ দুআ পড়েন। আল্লাহ তায়ালা তার দুআ কবুল করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী হওয়ার পরম সৌভাগ্য তার হয়েছে।
এভাবে মুমিনের জীবন পুরোটাই হয় তার জন্য কল্যাণকর। সর্বাবস্থায় তার সম্পর্ক থাকে আল্লাহর সাথে। শান্তিতে তো বটেই, অশান্তিতেও সে ‘শান্তি’ অনুভব করে। এজন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি মুমিনের ব্যাপারে বিস্মিত। মুমিনের সব ব্যাপার তার জন্য কল্যাণকর। এ মুমিনের বৈশিষ্ট্য। স্বচ্ছলতা দেখা দিলে সে শোকর করে, যা তার জন্য কল্যাণকর। অস্বচ্ছলতা দেখা দিলে সবরের পরিচয় দেয়, যা তার জন্য কল্যাণকর। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৮৯৩৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৯৯৯)
একারণে জীবনে যত মুসিবতই দেখা দিক, যত বড় সমস্যাই আসুক সে কখনো মৃত্যু-কামনা বা আত্মহত্যা করে না। দুঃখকষ্টের কারণে মৃত্যু-কামনা বা আত্মহত্যা করা বস্তুত আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। হ্যাঁ, পরিস্থিতি যদি এপর্যায়ে পৌঁছায় যে, আর ঈমান-আমল নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব না তাহলে এভাবে দুআ করা যেতে পারে-
اللَّهُمَّ أَحْيِنِي مَا كَانَتْ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِي , وَتَوَفَّنِي إِذَا كَانَتْ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِي
‘ইয়া আল্লাহ! যতদিন জীবিত থাকা আপনার জ্ঞানে আমার জন্য কল্যাণকর ততদিন আমাকে জীবিত রাখুন। আর যখন মৃত্যু আমার জন্য কল্যাণকর তখন আমাকে মৃত্যু দান করুন’।
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু-কামনা না করে। কেননা সে যদি নেককার হয়, হয়তো আরো কল্যাণ অর্জন করবে। আর যদি গোনাহগার হয়, হয়তো তওবা করার সুযোগ হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৬৭৩)
অন্য হাদীসে এসেছে, তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু-কামনা না করে। সময়ের আগে মৃত্যুকে না ডাকে। কেননা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমল বন্ধ হয়ে যায়। মুমিনের জীবন তো তার শুধু কল্যাণই বৃদ্ধি করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৬৮২)
আত্মহত্যা করা জীবনের উপর অবিচার। আখেরাতে এর শাস্তি কঠোর। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, যে পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামে চিরকাল পড়তে থাকবে। যে বিষপান করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামে চিরকাল বিষপান করতে থাকবে। আর যে লোহা দ্বারা আঘাত করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামে চিরকাল লোহা দ্বারা নিজ পেটে আঘাত করতে থাকবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৭৭৮)
হাসান (বসরী) রহ. বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী একলোকের ফোঁড়া উঠেছিল। প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলে লোকটি ত‚ণীর থেকে একটি তীর বের করে তাতে আঘাত করে। তখন অবিরাম রক্তক্ষরণে লোকটি মারা যায়। আল্লাহ বলেন, আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। হাসান বসরী রহ. মসজিদের দিকে ইশারা করে বলেন, আল্লাহর কসম, জুনদুব রা. আমাকে এই মসজিদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এই হাদীস বর্ণনা করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৩)