পয়লা বৈশাখ-প্রসঙ্গ : নিজেকে রক্ষা করুন,পাপ-তীর্থ বর্জন করুন
এবারের পয়লা বৈশাখে ঘটল দলবেঁধে নারী নির্যাতনের ঘটনা। মিডিয়ায় এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ হতে উষ্ণ-কোমল নানা প্রকারের প্রতিবাদও হচ্ছে। অর্থাৎ বিষয়টি যাদের উদ্বিগ্ন বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তাদের পক্ষ হতে গতানুগতিক উপায়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু অতীতের বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এসব প্রতিক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য সুফল প্রত্যাশা করা অতি বড় আশাবাদীর পক্ষেও কঠিন। কারণ, এক. যাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া তাদের ‘সামাজিক’ ও রাজনৈতিক অবস্থান। এ প্রসঙ্গে বেশি কিছু না বলাই সব দিক থেকে নিরাপদ। দুই. প্রতিক্রিয়া প্রকাশকারীদের চিন্তা-ধারার অস্বচ্ছতা। তাদের অধিকাংশই শুধু ঘটনাটির একটি চরিত্র সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। নতুবা নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও আদান-প্রদান তাদের কাছেও দোষের কিছু নয়।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এই যে,পয়লা বৈশাখ বা থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপনের মাহাত্ম্য আসলে কী? এ কি পূতপবিত্র কোনো অনুষ্ঠান? যে উপায়েই এর মহিমা কীর্তন করা হোক এ যে পাপাচার ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার এক বড় উপলক্ষ- এতে তো লুকোছাপা কিছু নেই! হাঁ, এখন যারা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন তাদের উদ্বেগের কারণ, বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এর চরিত্র বদল। আগে যা ছিল দু পক্ষের সম্মতিতে বা বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকাশ্য, জোরপূর্বক ও সদলবলে। কারণ এই ধারার একটি শক্তিশালী ও প্রাগ্রসর অংশ এখন আর বখাটেপনার সাথে ভদ্রতার খোলস বহন করতে রাজি না। এটাও নিঃসন্দেহে ভয়াবহ, তবে অভাবনীয় নয়, এ তো এ ধারারই অনিবার্য পরিণতি। এক পর্ব থেকে অন্য পর্বে উত্তরণমাত্র। সুতরাং এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে কিছু খণ্ডিত ও পরম্পরাবিহীন প্রতিক্রিয়া মোটেই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন এই অভিশপ্ত ধারা গোড়া থেকে বন্ধ করা এবং যেখানে যেখানে এর বীজ ও জীবাণু আছে তা ডেটল-পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা। দেখুন, পাপের সব পথ খোলা রেখে শুধু তার বিবর্তন ও বংশবৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখার দর্শন যে এক অবাস্তব দর্শন- এইসব ঘটনা তার প্রমাণ।
কয়েক দশক ধরে এ দেশের তরুণ ও যুব শ্রেণীকে চরিত্রহীন করার যে নানামুখী আয়োজন, শিল্প-সংস্কৃতির নামে প্রবৃত্তিপরায়ণতার, বিনোদনের নামে অশ্লীলতা ও বল্গাহীনতার আর তথ্য-প্রযুক্তির নামে উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়ের হাতে নগ্নতার চাবিকাঠি সরবরাহের পরও সংযম-সুবুদ্ধির প্রত্যাশা এক অবাস্তব প্রত্যাশা নয় কি?
না,আমরা ঐ জ্ঞানপাপী সম্প্রদায়ের সাথে কথা বলছি না,যারা বুঝেশুনে একটি সুপরিকল্পিত ছকের মধ্য দিয়ে এ জাতির নতুন প্রজন্মের সর্বনাশ করে চলেছেন। আমরা কথা বলছি ঐ সব দরদী ও সত্যপ্রিয় মানুষের উদ্দেশে,যারা সত্যি সত্যি এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন এবং জাতির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত। তবে পশ্চিমা চিন্তাধারায় আচ্ছন্ন হওয়ার কারণে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে বিভ্রান্ত।
এখানে প্রথমেই দরকার চিন্তার স্বচ্ছতা। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, জাতির উন্নতি-অগ্রগতির জন্য নগ্নতা ও বল্গাহীনতার বিস্তার আসলেই প্রয়োজন কি না। যদি না হয়; বরং জাতির জন্য যদি তা হয় আত্মঘাতী তাহলে নৈতিক অধঃপতনের সবগুলো ছিদ্রপথ বন্ধ করা প্রয়োজন কি না। এরপরের প্রশ্নটি হচ্ছে, কীভাবে তা সম্ভব। আমাদের কাছে এমন কোনো উত্তরাধিকার আছে কি না যার শক্তি ব্যবহার করে আমরা এ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারি। আশার কথা এই যে, আমাদের আছে সেই উত্তরাধিকার।
এখানে জাতির প্রত্যেক শ্রেণীর আলাদা দায়িত্ব আছে। যারা ক্ষমতাশালী তাদের কর্তব্য, শক্তি ও ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার, তথা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোথাও যদি দুষ্টের লালনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তখন অনাচার-অবক্ষয় রোধ করার কোনো উপায় থাকে না। সমাজের যারা মস্তিষ্ক তাদের কর্তব্য, সত্যপ্রিয় ও সত্যনিষ্ঠ হওয়া, হীনম্মন্যতা ও পরানুকরণ প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে ওঠা। সমাজের যারা কণ্ঠ তাদের দায়িত্ব, সত্য-প্রচারে অকুণ্ঠ হওয়া। এই দুই শ্রেণী বা তাদের সিংহভাগ বিপথগামী বা মিথ্যাশ্রয়ী হলে সমাজে মিথ্যা ও বিপথগামিতার ধারা চালু হয়ে যায়। তখন সত্যের নামে মিথ্যা, ভালোর নামে মন্দ আর শিল্প-সংস্কৃতির নামে অনাচার-অশ্লীলতার বিস্তার ঘটে। ব্যক্তি বা পরিবারের যারা অভিভাবক তাদের কর্তব্য, অভিভাবকত্বের যোগ্যতা অর্জন করা এবং নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া। বাবা-মা, স্বামী-শিক্ষক নিজেরাই যদি সঠিক চিন্তার অধিকারী না হন তাহলে কীভাবে তারা সংশ্লিষ্টদের সঠিক পথে পরিচালিত করবেন? সবশেষে ব্যক্তির কর্তব্য, নিজের প্রতি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া। নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা নির্বুদ্ধিতা নয় কি? যে কাজ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যে সম্পর্ক চারিত্রিক পবিত্রতা বিনষ্ট করে কিংবা যে উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ অবক্ষয় ও লাঞ্ছনার শিকার করে তা থেকে দূরে থাকা নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন।
আর এই লাভ-ক্ষতি শুধু পার্থিব ক্ষণস্থায়ী জীবনের হিসাবেই বিবেচ্য নয়, আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের হিসাবেও বিবেচ্য; বরং সেই বিবেচনাই মুমিনের কাছে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। নিজের দেহ-প্রাণ, জীবন-যৌবন নিয়ে স্বেচ্ছাচারের সুযোগ নেই। এ জীবন অমূল্য, এ যৌবন মহামূল্য। এ পৃথিবীতে একবারই তা কাউকে দেওয়া হয়। সুতরাং একে ভুল পথে ভুলভাবে ব্যবহার নিজের প্রতি চরম অবিচার, যে জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। তেমনি যারা অন্যের ইজ্জত-আব্রু বিনষ্ট করে, দুনিয়ার আদালতে কখনো কোনো কারণে তারা বেঁচে গেলেও যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহর আদালতে তাদের রেহাই নেই। ঐ আদালতের কাঠগড়ায় তাদেরও দাঁড়াতে হবে, যাদের ছিল কোনো না কোনো পর্যায়ের দায়িত্বশীলতা অথচ সে দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
এ অমোঘ সত্য ভুলে গেলে চলবে না যে, যা কিছুর আসা অবধারিত আপাতদৃষ্টে তা দূরে মনে হলেও আসলে তা দূরে নয়।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.