বড়দের মুখে বড়দের বেড়ে ওঠার কাহিনী : হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-১০
মনে মনে অহংবোধ ও তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. বলেন, যা পারি ভাল-মন্দ তাই বয়ান করি। পূর্বে চিন্তা করার ও কিতাব দেখার সুযোগ হয় না। যা কিছু বয়ান করি, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে অন্তরে জাগ্রত হয়। এতে একবার আমার মনে হল, ভাষাবিদদের মতো না হলেও আমার মধ্যে কিছ্টুা হলেও ওয়াজ করার ক্ষমতা আছে। এরপর একদিন যখন ওয়াজ করতে বসলাম, তখন কোনো কিছুই বলতে পারলাম না। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন বিষয়ই মাথায় আসছিল না। কুরআনে কারীমের আয়াত পড়ে তার তরজমা করলাম। এরপরও কিছুই মনে আসছিল না। সমার্থক শব্দ বাড়িয়ে আবার তরজমা করলাম, মনে করলাম এতে হয়তো জড়তা দূর হবে, আলোচনা গতি লাভ করবে। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হল না। শেষে চেষ্টা করলাম, পূর্বের কোনো বয়ানই পুনরায় করে দেই। অনেক বিষয়েই তো আগে বয়ান করেছি। অনেক বিষয়ে পড়া-শোনাও আছে। কিন্তু সে সময় এমন কোন বিষয়ও স্মরণ হল না। আমার মস্তিস্ক যেন তখন কোনো কাজই করছিল না। এরপর আমি বুঝতে পারলাম। এখন আমি বয়ান করতেই অক্ষম। তাই উপস্থিত লোকদেরকে সম্বোধন করে বললাম, “বন্ধুগণ! এখন আমার মস্তিষ্কে কোনো কিছুই আসছে না, আমি কি বয়ান করব? ব্যস! দুআ করুন।
সুতরাং দুআ করে বয়ান শেষ করে দিলাম। শুরু না করতেই শেষ। লজ্জাও হল, ওয়াজের জন্য মঞ্চ (চৌকি-বিছানা ইত্যাদি) প্রস্তুত করা হয়েছে, লোকেরা ওয়াজ শোনার আগ্রহ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু আমি কিছুই বয়ান করতে পারছিলাম না। লোকেরা আশ্চর্যবোধ করছিল। কারণ এমনটি পূর্বে কখনো হয়নি। কিন্তু আমি একটুও আশ্চর্যবোধ করছিলাম না। কারণ আমার জানা ছিল যে, আল্লাহ্ পাক এভাবে আমার অহংবোধের চিকিৎসা করছেন। এভাবে আল্লাহ্ পাক আমার ঐ অপচিন্তার জবাব দিচ্ছিলেন, যা এ ঘটনার পূর্বে আমার মনে কোনো কোনো সময় জাগ্রত হত, আর তা হল, “আমি বয়ান ভালই পারি“ আল্লাহ্ পাক আমাকে দেখিয়ে দিলেন, “যা কিছু করতে পার এ সবই আমার দেওয়া তাওফীকেই হয়। এছাড়া তোমার নিজস্ব কোনই যোগ্যতা নেই।”
সুতরাং আমি আমার এই (অহংবোধ তথা) কুচিন্তা থেকে তাওবা করলাম। পরে আর কখনো এ অবস্থা হয়নি।
(আশরাফুস সাওয়ানেহ, ১ম খণ্ড, ৬৫-৬৬ পৃষ্ঠা)
বিনিময়ও নয়, বিনিময়ের আকৃতিতে হাদিয়াও নয়
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. ওয়াজ করে কখনো কোনো প্রকার বিনিময় গ্রহণ করতেন না। এমনকি হাদিয়ার ক্ষেত্রেও যদি বিনিময়ের আকৃতি প্রকাশ পেত, তাহলে সে হাদিয়াও গ্রহণ করতেন না।
একবার কানপুরে নবাব সিদ্দীক হাসান খান ছাহেবের কন্যা সুফিয়া বেগম হযরত থানভী রাহ.-কে দিয়ে ওয়াজ করালেন। ওয়াজ শেষ হওয়ার পর বড় অংকের টাকা হযরতের খেদমতে পেশ করলেন। হযরত থানভী রাহ. গ্রহণ করতে পরিষ্কারভাবে অস্বীকৃতি জানালেন। তখন তিনি বললেন, “এটা বিনিময় নয়।” হযরত থানভী রাহ. বললেন, পদ্ধতিটাতো বিনিময়েরই মতো। উপস্থিত লোকেরা তো বিনিময়ই মনে করবে। পরবর্তিতে হাদিয়া দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে, কেউ আর ওয়াজ করানোর সাহস করবে না। এরপর সুফিয়া বেগম খানা খাওয়ার অনুরোধ করলে হযরত বললেন, আমার বাসায় পাঠিয়ে দিবেন। যাতে এতেও বিনিময়ের সন্দেহ না হয়। কারণ আমি এখন অন্য আরেকজনের মেহমান।
খানা বাসায় পাঠাতে বলাটাও কেবল এ ভদ্র মহিলার খাতিরেই ছিল। কারণ তাঁর ইখলাস সম্পর্কে হযরত রাহ. তাঁর পূর্বের আচরণেই অবগত হয়েছিলেন। (আশরাফুস সাওয়ানেহ ১ম খণ্ড ৬৪ পৃষ্ঠা)
ফরমায়েশী (অর্ডারী) ওয়াজ করতে পারি না
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. কখনো কারো নির্দেশিত বিষয়ে ওয়াজ করতেন না। ওয়াজ করার সময় আল্লাহ্ পাকের পক্ষ হতে যে বিষয় মনে আসত সেটাই বয়ান করতেন।
একবার এক লোক বলল, হযরত! ওয়াজে একটু ঢোল বাজানেওয়ালাদের খবর নিয়েন। হযরত থানভী রাহ. বললেন, “আমি কারো সমালোচনা করে কথা বলি না। এটা আমার অভ্যাস নয়। আমার যা বুঝে আসবে, তাই বয়ান করব।”
হযরত থানভী রাহ. আরো বলতেন, ওয়াজে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু উদ্দেশ্য হওয়া ঠিক নয়। ফরমায়েশী (অর্ডারী) বিষয় সাধারণত বিশেষ উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। ফলে ওয়াজের প্রতিক্রিয়াও খারাপই হয়ে থাকে। (আশরাফুল সাওয়ানেহ, ১ম খণ্ড, ৬৫ পৃষ্ঠা)
পাঠদান পদ্ধতি
হযরত থানভী রাহ.-এর পাঠদান পদ্ধতি এত সাজানো-গোছানো ও সহজ-সরল ছিল যে, কোনো ছাত্র একবার হযরতের নিকট কয়েকদিন সবক পড়লে অন্য কারো নিকট পড়ে আর তৃপ্তি পেত না। হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. এ সম্পর্কে নিজেই বলেন, “যে সময় আমি মাদরাসায় ছাত্রদেরকে পড়াতাম তখন পাঠদানের পূর্বে অনেক কষ্ট করে পুরো সবকটা নিজের মস্তিষ্কে বসিয়ে নিতাম। এভাবে আমার পাঠদান অত্যন্ত সাজানো-গোছানো ও ধারাবাহিক হত। ফলে কঠিন থেকে কঠিন বিষয়ও ছাত্রদের জন্য খুব সহজ হয়ে যেত। তারা খুব সহজেই তা হৃদয়ঙ্গম করে নিত। যদিও এভাবে সহজিকরণের জন্য আমাকে খুব কষ্ট করতে হত, কিন্তু কিতাবের কোনো বিষয় বুঝার জন্য ছাত্রদের সামান্যও বেগ পেতে হত না। আমি সব সময়ই অন্যের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে নিতাম। আমি সারা জীবন এভাবেই (কষ্ট করে) পড়িয়েছি।
হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. আরো বলেন,
“আমি পড়ানোর সময় প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোচনা করি না। কিতাব বুঝানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু করি। এ বিষয়ে আমি আমার অধীনস্থ শিক্ষকদেরকেও তাকীদ করে থাকি। বরং কোনো কোনো সময় সবকে গিয়ে আমি তাদের পড়ানোর পদ্ধতিও দেখাতাম।
ছাত্রদের প্রকৃত উপকার তো তখনই হবে, যখন তাদেরকে কিতাব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কারণ এভাবেই ছাত্রদের মধ্যে যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। আর যখন ছাত্রদের মধ্যে যোগ্যতা সৃষ্টি হবে, তখন এমনি এমনি বিভিন্ন সূত্র কথা ও রহস্যও বুঝে আসবে।” (আশরাফুস সাওয়ানেহ ১ম খণ্ড, ৫০ পৃষ্ঠা)