মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ.: কিছু শিক্ষণীয় ঘটনা
মুফতীয়ে আ‘যম হযরত মাওলানা মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ. (১৩১০ হি.-১৩৯৬ হি.) আড়াই বছর বয়সেই মা’কে হারান। মৃত্যুর সময় তাঁর পিতাকে অসিয়ত করেন ছেলেকে যেন দ্বীনী ইলম শেখানো হয় এবং আলেমেদ্বীন বানানো হয়। পিতা হযরতের মায়ের কথার প্রতি খুব গুরুত্ব দেন এবং তা পূর্ণরূপে পালন করেন। হযরত মুফতী ছাহেব বলেন, এজন্য আমার পিতা আমাকে দ্বীনী ইলম ছাড়া অন্য কিছু শেখাননি।
চার বছর চার মাস বয়সে তাঁর পড়ালেখার সূচনা হয়। নিয়মতান্ত্রিক মকতবের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, চাচা আহমদ আলী ছাহেব শিশুদের পড়াতেন এবং এ বিষয়ে খুব আগ্রহ রাখতেন। হযরত মুফতী ছাহেব তাঁর নিকট আলিফ বা পড়া শুরু করেন। কিছুদিন পর ফুফু মুহতারামা পেয়ারজান ছাহেবার নিকট পড়েন। তিনি কুরআন মাজীদসহ অন্যান্য দ্বীনী প্রাথমিক কিতাবাদী পড়াতে পারতেন। যেহেতু এসব কোনো নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি নয় তাই পিতা ও ঘরের অন্যান্য সদস্যগণ একজন নিয়মিত উস্তায নিয়োগের চিন্তা করলেন, যার কাছে হযরত মুফতী ছাহেব ও অন্যান্য শিশুরা পড়া-লেখা করবে। তারা খন্দকার হাসানুযযামান ছাহেবকে পড়ানোর দায়িত্ব দিলেন। হযরত মুফতী ছাহেব তার কাছে কিছুদিন পড়ে জনাব দারোগা হানীফ ছাহেবের কাছেও কিছুদিন পড়েন।
শৈশবে তাকওয়া ও পরহেযগারি
হযরত মুফতী ছাহেব স্বভাবজাত লাজুক ও দ্বীনী রুচিসম্পন্ন ছিলেন। শৈশব থেকেই দ্বীনের হুকুম-আহকাম লক্ষ করে খুব সতর্কতার সাথে চলতেন। তিনি যখন একেবারে ছোট, তাঁর নানী ছাহেবা তাঁকে কোলে নিয়ে অন্যান্য মহিলাদের কাছে গেলে তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। মুফতী ছাহেবের বড় চাচি স্বয়ং হযরতকে বলেন যে, তিনি যখন একেবারে ছোট তখন চাচি একদিন তাদের ঘরে আসলেন, ঘটনাক্রমে বে-খেয়ালে চাচির পিঠের কাপড় সরে গিয়েছিল। হযরত মুফতী ছাহেব তা দেখার সাথে সাথে অন্যদিকে ঘুরে গেলেন।
যেদিন হযরত মুফতী ছাহেব হাটহাজারী মাদরাসায় ‘রাহে নাজাত’ কিতাবে পর্দার হুকুম-আহকাম পড়েন সেদিন বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে পর্দা করা শুরু করলেন, এমনকি যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ জায়েয তাদের সাথেও। ঘরের লোকজন তাকে বুঝালেন, কিন্তু তিনি মানলেন না। অবশেষে উস্তাযগণ বুঝালে তিনি বুঝলেন।
হযরত মুফতী ছাহেব নিজেই বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমার শৈশবে ঘরে বা গ্রামে, সমাজে কিংবা মাদরাসায় কারো সাথে কোনোদিন ঝগড়া-বিবাদ হয়নি। আমি ছোটবেলা থেকেই সবার সাথে মিলে চলেছি। আলহামদুলিল্লাহ, (আমার জানামতে) পুরো জীবনে আমার দ্বারা কেউ কোনো কষ্ট পায়নি। জীবনভর কারো সাথে আমার পক্ষ থেকে কোনো অসদাচরণ প্রকাশ পায়নি।’
শেষ বয়সেও যখন মানুষজন দেখা-সাক্ষাতের জন্য ভিড় করত এবং অনেকে অসময়েও আসত, তাতে তাঁর বিশ্রাম ও পড়াশোনা-গবেষণায় বিঘ্ন ঘটতো, তাই শুভাকাক্সক্ষীদের কেউ কেউ সাক্ষাতের নিয়ম ও সময় নির্ধারিত করার আবেদন করলে হযরত বারবার বলতেন, আল্লাহর বান্দাগণ আমার কাছে বিভিন্ন প্রয়োজনে আসে, আমার খুব শরম হয় যে, আমি তাদেরকে ফিরিয়ে দিব এবং আমার কর্কশ উত্তর শুনে তারা কষ্ট পাবে। আমি জীবনভর কাউকে কষ্ট দেইনি। যখন আল্লাহর বান্দাগণ আমার কাছে আসে তখন আমি এ হাদীস সামনে রাখি-
‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকে, আল্লাহ তার সহযোগিতায় থাকেন।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯)
হযরত মুফতী ছাহেবের যখন জন্ম হয় তখনো বাংলাদেশের প্রাচীনতম মাদরাসা দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী অস্তিত্বে আসেনি। মুফতী ছাহেবের বয়স যখন নয় বছর তখন হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। সনটি ছিল ১৩১৯ হিজরী মোতাবেক ১৮৯৯ ঈসাব্দ। পরবর্তী বছরেই অর্থাৎ ১৩২০ হিজরীতেই হযরত মুফতী ছাহেব হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন।
ভর্তি হয়ে পুনরায় কুরআন মাজীদ ও উর্দুর প্রাথমিক কিতাবাদী পড়া শুরু করেন। প্রায় দশ বছর বাড়ি থেকে যাওয়া আসা করে পড়ালেখা করেন। এসময় তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি সাংসারিক কাজ করতেন। এমনকি অনেক সময় হাঁড়ি-পাতিলও মাজতেন। প্রতিদিন মাগরিবের পূর্বেই বাড়ী পৌঁছে যেতেন। মাগরিবের সাথে সাথে দস্তরখান থেকে ফারেগ হয়ে পড়তে বসতেন। ইশার সাথে সাথে শুয়ে পড়তেন। শেষ রাতে উঠে মুতালাআ করতেন। ফজরের পর থেকে ৮টা/৯টা পর্যন্ত মুতালাআ করে নাস্তা খেয়ে মাদরাসায় চলে যেতেন।
মুফতী ছাহেব নিজেই বলতেন, শৈশব থেকেই আমার দুনিয়া উপার্জন উদ্দেশ্য ছিল না। দ্বীন-ই উদ্দেশ্য ছিল। কাফিয়া ইত্যাদি যখন পড়া শুরু করি তখন ধীরে ধীরে আমার মাঝে কুতুববীনী এবং ইলমী শোগল-এর জযবা তৈরী হতে লাগল। আর আমি পূর্বের তুলনায় বেশী মেহনত করতে লাগলাম।’
‘কারীমা’ পড়ার সময় ফার্সিতে কবিতা তৈরি ও কিতাব রচনা
ফার্সীর অধিকাংশ কিতাব তিনি হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর নিকট পড়েন। হাবীবুল্লাহ ছাহেব রাহ. ফার্সি ভাষায় অনেক দক্ষ ও রুচিশীল ছিলেন। ছাত্রদের মাঝে ফনের যওক সৃষ্টি করে দেওয়া তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও কামাল ছিল। উস্তায যেমন শিষ্যও তেমন। যখন হযরত মুফতী ছাহেব তাঁর নিকট ‘কারীমা’ পড়েন তখন ‘কারীমার’ আদলে বিভিন্ন বিষয়ের শের রচনা করে একটি সমষ্টিও তৈরি করলেন। যার নাম দিয়েছেন ‘পান্দেফায়য’। পরবর্তীতে তিনি ফার্সিতে এতই পাণ্ডিত্য অর্জন করেন যে ফার্সিতে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কবিতার কিতাব রচনা করেন। যা তার প্রতিষ্ঠানে নেসাবভুক্ত হয় এবং উলামা-তলাবার জন্য যুগযুগ ধরে আলো দান করে চলেছে। শুধু ফার্সি নয় বরং উর্দু ও আরবীতেও তিনি সমান দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর সকল কিতাব এ তিন ভাষায়ই রচিত। তাঁর সকল চিঠিপত্র লেখা এ তিন ভাষায়ই ছিল। এ তিন ভাষায় তিনি এমন পারদর্শী ছিলেন, যেন এগুলোই তার মাতৃভাষা।
মানতেক পড়ার সময় মানতেক শাস্ত্রে কিতাব রচনা
মানতেক বিষয়ক কিতাব সুল্লামুল উলূম একটি দুর্বোধ্য ও সুপ্রসিদ্ধ কিতাব। এমনিতেই কিতাবটি কঠিন আর তার কিছু বাহাছ আরো কঠিন। তন্মধ্যে
عكس مستوي ও عكس نقيض এবং تناقض-এর বাহাছ। হযরত মুফতী ছাহেব যখন এ কিতাবটি পড়েন তখন ফার্সিতে এ বাহাছটির ব্যাখ্যায় একটি কিতাবও রচনা করে ফেলেন।
হেদায়া পড়াকালীন আরবীতে কিতাব রচনা
যে বছর হেদায়া আখেরাইন পড়েন ঐ বছর মাওলানা আবদুল হামীদ ছাহেব রাহ.-এর নির্দেশে কাসীদায়ে বানাত সুআদ (قصيدة بانت سعاد)-এর আরবীতে একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ তৈরি করেন যার নাম দিয়েছিলেন
الاقتصاد في شرح بانت سعاد
হযরত মাওলানা আবদুল হামীদ ছাহেব রাহ. হাটহাজারী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং তৎকালে তিনি সেখানের শিক্ষক। শিক্ষকতার সাথে সাথে তার দাওয়াতী কার্যক্রম ছিল বেশ শক্তিশালী। ঐ সময় ঐ এলাকা ছিল শিরক-বিদআত এবং রসম-রেওয়াযে ভরপুর। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পূর্বে তিনি চতুর্দিকে ওয়াজ নসীহত ও দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছিলেন। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরও তা পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। স্বয়ং হযরত মুফতী ছাহেব তার বিশেষ উস্তাযের কর্মতৎপরতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘তাবলীগ, ওয়ায-নসীহতের দায়িত্ব হযরত মাওলানা আবদুল হামীদ ছাহেবের যিম্মায় ছিল। তিনি সর্বদা আল্লাহর বান্দাদের হেদায়েত, সুন্নতের উজ্জীবন, বিদআতের মুলোৎপাটনের কাজে খুব মশগুল থাকতেন। অধিকাংশ সময়ে সফরে থাকতেন। বিদআতীদের সাথে মুনাযারা মুবাহাসা করতেন। মৃত সুন্নতগুলো জীবিত করতেন। বেদআত নির্মূল করতেন। এভাবে তিনি মুজাদ্দিদের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।
جزاه الله في الدارين خير الجزاء وأدخله جنته
মাওলানা আবদুল হামীদ ছাহেব একবার হাটহাজারী মাদরাসার পরিচয়, প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, রদ্দে বেদআত ও ইহইয়ায়ে সুন্নাতও এ যাবতীয় কিছু বিষয় নিয়ে একটি মযমূন তৈরি করতে বললেন। মুফতী ছাহেব বলেন, আমি সংক্ষিপ্তভাবে তথ্যসমৃদ্ধ একটি মযমূন তৈরি করি। তেমনিভাবে মাদরাসার শানে একটি কাসীদা রচনা করতে বললে আমি তাও করি। ঐ বছর বার্ষিক মাহফিলে সে মযমূন ও কাসীদা পাঠ করে তিনি সকলকে শোনান। আসাতেযায়ে কেরামও সকলে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা এবং উপস্থিত শ্রোতারা খুবই প্রভাবিত হলেন এবং বেশ উপভোগ করলেন। এ সময় শুধু মাহফিল সম্পর্কেও তিনি একটি কাসীদা পাঠ করেন।
আরেকবার মাইজভাণ্ডার ও তাদের বানোয়াট ও শরীয়ত-বিরোধী কর্মকাণ্ডের উপর বিস্তারিত এক কাসীদা তৈরি করেন, যা দেখে প্রবীণ পণ্ডিত কবিগণও বলতে বাধ্য হলেন যে, এ ধরনের কবিতা একজন অভিজ্ঞ উস্তাযই লিখতে পারেন, কোনো ছাত্রের দ্বারা সম্ভব নয়। বিবাহ বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানেও তিনি বিভিন্ন কবিতা রচনা করেছেন। হযরত মুফতী ছাহেবের রচিত কবিতার কিতাবগুলো দেখলে হতবুদ্ধি হয়ে যেতে হয় যে, একজন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ কীভাবে ফার্সি বা অন্য ভাষায় এমন সাবলীল ও অর্থপূর্ণ কবিতা রচনা করতে পারেন।
আরো বেশি অবাক করার বিষয় হল, হযরত মুফতী ছাহেব কবিতা বা কোনো মাযমূন; একবারেই লিখে ফেলতে পারতেন। এমন নয় যে প্রথমে লিখলেন পরে তা কাটছাট করে পুনরায় লিখতে হত। জীবনীকারগণের ভাষ্যমতে এটা হযরত মুফতী ছাহেবের ‘ইলমী কারামত’। দরসী কিতাবাদীর শে‘রসমূহ তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। লেখায় বা বক্তৃতায় সুযোগমতই তা অনায়াসে প্রয়োগ করতে পারতেন। এক্ষেত্রে উর্দু-ফার্সি-আরবী সমান ছিল। তবে রচনা অধিকাংশ সময় ফার্সিতেই করতেন এবং এমন সহজে রচনা করতেন যেন পর্দার ওপাশ থেকে তাঁকে কেউ তৈরি করে দিচ্ছে আর তিনি তা লিখছেন বা বলছেন। বিনা দ্বিধায় যে কোনো বিষয়ে উপস্থিত শে‘র রচনা করতে পারতেন।