ওলিদের আলোচনায় দিল তাজা হয় : হযরত মাওলানা এহসানুল হক সন্দ্বিপী
এ উপমহাদেশে তৎকালীন অন্যান্য ইসলামী শহরের মত ইলমে হাদীসের ব্যাপক চর্চা যদিও ছিল না বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু আসলে ইল মে হাদীসের চর্চা এ অঞ্চলে একেবারে কমও ছিল না। তবে একসঙ্গে ছয় কিতাবের দরস প্রদানের ধারা হয়ত সর্বপ্রথম হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ রাহ. -এর মাধ্যমে শুরু হয়েছে। আর পূর্ব বাংলায় তা শুরু হয়েছে হিজরী ১৩০০ শতাব্দীর শুরুর দিকে নোয়াখালী সন্দ্বিপের দুজন বুযুর্গ মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ ছাহেব ও হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ ছাহেব রাহ. -এর মাধ্যমে। তাঁরা দুজনেই ছিলেন বহু আলেমের জন্মভূমি সন্দ্বিপের বাসিন্দা। আবার দুজনই ছিলেন একই উস্তাযের শাগরিদ। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম ছাত্র মাহমুদ হাসান দেওবন্দী যিনি পরে শায়খুল হিন্দ নামে বিশ্বময় খ্যাতিলাভ করেন, তাঁরা দুজন এই শাইখুল হিন্দেরই অন্যতম কীর্তিমান ছাত্র ছিলেন।
১৯০১ ঈ. দারুল উলূম হাটহাজারীর সৃষ্টি হলে এখানে হাদীস পড়ানোর জন্য দেওবন্দ থেকে পাঠানো হয় হযরত সাঈদ আহমদ ছাহেবকে। তিনি মুফতীয়ে আ‘যম হযরত মুফতি ফয়যুল্লাহ রাহ.-এর প্রিয়তম উস্তায ও পীর ছিলেন। পরে যখন জিরি ইসলামিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠা হয় তখন সেখানে হাদীস পড়ানোর জন্য যাকে আনা হয় তিনি ছিলেন হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ ছাহেব। যিনি পটিয়া জমিরিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতি আযিযুল হক ছাহেবের প্রিয়তম উস্তায ছিলেন। পরে হযরত সাঈদ আহমদ ছাহেব সারিয়ার মুহাদ্দিস ছাহেব নামে এবং হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ ছাহেব জিরির মুহাদ্দিস ছাহেব নামে পরিচিতি লাভ করেন। এই জিরির মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ ছাহেবের ছাহেবযাদা হলেন হযরত মাওলানা এহসানুল হক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম।
জিরির মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরকে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। বাল্যকালে একবার আমার উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আবদুল বারী ছাহেবের (ফতেহপুরী হুযুর) সাথে মাজাহেরে উলূম মাদরাসা থেকে জিরি মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে গিয়েছিলাম। জোয়ারের সময় কর্ণফুলী নদীতে সাম্পানের ডুবুডুবু অবস্থা দেখে আমাদের উস্তায-শাগরিদের সে কী কান্না, তা মনে রাখার মত। কারণ আমরা দুজনই নদী এলাকার লোক নই। তাই জোয়ারের সময় ঢেউয়ের আঘাতে সাম্পানের উঠা-নামা দেখেই ভয়ে জড়সর হয়ে গিয়েছিলাম। হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরকে অযু করতে দেখেছি; এটাই শুধু আমার মনে আছে। সুন্দর চেহারা, সুন্দর সফেদ দাড়ি ও অবয়বে ফেরশতাতুল্য লোক ছিলেন তিনি।
হযরত মাওলানা এহসানুল হক ছাহেব বাবার সান্নিধ্যে থেকেই জিরি মাদরাসায় পড়া-লেখা করেছেন। মেশকাত পড়ার পর দেওবন্দে গিয়ে দাওরায়ে হাদীস পড়েন। দেওবন্দে হযরতের সবচেয়ে প্রিয় উস্তায ছিলেন শায়খুল আরব ওয়াল আযম আওলাদে রাসূল হযরত মাওলানা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.। হযরত মাওলানা এহসানুল হক ছাহেব ছাত্রজীবন থেকেই যুক্তিতে পারঙ্গম ছিলেন। হযরত বলেন, ‘জিরি মাদরাসায় থাকতে আমি মাঝে মাঝে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে পাহাড়ে অবস্থিত খ্রিস্টান মিশনারীদের গীর্জায় যেতাম এবং ইংরেজ প্রধান পাদ্রীর সাথে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করতাম। আমার এই গীর্জার যাতায়াত নিয়ে ছাত্ররা কেউ আব্বাজানকে অবহিত করলে আব্বাজান আমাকে ডেকে বললেন, কি এহসান, তুমি নাকি গীর্জায় যাতায়াত কর? আমি বললাম, আব্বা! আমি তাদের তৈরি কোনো খাবার খাই না, পাদ্রী সাহেব আমাকে একটি কলম দিয়েছেন, আমি তা গ্রহণ করেছি মাত্র। আমি তার সাথে ইসলামের যৌক্তিকতা নিয়ে কথাবার্তা বলি। আমার কথায় আব্বাজান আশ্বস্ত হয়ে আর কিছু বললেন না।
হযরত বলেন, ইংরেজ পাদ্রীকে বিভিন্নভাবে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আমি তো দেওবন্দ চলে গেছি। কিন্তু পরে শুনেছি, পাদ্রী সাহেবের ইসলামের সত্যতা বুঝে আসার কারণে তিনি নাকি মুসলমান হওয়ার জন্য আমাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিলেন। আমাকে না পেয়ে চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের মাননীয় খতীব আওলাদে রাসূল হযরত মাওলানা আবদুল কারীম মাদানী ছাহেবের হাতে মুসলমান হন। আলহামদুলিল্লাহ। তাঁর হেদায়েত মঞ্জুর ছিল বলে আল্লাহ পাক তাঁকে হেদায়েত নসীব করেছেন।
হযরতের ভাষণ-বক্তব্য যদিওবা সাধারণ সন্দীপী ভাষায়ই হয়ে থাকে, তবে অত্যন্ত যৌক্তিক ও জ্ঞান-গর্ভ বক্তব্য হয়। ঢাকার আরজাবাদ মাদরাসা থেকে হযরতের চলে যাওয়ার পর হযরতের অন্যতম মুরিদ ও ভক্ত জনাব আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ আমরা ভক্তরা ঢাকায় হযরতের একটি মাসিক এজতেমা করতাম টিকাটুলী মামুন প্লাজায়। একদিন হযরত বক্তব্যের মধ্যে বলেন, ‘আমি একটি অফিসে বসা ছিলাম, অফিসের মালিক বললেন, হযরত! ফ্যাক্স মেশিনে এইযে ফ্যাক্সের মাধ্যমে যে কথাগুলো লিখে পাঠিয়েছি তা মুহূর্তের মধ্যে আমেরিকায় পৌঁছে গেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, এক মুহূর্তের মধ্যে লেখাটা পৌঁছে গেল? কী আশ্চর্য ব্যাপার। মাঝ পথে ইরাক-ইরানের যুদ্ধ পর্যন্ত তার কোনো ক্ষতি করতে পারল না, কোনো তুফান-বাতাসও তা রোধ করতে পারল না। ঠিক যেভাবে লেখা ছিল হুবহু লেখাটাই পৌঁছে গেছে। কাটা-ছেঁড়া থাকলে তা সহই চলে গেছে। অবাক কাণ্ড? এখানে একটি আলোর মেশিন আছে ফ্যাক্স মেশিন, আর আমেরিকাতেও একটি আলোর মেশিন ফ্যাক্স মেশিন বসানো রয়েছে, এখানকার আলোর মেশিন থেকে সেখানকার আলোর মেশিনে ফ্যাক্সটা করা হয়েছে, তাই হুবহু লেখাটাই সেখানে পৌঁছে গেছে। এবার শুনুন! আল্লাহ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন বলছে,
الله نور السماوات والأرض
অর্থাৎ মহান আল্লাহ হচ্ছেন আসমান যমিনের আলো। আবার খোদ কুরআন সম্পর্কে বহু আয়াতে বলা হয়েছে
قد جاءكم من الله نور وكتاب مبين.
অর্থাৎ কুরআনে পাক আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো স্বরূপ। আবার নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ছিলেন হেদায়াত ও সকল কল্যাণের নূর। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আলো। আবার ফেরেশতারা আলোর তৈরি। তাহলে কী দাঁড়ালো? আল্লাহ থেকে কুরআনের আলো আলোর ফেরেশতার মাধ্যমে আলোর নবীর কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনটি আলোর সমন্বয়ে একটি আলো কুরআনকে পাঠানো হয়েছে, তাই এই কুরআনের একটি যের-যবরও কেউ নষ্ট করতে পারবে না। কেয়ামত পর্যন্ত তা যেভাবে পাঠানো হয়েছিল ঠিক অবয়বেই বহাল থাকবে। তা কোনো মহাশক্তিও নষ্ট করতে পারবে না।’
হযরতের এমন যৌক্তিক বক্তব্য শোনার পর আমি অবাক হয়ে মামুন ছাহেবের দিকে তাকালাম, তিনিও হাসিমুখে অবাক নেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হযরতের প্রায় সবগুলো বক্তব্যই এ ধরণের যৌক্তিকতায় ভরা। আমার হৃদয়ের ভাণ্ডার দুর্বল হওয়ার কারণে সব কথা মনে রাখতে পারিনি।
হযরত মাওলানা এহসানুল হক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম দেওবন্দ থেকে আসার পর পটিয়ার মুফতি ছাহেব হুযুর প্রিয়তম উস্তাযের এই ছাহেবযাদাকে পটিয়া মাদরাসায় উস্তায হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি সেখানে পারদর্শিতার সাথেই শিক্ষকতা করছিলেন এমন সময় হযরত থানভী রাহ.-এর অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা আতহার আলী ছাহেব রাহ. মুফতী ছাহেব হুযুরকে বলে-কয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামিয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে তাঁকে হাদীস পড়ানোর জন্য নিয়ে যান। তিনি সেখানে বহুদিন পর্যন্ত শায়খুল হাদীস হিসেবে শিক্ষকতা করেন। মাদরাসার একটি ঘর সুদী ব্যাংকের কাছে ভাড়া দেয়াকে কেন্দ্র করে হযরতের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় হযরত সেখান থেকে গিয়ে অন্য এক মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। স্বাধীনতার কিছু দিন পর হযরত মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী ছাহেব রাহ. হযরতকে শাইখুল হাদীস করে মিরপুর আরজাবাদ মাদরাসায় নিয়ে আসেন। এখানে ৭ বছর থাকার পর হযরত অসুস্থ হয়ে গেলে চিকিৎসা নেয়ার পর আবার ময়মনসিংহ জামিয়া গফুরিয়া মাদরাসায় শাইখুল হাদীস হিসেবে বরিত হন। সেখানে বেশ কয়েক বছর থাকার পর হযরত বার্ধক্যের কারণে চট্টগ্রাম শহরে চলে যান। সেখানে ফিরোজ শাহ কলোনীতে হযরত ভাড়া থাকেন, এমতাবস্থায় হযরতের অন্যতম প্রিয় শাগরিদ হযরত আল্লামা সুলতান যওক ছাহেব হুযুর সপ্তাহে এক-দু’দিন সময় দেওয়ার জন্য দারুল মাআরিফে বোখারী শরীফের দরস দেয়ার আবেদন করেন। হযরত তা কবুল করলেন। বর্তমানে হযরত বেশি বার্ধক্যের কারণে দারুল মাআরিফে আর যেতে পারেন না বলে বাসায়ই থাকেন। হযরতের জীবনের প্রায় চল্লিশটি বছর অতিবাহিত হয় ময়মনসিংহে। সেখানের এক আল্লাহর ওলি হযরতের কাছে তাঁর মেয়েকে বিয়ে দেন। সমগ্র ময়মনসিংহে হযরতের পরিচয় পীর ছাহেব হুযুর। হযরতের হাজার হাজার শাগরিদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজনের নাম হল। ১। হযরত আল্লামা সুলতান যওক নদভী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম। ২। পটিয়া মাদরাসার সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রাহ.। ৩। ঢাকা যাত্রাবাড়ি মাদরাসার মুহতামিম ও দাওয়াতুল হকের আমীর হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান ছাহেব। ৪। ময়মনসিংহ শহরের বড় মসজিদের খতীব ও শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল হক ছাহেব দা. বা.। ৫। বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়্যাহর সাবেক মহাসচিব ও কিশোরগঞ্জের সংসদ সদস্য শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আতাউর রহমান খান রাহ.। ৬। কিশোরগঞ্জ জামিয়া এমদাদিয়ার বর্তমান মুহতামিম হযরত মাওলানা আনোয়ার শাহ ছাহেব দা. বা.। ৭। জনাব মাওলানা ফরিদুদ্দীন মাসউদ ছাহেব দা. বা.।
হযরতের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় প্রায় ৫০ বছর পূর্বে পটিয়া জমিরিয়া মাদরাসায়। আমি তখন জামাতে হাশতমের ছাত্র। হযরত কিশোরগঞ্জ থেকে পটিয়ায় তাশরীফ এনেছিলেন। আমার পরিষ্কার মনে আছে, ছাত্রদের জমায়েত করে মসজিদে হযরতের বয়ান হয়েছিল। হযরতের পূর্ণ যৌবন সত্তে¡ও হাতে একটি সুন্দর লাঠি ছিল। জিরির মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের ছাহেবযাদা হওয়ার সুবাদে আমার খুব ভক্তি হয়েছিল। ছোট মানুষ বলে হযরতের সেই বয়ানের কিছুই আজ মনে নেই। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয় হযরত হাফেজ্জী হুযুরের মাদরাসা নূরিয়া মাদরাসায়। মসজিদের দোতলার সিঁড়ির নিচে ভাই মাওলানা হামিদুল্লাহ ছাহেবের হুজরায়। সম্ভবত ১৯৮২ সন হবে তখন। হযরত হাফেজ্জী হুযুরের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য হযরত তখন সেখানে তাশরীফ নিয়েছিলেন। আমি তখনো পূর্বের ভক্তির কারণে হযরতের সাথে মোলাকাত করেছি এবং বরকতের জন্য আমার কামরায়ও নিয়েছিলাম। হযরতের শাগরিদ, মাদরাসার মুহাদ্দিস, হাফেজ্জী হুযুরের খলিফা হযরত মাওলানা আবদুল হক ছাহেব (যিনি বর্তমানে ময়মনসিংহ বড় মসজিদের খতীব ও পেশ ইমাম) আমাকে বললেন, হযরতের নাকি ৫-৬ জন বুযুর্গের কাছ থেকে এজাযত হাসিল আছে। আমরা দুজনে হযরতকে নিয়ে নৌকায় উঠিয়ে দিয়েছিলাম। তৃতীয়বার দেখা হয় আজিমপুর ছাপরা মসজিদের ইমাম ছাহেবের রুমে। হযরত আমাকে দেখে হামিদুল্লাহ ভাইয়ের রুমে হযরতের বলা বক্তব্যের প্রতি ইশারা করে বললেন, দেখলেন তো! সেদিন আমার এ ধরনের কিছু বলতে মনে চেয়েছিল তাই বলেছিলাম, এখন দেখুন তাতে সত্যি সত্যিই সমস্যা ছিল বলে প্রকাশ হয়ে গেল। হযরত ঐ দিন বলেছিলেন, ‘আমি যদি আল্লাহর নযরে দোষী না হই, তাহলে সমগ্র পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে হলেও আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, পক্ষান্তরে আমি যদি আল্লাহর কাছে দোষী হই, সমগ্র পৃথিবী মিলে আমাকে বাঁচাতে চাইলেও কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না।’ এই কথাগুলো সেদিন তো সাধারণ ও স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল কিন্তু হযরতের আজকের বক্তব্যে বোঝা গেল যে, তা হযরতের কাশ্ফ ছিল। মাদরাসার একটি সমস্যা সম্পর্কে কথাগুলো সেদিন ইশারা ছিল, অথচ সমস্যাটা পরিষ্কার ও প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর আজতো হযরতের কাশ্ফ বলে মনে হল।
এতদিনে হযরতের সাথে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। ইত্যবসরে আমার শায়েখ ও উস্তায হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেব (ওলামাবাজারের হুযুর) ইন্তেকাল করার ফলে আমি হযরতের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করি। হযরত আরজাবাদ মাদরাসায় থাকতেন। আমি বাইয়াতের দরখাস্ত করলে হযরত বললেন, আজ নয় আগামী কাল সকালে। আমার মনে আছে, আমি সেদিন বাসায় না গিয়ে মিরপুরেই কোথাও ছিলাম। সকালে হযরতের দরবারে উপস্থিত হলে আমাকে বাইয়াত করে নেন আলহামদুলিল্লাহ। হযরতের খেদমতে যাতায়াত করতে আমার খুব ভয় লাগতো। কারণ হযরতের কাশ্ফ এত পরিষ্কার ছিল যে, আমার কোন্ গুনাহের কারণে আবার বিতাড়িত হয়ে যেতে হয় এই ভয়ে থাকতাম সবসময়। প্রায় দেখা যেত যখন যে বিষয় নিয়ে দেখা করেছি হযরত আমার বলার পূর্বেই আমাকে ঐ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।[1]
হযরতের কাছে আমার বাইআত হওয়ার পূর্বে এক সফরে হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেসবাহ ছাহেবসহ আমরা স›দ্বীপ একটি তাফসীর মাহফিলে যাই। মাহফিলটি প্রশাসন, তাবলীগ জামাতের লোক ও স›দ্বীপের আলেম-ওলামার পক্ষ থেকে দুই দিন ব্যাপী ছিল। ঐ মাহফিলে স›দ্বীপের উভয় বুযুর্গকে উপস্থিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল অর্থাৎ হযরত মাওলানা এহসানুল হক ছাহেব ও হযরত মাওলানা ইদ্রিস ছাহেব (স›দ্বীপের হুযুর)। হযরতের ছোট ভাই জনাব মাওলানা এমদাদ ছাহেব আমাকে বলেছেন যে, তাঁরা দুজনেই প্রথমে এই মাহফিলে উপস্থিত হতে ইনকার করেছিলেন এই মনে করে যে, মেসবাহ ছাহেব কোনো জামাতি লোক কিনা? এমদাদ ছাহেবসহ সকলে তাঁদেরকে বুঝিয়ে দেন যে, না, মেসবাহ ছাহেব আমাদেরই লোক। আমাদেরই আকাবের-আসলাফের কথাই বয়ানে বলেন অন্য কিছু নয়। উভয় বুযুর্গ এদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রথম দিনের তাফসীর শুনে উভয় বুযুর্গ মাওলানা মেসবাহ ছাহেবের গর্বিদা হয়ে যান। পরদিন সকালে আমি হযরত মাওলানা এহসানুল হক ছাহেবের অবস্থানে দেখা করতে গেলে আমাকে হযরত বললেন, মাওলানা মেসবাহ ছাহেব এখন কী করছেন? আমি বলালম, হয়ত ঘুমুচ্ছেন। হযরত বললেন, যদি না ঘুমিয়ে থাকেন তাহলে আমার সালাম বলুন। আমি গিয়ে দেখি তিনি ঘুমাননি। আমি হযরতের সালাম পেশ করা মাত্রই মেসবাহ ছাহেব প্রস্তুত হয়ে হযরতের অবস্থানে এসে সালাম দিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। হযরতের কাছে আগত লোকদেরকে হযরত কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যেতে বললেন, আমি উর্দুতে বললাম,
حضرت ميں بھی جاؤں
হযরত আমার দাড়ির দুই পাশে শফকতের হাত মুছে দিতে দিতে বললেন,
جی آپ بھی جا ۓ
আমি তখন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বলে সন্দেহ হওয়াতে সম্পূর্ণ বাইরে না গিয়ে বোর্ড পার্টিশনের ওপারে কিছু একটি নিয়ে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর দুজনেরই কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। দরজা খোলার পর সর্বপ্রথম আমি প্রবেশ করলাম। দেখলাম উভয়ে কান্না জড়িত অবস্থায় মোআনাকা করছেন এবং হযরত মেসবাহ ছাহেবকে বিদায় দিলেন। আমি বসেই হযরতকে জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর সাথে কি হযরতের বাইআতের সম্পর্ক হয়ে গেছে? হযরত বললেন, জ্বী হয়েছে। আমি বললাম, হযরতের পক্ষ থেকে কি এজাযতও হয়ে গেছে? হযরত হাসি মুখে বললেন, জ্বী ভাই
اجازت بھی ہو گئ
আমার মন চাইছে তাঁর মাধ্যমে যেসব খেদমত আঞ্জাম পাচ্ছে তাতে আমারও একটু শিরকত ও অংশ থাকুক, যাতে করে আমিও ছাওয়াবের ভাগি হতে পারে। তবে আপনি কী করে বুঝলেন? আমার তখন চোখে মুখে কান্না এসে গেছে এবং ঐ অবস্থায়ই বললাম, হযরত! আমিও তাঁর সোহবত-সান্নিধ্যে এ নিয়তেই থাকছি যে, আমিও যেন কিছুটা ছাওয়াবের ভাগি হতে পারি। সম্ভবত তখনই আমি হযরতকে প্রশ্ন করলাম, হযরতের কোন্ কোন্ বুযুর্গের এজাযত আছে? হযরত বললেন, “আমি তো হযরত মাদানী রাহ.-এর হাতে বাইআত ছিলাম, কিন্তু স্বপ্নের মাধ্যমে এজাযতের অনেক আলামত পাওয়া যাওয়া সত্তে¡ও, এমনকি বন্ধুদের অনেক অনুরোধের পরও স্বপ্নগুলো আমি হযরত মাদানীকে এই মনে করে লিখিনি যে, এজাযতের জন্য এসব লিখব? এমতাবস্থায় হযরতের এন্তেকাল হয়ে যায়। তাই হযরতের পক্ষ থেকে সরাসরি আর কোনো এজাযত হয়নি। তবে আমাকে সর্বপ্রথম এজাযত দেন আমার আব্বাজানের পীর হযরত গাঙ্গুহী রাহ.-এর খলিফা মির সরাইয়ের শাহ কাজী মোয়াজ্জম হুসাইন ছাহেব রাহ., এরপর আব্বাজান রাহ.-ও আমাকে এজাযত দেন, যুদ্ধের সময় আমি এক বছর যাবৎ পাকিস্তানের তাবলীগি সফরে ছিলাম, তখন পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ আ’লা হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রাহ.-এর সুযোগ্য খলিফা হযরত মাওলানা আবদুল মাবুদ লাহোরী ছাহেব পাকিস্তান অবস্থান করছিলেন (তিনি পুরা বছরকে তিন ভাগ করে তিন যায়গায় অবস্থান করতেন, মক্কা শরীফে চার মাস, মদীনা শরীফে চার মাস আর চার মাস থাকতেন লাহোরে। তাঁর বুযুর্গী ও কারামাত ছিল, তাঁর এন্তেকালে রয়টার নিউজ করেছে যে, আমি নিজ চোখে দেখেছি, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ হায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি আজ মৃত্যুবরণ করলেন।’ তাঁর বয়স তখন ১৫০/১৬০ বছর ছিল। সমস্ত দাঁত পড়ে গিয়ে আবার উঠেছিল। চুল-দাড়ি সাদা হয়ে আবার কালো হয়ে গিয়েছিল। স্বপ্নযোগে আ’লা হযরত হাজ্বী ছাহেব রাহ. তাঁর দীর্ঘ হায়াতের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি নাকি উত্তরে বলেছিলেন, একবার শবেকদর মাহসুস বা প্রত্যক্ষ করেছিলাম তখন দীর্ঘ হায়াতের জন্য দুআ করেছিলাম নেক আমল বেশি করার আশায়। তাই আল্লাহ পাক মেহেরবানী করেছেন। আমি তাঁর কোনো এক মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। লোকেরা আমার পরিচয় দিয়ে দিল বাংলাদেশের একজন মুহাদ্দিস বলে, তিনি ঐ মজলিসেই সবার সামনে আমাকে দেখিয়ে বললেন,
ان كومیری طرف سے اجازت ہے
তারপর হযরত মাদানীর খলিফা হযরত মাওলানা আমিনুল হক কাসেমী ছাহেবও হাদিয়া বলে আমাকে এজাযত দেন। এখন আমার শায়েখ হচ্ছেন হযরত মাওলানা সৈয়দ আসআদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুম। তিনিও আমাকে এজাযত দিয়েছেন।”
হযরতের বেশিরভাগ মুরিদান সন্দীপ এবং ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহে যেহেতু হযরতের সবচেয়ে মুল্যবান সময় অতিবাহিত হয়েছে তাই সেখানেই বেশি। আলেমদের মধ্যে হযরতের আজাল্লে খলিফা হচ্ছেন, খতীবে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেসবাহ ছাহেব রাহ. নোয়াখালী, হযরত মাওলানা হাফেয তাজুল ইসলাম ছাহেব দা. বা. চট্টগ্রাম। সুমিষ্ট বক্তা মরহুম হযরত মাওলানা জামালুদ্দীন ছাহেব চট্টগ্রাম। মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা আকরাম ছাহেব দা. বা. ঢাকা। মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা শরফুদ্দীন ছাহেব দা. বা. কিশোরগঞ্জ প্রমুখ।
হযরত দাওয়াত ও হাদিয়া গ্রহণ করতে খুব বেশি পরহেয করতেন। একদিন এ বিষয়ে ‘তাফতীশ’ হয়ে যায় নাকি এমন প্রশ্ন করাতে হযরত কয়েকটি ঘটনা বললেন। হযরত বলেন, ‘ময়মনসিংহ থাকার সময় এক বুড়োবেটা বড়সড় একটি কাঠাল হাদিয়া হিসেবে নিয়ে আসে। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, গাছের কাঠাল না বাজারের? বুড়ো খুশী মনে উত্তর দিল, হযরত! গাছের। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নিজ হাতে বপন করা গাছ নাকি আপনার বাবার হাতের? লোকটি বলল, হযরত, আমার নিজ হাতে লাগানো গাছের। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কি বোন আছে? লোকটি বলল, আছে হযরত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাদের প্রাপ্য মিরাছ দিয়েছেন? লোকটি বলল, জ্বি না হযরত! আমি বললাম, তাহলে তো খেতে পারব না। কাঠালটা নিয়ে যান। লোকটি কান্না জুড়ে দিল।’ হযরত বললেন, আমি তাকে ধমক দিলাম, ‘মিয়া আপনার কান্নায় আমার কী আসে যায়, আমি কি হারাম খাবো?’ হযরত তাঁর আব্বাজানের এ ধরণের একটি ঘটনাও বললেন, ‘আব্বাজান কোনো কাজে একবার হাটহাজারী গিয়েছিলেন। আব্বার সাথে আমিও ছিলাম। হাটহাজারীতে একজন বড় মানুষের বাড়িতে সব মুরুব্বীদের দাওয়াত ছিল। মুফতী আযম মুফতী ফয়জুল্লাহ ছাহেব ও হাটহাজারীর মুহতামিম মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব ছাহেবসহ বড় বড় আলেমরা ঐ দাওয়াতে মেহমান ছিলেন। মেযবানরা মহব্বত করে আব্বাজানের বরতনে একটি বড় রুই মাছের মাথা দিলেন। আব্বাজানকে দেখলাম, খাওয়ার মতো করে মাথাটা নাড়াচাড়া করছেন আর প্রশ্ন করছেন, মাশাআল্লাহ-মাশাআল্লাহ, বহুত বড় মাথা, মাছটি বাজারের না পুকুরের? মেযবানরা খুশীতে সবাই বললেন, হযরত পুকুরের। মাশাআল্লাহ-মাশাআল্লাহ। আপনারা ক’ভাই? সবাই কি জীবিত আছেন? মেযবানরা উত্তর দিলেন আমরা এতো ভাই তবে একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। আব্বাজান বললেন, তাঁর সন্তানরা সবাই কি বালেগ না নাবালেগও কেউ আছে? মেযবানরা উত্তরে বলল, হযরত না বালেগও আছে। আব্বাজান কিন্তু এখনো খাওয়া শুরু করেননি শুধু নাড়াচাড়া করছেন। তারপর বললেন, আমি তো বড় আলেম নই, এখানে বড় বড় আলেমরা আছেন, তাঁরা বলবেন খাওয়া যাবে কি না? ইত্যবসরে মুফতী আযমসহ সকলের ঘাম ছুটে গেছে, তাঁরা সবাই তাড়াতাড়ি করে মাছটির বিক্রিমূল্য ধার্য্য করে এক ভাইয়ের ভাগে যত পড়েছে তা ঐ মৃত ভাইয়ের সন্তানদের দিয়ে দেওয়ার পর আব্বাজান খাওয়া আরম্ভ করলেন। তো আব্বাজান এভাবে ‘তাফাতীশ’ করতেন যাতে করে কেউ শরম না পান এবং তাফতীশ করছেন তাও বোঝা না যায়। তবুও হালালের স্বার্থে তাফতীশ অবশ্যই করতেন।
হযরতের এ ধরণের বহু ঘটনা আছে যা লিখে শেষ করা যাবে না। হযরত এখন একেবারে মাজুর, তেমন কোনো রোগ-বালাই না থাকলেও বার্ধক্যের ফলে একেবারে মাজুর হয়ে গেছেন। তবে বসে বসে অথবা শুয়ে শুয়ে মনের মানুষ পেলে কিছু বলতে থাকেন। হযরতের সঠিক জন্ম তারিখ জানা না থাকলেও প্রায় শত বছরের কাছাকাছি এখন হযরতের বয়স। গত ২৩/৫/২০১৪ ঈ. শুক্রবার সকালে হযরতকে দেখতে চট্টগ্রাম গেলে হযরত খুশীতে বাগবাগ হয়ে যান। আধ্যত্ম জগতের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা বিভিন্ন মহাপুরুষের শে‘র-আশআর পড়তে থাকেন এবং মাঝেমধ্যে তার সমর্থনে কুরআনের আয়াতও পড়তে থাকেন। অনেকক্ষন বসেবসেই কথা বলছিলেন। পরে আমাকে বললেন, একটু শুই, কষ্ট হচ্ছে। আমি বললাম, জ্বি! হযরত শুয়ে পড়লেন। শুয়ে শুয়েও কিছুক্ষণ কথা বললেন। মনের অদম্য ইচ্ছা সত্তে¡ও হযরতের কষ্টের কথা খেয়াল করে আমাকে চলে আসতে হল। মহান আল্লাহ পাক হযরতকে আফিয়াতের সাথে হায়াতে তাইয়্যেবাহ দান করুন। আমীন
[1] কারো কোনকিছু কাশ্ফ হওয়া মানে, এ নয় যে (নাউযুবিল্লাহ) তিনি গায়েব জানেন। যখন যদ্দুর আল্লাহ জানিয়ে দেন বস্ এতটুকুই। মানুষ অনেক সময় সুধারণার ভিত্তিতে এমনিই ঘটে যাওয়া কোন বিষয়কে কাশ্ফ মনে করে বসে থাকে। আমাদের অন্যান্য বুযুর্গগণের ন্যায় এই হযরতেরও সবচে বড় কারামত হল, ইত্তেবায়ে সুন্নাত এবং ইস্তিকামাত তথা সুন্নাত অনুসরণ ও দ্বীন-শরীয়তের ওপর অবিচল থাকা। আর স্বপ্ন ও কাশ্ফ যে শরীয়তের দলীল নয় এটা তো সবারই জানা। প্রবন্ধে তা বলাও হয়নি। তাও বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভাল মনে হল। (আবদুল মালেক)