উলামায়ে কিরাম ও আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে সেতুবন্ধন : চাই মধ্যপন্থী ভাবনার চর্চা
একবার এক ওয়াজের মাহফিলে জনৈক বক্তার বয়ান শুনছিলাম। তিনি ইলমে দ্বীন ও ওলামায়ে কিরামের ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। কথায় বলে تتبين الأشياء بأضدادها ‘যে কোনও বিষয় তার বিপরীতের দ্বারাই বেশি পরিষ্কার হয়’। আলো বোঝা যায় অন্ধকার দ্বারা এবং সাদা কালোর দ্বারা। সুতরাং ইলমে দ্বীন ও উলামায়ে কিরামের মাহাত্ম্য পরিষ্কার করার জন্য বক্তা একপর্যায়ে তার শ্রোতাদেরকে দুনিয়ার বিদ্যা ও আধুনিক বিদ্বানদের কাছে নিয়ে গেলেন এবং সেই পরিমণ্ডল যে কতটা কদর্য তা তাদেরকে চাক্ষুষ দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। শ্রোতামণ্ডলীও যেন তা দেখতে পেরে বেশ তৃপ্তি বোধ করলেন এবং বিভিন্ন ধ্বনি সহযোগে চোখ-মুখের ভঙ্গী দ্বারা সেই বোধের অভিব্যক্তি ঘটালেন।
বলাবাহুল্য, ওয়াজ মাহফিলেরও শ্রেণীভেদ আছে। কোন ঘরানার মাহফিল এবং বক্তা কে, অধিকাংশ শ্রোতার কাছে তা বিবেচ্য হয়ে থাকে। যে কোনও বক্তার ওয়াজ সাধারণত তার চিন্তা-চেতনা ও আকীদা-বিশ্বাসের সাথে যাদের মিল আছে তারাই শুনতে বেশি আগ্রহী হয়। স্বাভাবিকভাবেই তার বক্তব্যের সাড়াও তাদের মধ্যে বেশি পড়ে। কাজেই তাদের হর্ষধ্বনি দ্বারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছার অবকাশ নেই যে, মাহফিলের বাইরের আপামর সকলেও সেই বক্তব্যে আহ্লাদ বোধ করবে। তা নাই করুক- বক্তার তাতে কিছু যায় আসে না। উপস্থিত শ্রোতাদের বাহবা ধ্বনির ভেতরেই যেন তিনি সমস্ত গণমানুষের ঐকতান শুনতে পান। ফলে ক্রমবর্ধমান উৎসাহে সব সীমারেখা অতিক্রম করে চলে যান বহুদূর। যে বক্তার কথা বলেছি এমনটাই হয়েছিল তার বেলায়। বলা যায় তিনি তার বয়ানে শ্রোতামানসে এই অনুভ‚তি জন্মাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আধুনিক শিক্ষা কিছু শিক্ষা নামেরই উপযুক্ত নয়। কিছুদিন আগে সদ্য কলম বাগানো এক তরুণের লেখায়ও এই ভাবনার ছাপ দেখতে পেলাম। তা পড়লে ধারণা জন্মায় মুসলিম সমাজে আধুনিক শিক্ষার কোনও প্রয়োজন নেই। এই শিক্ষায় শিক্ষিতদের দ্বারা সমাজের বিশেষ কল্যাণ হয় না।
তো দেখা যাচ্ছে ‘আলেম-উলামার একাংশ আধুনিক জ্ঞান-বিদ্যাকে ঘৃণার চোখে দেখে। তারা তাদের বয়ান ও লেখার মাধ্যমে সেই ঘৃণা প্রকাশও করে। তারা নিজেরা যেমন বিশ্বাস করে তেমনি অন্যদেরও বোঝানোর চেষ্টা করে এ জ্ঞান-বিদ্যা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়; বরং অত্যন্ত ক্ষতিকর।
আমার একথা উলামায়ে কিরামের একাংশ সম্পর্কে। সকলেই যে এরূপ মনোভাব পোষণ করেন তা নয়।[1]
আবার অন্যদিকে যারা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করেন তাদের একটা বিরাট অংশ ইলমে দ্বীন ও উলামায়ে কিরাম সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতার ধারক। তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখা-জোখায় এ ব্যাপারে কোনও রাখঢাক নেই। সব রকম প্রচার মাধ্যমে অত্যন্ত উৎকটভাবে তারা এ সম্পর্কে বিষোদ্গার করে থাকে। দেশের আপামর জনগণকে কিভাবে এ শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করা যায়, কিভাবে সমাজ চোখে উলামায়ে কিরামকে হেয় প্রতিপন্ন করা যায় সে লক্ষ্যে তাদের চেষ্টা-কসরতের কোনও শেষ নেই। তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে এই মেহনত করে যাচ্ছে এবং উত্তরোত্তর তাতে সফলতাও লাভ করছে। তাদের দিক থেকে এ তৎপরতা এমনই খোলামেলা বহুবিচিত্র ও নিত্যনবতর যা বিশদ বলার অবকাশ রাখে না। বলা যায় বর্তমানে এটা তাদের সর্বাপেক্ষা সুখকর বিনোদনক্রিয়া।
এ উভয় মনোভাবই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুই প্রান্তিকতা ও চরম একদেশদর্শিতা। অন্যসব বাড়াবাড়ির মতই এ বাড়াবাড়িও ব্যক্তি ও সমাজের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। এর ফলে দ্বীনী ইলমের উলামা ও আধুনিক বিদ্বৎসমাজের মধ্যে এক অদৃশ্য দেওয়াল গড়ে উঠেছে। দৃশ্যমান দেওয়াল তো সহজেই টপকানো যায়, কিন্তু অদৃশ্য দেওয়াল দুর্লঙ্ঘ্য। সাধারণত তা টপকানোর চিন্তাই করা হয় না। অগত্যা প্রত্যেক মহল আপন-আপন পরিমণ্ডলেই বিচরণ করছে। কেবল নিজেদেরই লাভ-লোকসান চিন্তা করছে। অপর মহলের কল্যাণ চিন্তা করলেও নিজেদের অবস্থান থেকেই করছে। চিন্তার বিনিময় হচ্ছে না। একে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে না। একের কল্যাণ অন্যতে বিস্তার লাভ করতে পারছে না। মাঝখানে অদৃশ্য দেওয়াল প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। সামগ্রিক কল্যাণার্থে এ দেওয়ালের অপসারণ জরুরি। তার জন্য প্রথমে দরকার মনোভাবের পরিবর্তন ও চিন্তার ভারসাম্য আনয়ন। প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিহার করে উদার মানসিকতার সাথে যদি প্রত্যেকে অপরকে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে তবে এ প্রাচীর আপনিই অপসৃত হতে পারে।
উলামায়ে কিরামের দিকটাকেই প্রথমে ধরা যাক। সন্দেহ নেই কুরআন-হাদীসে তাদের অতি উঁচু মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। যেমন ইরশাদ,
اَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ اٰنَآءَ الَّیْلِ سَاجِدًا وَّ قَآىِٕمًا یَّحْذَرُ الْاٰخِرَةَ وَ یَرْجُوْا رَحْمَةَ رَبِّهٖ ؕ قُلْ هَلْ یَسْتَوِی الَّذِیْنَ یَعْلَمُوْنَ وَ الَّذِیْنَ لَا یَعْلَمُوْنَ ؕ اِنَّمَا یَتَذَكَّرُ اُولُوا الْاَلْبَابِ۠
‘যে ব্যক্তি রাতের বিভিন্ন সময়ে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে আখিরাতকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে সে কি তার সমান যে তা করে না? বল, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? কেবল বোধসম্পন্ন লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে -সুরা যুমার : ৯
এ আয়াত সুনির্দিষ্ট শর্তপূরণ ও দায়-দায়িত্ব পালন সাপেক্ষে উলামায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করে। এক হাদীসে আছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে কুরআন নিজে শেখে ও অন্যকে শেখায়’। ইশারাস্বরূপ একখানি আয়াত ও একটি হাদীস উল্লেখ করা হল, না হয় উলামায়ে কিরামের মর্যাদা সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কি এই যে, তাদের ছাড়া বাকি সব লোক উপেক্ষিত হবে? অন্যদের কোনও গুণ ও অবদানকে স্বীকার করা হবে না? নিশ্চয়ই তা নয় এবং সেরূপ ভাবনা শ্রেষ্ঠত্বের মহিমাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
উলামায়ে কিরাম একটা সমাজের সব নয়; বরং ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। একটা সুন্দর, সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য তাদের প্রয়োজন যেমন অনঃস্বীকার্য তেমনি একথাও সত্য যে, কেবল তাদের পক্ষে সমাজের সকল প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়। যত রকম পেশাজীবি আছে তাদের প্রত্যেকের ভ‚মিকাই অত্যন্ত মূল্যবান এবং বাকি সকলের জন্য তা অপরিহার্য। সন্দেহ নেই প্রতিটি পেশার উৎকর্ষ ও উপযোগিতায় আধুনিক শিক্ষার ভূমিকা বিশাল। এ শিক্ষার কল্যাণে আজ জীবন ও জীবিকার প্রতিটি বৃত্তি অভাবিতপূর্ব উপযোগিতা অর্জন করেছে। ক্রমবর্ধিষ্ণু মানবগোষ্ঠীর হরেক রকম চাহিদা পূরণে কৃষক-শ্রমিকের মেহনত পর্যন্ত যে বিস্ময়কর সরবরাহ সৃষ্টি করছে, তা আধুনিক জ্ঞান-বিদ্যার অবদান নয় কি? আজকের সহজ, নিরাপদ ও দ্রুত যোগাযোগ, যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা, কঠিন-কঠিন রোগ-ব্যাধির উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা এবং নিরাপদ ও মনোরম আবাসনের স্থাপত্যকলা এবংবিধ জীবন-সংশ্লিষ্ট আরও যত ক্ষেত্র আছে, কোনটিতে না অধুনা জ্ঞান-বিজ্ঞান যুগান্তকারী বিপ্লব সাধন করেছে? এদিকে লক্ষ করলে স্বীকার করতেই হবে যে, এ শিক্ষাও আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিআমত। সে দৃষ্টিতে এ শিক্ষা ও এর শিক্ষিতজনদেরকে অবজ্ঞার সাথে নয়; বরং কৃতজ্ঞতার সাথেই নেওয়া উচিত।
বিশেষত এ কারণে যে, এর সাথে সংশ্লিষ্ট কাজকর্ম, যা ছাড়া জীবন ও সমাজের গাড়ি চলতে পারে না, কেবল তারাই আঞ্জাম দিচ্ছে। উলামায়ে কিরামের পক্ষে তা সম্ভব নয়। কেননা উলামায়ে কিরাম যে শিক্ষা লাভ করেন তা আদৌ এজন্য নয়। কুরআন-হাদীস এ জন্য নয় যে, তা পড়ে মানুষ প্রকৌশলী, চিকিৎসক, নাবিক-পাইলট, কৃষিবিদ ইত্যাদি হবে। এসব তাদের কাজ নয়। তবে তাদের কাজ কী? কুরআন মাজীদ বলছে,
وَ مَا كَانَ الْمُؤْمِنُوْنَ لِیَنْفِرُوْا كَآفَّةً ؕ فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآىِٕفَةٌ لِّیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ وَ لِیُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَیْهِمْ لَعَلَّهُمْ یَحْذَرُوْنَ۠
প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়’ -সুরা তাওবা :১২২
কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জনকারীগণ কী কাজ করবে তা এ আয়াতে পরিষ্কারভাবেই বলে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা সরাসরি কুরআন-হাদীসের জ্ঞানার্জন করেনি, যারা জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত তারা সেই কাজের ভেতর দিয়েও কিভাবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করবে। তারা তাদের সেইসব জাগতিক কাজকে কিভাবে পারলৌকিক সফলতার মাধ্যম বানাবে। কিভাবে তারা তাদের দুনিয়াকে দ্বীনে পরিণত করবে। ‘আলেমগণ তাদেরকে সেই পথ দেখাবে। তারা যাতে কুরআনের ভাষায় এমন না হয়ে যায় যে, তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে অবগত আর আখিরাত সম্বন্ধে তারা গাফিল। (সূরা রূম:৭) সেই লক্ষ্যে তাদেরকে সতর্ক-সচেতন করবে। অনাচার করলে, দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে এবং আপন দায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম না দিলে আখিরাতে কী কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে সেই ভয় দেখাবে। যাতে প্রত্যেক পেশাজীবি আপন পেশায় বিশ্বস্ত থাকে, চিন্তা-চেতনায় আখিরাতের জবাবদিহিতাকে জাগ্রত রাখে আর এভাবে দুনিয়ার কাজের ভেতর দিয়েও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়।
এভাবে এ আয়াত উলামায়ে কিরামকে গণমানুষের সাথে যুক্ত করে দিয়েছে। আম জনগণই তাদের কাজের ক্ষেত্র। একজন আলেমেদ্বীন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা জাগতিক অন্য কোন কর্মজীবি নয়, কিন্তু তাদের থেকে সে বিচ্ছিন্নও নয়। সে তাদের কাজে প্রাণরস জোগাবে। তাদের নীতি-নৈতিকতা রচনা করবে। উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক দেহ ও আত্মার মত। একটা সুষ্ঠু সমাজের জন্য আলেমগণ আত্মাস্বরূপ, জাগতিক পেশার লোকজন সেই সমাজের শরীর। তাদের মেহনত শরীরকেন্দ্রিক। আলেমদের কাজ আত্মাকেন্দ্রিক। উভয় মেহনত একটি আরেকটির সম্পূরক। শরীর ছাড়া যেমন আত্মার অবস্থিতি কল্পনা করা যায় না তেমনি ইহজাগতিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত লোকদের ছাড়া উলামায়ে কিরামের অবস্থান অকল্পনীয়। কাজেই আলেমদের পক্ষে তারা ‘পর’ নয়; বরং তাদের অস্তিত্বের অংশ। সুতরাং আলেমদের কর্তব্য তাদের সাথে অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকা।
এর জন্য প্রথম কাজ, যে কথা আগেই বলা হয়েছে, মানসিকতার পরিবর্তন। অর্থাৎ আধুনিক শিক্ষিতদেরকে ‘পর’ না ভেবে ‘আপন’ ভাবা। তাদেরকে সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় ও উপকারী গণ্য করা এবং তাদের কাজকর্মের মূল্যায়ন করা। সেইসঙ্গে তাদের কাজকর্মকে কেবলই ইহজাগতিক দৌড়ঝাঁপ মনে না করে তার পারলৌকিক মহিমা উপলব্ধি করা। যেমন হাদীসে রোগী দেখতে যাওয়া ও রোগীর সেবা-যত্ন করাকে অতি বড় পুণ্যের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য এ কাজে একজন চিকিৎসকের চেয়ে অগ্রণী আর কেউ হতে পারে না। অপর এক হাদীসে কারও পার্থিব কষ্টলাঘব করলে তার বিনিময়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কষ্টলাঘবের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। জাগতিক যে কোনও পেশার লোকই এর আওতায় পড়ে যায়। এক হাদীসে পরোপকারী মানুষকে শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা হয়েছে। এটাও সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরের লোকদের জন্যই প্রযোজ্য। এভাবে যে যেই বৈধ পেশাই গ্রহণ করুক না কেন তা সর্বশ ইহজাগতিক হওয়া অনিবার্য নয়। দৃষ্টিকোণের বদল দ্বারা তা পারলৌকিকও হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত ইসলাম মানুষকে সেই নির্দেশনাই দান করে। সমাজের সর্বস্তরে সেই বোধ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তো উলামায়ে কিরামেরই, আর তারই প্রথম ধাপ নিজ মন-মস্তিষ্কে সেই চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করা।
প্রকাশ থাকে যে, আখিরাতের বিচারে উলামায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব তো নিঃশর্ত নয়, বরং ইখলাস, আমল ও দায়িত্বপালনের শর্তসাপেক্ষ। সমষ্টিগতভাবে সে শর্তপূরণের নিশ্চয়তা থাকলেও যে কোনও ‘ব্যক্তি আলেমের’ ক্ষেত্রে তাতে ঘাটতি থাকার যথেষ্ট অবকাশ আছে। ফলে এ মহলের কোনও ব্যক্তি নিজেকে অন্য কারও অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ভাবতে পারে না। তাতে সেই অন্য ব্যক্তিটি যে পেশারই হোক না কেন। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. তো বলতেন দুনিয়ার যে কোনও মুসলিমকে তার বর্তমান অবস্থার ভিত্তিতে এবং যে কোনও অমুসলিমকে তার ভবিষ্যত সম্ভাবনার ভিত্তিতে আমি নিজের চেয়ে উত্তম মনে করি। দ্বীনী খেদমতে বিস্ময়কর ভ‚মিকা রাখা সত্তে¡ও যখন তাঁর এই অনুভূতি তখন নিজেকে আর কার কি ভাবার অবকাশ আছে? এ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তিগতভাবে যে কোনও আলেমই আধুনিক শিক্ষিত যে কোনও লোককে নিজের থেকে উত্তম ভাবতেই পারে।
যা হোক প্রথম কাজ হল মানসিকতার বদল। এই বদলে দেওয়া মানসিকতাই উলামায়ে কিরামকে আধুনিক শিক্ষিত সমাজের কাছে নিয়ে যেতে পারে। এটাই হতে পারে বাধার প্রাচীর উৎপাটনে তাদের পক্ষ থেকে প্রথম আঘাত। এর পরবর্তী কাজ হল তাদের সাথে মেলামেশা ও মতবিনিময় করা, তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করা, তাদেরকেও বোঝার সুযোগ দান করা। সেই লক্ষ্যে নিজেদের অনুষ্ঠানাদিতে তাদেরকে শামিল রাখা এবং আরও যত যোগাযোগ-মাধ্যম আছে সেগুলোকেও কাজে লাগানো। ইত্যাদি উপায়ে সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ঠতায় নিয়ে যাওয়া। বিভেদ-বিভক্তি দূর করে পারস্পরিক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য উলামায়ে কিরামের পক্ষ থেকে এ জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে। কারণ তারা উলামায়ে কিরামের মাদ্উ-দাওয়াতের ক্ষেত্র ও পাত্র। মাদ্উ স্ব-উদ্যোগে এগিয়ে আসবে তা আশা করা যায় না। উদ্যোগটা দাওয়াতদাতাকেই নিতে হয়। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
এতো গেল উলামায়ে কিরামের দিক। তাদের সম্পর্কে আধুনিক শিক্ষিত সমাজের যে নেতিবাচক ধারণা এবং তাদের একটা বিরাট অংশের চরম একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গী সে সম্পর্কে আলকাউসারের পাতায় কিছু লেখার বিশেষ ফায়দা নেই। তবে এ সম্পর্কে উলামায়ে কিরামকে লক্ষ্য করে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ব্যক্তি ও সমাজ নির্মাণ এবং মানুষের ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ সাধনে উলামায়ে কিরামের ভ‚মিকা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যাতে তারা যথার্থ উপলব্ধি লাভ করতে পারে সেজন্য উলামায়ে কিরামকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদেরকে বুঝতে দিতে হবে আলেমদের কাজই তাদের সর্বপ্রকার মেহনতের প্রাণবস্তু। সেই প্রাণবস্তুর অভাবেই তাদেরকে আজ যান্ত্রিক জীবনের ঘানি টানতে হচ্ছে। পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত। সমাজ থেকে শান্তি-শৃংখলা উধাও। অফিস-আদালত দুর্নীতিকবলিত। এর থেকে মুক্তির কোনও পথ কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। অন্ধকারের ভেতর থেকে এ লক্ষ্যে যা কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে সঙ্গত কারণেই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। তা হতে বাধ্য। কেননা গলত রয়ে গেছে গোড়াতেই। মূল রোগ আত্মায়- অর্থাৎ আকীদা-বিশ্বাস ও নীতি-নৈতিকতায়। কর্মের সুচারু পরিচালনা, বিশ্বাস ও আখলাকের শুদ্ধতা দ্বারাই সম্ভব। ইসলাম যে বিশ্বাস ও আখলাকের শিক্ষা দান করে মানব জীবনের যাবতীয় কাজের সাথেই রয়েছে তার গভীর সম্পর্ক। জীবনদৃষ্টিতে সেই বিশ্বাস ও আখলাকের আধিপত্য থাকলে কর্মের শুদ্ধতা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই মহাসত্যের সবক তারা কোথায় পাবে? যে শিক্ষা তারা লাভ করছে কেবল বস্তুর সাথেই তার সম্পর্ক। তা দ্বারা তারা
يعلمون ظاهرا من الحياة الدنيا
পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিকটাই জানতে পারে। আত্মাকে তা স্পর্শ করে না। আত্মার খোরাক পেতে হলে তাদেরকে উলামায়ে কিরামেরই দ্বারস্থ হতে হবে। কেননা সে খোরাক কেবল কুরআন-হাদীসেই আছে আর তা নিয়েই আলেমদের কারবার। সুতরাং উলামা সমাজ তাদের ব্যক্তিজীবন তো বটেই বৃহত্তর সমাজের জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, অতি প্রাসংগিক।
মোটকথা উলামা সমাজ ও আধুনিক শিক্ষিত মহল উভয়েরই চিন্তায় ভারসাম্য আনতে হবে। প্রত্যেককেই নিজ সীমারেখা সম্পর্কে সজাগ হতে হবে এবং নিজের জন্য অপরের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করতে হবে। এভাবে উভয় পক্ষ যদি পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসতে পারে এবং বিভক্তির প্রাচীর উৎপাটিত করে একে অন্যের সম্পূরক হিসেবে হাতে হাত ধরে চলতে পারে তবেই সাধিত হতে পারে ব্যক্তি ও সমষ্টির সত্যিকারের মঙ্গল। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।
[1] বরং তারা জাগতিক বিদ্যা ও উপকারী আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং বিভিন্ন বৈধ পেশার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতার প্রবক্তা। এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়নও করেন তারা। জাগতিক বিদ্যা ও উপকারী আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপর তাদের কোনো আপত্তি নেই। তাদের আপত্তি শুধু শরীয়ত বিরূদ্ধ পন্থায় শিক্ষাদান ও লব্ধ শিক্ষা ও বিদ্যার শরীয়ত বিরূদ্ধ প্রয়োগের উপর। নতুবা তাঁদের দৃষ্টিতে যারা এই লব্ধ বিদ্যা আল্লাহর মাখলুকের সেবায় ব্যয় করে তারা শত মোবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য।- আব্দুল মালেক