জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৬   ||   এপ্রিল ২০১৫

চান্দ্রমাস: একটি পর্যালোচনা-২

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

বিগত শাওয়াল ১৪৩৪ হি. থেকে সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ পালন প্রসঙ্গে ধারাবাহিক লেখা সম্মানিত পাঠকবৃন্দের সামনে পরিবেশিত হচ্ছে। গত সংখ্যায় জনাব ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ এনামুল হকের বই চান্দ্রমাস-এর উপর পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনাটিও কয়েক কিস্তিতে আসবে। পাঠকদের কাছে দুআর দরখাস্ত, আল্লাহ তাআলা একে উপকারী বানান এবং কবুল ও মনযূর করেন। আমীন।(-মুহাম্মাদ আবদুল মালেক)

চান্দ্রমাস বইয়ের বিকৃতি

গত সংখ্যায় পাঠকগণ আয়াত ২ : ১৮৯-এর তরজমা ও তাফসীর পড়েছেন। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আয়াতের অনুসৃত ব্যাখ্যাকে বাদ দিয়ে সঠিক অনুবাদ শিরোনামের নতুন তরজমা করেছেন এই:

তারা আপনার কাছে নতুন চাঁদসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বা জানতে চায়। বলে দিন, এগুলো সময়সমূহ (চান্দ্রমাসসমূহ) আরম্ভ (হিসাব) করার মাধ্যম, পুরো মানবজাতির জন্য এবং হজ্জের জন্য।

অথবা আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায়: তারা আপনাকে নতুন চাঁদসমূহ (বারটা) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন, এগুলো (বারটা নতুন চাঁদ) সূচনাকারী বা আরম্ভ করার মাধ্যম (বার মাসসমূহের) পুরো মানবজাতির জন্য এবং হজ্জের জন্য। (চান্দ্রমাস পৃ. ২১৫-২১৬)

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পুরো বক্তব্য সামনে আসছে। এতে তার গর্ববোধ রয়েছে যে, তিনি أهلة  আহিল্লাহ এই বহুবচন শব্দের তরজমা করেছেন বহুনির্দেশক শব্দ সমূহ সহকারে। এমনিভাবে مواقيت (মাওয়াকীত) যেটি বহুবচন, এর তরজমাতেও বহুবচনসূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি বলতে চান, অন্য মুতারজিমগণ এটা করেননি। তিনি আরো বলতে চান যে, কোনো মুফাসসির এই আয়াতের অধীনে বারো চান্দ্রমাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেননি। তিনিই যা সর্বপ্রথম করেছেন।

অথচ সব জায়গায় বহুবচনের তরজমায় বহুর অর্থ প্রকাশের জন্য বহুবচনসূচক শব্দ ব্যবহারের দরকার হয় না। তথাপি কোনো কোনো মুতারজিম উভয় শব্দের তরজমায় বহুনির্দেশক শব্দ উল্লেখ করেছেন আর বারো চান্দ্রমাসের প্রসঙ্গও ধরেছেন মুফাসসিরগণের অনেকে। অতএব ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের গর্ব আসলে নিজের ব্যাপারে সুধারণা। এদিকে উনার খবরই নেই যে, তিনি مواقيت (মাওয়াকীত)-এর তরজমা করেছেন একেবারে গলদ। তদুপরি জেনে বুঝে আরবী হিলাল, বাংলা নতুন চাঁদ এবং ইংরেজি নিউমুন (যা কেবল আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে)- এই সবগুলোকে বিকৃত করে তাতে অমাবস্যার অর্থ চাপিয়ে দিয়েছেন, আর মিথ্যা দাবি করেছেন যে, ইসলামী মাস শুরু হয় অমাবস্যা থেকে! ভুল করছেন নিজে, বিকৃতির আশ্রয় নিচ্ছেন নিজে, কিন্তু দোষারোপ করছেন কুরআনে কারীমের অনুবাদক ও তাফসীরকারদের!!

পাঠকগণ একটু ধৈর্য সহকারে তার কথাগুলো পড়ে নিন। যাতে পর্যালোচনা করা সহজ হয়। তিনি লিখেছেন:

ক). পুনশ্চ : মুসলিম উম্মাহর কাছে আমার আকুল আবেদন ও জরুরী পরামর্শ, কালবিলম্ব না করে আসুন আমরা সবাই সূরা বাকারার আয়াত-১৮৯ (অংশ)-এর অনুবাদ সংশোধন বা শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে যুগান্তকারী সংস্কার মেনে চলি। একতাবদ্ধ হয়ে আল্লাহর দেওয়া এই প্রাকৃতিক বিধানকে মেনে চলি। দুনিয়া ও আখেরাতের কামাইকে আর বিনষ্ট না করি। আমীন। (চান্দ্রমাস : সপ্তম সংস্করণ, পৃ. ১৩)

আরো লিখেছেন:

খ). আল্লাহ নবচন্দ্র দিয়েছেন চান্দ্রমাস গণনা শুরু করার জন্য :

১। সুরা বাকারার ২ : ১৮৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তারা আপনার কাছে নবচন্দ্রসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বা জানতে চায়। বলে দিন, এগুলো (নতুন চাঁদসমূহ) আরম্ভ (হিসাব) করার মাধ্যম। পুরো মানব জাতির জন্য (লিননাছ) এবং হজ্জের জন্য।[1] তাই হিজরী মাস গণনা করতে হয় নতুন চন্দ্র দিয়ে।[2]  এটা সারা পৃথিবীর মানুষের (লিননাছ) জন্য আল্লাহর নির্দেশ, কোন গোত্র বা দেশের জন্য নয়। তাই সারা পৃথিবীতে একক চান্দ্রমাস হিসাব করে একক হিজরী বৎসর গণনা করতে হবে। [3]

২। এই আয়াতে হেলাল বা নবচন্দ্র এর বহুবচন আহিল্লাতি শব্দ দিয়ে আল্লাহ ১২ (বার) মাসে বারটা নবচন্দ্রের কথা বলেছেন। অর্থাৎ ১২টা নবচন্দ্র দিয়ে আল্লাহ সারা বিশ্বের মানবজাতিকে ১২টা চান্দ্রমাস আরম্ভ করতে বলেছেন।

৩। আবার মীকাত-এর বহুবচন মাওয়াকীতু শব্দ দিয়ে আল্লাহ বার মাসের সময়সমূহের শুরুসমূহ নির্ধারণের কথা বলেছেন।[4]  উপরোক্ত আয়াতের মর্মার্থ বিশ্বব্যাপী তাফসীরকারগণ সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন না কেন তা আমার বোধগম্য নয়।[5]   (চান্দ্রমাস : নবম সংস্করণ, পৃ. ২১)

বইয়ের শেষে একই বিষয়ে লম্বা আলোচনা করেছেন। লিখেছেন:

২০ খানা তাফসীরের ইংরেজি অনুবাদ, না বাংলা অনুবাদ, কোনটা ভুল? এই শিরোনামের অধীনে একটি ভমিকা টেনে লেখেন:

সঠিক অনুবাদ : তারা আপনার কাছে নতুন চাঁদসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বা জানতে চায়। বলে দিন, এগুলো সময়সমূহ (চান্দ্রমাসসমূহ) আরম্ভ (হিসাব) করার মাধ্যম, পুরো মানবজাতির জন্য এবং হজ্জের জন্য।

অথবা আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় : তারা আপনাকে নতুন চাঁদসমূহ (বারটা) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন, এগুলো (বারটা নতুন চাঁদ) সূচনাকারী বা আরম্ভ করার মাধ্যম (বার মাসসমূহের), পুরো মানবজাতির জন্য এবং হজ্জের জন্য

বিভিন্ন তাফসীরগ্রন্থে সুরা আল বাকারার আয়াত ২ : ১৮৯ (অংশ)-এর অনুবাদের ছক...

(এই ছকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ইংরেজি, বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে মোট বিশটি তাফসীরগ্রন্থ থেকে আলোচ্য আয়াত-অংশের তরজমা ও সে সম্পর্কে মন্তব্য তুলে ধরেছেন। অতঃপর লিখেছেন: )

উপসংহার:

ইংরেজি ভাষার পাঁচটি অনুবাদে আহিল্লাতি এবং মাওয়াকীতু শব্দদ্বয়ের অর্থ সঠিকভাবে বহুবচন করা হয়েছে। ইংরেজি ভাষার দ্বিতীয় অনুবাদে মাওয়াকীতু শব্দের অর্থ মৌসুমসমূহ (!) বলা হয়েছে। বাকী বারটা বাংলা অনুবাদে শব্দদ্বয়ের অর্থ কেউই বহুবচনে করেননি। এখন প্রশ্ন হল- কোন তাফসীরটা সঠিক? আবার নবচন্দ্রসমূহের স্থলে কেউ কেউ অর্থ নবচন্দ্র করেছেন আর কেউ কেউ করেছেন শুধুই চন্দ্র বাকী দুইটা উর্দু অনুবাদের একটায় আহিল্লাতি শব্দের অর্থ নবচন্দ্রসমূহ (চাঁদসমূহ) করা হয়েছে, অন্যটায় করা হয়েছে মাসসমূহ এমনকি আয়াতে না থাকলেও অনেকেই চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধি(!) এবং নবচন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধির (!!) কথাও বলতে দ্বিধা করেননি। আশা করি শ্রদ্ধেয় ওলামায়ে কেরাম অতিসত্ত¡র এর একটা সমাধান দেবেন। সূরা তাওবার ৯ : ৩৬ আয়াতে উল্লিখিত ১২টা মাস আরম্ভ করতে বারটা নবচন্দ্রের কথা বুঝানোর জন্যই যে আল্লাহ ২ : ১৮৯ আয়াতে আহিল্লাতি বা নবচন্দ্রসমূহ কথাটা বলেছেন, তাফসীরকারগণের কেউই তা চিন্তা করেননি।[6] এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এত দীর্ঘ সময় ধরে কী করে সকল জ্ঞানী-গুণী মহলের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেল তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। পাঠক আপনি কী বলেন?

মীকাতের অর্থ অভিধানে স্থান ও সময় দুইটাই বলা হয়েছে। মূলে এর অর্থ হবে আরম্ভ, সূচনা বা Starting of an event, যার জন্য স্থান ও সময় দুটোরই প্রয়োজন হয়।[7]  তাই মীকাতের বহুবচন মাওয়াকীতু শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ বারটা নবচন্দ্র দিয়ে বার মাসের জন্য বারটা সূচনা বা আরম্ভকে বুঝিয়েছেন। (চান্দ্রমাস, ২১৫-২১৯)

পার্থক্য কোথায়?

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের তরজমা এবং অন্যান্যদের কৃত তরজমার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? তার কথায় তিনটি জিনিসের আলোচনা এসেছে:

১। الأهلة (আল-আহিল্লাহ) বহুবচনের শব্দ। এর তরজমা হওয়া উচিত নবচন্দ্রসমূহ। কিন্তু বাংলা অনুবাদকগণ শুধু নবচন্দ্র বা নতুন চাঁদ লিখেছেন। সমূহ এই বহুবচন নির্দেশক শব্দটি উল্লেখ করেননি।

২। مواقيت (মাওয়াকীত) শব্দটিও বহুবচন। এর তরজমাতেও বাংলা অনুবাদকারীগণ সমূহ লেখেননি।

৩। এই ব্যাপারটি কোনো মুফাসসিরই বুঝতে পারেননি যে, এখানে الأهلة (আলআহিল্লাহ) বহুবচন আনা হয়েছে এজন্য যে, চান্দ্রমাস মোট বারটি। আর প্রত্যেক মাসে একটি করে নতুন চাঁদ। সর্বমোট বারোটি নতুন চাঁদ। অথচ বাস্তবতা এই যে, বারো চান্দ্রমাসের বারোটি নতুন চাঁদ এটা এমন কোনো রহস্য নয় যে, প্রত্যেক মুফাসসিরকেই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বলতে হবে। এটা খুবই সহজ এবং সাধারণ একটি বিষয়। তাই অনেক মুফাসসির এর উল্লেখ প্রয়োজন মনে করেননি। অথচ তাদের এই উল্লেখ না করার অর্থ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বলতে চাচ্ছেন, তারা নাকি বিষয়টা বোঝেননি! আসলে এটা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জ্ঞানের স্বল্পতা বরং তার অপারগতা। তিনি যে বলছেন কোনো মুফাসসিরই এখানে বারো মাসের উল্লেখ করেননি; বাস্তবে কিন্তু বেশ কয়েকজন মুফাসসির বিষয়টি নিয়ে দিব্যি আলোচনা করেছেন।

রইল বহুবচন শব্দের অনুবাদে সমূহ এর উল্লেখ-অনুল্লেখ প্রসঙ্গ। তো এটা কীভাবে অজানা থাকে যে, বহুবচনের অনুবাদে যদি ইসমে জিনস (জাতিবাচক) শব্দ ব্যবহার করা হয় তাহলে বহু-এর অর্থ তাতে এমনিতেই আদায় হয়ে যায়। পৃথক বহুবচন-সূচক শব্দের দরকার হয় না। যেমন বলা হল, বাগানে ফুল ফুটেছে, এর অর্থ কেউ এটা বোঝে না যে, বাগানে কেবল একটি ফুল ফুটেছে। এখন যদি কেউ নিজের বিজ্ঞতা ফলাতে গিয়ে বলে, বাগানে ফুলসমূহ ফুটেছে তাহলে এটা কি বিশাল কোনো কৃতিত্ব হয়ে যাবে, যার জন্য অন্যদের অজ্ঞ মনে করা এবং নিজেকে সংস্কারক মনে করা জরুরি হয়ে পড়বে?! যাইহোক, যেসব অনুবাদক এখানে সমূহ লেখেননি তারা কিছুমাত্র ভুল করেননি। কথার আবহ থেকে বহু-এর অর্থ তাদের তরজমায় প্রতিফলিত হয়। তারপরও বাস্তব ঘটনা হল, অনেক অনুবাদক এ জায়গায় সমূহ শব্দ স্পষ্ট করেই লিখেছেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবই প্রথম এই কর্মযজ্ঞ আঞ্জাম দিচ্ছেন- বিষয়টা সে রকম নয়। কিন্তু আসল রহস্য, যা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মনের মধ্যে রয়েছে এবং যা কিনা তার মতে যুগান্তকারী সংস্কার; অন্যান্য তরজমার সাথে নিজের তরজমার তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে সেটার উল্লেখ করেননি। জানা নেই, কেন তিনি এমনটা করলেন। অথচ এই রহস্য উদ্ঘাটিত হওয়া ছাড়া এটা জানাই সম্ভব হবে না যে, তিনি পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের খেলাফ কী বলতে চান? ঐ রহস্যের কিনারা করতে চাইলে দেখুন, তার লিখিত চান্দ্রমাস পৃ. ৯৬-৯৭ পর্ব ৫৮ এবং পৃ. ২০৬ ও পৃ. ৫৬-৫৮ পর্ব ৩৩ ইত্যাদি।

সেই রহস্যটি এই যেবাস্তবে তো হিলালের অর্থ হচ্ছে অমাবস্যা-পরবর্তী ধনুকাকৃতির জ্যোতির্ময় চাঁদ। সমগ্র দুনিয়া এটাই বুঝতো এবং এখনো এটাই বোঝে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বলছেন, হিলালের অর্থ হচ্ছে অমাবস্যা। তিনি বলছেন, অমাবস্যা থেকে চান্দ্রমাসের সূচনা হবে। দৃশ্যমান নতুন চাঁদ থেকে নয়!!

পাঠকবৃন্দ হয়ত বলবেন, তিনি তো হিলালের তরজমা নবচন্দ্রই করেছেন, অমাবস্যা তো করেননি! ঠিক। এজন্যই তো এটা রহস্য। ভাই, নবচন্দ্রের অর্থ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অভিধানে অমাবস্যা তো তিনি কথা বলছেন তার অভিধান অনুযায়ী আর মানুষ বুঝছেন বাংলা ভাষার অভিধান অনুযায়ী!!

যাইহোক, আরবী হিলাল এবং বাংলা নবচন্দ্রকে যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বিকৃত করে অমাবস্যা করলেন এটা পরিষ্কার ধোঁকাবাজি। এ বিষয়ে সামনে আলোচনা আসছে। প্রথমে আমরা এই তিনটি জিনিস নিয়ে আলোচনা করতে চাই, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যেখানে নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রমাণের চেষ্টা করেছেন এবং অন্যদের দোষারোপ করেছেন।

প্রথম বিষয়

আল-আহিল্লার অর্থ। যেমনটি আমি বলে এসেছি, আয়াতে কারীমার তরজমায় সমূহ না লেখা হলেও বক্তব্যের আবহ থেকে তাতে বহুবচনের অর্থ বোঝা যায়। অধিকন্তু স্বয়ং ইঞ্জিনিয়ার সাহেবও এক জায়গায় সমূহ ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, এর জবাবে আল্লাহ বলেছেন, এই নবচন্দ্র সারা বিশ্বের মানুষের জন্য মাসসমূহ হিসাব করার মাধ্যম (চান্দ্রমাস, পৃ ১১২)

এখানে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজেও কেবল নবচন্দ্র লিখেছেন নবচন্দ্রসমূহ লেখেননি! আরো শুনুন, বইয়ের ১১২ থেকে ১৪১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কুরআনে কারীমের অনেক আয়াত উদ্ধৃত করেছেন, সেগুলোর তরজমার উপর আমরা সংক্ষিপ্ত নযর বুলিয়েছি। তখন লক্ষ্য করলাম, তিনি বহু আয়াতে বহুবচনের অনুবাদ করেছেন একবচনের মতো করে। বহুবচনসূচক কোনো শব্দ সেখানে ব্যবহার করেননি। না সমূহ, না অন্য কিছু!! যেমন,

১। وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ স্পষ্ট নিদর্শন (পৃ. ১১৩)

২। فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ অন্ধকারের মধ্যে (পৃ. ১১৫)

৩। خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ  আসমান ও যমীন (পৃ. ১১৬)

৪। فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ আসমান ও যমীনে আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তাতে নিদর্শন রয়েছে (পৃ. ১১৯)

৫। لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ জ্ঞানবান লোকদের জন্য নিদর্শন (পৃ. ১২১)

৬। عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ বছরের গণনা ও হিসাব (পৃ. ১২২)

৭। خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন (পৃ. ১২৬)

৮। لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ... নিশ্চিত নিদর্শন (পৃ. ১৩২)

এছাড়াও আরো কয়েকটি আয়াতে বহুবচন শব্দের তরজমা করেছেন একেবারে একবচনের মতো। কোনোরকম বহুবচন নির্দেশক শব্দ তিনি ব্যবহার করেননি। অথচ ব্যাকরণের দৃষ্টিতে উল্লিখিত স্থানগুলোতে এমন কিছু শব্দ রয়েছে, যার তরজমা পরিষ্কার বহুবচনের শব্দে করা উচিত।

প্রশ্ন হচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজে বহুসংখ্যক আয়াতে বর্ণিত বহুবচনের তরজমায় না সমূহ লিখেছেন আর না অন্য কোনো বহুবচনসূচক শব্দ, সে লোক আল-আহিল্লা কিংবা মাওয়াকীতু-এর তরজমায় সমূহ না লেখায় কুরআনের অনুবাদকদের প্রতি এত ক্ষুব্ধ কেন? আর নিজে সমূহ লিখেই বা সংস্কারের দাবি করছেন কীভাবে?

আশা করি, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শুনে অসন্তুষ্ট হবেন না যে, তার এই লেখার আগে শুধু নয়; বরং তার জন্মেরও আগে উর্দু, ফার্সীতে লিখিত তরজমা তো বটেই, স্বয়ং বাংলা ভাষাতেও এমন তরজমায়ে কুরআন রয়েছে যেখানে আল-আহিল্লা-এর অনুবাদে সমূহ বা এ ধরনের কোনো শব্দ আছে।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বইয়ের প্রথম প্রকাশ ৪/৫/২০০৬ ঈ. আর তার জন্ম যদ্দূর জানা সম্ভব হয়েছে, ১৯৪০-এর দিকে। এখন লক্ষ্য করুন:

১। মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদি (১৬ শাবান ১৩০৯ হি.-১৩৯৭ হি. মোতাবেক ১৬ মার্চ ১৮৯২ ঈ. - ৬ জানুয়ারি ১৯৭৭ ঈ.) -এর তরজমায়ে কুরআন এবং সংক্ষিপ্ত তাফসীরের বঙ্গানুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বেরিয়েছে ১৯৯৫-এর অক্টোবরে। তাতে আয়াতের তরজমা লেখা হয়েছে: আপনাকে (লোকেরা) নতুন চাঁদগুলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন, তা মানুষের জন্য এবং হজ্জ্বের সময় জ্ঞাপক (তাফসীরে মাজেদী শরীফ ১/৩৫৫)

২। জনাব আকরাম খাঁ (১৮৬৮ ঈ.-১৯৬৮ ঈ.)-এর তরজমায়ে কুরআনের ফাতেহা ও বাকারা অংশ প্রথমবার বেরোয় ১৯৩০ সনে। তাতে আয়াতের তরজমা নিম্নরূপ:

(হে রাসূল!) লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে নূতন চাঁদগুলো সম্বন্ধে, বল এগুলি হইতেছে জনগণের মঙ্গলের জন্য একটা সময় নির্ধারণ- বিশেষ করিয়া হজের জন্য। (২ : ১৮৯) (সরল বাংলা অনুবাদ ও বিস্তারিত তাফসীরসহ, মোহাম্মাদ আকরাম খাঁ, ১/২৩১)

৩। মাওলানা আলী হাসান রাহ., যার মাসলা শিক্ষা নামক বই ১৯১৪ সনে বের হয়েছে। তিনি এবং মাওলানা আব্দুল হাকীম, যার জন্ম ১৮৮৭ তে এবং মৃত্যু ১৯৫৭ ঈসাব্দীতে। এ দুইজনের যৌথভাবে অনূদিত তরজমাতুল কুরআনের দ্বিতীয় পারা, যেখানে আয়াত ২ : ১৮৯ রয়েছে, যেটি ১৯২২ সনে প্রকাশিত হয়- ওখানে আয়াতের তরজমা লক্ষ্য করুন: তাহারা তোমাকে নবচন্দ্রসমূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিতেছে, তুমি বল, উহা মানুষের জন্য ও হজের সময় নিরূপক (কুরআন শরীফ, বিশুদ্ধ বঙ্গানুবাদ ও বিস্তারিত তাফসীর ১/৭৯)[8]

ব্যাখ্যায় লিখেছেন, আহেল্লাত- হেলাল-এর বহুবচন; হেলাল অর্থ দ্বিতীয়ার চন্দ্র অর্থাৎ পরিদৃশ্যমান নবচন্দ্রকলা এই তরজমার একটি কপি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে। যা উসমানিয়া বুক ডিপো কর্তৃক প্রকাশিত। প্রকাশকাল ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ।

৪। শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী (১৬৯৯ ঈ. - ১৭৬৭ ঈ.) তাঁর ফার্সী তরজমায় লিখেছেন,

 می پرسند ترا از ماہ ہاۓبگو اينہا میعاداند ہمرائے مردماں وبراۓ حج

(ফাতহুর রহমান পৃ. ৪৩ মাতবায়ে মুজতাবাঈ ১৩০৪ হি.)

এখানে আহিল্লা এবং মাওয়াকীত দুটোর তরজমাতেই বহুবচননির্দেশক শব্দ রয়েছে।

৫। ফাতহুর রহমান-এর সঙ্গে একই মলাটে শেখ সাদী (৬৯০ হি.) রাহ. -এর ফার্সী তরজমাও ছাপা হয়েছে। এতেও উভয় শব্দের তরজমায় বহুবচনসূচক শব্দ রয়েছে।

৬। শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান রাহ. (১২৮৬ হি. - ১৩৩৯ হি.)-এর তরজমা তো জগদ্বিখ্যাত। মাআরিফুল কুরআনে (মুফতি মুহাম্মাদ শফী রাহ.) আয়াতের নীচে হুবহু এ তরজমাই দেয়া হয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে:

 تجھ سے پوچھتے ہیں حال نئے چاند کا، کہدے کہ يہ اوقات مقررہ ہيں لوگوں کے واسطے،اور حج کے واسطے 

মাওয়াকীত-এর তরজমায় বহুবচনের চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে।

একাধিক ইংরেজি তরজমা থেকে তো স্বয়ং ইঞ্জিনিয়ার সাহেবই উদ্ধৃত করেছেন যে, সেখানে আলআহিল্লাহ এবং মাওয়াকীত দুটোর তরজমাই পরিষ্কার বহুবচন নির্দেশক শব্দে করা হয়েছে।

তার আগে এতগুলো মানুষ যে কথা লিখে গেছেন, সেটার আবিষ্কারক এবং সংস্কারক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব হয়ে গেলেন কী করে?!

 

দ্বিতীয় বিষয়:

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দ্বিতীয় আপত্তি এই যে, অনুবাদকগণ মাওয়াকীত-এর তরজমাও ভুল লিখেছেন। তাতে বহুনির্দেশক শব্দ উল্লেখ করেননি। অথচ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের খবরই নেই যে, মীকাত-এর তরজমা তিনি নিজেই ভুল করে বসে আছেন। অন্য অনুবাদকেরা ঠিক তরজমা লিখেছেন।

চাই স্পষ্ট বহুবচনসূচক শব্দে তরজমা করে থাকুন কিংবা এমন কোনো শব্দে, যাতে পূর্বাপর থেকেই বহুর অর্থ বুঝে এসে যায়।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এই শব্দের তরজমায় তো সমূহের পুরো স্তপ জমা করে ফেলেছেন, কিন্তু তরজমা করেছেন গলদ। তিনি নিজেই তার বইয়ের ১১১ পৃষ্ঠায় একাধিক অভিধানের উদ্ধৃতিতে এর যে অর্থ লিখেছেন, আয়াতের তরজমায় তার মোটেও ধার ধারেননি!

আর সে কারণেই মাওয়াকীত-এর সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কৃত উদ্ভট এই তরজমা তিনি করেছেন: সময়সমূহ (চান্দ্রমাসসমূহ-বারটা) -এর আরম্ভ করার মাধ্যম

আমরা ইতঃপূর্বে অভিধানগ্রন্থসমূহের বরাত দিয়ে উল্লেখ করে এসেছি যে, মীকাতের অর্থ হয়ত সময় কিংবা সময় নির্ণয়ের মাধ্যম। মীকাত যদি সময় অর্থে ব্যবহৃত হয় তাহলে সাধারণত তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে কোনো কাজের জন্য নির্ধারিত সময়। এছাড়াও মীকাতএর আরো বহু অর্থ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো এখানে উদ্দেশ্য নয়। যেমন হাজ্বীদের জন্য শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সেইসব স্থান, যেগুলো ইহরাম ব্যতিরেকে অতিক্রম করা জায়েয নেই। একেও মীকাত বলা হয়। বহুবচনে মাওয়াকীত (প্রকাশ থাকে যে, এই স্থানগুলোকে মীকাত এজন্য বলা হয় না যে, এখান থেকে ইহরাম শুরু করা জরুরি। ইহরাম চাইলে ঘর থেকে বেঁধেও বের হতে পারে। ওগুলোকে বরং মীকাত বলা হয় শেষসীমা হওয়ার বিচারে। কারণ এরপর আর ইহরাম ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। এমনিভাবে মীকাত-এর একটি অর্থ, প্রতিশ্রুত সময়। এদিক থেকে কিয়ামত এবং হাশরের জন্যও মীকাত শব্দ ব্যবহৃত হয়।

যাইহোক هي مواقيت للناس والحج -এ মীকাত দ্বারা উদ্দেশ্য হয়ত নির্ধারিত সময় কিংবা সময় নিরূপণের উপকরণ ও মাধ্যম। যদি সময় অর্থে নেয়া হয় তাহলে মাওয়াকীত-এর অর্থ হবে, সময়সমূহ কিংবা নির্ধারিত সময়সমূহ আর যদি সময় নির্ণয়ের মাধ্যম অর্থ ধরা হয় তাহলে মাওয়াকীত-এর অর্থ হবে, সময় নির্ধারণ করার মাধ্যমসমূহ

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যদি মীকাতকে সময় অর্থে নিতে চান তাহলে তাকে এর তরজমা করতে হবে, সময়সমূহ কিংবা নির্ধারিত সময়সমূহ তারপর যদি তার কাছে কোনো প্রমাণ থাকে তাহলে এর ব্যাখ্যা বার মাস দিয়ে করতে চান তো করবেন। কিন্তু কোনো প্রমাণ তো নেই। উল্টো এর পক্ষে প্রমাণ রয়েছে যে, এখানে উদ্দেশ্য, মানুষের ইবাদাত ও লেনদেনের সময়। অন্য প্রমাণাদি ছাড়াও والحج শব্দও এর পক্ষে খুবই স্পষ্ট ও বড় আলামত। যাইহোক সময়সমূহ কিংবা নির্ধারিত সময়সমূহ বলার পর মাওয়াকীত-এর তরজমা পুরা হয়ে গেছে। এখন আরম্ভ করার মাধ্যম, হিসাব করার মাধ্যম, শুরুসমূহ এসব বলার তো কোন অবকাশ বাকি থাকে না। এই শব্দগুলো আয়াতে বিদ্যমান কোন্ আরবী শব্দের তরজমা? কোনোটারই নয়। এগুলো বরং ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পক্ষ থেকে সরাসরি নিজস্ব সংযোজন। আর শুরুসমূহ তো একেবারে অপরিচিত, অপ্রাসঙ্গিক। মীকাত-এর একাধিক অর্থ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ঐ সব অর্থের মধ্যে শুরু এবং সূচনার কোনো নামগন্ধও নেই। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যদি জিদ ধরেন তাহলে আরবী অভিধানমালার একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ থেকে হলেও এ অর্থটি উদ্ধৃত করুন! এবং ৬৪ পৃষ্ঠায় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজের দাঁড় করানো অর্থের পক্ষে আবেগতাড়িত হয়ে এক দুর্দান্ত কাজ করে ফেলেছেন। সেটা হল مواقيت الصلاة -এর তরজমা করেছেন সালাতের আরম্ভসমূহ অথচ এর অর্থ হচ্ছে, সালাতের নির্ধারিত সময়সমূহ বেচারা বোধহয় এটাও চিন্তা করেননি যে, নামাযের সূচনা হয় তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে, কেবল সময় আরম্ভ হওয়ার দ্বারা নয়!

আর যদি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মীকাত-কে সময় নির্ধারণের মাধ্যম অর্থে নিতে চান তাহলে মাওয়াকীত-এর তরজমা হবে সময় নির্ধারণের মাধ্যমসমূহ এই তরজমাও পূর্ণাঙ্গ এবং সঠিক। এই তরজমা করা হলে সময়সমূহ শব্দের ব্যবহার অপ্রাসঙ্গিক। এখানে এর কোনো অবকাশ নেই। যদি কোনো সুযোগ থাকত তাহলে পরে তার দ্বারা বার মাস উদ্দেশ্য নেয়ার পক্ষে প্রমাণের দরকার হত।

এই হলো সুরতেহাল। কিন্তু আপনারা দেখেছেন, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মীকাত এর আলাদা আলাদা দুটো অর্থকে একসাথে করে একটি অর্থ দাঁড় করিয়েছেন এবং তাকেই মাওয়াকীত-এর তরজমা সাব্যস্ত করেছেন। এই প্রক্রিয়া আরবী-বাকরীতির সম্পূর্ণ রুচিবিরুদ্ধ হওয়ায় তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কিন্তু এই অচল ও অবাস্তবকে আঁকড়ে ধরেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সংস্কারের যত গর্ব আর অহংকার!! অথচ ভাষার সঙ্গে যার সামান্য সম্পর্কও আছে তিনি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের তরজমা পড়ে হতবাক হবেন। কে না জানে যে, বহুবচন শব্দের তরজমায় একটাই বহুবচনসূচক শব্দ ব্যবহৃত হয়, দুটো না। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মাওয়াকীত এর তরজমা করতে গিয়ে লিখেছেন:

আবার মীকাত এর বহুবচন মাওয়াকীতু শব্দ দিয়ে আল্লাহ বার মাসের সময়সমূহের শুরুসমূহ নির্ধারণের কথা বলেছেন। উপরোক্ত আয়াতের মর্মার্থ বিশ্বব্যাপী তফসীরকারগণ সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন না কেন তা আমার বোধগম্য নয়; (চান্দ্রমাস, নবম সংস্করণ পৃ. ২১)

এই যে বার মাসের সময়সমূহের শুরুসমূহ এখানে একটিমাত্র বহুবচন-শব্দের জন্য (মাওয়াকীত) দুই দুই বার সমূহ ব্যবহার কীভাবে সম্ভব হল? যে কেউ বুঝতে পারবেন, এটা এ কারণেই হয়েছে যে, এখানে এক শব্দের অধীনে দুই শব্দের তরজমা করা হয়েছে। একটি আয়াতে আছে, আরেকটি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজের তরফ থেকে যোগ করেছেন।

আরো মজার বিষয় হল, পৃ.২১ এবং ২১৫-২১৬ তে যে তরজমা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব করেছেন তাতে বহু-নির্দেশক শব্দ নেই। কেবল অতিরিক্ত যোগ করা শব্দে বহু-নির্দেশক রয়েছে। আবারো দেখুন:

বলে দিন এগুলো সময়সমূহের আরম্ভ করার মাধ্যম। (পৃ. ২১, ২১৫)

আপনি বলে দিন এগুলো সূচনাকারী বা আরম্ভ করার মাধ্যম (বার মাসসমূহের) (পৃ.২১৬)

উভয় তরজমাতেই মীকাত এর অর্থ গলদ করেছেন। আরবী অভিধানে মীকাতের কোনো  অর্থ সূচনাকারী বা আরম্ভ করার মাধ্যম নেই। সুতরাং তরজমা তো ভুল করেছেনই, এদিকে বহু-নিদের্শক শব্দ বসাতে ভুলে গেছেন! সেটা লাগিয়েছেন সময়-এর সাথে, যা তার পক্ষ থেকে যোগ করা। আর সম্ভবত সে কারণেই দ্বিতীয় তরজমায় এটাকে বন্ধনীতে রেখেছেন। কিন্তু যে জিনিস আয়াতে উদ্দেশ্যের অন্তর্গত নয় তাকে বন্ধনীতেও রাখা যায় না।

এটা ঠিক যে, কখনো কখনো বক্তব্যের মাঝে কোনো কোনো শব্দ অনুক্ত থাকে। কিন্তু উহ্য রাখতে হলে কিছু না কিছু আলামত উপস্থিত থাকা জরুরি। এখানে مواقيت (মাওয়াকীত) -এর পরে الشهور (মাসসমূহ) উহ্য থাকার পক্ষে কোনো আলামত বা প্রমাণ নেই। এ কারণেই আজ পর্যন্ত কোনো আলেম এমন ব্যাখ্যা করেননি। বরং সাহাবা-তাবেঈন যুগ থেকে সবাই এই অর্থই বুঝে আসছেন যে, হিলালসমূহ অর্থাৎ হিলালী মাসসমূহ মানুষের ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন এবং বিশেষভাবে হজ্বের জন্য মীকাত।

যাই হোক, এই ভুল বরং তামাশা তো হল মাওয়াকীত এর তরজমা প্রসঙ্গে। আরো একটি ভুল তিনি করেছেন, مواقيت (মাওয়াকীত)-এর পর الشهور (আশশুহুর) শব্দ উহ্য মেনে বক্তব্য শেষ করে দিয়ে। আর সেজন্যই (মাওয়াকীত)-এর উপর ওয়াকফ করে  للناس والحج অংশকে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। তরজমা ও তফসীর দুটোই করেছেন এমনভাবে, যার দাবি হলো للناس উহ্য মুবতাদার খবর। অথবা هي মুবতাদার দ্বিতীয় খবর। অথচ বাস্তবে للناس তার মাতুফকে নিয়ে مواقيت এর ছিফত। এবং মাওছুফ-ছিফত মিলে هي মুবতাদার খবর। মূলরূপ এরকম: مواقيت كائنة للناس কুরআনে কারীমের নাহবী তারকীব (ব্যাকরণের সূত্র মেনে বিশ্লেষণ) -এর জন্য ইরাবুল কুরআনের যেসব পুস্তক লেখা হয়েছে তার মধ্যে থেকে শুধু তিনটি কিতাবের উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি। ১. ইরাবুল কুরআন শাস্ত্রের ইমাম ও পণ্ডিত শিহাবুদ্দীন আসসামীন (৭৫৬ হি.) লিখেছেন:

و "للناس" متعلق بمحذوف، لأنه صفة لـ "مواقيت" أي: مواقيت كائنة للناس....

قوله: {والحج} عطف على "الناس"، قالوا: تقديره: ومواقيت الحج، فحذف الثاني اكتفاء بالأول،

ولما كان الحج من أعظم ما تطلب مواقيته وأشهره بالأهلة أفرد بالذكر، وكأنه تخصيص بعد تعميم، إذ قوله "مواقيت للناس" ليس المعنى لذوات الناس، بل لا بد من مضاف أي: مواقيت لمقاصد الناس المحتاج فيها للتأقيت، ففي الحقيقة ليس معطوفا على الناس، بل على المضاف المحذوف الذي ناب "الناس" منابه في الإعراب.

(আদ-দুররুল মাসূন ফি উলূমিল কিতাবিল মাকনুন, শিহাবুদ্দীন আসসামীন, ১/৪৭৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত, প্রকাশকাল, ১৪১৪ হিজরী)

২. "مواقيت" خبر مرفوع، "للناس" جارّ ومجرور متعلّق بمحذوف، نعت لمواقيت"

(আল-জাদওয়াল ফি ইরাবিল কুরআন ও ছারফিহি ও বায়ানিহি মাহমূদ ছাফী (১৯৮৫ ইং.) ১/৩৮৬, দারুর রশীদ দামেস্ক ১৪১৮ হি.)

৩. للناس، الجار والمجرور متعلقان بمحذوف، صفة لمواقيت 

(রাবুল কুরআনিল কারীম ওয়া বায়ানুহু মুহিউদ্দীন আদ-দারবিশ (১৩২৬-১৪০৩ হি.) ১/২৪৮, দারুল ইয়ামামা ও দারু ইবনে কাছীর, বৈরুত, ১৪২৬ হি., নবম মুদ্রণ)

আরবী ভাষা ও কুরআনে কারীমের ভাষা অলঙ্কার সম্পর্কে যার কিছুমাত্র জ্ঞান আছে তিনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের তাফসীরে সেই তারকীব (বাক্যবিশ্লেষণের ধারা) রক্ষিত হয়নি, যা ইরাবের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ বর্ণনা করেছেন। আর তার তরজমা ও ব্যাখ্যা থেকে যে তারকীব বোঝা যায় তা কুরআনের ভাষা-অলঙ্কারের সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এবং এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে  والحج শব্দটি একদম অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।  الناس এর উপর তাকে عطف (আতফ) করা অর্থহীন হয়ে পড়ে তখন। عطف (আতফ)-এর প্রাসঙ্গিকতা সৃষ্টির জন্য বক্তব্যের মাঝে একটা কিছু উহ্য মানতে হয়, যা সাধারণ নিয়মে পড়ে না।

 যেমনটি পূর্বেই বলা হয়েছে, তার ব্যাখ্যার দাবি এই যে, ওয়াকফ করা হবে مواقيت-এর উপর। অথচ কুরআনে কারীমের কোনো একটি মুতাওয়াতির কেরাতের বিচারেও এখানে ওয়াকফ হয় না। না ওয়াকফে লাযেম, না ওয়াকফে তাম। কোনো প্রকার ওয়াকফ বা বিরামের সুযোগ নেই এখানে।

যাক, এই ইলমী আলোচনা তো লেখা হল তালিবে ইলম ভাইদের জন্য। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে শুধু এটুকুই বলতে চাই, কোনো আয়াতের এমন কোনো অর্থ যা আজ পর্যন্ত কোনো মুফাসসির, কোনো মুতারজিম এবং কোনো একজন আলেমে দ্বীনের চিন্তায়ও আসেনি এটাই প্রমাণ করে যে, এই অর্থ ভিত্তিহীন। তা যদি কারো চিন্তায় আসে তো এটা তার কোনো বিশেষত্বের সনদ নয়; বরং বিচ্ছিন্নতার লক্ষণ। তার জন্য আনন্দের নয়, আক্ষেপের কারণ। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব হচ্ছেন সেই লোক, যে আসতাগফিরুল্লাহ -এর জায়গায় আলহামদুলিল্লাহ পড়ে এবং বিকৃতি ও সর্বনাশকে সংশোধন ও সংস্কার মনে করে!! খোদার বান্দা! আল্লাহ তাআলা কুরআন ও সুন্নাহর অর্থ ও বিধিবিধান এবং এর আমলি নকশা  (বাস্তবরূপ) সবকিছুর হেফাযত ও সংরক্ষণ করেন ইলমের ন্যায়নিষ্ঠ ধারক ও বাহকদের মাধ্যমে। এমন লোকের মাধ্যমে নয়, যাদের কুরআন ও হাদীসের ভাষার আলিফ-বাও জানা নেই। হাঁ, দ্বীনের সাহায্য যে কারো মাধ্যমেই করিয়ে নেন। এমনকি ফাজের ও পাপাসক্ত ব্যক্তির দ্বারাও। দ্বীনের নুছরত বা সাহায্য আর দ্বীনের ইলম ও বিধানাবলীর সংরক্ষণ দুটো এক জিনিস নয় যে, একটাকে অপরটার সাথে তুলনা করা হবে। সুতরাং উলামায়ে কেরামের ইজমার পরিপন্থী কোনো কিছু যদি কোনো গবেষকের মনে আসে তাহলে তার জন্য জরুরি, সে এটাকে শয়তানের ওয়াসওয়াসা মনে করবে। তা না করে একে রহমানী ইলহাম (উপর ওয়ালার দান ) মনে করা একটি স্বতন্ত্র গোনাহ।

 

তৃতীয় বিষয়

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের তৃতীয় অভিযোগ এই যে, কোনো মুফাসসির এটা বুঝতেই পারেনি যে, আয়াত ২ : ১৮৯ -এর সাথে সূরা তাওবার ৯ : ৩৬ আয়াতের সম্পর্ক রয়েছে। অথচ এটা এত স্পষ্ট বিষয় যে, সাধারণভাবে মুফাসসিরগণ তা উল্লেখের প্রয়োজন বোধ করেননি।

আর ব্যাপারটা এমনও নয় যে, মুফাসসিরদের মধ্যে কেউই এর উল্লেখ করেননি। বরং অনেকেই উল্লেখ করেছেন। আর বুঝেছেন তো সকলেই। এমন সহজ সাধারণ একটা বিষয় কোনো মুফসসির বুঝবেন না তা কী করে হয়? ইঞ্জিনিয়ার সাহেব হয়ত চাচ্ছেন যে, সবাই ওনার মতো আয়াত ২ : ১৮৯-এর অধীনে বারো মাসের কথা مواقيت (মাওয়াকীত) শব্দের অর্থ বা মর্ম হিসেবে বলুক। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। কারণ এতো হবে ভুল ব্যাখ্যা। তাই আমার জানা মতে তাদের কেউ এই কাজ করেননি। বাকি, যে প্রসঙ্গে বারো মাসের উল্লেখ এখানে আসতে পারে সেভাবে অনেকে তার উল্লেখ করেছেন।

এখানে একটি প্রাচীন তাফসীরের ভাষ্য উদ্ধৃত করা হচ্ছে এবং আরো কিছু তাফসীরের শুধু হাওয়ালা উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে হচ্ছে। ইমাম আবু জাফর ত্বহাবী (২৩৯-৩২১ হি.) -এর প্রসিদ্ধ তাফসীর আহকামুল কুরআন-এর দুই খণ্ড আলহামদুলিল্লাহ ছেপে এসেছে। ঐ তাফসীরে আয়াত ২ : ১৮৫

 (فمن شهد منكم الشهر فليصمه)

-এর অধীনে তিনি লিখেছেন:

وكان شهر رمضان الذي ذكره الله عز وجل لنا شهرا معقولا بالأهلة التي جعلها لنا مواقيت بقوله تعالى: {يسألونك عن الأهلة قل هي مواقيت للناس والحج} ، فأعلمنا عز وجل أن الأهلة مواقيت لنا لحجنا، ولما سوى ذلك مما نحتاج إلى الأوقات فيه من أمور ديننا من الصيام، والعدد، والإيلاءات، وما أشبه ذلك، ولما نحتاج إليه من أمور دنيانا في معاملاتنا وحلول آجال ديوننا ولم يبين لنا عز وجل في هذه الآية عدة الشهور التي تعلم بالأهلة، وبينه لنا في سورة براءة بقوله عز وجل: {إن عدة الشهور عند الله اثنا عشر شهرا في كتاب الله يوم خلق السموات والأرض منها أربعة حرم} فأخبر عز وجل أن عدة هذه الشهور التي جعلها مواقيت اثنا عشر شهرا

অর্থাৎ রমযানের মাস হিলালের মাধ্যমেই জানা যায়। যাকে আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য মীকাত সাব্যস্ত করেছেন তাঁর এই পবিত্র ভাষ্যে:

 يسألونك عن الأهلة قل هي مواقيت للناس والحج

তো আল্লাহ তাআলা আমাদের বলে দিয়েছেন যে, হিলাল হচ্ছে আমাদের হজ্ব এবং অন্যান্য ইবাদত ও লেনদেনের জন্য মীকাত, যে সব ক্ষেত্রে আমাদের সময় রক্ষার দরকার হয়।

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঐ মাসগুলোর সংখ্যা বর্ণনা করেননি, যেগুলো জানা যায় হিলালের মাধ্যমে। সেটা বর্ণনা করেছেন সূরা বারাআতে (সূরা তাওবায়) এই বাণীতে:

 إن عدة الشهور عند الله اثنا عشرشهرا  

অর্থাৎ হিলালী মাসসমূহ, যাকে আল্লাহ মীকাত বানিয়েছেন তার সংখ্যা হল বারো...

(আহকামুল কুরআন, আবু জাফর ত্বহাবী ১/৩৪১, কিতাবুস সিয়াম ওয়াল ইতিকাফ, মারকাযুল বুহুছিল ইসলামিয়া ইস্তাম্বুল প্রকাশিত, ১৪১৬ হি. মোতাবিক ১৯৯৫ ঈ.)

এত প্রাচীন এবং এত পরিষ্কার ভাষ্য থাকা সত্তে¡ও কি এ কথা বলার অবকাশ আছে যে, আয়াত ২ : ১৮৯ এবং ৯:  ৩৬-এর মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টি কোনো মুফাসসির উল্লেখ করেননি? ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তো কেবল উল্লেখ না করা নয়; তিনি বরং বলছেন, কেউ বোঝেইনি! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

আয়াত ২ : ১৮৯-এর অধীনে চান্দ্রমাসের প্রসঙ্গ ধরেছেন আরো যেসকল মুফাসসির তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনের শুধু হাওয়ালা দেখুন:

১. ইমাম আবুল হাসান আল-মাওয়ারদি (৩৬৪ হি.-৪৫০ হি.), আন-নুকাতু ওয়াল উয়ূন (তাফসীরুল মাওয়ারদি) ১/২৪৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত।

২. ইমাম আবু আবদিল্লাহ কুরতুবি (৬৭১ হি.) আল-জামে লি আহকামিল কুরআন, ৩/২২৯ মুআস্সাসাতুর রিসালা, বৈরুত।

৩. আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে আলী শাওকানী রাহ. (১১৭৩ হি.-১২৫০ হি.) ফাতহুল ক্বদীর আলজামে বাইনা ফাননাইর রিওয়াতি ওয়াদ দিরায়াতি মিন ইলমিত তাফসীর, ১/২১৭, দারে ইবনে কাছীর দামেস্ক, প্রকাশকাল: ১৪১৪ হি.

৪. আল্লামা সিদ্দীক হাসান খান (১২৪৮ হি.-১৩০৭ হি.) ফাতহুল বায়ান ফী মাকাছিদিল কুরআন ১/৩৮২, আল-মাকতাবাতুল আছরিয়্যা, বৈরুত, ১৪১২ হি.

আরো দেখুন:

৫. আল-মুহাররারুল ওয়াজিয ফী তাফসীরিল কিতাবলি আযীয, আবু মুহাম্মাদ ইবনে আতিয়্যা আন্দালুসি (৫৪১ হি.) ২/১৩৪, দোহা, কাতার, প্রকাশকাল: ১৪০১ হি.

৬. তাফসীরে মাজেদী পৃ. ৯৫, টীকা  ৬৮৯, তাজ কোম্পানি।

যাইহোক, এই হচ্ছে সেই তিন জিনিস যার উপর ভিত্তি করে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব সমস্ত মুতারজিম ও মুফাসসিরদের ভুল ধরেছেন এবং নিজেকে  হাজার বছরের ভুলের সংশোধনকারী দাবি করেছেন। পাঠকবৃন্দ  এর হাকীকত ও আসল রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন। এবার বলুন, এখানে কোন বিষয়টি এমন আছে, যাতে মুতারজিম ও মুফাসসিরগণ ভুল করেছেন এবং সেই ভুলের কারণে হাজার বছর কালব্যাপী বিশৃঙ্খলা চলে আসছে? এবং এখানে কোন বিষয়টা এমন আছে, যাতে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এমন কোনো কর্মযজ্ঞ আঞ্জাম দিয়েছেন, যার ফলে ঐ বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটেছে? তাহলে কী দরকার ছিল এত কিছু দাবি করার এবং নিজের বইকে যুগান্তকারী সংস্কার বলার?!

(পরবর্তী শিরোনাম: ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কর্তৃক হিলাল এর বিকৃতি সাধন চলবে ইনশাআল্লাহ।)

দৃষ্টি আকর্ষণ:

জুমাদাল উলা ১৪৩৬ হি. সংখ্যায় চান্দ্রমাস একটি পর্যালোচনা-এর প্রকাশিত অংশের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় লক্ষণীয়:

১। প্রবন্ধের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় (আল কাউসার গত সংখ্যার পৃষ্ঠা ৮) তৃতীয় কলামের প্রথম প্যারা কিছু সংযোজনসহ এভাবে পড়তে হবে:

সুতরাং বর্ষগণনা এবং মাসসমূহের হিসাব সাধারণভাবে বোঝার সম্পর্ক কেবল চাঁদের হিলাল আকৃতির সাথে নয়; বরং তার ক্রমাগত তিথি পরিবর্তন ও রূপ বদলের সাথে। খোদ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ১০ : ৫-এর অধীনে লিখেছেন:

বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, চন্দ্র সূর্য থেকে আলো পায়। এই জ্যোতির হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে একটা মাসের সৃষ্টি হয় যার ব্যাপ্তি এক নবচন্দ্রোদয় দিয়ে শুরু এবং আরেক নবচন্দ্র দিয়ে শেষ। (চান্দ্রমাস, পৃ.১১৮)

তাই চাঁদের হিলাল আকৃতি থেকে নিয়ে পরবর্তী হিলালের রূপ লাভ পর্যন্ত তার এই সবগুলি পর্যায়কে ইঙ্গিত করে আয়াতে أهلة  বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। আরবী ভাষার বাগ্ধারা ও গদ্যরীতি সম্পর্কে যার জানা নেই, তার এখানে এই প্রশ্ন জাগতে পারে যে, هلال (হিলাল)-এর অর্থ হল নবচন্দ্র তো একে বহুবচনরূপে ব্যবহার করে চাঁদের সবগুলি আকৃতির প্রতি ইঙ্গিত কীভাবে হয়? কিন্তু ভাষা সম্পর্কে যার জানাশোনা আছে এবং আরবী অলঙ্কার শাস্ত্রের সনআতে তাগলীব সম্পর্কে যার জানা আছে তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারবেন যে, أهلة-কে বহুবচন হিসেবে ব্যবহার করে চাঁদের সবগুলি আকৃতির প্রতি ইঙ্গিত করা খুব সহজেই সম্ভব। অনেক মুফাসসির এই সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন।

২। ১০ নম্বর পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় কলামের মাঝামাঝি طَلْق بن علي রা.-এর নাম এসেছে। বাংলায় লেখা হয়েছে: তলাক এর সঠিক উচ্চরণ হবে তাল্ক

এই ভুলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বান্দা হযরত মাওলানা আব্দুল মতিন দামাত বারাকাতুহুম, জামেয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা- এর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।

৩। তিনি ৮ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লিখিত আয়াত ৩৬ : ৩৯-এ كالعرجون القديم-এর তরজমা সম্পর্কে বলেছেন যে, العرجون-এর তরজমায় শাখা শব্দ খুব একটা উপযোগী নয়। তার কথা ঠিক। কারণ العرجون  তো আসলে حامل التمر খেজুরের কাঁদি বহনকারী দণ্ডের নাম। শাখা বললে চিন্তা যায় ডালের দিকে। কিন্তু আমরা অবশ্য লিখেছি খেজুরশাখা খেজুর গাছের শাখা নয়। এতে হয়ত কাছাকাছি অর্থ আদায় হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে আরো ফিকির এবং মশওয়ারা করা যেতে পারে।

এই দুইটি পরামর্শের জন্য বান্দা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাঁকে জাযায়ে খায়ের নসীব করুন। আমীন। (আবদুল মালেক)

 

 



[1] সপ্তম সংস্করণে তরজমা ছিল এ রকম: সূরা বাকারার ২ : ১৮৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, (তারা) আপনার কাছে নবচন্দ্রসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বা জানতে চায়। বলে দিন, এগুলো (নতুন চাঁদসমূহ) সময়সমূহ (চান্দ্রমাসসমূহ) নির্ধারণ (গণনা বা হিসাব) করার মাধ্যম, পুরো মানবজাতির জন্য (লিননাছ) এবং হজ্জের জন্য (চান্দ্রমাস, সপ্তম সংস্করণ পৃ. ১৫)

তরজমায় পার্থক্য কেন করলেন কিছু বলেননি। আগে নির্ধারণ-এর পরে বন্ধনীতে গণনা বা হিসাব লিখেছিলেন আর এখন আরম্ভ-এর পরে শুধু হিসাব লিখেছেন! প্রশ্ন হল গণনা বা হিসাব- এটা নির্ধারণ অথবা আরম্ভ-এর অনুবাদ নাকি ব্যাখ্যা?

দুটো তরজমাতেই مواقيت (মাওয়াকীত)-এর অর্থ ভুল লিখেছেন। একটু পরেই যার বিস্তারিত আলোচনা আসছে। আবার مواقيت দ্বারা উদ্দেশ্য নিয়েছেন বারো চান্দ্রমাসএটাও ভুল। পাঠকগণ ইতঃপূর্বে সঠিক ব্যাখ্যা পড়ে এসেছেন। কিছু বিস্তারিত সামনেও আসছে। (আবদুল মালেক)

[2] সপ্তম সংস্করণে ছিল : তাই হিজরী মাস গণনা করতে হয় নতুন চন্দ্রোদয় দেখে (পৃ. ১৫) উদয় এবং দেখার বিষয়টি নবম সংস্করণে ফেলে দিয়েছেন কেন?

প্রশ্ন হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যে উদয় এবং দেখার বিষয়টি নবম সংস্করণে বাদ দিলেন তাতে কথার কী সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেল? আগে তো বক্তব্য পরিষ্কার ছিল, এখন অস্পষ্ট হয়ে গেল! আসল কথা হল, আগে তার হুঁশ ছিল না যে, এই শব্দগুলো তার সংস্কার (মূলত বিকৃতি)-এর দাবিকে অপাঙক্তেয় করে ফেলে। পরে যখন খবর হল তখন ব্যস সেগুলো ফেলে দিলেন! (আবদুল মালেক)।

[3] আয়াতে কোথায় আছে হিসাবের কথা? কোথায় বা একক হিজরী বৎসরের কথা? হিলাল পুরো মানবজাতির জন্য মীকাত, কিন্তু তা একক এ কথা কুরআনে কোথায়?! যখন একক চান্দ্রক্যালেন্ডার নয় শুধু, আগাম তৈরি করা ক্যালেন্ডারের চিন্তাও ছিল না তখন কি হিলাল মীকাত ছিল না? হিলালের মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করা হত না? (আবদুল মালেক)।

[4]  মাওয়াকীত-এর তরজমায় আরম্ভ এবং বারো মাস এগুলো ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পকেট থেকে যোগ করা। মাওয়াকীত-এর অর্থের মধ্যে এগুলো অন্তর্ভুক্ত নয়। তিনি নিজেই তার বইয়ের ১১১ পৃষ্ঠায় বিভিন্ন অভিধানের বরাতে مواقيت (মাওয়াকীত)-এর অর্থ লিখেছেন। সেখানেও এ জিনিসগুলো নেই। (আবদুল মালেক)

[5] এটা বোধগম্য হওয়ার কথাও না। মুফাসসিরগণ তো সঠিক ব্যাখ্যা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আসলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবেরই নিজের বোধ-বুদ্ধির চিকিৎসা নেওয়া উচিত (আবদুল মালেক)।

[6] এ রকম নয় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব! একটু ধৈর্য ধরুন! (আবদুল মালেক)।

[7] আপনার বক্তব্যমতেই যখন অভিধানগুলোতে মীকাত-এর অর্থ লেখা হয়েছে সময় এবং স্থান; আর এখানে সময় অর্থই উদ্দেশ্য, তখন আপনি সূচনা এবং আরম্ভ-এর অর্থ নিজের তরফ থেকে কেন এবং কীভাবে আবিষ্কার করলেন? শব্দ এবং পরিভাষার ক্ষেত্রে কি নিজস্ব মতামত চলে? শব্দকে ভাষাভাষীদের মধ্যে প্রচলিত, অনুসৃত ও স্বীকৃত অর্থ এবং উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে যেমনখুশী অর্থ তাতে চাপিয়ে দেওয়াই তো সবরকম বিকৃতির গোড়া। (আবদুল মালেক)

[8] সদরুদ্দীন আহমদ চিশতি বিপথগামী চিন্তা-বিশ্বাসের লোক। তাফসীর লিখেছেন- সেটাও বাতেনী। কিন্তু আয়াত ২ : ১৮৯-এর তরজমা (তাফসীর নয়) তিনিও সঠিক লিখেছেন। লিখেছেন: তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে নূতন চাঁদসমূহ সম্বন্ধে। বলিয়া দাও এইগুলো ইনসানের জন্য এবং হজের জন্য ওয়াক্ত করা হইয়াছে (কোরআন দর্শন সদরুদ্দীন আহমদ চিশতি ২ : ১৮৯) তো এখানেও সমূহ রয়েছে। এটা ছাপা হয়েছে ২০০০ সালে।

 

 

advertisement