দ্রব্যমূল্য ও শিক্ষানীতি : কিছু সহজ সরল কথা
মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ
সহকর্মীদের পক্ষ থেকে আমাকে ফরমায়েশ করা হয়ে থাকে কারেন্ট ইস্যু বা চলতি ঘটনাবলির উপরে লেখার। সে হিসেবে এবার তারা আমার লেখার বিষয় ঠিক করেছেন, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’। লেখাটি শুরু করার আগেই নতুন ইস্যু সৃষ্টি হয়েছে। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন যে, আমি দ্রব্যমূল্যের কথাই বলতে চাচ্ছি। শিরোনামেও তা আছে এবং এটিই এখন সাধারণ মানুষের প্রধান সমস্যা। ক্রমবর্ধমান আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য যে নিম্ন আয়ের মানুষ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হতদরিদ্র শ্রেণীর কী পরিমাণ নাভিশ্বাস তুলেছে তা হয়ত ভুক্তভোগীরা ছাড়া অন্য কেউ অনুভব করতে পারছে না।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পূর্ব থেকেই তাদের নির্বাচনী ইশতিহারে এবং প্রচারণী সভায় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার বিষয়টিকে অন্যতম অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছিল এবং মন্ত্রীবর্গ বড় বড় বক্তৃতা দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যেই সকল সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারা বলেছেন, জোট সরকারের সময় বিভিন্ন ভবনের কমিশনের কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। এখন দেশ সেসব থেকে মুক্ত। তাই দ্রব্যমূল্য নিম্নমুখী করতে কোনো বাধা নেই। কিন' সরকারের এক বছর পূর্ণ না হতেই আম জনতা কী দেখল? দু’একটি পণ্য ছাড়া প্রায় সকল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি এবং তা দিন দিন বাড়ছেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয় এ নিয়ে যে কী বলেছেন তা একসময় তিনি নিজেই বুঝতে পেরেছেন। তাই এক দিন তিনি সত্য উচ্চারণ করলেন এ বলে যে, ‘অনেকে বলে থাকে আমার বেশি কথা বলার কারণেও নাকি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে’।
এবার রমযান আসার অনেক পূর্ব থেকে সরকারের বিভিন্ন মহলের কথাবার্তায় মানুষ কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। বলা হয়েছিল, কিছুতেই সিন্ডিকেট করতে দেওয়া হবে না। টিসিবিকে সক্রিয় করা হবে এবং কোনোক্রমেই রমযানে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে দেওয়া হবে না। কিন' রোযা আসার আগেই ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন এতগুলো কথা বলা হল? কেন মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল? কেন সিন্ডিকেটকারী ও মুনাফাখোরদের স্পর্ধা আরো বাড়িয়ে দেওয়া হল? আর টিসিবির পণ্যের দাম যদি বর্ধিত বাজার মূল্যের সমান বা কাছাকাছিই হয় তাহলে এর দরকারই বা কী? সে বাজারে কে যাবে পণ্য কিনতে? রাষ্ট্র তথা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের অপচয় করা ছাড়া এ সংস'ার কাজ কী?
ইতিমধ্যে আরেকটি অযৌক্তিক ও অবাক কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তা হচ্ছে রমযানের শুরুর সময় হঠাৎ করে কিছু পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে দ্রব্যমূল্য কমানোর কথা বলে। অথচ এ ঘোষণার পর যে পণ্য আমদানি হবে তা দেশে পৌঁছাতে সময় লাগবে কমপক্ষে রোযার শেষ পর্যন-। তাহলে এ কাজটি করা হল কার স্বার্থে? মোটকথা, বাজারমূল্য নিয়ে এখন সরকারে চলছে হ-য-ব-র-ল অবস'া। মনে হচ্ছে, তারা একেবারেই খেই হারিয়ে ফেলেছেন। একজন বয়োবৃদ্ধ সিনিয়র মন্ত্রী মন-ব্য করে বসলেন, ‘দ্রব্যমূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও জনগণের মধ্যে ক্ষোভ নেই।’ বাক্যটি যে জ্বলন- আগুনে পেট্রোল ঢালার মতোই তা তো আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। এ মূল্যই যদি হয় ‘কিছুটা’ বৃদ্ধি, তাহলে আসল বৃদ্ধি কোনটা হবে তা চিন-া করাও হয়ত সম্ভব নয়। আর মানুষের মধ্যে ‘ক্ষোভ’ তিনি দেখতে পাননি। আসলে ক্ষোভের সংজ্ঞা যে তাদের নিকট কী এবং মানুষ বলতে তারা কাদেরকে বুঝেন, দেশের হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের ৭০-৭৫% লোককে তারা মানুষ মনে করেন কি না এ প্রশ্নগুলো এখন সহজেই উঠে আসছে। আমরা মনে করি, ক্ষোভের বিষয়টি মূলত অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত। মন দিয়ে তা বুঝতে হয় এবং দেখতে হয় অন-রাত্মা বা দিলের চক্ষু দিয়ে। সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা বুঝতে হলে তাদের কাছাকাছি যেতে হবে। নিকট থেকে দেখতে হবে তাদের সমস্যাগুলো এবং অনুভব করতে হবে অন-র দিয়ে। যেমনটি করেছিলেন খলীফা হযরত ওমর রা.। অন্ধকার রাতে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে এবং স্বশরীরে বাজার পরিসি'তি পর্যবেক্ষণ করত: পয়োজনীয় ব্যবস'া গ্রহণ করে। এখন প্রশ্ন হল, এ অনুভুতি আমাদের মধ্যে আসবে কিভাবে?
হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক! এ কোটি টাকা মূল্যের প্রশ্নের জবাব হল, এ অনুভূতি আসবে মানবজাতির ইহ ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র সনদ ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করে তা বাস-বায়নের মাধ্যমে। রাষ্ট্র পরিচালনা, বাজার ব্যবস'াপনা ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষাগুলো জানতে হবে। দরিদ্র সমাজ সম্পর্কে রাষ্ট্রের কী দায়িত্ব, বিত্তশালীদের কী কর্তব্য, ব্যবসায়ীদের কী করণীয় তা জানতে হবে। মজুতদারী, মুনাফাখোরী, সিন্ডিকেট গঠন ও কৃত্রিমভাবে মূল্য বৃদ্ধি কত বড় পাপ এবং এগুলোকে সহযোগিতা দেওয়া ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এসব নিরসনের ব্যবস'া না করা কত বড় জুলুম তাও জানতে হবে ইসলামী শিক্ষা থেকেই। কিন' এ শিক্ষাই তো আজ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।
তাই সরকার যখন কুখ্যাত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষানীতিকে মূল বানিয়ে শিক্ষা বিষয়ক সুপারিশমালা পেশের জন্য নতুন করে শিক্ষানীতি তৈরি করেন, যে শিক্ষানীতিতে ধর্ম ও ধর্মীয় শিক্ষা অবহেলিত হয়েছে চরমভাবে এবং যার মূলমন্ত্র হচ্ছে খোদাদ্রোহী ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইতিহাসের আস-াকুড়ে নিক্ষিপ্ত সমাজতন্ত্র সে শিক্ষানীতিই এখন নতুনভাবে চালু করার অপচেষ্টা চলছে। আর ঐ নীতিকে ঘষা মাজার জন্য কমিশন বানানো হয়েছে এমন লোকদের দ্বারা যারা বড় বড় পদবীর অধিকারী হলেও এদেশের ৯০% মুসলমানের প্রিয় ধর্মের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের কেউ কেউ ইতিপূর্বে নাসি-ক্যপূর্ণ মন-ব্য করে কুখ্যাতিও কুড়িয়েছেন। আবার দেশের শিক্ষামন্ত্রীও এমন একজন ব্যক্তি যিনি পুরো জীবন বাম রাজনীতি ও পরিত্যক্ত সমাজতান্ত্রিক মতবাদ লালন করে এসেছেন। এত কিছুর পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ঐ শিক্ষা কমিশন থেকে দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ কিইবা আশা করতে পারেন।
নতুন শিক্ষা কমিশনের কার্যক্রমের সুপারিশ ইতিমধ্যে মন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয়েছে। তবে তারা কি কি সুপারিশ করেছেন তা এখনো বিস-ারিত ভাবে সামনে আসেনি। তাই এ বিষয়ে বিস-ারিত বলার সময় এখনো আসেনি।
বলা হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স-র পর্যন- একমুখী শিক্ষাব্যবস'ার কথা এবং চিহ্নিত শ্রেণীটির দাবি হল তা থেকে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপক সংকোচন ঘটাতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার সবিস-ার অধ্যায়গুলো বাদ দিয়ে বিজ্ঞান, গণিতসহ অপরাপর সাধারণ বিষয়গুলো পুরোপুরি পাঠ্য হিসেবে পড়াতে হবে। আমরাও মনে করি, একমুখী শিক্ষাব্যবস'া খুবই প্রয়োজনীয় এবং মাধ্যমিক নয়; বরং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন- সকলের জন্য একই শিক্ষাব্যবস'া থাকা দরকার। দ্বিমুখী বা বহুমুখী শিক্ষাব্যবস'া ইসলামে ছিল না। ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের পর ইংরেজরা তাদের আল্লাহবিমুখ এবং গোলামী ভিত্তিক শিক্ষানীতি জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার পরেই শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতি বিভক্ত হয়েছে। তাই একমুখী শিক্ষানীতি সময়ের দাবি। কিন' কী থাকবে সে একমুখী শিক্ষায়। অবশ্যই এমন কিছু উপাদান যার দ্বারা জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সুন্দর জীবন, একটি সুন্দর পরিবার, একটি সুখি, সমৃদ্ধিশালী আত্মনির্ভরশীল সমাজ এবং একটি জুলুমমুক্ত ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার দিশা পাবে। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের ২য় অধ্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সত্যবাদিতা, সাধুতা, ন্যায়বোধ, নিরপেক্ষতা, কর্তব্যজ্ঞান, সুশৃঙ্খল আচরণ, দেশসেবা, মানবপ্রেম, নিঃস্বার্থতা ইত্যাদি গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যের কথা রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব গুণাবলি অর্জিত হবে কীভাবে? প্রচলিত সাধারণ শিক্ষাব্যবস'া দ্বারা যদি এসব গুণাবলি অর্জিত হত তাহলে দেশে ঘুষ, সিন্ডিকেট ও প্রতারণার সাথে জড়িত দুর্নীতিবাজরা কি অশিক্ষিত? দুর্নীতি দমন কমিশন যাদের নামে মামলা করেছে তারা কোন শিক্ষায় শিক্ষিত? ট্রুথ কমিশনে যারা সম্পদের পাহাড় বৈধ করার জন্য গিয়েছেন তারা কি অশিক্ষিত? মুনাফাখোর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কর্ণধাররা কি শিক্ষিত নন? এতে কি প্রমাণ হয় না যে, সকল শিক্ষাই জাতির জন্য উপযুক্ত সন-ান তৈরি করতে পারে না? তাই প্রয়োজন এমন একটি একমুখী শিক্ষাব্যবস'া যা শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় জাগতিক শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তাকে গড়ে তুলবে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসাবে। আর তা সম্ভব ইসলামী আদর্শ গুরুত্বের সাথে শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষাজীবনে তা বাস-ব অনুশীলন করানোর মাধ্যমে। ধর্মীয় মূল্যবোধ তৈরি করে নীতি নৈতিকতা জাগ্রত করা ছাড়া কখনো সৎ ও দক্ষ এবং কর্মঠ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই আমরা মনে করি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তব্য হল, বর্তমান শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ অবিলম্বে বাতিল করা এবং সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষার সকল স-রের উপযুক্ত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ব্যাপক ভিত্তিক কমিশন গঠন করা, যারা নতুন করে যুগোপযোগী ও বাস-বমুখী সুপারিশমালা তৈরি করবে। কুদরত-ই-খুদা কমিশনের পুরনো কাসুন্দি ঘেটে লাভ নেই। গণতান্ত্রিক সরকার হিসাবে সাধারণ মানুষের নাড়ির কথা বুঝতে হবে, কিছুতেই ধর্ম বা ধর্মীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস'ান নেওয়া যাবে না। অন্যথায় তা দেশ ও সরকারের জন্য আত্মঘাতী হতে বাধ্য।
এখানে একটি কথা অত্যন- পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে। তা হল, দেশের ঐতিহ্যবাহী পুরনো দল আওয়ামী লীগের উপর যখনই মানুষ ব্যাপক আস'া প্রকাশ করে ক্ষমতায় বসিয়েছে তখনই তাদের ঘাড়ের উপর মতবাদের দিক থেকে একেবারেই সংখ্যালঘু একটি খোদাদ্রোহী শ্রেণী সওয়ার হয়েছে যারা সরকারকে করেছে জাতির বিরাগভাজন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দাঁড় করিয়েছে সরকারের বিপক্ষে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন- জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে কীভাবে সরকারকে দিয়ে একশ্রেণীর অতি উৎসাহী ধর্মবিরোধী লোক অব্যাহতভাবে ইসলামী মূল্যবোধ বিরোধী কার্যকলাপ করিয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় বসেছে বেশি দিন হয়নি। দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন পাওয়া এ সরকারের জনপ্রিয়তা যেখানে তুঙ্গে থাকার কথা সেখানে কেন তা দ্রুত অবনতিশীল এবং কারা সরকারকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর কাছে বিরাগভাজন করে তুলছে তা এখনই বুঝে না উঠলে সুযোগ হাত থেকে বেরও হয়ে যেতে পারে।
শিক্ষানীতি একটি বিশাল বিষয়। প্রচলিত শিক্ষা এবং ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষা ও শিক্ষার দর্শন এবং এগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে বলার বহু কিছুই আছে। এখানে আমরা দেশ ও জনগণের স্বার্থে এ দাবি করতে চাই যে, সরকার যেন এমন কিছু না করে যা ৯০% মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত লাগে বা শ্রদ্ধেয় আলেমসমাজ ও দ্বীনদার শ্রেণীকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে বাধ্য করে। আশা করি, সময় থাকতেই সংশ্লিষ্টদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।