খাওয়ার পর মুখমণ্ডলে ও পায়ের তালুতে হাত মোছা প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন: জনাব, আমরা মাসিক আল কাউসারকে অন্যান্য সাধারণ পত্রিকার চেয়ে অন্যরকম মনে করি। আমরা তাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে থাকি। আল কাউসারে কোনো কিছু পড়লে অন্যদের কাছে বলতে দ্বিধাবোধ করি না।
কিন্তু গত মে (২০১১) সংখ্যায় প্রচলিত ভুল বিভাগে ‘খাওয়ার পর মুখমণ্ডলে ও পায়ের তালুতে হাত মোছা কি সুন্নাত?’ শিরোনামে একটি লেখা নজরে পড়ল। তাতে খাওয়ার পর পায়ের নিচে ও মুখমণ্ডলে হাত মোছাকে সুন্নাত বলা ভুল সাব্যস্ত করা হয়েছে।
এক ভাই বুখারী শরীফের হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত এ হাদীসটি
حدثنا إبراهيم بن المنذر، قال: حدثني محمد بن فليح، قال: حدثني أبي، عن سعيد بن الحارث، عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما: أنه سأله عن الوضوء مما مست النار؟ فقال: لا، قد كنا زمان النبي صلى الله عليه وسلم لا نجد مثل ذلك من الطعام إلا قليلا، فإذا نحن وجدناه لم يكن لنا مناديل إلا أكفنا وسواعدنا وأقدامنا، ثم نصلي ولا نتوضأ
দেখিয়ে বললেন, জামাতে সাহাবার আমলকে কীভাবে সুন্নাত বলা যাবে না। আমি অবশ্য বলেছি সুন্নাতের তো নির্ধারিত সংজ্ঞা রয়েছে। কোনো হাদীসে কোনো কথা থাকলেই বা সাহাবায়ে কেরাম রা. কোনো কাজ করলেই তা সুন্নাত সাব্যস্ত হয়ে যায় না। তথাপি বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্য এবং সংশয় দূর করার জন্য আমার কয়েকটি প্রশ্ন:
১. বাস্তবেই কি বিষয়টিকে সুন্নাত বলা ভুল। বিস্তারিত দলীলসহ জানতে চাই।
২. পত্রিকায় সুন্নাত বলা ভুল এর দলীল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে মুসনাদে আহমাদের হাওয়ালায় হযরত জাবের রা. এর হাদীস যা মুসলিম শরীফেও রয়েছে। সেখানে হাদীসের লফজ হল,
ولا يمسح يده بالمنديل حتى يلعق أصابعه، فإنه لا يدري في أي طعامه البركة
নববী র. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল মিনহাজে লেখেন,
إن الطعام الذي يحضر الإنسان فيه بركة، ولا يدري أن تلك البركة فيما أكله أو فيما بقي على أصابعه...
হাদীস ও হাদীসের ব্যাখ্যা থেকে যতটুকু মনে হয় আঙ্গুল চেটে খাওয়ার আগে রুমালে হাত মোছা থেকে বারণ করেছেন যাতে বরকত থেকে মাহরুমীর কারণ না হয়। এই হাদীস থেকে নি¤েœাক্ত বিষয়টি বের হয় কি?!
‘বরং চর্বিযুক্ত খাবারের ক্ষেত্রে হাত সাবান বা গরম পানি দ্বারা উত্তমভাবে পরিষ্কার করে রুমাল বা তোয়ালে জাতীয় কিছুতে মুছে নেওয়া উচিত।” অথচ এ বিষয়েরই দলীল হিসেবে হাদীসকে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার করে দেওয়ার অনুরোধ রইল।
৩. সুন্নাত, মুস্তাহাব, সুন্নাতে মুআক্কাদা ও সুন্নাতে গায়রে মুআক্কাদা এবং ওয়াজিব সবগুলোর সংজ্ঞা ও পরস্পর পার্থক্য জানালে খুশি হব।
আগামি সংখ্যায় উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।
আব্দুল্লাহ, মোমেনশাহী
উত্তর:
আপনার চিঠি সময়মতো পেয়েছি। জানি না জবাব দিতে এত দেরি হয়ে গেল কেন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে এবং আপনার ঐ ভাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন।
খাওয়া শেষ করার পর প্রথম কাজ তো হাতের আঙ্গুল চেটে খাওয়া এবং পাত্র পরিষ্কার করে খাওয়া। খাদ্যের কোনো অংশ নষ্ট না করা, খুব পরিষ্কার করে খাওয়া। এটা খাবারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এরপর হাত পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত। হাত পরিষ্কার করার কয়েকটি সুরত হতে পারে:
এক. একটি সুরত হল, হাত ধুবেও না এবং রুমাল দ্বারাও মুছবে না বরং সরাসরি চেহারা, হাত ও পায়ে মুছে নিবে।
এই সুরতের কথাই সহীহ বুখারীর ঐ হাদীসে এসেছে, যা আপনি উল্লেখ করেছেন। হাদীসটির তরজমা নিম্নরূপ:
‘সায়ীদ ইবনুল হারীছ রাহ. জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আগুনে রান্না করা কোনো খাবার খাওয়ার পর ওযু করা কি জরুরি? জাবের রা উত্তরে বললেন, না, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এ ধরনের খাবার তো আমরা কমই পেতাম। যখন পাওয়া যেত, (হাত মোছার জন্য) আমাদের কাছে হাতের পাতা, বাহু ও পায়ের পাতা ছাড়া কোন রুমাল থাকতো না। (অর্থাৎ রুমালের পরিবর্তে আমরা এগুলোতেই আঙ্গুল মুছে নিতাম।)’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৪৫৭, কিতাবুল আতয়িমা, বাবুল মানাদিল।
হাদীসের পূর্বাপর শব্দ থেকেই বুঝা যাচ্ছে যে, তারা এমনটি করতেন জরুরতের কারণে। এজন্য নয় যে, তারা রান্না করা খাবার খাওয়ার পর হাত না ধোয়াকে কিংবা রুমালে হাত না মোছাকে উত্তম মনে করতেন, অথবা হাতের পাতা, বাহু ও পায়ের পাতায় হাত মোছাকে সুন্নাত মনে করতেন। এ জন্য এই হাদীস থেকে আমার জানামতে কোন ফকীহ অথবা আলেম এরকম কোন হুকুম গ্রহণ করেননি। বরং উলামায়ে কেরাম তো একথাই বলেছেন যে, রান্না করা খাবার খাওয়ার পর হাত রুমাল ইত্যাদিতে মুছে নেওয়া উচিত। বরং প্রয়োজনে ধুয়ে নেওয়া উচিত।
রুমাল ইত্যাদিতে হাত মোছার কথা তো সহীহ বুখারীর আলোচ্য হাদীস থেকেও বুঝা যায়। তাছাড়া এ ব্যাপারে স্পষ্ট হাদীসও আছে। আল কাউসারের প্রচলিত ভুল বিভাগে মুসনাদে আহমাদের বরাতে যে হাদীসটি উল্লেখিত হয়েছে সেটি যেমন আপনিও বলেছেন সহীহ মুসলিমেও আছে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২০৩৩ [১৩৪] কিতাবুল আশরিবা, বাবু ইসতিহবাবি লা’কিল আসাবি’) এ হাদীসটি তো এ অর্থে একেবারেই সুস্পষ্ট।
কাযী ইয়ায ইবনে মূসা রাহ. সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে এই হাদীসের অধীনে লিখেছেন,
وفيه جواز مسح اليد بعد الطعام بالمنديل وهذا - والله أعلم - فيما لم يحتج فيه لغسل مما ليس فيه غمر ولزوجة مما لابد منه إلا الغسل، فقد جاء فى الحديث فى الترغيب فى غسله أو الحذر من تركه.
অর্থাৎ এই হাদীস থেকে খাওয়ার পর রুমাল দিয়ে হাত মোছা ‘মুবাহ’ এ কথা প্রমাণিত হয়। (অর্থাৎ আঙ্গুল চেটে খাওয়ার পর হাত শুধু মুছে নিলেও তা জায়েয হবে।) কিন্তু এটা ঐ সময় যখন ধোয়া ছাড়াই শুধু মুছে নিলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। অন্যথায় খাবার যদি এমন হয় যে, খাবারের দাগ, তৈলাক্ত ও আঠালোভাব এবং গন্ধ হাতে-মুখে লেগে থাকে যা ধোয়া ছাড়া পরিষ্কার হয় না তবে তো হাত ধুয়ে নেয়াই উচিত। এ কথাটি হাদীসে এরশাদ হয়েছে। (ইকমালুল মু’লিম, কাযী ইয়ায, ৬/৫০২)
এরপর কাযী ইয়ায নিম্নোক্ত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন,
من رواية أبي هريرة: من نام وفى يده غمر ولم يغسله فأصابه شيء، فلا يلومن إلا نفسه.
অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হাতে চর্বি লেগে থাকা অবস্থায় সেটি না ধুয়ে ঘুমিয়ে গেল, পরে এর কারণে তার কোন ক্ষতি হল সে যেন নিজেকেই তিরস্কার করে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৮৫২ কিতাবুত ত’য়াম, বাবুন ফি গাসলিল ইয়াদ মিনাত ত’য়াম; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ৭৫৬৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস: ৫৫২১)
তো বুঝা গেল যে, সহীহ বুখারীর উল্লেখিত রেওয়ায়েতে জাবের রা. নিজের এবং নিজ সাথীদের যে আমলের কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি একটি মুবাহ আমল। যা তারা করতেন পানির স্বল্পতার কারণে এবং রুমাল ইত্যাদি সাধারণভাবে সহজলভ্য না হওয়ার কারণে। এ জন্য নয় যে, তারা এটিকে সুন্নাত মনে করতেন।
দুই. দ্বিতীয় সুরত এই যে, প্রথমে রুমাল ইত্যাদি দিয়ে হাত মুছে নিবে। তারপর ধুবে। ধোয়ার পর হাত শুকানোর জন্য আবার হাত মুছবে বা মুছবে না। এ সুরতটিও জায়েয। এটি নিষেধ হওয়ার কোনো দলীল নেই।
তিন. তৃতীয় সুরত এই যে, প্রথমে পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিবে। তারপর রুমাল ইত্যাদি দিয়ে মুছবে।
হাত ধোয়ার কথা তো হাদীসে এসেছে। কিন্তু ধোয়ার পর রুমাল ইত্যাদি দিয়ে হাত মোছার কথা কোনো হাদীসে বা আসারে এসেছে কি না তা আমার খুঁজে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে এটি মুবাহ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
(وقد ذكره في "رد المحتار" ج ৬ ص ৩৬ والدر المنتقى شرح ملتقى الأبحر، ج ৪ ص ১৮১ من الآداب، والله تعالى أعلم بالصواب.)
চার. চতুর্থ সুরত এই যে, প্রথমে পানি দিয়ে হাত ধুবে। এরপর হাতে লেগে থাকা আর্দ্রতা দ্বারা চেহারা ও পা মুছবে।
এ সুরতটি আমাদের দেশে কিছু মানুষের মাঝে প্রচলিত আছে। এটিও মুবাহ আমল। তবে একে সুন্নাত মনে করা ভুল। আল কাউসারে মূলত এই সুরতের কথা বলাই উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু বর্ণনার অস্পষ্টতার কারণে মনে হচ্ছে, এতে প্রথম সুরতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আসলে এটি উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ আমাদের দেশে এ সুরতটি প্রচলিত নয় যে, হাত ধোয়া ছাড়াই চেহারা ও পায়ে মুছে নিবে।
যাই হোক, এই চতুর্থ সুরত, অর্থাৎ হাত ধোয়ার পর ভেজা হাত চেহারা ও পায়ে মুছে নেওয়া এটিও মুবাহ ; সুন্নাত নয়। কারণ এটি সুন্নাত হওয়ার কোনো দলীল নেই।
তবে মেশকাত শরীফের ২য় খণ্ডে হাদীস নং ৪২৩৩-এ তিরমিযীর হাওয়ালায় একটি রেওয়ায়েত উল্লেখ আছে। তাতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ছারীদ’ খাওয়ার পর পানি দিয়ে দুই হাত ধুয়েছেন। এরপর হাতের আর্দ্রতা দ্বারা চেহারা, বাহু ও মাথা মুছেছেন। (জামে তিরমিযী, হাদীস: ১৯৬৪, কিতাবুল আতইমা, বাবুত তাসমিয়া আলাত ত’য়াম)
কিন্তু রেওয়ায়েতটি প্রমাণিত নয়। ইমাম তিরমিযী নিজেই একে غريب বলেছেন । ইমাম বুখারী বলেছেন, لا يثبت অর্থাৎ হাদীসটি ছাবিত নয়। (দ্রষ্টব্য: আততারীখুল কাবীর, ৫/৩৯৪; আয-যুয়াফাউস সগীর, ২১৭ নং তরজমা)
যদি রেওয়ায়েতটি ‘ছাবিত’ হত, তারপরও এ থেকে শুধু উল্লেখিত আমলের মুবাহ হওয়া এবং খেলাফে সুন্নাত না হওয়াই প্রমাণিত হত। এর সুন্নাত হওয়া প্রমাণিত হত না। বিষয়টি ইলমে উসূলুল ফিকহের أفعال النبي صلى الله عليه وسلم অধ্যায়ে আলোচিত উসূল ও কাওয়ায়েদের আলোকে স্পষ্ট।
(ولو كان كل فعل فعله النبي صلى الله عليه وسلم سنة على مصطلح علم الفقه، فانظرو الأحاديث المروية في كتاب الأطعمة فقط، وتفكروا كم فيه مما لم يحكم بسنيته مع ثبوته قولا وفعلا، وكم فيه مما لا يرتاب في كونه مستحباً ولكننا غافلون عنه، مع إصرارنا على سنية مسح الوجه ببلل الكفين، ونحو ذلك مما لا شك في عدم كونه سنةً مقصودة وأدباً عاماً، والله المستعان، قاله الراقم.)
আশা করি এই আলোচনা থেকে আপনার ইশকাল হল হয়েছে। বাকী যে ইসতিলাহগুলোর ব্যাপারে আপনি জানতে চেয়েছেন, আপনি নিজেই এগুলো উসূলে ফিকহের বিশদ ও দালীলিক কিতাবসমূহে মুতালাআ করে আসাতিযায়ে কেরামের নিকট থেকে হল করার চেষ্টা করুন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে তাওফীক দান করুন। আমীন। সুযোগ হলে বান্দার রিসালা ‘তাসাউফ: তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ’ নতুন সংস্করণে ইত্তিবায়ে সুন্নাতের আলোচনা মুতালাআ করে নিতে পারেন। আশা করি ফায়দা হবে।
২৯/০৩/১৪৩৬
বুধবার, রাত ৩ টা