আল্লাহর ঘর এই গোনাহগার চোখদু’টো প্রথম দেখেছিলো আজ থেকে আটাশ বছর আগে ১৪০৩ হিজরীর পবিত্র রামাযান মাসে। সে বছরই আল্লাহ তাআলা আমাকে হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ)-এর ছোহবতে হজ্জে বাইতুল্লাহর খোশকিসমত দান করেছিলেন। সেটা ছিলো শৈশব থেকে আমার যিয়ারাতে বাইতুল্লাহর স্বপ্ন দেখার প্রথম ফুল, প্রথম ফল।
পিপাসা ছিলো, শীতল পানীয় পান করেছিলাম এবং আল্লাহর রহমতে তৃপ্তিও লাভ করেছিলাম। কিন্তু বাইতুল্লাহর সঙ্গে মুমিনের কলবের এমনই এক আশ্চর্য মধুর সম্পর্ক যে, বাইতুল্লাহর যিয়ারাত-সুধা পান করার পর পিপাসা আরো বেড়ে যায় এবং হৃদয় আরো তৃষ্ণাকাতর হয়। বাইতুল্লাহর দীদার মুমিনের দিলকে আরো বে-কারার করে। আল্লাহর ঘর একবার দেখে আসার পর আবার তা দেখতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অন্তরে প্রবলভাবে জেগে ওঠে।
কালো গিলাফে ঢাকা বাইতুল্লাহর জামাল ও সৌন্দর্য কখনো শেষ হয় না। তাই মুমিনের হৃদয়ে সে সৌন্দর্যের পিপাসাও কখনো মেটে না, আরো বাড়ে; বাড়তেই থাকে। আল্লাহর ঘর এখনো যে দেখেনি তার হৃদয়ের ব্যাকুলতা হলো, আহা, একবার যদি দেখতে পেতাম আমার মাওলার ঘর! একবার যে দেখে তার ব্যাকুলতা হলো, আহা, আবার যদি দেখতে পেতাম আমার আল্লাহর ঘর! আবার যে দেখে তার হৃদয়ের আকুতি হলো, আহা, বারবার যদি দেখতে পেতাম! সারা জীবন যদি দেখতে পেতাম! অন্তত একজন মুমিন তো- যত গোনাহগারই হোক সে এবং যত বে-জান হোক তার কলব, আল্লাহর দরবারে সবসময় এ মুনাজাতই করে থাকে, হে আল্লাহ, আমার দিলে তোমার ঘরের মুহব্বত আরো বাড়িয়ে দাও। তোমার ঘর বারবার যিয়ারাত করার শাওক ও জাযবা এবং আবেগ ও তড়প পয়দা করে দাও।
একই অবস্থা সোনার মদীনায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযা শরীফ যিয়ারাতের ক্ষেত্রেও। মুমিন পৃথিবীর যেখানেই থাকুক এবং দূর আজমের যে দেশেরই বাসিন্দা হোক, সে তো সারা জীবনই তার পেয়ারা হাবীবের দরবারে দুরূদের নাযরানা পাঠাতে থাকে এবং সে বিশ্বাস করে, আল্লাহর হুকুমে ফিরেশতাগণ তার দুরূদের তোহফা পৌঁছে দেন নবীজীর খেদমতে। কিন্তু এ আকাঙ্ক্ষা সবসময় তার দিলকে ব্যাকুল-বেকারার করে রাখে যে, হায়, একবার, শুধু একবার যদি হাযির হতে পারতাম সোনার মদীনায়! একবার যদি সৌভাগ্য হতো নবীজীর রওযা শরীফে হাযির হয়ে দুরূদ ও সালামের নাযরানা পেশ করার! হায়, এ অভাগা চোখে একবার যদি দেখতে পেতাম সবুজ গম্বুজের সৌন্দর্য!
আচ্ছা বলো দেখি, আল্লাহ তোমার দুআ কবুল করলেন। তোমার দিলের তড়প ও কলবের বে-কারারি আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় জোশ পয়দা করলো। তোমার উড়ে যাওয়ার ডানা নেই; মরুভূমির তপ্ত বালু পাড়ি দেবে, তোমার পায়ে সে শক্তি নেই; তোমার পথ জানা নেই; তোমার কাছে পথের পাথেয় নেই। না আছে যোগ্যতা, না আছে সামর্থ্য; তবু আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় জোশ এলো এবং আল্লাহ তোমাকে যিয়ারাতে মদীনার সৌভাগ্য দান করলেন! ইশক ও মুহব্বতের ভরপুর জোয়ারে ভাসতে ভাসতে একদিন তুমি গিয়ে দাঁড়ালে রওযা শরীফের মাকামে এবং দুরূদ ও সালামের নাযরানা পেশ করলে পেয়ারা হাবীবের পাক দরবারে। তোমার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন স্বার্থক হলো, তুমি ধন্য হলে, কৃতার্থ হলে। কিন্তু বলো দেখি, এখন কি তোমার হৃদয়-সাগরের জোয়ারে ভাটা এসেছে, না জোয়ার আরো জোরওয়ার হয়েছে! তোমার বুকের স্বপ্ন-ময়ুর কি এখন তার পাখা গুটিয়ে নিয়েছে, না আরো সুন্দর করে আবার পেখম মেলেছে!
তুমি যে সবুজ গম্বুজের সৌন্দর্য অবলোকন করে এসেছো; তুমি যে তোমার চোখে সোনার মদীনার ধুলোবালির সুরমা মেখে এসেছো তাতে কি তোমার যিয়ারাতে মদীনার আকাঙ্ক্ষা ও ব্যাকুলতা প্রশমিত হয়েছে, না আরো তীব্র হয়েছে!
মুমিনের হৃদয়ে আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের আকুতি এবং সোনার মদীনায় হাযির হওয়ার ব্যকুলতা কখনো শেষ হয় না, হতে পারে না; জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত না। আল্লাহর ঘর তুমি যত বার যিয়ারাত করবে, নবীজীর রওযায় তুমি যত বার হাযির হবে তোমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা এবং কলবের বে-কারারি ততই বাড়তে থাকবে। কালো গিলাফ বারবার তোমাকে আকর্ষণ করবে; সবুজ গম্বুজ বরাবর তোমাকে হাতছানি দেবে। হজ্বের কাফেলা যখনই হিযাজের পথে রওয়ানা হবে তোমার দিল আবার বে-কারার হবে, তোমার কলবের দরিয়ায় আবার মৌজ আসবে। তুমিও শামিল হয়ে যাবে হিজাযের কাফেলায়, কিংবা মজবূর অবস্থায় অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে থাকবে কাফেলার গমনপথের দিকে, আর আসমানের দিকে হাত তুলে ফরিয়াদ করবে, হে আল্লাহ! আবার তাওফীক দাও, আবার নিয়ে চলো তোমার বান্দাকে তোমার ঘরে, তোমার নবীর শহরে!
এ শরাবের পেয়ালায় হে বন্ধু, যত বার চুমুক দেবে, নেশা ও পিপাসা তত তীব্র হবে, তুমি ততই মিনতি জানাবে, হে সাকী! আবার আনো সুরাহী! আবার পূর্ণ করো পেয়ালা! আবার পিলাও তোমার সুরা-মদিরা!
বাইতুল্লাহর দীদারের শাওক ও তামান্না তখনই তোমার শান্ত হবে যখন তুমি রাব্বুল বাইতের দীদার লাভ করে ধন্য হবে। সোনার মদীনায় নবীজীর রওযায় হাযির হওয়ার আকুলতা ও ব্যাকুলতা তখনই তোমার প্রশান্তি লাভ করবে যখন তুমি হাউযে কাউছারে নবীজীর পবিত্র হাত থেকে লাভ করবে সেই পেয়ালা যা পান করে চিরকালের জন্য দূর হয়ে যাবে সব পিপাসা।
***
বুকের ভিতরে বহু বছর যিয়ারাতে বাইতুল্লাহ ও যিয়ারাতে মদীনার স্বপ্ন লালন করার পর যখন আল্লাহর রহমত নেমে এলো; যখন আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের এবং সোনার মদীনায় হাযির হওয়ার প্রথম সৌভাগ্য লাভ হলো, তারপর আমারও সেই অবস্থা হলো। আমি আরো ব্যাকুল-বেকারার হলাম। আমার পিপাসা আরো তীব্র হলো। ব্যাকুলতা ও তৃষ্ণাকাতরতার এ যন্ত্রণা বড় মধুর যন্ত্রণা! না দেখার ব্যাকুলতা এবং না পাওয়ার অস্থিরতা একরকম; একবার দেখে আবার দেখার এবং একবার পেয়ে আবার পাওয়ার ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা অন্যরকম, সম্পূর্ণ অন্যরকম। এ যন্ত্রণা আরো মধুর!
আমাদের ছালাফ ও মহান পূর্ববর্তিদের জামাতে তো এমন সৌভাগ্যবানও ছিলেন যিনি সত্তর বারের বেশী হজ্ব করেছেন। শেষবার যখন তিনি মুলতাযামে দাঁড়িয়ে দু‘আ করছেন তখনো তাঁর দিলে ছিলো আবার বাইতুল্লাহর যিয়ারাত লাভের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু তাঁর দিলে
ইলহাম হলো, হয়ত এবারই তাঁর শেষবার। মুলতাযাম থেকে সরে এসে সফরসঙ্গীদের তিনি বললেন,
প্রতিবার মুলতাযামে বুক লাগিয়ে আমি কাঁদি, এবার মনে হলো, মুলতাযাম
আমার জন্য কাঁদলো! আমার কি আর আসা হবে না, আল্লাহর ঘরে, মুলতাযামের কাছে!
আল্লাহর আশিক বান্দা যারা, বাইতুল্লাহর প্রকৃত প্রেমিক যারা বাইতুল্লাহর যিয়ারাতে তাদের দিল কখনো তৃপ্ত হয় না। প্রতিবার তারা ফিরে যান আবার ফিরে আসার আরো প্রবল পিপাসা নিয়ে। যামযামের পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা পান করেন যামযামের নতুন তৃষ্ণাকাতরতা অর্জন করার জন্য। তাই আল্লাহর প্রেমিক বান্দাদের জীবনে হজ্ব ও যিয়ারাতে বাইতুল্লাহর এমন অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যায় যার হাকীকত ও রহস্য আমাদের কখনো বুঝে আসে না। সেসব ঘটনা আমরা পড়ি, আর ব্যাখ্যাতীত রহস্যের অতলে হারিয়ে যাই। তখন এইটুকু শুধু বলতে পারি, এটা আমাদের পরিচিত জগত নয়, এটা অন্য জগত! এ জগতের বাসিন্দা যারা তাদের সঙ্গে আল্লাহর মু‘আমালা অন্যরকম!
হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ) ছিলেন আমাদের যুগে, আমাদের মাঝে আল্লাহ তা‘আলার
তেমনি এক পেয়ারা
বান্দা এবং আমার পরম সৌভাগ্য, আজ থেকে সাতাশ বছর আগে আমার
জীবনের প্রথম হজ্বের সফর হয়েছিলো তাঁর পাক ছোহবত ও পবিত্র সান্নিধ্যে। তাই সফর থেকে ফিরে আসার পর ব্যাকুলতা ও অস্থিরতার এবং পিপাসা ও তৃষ্ণার সেই মধুর যন্ত্রণা কিছুটা হলেও আমি আমার বুকের গভীরে অনুভব করেছিলাম। তখন দিন-রাত অদ্ভুত এক বেদনায় দগ্ধ হতাম, আর ভাবতাম, আবার কবে দেখা হবে আল্লাহর ঘর! আবার কবে নছীব হবে বাইতুল্লাহর যিয়ারাত! আবার কবে যাওয়া হবে সোনার মদীনায়! আবার কবে নছীব হবে নবীজীর রওযায় হাযির হওয়া!
একবছর গেলো, দু’বছর গেলো; প্রতীক্ষার যন্ত্রণা বাড়লো, কিন্তু ডাক এলো না। তিনবছর, চারবছর পার হলো, তবু ডাক এলো না। দিন যায়, রাত আসে, কিন্তু হায়, ডাক আসে না! হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ) আল্লাহর ঘরে গেলেন। সৌভাগ্যবান কত জন শরীক হলো সেই কাফেলায়, আমি শুধু তাঁর বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদলাম। খানকায় তখন কেউ ছিলো না, হযরত ছিলেন, আর তাঁর বুকে আমার মাথা ছিলো। আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত, ইয়ে মাহরূমী কী আলামত তো নেহী হায়? (এটা মাহরূম হওয়ার আলামত নয় তো?)
তিনি মৃদু হাসলেন, আর আমার মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন।
হযরত সেদিন বিভিন্ন কথা বলে আমাকে সান্তনা দিয়েছিলেন। তাঁর সান্তনা-উপদেশ থেকেই সেদিন জানতে পেরেছিলাম, নিজের গোনাহ ও বদআমলের কথা স্মরণ করে মাহরূমির আশঙ্কা করা ভালো, কিন্তু সেটাকে মনের ভিতরে স্থায়ী হতে দেয়া এবং সেটাকে প্রশ্রয় দেয়া ভালো নয়। তাতে শয়তান মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করার সুযোগ পায়। তুমি যদি তাওবা করো, ইস্তিগফার করো তাহলে তোমার গোনাহ যত বড়, আল্লাহর রহমত তার চেয়ে বড়। অনুতপ্ত বান্দাকে আল্লাহ কখনো মাহরূম করেন না।
হযরত সেদিন বলেছিলেন, দিলকে আন্দার শাওক কো বাড়নে দো, ফের মাযা আয়ে গা। (দিলের ভিতরে আকাঙ্ক্ষাকে আরো বাড়তে দাও, তখন আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের আসল স্বাদ পাবে।)
সেবার হযরতকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে গেলাম অন্তরে প্রশান্তির অন্যরকম একটি অনুভূতি নিয়ে। হযরতের বিমান আকাশে উড়ছে, ঝাপসা চোখে আমি তাকিয়ে আছি, আর ভাবছি, হে আল্লাহ, তুমি ডাকলেও খুশী, না ডাকলেও রাজী। আমার জন্য তুমি যা পছন্দ করবে তাতেই আমি রাজি-খুশি। বিরহের বেদনা, কিংবা মিলনের আনন্দ, তুমি যা দেবে তাতেই আমি সন্তষ্ট। কারণ আমার কল্যাণ আমি জানি না, তুমি জানো। তবে আমি স্বপ্ন দেখেই যাবো। আবার তোমার ঘরের দীদার লাভের আশায়, আবার তোমার হাবীবের রওযা শরীফের যিয়ারাতের তামান্নায় প্রতীক্ষার দিন গুণেই যাবো। তোমার যখন ইচ্ছে হে আল্লাহ, অধম বান্দাকে ডাক দিয়ো এবং লাব্বাইক বলে হাযির হওয়ার তাওফীক দিয়ো। তোমার যখন ইচ্ছে, আমার পিপাসার্ত ঠোঁটের সামনে পেয়ালা ধরো হে আল্লাহ! তখনই আমি আমার দগ্ধ হৃদয়ের উত্তপ্ত পিপাসা প্রাণভরে মেটাবো। তোমার ঘরের যিয়ারাতেও তোমার ইচ্ছের মাঝে আমি সমর্পিত হতে চাই হে আল্লাহ! আমি শুধু তোমার হতে চাই হে আল্লাহ! আর চাই, তুমি আমার হও হে আল্লাহ! এ আমার মিনতি! এ আমার নিবেদন!
হে আল্লাহ, আমার শুধু একটি ফরিয়াদ; তুমি তোমার ঘর যিয়ারাতের সৌভাগ্য দান করেছো, আমি তার হক আদায় করতে পারিনি। তুমি তোমার হাবীবের রওযা শরীফে হাযির হওয়ার খোশকিসমত দান করেছো, আমি তার আদব রক্ষা করতে পারিনি। জেনে, না জেনে অনেক বে-আদবি করে ফেলেছি। আমার বে-আদবি যেন মাহরূমির কারণ না হয় হে আল্লাহ! তোমার রহমত চিরকাল যেন আমার সঙ্গী হয় হে আল্লাহ!
***
হতে হতে পাঁচবছর পার হলো। আবেগে, উচ্ছ্বাসে, ব্যাকুলতায়, অস্থিরতায় হৃদয়ের সব বাঁধ যেন ভেঙ্গে গেলো। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম, আর তো পারি না হে আল্লাহ! বিরহের যন্ত্রণা আর তো সয় না হে আল্লাহ! কবে আসবে তোমার ডাক!
এবং আমার মাওলার ডাক এলো। আগে যেমন তখনো তেমন আমার না ছিলো কোন উপায়-উপকরণ, না ছিলো সহায়-সম্বল। কিন্তু মাওলার যখন ডাক আসে তখন গায়ব থেকেই সবকিছুর আঞ্জাম হয়; তখন অদৃশ্য হতেই সবকিছুর ইন্তিযাম হয়। আমাদের কর্তব্য শুধু প্রতীক্ষায় থাকা মাওলার ডাক আসার। কারণ আমি তাঁর এবং তিনি আমার। মিলনের আনন্দে যেমন তিনি আমার কাছে তেমনি বিরহের যন্ত্রণায়ও তিনি আমার পাশে।
আমার দীর্ঘ জীবনের মুখলিছ দোস্ত মাওলানা ইয়াহইয়া জাহাঙ্গির। তার এ ইহসান আমি কখনো ভোলবো না যে, তিনি তার জীবনের প্রথম হজ্বের সফরে আমাকে সঙ্গী বানিয়েছিলেন। তারই ওছিলায় আমার হজ্বেবদলের ব্যবস্থা হয়েছিলো। আল্লাহ তাকে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
সেবার আমাদের চারজনের কাফেলা ছিলো। তৃতীয়জন ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় মাওলানা কাযী মু’তাছিম বিল্লাহ ছাহেব। চতুর্থজন আত্মীয় সম্পর্কে মাওলানা ইয়াহইয়া জাহাঙ্গিরের চাচা জনাব শামসুল হক ছাহেব। তিনি এখন মরহূম। আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন, আমীন। বড় সহজ-সরল ও ছাফদিল মানুষ ছিলেন। সেই সফরেই তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। আমাদের মাঝে আল্লাহর ওয়াস্তে এমন এক দ্বীনী মুহব্বত পয়দা হয়েছিলো যা তার মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো, এখনো আছে; আশা করি, এ মুহব্বত আখেরাতেও আমাদের ফায়দা দান করবে।
সেদিনটির কথা মনে হলে এখনো মনে অদ্ভুত শিহরণ জাগে। বিকেলে হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ)-এর কবর যিয়ারাত করলাম। স্নেহ-প্রীতির কত স্মৃতি যে মনের পাতায় জেগে উঠলো! হৃদয়ের আকাশে ভাবের কত রকম মেঘের ছায়াপাত হলো! মাগরিবের পর বাসায় ফিরে এলাম এবং সফরে রওয়ানা হলাম। আব্বা নৌকায় তুলে দিলেন। এ যেন
পালতোলা জাহাযে হজ্বের সফর। সত্যি সত্যি ঐরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতিই হয়েছিলো সেদিন।
তখন বর্ষাকাল ছিলো। আমাদের বাড়ীর পিছনে নৌকা ভিড়তো। যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো আবছা অন্ধকারে আব্বাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। মনে হয় এই সেদিনের কথা, অথচ পার হয়ে গেছে কত বছর! মাটির উপরের আব্বা এখন মাটির নীচে! আল্লাহ তাঁর ‘তুরবত’কে ঠাণ্ডা রাখুন, আমীন।
এখন তো বিমানবন্দরের সন্নিকটে স্থায়ী হাজীক্যাম্প হয়েছে। তখন অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিলো মহাখালিতে। দুটি রাত এবং দুটি দিন ছিলাম সেই
হাজীক্যাম্পে। সামান্য সময়, কিন্তু আল্লাহর ঘরের সফরের জন্য নিজেকে
প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে অসামান্য সুফল বয়ে এনেছিলো তা। নিজেকে তখন মনে
হয়েছিলো দুনিয়ার সকল সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন আখেরাতের এক মুসাফির। মনে হয়েছিলো, দুনিয়াতে আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-কন্যা কেউ নেই। গভীর রাতে আমি ছিলাম একা, সম্পূর্ণ একা। তখন আমি যেন কবরের বাসিন্দা। আল্লাহকে সেদিন বড় আপন করে ডাকতে পেরেছিলাম।
হরতালের কারণে রাস্তা ছিলো গাড়ীশূন্য তো বটেই, এমনি একেবারে জনশূন্য। গাড়ী যখন বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো, মনে হলো বাইতুল্লাহর এ কয়জন মুসাফির ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন মানুষ নেই। গোটা প্রকৃতি যেন আমাদের বিদায় জানাচ্ছে। সেদিনের লাব্বাইক-ধ্বনির মধুরতা এখনো যেন কানে অপূর্ব এক সুরঝঙ্কার সৃষ্টি করে। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান্-নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারীকা লাক।
আমাদের চারজনের ছোট্ট কাফেলার সেই সফর বড় মুবারক সফর ছিলো। আরাফায়, মুযদালিফায়, মিনায়, মক্কায় এবং মদীনায় বড় আনন্দের দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছিলো। যেন এক মধুর স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম; স্বপ্ন থেকে জেগেই দেখি, আবার আমরা ঢাকায়। বন্যায় ডুবে আছে সারা দেশ, আমাদের বাড়ীঘর। নৌকা থেকে একেবারে ঘরের ভিতরে এসে নেমেছিলাম।
হজ্বের সেই সফরের মধুর স্বপ্নের দিনগুলোর
কাহিনী যদি লিখতে যাই হয়ত বেশ উপভোগ্য ও শিক্ষণীয় হবে, কিন্তু এ
লেখা তখন অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে।
প্রথম সফরে আল্লাহ তা‘আলা হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ)-এর ছোহবত নছীব করেছিলেন। দ্বিতীয় সফরেও আল্লাহ তা‘আলা বঞ্চিত করেননি। আরাফায়, মিনায় এবং মক্কা-মদীনায় আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মুরুব্বিদেরও মুরুব্বি হযরত মুহাদ্দিছ ছাহেব (রহ)-এর ছোহবত নছীব করেছিলেন। আমরা জানতাম না তিনি হজ্বের সফরে এসেছেন। হজ্বের পূর্বে হারাম শরীফে উম্মেহানিতে যখন অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর দেখা পেলাম, কলিজাটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। হযরতও
খুব খুশী হলেন। এখানেও সেই একই কথা; আব্বার সঙ্গে মুহব্বতের কারণে তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি ও মাওলানা ইয়াহয়া অন্তরের অন্তস্থল
থেকে আল্লাহর শোকর আদায় করলাম যে, আমাদের পক্ষ হতে কোন চেষ্টা ছিলো না, তবু আল্লাহ মেহেরবান এই সফরে এই নূরানি মানুষটির ছোহবত দান করেছেন। যদিও সেটি হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ)-এর মত দিন-রাতের নিরবচ্ছিন্ন ছোহবত ছিলো না, তবু আমাদের অনেক ফায়দা হয়েছিলো। হজ্বের সফরে আমরা আমাদের প্রিয় হযরত মুহাদ্দিছ ছাহেবকে যেমন দেখেছি যদি আল্লাহ তাওফীক দেন কিছুটা হলেও তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। তিনিও আজ কবরের বাসিন্দা। ‘একে একে হায়, নিভিছে সকল প্রদীপ’!
এই সফরের আরেকটি সৌভাগ্যের কথাও এখানে বলতে ইচ্ছে করছে। হজ্বের পরে একদিন দুপরে আল্লাহর ঘর তাওয়াফের জন্য মাতাফে নেমেছি। মাতাফ তখন কিছুটা খালি। হঠাৎ দেখি, ওমরার ইহরামে দু’জন নূরানী মানুষ মাকামে ইবরাহীম বরাবর একটু দূরে মুনাজাত করছেন। একজন মুনাজাত করছেন, অন্যজন সামান্য একটু পিছিয়ে বসে তাঁর মুনাজাতে শরীক হয়েছেন। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। তাঁদের মুনাজাতের নূরানিয়াত ও কবূলিয়াত আমাকেও যেন স্পর্শ করলো। নিজের অজানে-ই সেদিকে এগিয়ে গেলাম। মাওলানা ইয়াহয়া বললেন, ইনি আওলাদে রাসূল হযরত মাওলানা সৈয়দ হোসায়ন আহমাদ মাদানী (রহ)-এর ছাহেবযাদা হযরত মাওলানা আস’আদ মাদানী, আর পিছনের জন হলেন হযরত মাওলানা মারগূবুর-রহমান ছাহেব।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)