জুমাদাল উলা ১৪৩৬   ||   মার্চ ২০১৫

তুরস্কে, তুর্কিস্তানের সন্ধানে-৭

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

***

কামরায় ফিরে এলাম এবং আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত তখন এগারোটা।

ঘুম এলো, সঙ্গে নিয়ে এলো মধুর এক স্বপ্ন! আমার ঘুম এমনই, সেই শৈশব থেকে। কোন না কোন স্বপ্ন দেখি! আমার জীবনের স্বপ্নগুলোর কথা না হয় থাক, শুধু ঘুমের স্বপ্নগুলোও যদি লেখা হতো, রীতিমত একটা সুখপাঠ্য সাহিত্য হয়ে যেতো, যার নাম হতে পারতো স্বপ্ন-সাহিত্য । আজ ইস্তাম্বুলের প্রথম রাতটিও স্বপ্নের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হলো না। আধুনিক ইস্তাম্বুল থেকে চলে গেলাম দূর অতীতের সেই যুগের ইস্তাম্বুল শহরে। তখন পাকা সড়ক ছিলো না এবং গাড়ী ছিলো না, তবে ঘোড়া ছিলো। ঘোড়ায় চড়ে মুজাহিদীন ছুটে চলেছেন জিহাদের ময়দানে, আমি তাদের পিছনে দৌড়ে যাচ্ছি, আর চিৎকার করে বলছি, আমাকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও। এক মুজাহিদ ঘোড়া থামিয়ে বললেন, তুমি কীভাবে যাবে, তোমার তো ঘোড়া নেই, আর তুমি তো আমাদের যুগের মানুষ নও!

মুজাহিদীনের ফৌজ আমাকে ফেলেই চলে গেলো, আর আমি  তাদের পিছনে দৌড়াতে থাকলাম। একসময় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো, সুন্দর স্বপ্নটাও হোঁচট খেলো। কোমল শয্যায় উঠে বসলাম। মনটা অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভরে উঠলো। তবে সারা শরীরে ব্যথা অনুভূত হলো। আসলে এত কোমল শয্যায় শোয়ার অভ্যাস নেই; অভ্যাস থাকা উচিতও নয়। মনে হলো এবং কিছুটা লজ্জা পেলাম যে, এমন নরম বিছানায় এমন জিহাদি স্বপ্ন

দেখা আগাগোড়া স্বপ্নবিলাস ছাড়া আর কী! মুজাহিদীন তোমাকে ফেলে যাবে না তো কী করবে? তোমার কি ঘোড়া আছে?!

রাত তখন কত! পাশের শয্যায় মাওলানা আব্দুল মতিন ঘুমিয়ে আছেন। আলোটা না জ্বেলে  চশমা পরে রেডিয়াম ঘড়িটার কাছে গেলাম। দুটো বেজে কয়েক মিনিট। জানি, এখন আর ঘুম হবে না। যদি নিজের ঘরে থাকতাম, মনের এখন যে অবস্থা, কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে যেতাম। আমার এমন সময়ের লেখা অন্যরকম হয়। লেখার জন্য আমি এই রকম সময়ের প্রতীক্ষায় থাকি। সময় এলো, কিন্তু লেখার সুযোগ হলো না। না হোক, আফসোস নেই। আজকের এ সময়টুকু কলমের পরিবর্তে আমি রাব্বুল কলমের সান্নিধ্যে যাপন করবো।

অযু করে এলাম। জায়নামাযে দাঁড়ালাম। কয়েক রাকআত নামায পড়লাম। মনটা আশ্চর্যরকম কোমল হলো, আর্দ্র হলো এবং বিগলিত হলো। নিজের ঘরে এমন নামাযের কিছমত কমই হয়। জন ও স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন মুসাফিরের প্রতি আল্লাহর দয়া ও করুণা আসলেই অন্যরকম হয়; হোক না আমাদের মত আরামের সফর। মুনাজাতও হলো নীরব কান্না ও অশ্রুপাতের মুনাজাত। মুসাফিরের দিল এমনিতেই থাকে নরম, তার উপর বারবার মনে পড়লো মুসলিম উম্মাহর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া তুর্কিস্তানের কথা। মনে পড়লো কাশগড়ের কথা, একসময় কাশগড়কে মনে করা হতো মুসলিমজাহানের শেষ প্রান্ত। বলা হতো কায়রো থেকে কাশগড়কেমন আছে এখন কাশগড়ে তুর্কী মুসলিম জনগোষ্ঠী? কয়েকদিন আগেও সেখানে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে কমিউনিস্ট চীনের সামরিক বাহিনী। শাব্দিক অর্থেই রক্তের নদী বয়ে গেছে। বহু যুবক হয়েছে নিখোঁজ। মসজিদে জুমার জামাত হতে পারেনি বহু মাস। আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায় খবর আসে একেবারে ছিটেফোঁটা, এমনকি পরে খোঁজ নিয়ে যদ্দুর জেনেছি ইস্তাম্বুলের পত্রপত্রিকায়ও তেমন খবর নেই। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী এবং আমাদের হোটেলেই অবস্থানকারী ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বরং আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, চীনে তুর্কী মুসলমানেরা শান্তিতেই বসবাস করছে! কী অমার্জনীয় অজ্ঞতা এবং নির্লিপ্ততা!!  উইঘোর মুসলিমের রক্ত ঝরে, আর আমরা ঘুমে বেঘোর!!

মুনাজাত শেষে, কাঁচের দেয়াল সরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।

রাত গভীর হলেও ইস্তাম্বুল তখনো পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েনি। এখানে তো দিনের কর্মমুখর সময়েও মানুষের বা গাড়ীর শোরগোল নেই। গোটা জাতি কাজের মধ্যে থেকেও নীরবতা রক্ষা করার আশ্চর্য রকম যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাই ব্যাপক কর্মচঞ্চলতার মধ্যেও বিরাজ করে আশ্চর্য নীরবতা, যা মধ্যরাতে হয় আরো গভীর ও নিঝুম। ইউরোপ থেকে এই ভালো জিনিসটা এরা গ্রহণ করেছে। নাকি ভুল বললাম, ইউরোপ এই ভালো জিনিসটা এদের থেকে গ্রহণ করেছে। কোনটা সত্য তা সমাজ-সভ্যতার ইতিহাসের বিষয়। আমার লজ্জা লাগলো নিজেদের কথা ভেবে। আমাদের দেশে যখন কাজ থাকে না তখনো শোরগোল থাকে, আর কাজের

সময় তো শোরগোলটাই বেশী হয়।

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গভীর রাতের ইস্তাম্বুল দেখতে বড় ভালো লাগলো। রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যা দিনের তুলনায় অনেক কম হলেও একেবারে কম নয়; আসছে এবং যাচ্ছে। আলোগুলো দেখা যায়, আবার হারিয়ে যায়, আবার দেখা যায়, আবার হারিয়ে যায়; ভালোই লাগে। শহরের বিশাল অংশই এখান থেকে দেখা যায়, বহু দূরে সুলতান আহমদ মসজিদের মিনারগুলোর চূড়ায় আলো জ্বলছে। লাল আলোগুলো এখান থেকে স্পষ্টই দেখা যায়। বসফরাসের ওপারে ইস্তাম্বুলের এশীয় অংশও দেখা যায়, যেন পাহাড়ের গায়ে থরে থরে সাজানো আলোসজ্জিত এক স্বপ্নের শহর। সেখানেও বিভিন্ন মসজিদের মিনার-চূড়ায় লাল আলো জ্বলছে। উভয় অংশে যদ্দুর দেখা যায়, শহরটা যেন মিষ্টি আলোর চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার মধ্যে আলো ছড়িয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ীগুলো যেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের সজীবতা!

ঘুমন্ত ইস্তাম্বুল কি জানে, দূর দেশের এক মুসাফির এই গভীর রাতে কত মমতার সঙ্গে তাকে দেখছে! ভালোবেসে আরো কাছে টেনে তাকে আলিঙ্গন করতে চাইছে!! তার সবটুকু আলো, সবটুকু নৈঃশব্দ, সবটুকু স্নিগ্ধতা নিজের বুকে ধারণ করতে চাইছে!!!

কেন জানি হঠাৎ মনে পড়ে গেলো আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব তুরস্কের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগানের কথা। এই ইস্তাম্বুলেরই মানুষ তিনি। ১৯৫৪ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ইস্তাম্বুলের কাশিমপাশায় জন্মগ্রহণ করেছেন। সেই কাশিমপাশা

যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইস্তাম্বুল জয়ের সময়ের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা! তুরস্ক তখনো জানতো না, জানতো না এই ইস্তাম্বুল; একটি সদ্যভমিষ্ঠ শিশুর অবোধ কান্নার মধ্যে লুকিয়ে ছিলো তাদের হৃত গৌরবের নতুন মানচিত্র রচনাকারী এক মহান ব্যক্তিত্বের আগমনী ঘোষণা! খুব দরিদ্র একটি পরিবারে চোখ মেলেছিলেন রজব তাইয়েব এরদোগান। তাই বালকবয়সে এই ইস্তাম্বুল শহরেরই পথে পথে শরবত বিক্রি করে তাঁকে পরিবারের বাড়তি উপার্জনের যোগান দিতে হয়েছে। জীবনের দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে ১৯৯৪ সালের সাতই মার্চ তিনি এই ইস্তাম্বুল শহরের মেয়র নির্বাচিত হন। আজকের আধুনিক ইস্তাম্বুল মূলত এরদোগানেরই অবদান। মুস্তফা কামাল পাশার রেখে যাওয়া সামরিক বাহিনীর অক্টোপাসে তুরস্ক এই নিকট অতীতেও কতটা অসহায় ছিলো তা বোঝার জন্য এরদোগানের জীবনের একটি ঘটনাই যথেষ্ট।

১৯৯৭ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসাবে তিনি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। কারণ বড় বড় যেসব সমস্যায় ইস্তাম্বুলের নগরজীবন বিপর্যস্ত ছিলো, অক্লান্ত ও নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেগুলোর সফল সমাধান করেছিলেন, তার মধ্যে আবার কঠিনতম সমস্যা ছিলো পানির সঙ্কট এবং গুরুতর যানজট।

এমন একজন যোগ্য ও জনপ্রিয় নগরপতিকে সামরিক প্রভাবাধীন আদালতের বিচারে জেলে যেতে হয়েছিলো শুধু জনসভায় একটি কবিতা আবৃত্তি করার অপরাধে। বিখ্যাত তুর্কী কবির সে কবিতার যে চারটি লাইন তিনি আবৃত্তি করেছিলেন তা হলো-

মসজিদ আমাদের ব্যারাক/গম্বুজ আমাদের হেলমেট/মিনার আমাদের বেয়নেট/আর বিশ্বাস হলো আমাদের সৈনিক।

আদালতের দৃষ্টিতে এটা ছিলো কামালবাদ-এর প্রতি অবমাননা। এ অপরাধে তাঁকে নয় মাস জেলযুলুম সহ্য করতে হয়েছে। অথচ ঐ কবিতা শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিলো। আইন যখন ক্ষমতার মর্জিতে চলে তখন তা কেমন প্রহসনে পরিণত হয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ তো আমাদের দেশেই আমরা দেখতে পেলাম এই সেদিন।

তারপরো কি সামরিক বাহিনী এ অকুতোভয় বীরকে থামাতে পেরেছে তাঁর অগ্রযাত্রা থেকে?! এরদোগানের একে পার্টি ২০০২ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলো। তবে তিনি কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তখন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। কিন্তু ভিতর ও বাইরের সব চক্রান্তজাল ছিন্ন করে শেষ পর্যন্ত তিনি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী পদে সমাসীন হয়েছেন। সামরিক বাহিনীর লাগাম শেষ পর্যন্ত তিনি শক্ত হাতে টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এটা যে তাঁর কত বড় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কর্মকুশলতার পরিচয় তা শুধু তারাই অনুধাবন করতে পারবেন যারা তুরস্কের জাতীয় রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর নিঃশর্ত সাংবিধানিক ক্ষমতার কথা জানেন। সেনাবাহিনী প্রধান ইচ্ছা করলেই নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করতে পারতেন কামালবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার অজুহাতে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দীন আরবেকান, যার হাত ধরে এরদোগানের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা, ১৯৮০ সালে এই ঠুনকো অজুহাতে আরবেকান-সরকারকে সেনাবাহিনী বরখাস্ত করেছিলো, এমনকি তার দল ন্যাশনাল স্যলভেশন পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিলো।

এরদোগানের সুযোগ্য নেতৃত্বে তুরস্ক আজ সমৃদ্ধির পথে সুসংহত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। তুরস্ক এখন পৃথিবীর ১৭তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।

তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যাত্রা শুরু করেন, তুরস্ক তখন আই এম এফ-এর ঋণজালে আটকা পড়ে ছিলো, যার পরিমাণ ছিলো তিনহাজার কোটি ডলারেরও বেশী, দুহাজার দশ সালে যা নেমে এসেছে ছয়শ কোটি ডলারের কাছাকাছি। বিশ্বব্যাংকের মত মহাজনি সংস্থাও এরদোগানের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছে।

রজব তৈয়ব এরদোগানের জন্মস্থান ও প্রিয় শহর ইস্তাম্বুল এখন আমার সামনে। তিনি সম্ভবত এখন রাজধানী আঙ্কারায়। বড় ইচ্ছে হয়, শুধু একবার যদি এই সাহসী মুসলিম রাষ্ট্রনায়ককে নিজের চোখে দেখতে পেতাম! সে সুযোগ হয়ত পাবো না। এই গভীর রাতে তাঁরই প্রিয় শহরের এই হোটেল-ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মনে মনেই তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম।

পথে গাড়ীর সংখ্যা এখন অনেক কমে এসেছে, মাঝে মধ্যে একটা দুটো আসে যায়। গভীর তন্ময়তা নিয়ে আমি তাকিয়ে আছি দূরের সুলতান আহমদ মসজিদের মিনারচূড়ার লাল আলোর দিকে। ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে থেকে মুছে গেলো আলোপ্লাবিত আধুনিক ইস্তাম্বুলের ছবি। জেগে উঠলো দূর অতীতের ইস্তাম্বুল। ভাগ্যবিড়ম্বিত সুলতান আব্দুল হামীদের ইস্তাম্বুল; সুলতান মুরাদ, সুলতান সেলিম ও সোলায়মান আলকানুনীর ইস্তাম্বুল; সুলতান আহমদের ইস্তাম্বুল, যার মসজিদের মিনারচূড়ার লাল আলো আমাকে নিয়ে চলেছে অতীতের সফরে। একসময় আমি দেখতে পেলাম ইস্তাম্বুল নয়, কনস্টান্টিনোপল, যার নগর-দরজায় হামলা শুরু করেছেন বিজয়ী বীর সুলতান মুহাম্মদ আলফাতিহ। ঘোরতর যুদ্ধের মধ্যে আমি যেন দেখতে পাচ্ছি সুলতানের শান্তসৌম্য মুখমণ্ডল। ফজরের জামাতে তিনিই ইমামতি করলেন, তারপর মুনাজাত শেষে সমবেত মুজাহিদীনের উদ্দেশ্যে ঈমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে ঘোষণা করলেন, ইনশাআল্লাহ আজকের যোহর আমরা আদায় করবো আয়াছুফিয়ায়।

চূড়ান্ত হামলার আগে সুলতান এই বলে সন্ধিপ্রস্তাব পাঠালেন যে, আত্মসমর্পণ করো, আমি ওয়াদা করছি, তোমাদের জানমাল, ইজ্জত-আবরু এবং ধর্ম ও ধর্মস্থান সবকিছু নিরাপদ থাকবে।

ইতিহাসের পাতায় এ রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে যে, কী কারণে এমন নাযুক পরিস্থিতির মুখেও এমন একটি উদার সন্ধিপ্রস্তাব বাইজান্টাইন সম্রাট প্রত্যাখ্যান করে বসলেন! একেই হয়ত বলে নিয়তি ও তাকদীর।

সময়ের প্রাচীর এবং ইস্তাম্বুল নগরের প্রাচীর যেন একই সঙ্গে ধ্বসে পড়লো। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ভাঙ্গা প্রাচীরের আড়ালে নিশ্চিত পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়েও বাইজান্টাইন বাহিনী অর্থহীন সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করছে। লড়াই করছে, আর গোলার আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।

সুলতান মুহাম্মদ আলফাতিহের মুখে তখন সেই শান্ত স্নিগ্ধ হাসিটি ফুটে উঠলো যা ইসলামের প্রত্যেক বিজয়ী বীরের মুখে ইতিহাস দেখতে পেয়েছে যখনই তাঁর চোখের তারা আকাশ থেকে বিজয়ের আলোকরেখা দেখতে পায়। সুলতান তাঁর সংরক্ষিত বাহিনীকে তোপদুয়ারের সামনে নিয়ে এলেন, আর সরদার আগা হাসান, তাঁর ত্রিশজন জানবাজ সিপাহীকে নিয়ে পাচিলের উপর উঠে গেলেন। দুশমনের একটি গোলা এসে পড়লো, কয়েকজন সিপাহীসহ তিনি পাচিল থেকে পড়ে গেলেন, অবশিষ্ট সিপাহীদের উদ্দেশ্যে শেষ যে হুকুমটি তিনি দিলেন তা হলো, লাল হেলালী ঝাণ্ডা ওড়াও, সুলতানের পথ সাফ করো।

আগা হাসান, তোমার কবর কোথায়, জানি না; তোমার এবং তোমার সিপাহীদের শহিদী রূহকে আমার সালাম। বহু যুগের ব্যবধানে বহু দূর থেকে এক মুসাফির এসেছে তোমার শহীদী খুনে রাঙ্গা আজকের ইস্তাম্বুলে। এই নিঝুম রাতে স্মরণ করেছে তোমাকে। তুমি হয়ত এখন উড়ছো জান্নাতের বাগানে ছোট্ট পাখী হয়ে।

বাইজান্টাইন সম্রাট সাহসী, তবে নির্বোধ; তখনো তিনি বীরত্ব দেখিয়ে চলেছেন। হয়ত তার জানা ছিলো না, বিজয়ের জন্য জীবন দেয়া যেমন বীরের ধর্ম, তেমনি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য পরাজয় মেনে নেয়াও বীরের কর্ম। সম্রাট চিৎকার করে বলে উঠলেন, একজন ঈসাঈও কি নেই যে নিজের হাতে আমাকে কতল করতে পারে!

না, কেউ ছিলো না। তিনি তখন রাজপোশাক ছেড়ে উছমানী ফউজের এগিয়ে আসা সয়লাবের মধ্যে হারিয়ে গেলেন এবং বাহাদুরের মত লড়াই করেই নিহত হলেন। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেলো সুদীর্ঘ এগারশ বছরের বাইজান্টাইন সালতানাত। জানি না, এটা কি কোন কাকতালীয় ঘটনা, না এখানেও লুকিয়ে আছে ইতিহাসের অজানা কোন রহস্য যে, বাইজান্টাইন সালতানাতের সূচনা যার হাতে তার নাম ছিলো কনস্টান্টাইন, যার কারণে এই রাজধানী শহরটি বাইজান্টিয়া’- এর পরিবর্তে কনস্টান্টিনোপল নাম ধারণ করেছিলো; আবার তার পতন হলো যার মৃত্যুতে তারও নাম ছিলো কনস্টান্টাইন।

এই যে বিজয়ী মুসলিম বাহিনী এগিয়ে চলেছে সেন্ট ছুফিয়া গীর্জা অভিমুখে। সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে চলেছেন সবার আগে। বিজয়ের গর্বে তাঁর মাথা উদ্যত নয়, বিনয়ের ভারে অবনত। তিনি গীর্জার দরজার সামনে এসে ঘোড়া থেকে নামলেন। পরাজিত ও নিহত সম্রাট যদি সন্ধিপ্রস্তাব

মেনে নিতেন তাহলে সেন্ট ছুফিয়া গীর্জা হয়ত গীর্জাই থেকে যেতো, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ হলো। সুলতানের আদেশে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ছালীবী ঝাণ্ডা নামানো হলো, তারপর প্রথম আযান ধ্বনিত হলো গীর্জার গম্বুজ থেকে। সুলতান সেখানেই যোহর আদায় করলেন।

আমি আযানের ধ্বনি শুনতে পেলাম। মনে হলো, এ যেন সেন্ট ছুফিয়ার গম্বুজ থেকে ধ্বনিত সেই যোহরের আযান; কিন্তু না, ইতিহাসের প্রাচীর আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে। রাত তখন ভোর হয়ে গেছে। ইস্তাম্বুলের কোন এক মসজিদ থেকে, হয়ত দূরের সেই সুলতান আহমদের মসজিদ থেকে ফজরের আযান ধ্বনিত হয়েছে। ইতিহাসের তন্ময়তা থেকে যদিও তখন আমি জেগে উঠেছি, তবে আচ্ছন্নতার একটা ঘোর তখনো আমাকে ঘিরে রেখেছিলো। তাই আমার ভিতর থেকে কে যেন আমাকে আহ্বান জানালো, কবে সে খোয়ালি বাদশাহী/ সেই সে অতীতে আজো চাহি/জাস মুসাফির ফেলিস অশ্রুজল/যাক রে যাক তখত-তাউস/জাগরে জাগ বেহুশ...।

***

আমীর ছাহেবের কামরায় তিনজনের জামাতে ফজর আদায় হলো। খুব সামান্য সময় ঘুম হয়েছে, তবু নিজেকে বেশ সজীব ও তরুতাজা মনে হলো। কিছুক্ষণ পর আমরা নীচে নেমে এলাম। কিছু কিছু মেহমান আমাদের আগেই নেমে এসেছেন। সবুজ মাঠে পায়চারি করছেন। ভোরের মৃদুমন্দ বায়ুতে নিজেকে আরো তাজাদম লাগলো, ভুলে চাদরটা কামরায় ফেলে এসেছি, কিন্তু তাতে কোন অসুবিধা হলো না। হিমেল হাওয়া বরং ভালোই লাগলো। সবুজ ঘাসের ডগায় বাংলাদেশের মত শিশিরবিন্দু ছিলো না, তবে ঘাসগুলো বেশ ভেজা ছিলো। ইচ্ছে হলো খালি

পায়ে হাঁটি, কিন্তু আমীর ছাহেব সতর্ক করলেন, ঠাণ্ডা লাগিয়ে না আবার ঝামেলায় পড়েন! আমার মনে হলো, সৌজন্যের মোড়কে তিনি বললেন, আবার না ঝামেলায় ফেলেন

এত দূর দেশের সফরে ঝামেলায় পড়া, বা ফেলা কোনটাই সুবুদ্ধির পরিচয় হবে না। তাই সে ইচ্ছা থেকে বিরত থাকলাম। ঘাসগুলো সবুজ, বাংলাদেশের ঘাসও সবুজ, তবু দুই সবুজের মধ্যে কোথায় যেন সূক্ষ্ম একটি পার্থক্য রয়েছে, অনুভব করছি, কিন্তু শব্দে তুলে আনতে পারছি না। উপুড় হয়ে একচিমটে মাটি নিলাম। ইউরোপের মাটি। মনে থাকে না, বারবার ভুলে যাই, আমরা এখন ইউরোপের ভূখণ্ডে। মাটির পার্থক্যটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। বাংলাদেশের মাটির সেই পরিচিত কোমলতাটি নেই, আছে কেমন একটি রুক্ষতা। বসফরাসের ঐ পারে এশীয় ভূখণ্ড, ওখানকার মাটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতো, ইস্তাম্বুলের দুই মাটিতে কেমন পার্থক্য!

মুসলিম ভূখণ্ড, তা এশিয়ায় হোক, বা আফ্রীকায়, কিংবা ইউরোপে, মুসলিম হৃদয়ে তা একই রকম আবেগ সৃষ্টি করে, একই রকম মমতার বন্ধন জাগ্রত করে। এক্ষেত্রেও তাই হলো; পরম মমতায় হাতের তালুতে মাটিটুকুর স্পর্শ গ্রহণ করলাম। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, এ মাটি যেন চিরকাল আমাদেরই থাকে। কত শহীদের রক্ত ঝরেছে এই মাটির অধিকার অর্জন করতে! এই মাটিরই শয্যায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেযবান সাইয়েদেনা আবূ আইয়ূব আনছারী রাদিয়াল্লাহু আনহু! মাটির অধিকার অর্জন করা কঠিন, সে অধিকার রক্ষা করা আরো কঠিন। গাফলতের ঘুমে কত ভূমির, কত ভূখণ্ডের অধিকার এ পর্যন্ত হারিয়েছি আমরা! আর যেন হারাতে না হয় হে আল্লাহ! আলবেনিয়া ও

বসোনিয়া হার্জেগোভিনিয়ার রক্ত ভেজা মাটিও যেন আমাদেরই থাকে হে আল্লাহ!

***

যে মধুর স্মৃতি জীবনে কখনো ভুলতে পারবো না সেটা এবার উল্লেখ করছি, আমরা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে গিয়েছি। অর্থাৎ হোটেলের কাছাকাছি যারা পায়চারি করছেন তাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সূর্য তখন উঁকি দিয়েছে। নরম রোদে বেশ ভালো লাগছে। এটাকেই বোধ হয় বলে ইউরোপের নরম রোদ, আমাদের শীতকালের রোদের মতই, তবে ইউরোপে নাকি এ রোদের যথেষ্ট কদর, মানুষ নাকি তখন ঘরে থাকতে চায় না। হয়ত এটা ইউরোপের গভীর ভূখণ্ডের কথা। ভাবছি, হোটেলের কামরায় ফিরে যাই, এমন সময় দেখি, কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা সঙ্কোচ নিয়ে দুটি বালক, ভুল বললাম, দুটি আধফোটা বেলী ফুলের কলি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দুকদম আসে, আবার দ্বিধা-সঙ্কোচে দাঁড়িয়ে পড়ে, হয়ত ভাবে, আসবে কি আসবে না। কিছুটা অবাক হয়ে আমরাই ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম, সালাম দিলাম। এতে ওদের কিছুটা সাহস হলো, ফুলের নিষ্পাপ হাসি নিয়ে আমাদের একেবারে কাছে এসে দাঁড়ালো। এবার এমন করে হাসলো যেন কত কালের চেনা, যেন এই দুদিন আগে ওদের বাড়ী গিয়েছিলাম। সালামের জওয়াবটা দিলো, যেন আগে সালাম দেয়ার সুযোগ ফসকে যাওয়ায় খুব লজ্জা পেয়েছে। সেটা পুষিয়ে নিলো মুছাফাহার জন্য আগে হাত বাড়িয়ে দিয়ে। তুর্কী বালক, প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম, মাওলানা আব্দুল মতীনের ধারণা ছিলো, আরব বালক। কয়েকজন আরব মেহমান অবশ্য সস্ত্রীক এসেছেন। সঙ্গে আছে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে। আমার ধারণাই ঠিক হলো। দুজনই পকেট থেকে একটা কাগজ

বের করে কী যেন দেখে নিলো, তারপর দুজন একসঙ্গে বলে উঠলো- أهلا و سهلا في تر كيا তুরস্কের ভূমিতে স্বাগতম।

আনন্দে আমার বুকটা ভরে উঠলো। কে জানে, হয়ত ভবিষ্যত তুরস্কের কর্ণধার আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে! রজব তাইয়েব এরদোগান তো এমন বালকই ছিলেন পঞ্চাশ বছর আগের ইস্তাম্বুলে। কয়েক বছর আগে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। খুব ইচ্ছে ছিলো আরবী শেখার। সুযোগ ছিলো না। কাশিম পাশার যে স্কুলে পড়তেন, কোন আরবদেশের রাষ্ট্রদূত গিয়েছিলেন পরিদর্শনে। আগে থেকে মুখস্থ করে রেখেছিলেন কয়েকটি বাক্য। তারই সাহায্যে কথা বলবেন আরব মেহমানের সঙ্গে। কিন্তু মেহমানের সামনে গিয়ে ভুলে গেলেন মুখস্থ আরবী। এ ছেলেদুটি বোঝা গেলো আজকের তুরস্কের সফল প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বুদ্ধিমান। স্মৃতিশক্তির উপর ভরসা না করে কাগজে টুকে এনেছে। সেটাই এখন কাজে দিয়েছে।

আবার কাগজে চোখ বুলালো ওরা। আমিও আড়চোখে দেখলাম, আরবী হরফে নয়, রোমান হরফে লিখে এনেছে! হায় মুস্তফা কামাল, ধিক তোমাকে; ধিক তাদেরকে, তোমার মাথায় যারা এ শয়তানি বুদ্ধি ঢুকিয়েছিলো। আরবী হরফ বিলুপ্ত করে তুর্কীজাতিকে তুমি শতাব্দীর পথ পিছিয়ে দিয়েছো। তোমার দেশের দুটি বালক তাদের মেহমানদের সঙ্গে আরবীতে কথা বলতে চায়, কিন্তু আরবী হরফের সঙ্গে তাদের কোন পরিচয় নেই। হয়ত জানেও না, আরবী হরফই ছিলো তাদের ভাষার আসল বর্ণ!

এবার তাদের প্রশ্ন-كيف الحال؟ কেমন আছো?

বললাম, তাইয়েব, ওয়াল হামদু লিল্লাহ।

আমীর ছাহেব প্রশ্ন করলেন-وكيف أنتم؟ তোমরা কেমন আছো?

ছেলে দুটি বুঝতে না পেরে মুখ চাওয়াচাওয়ী করছে। আমার তো দিনরাতের কাজই হলো বাচ্চাদের আরবী নিয়ে। তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, অসুবিধাটা কোথায়? তাদের প্রশ্নটা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, কাইফাল হাল? এবার ওরা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, তাইয়েব।

মনে মনে প্রার্থনা করলাম রজব তাইয়েব এরদোগানের উত্তরসূরী, চিরকাল তোমরা তাইয়েব থেকো। বাতিল শক্তির অপছায়া থেকে চিরকাল আল্লাহ তোমাদের রক্ষা করুন।

ما اسمك؟ أين بلدك؟  এজাতীয় আরো কয়েকটি প্রশ্নের পর ওদের কাগজের সঞ্চয় ফুরিয়ে গেলো, কিন্তু উভয়ের চোখে মুখে তখন যেন দেশজয়ের আনন্দ। হয়ত মা-বাবার কাছে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বলবে তাদের সফলতার কাহিনী। মা হয়ত পরম মমতায় ওদের বুকে টেনে নেবেন, আর আল্লাহর শোকর আদায় করবেন। দৃশ্যটা কল্পনা করে আমার বুকটা আনন্দে ভরে ওঠলো। সালাম দিয়ে ওরা বিদায় নিলো, হয়ত নতুন মেহমানের খোঁজে। আমার ধারণাটা যে সত্য, বোঝা গেলো বিকেলে, এই মাঠে, একই স্থানে। ওদের অবশ্য বুঝতে দেইনি যে, আমরা সকালের সেই মেহমান। প্রশ্নের সঞ্চয় শেষ না হওয়া পর্যন্ত উত্তর দিয়ে গেলাম, আর সকালের মতই মাথায় হাত বুলিয়ে সাদর উৎসাহ দিলাম। হায়, এমন শৈশব আমারও ছিলো! কোন আরব মেহমানের সঙ্গে দুটি কথা বলতে পেরে সে আনন্দেই বিভোর থাকতাম সারা দিন। খুব ছোট্ট বেলা ঢাকা লালবাগ মাদরাসায় এসেছিলেন ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত, যাকে হত্যা করা হয়েছে স্লো পয়জন দিয়ে; অবশ্য তার আগেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন সুজানকে বিয়ে করে। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় তিনি ছিলেন সারা মুসলিম জাহানের

প্রাণপ্রিয় নেতা। এখনো ভাবলে মনটা ভরে ওঠে তাঁর সঙ্গে একটা দুটো কথা বলতে পেরেছিলাম বলে। আশ্চর্য, আজ এত বছর পর সেই আমাদেরই উপর দুটি তুর্কী বালক একই দিনে দুদুবার তাদের আরবীজ্ঞানের এক্সপেরিম্যান্ট চালিয়ে গেলো। কে জানে সেই সোনালী দিনটি কত দূর, যেদিন আরবী ভাষাই হবে মুসলিম উম্মাহর ভাব বিনিময়ের ভাষা!

***

আমরা তখন হোটেলের কাছে চলে এসেছি; কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে যাবো, এমন সময় আমীর ছাহেব ডান দিকে ইশারা করে বললেন, পাকিস্তানের মেহমান মনে হচ্ছে। তাঁরা দুজন সম্ভবত হোটেলের সীমানার বাইরে গিয়েছিলেন পায়চারি করতে, অথবা পায়চারি করতে করতে।

আমরা সাগ্রহে এগিয়ে গেলাম। নবীন যিনি তিনি পাকিস্তানের সর্বশ্রদ্ধেয় আলিম, আমাদের মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের প্রিয় ওস্তাদ, হযরত মাওলানা আর্ব্দু-রশীদ নোমানী ছাহেব রাহ.-এর ছাহেবযাদা মাওলানা আব্দুশ্-শহীদ নোমানী। প্রবীণ যিনি, তিনি তাঁর চাচা মাওলানা আব্দুল হালীম চিশতী। সৌজন্যবিনিময়ের পর আবার সেই প্রশ্ন, আবদুল মালিক ছাহেব আসেননি কেন?

আরে বাবা, সে দোষ কি আমাদের! মুখে অবশ্য কিছু বললাম না, অপ্রতিভ একটা হাসি শুধু ঝুলিয়ে রাখলাম। আমীর ছাহেব, বড় ভাই; তাঁরই দায়িত্ব কারণ ব্যাখ্যা করার। করলেনও, আর উভয়ে প্রচুর আফসোস করে বললেন, তিনি এলে সম্মেলনের রওনক অনেক বেড়ে যেতো। আচ্ছা, আমরা যে হিন্দুদের হাতে এতটা নাজেহাল হয়ে, কোনমতে জানটা নিয়ে এসে হাজির হলাম, তাতে কি রওনক একটুও বাড়লো না! খামোখা আবদুল মালেক, আবদুল মালেক! আসলে আমি গোস্সা করলে কী হবে; আল্লাহ যাকে মর্যাদা দেন এভাবেই দেন। হাঁ, একটু আধটু গিবতা করা যেতে পারে। তাতে হয়ত ছিটেফোঁটা আমাদেরও কিসমতে আসতে পারে।

আমীর ছাহেব আমাদের দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার পরিচয়টা একটু বেলুনফোলা করেই দিলেন। আমি কী যে বলেন! ভাব ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এ অবস্থায় কী করতে হয়, কী বলতে হয়, আসলে আমার জানা নেই।

বাংলাদেশের হালাত জিজ্ঞাসা করলেন। সংক্ষেপে যা বলা যায়, আমীর ছাহেব বললেন। মাদারিস ও আহলে মাদারিস-এর জন্য দুআ চাইলেন।

তাঁরাও পাকিস্তানের হালাত বললেন; কিছুটা বিশদ করেই বললেন। তাতে বোঝা গেলো, গুণগতভাবে আমাদের অবস্থা একই; পার্থক্য হচ্ছে মাত্রায়। বিশ্বরাজনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যদি মোটামুটি ধারণা থাকে তাহলে এতটুকু বোঝার  জন্য অবশ্য মতবিনিময়ের প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি ওয়াযিরিস্তান এবং পাক তালেবান সম্পর্কে যা বললেন সেটাও আমাদের পূর্বধারণা থেকে খুব বেশী ভিন্ন নয়। বিশদ আলোচনা এখানে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলাম। একসময় আমরা একটি দেশের দুটি ডানা ছিলাম। উভয় ভূখণ্ডকে আরো খণ্ডিত করার জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কিন্তু থেমে নেই। প্রতিটি মুসলিম জনপদকে আল্লাহ রক্ষা করুন, আমীন।

আবার দেখা হবে, এ আশা জানিয়ে আল্লাহ হাফিয বলে তাঁরা বিদায় নিলেন। নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হলো যে, হযরত নোমানী ছাহেব রা.-কে দেখার সৌভাগ্য যদিও হয়নি, তাঁর ভাই ও ছাহেবযাদাকে দেখার তাওফীক হলো।  

***

প্রিয় পাঠক, ভেবেছিলাম, আর তোমাকে ডাইনিং হলে ডেকে আনবো না। কিন্তু বিষয়টা এমনই উপাদেয় যে, লোভ সম্বরণ করা গেলো না। সুতরাং আজকের নাস্তার জন্য দুমিনিট সময় দাও।

ঢাকায় মোগলাই পরোটা পাওয়া যায়; কারণ ঢাকা ছিলো মোগলদের আঞ্চলিক রাজধানী। দিল্লীতেও পাওয়া যাওয়ার কথা; কারণ দিল্লীতে মোগলরা নেই, তবে তাদের বংশধর আছে। কিন্তু ইস্তাম্বুলে কি মোগলাই পরোটা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে? নেই। তাহলে ডাইনিং হলের দিকে যাওয়ার সময় আমার কেন বেমক্কা সাধ জাগলো মোগলাই পরোটা খাওয়ার! তারপর যদি মোগলাই-এর কাছাকাছি প্রজাতির কোন পরোটা পেয়ে যাই, অধমের কারামাত বলে মেনে নিতে আপত্তি আছে? জ্বি, যেটা পেলাম সেটার সঙ্গে মোগলাই পরোটার পার্থক্য ততটুকুই যতটুকু দুধের সঙ্গে ঘোলের। আর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে বাঙ্গালীর পারঙ্গমতা তো সর্বজনবিদিত। সুতরাং আমিও মোগলাই ভেবে চোগলাই পরোটা পরম তৃপ্তির সঙ্গে আহার করলাম। চোগলাই নামটা আমার দেয়া, নামকরণের কারণ অবশ্যই আছে। থাক সে প্রসঙ্গ।

লাইনে দাঁড়াতে হয়, আগেই বলেছি। ভাবছি থালা-বাসন নেবো, এর মধ্যেই পাকিস্তানের মাওলানাদ্বয় উপস্থিত। আমাদের দেখে, কোন কথা নেই, একে একে তিনটি বাসন নিয়ে আমাদের তিনজনের দিকে লীজিয়ে বলে এগিয়ে দিলেন। মাটির কথা অনেক বলেছি; বলে বলে বদনাম হয়ে গেছি। এখানে আর মাটির কথা বলবো না; শুধু বলবো, এটা তাঁরা পারেন এবং করেন। আমরাও পারতে পারি, যদি চেষ্টা করি; চেষ্টা করতে দোষ কী?!

আমরা যে টেবিলে বসলাম, প্রথমে লক্ষ্য করিনি একজন বৃদ্ধ মেহমান, তাঁর খাদেমসহ বসেছেন। চেহারা দেখে যে কয়টি দেশের হতে পারেন বলে আন্দায করলাম, তার একটি হলো থাইল্যান্ড। ধারণা ঠিক হলো, থাইল্যান্ডের মুসলিমপ্রধান প্রদেশ পাত্তানি-এর সর্বজনমান্য আলিম, সরকারী মহলেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। পাত্তানী সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারের সন্ধি আলোচনায় একাধিকবার মধ্যস্থতা করেছেন। এসব তথ্য অবশ্য জেনেছি পরে। যে বিষয়টি আমার সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটা হলো তাঁর অতি সাধারণ বেশভূষা, দেওবন্দী টুপি এবং খাওয়ার তরীকা। ছোট ছোট লোকমা তুলছেন, আর বিসমিল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, অনুচ্চ স্বরে বলছেন। পরে আরো জানা গেলো, তিনি দেওবন্দের ছাত্র। পাত্তানে তার মাদরাসা রয়েছে। প্রতিটি মুসলিম জনপদেই এমন মানুষ আছে, সংখ্যায় কম হলেও আছে। তাঁরা যত দিন বেঁচে থাকেন, মুসলিম জনপদের জন্য আল্লাহর রহমতরূপেই বেঁচে থাকেন। বসোনিয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠী যখন সার্ব নরপশুদের বর্বরতায় বিপর্যস্ত তখন নূরানি ফিরেশতার ছবি দেখেছিলাম পত্রিকায়। তিনি বসোনিয়ার (মরহুম) প্রেসিডেন্ট ইজ্জত আলী জাহ-এর ধর্মীয় উপদেষ্টা ও মুফতী। প্রেসিডেন্ট-এর পক্ষে তিনি জিহাদের ফতোয়া জারি করেছিলেন এবং নিজে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। তাঁর সেই নূরানি ছবি আজো আমার হৃদয়ে জ্বলজ্বল করছে। জিহাদের ময়দানে তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন, ঠিক সেই দিন যেদিন বসোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী জাতিসঙ্ঘের আমন্ত্রণে নিউইয়র্ক  সফর করে রাজধানী ফিরলেন। জাতিসঙ্ঘবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিমানবন্দর থেকে বের হলেন, আর সার্ভ হানাদাররা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে সেখানেই হত্যা করলো। রক্ষীবাহিনী চেয়ে চেয়ে দেখলো!

***

প্রিয় পাঠক, নাস্তার কথা বলে তোমাকে ডাইনিং হলে এনেছি, সুতরাং একটু মিষ্টিমুখ করিয়ে তারপর বিদায় জানাই। মধুর চাকের মত মিষ্টিটার কথা তো বলেছি, আজকে আবার নিলাম ছুরি দিয়ে যত্নের সঙ্গে কেটে এবং খেলাম একটু একটু করে স্বাদটা উপভোগ করে। সেই স্বাদের কথা কীভাবে বোঝাই! ছোট্ট একটি টুকরো মুখে দিয়ে একটু চাপ দাও, ভিতর থেকে রস বের হয়ে তোমার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়বে, আর মিষ্টির শরীরটা  জিভে ও তালুতে লেগে থাকবে। ধীরে ধীরে গলতে থাকবে। একসময় গলে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু মুখে স্বাদটা লেগে থাকবে। চমচমের স্বাদ তো জানো, সেটাকে তিনগুণ করো, তখন সেটা এই মিষ্টির স্বাদের কাছাকাছি হবে।

***

সাড়ে নয়টায় শুরু হবে আজকের প্রথম অধিবেশন। খুব বেশী সময় নেই। কামরায় গিয়ে প্রস্তুত হয়ে নেমে এলাম। মেহমানগণ ধীরে ধীরে সম্মেলনকক্ষে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে কক্ষ প্রায় পূর্ণ হয়ে গেলো।

তিনটি প্রবন্ধ পাঠ করা হলো। সম্ভবত সময় স্বল্পতার কারণে বেশ তাড়াহুড়া করেই পড়তে হলো। ফলে বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম করা ছিলো কঠিন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শ্রোতাদের মধ্যেও তেমন আগ্রহ ছিলো না। তন্দ্রাচ্ছন্নতা ছিলো কারো কারো মধ্যে। মনে হয়, প্রবন্ধপাঠকারীর নযরে তা এড়ায়নি। সময়ের বিচারে দুটি প্রবন্ধই যথেষ্ট ছিলো। শ্রোতাদের, হৃদয়ঙ্গম করার জন্য, সময় দিয়ে আরো ধীরে ধীরে পাঠ করলে ভালো হতো।

প্রথম প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেছেন আরবজাহানের শীর্ষস্থানীয় গবেষক মুহাদ্দিছ শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামাহ। তার প্রবন্ধের শিরোনাম হলো- تو حيد الجهود في خدمـة السنة النبويـة  সুন্নাহর খেদমতে সমন্বিত প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তা।

তাঁর বক্তব্যের খোলাছা হলো, বর্তমানে হাদীছ চর্চার ক্ষেত্রে একটি বড় ফেতনা এই দেখা দিয়েছে যে, যাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, মেধা ও প্রজ্ঞা নেই তারাও অবলীলায় হাদীছের উপর কাজ করছেন, ব্যাখ্যা-ভাষ্য লিখছেন এবং তাহকীক ও গবেষণার নামে অনধিকার চর্চা করছেন। ফলে এমন নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, আওয়াম তো বটেই, সাধারণ আলিমদের জন্যও সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

দ্বিতীয় সমস্যা এই যে, যারা হাদীছ চর্চা করছেন এমনিতেই তাদের সংখ্যা অল্প, তদুপরি তারা হাদীছের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও শাস্ত্রীয় বিষয়াদির প্রতিই শুধু গুরুত্বারোপ করে থাকেন, হিফযে হাদীছ বা হাদীছ মুখস্থ করার প্রতি তাদের মোটেও মনোযোগ নেই। ফলে যুগের মানদণ্ডে দুএকজনকে হাদীছের আলিম বলা গেলেও হাদীছের হাফিয বলা যায়, এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ আমাদের সালাফের মধ্যে হিফযে হাদীছের গৌরবময় ধারাবাহিকতা বিদ্যমান ছিলো।

তৃতীয় সমস্যা হলো পঠিত বা অর্জিত হাদীছের উপর আমল করা এবং শায়খের ছোহবত ও তারবিয়াত গ্রহণ করার মাধ্যমে আত্মসংশোধন করা, এ বিষয়ের প্রতি ইহতিমাম প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথচ আমাদের সালাফের অবস্থা এই ছিলো যে, হাদীছের দরস শেষে আযান হয়েছে, আর এক ছাত্র অযু করার জন্য বাইরে যাচ্ছে; শায়খ তখন বললেন, তোমার সম্পর্কে তো আমার সুধারণা ছিলো। নামাযের ওয়াক্ত হয়েছে, অথচ তুমি অযুর অবস্থায় নও!

আরো বড় ফেতনা এই যে, এরূপ ধারণা ব্যাপক হয়ে পড়েছে যে, হাদীছের জন্য শায়খের প্রয়োজন নেই। নিজের অধ্যয়ন দ্বারাই হাদীছ হাছিল করা যায়। বরং এটাকে প্রশংসার বিষয় মনে করা হয় যে, অমুক কোন শায়খ ছাড়া নিজস্ব মেধা ও অধ্যয়নের মাধ্যমে ইলম হাছিল করেছে।

এ তো হলো ঐ সকল ফেতনা যা হাদীছের সেবক বলে যারা পরিচয় দেন তাদের কারণে সৃষ্ট। পক্ষান্তরে শত্রুদের পক্ষ হতে হাদীছে নববীর উপর যে বহুমুখী হামলা চলছে তা বর্তমান যুগে সব সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছে।

সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পর তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে প্রয়োজনীয় সমাধানও পেশ করেছেন। পুরো প্রবন্ধটি শাবাকায় দেখা যেতে পারে।

***

তাছাওউফের শরয়ী ভিত্তি শিরোনামে দ্বিতীয় প্রবন্ধটি পেশ করেছেন মৌরিতানিয়ার আলিম শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বইয়াহ। (তাঁর পক্ষ হতে পাঠ করেছেন শায়খ ডক্টর আহমদ জাবালাহ)। এ প্রবন্ধে তিনি, তাছাওউফের নামে যারা শরীয়তের সীমা লঙ্ঘন করে তাদের যেমন বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করেছেন তেমনি যারা তাছাওউফ-এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে চায় তাদের বক্তব্যও কোরআন সুন্নাহর দলীল দ্বারা খণ্ডন করেছেন। তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ, যুক্তিনির্ভর ও তথ্যসমৃদ্ধ।

***

তৃতীয় প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেছেন সউদী আরবের শায়খ ডক্টর আব্দুল ইলাহ আলআরফাজ, বিষয়বস্তু ছিলো, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য : মাযহাব ও লা-মাযহাব।

তাঁর বক্তব্যের খোলাছা হলো, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কোরআন ও সুন্নাহ উম্মাহর ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো বিভিন্ন মাযহাব ইসলামী উম্মাহর ঐক্যের পথে অন্তরায় কি না? চার মাযহাব কি এক দ্বীনুল ইসলামকে চার দলে ও ফেরকায় বিভক্ত করেছে? এবং কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে মুসলমানদের একটি ফিক্হ-এর উপর ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব কি না?

প্রথমে তিনি শরীয়তের দৃষ্টিতে মাযহাব-এর হাকীকত আলোচনা করেছেন। তারপর কোরআন ও সুন্নাহর দলীল দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, মাযহাব আলাদা কোন শরীয়ত নয়, বরং শরীয়তের প্রায়োগিক ব্যাখ্যা। যিনি মুজতাহিদ, আল্লাহ যাকে ইজতিহাদের যোগ্যতা দান করেছেন তিনি কোরআন ও সুন্নাহ থেকে আহকাম ও মাসায়েল আহরণ করেছেন। শরীয়তের পক্ষ হতেই মুজতাহিদের প্রতি এ আদেশ ছিলো, আর তিনি সে আদেশ পালন করেছেন। তাই হাদীছ শরীফে এসেছে, মুজতাহিদ যদি নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হন তাহলে তিনি দুটি আজর পাবেন, আর যদি ভুল করেন তাহলে একটি আজর পাবেন।

পক্ষান্তরে যার মধ্যে ইজতিহাদী যোগ্যতা নেই, সে যদি ঘটনাক্রমে নির্ভুল সিদ্ধান্তেও উপনীত হয়, আজর পাবে না, বরং গোনাহগার হবে। কারণ সে অনধিকার চর্চা করেছে।

হানাফী মাযহাব মানে ইমাম আবু হানীফার শরীয়ত নয়, বরং শরীয়ত, তথা কোরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে তাঁর বুঝ ও ব্যাখ্যা, যারা হানাফী মাযহাব অনুসরণ করে তারা মূলত কোরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে নিজস্ব বুঝ না থাকার কারণে আবু হানীফা রহ.-এর বুঝ ও ব্যাখ্যা অনুসরণ করে। অন্যান্য মাযহাব সম্পর্কেও একই কথা।

ইজতিহাদের বিভিন্নতা স্বয়ং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতিতে ঘটেছে এবং তিনি তা অনুমোদন করেছেন। যেমন বুখারী শরীফের বর্ণনায় রয়েছে, বনু কোরায়যার গাযওয়ার দিন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবাকে আদেশ করলেন, তারা যেন বনু কোরায়যার বস্তিতেই আছর পড়ে। কিন্তু পথে ওয়াক্ত হয়ে গেলো। তখন মতপার্থক্য দেখা দিলো। একদল পথেই আছর আদায় করে নিলো। তাদের যুক্তি হলো, নামায তো ওয়াক্তের মধ্যেই পড়তে হবে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদেশ করেছেন তার উদ্দেশ্য ছিলো দ্রুত পৌঁছার বিষয়ে তাকীদ করা। আরেক দল বনু কোরায়যায় পৌঁছার পর আছর পড়লেন, অথচ তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে এবং মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছে। তাঁদের যুক্তি ছিলো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশের সরল অর্থটি অনুসরণ করা।

লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, ছাহাবা কেরামের মতপার্থক্যটি ঘটেছে যুদ্ধের নাযুক সময়ে, যখন ঐকমত্য ছিলো সময়ের সবচে বড় প্রয়োজন। অথচ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মতপার্থক্যের কথা অবগত হয়ে কোন দলকেই তিরস্কার করেননি, বরং উভয়ের কর্মপন্থা অনুমোদন করেছেন।

সুতরাং সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো যে, ইজতিহাদের ঐক্য সম্ভবও নয়, শরীয়তের কাম্যও নয় এবং তা উম্মাহর ঐক্যের পরিপন্থী কোন বিষয়ও নয়।

***

প্রবন্ধপাঠকারী নিজেও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। গলা শুকিয়ে আসছে, তিনচারবার গলা ভিজিয়ে নিলেন, তবে পানি দ্বারা নয়, কোমলপানীয় দ্বারা। আমাদের দেশে বক্তাকে পানি পান করে গলা ভিজিয়ে নিতে দেখেছি; গলা ভেজানোর জন্য কোমল পানীয়-এর ব্যবহার এই প্রথম দেখলাম। হয়ত সামান্য বিষয়, হয়ত উল্লেখযোগ্যই নয়, কিন্তু আমার কাছে একটু দৃষ্টিকটুই লেগেছে। পানি দ্বারা যে প্রয়োজন মিটে যায়, তার জন্য চারশ মানুষের আটশ চোখের সামনে কোমল পানীয় কেন? প্রশ্নটি বৈধতার নয়, শিক্ষার, সংস্কারের, সৌজন্যের। যাক।

প্রবন্ধপাঠ শেষ হওয়ার পর ঘোষক একটি সুসংবাদ ঘোষণা করলেন। হাঁ, অনেকের জন্যই সেটা ছিলো সুসংবাদ, বিশেষ করে আমার জন্য। আরবজাহানের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ইসলামী চিন্তাবিদ ও তাফসীর বিশারদ শায়খ মুহাম্মাদ আলী আছ্-ছাবূনী (হাফিযাহুল্লাহ)-এর উপস্থিতি। তাঁর সঙ্গে আমার আত্মিক পরিচয় তাঁর অনবদ্য তাফসীর গ্রন্থ صفوة التفاسير -এর মাধ্যমে। এর শুরুতে রয়েছে আমার প্রিয়তম হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ.-এর সংক্ষিপ্ত প্রশংসাপত্র, যাতে তিনি তাফসীর ও তাফসীরকার উভয়ের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। এ তাফসীর যতই পড়ি, ততই মুগ্ধ ও অভিভূত হই; হৃদয় ততই বিগলিত হয়; আত্মার জগত কোরআনের সম্পদে ততই সমৃদ্ধ হয়। আজ প্রায় ত্রিশবছর এ তাফসীর আমার সঙ্গী, আমার বন্ধু, আমার পথের আলো।

তখন থেকে মনের মধ্যে একটি আকাক্সক্ষা সুপ্ত ছিলো যে, কখনো কোন সুযোগে যদি একবার, শুধু একবার তাঁর সঙ্গে দেখা হতো, অন্তত একবার তাঁকে দেখা হতো! জাগতিক কোন উদ্দেশ্য ছিলো না। শুধু আল্লাহর জন্য যাকে ভালোবাসি, একবার তাঁকে দেখা, দেখে চোখের তারায় কিছু নূর অর্জন করা।

হজ্বের সফরে দুএকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে ছিলো আমার মত অখ্যাত অজ্ঞাত মানুষের অতি দুর্বল চেষ্টা। সুতরাং তা সফলতার মুখ দেখেনি। ভাবতে পারিনি, হৃদয়ের গভীর প্রকোষ্ঠে সযত্নে লালিত এ আকাঙ্ক্ষা, আজ এখানে ইস্তাম্বুলের মাটিতে আমার পূর্ণ হবে, এমনভাবে! আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন বান্দার হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা, দিলের আরযু এভাবেই পূর্ণ হয়।

অধিবেশনের মধ্যসময়ে তিনি মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন, মঞ্চে তখন কিছুটা চঞ্চলতা সৃষ্টি হলো, তাঁকে সসম্মানে বসানো হলো। বুঝতে পারিনি, ইনি আমার সেই প্রিয় তিনি। কারণ আমি তো তাঁকে চিনতাম না, ছবিও দেখিনি। শুনেছি, ছবি হারাম হওয়ার বিষয়ে এ উপমহাদেশের আলিমদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি একমত না হলেও ছবি পছন্দ করেন না এবং নিজের ছবি তুলতে দেন না।

ঘোষকের মুখে তাঁর নামটি শুনে অন্তরে আনন্দের কেমন ঢেউ সৃষ্টি হলো তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যদি ঘোষণা করা হতো, রজব তাইয়েব এরদোগান উপস্থিত হবেন তাহলেও এত আনন্দ হতো না, যদিও বর্তমান মুসলিম জাহানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে তিনি আমার অতিপ্রিয় ব্যক্তি।

ঘোষক আরো ঘোষণা করলেন, শায়খ ছাবূনী অধিবেশনের সমাপ্তি মুনাজাত পরিচালনা করবেন। তাতে আরো আনন্দ হলো। মাইক তাঁর সামনে রাখা হলো। দূর থেকে অস্পষ্ট হলেও মোটামুটি দেখা যাচ্ছিলো। এবার আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছনের পর্দায় তাঁর ছায়ার প্রতিফলন ঘটানো হলো, যাতে কক্ষে উপস্থিত সবাই ভালোভাবে দেখতে পায়। আমিও দেখতে পেলাম। মনে হলো, আখের যামানার সেই মানুষগুলোর জীবন্ত প্রতিনিধি! চেহারা শুধু নূরানী নয়, চেহারা থেকে নূর যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে। নূরানী চেহারা এ যুগেও আছে অনেক, কিন্তু নূরের বিচ্ছুরণ ঘটে, এমন চেহারা বড় দুর্লভ।

তিনি মুনাজাত করলেন। সংক্ষিপ্ত মুনাজাত, কিন্তু হৃদয় কোমল করে এবং কুবূলিয়াতের আশা জাগ্রত করে, এমন মুনাজাত! আমার চোখ যদিও ভিজলো না, তবে হালকা কান্নার আওয়ায কানে এলো।

আল্লাহর পক্ষ হতে এ অপ্রত্যাশিত দান পেয়ে খুশিতে আমি আত্মহারা হলাম এবং অন্তরের অন্তস্তল থেকে শোকর আদায় করলাম। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি, আমার জন্য আল্লাহর এ দান হবে উপচে পড়া দান! যথাসময়ে তা বলার আশা রাখি।

চলবে ইনশাআল্লাহ

 

 

advertisement