কে অন্ধ, কে চক্ষুষ্মান?
এ আবার কেমন প্রশ্ন! ছোট বাচ্চাও তো জানে কে অন্ধ, কে চক্ষুষ্মান। অন্ধ হল, যে চোখে দেখে না; যার দৃষ্টিশক্তি নেই। যার কাছে সূর্যের আলো আর অমাবশ্যার অন্ধকার সমান। যার কাছে আলো-আঁধার, কালো-সাদা সমান। আর যে চোখে দেখে সে চক্ষুষ্মান। তাহলে এ প্রশ্ন কেন, আর এর উত্তরই বা কী? এ অন্ধ তাহলে কোন্ অন্ধ?
হাঁ, প্রকৃত অন্ধ কে, এ প্রশ্নের উত্তর জেনে নিই সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে। তাকে দান করেছেন দৃষ্টিশক্তি ও চিন্তাশক্তি। আল্লাহ বলছেন,
فَإِنَّها لا تَعْمَى الْأَبْصارُ وَلكِنْ تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ
‘প্রকৃতপক্ষে চোখ অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয়।’ -সূরা হজ্ব ২২ : ৪৬
তাহলে হৃদয়ও অন্ধ হয়! বরং যার হৃদয় অন্ধ সেই সবচেয়ে বড় অন্ধ। হৃদয় যদি অন্ধ না হয় তাহলে তো নবীকে চর্মচক্ষে না দেখেও একজন অন্ধ হেদায়েতের আলো গ্রহণ করে সাহাবীর মর্যাদায় ধন্য হতে পারে। দৃষ্টির অন্ধত্ব আলোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কত অন্ধ আছে, যে হেদায়েতের আলোয় আলোকিত হচ্ছে। কিন্তু যার হৃদয় অন্ধ; সূর্যের আলোতেও সে পথ খুঁজে পায় না!
رَبَّنَا لا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
‘হে আমাদের রব! তুমি আমাদের যে হেদায়েত দান করেছ তারপর আর আমাদের অন্তরকে বক্র ও সত্যলংঘনপ্রবণ করো না। এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদেরকে বিশেষ রহমত দান কর। নিশ্চয় তুমিই মহাদাতা। -সূরা আলে ইমরান ৩ : ৮
যে এই পৃথিবীতে অন্ধ সে তো চিরঅন্ধ নয়। বরং চিরঅন্ধ হল, এই পৃথিবীতে যার দৃষ্টিশক্তি আছে কিন্তু তা দিয়ে সে ‘আলো’ দেখতে পায় না। পার্থক্য করতে পারে না আলো-আঁধারের মাঝে, হক-বাতিলের মাঝে। আলোকে ভাবে অন্ধকার, আর মরিচিকাকে ভাবে পিপাসা নিবারণকারী শীতল পানি। এরা ‘আল্লাহর নূর’-কে অন্ধকার ভেবে (বরং আলো বলে জানার পরও) মুখ ফিরিয়ে নেয় আর ছোটে ‘অন্য আলো’র পিছে। আল্লাহ ওদের সম্পর্কেই বলছেন-
وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنتُ بَصِيرًا قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنسَى
‘আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন হবে বড় সংকটময়। আর কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাব। সে বলবে, হে রব! আমাকে যে অন্ধ করে ওঠালে? আমি তো দুনিয়ায় চক্ষুষ্মান ছিলাম! আল্লাহ বলবেন, এভাবেই তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আজ সেভাবেই তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে। -সূরা ত্ব-হা ২০ : ১২৪-১২৬
হাঁ, আজ যেমন তারা নিজেদের চক্ষুষ্মান, মহাজ্ঞানী বলে দাবি করছে আর যারা আল্লাহর ‘যিকর’ ও আল্লাহর হেদায়েতের অনুসরণ করছে, যারা ‘অন্য সকল আলো’ (আলো নামক অন্ধকার) ছেড়ে ‘ইসলামের নূর’-এর অনুসরণ করছে- তাদেরকে অন্ধ বলছে,‘ধর্মান্ধ’ বলছে, যারা মঙ্গলপ্রদীপে মঙ্গল খুঁজে ফিরছে, আর দ্বীনদারিকে বলছে, সেকেলে, পশ্চাৎপদ ও কুসংস্কার, কাল কিয়ামতের দিন তারা দেখতে পাবে কারা অন্ধ আর কারা চক্ষুষ্মান!
আজ যেমন তারা নিজেদের জ্ঞানী ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন বলে দাবি করে, কাল কিয়ামতের দিনও বলবে, ‘আল্লাহ! আমাকে যে অন্ধ করে ওঠালে? আমি তো দুনিয়ায় দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ছিলাম (বরং দৃষ্টিশক্তিসম্পন্নদের সেরা ছিলাম)!!
ওরা আসলে দুনিয়াতেও অন্ধ; যদিও ওদের চোখ আছে। কারণ অন্ধ যেমন বুঝতে পারে না, কোনটা সাদা কোনটা কালো, তেমনি ওরাও চিনতে পারে না সাদা-কালো, আলো-আঁধার। আল্লাহ ওদেরকে দুনিয়াতেও অন্ধ বলেছেন-
وَمَن كَانَ فِى هَذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الْآخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيلاً
‘আর যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অন্ধ হয়ে থেকেছে সে আখেরতেও অন্ধ ও অধিকতর পথভ্রষ্ট থাকবে।’ -সূরা বনী ইসরাঈল ১৭ : ৭২
আরেকটি বিষয় হল, (ওদের কথা থেকে যেমনটা মনে হয়) বাস্তবেই যদি ধর্মান্ধ বলে তারা এরকম বোঝাতে চায় যে, ধার্মিক ব্যক্তিরা ধর্মের কারণে মঙ্গলপ্রদীপ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ইত্যাদি সংস্কৃতি (হোক তা পৌত্তলিকদের ধর্মীয় বিষয়) গ্রহণ করছে না, এগুলো থেকে বারণ করছে- এগুলো হল, ধর্মান্ধতা; তাহলে তাদের প্রতি করুণাই করতে হয়। এগুলোর পর ধর্ম বলে আর কী থাকে?
ধর্মান্ধ শব্দের আরেকটি কপটতা হল, যাদেরকে ওরা ‘ধর্মান্ধ’ বলছে তারা যেন অন্ধভাবে ধর্ম পালন করছে আর ওরা সঠিকভাবে ধর্ম পালন করছে (?!)
মাঝেমধ্যেই ওরা ওদের লেখা ও বক্তব্যে বা নাটক ও টকশোতে ‘ধর্মান্ধ’ শব্দ ব্যবহার করছে এবং একরকম উপদেশের সুরে বলতে চাচ্ছে, ধর্ম সঠিকভাবে পালন করা দরকার। অথচ বাস্তবতা হল, ওদের কেউ নাস্তিক, কেউ ধর্মবিদ্বেষী।
আসলে ওরা আখেরাতে অবিশ্বাসী, প্রবৃত্তিপূজারী, সত্য প্রত্যাখ্যানকারী ও প্রকৃত অন্ধ। আল্লাহ ওদেরকে অন্ধ বলছেন আর ওরা যাদেরকে ধর্মান্ধ বলে গালি দিচ্ছে তাদের জ্ঞানী (চক্ষুষ্মান) বলছেন-
أَفَمَنْ يَعْلَمُ أَنَّما أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ أَعْمى إِنَّما يَتَذَكَّرُ أُولُوا الْأَلْبابِ
‘আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, যে ব্যক্তি তা সত্য বলে বিশ্বাস করে আর যে অন্ধ তারা কি সমান? বস্তুত উপদেশ কেবল তারাই গ্রহণ করে, যারা জ্ঞানী।’ -সূরা রা’দ ১৩ : ১৯
সুতরাং আমরা দিল থেকে বলি,
رَضِيتُ بِاللَّهِ رَبًّا، وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولاً
রব হিসেবে আমি আল্লাহকে পেয়ে সন্তুষ্ট। দ্বীন হিসেবে ইসলাম পেয়ে সন্তুষ্ট। নবী হিসেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়ে আমি সন্তুষ্ট।
اللَّهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الإِيْمَانَ وَزَيِّنْهُ فِيْ قُلُوبِنَا، وَكَرِّهْ إِلَيْنَا الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ وَاجْعَلْنَا مِنَ الرَّاشِدِينَ.
হে আল্লাহ! ঈমানকে আমাদের কাছে (সবচেয়ে) প্রিয় বানিয়ে দিন এবং ঈমানকে আমাদের অন্তরে সুশোভিত করে দিন। কুফ্র, পাপাচার ও নাফরমানীকে আমাদের কাছে ঘৃণার বিষয় বানিয়ে দিন আর আমাদের করুন সুপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। আমীন