আমাদের ভবিষ্যত জীবন
মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ
সকল মানুষেরই স্বপ্ন থাকে। সুন্দর ও সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আমরা শুধু নিজেদের ভবিষ্যতের কথাই চিন্তা করি না, অধীনস্ত ও সংশ্লিষ্টদের কথাও ভাবি। বাবা তার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করেন। উস্তাদ তার শাগরিদের আলোকিত ভবিষ্যত আকাঙ্খা করেন। কিন্তু ভবিষ্যত সম্পর্কে সবার ধারণা এক নয়। অনেক মানুষ ভবিষ্যত বলতে শুধু দুনিয়ার জীবনের অবশিষ্ট সময়টুকুই বোঝে। আর তা সুখী ও সমৃদ্ধ করার জন্য স্বদেশ ও স্বজন ছেড়ে সুদূর বিদেশের মাটিতে প্রবাসী জীবন কাটায় এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের দৃষ্টিতে বান্দার প্রকৃত ভবিষ্যত জীবন কোনটি, যাকে সুখময় ও উজ্জ্বল করার জন্য সে সারা জীবন মেহনত-মোজাহাদা করবে?
আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বারবার বিভিন্নভাবে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তার প্রকৃত জীবন হল আখেরাতের জীবন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) ‘আর এই পার্থিব জীবন খেলাধুলা ছাড়া আর কিছুই নয়। বস'ত পরকালের আবাসই হল চিরন্তন (ও প্রকৃত আবাস।) যদি তারা জানত।’-সূরা আনকাবূত : ৬৪
অন্যত্র ইরশাদ করেন, (তরজমা) হে আমার সমপ্রদায়, পার্থিব এ জীবনের নেয়ামতরাজি তো কেবল জীবন ধারণের সামান্য উপকরণমাত্র। বস্তুত পরকালই হচ্ছে স্থায়ী আবাস। -সূরা মুমিন : ৩৯
অন্যত্র আরো ইরশাদ করেন, (তরজমা) বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দাও। অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।-সূরা আ’লা : ১৬-১৭
আরো ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) পার্থিব জীবন তো খেলা ও তামাশা ব্যতীত আর কিছুই নয়। নিশ্চয়ই পরকালের আবাস মুত্তাকীদের জন্য উত্তম। তোমরা কি ভেবে দেখ না?-সূরা আনআম : ৩২
অন্য জায়গায় ইরশাদ করেন, (তরজমা) এবং আখিরাতের পুরষ্কার তাদের জন্য উত্তম, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে।-সূরা ইউসুফ : ৫৭
আরো ইরশাদ করেন, আর নিশ্চয়ই আখিরাত মর্যাদায় মহত্তর ও গুণে শ্রেষ্ঠতর।-সূরা বনী ইসরাইল : ২১
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনার জন্য ইহকাল অপেক্ষা পরকাল উত্তম।-সূরা আদ দ্বোহা : ৪
এজন্য আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দাকে বারবার তার প্রকৃত ভবিষ্যত, পরকালের জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের তাগিদ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, (তরজমা) হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। প্রত্যেকে ভেবে দেখুক, আগামী দিনের জন্য সে কী প্রেরণ করেছে। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সম্যক অবগত।-সূরা হাশর : ১৮
অন্যত্র আরো ইরশাদ করেন, (তরজমা) তোমরা সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এরপর প্রত্যেককেই তার কর্মের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হবে এবং তাদের প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না।-সূরা বাকারা : ২৮১
তদ্রূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্নভাবে তাঁর বাণী ও কর্মের দ্বারা মানুষকে ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে সচেতন করেছেন।
এক হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আল্লাহ, আখেরাতের জীবনই একমাত্র জীবন। অতএব তুমি আমাদের ও মুহাজিরদের সংশোধন কর।-সহীহ বুখারী ২/৯৪৯
একবার হযরত উমর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে দেখলেন যে, তিনি খালি চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। ফলে তাঁর পার্শ্বদেশে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে হযরত উমর রা. কেঁদে ফেললেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উমর! কাঁদছ কেন? উমর রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিসরা ও কায়সার কত ভোগ-বিলাস ও আরাম আয়েশের মধ্যে ডুবে আছে। অথচ আপনি আল্লাহর রাসূল! (দোজাহানের সরদার আপনার এই অবস্থা!)
তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (তরজমা) তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের জন্য দুনিয়া, আর আমাদের জন্য আখেরাত?-সহীহ বুখারী ২/৭৩০
মুমিনের জন্য দুনিয়া ভোগ ও উপভোগের জীবন নয়। দুনিয়াতে সে একজন পথিক, যার গন্তব্য সামনে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, দুনিয়াতে এমনভাবে থাক, যেন তুমি একজন পরদেশী আগুন্তুক অথবা পথিক-মুসাফির।-সহীহ বুখারী ২/৯৪৯
অতএব বুদ্ধিমান ঐ ব্যক্তি, যে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করে এবং চিরস্থায়ী জীবনের শান্তি ও সফলতার জন্য সচেষ্ট হয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক সাহাবী প্রশ্ন করলেন -মানুষের মধ্যে সর্বাধিক বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ কে?’ উত্তরে নবীজী বললেন, যারা মৃত্যুকে অধিক স্মরণ করে এবং মৃত্যুর জন্য অধিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে, বস্তুত তারাই বুদ্ধিমান। তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে সম্মানিত।-আলমু’জামুস সগীর তবারানী ২/৮৭
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মৃত্যুর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহে পড়ে যায় এবং দুনিয়ার সাধ ও অভিলাষ চরিতার্থ করার পিছনে পড়ে জীবনের মূল্যবান সময় শেষ করে দেয়, ভবিষ্যতের জন্য পাথেয় সংগ্রহের কোনো ফিকিরই করে না, উপরন' চিরস্থায়ী বঞ্চনা ও অসহনীয় কঠিন আযাবকে গ্রহণ করে, তার মতো নির্বোধ ও অপরিণামদর্শী আর কে আছে? তাই রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বিচক্ষণ ঐ ব্যক্তি, যে নিজের হিসাব গ্রহণ করে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কাজ করে। আর অক্ষম (নির্বোধ) ঐ ব্যক্তি, যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে আর আল্লাহ তাআলার কাছে অমূলক আশা করে।-জামে তিরমিযী ২/৭২
সাহাবায়ে কেরামের জীবন যাপনে উপরোক্ত আদর্শের উত্তম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
প্রচণ্ড এক শীতের রাতে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবুদ্দারদা রা.-এর বাড়িতে কিছু লোক মেহমান হলেন। তিনি গরম খাবার দিয়ে তাদের মেহমানদারি করলেন। যখন ঘুমানোর সময় হল তখন মেহমানরা দেখলেন যে, সে কক্ষে লেপ বা কম্বল নেই। তাদের একজন বললেন, আমি আবুদ্দারদা রা.-এর কাছে তা বলি। অপরজন বাঁধা দিলেন। কিন্তু তিনি গিয়ে হযরত আবুদ্দারদা রা.-এর কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন যে, তিনি শুয়ে পড়েছেন এবং তার গায়ের উপর একটিমাত্র পাতলা কাপড়, যা ঠাণ্ডা প্রতিহত করতে পারে না। তিনি আবুদ্দারদা রা.কে লক্ষ করে বললেন, আমরা যেমন শীতের কাপড় ছাড়া রাত্রিযাপন করছি আপনাকেও তো তেমনি দেখছি। হযরত আবুদ্দারদা রা. বললেন, আমাদের অন্য একটি বাড়ি আছে। আমরা যা কিছু সংগ্রহ করতে পারি তা সেখানে পাঠিয়ে দেই। এই বাড়িতে কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা অবশ্যই তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতাম। আর ঐ বাড়িতে যাওয়ার পথ বড় দুর্গম। হালকা ও বোঝাহীন ব্যক্তি বোঝাবাহী ভারি ব্যক্তির চেয়ে অনেক সহজে সেই পথ অতিক্রম করতে পারবে। তাই আমরা আমাদের বোঝা হালকা করতে চেয়েছি। অতঃপর তিনি মেহমানকে বললেন, বুঝেছ ভাই? তিনি বললেন, হাঁ, বুঝেছি। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।-ছিফাতুস সাফওয়াহ ১/২৮৩; হিলয়াতুল আওলিয়া ১/২৮৪
জনৈক বুযুর্গ বলেছেন, তুমি দুনিয়ার জন্য এই পরিমাণ শ্রম দাও যতদিন তুমি তাতে থাকবে। আর আখেরাতের জন্য ততটুকু শ্রম দাও যত সময় তোমাকে তাতে থাকতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে কুরআন-হাদীসের মর্মবাণী যথাযথ অনুধাবন করার এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে প্রকৃত জীবন তথা আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।