কৌতূহলেরও লাগাম থাকা চাই
ঘর থেকে বের হলাম। বাজারে যাব, কিছুদিন আগে একটি পানির কল কেনা হয়েছিল। দাম দেওয়া হয় নি। দামটা দেওয়ার জন্য যাচ্ছি। পথে নামার পর অনেকের সাথেই দেখা। অনেককে সালাম দেওয়া হল। অনেকের সালাম গ্রহণ করা হল। সবকিছু ঠিকঠাক মতই চলল। সমস্যা বাধাল দু ব্যক্তি। তাদের ব্যাপারটাকে সমস্যা না বলে কী বলব বুঝতে পারছি না। পথের মাঝামাঝিতে দেখা প্রথম ব্যক্তির সাথে। আসসালামু আলাইকুম। ওয়াআলাইকুমুসসালাম। কেমন আছেন? ভালো আছি। চলন্ত পথে কিছুটা গতি কমিয়ে কুশল বিনিময় হয়ে গেল। সেও চলমান। আমিও। এ পর্যন্ত চলার পর লোকটা চট প্রশ্ন করে বসল, কই যান ভাই? বললাম, এই তো একটু সামনে। লোকটি আচ্ছা বলে চলে গেল। আমিও সামনে চলতে থাকলাম আর ভাবতে থাকলাম, আমি কোথায় যাচ্ছি, এ প্রশ্নটা কি লোকটার জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল? লোকটার মনে এই যে কৌতূহল জাগল, আমি কোথায় যাচ্ছি, এর কি কোনো যৌক্তিক কারণ আছে? লোকটা অবশ্যই আমার প্রতি আন্তরিক। কিন্তু এই প্রশ্নের হেতু কী? আমি বুঝতে পারছি না। প্রায় পথে ঘাটে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যারা প্রশ্নটা করে, তাদের এর উত্তর জানার আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাদেরকে উত্তরটা দিতে হয়। উত্তরটা দেওয়ার জন্য হাঁটার গতি কমিয়ে আনতে হয়। কিংবা চলতে চলতে বিপরীত দিকে হাঁটতে থাকা একটি লোকের সাথে কথা বলতে হয়। একটি অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের অপ্রয়োজনীয় উত্তর। এসব কথা ভাবছি, এমন সময় আরেক লোকের প্রশ্ন, ভাই কই যান? থমকে দাঁড়ালাম, এই তো একটু সামনে যাচিছ। মুখে বললাম এটা। মনে মনে বললাম, আমি ‘কই যাই’ আপনার জানার কী প্রয়োজন ভাই?
এমন অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের একটা কারণ হতে পারে, দেখা যখন হল, কিছু একটা তো বলতে হবে, তাই একটা প্রশ্ন করে দেওয়া। উত্তরটা জানার গরজ তার মধ্যেও নেই। যার কারণে ‘এই তো একটু সামনে’ জাতীয় উত্তর পেলেই সে খুশি। সে আর একথা জানতে চায় না, সামনে কোথায়? সামনে কী কাজ? কেন যাচ্ছেন? কখন ফিরবেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। কারণটা যদি এতটুকু হয়, তাও কিছুটা সহনীয়। কিন্তু অনেক সময় এসব প্রশ্নের পেছনে কৌতূহল কাজ করে। কৌতূহল থেকে যখন প্রশ্ন করা হয়, তখন কথাবার্তা একটি প্রশ্নে থেমে থাকে না। তখন কৌতূহল মেটানোর জন্য একের পর এক অনেক প্রশ্ন হতে থাকে। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আসলে এই ব্যক্তির জানার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে বেচারা উত্তরদাতার কতরকম পেরেশানীতে যে পড়তে হচ্ছে, সে খবর তার নেই। কখনো এমন কিছু প্রশ্ন চলে আসে যেগুলোর উত্তর দারুণ বিব্রতকর। তবু প্রশ্নকর্তাকে শান্ত করার জন্য উত্তর দিতে হয়। সব শুনে প্রশ্নকর্তা বলে, ও আচ্ছা। অনেক সময় এজাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিজের খাছ কথাও প্রকাশ করে দিতে হয়। অনেক সময় দারুণ লজ্জার মধ্যে পড়তে হয়।
মাদরাসায়ে নূরিয়ার মসজিদ। বেশ বড়সড় মসজিদ। মুসল্লীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। মাদরাসার ছাত্র শিক্ষক ও মহল্লার মুসল্লীদের নিয়ে বেশ বড়সড় জামাতই হয়। যোহরের নামাযের পর মুআয্যিন সাহেব ঘোষণা করলেন, ‘‘আজকে যারা ফজরের নামায এই মসজিদে পড়েছেন, তারা নামাযটা পুনরায় পড়ে নিবেন।’’ বেশীর ভাগ মুসল্লীই মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। মহল্লার লোকজনও মাশাআল্লাহ সমঝদার। সবাই যা বোঝার বুঝে নিল। ব্যাস, এ নিয়ে আর কথাবার্তা হল না। সবাই যার যার নামায পুনরায় পড়ে নিল। বিষয়টা পরিষ্কার, বিশেষ কোনো কারণে নামাযটা হয় নি। যে ব্যাপারটা তিনি তখন টের পান নি। পরবর্তীতে টের পেয়েছেন। তাই এখন যোহরের ওয়াক্তে জানিয়ে দিয়েছেন। এখানে একটি প্রশ্ন মনে জাগতে পারে, কী হয়েছিল? ইমাম সাহেব তাহলে উযু ছাড়া নামায পড়িয়েছেন! নাকি তার কাপড় পাক ছিল না! এসব প্রশ্ন মনের মধ্যে আসতেই পারে। কিন্তু বুদ্ধিমান লোক কখনো এর পিছনে পড়ে থাকবে না। সে তার করণীয় কাজ যেটা সেটাই করবে। ইমাম সাহেবকে গিয়ে প্রশ্নগুলো করে বসার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সেদিন আমি দেখলাম, এ ঘটনার কয়েক দিন পর এক লোক ইমাম সাহেবকে প্রশ্ন করছেন, সেদিন ফজরে কী সমস্যা হয়েছিল? প্রশ্ন শোনে বেচারা ইমাম সাহেব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলেন। লোকটি ইমাম সাহেবকে প্রশ্ন করে দিব্যি তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকল। বেচারা ইমাম সাহেব কোন রকম একটা উত্তর দিয়ে সেখান থেকে সরে পড়লেন।
অনেক সময় এমন হয়, কাউকে বললাম যে, ‘‘আমার স্ত্রী অসুস্থ, দুআ করবেন, আল্লাহ যেন সুস্থ করে দেন’’। তখন লোকটির কাজ হল, স্ত্রীর জন্য হয়ত নগদ দুআ করা কিংবা দুআ করার কথা বলা। কিন্তু অনেক সময় এক্ষেত্রেও এমন অযথা কৌতূহলের সামনে পড়তে হয়। লোকটি চট করে প্রশ্ন করে বসে, কী হয়েছে ভাই? তখন বাধ্য হয়ে বলতে হয়, পেট ব্যথা। এরপর শুরু হয় অযথা কিছু প্রশ্ন এবং তার চেয়েও অযথা কিছু উত্তর। কিসের ব্যথা ভাই? অমুক রোগের ব্যথা। ব্যথাটা কোন দিকে? ডান দিকে, ইত্যাদি। অথচ এসব জানার তার কোনো প্রয়োজন নেই। তাকে আমার স্ত্রীর রোগের বিবরণ দেওয়ার জন্যও আমি তার কাছে আসিনি। আমি শুধু তার কাছে দুআ চেয়েছি। তার উচিত হল, দুআ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা। হ্যাঁ, কখনো মানুষ রোগ সম্পর্কে জানতে চায়, ভালো কোনো পরামর্শ দেওয়ার জন্য। সেটা অবশ্যই আলাদা ব্যাপার। কিন্তু তখনও প্রশ্ন করার তরিকা আছে।
আসলে এ ব্যাপারগুলো উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। এখানে প্রয়োজন কিছুটা আকলের। কিছুটা বুদ্ধিমত্তার। আমার কাছে যে জিনিস কেউ চাচ্ছে না, আগে বেড়ে সেই জিনিস মানুষকে দিতে যাওয়াটা সবক্ষেত্রে সুখকর নয়। হ্যাঁ, আমি যদি কারো কাছে পরামর্শ নেওয়ার উদ্দেশ্যেই যাই, তখন তো ব্যাপারটা উভয়ের কাছেই পরিষ্কার থাকার কথা। কিংবা আমার গভীরতম ও অন্তরঙ্গ কোনো মানুষ যদি হয়, যার সাথে আমার বেতাকাল্লুফ সম্পর্ক, তো সেখানে অবশ্যই ভিন্ন কথা। আসলে ব্যাপারগুলো যেহেতু সম্পূর্ণই আকল ও বুদ্ধির সাথে সম্পর্কিত, এগুলো উদাহরণ দিয়ে আর ধারা উপধারা উল্লেখ করে বোঝানোর বিষয় না। আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং সবাইকে বোঝার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।