স্মৃতির মজলিস : হায়াতে মুহাদ্দিস : উম্মাহর পাথেয়
সকাল থেকে শেষ দুপুর। সৌরভমাখা পবিত্র স্মৃতির এক মজলিস বসেছিল মুহাম্মাদপুরে। বেড়িবাঁধের তিনমাথা থেকে বসিলা রোডে সামান্য গেলেই হাতের ডানে একটু ভেতরে জামিয়াতুল আবরার রাহমানিয়া। সেই জামিয়ার নবনির্মিত মসজিদের নিচতলায়। এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর জীবন ভিত্তিক বই প্রকাশ হয়েছে; ‘হায়াতে মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.’। হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. দীর্ঘকাল ছিলেন লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়ার শায়খুল হাদীস, মুহাদ্দিস ও প্রিন্সিপাল এবং জীবনের শেষভাগে যাত্রাবাড়ি মাদরাসার তিরমিযী শরীফের দরস দান করেছেন। শায়খুল হাদীস মাওলানা আজীজুল হক ছাহেব রাহ.-সহ বহু বিখ্যাত ও প্রজ্ঞাবান মুহাদ্দিসের তিনি ছিলেন উস্তায। তাঁরই জীবনী ও স্মারকগ্রন্থ। সে বই প্রকাশের শুকরিয়া স্বরূপ অনুষ্ঠান। প্রবীণ আলেমগণ সে মজলিসে তাদের সৌরভমাখা স্মৃতি তুলে ধরেছেন।
১৬ই ডিসেম্বর ’১৪ সকাল সাড়ে নয়টায় মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর ‘জীবন ও কর্ম : উম্মাহর পাথেয়’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিচালনা করেন জামি‘আতুল আবরার রাহমানিয়া’র মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম আল-মাসউদ ছাহেব এবং মা‘হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া’র পরিচালক মুফতী মাহমূদুল আমীন ছাহেব। এ আলোচনা সভার আয়োজন করে গ্রন্থটির প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান ‘মাকতাবাতুল আশরাফ’। বাংলাদেশ নূরানী তা‘লীমুল কুরআন ওয়াকফ এস্টেটের মহাপরিচালক মাওলানা রহমাতুল্লাহ ছাহেব-এর মুনাজাতের মাধ্যমে দুপুর আড়াইটায় অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়। এরপর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়।
বর্ষীয়ান শায়খুল হাদীস ও হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী ছাহেব বলেন, ‘আমি গ্রামে পাহাড়পুর মাদরাসায় জালালাইন পর্যন্ত পড়ার পর আমার আববাজান রাহ. আমাকে নিয়ে রাস্তায় আসেন এবং বলেন বাবা কোথায় পড়বে? বললাম, লালবাগে। বললেন, তোমাকে হাটহাজারী পড়তে হবে। বললাম, আববা আমি লালবাগে পড়ার ইচ্ছা করেছি। লালবাগে পড়বে তো মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের কাছে চিঠি লিখে দিচ্ছি। তাঁর কাছে পেশ করতে হবে। আববা হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর সাথী ছিলেন। আমি লালবাগে গিয়ে আববার চিঠিটি হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরকে দিলাম। তিনি তো মাদরাসার মুহতামিম। পরীক্ষা নিবেন মাওলানা হারূন ছাহেব চাটগামী। হারূন ছাহেবের নাম লিখে দিলেন। হারূন ছাহেব পরীক্ষা নিলেন। পাশে মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর বসা। হারূন ছাহেব প্রশ্ন করলেন, هديا هديا بالغ الكعبة এখানে هديا টা موصوف এবং بالغ الكعبة টা صفةআর-نكرة এর صفة - نكرة আসে। তো এখানে هديا টা তো نكرة এবং بالغ الكعبة مضاف ومضاف اليه হয়ে معرفة হয়েছে। তাহলে তারকীব কিভাবে সহীহ হবে? সঙ্গে সঙ্গে বললাম, হুযূর! هديا যদিও نكرة আর بالغ الكعبة টা مضاف ومضاف إليهএটা اضافت لفظى। আর اضافت لفظى - معرفة হয় না। এটাও نكرة সুতরাং نكرة এর صفة - نكرة-ই হল। হুযূর খুশি হয়ে গেলেন। বললেন,
عبد الحی کامیاب ہو گئے ہو، کامیاب ہو گئے ہو
লালবাগের দোতলায় দাওরায়ে হাদীসের কামরা ছিল। একদিন নিচে নামছিলাম। দূর থেকে দেখছিলাম যে, হাফেজ্জী হুযুর হাউজের পাড়ে বসা আছেন। আর ঠিক মক্তবের বাচ্চা যেমন উস্তাযের সামনে বসে ঠিক সেভাবে একজন বৃদ্ধলোক হাফেজ্জী হুযুরের সামনে বসা আছে। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখি তিনি হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর রাহ.।
হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর রাহ. এমন বিনয়ী ছিলেন এমন বিনয়ী ছিলেন যে, এরূপ বিনয়ী এ যমানায় দেখা যায় না।’
হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. ও হযরত হারদুই হুযুর রাহ.-এর খলীফা হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান ছাহেব বলেন, ‘আমি হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরকে বারবার দেখেছি, তাঁর কামরায়ও অনেকবার গিয়েছি। হুযুরকে আমার খুব ভালো লাগতো।’
মতিঝিল জামিআ দারুল উলূমের মুহতামিম, বায়তুল মুকাররমের সাবেক পেশ ইমাম মাওলানা রফীক আহমাদ ছাহেব বলেন, ‘আমার এক উস্তায ছিলেন মাওলানা জিয়াউল ইসলাম ছাহেব রাহ.। তাঁর বাড়ি ছিল বি.বাড়িয়া। তাঁর কাছে আমি নূরানী কায়েদা পড়েছি। তিনি দেওবন্দ ও সাহারানপুর পড়েছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। তখন তিনি বললেন,
ایک بات ہے جو کوئی نہیں جانتا، میں جانتا ہوں، وہ یہ کہ حضرت محدث صاحب رح حضرت تھانوی رح کے اجازت یافتہ ہے، حضرت تھانوی رح نے انکو اجازت دی ہے،حضرت تھانوی رح کے خلیفہ ہے، لیکن محدث صاحب اسکو بھی ظاھر نہیں کیا میں اسکو جانتا ہوں۔
আর পরবর্তীতে তিনি বাইআত হয়েছেন হযরত থানবী রাহ.-এর খলীফার খলীফার কাছে। তাওয়াযুর এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া কঠিন।
আমার দৃষ্টিতে মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর যে বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল, তাঁর বয়ানে আজীব এক তারতীব থাকত। মাযমূনগুলো সব বয়ান করতেন। এমন সুন্দর তারতীব থাকত একটা কথার পর আরেকটা কথা যে বলতেন এত মুনাজ্জাম থাকত। আর এভাবে অনর্গল আসানির সাথে বলতেন মনে হয় একটা ভরা কলস কাত করে ধরা হয়েছে, আর পানি গড়গড় করে পড়ছে। আর তিনি যে বয়ান করতেন পুরা বাসীরাতের সাথে বয়ান করতেন; কোনো শক-সন্দেহ, দ্বিধা-সংকোচ বা কোনো প্রকারের ইতস্ততা ছিল না। এমন মনে হত, মাযমূনগুলো তাঁর এমনভাবে মুখস্থ যেমন হাফেযে কুরআন কুরআন হিফয করেছে। এভাবে আহাদীস, উলূম ও মা‘আরিফ তাঁর যেহেনে মুরাত্তাব ছিল, মজবুতির সাথে ছিল।’
জামিয়া নূরিয়ার প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা ইসমাঈল ছাহেব বলেন, ‘হুযুর কখনোই দোজানুর বাইরে যেতেন না; যত ঘন্টাই বসে থাকতে হোক। তাঁর একটি বাক্য পরিষ্কার মনে আছে-
جب جب درس حدیث شروع ہوتا ہے تو مدینہ منورہ روضۂ اطہر کے ساتھ ایک لاسلکی تعلق ہو جاتا ہے۔
لاسلکی تعلق অর্থাৎ বেতার সম্পর্ক। এটা তিনি নিজের জীবনে করে দেখিয়েছেন। ব্যাস! নিজে বসলেন এসে, দেড়-দুই ঘন্টা বসলেন। বসলেন তো বসলেন। বেশির থেকে বেশি এপাশ থেকে ওপাশ। কিন্তু দোজানু ঠিক আছে। পূরা দরসের কাইফিয়াতটা এমন যে, তিনি সব দিকে একেবারে একমাপে চেহারা ঘুরিয়ে কথা বলতেন। এটা নযীরবিহীন।
জামিয়া রাহমানিয়ার মুহতামিম ও হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর ছাহেবযাদা হযরত মাওলানা হিফযুর রহমান মুমিনপুরী ছাহেব বলেন, ‘হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. শুধু ইলমী হাইসিয়াতেই নয় বরং প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যাপারে তার অনন্য যোগ্যতা ছিল। এ বিষয়টি হাফেজ্জী হুযুর রাহ. ও হযরত ছদর ছাহেব রাহ. বুঝেছিলেন। যার কারণে হযরত ছদর ছাহেব রাহ. তাঁকে জামে‘আ কুরআনিয়ার মুহতামিম বানিয়েছিলেন। হযরত ছদর ছাহেব রাহ. বলতেন, একটি পাহাড় আমি রেখে গেলাম, এ পাহাড় যতদিন থাকবে জামি‘আ কোনদিন টলবে না, তার নিজস্ব উসূলের উপর অটল থাকবে।’
জামিয়া রাহমানিয়ার প্রধান মুফতী ও শায়খুল হাদীস মুফতী মনসূরুল হক ছাহেব বলেন, ‘মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. চাইতেন, ছাত্ররা সবসময় দরসে হাজির থাকুক। নাগাহ না দিক। এক ছাত্র, তার কণ্ঠস্বর সুন্দর ছিল। সে বিভিন্ন মাহফিলে তিলাওয়াত করত। এটা হুযুর জানতে পারলেন। তো হযরত রাহ. তাকে দরস থেকে উঠিয়ে দিয়ে বললেন,
آپکے یہاں کیا کام ہے آپ جائیے کہاں جلسہ ہو رہا ہے وہاں جائیے قرائت پڑھئے یہاں آپ کا کیا کام ہے۔
অথচ এটা আমাদের নযরে মনে হতে পারে এতে ভুলের কী ছিল। মূলত এটা ইলমী ইনহিমাকের খেলাফ ছিল। আরেক দিন দরস চলছিল। হঠাৎ হুযুর কিতাব বন্ধ করে উঠে চলে গেলেন। কেউ বুঝতে পারল না, কি হল। তো একজন বলল, আমি কানে কাঠপেন্সিল ঢুকিয়েছি, এটাই কারণ।
হযরত রাহ. ছাত্রদের যে কোনো ভুল দেখলে সতর্ক করে দিতেন। সংশোধন করে দিতেন। আমি একবার হাউজে ওযু করছিলাম। হুযুর অপর পাশে। তো একহাতে পানি নিয়ে চেহারা ধুচ্ছিলাম। হুযুর সেখান থেকে ডাক দিয়ে বললেন, চেহারা দুই হাতে ধুইতে হয়। আরেকবার নামায পড়তে হুযুরের পাশে দাঁড়াই। নামায শেষে হুযুর বললেন, তোমার রুকুতে বেশি ঝোঁকা হয়ে যায়। এমনিভাবে অন্যদেরকেও সতর্ক করতেন। তা‘লীম-তরবিয়াতে এত চৌকান্না ছিলেন, যা অকল্পনীয়।
মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা’র রঈস ও মাসিক আলকাউসারের সম্পাদক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ছাহেব বলেন, ‘আমি লালবাগে ভর্তি হয়েছি হেদায়া জামাতে। যে বছর আমি ভর্তি হয়েছি সে বছর কোনো কারণে আমাদের এক মুরুববী ফোন করেছিলেন। তখন মোবাইল ছিল না, ডিজিটাল ফোনও ছিল না, শুধু এনালগ ফোন ছিল। তখনকার লালবাগে দুইটা টেলিফোনসেট ছিল। একটা মাদরাসার দফতরে থাকত। আরেকটা ফোন থাকত হুযুরের রুমে। কখনো দফতর বন্ধ থাকলে বা ফোন উঠানো না হলে মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর উঠাতেন। একদিন মাগরিবের পরে বা অন্য কোনো সময় (আমরা দোতলায় থাকতাম উত্তর পাশের বিল্ডিং-এ) হযরত ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠেছেন। দোতলায় উঠে বললেন যে, ‘আব্দুল্লাহ কুমিল্লায়ী কে, তার ফোন এসেছে’। এখনো সে কথা মনে হলে আমার শরীর শিউরে ওঠে, শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। হুযুরের বয়স বেশি থাকা সত্ত্বেও তিনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছেন।
পরবর্তীতে জেনেছি যে, এটা একজনের ঘটনা নয়। দফতরের ফোন মিস হতে পারে, কিন্তু মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের রুমে ফোন আসলে এটা মিস হওয়ার কোন ভয় নেই। হযরত ধরবেনই এবং খবর দিবেন।
তিনি ছিলেন নীরব প্রশাসক। তখনকার সময়ে এত সুন্দর নেযামী প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে আর ছিল না, এটা সবাই জানত। কোনো শব্দ ছাড়া একটা বড় জামেয়াকে পরিচালনা করা এটা অন্য কোথাও ছিল না। আইন-কানুন পিটিয়ে সেখানে মানানো লাগতো না। সবাই এটাকে ফরয মনে করত- আইন মেনে চলা, নিয়ম মেনে চলা। এই নীরব পরিচালনা, শব্দ ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানের মূল কাজগুলোকে চালিয়ে নেয়া এটা তাঁর যাহেরী দক্ষতা এবং খোদাদাদ কাবেলিয়াত। এটা ছাড়া আর কিছু আমরা মনে করি না।’
মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স-এর খতীব, মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস মুফতী দিলাওয়ার হোসাইন ছাহেব বলেন, ‘আমাদের কপাল খুলেছে যে, আমি হুযুরের কাছে পড়তে পেরেছি। হযরত রাহ. যে শুধু দরস দিতেন তা নয়; বরং একজন ছাত্রকে কিভাবে গড়া যায় এমনভাবে তরবিয়াত দিতেন যা এখন আমরা কল্পনাও করতে পারি না। ছাত্র নিজেও টের পেত না যে, হুযুর আমার প্রতি কিভাবে লক্ষ্য রাখেন। হুযুর রহ. ছিলেন استاذ مقوم (যে উস্তায ছাত্রদের শুধুমাত্র পড়ান না; বরং গড়েনও)। আমি আমার জীবনে যাদেরকে استاذ مقوم হিসেবে পেয়েছি হুযুর তাঁদের অন্যতম।
হুযুর সকল ছাত্রের নাম জানতেন। আমল-আখলাক সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কিন্তু ছাত্ররা তা জানত না।’
মারকাযুদ দাওয়া আলইসলামিয়া ঢাকা’র আমীনুত তালিম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব বলেন, ‘হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. সম্পর্কে আমি কিছু বলার জন্য আসিনি। আমি বরং হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর খাছ খাছ শাগরিদদের বক্তব্য লিখে নেওয়ার জন্য খাতা-কলম নিয়ে এসেছি। আলহামদুলিল্লাহ, অনেকের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা লিপিবদ্ধও করেছি। হযরতের তাকরীরে তিরমিযীর কিছু অংশ তো ছাপানোই পেয়েছি। আর তাকরীরে মেশকাতের একটি মাখতূতার ফটোকপিও আমার এক তালেবুল ইলম ভাইয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ হয়েছে। কিছু কিছু ইস্তেফাদাও করার সুযোগ হয়েছে। ইনশাআল্লাহ ইস্তেফাদা জারি থাকবে।’
জামিয়া নূরিয়ার প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা ফারুক ছাহেব (নূরিয়া মাদরাসা) বলেন, ‘আমার উস্তায মাওলানা হারূন ছাহেব কথায় কথায় বলেছিলেন যে, আমাকে একবার চট্টগ্রামের কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, হাদীসের জগতে এবং ইলমী লাইনে আমাদের হযরত মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম ছাহেব (হাটহাজারী মাদরাসার তৎকালীন শাইখুল হাদীস) এবং হযরত মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ ছাহেব (লালবাগের মুহতামিম) ইলমী লাইনে কাকে বড় মনে হয়? তিনি বলেছিলেন, আমি তো আমার দৃষ্টিতে মনে করি যে, মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম ছাহেবের চেয়ে ইলমী তাবাহ্হুর হযরত মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ ছাহেবের বেশী ছিল। এবং এ কথা বলার পর এ কথাও বলেছেন যে, আমার বাড়ি চিটাগং এজন্য আমি বলিনি যে, মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম ছাহেব বড়। (হকিকত তো আল্লাহই জানেন। এসব বিষয়ে রায়ের এখতেলাফ হওয়াই স্বাভাবিক।)’
ফরিদাবাদ জামিয়ার প্রবীণ মুহাদ্দিস ও বিশিষ্ট লেখক মুফতী উবাইদুল্লাহ ছাহেব বলেন, আমি দেওবন্দে যাওয়ার পর দেওবন্দের বহুত বড় মশহুর শখসিয়াত আল্লামা ওয়াহিদুজ্জামান কীরানবী রাহ.-এর কামরায় যেতাম। একদিন আমি মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর তাকরীরের খাতা (যেটা আমি লিখে হুযুরকেও দেখিয়েছি, হুযূর সেটাতে এসলাহও করে দিয়েছেন। কিছু কিছু জায়গায় হুযুরের এসলাহী লেখাও আছে।) নিয়ে গেলাম। তো আলোচনার একপর্যায়ে বললাম যে, আমি লালবাগ থেকে দাওরা পড়ে এসেছি। আর এটা মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর তাকরীর। তিনি অত্যন্ত গওর ও ফিকিরের সাথে বেশ কিছুক্ষণ দেখলেন। দেখার পর তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন,
ایسے راسخ العلم محدث بنغلادیش میں ہے! (এমন গভীর জ্ঞানের অধিকারী মুহাদ্দিস বাংলাদেশে আছেন!) তিনি বারবার তাআজ্জুব প্রকাশ করছিলেন।
নূরানী তালীমুল কুরআন ওয়াকফ এস্টেট-এর পরিচালক মাওলানা রহমাতুল্লাহ ছাহেব বলেন, ‘হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. অত্যন্ত সাদাসিধা চলতেন। আমরা হুযুরের একটা জামা, একটা লুঙ্গি আর কাঁধে একটা গামছা ব্যতীত অতিরিক্ত কোন পোশাক জীবনেও দেখিনি।’
মাওলানা ফখরুদ্দীন মানিকগঞ্জী ছাহেব বলেন, একদিন আমি দেখি যে, তিনি একা একা পা টিপছেন। আমি গেলাম। গিয়ে বললাম, হুযুর পা টিপে দিই। তিনি বললেন, چھوڑیئے (ছেড়ে দিন) ভাষাটা সম্মানি ভাষা ব্যবহার করেছেন। অথচ আমি ছাত্র, তিনি আমার উস্তায, তিনি আমাকে বলছেন, چھوڑیئے کیا بد تمیزی ہے؟ ہے؟ পা টিপে দিতে দিলেন না। আমি আমার জীবনে মীযান থেকে দাওরা পর্যন্ত খেদমত করতে চেষ্টা করেছি; কোনো দিন পারিনি।’
জামিয়া রাহমানিয়ার মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক ছাহেব বলেন, ‘অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তার একেবারে ষোল আনা সব দিক অনুকরণের মতো থাকে না। কিন্তু হুযূরের সব কিছুই ছিল অনুকরণ করার মত।’
হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর ভাতিজার দিকের নাতি মমিনপুর মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা খালেদ ছাহেব বলেন, ‘দাদাজান রাহ. যখন বাড়িতে আসতেন তখন আমাদেরও মাদরাসা ছুটি হত। আমরাও বাড়িতে আসতাম। তো আববাজান বলতেন যে, চাচা এসেছেন, চাচার গোসলের সময় খেয়াল রেখ। তাঁর আদত ছিল যে, তিনি যখন গোসলের ঘাটে যেতেন কেউ ঘাটে থাকত না, সকলেই সরে যেত। তিনি গোসল করার পর (আববা বলতেন যে, তুমি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকো, যখন চাচা কাপড় বদলায় তুমি কাপড় ধুয়ে দিও- শিখিয়ে দিতেন) যখন কাপড় বদলাতেন তখন গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। গাছটা এখনো আছে, আম গাছ। তিনি কাপড় বদলিয়ে কাপড়টা পা দিয়ে চাপ দিয়ে রাখতেন। যখন দেখতাম যে, কাপড় পরছেন তখন দৌড়ে গিয়ে কাপড়টা ধরতাম। সালাম দিয়ে কাপড়টা ধরলেই মুচকি হাসি দিতেন এবং বলতেন, তুমি পারবা ধুইতে? আমি বলতাম, দাদা আমি পারব। ছাড়তাম না; ধরে রাখতাম। তখন পা ছেড়ে দিতেন।’
দৈনিক ইনকিলাব-এর সহকারী সম্পাদক মাওলানা উবাইদুর রহমান খান নদভী ছাহেব বলেন, ‘মুহাদ্দিস সাহেব হুযুরকে আমি আমার বাল্য বয়সে শুধু একজন ব্যক্তি হিসেবে এক নজর দেখেছি। তিনি কী বা তিনি কে সেটা দেখার মত বয়স, সময় বা জ্ঞান আমার ছিল না। কিন্তু তাঁর একদম হামসবক-সহপাঠী মুফতী মুহাম্মদ আলী ছাহেবের কাছে আমরা বুখারী পড়েছি। তাঁদের মাঝে সম্পর্ক ছিল এবং দরসে তাঁদের মাঝে প্রতিযোগিতাও ছিল। দরসে কোনো প্রসঙ্গ আসলে কিংবা দেওবন্দ এবং আসাতেযায়ে কেরামের আলোচনা আসলে হুযুর মুহাদ্দিস সাহেবের কথা বলতেন। তাঁর সাথে আমার পরিচয় এতটুকুই।
আমার মনে হয় যদি বাংলাদেশের আলেমসমাজ তাঁর নেযামকে বাংলাদেশের ইলমী সমসত্ম প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্রহণ করতেন তাহলে অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন কিছু আলেম তৈরি হতেন এবং এদেশ ইলমের গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র হত। ’
ঢালকানগর মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা জা‘ফর ছাহেব বলেন, ‘একদিন আমি করাচীতে খানকায় ছিলাম। তখন আমার হযরতওয়ালা হাকীম আখতার ছাহেব রাহ. আমাকে ডেকে পাঠালেন। হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-এর লেখা একটি চিঠি তিনি আমাকে উপস্থিত লোকদেরকে পড়ে শোনাতে হুকুম করেন।
আমি চিঠি পড়ছিলাম, লোকদেরকে শোনাচ্ছিলাম। এদিকে আমার প্রিয় মুরশিদ হযরতওয়ালার চোখ দিয়ে অশ্রম্ন ঝরছিল। হযরতওয়ালা শেষে বলেছিলেন,
دیکھو یہ پوری دنیا کے اندر اس وقت سب سے بڑے محدث ہے اور جس کے بارے میں حضرت شمس الحق فریدپوری رح نےفرمایا کہ میدان محشر میں اللہ میاں اگر مجھ سے پوچھے تم کیا لے کے آئے ہو؟ تو میں انکو پیش کرونگا۔ لہذا آج آپ لوگوں کے سامنے میں بھی یہی کہتا ہوں کہ اللہ میاں اگر مجھ سے پوچھےمیدان محشر میں کہ تیرے پاس کیا سرمایہ ہے؟ تو میں بھی مولانا ہدایۃ اللہ صاحب کو اللہ تعالی کے سامنے پیش کرونگا۔
মালিবাগ জামিয়ার সাবেক উস্তায মাওলানা ইয়াহইয়া জাহাঙ্গীর ছাহেব বলেন, ‘আমি জালালাইন পড়ি। সে বছর হুযুর আমাকে এবং আবূ তাহের মিসবাহকে (আমরা সাথী ছিলাম) রাত এগারটার সময় কামরায় ডেকে নিয়ে (সাধারণত এ সময় তিনি ডাকেন না, তাঁর আদত নেই) বললেন, কোনো পরিস্থিতির কারণে আপনারা দুইজন হাটহাজারী বা পটিয়া পড়ুন, আমি খুশি হব। আসমান ভেঙে মাথায় পড়ল। বহু দিনের আকাঙ্ক্ষা ছিল হযরতের কাছে হাদীস পড়বো। আমি শুধু এতটুকু বলেছিলাম, হযরত! দীর্ঘ দিনের তামান্না ছিল হযরতের কাছে হাদীসের দরস নিব। হুযুর মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, আমি যদি দু‘আ করি এটা কি আপনাদের জন্য কাফী (যথেষ্ট) নয়। তো সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে বললাম, (তখন গাড়ি ভাড়াও ছিল না) হুযুর আমি কালকে সকালেই চলে যাব। হুযুরের ইজাযত নিয়ে চলে গেলাম পটিয়া মাদরাসায় আমি আর আবূ তাহের মিসবাহ ছাহেব। তাঁর কথাটা যে রাখতে পেরেছি এটা আমাদের জন্য বিরাট সৌভাগ্য। সেখানে পৌঁছে একটা চিঠি দিয়েছিলাম হুযুরের কাছে। হুযুর চিঠির জওয়াবও দিয়েছেন।’
এতে আরো আলোচনা পেশ করেন মাওলানা হাবীবুর রহমান খান ছাহেব, মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম আল-মাসউদ ছাহেব, মাওলানা মাহমূদুল আমীন ছাহেব, মাওলানা কারী মুনীরুজ্জামান ছাহেব, মাওলানা রফীকুল্লাহ ছাহেব, মাওলানা আমীনুল হক ছাহেব প্রমুখ।
এছাড়াও মজলিসে উপস্থিত ছিলেন, মাওলানা আব্দুর রহীম ছাহেব, (মুহাদ্দিস, জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগ) মাওলানা আব্দুর রব ছাহেব, (মুহাদ্দিস, জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগ) মাওলানা মুফতী নুমান আহমাদ ছাহেব (মুহাদ্দিস, জামেয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া), মাওলানা মুফতী মাহমূদুল হাসান ছাহেব, (মুহতামিম, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া তেজগাঁও), মাওলানা আবরারুযযামান ছাহেব, মুফতী সিফাতুল্লাহ ছাহেব, মাওলানা শরীফ আহমাদ ছাহেব, মাওলানা শফীকুল্লাহ ছাহেব, মাওলানা কবীর আহমাদ ছাহেব, মাওলানা হারুনুর রশীদ চৌধুরী, মাওলানা আব্দুল মুক্বীত ছাহেব, মাওলানা ইলিয়াছ মাদারিপুরী, মাওলানা আমীনুর রহমান ছাহেব, মাওলানা নজরুল ইসলাম ছাহেব, মুফতী মুশাররফ হুসাইন ছাহেব, মুফতী ইবরাহীম হাসান ছাহেব, মাওলানা কারামত আলী ছাহেব, মাওলানা মীযানুর রহমান জামীল ছাহেব, মাওলানা সফিউল্লাহ ফুয়াদ ছাহেব, মুফতী ইমাদুদ্দীন ছাহেব প্রমুখ। l
-মাওলানা মাহমূদুল আমীন