রবিউল আউয়াল ১৪৩৬   ||   জানুয়ারি ২০১৫

তুরস্কে, তুর্কিস্তানের সন্ধানে-৫

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

***

কিছুক্ষণের মধ্যে প্রায় সব মেহমান হোটেলের সামনে বিরাট মাঠে এসে সমবেত হলেন। পনেরো/ষোলটা বড় বাস প্রস্তত মেহমানদের বহন করে নেয়ার জন্য। কয়েকটা ছোট ও আরামদায়ক গাড়ীও ছিলো বিশিষ্ট ও বয়োবৃদ্ধ মেহমানদের জন্য। প্রত্যেক বাসে একজন করে গাইড। আয়োজকদের কর্মকুশলতা ছিলো অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আগে থেকেই তারা মেহমানদের শ্রেণীবিন্যাস করে রেখেছিলেন। কারা কোন্ গাড়ীতে ওঠবেন। আরবমেহমান এবং যারা আরবী জানেন তাদের গাড়ী আলাদা, যারা ইংরেজি জানেন তাদের গাড়ী আলাদা, যাতে গাইডদের জন্য সুবিধা হয়।

আজ সকালের অধিবেশনে প্রধান আকর্ষণ ছিলো আরবজাহানের প্রবীণ আলিমে দ্বীন ও মুসলিম স্কলার আল্লামা শায়খ ডক্টর ইউসুফ আল কারযাবীর ভিডিও ভাষণ। স্বাস্থ্যগত কারণ ছাড়াও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁর পক্ষে ইস্তাম্বুল আসা সম্ভব হয়নি। ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি সে জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও মর্মবেদনা প্রকাশ করেছেন। অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় তিনি বলেছেন, আমি আপনাদেরই একজন; অনেক আশা ছিলো, আজ এ সময়ে আমি আপনাদের মাঝে উপস্থিত থাকবো, যদি বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটতো তাহলে সেটাই হতো, কিন্তু আল্লাহর ফায়ছালাই অটল। তবে আশা করি, আপনাদের উদ্দেশ্যে আমার যে বক্তব্য সেটাই এখন আমার প্রতিনিধিত্ব করবে।

তাঁর ভাষণের বিষয় ছিলো-

أهمية وحدة الأمـة

[উম্মাহর ঐক্যের গুরুত্ব]

ইউসুফ আলকারযাবীর নাম প্রথম আমি পড়ি হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী রহ.-এর মুযাক্কিরাতু সাইহিন ফিশ্-শারক্বিল-আওসাত (মধ্যপ্রাচ্যের এক পর্যটকের ডায়রী) কিতাবে। ১৯৫১ সালে হযরত আলী মিয়াঁ যখন প্রথমবার মিশর সফর করেন, তখন তিনি তাঁর সদ্যপ্রকাশিত আরবী গ্রন্থ

ماذا خسر العالم بانحطاط المسلمين

এর কল্যাণে আরববিদ্বান মহলে অতি সুপরিচিত ব্যক্তি। ইউসুফ কারযাবী তখন মাত্র যুবক, আলআযহারের ছাত্র। তিনি হযরত মাওলানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। হযরত মাওলানার অন্তর্দৃষ্টি তখন চিনে নিয়েছিলো যে, এ যুবকই হবেন আগামী প্রজন্মে উম্মাহর রাহবার। যুবক কারযাবী সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন-

ইখওয়ানী যুবক ইউসুফ কারযাবী সকালে দেখা করতে এলেন। তার চেহারা থেকে উৎসারিত হচ্ছিলো মেধার প্রখরতা এবং দ্বীনী জোশ-উদ্দীপনা। যুবক বয়সেই তার জ্ঞান ও পড়াশোনা  ছিলো এমন সমৃদ্ধ যে, মুগ্ধ হতেই হয়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে, মিশরে ইসলামের ভবিষ্যত উজ্জ্বল।

আল্লাহর রহমতে তাঁর সে ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে।

১৯৫১ সালের সেই প্রাণোচ্ছল যুবক ও জোশীলা[1] নওজোয়ানই হচ্ছেন আজকের বিশ্বনন্দিত জ্ঞানবৃদ্ধ শায়খ আল্লামা ইউসুফ আলকারযাবী।  ইসলামী আন্দোলনে নিবেদিত আরবযুবকদের জন্য আজ তিনি হচেছন প্রেরণার উৎস এবং মিশরের ইসলামদুশমন শাসকদের জন্য ত্রাস। তাই বহু বছর ধরে, সেই জামাল আব্দুন-নাসের-এর যুগ থেকে তিনি মিশর ত্যাগ করে কাতারে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন।

সত্য প্রকাশে এখনো তিনি অকুতোভয়। মিশরের বর্তমান শাসকদের তিনি জবরদখলকারী, জালিম ও হত্যাকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ অপরাধে মিশরে এমনকি ভিসা নিয়েও তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সফরনামা যখন লিখছি তখন মিশরের বৈধ প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আলশিশী ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরারী আসামী হিসাবে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করেছেন। কারণ তিনি একজন সন্ত্রাসী! পরিহাস আর কাকে বলে! এখন দেখছি সব ভাষারই অভিধান নতুন করে লিখতে হবে! আমরা অসহায় মানুষেরা এখন শুধু দুআ করতে পারি, আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর মত দ্বীনের যত সাচ্চা খাদেম সবাইকে দীর্ঘায়ু করুন এবং নিরাপদ রাখুন।[2]

***

গাইড তাগাদা দিলেন বাসে ওঠার জন্য। আমরা ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে সবকটি বাস একসঙ্গে রওয়ানা হলো। সামনে ছোট ছোট তিন/চারটি গাড়ী, তারপর বাসের কাফেলা। ইস্তাম্বুলের পথে সে দৃশ্য দেখতে কী যে সুন্দর লাগছিলো, এক সময় ইস্তাম্বুলে এবং সমগ্র তুরস্কে এটা কল্পনা করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিলো। মুস্তফা কামালের আত্মাকে লক্ষ্য করে আমার তখন বলতে ইচ্ছা করছিলো, দেখো কামাল, ইসলামের কাফেলা আবার ইস্তাম্বুলে এসে গেছে। দেখো, তুরস্কের মুসলিম জনতা, যাদের হৃদয় থেকে ইসলামের ভালোবাসা তুমি মুছে ফেলতে চেয়েছিলে, ইসলামের প্রতি আজো তারা কেমন নিবেদিত। দেখো, ইসলামী কাফেলাকে তারা কেমন প্রাণঢালা ভালোবাসা দিয়ে বরণ করছে। রাস্তার দুপাশে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত মানুষের উচ্ছ্বাস দেখো।

***

সুপ্রশস্ত সড়কে বিভিন্ন গাড়ী ও যানবাহনের এক অন্তহীন স্রোত, কিন্তু কোথাও যানজট নেই। বাসের কাফেলা স্বচ্ছন্দ গতিতে এগিয়ে চলেছে।

রাস্তা তখন সাগরের পাড় দিয়ে চলেছে, যেন হাত বাড়ালেই বসফরাসের পানি ছোঁয়া যাবে। কোথাও কোথাও বোটে চড়ে মাছ ধরা হচ্ছে জালের সাহায্যে, এমনকি পাড়ে বসে একেবারে আমাদের দেশী পদ্ধতিতে বড়শি ফেলেও মাছ ধরছে দুএকজন এবং দুএকটা মাছ উঠেও আসছে, যা দেখে কোন কোন মেহমান আনন্দধ্বনি করে উঠছেন।

দূরে দেখা যাচ্ছে ঝুলন্ত সেতু যা ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশকে এশীয় অংশের সঙ্গে যুক্ত করেছে। পোল পারহওয়া গাড়ীগুলোকে দূর থেকে খুব ছোট দেখা যাচ্ছে। গাইড বললেন, এরকম পোল আরো দুটি আছে এবং প্রতিদিন কয়েক লাখ গাড়ী পোল দিয়ে যাতায়াত করে। জাহায ও ফেরীর সাহায্যেও নাকি অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ইস্তাম্বুলের উভয় অংশে আসা-যাওয়া করে। আমাদের সামনে কোন সুযোগ নেই ইস্তাম্বুলের এশীয় অংশ ভ্রমণের, অন্তত এই সফরে। হযরত মাওলানা তক্বী উছমানী মু. তাঁর ইস্তাম্বুল সফরকালে এই ঝুলন্ত পোল পার হয়ে ইস্তাম্বুলের এশীয় অংশে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সফরনামায় এর বিশদ বিবরণও দিয়েছেন।

সাগর ছিলো আমাদের ডানে আর শহর ছিলো বামে। কিছু দূর যাওয়ার পর সাগরপাড়ে এক মনোরম দৃশ্য দেখলাম। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে বৈকালীন ভ্রমণ ও বিনোদনের ব্যবস্থা। রঙবেরঙের বড় বড় শামিয়ানা টানানো। শামিয়ানা তো নয়, যেন ফুলের চাদর! মাঝে মাঝে বড় বড় রেস্টুরেন্ট। সম্ভবত সাগর থেকে এই মাত্র ধরে আনা মাছ ভাজা হচ্ছে। অসংখ্য চেয়ার-টেবিল, মনে হলো একটাও খালি নেই। তুর্কী তরুণ-তরুণী, বুড়ো-বুড়ি ভাজা মাছের স্বাদ গ্রহণ করছে। দেখে মনে হয়, এই মুহূর্তে এদের চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। বিদেশী পর্যটকের সংখ্যাও কম নয়, তবে স্থানীয় তুর্কীরাই বেশী। শিশু-কিশোরদের খেলাধূলার ব্যবস্থাও আছে এখানে ওখানে। ওরাও খেলার আনন্দে বিভোর, সঙ্গে আছে ওদের মায়েরা। সব দেশেই ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে, তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস একই রকম। আসলে পার্থক্যটা গড়ে ওঠে মানুষ যখন শৈশবকে পিছনে ফেলে বয়সের সিঁড়ি বেয়ে সামনে এগিয়ে যায়। তখন তারা জড়িয়ে পড়ে জীবনের নানা রকম জটিলতায় এবং বিভিন্নমুখী স্বার্থের দ্বন্দ্বে।

কী কারণে জানি না, আমাদের বাসের কাফেলা কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলো, আর তখনই ঘটলো সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা যা সারা জীবনেও ভোলার মত নয়। আনন্দ-বিনোদনে মগ্ন মানুষগুলো বাসের দিকে তাকিয়ে এবং টুপি-পাগড়ী ও দাড়ি দেখেই হয়ত যা বোঝার বুঝে ফেললো। হঠাৎ তাদের মধ্যে যেন সাড়া পড়ে গেলো। দূর থেকেই তারা হাত নেড়ে নেড়ে বলতে লাগলো সালাম! সালাম! সব বয়সের নারী-পুরুষ দৌড়ে আসতে লাগলো বাসের দিকে। সবার চোখে মুখে আনন্দের সেকি উচ্ছ্বাস! মেহমানদেরও তখন আনন্দে অভিভূত অবস্থা। হয়ত জীবনে কখনো তারা ভক্তি-

ভালোবাসার এমন প্রকাশ দেখতে পাননি। আমাদের বাসে সামনের আসনে বসা এক আরব মেহমান তার সঙ্গীকে এমনই বললেন, বহু দেশ দেখেছি, কিন্তু এমন দেখিনি। হাঁ, ইন্দোনেশিয়ায় কিছুটা দেখেছিলাম, কিন্তু আজ যা দেখলাম, এটা একেবারেই ভিন্ন। হয়ত জান্নাতেই মুমিনদের মধ্যে দেখা যাবে এমন আনন্দ-উচ্ছ্বাস!

অনেকে মেহমানদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন মুছাফাহার উদ্দেশ্যে। মেহমানরাও জানালা দিয়ে হাত বের করে মুহববতের ডাকে সাড়া দিলেন। আমাদের সামনের বাসে এক তুর্কী মা কোলের শিশুকে উঁচিয়ে ধরলেন, আর এক মেহমান তার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে আদর জানালেন। তাতেই মায়ের চোখে আনন্দে অশ্রু দেখা দিলো, তিনি কয়েকবার শুকরান, শুকরান বললেন। এসব দৃশ্যের সৌন্দর্য ও পবিত্রতা শুধু অনুভব করা যায়, শব্দে ভাষায় এর কোন বর্ণনা দেয়া যায় না।

মনে হলো, পরিকল্পিতভাবেই আমাদের কাফেলার গমনপথ দীর্ঘ করা হয়েছে, যাতে মোটামুটি পুরো শহর ঘুরে দেখা হয়ে যায়। পুরো শহর যা দেখলাম, তাতে এটাই মনে হলো, তুর্কীরা অসম্ভব পরিচ্ছন্ন এবং ফুলপ্রিয় জাতি। রাস্তার দুপাশে যেমন আছে সবুজ বৃক্ষ, তেমনি কিছুক্ষণ পর পর আছে ফুলের ছোট ছোট বাগান। বিভিন্ন বর্ণের ফুল যেমন দেখার বিষয়, তার চেয়ে বড় দেখার বিষয় হলো ফুলবাগানগুলোর পরিকল্পিত সজ্জা। চোখ ফেরানো যায় না, আমরা চোখ ফেরাচ্ছিও না, কিন্তু বাগানগুলো মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে থেকে চলে যাচ্ছে পিছনের দিকে। ইচ্ছে করছিলো, বাস থেকে নেমে পড়ি, আর শুধু ফুল ও ফুলবাগানের সৌন্দর্য দেখি।

কোথায় যেন পড়েছিলাম, উছমানি খেলাফতের আমলে, বিশেষত সুলতান তৃতীয় আহমদের আমলে[3] শুধু বৃক্ষ, বাগান ও ফুলের পরিচর্যার জন্য আলাদা ওয়াযারত বা মন্ত্রণালয় ছিলো। তাঁর আমল থেকেই নাকি ইস্তাম্বুল ফুলবাগান ও গুলবাগিচার শহর নামে সুখ্যাতি লাভ করেছে।

কিছু দূর যাওয়ার পর দীর্ঘ প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ দেখা গেলো। গাইড জানালেন একসময় এটা ছিলো মুসলিমপূর্ব যুগে ইস্তাম্বুলের অপরাজেয় নগরপ্রাচীর। ইস্তাম্বুল তখন ছিলো বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। বহু তুর্কী শাসকের ইস্তাম্বুল অভিযান ব্যর্থ হয়েছে শুধু এই মযবুত নগরপ্রাচীর ও দুর্গের কারণে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এ নগরপ্রাচীর মুসলিম অভিযানের ঢেউ রোধ করতে পারেনি, আর আজ তো বোঝারই উপায় নেই যে, কেমন ছিলো দেখতে তখনকার নগরপ্রাচীর। ব্যস, শুধু কিছু ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে এখানে ওখানে কালের নির্মমতার সাক্ষী হয়ে।

শহরের অনেক পথ ঘুরে অবশেষে আমাদের কাফেলা পৌঁছলো সুলতান আহমদ মসজিদে। সতের শতকে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ১৬১৬ এর শুরুতে সুলতান আহমদ এ মসজিদের নির্মাণ শুরু করেন। তখন তুরস্কের সবচে সুন্দর ইমারত ছিলো খৃস্টানদের সুপ্রসিদ্ধ গীর্জা আয়াছুফিয়ার ইমারত। এটাকে মনে করা হতো পৃথিবীর সুন্দরতম ইবাদতখানা। স্থাপত্যসৌন্দর্যের দিক থেকেও এটা ছিলো অতুলনীয়। সুলতান আহমদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিলো, সর্বদিক থেকে তার কল্পনার মসজিদটি যেন হয় আয়াছুফিয়ার চেয়ে বড়, উঁচু ও সুন্দর। সেভাবেই তিনি সব আয়োজন ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন এবং অবশেষে তাঁর স্বপ্ন সার্থক হয়েছিলো। ইস্তাম্বুলের শেষ প্রান্ত থেকে, এমনকি মর্মর সাগরে জাহায থেকে এবং আকাশপথে বিমান থেকেও দেখা যায় মসজিদের সুউচ্চ ছয় মিনার। আমাদের হোটেলের বেলকনিতে দাঁড়িয়েও  দেখেছি এর মিনার। তখন থেকে এখন পর্যন্ত ইস্তাম্বুলের অধিবাসীরা এ মসজিদের ছয় মিনারকেই মনে করে তাদের শহরের গর্ব ও গৌরবের প্রতীক। কথিত আছে, তখন মক্কার মসজিদুল হারাম ছাড়া আর কোন মসজিদে ছয় মিনার ছিলো না। তাই সুলতান নিজের খরচে আরেকটি মিনার নির্মাণের ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে হারামের মর্যাদা উপরে থাকে। এমনই ছিলো তখনকার তুর্কী সুলতানদের ধর্ম, কর্ম ও চিমত্মার ভারসাম্য এবং এমনই ছিলো হারামের প্রতি তাদের ভক্তি-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ!

আর এ জন্যই আল্লাহ তাদের দান করেছিলেন সমগ্র বিশ্বের বুকে এমন অপ্রতিহত প্রভাব-প্রতিপত্তি। কিন্তু ...

মসজিদের বাইরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই অনেক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম আমরা তিনজন। আমীর ছাহেব বললেন, চলুন ভিতরে যাই। ভিতরে গিয়ে তো যাকে বলে একেবারে অভিভূত ও বাক্যহারা। ছাদ, গম্বুজ ও দেয়ালের ফুলবোটা ও কারুকাজ এমনই অনন্য সুন্দর যে, মৌনবিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে থাকতে হয়। আমি নিজে

কোন মন্তব্য করা তো ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়বে, হযরত মাওলানা তক্বী উছমানী, যিনি পৃথিবীর বহু দেশ সফর করেছেন, এবং অতীত ও বর্তমান  মুসলিম জাহানের অনেক মসজিদেই নামাজ পড়েছেন, সেজদা করেছেন, উন্দুলুসের কুরতুবা[4] জামে মসজিদ সম্পর্কে তার মন্তব্য হলো-

 এর অভ্যন্তরের অংশ প্রশস্ততা ও সৌন্দর্যের দিক থেকে সারা পৃথিবীতে অনন্যবৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সম্ভবত ছাদ-ঢাকা অংশটুকু এখনো পৃথিবীর সমস্ত মসজিদের মধ্যে বিশালতম। আর ইস্তাম্বুলের সুলতান আহমদ মসজিদ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য হলো-

ভাবগাম্ভীর্য, স্থাপত্যসৌন্দর্য এবং কারুকাজের অনন্যতায় এ মসজিদ এমনই আযীমুশ্-শান যে, দুনিয়ার কোথাও এমন মসজিদ দ্বিতীয়টি দেখিনি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এ চরমোৎকর্ষের যুগেও এ পর্যায়ের স্থাপনা নির্মানের কল্পনা করেও বড় বড় স্থপতি হয়রান না হয়ে পারবেন না।

মূল মসজিদঘরের ভিতরের আয়তন হলো চৌষট্টি মিটার দীর্ঘ এবং বাহাত্তর মিটার প্রস্থ। উচ্চতা পনের মিটারের কম হবে না। ছাদের গম্বুজগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে, সে যুগে মাইক ছাড়াই মিম্বর থেকে খতীবের কণ্ঠস্বর পুরো মসজিদে মুছল্লীরা একই শব্দমাত্রায় শুনতে পেতো। সবচেয়ে বড় গম্বুজটি আয়াছুফিয়ার গম্বুজের চেয়ে কয়েক মিটার উঁচু। দিনে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উচ্চতায় এবং প্রতিটি গম্বুজে সমান মাপের জানালা রাখা

হয়েছে, যার সংখ্যা হচ্ছে দুশ ষাট। এজন্য তুর্কীরা গর্বের সঙ্গে বলে, দুশ ষাট জানালার মসজিদ। জানালাগুলোর পরস্পর দূরত্ব, উচ্চতা ও আয়তনে এমনই নিখুঁত জ্যামিতিক মাপ রক্ষা করা হয়েছে যে, সেটাই হয়ে উঠেছে আলাদা এক সৌন্দর্যের বিষয়।

আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, জানালায় হালকা নিল বর্ণের কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে, যার কারণে সকালে সূর্যের আলো যখন ভিতরে আসে মনে হয় পুরো মসজিদ নীল গালিচায় ঢাকা। দুপুরের আলোর বর্ণ হয় ভিন্ন, কিছুটা যেন বেগুনী, বিকালে হয় আরেক রকম, কিছুটা যেন ধূসর। এগুলো সম্ভবত পূর্ব, পশ্চিম ও মধ্যখানের কাঁচের বর্ণভিন্নতার কারণে, অথচ দেখতে প্রতিটি কাঁচই হালকা নীল, যার কারণে মসজিদের আরেক নাম হয়েছে المسجد الأزرق বা নীল মসজিদ।

পুরো ছাদটি মর্মর পাথরের বিশাল বিশাল চারটা স্তম্ভের উপর অবস্থিত। প্রতিটি স্তম্ভের গোল আয়তন বা ব্যাস হচ্ছে ৩৩ ফুট; কল্পনা করুন, তেত্রিশ ফুট! অথচ দেখতে মোটেও বেমানান মনে হয় না, বরং এমন না হলেই যেন দেখতে অসুন্দর হতো।

মসজিদের বাইরে চত্বরের দুদিকে বহুকামরাবিশিষ্ট লম্বা ইমারত। কালের আঘাত যেমন আছে, তেমনি কিছুটা যত্নের অভাবও মনে হলো; জীর্ণতাকে যেন আর উপেক্ষা করতে পারছে না। প্রত্নতত্ত্ববিভাগের সবটুকু মনোযোগ সম্ভবত মসজিদ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। গাইড বললেন, সুলতানি আমলে এখানে বিরাট মাদরাসা ছিলো। দেশী, বিদেশী বহু তালিবে ইলম এখানে সরকারী খরচে বিদ্যা অর্জন করতেন। এমনকি সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামীদ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিলো।

আছরের সময় হয়ে গেলো। আযান হলো, ঠিক যেন হারামের আযান! জামাতে বিপুল সমাগম সম্পর্কে গাইড বললেন, আজ মেহমানদের দেখতে আসার কারণে এ অবস্থা, অন্য সময় তিনকাতারের মত মুছল্লী হয়, তবে জুমার জামাতে মসজিদ পূর্ণ হয়ে যায়। গাইড আরো বললেন, নামটা মুখে আনতে ইচ্ছে করে না, তবু বলতে হচ্ছে, মুস্তফা কামালের সময় এবং তার পরেও বহুদিন তো অবস্থা এমন ছিলো যে, ত্রিশ/পঁয়ত্রিশের বেশী মুছল্লী হতো না, তাও সবাই বয়োবৃদ্ধ; এমনকি জুমার জামাতেও কয়েক কাতার শুধু পূর্ণ হতো। বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু এটাই ছিলো সে সময়ের তুরস্কের বাস্তবতা, যখন আযান হতো আরবীতে নয়, তুর্কী যবানে।

চারবছর পর এ সফরনামা লিখছি, যদ্দুর মনে পড়ে, মসজিদের দক্ষিণ দিকে সবুজ বাগানঘেরা ছোট্ট এলাকায় বেশকিছু কবর রয়েছে, যার মধ্যে সুলতান আহমদ প্রথম, সুলতান উছমান দ্বিতীয় এবং সুলতান মুরাদ চতুর্থ-এর কবর উল্লেখযোগ্য। রাজপরিবারের কয়েকজন নারী সদস্যের কবরের কথাও গাইড বললেন। অবাক হলাম, খুশীও হলাম যে, গাইড পুরুষদের নাম উচ্চারণ করলেও নারী-নাম উচ্চারণ করলেন না। কোন কিতাবে পড়েছিলাম তুর্কীজাতির নারীবিষয়ক গায়রত ও আত্মমর্যাদাবোধের কথা, যা মুস্তফা কামাল বোরকা বিদায় করে এবং মিনিস্কার্টের প্রচলন ঘটিয়ে তুর্কী সমাজ থেকে উৎখাত করতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তিনি যথেষ্ট সফলও হয়েছেন, যদিও তুর্কীরা আবার পিছনের দিকে ফেরার একটা আড়মোড়াভাঙ্গা চেষ্টা শুরু করেছে, যার কিছুটা ছাপ চলতে ফিরতে অনুভব করা যায়।

প্রতিটি কবরের নামফলক তুর্কীভাষায়, তবে আরবী হরফে লেখা। একটি কবরের ফলকে কোন এক সুলতানের মাতার নাম লেখা ছিলো এবং আমার মনেও আছে, কিন্তু আমাদের গাইড, যিনি তুরস্কের প্রবীণ আলিম, তার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সে নাম এখানে লিখলাম না। আমরা তিনজন এবং আরো বেশ কিছু মেহমান কবর যিয়ারত করলাম, ফাতেহা ও ইখলাছ পড়ে ঈছালে ছাওয়াব করলাম।

দিলটা খুব নরম হলো একথা ভেবে যে, একসময় যারা দুর্দণ্ড প্রতাপে অর্ধবিশ্ব শাসন করেছেন, যাদের নামে গোটা ইউরোপ ও খৃস্টজগত থরথর করে কাঁপতো, আজ তারা মাটির নীচের বাসিন্দা! উম্মাহর তরক্কির জন্য, ইসলামের বুলন্দির জন্য তারা যত জিহাদ ও মুজাহাদা করেছেন, যত ত্যাগ, আত্মত্যাগ ও  কোরবানি পেশ করেছেন, আল্লাহ যেন তা কবুল করেন এবং সর্বোত্তম বিনিময় দান করেন। বিপুল বিত্তবৈভব, ক্ষমতা ও প্রতাপ শাসকদের জীবনে বিচ্যুতি ও স্খলন ঘটাতেই পারে, আমাদের মত সাধারণ মানুষের জীবনেই তো লোভে, প্রলোভনে কত কিছু ঘটে যায়, আল্লাহ যেন তাদের জীবনের সব বিচ্যুতি, সব স্খলন ক্ষমা করে দেন। এ দুআ করে অত্যন্ত বিষণ্ণ হৃদয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে এলাম।

***

আমরা মসজিদে প্রবেশ করেছিলাম পূর্ব দিকের মূল প্রবেশ পথ দিয়ে নয়, বরং উত্তর দিকের পার্শ্বদরজা দিয়ে, তবে বের হলাম পূর্বদিকের প্রধান দরজা দিয়ে। গাইড আমাদের সেভাবেই নিয়ে এলেন এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, সব মেহমানের জুতা আগে থেকে এখানে এনে এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যে, নিজ নিজ জুতা খুঁজে পেতে তেমন কোন অসুবিধাই হলো না। অবস্থা দেখে মনে হলো, মেহমানদের অনেকেই বিষয়টি বুঝতে

পর্যন্ত পারেননি। এমনভাবে জুতা হাতে নিলেন যেন তিনি নিজেই এখানে জুতা রেখে প্রবেশ করেছেন।

মসজিদের সামনে বিরাট এক ময়দান, যাতে এখন যথেষ্ট গাছের ছায়া আছে এবং পর্যটকদের জন্য বসার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ বহু পর্যটক ও তুর্কী গাছের ছায়ায় কারুকাজ করা কাঠের বেঞ্চে বসে খোশগল্পে মশগুল।

মসজিদের ভিতরে তো তুর্কী মুছল্লীদের সমাগম ছিলোই এবং তাদের মুছাফা-আলিঙ্গনের চাপে আমরা হয়রান-পেরেশান তো ছিলামই, কিন্তু বাইরে ময়দানে এমন বিপুল সমাগম ছিলো যে, সবার রীতিমত ভড়কে যাওয়ার দশা। নিরাপত্তারক্ষীদের কর্ডন ভেঙ্গে মানুষের ঢল যেন আমাদের উপর আছড়ে পড়বে। অবস্থা দেখে অস্বসিত্ম যেমন লাগছিলো তেমনি আনন্দবোধও হচ্ছিলো। এ বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস কিসের জন্য; বহু প্রতিকূলতার পরও অন্তরের গভীরে বিদ্যমান ঈমানের তাপ ও উত্তাপের কারণেই তো!

এমনকি তুর্কী বুড়োবুড়িরা মেহমানদের একটু হাত ছোঁয়ার জন্য আশ্চর্য রকম আকুতি প্রকাশ করছিলো। একটু হাতের ছোঁয়া পেয়ে অনেকে আলহামদুলিল্লাহ বলে কেঁদে ফেলছে। ভিড় থেকে দূরে এমন কিছু নারী-পুরুষের চেহারাও দেখা গেলো যাদের চোখ থেকে অঝোর ধারে অশ্রু ঝরছে। বিশ্বাস করো ভাই, এ দৃশ্য নিজের চোখে যে না দেখেছে, শব্দের সমগ্রভাণ্ডার উজাড় করেও তাকে এর প্রকৃত রূপ বোঝানো যাবে না। সম্মেলনের আয়োজকদের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট তিউনিসীয় আলেম আবু আব্দুল্লাহ আলী বিন মসঊদ সম্মেলনের কার্যবিবরণীতে লিখেছেন-

ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন দেশে কোন জনগোষ্ঠীর মাঝে ভক্তি-মুহববতের এমন অপূর্ব উচ্ছ্বাস আর কখনো দেখিনি, যেমন দেখিনি এত দেশের এত বিভিন্ন বয়সের এবং পথ ও মতের আলেম, মাশায়েখ ও ইসলামী চিন্তাবিদগণের এমন বিশাল সমাবেশ। মানুষ যেন আনন্দের আতিশয্যে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলো। অনেক তুর্কী নারী ও তরুণীকে আমি নিজের চোখে অঝোরে কাঁদতে দেখেছি। এমনকি হতবুদ্ধি বিদেশী পর্যটকরাও মোবাইলে এবং ভিডিও ক্যামেরায় এ অভূতপূর্ব দৃশ্য ধারণ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। -

فسبحان من وحد قلوب الناس على هدي نبيـه قبل أن يجمع بين أجسادهم

সপবিত্র প্রশংসা সেই মহান সত্তার যিনি তাঁর নবীর তরীকার উপর মানুষের কলবকে একত্র করেছেন, দেহ ও শরীরকে একত্র করার আগে।

আমি সুদূর বাংলাদেশ থেকে আসা সামান্য এক মুসাফির, শুধু বলতে পারি, তুরস্কের এই মানুষগুলোর চেহারায় যেন আমি দেখতে পেলাম দূর অতীতের তুর্কিস্তানের ছায়া, যদিও খুব হালকা ও অস্পষ্ট।

এখান থেকে আমাদের গন্তব্য হলো আয়াছুফিয়া, পায়ে হেঁটে তিনচার মিনিটের পথ, কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় এই বিপুল সমাগম পার হয়ে সেখানে পৌঁছতে লাগলো দীর্ঘ সময়। ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা, কিন্তু মেহমানদের চেহারা দেখে মনে হলো তুর্কীহৃদয়ের ভালোবাসায় আপস্নুত হয়ে তারা আরো সজীবতা লাভ করেছেন।

মসজিদের সামনে যে বিরাট ময়দান সেটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিলো, কিন্তু না আমাদের তা দেখার কোন সুযোগ হয়েছে, আর না গাইড সে সম্পর্কে কিছু বলার সুযোগ পেয়েছেন। তবে হযরত মাওলানা তক্বী উছমানী মু. ময়দানটির সুসংক্ষিপ্ত একটি বিবরণ দিয়েছেন সেটাই এখানে তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন-

ময়দানটি দৈর্ঘ্যে ৩৭০ মিটার, প্রস্থে ১১৮ মিটার। বাইজান্টাইন শাসনের সময় এটা ছিলো প্রধানত ঘোড়দৌড়ের ময়দান এবং এর নাম ছিলো হিপুডরোম। এখানেই নতুন সম্রাটের অভিষেক ও মুকুটগ্রহণের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হতো। বিজয়ী সেনাপতিকে বরণ করার জন্য এখানেই বিজয়-উৎসব পালন করা হতো। আবার এখানেই অপরাধীদের ফাঁসি দেয়া হতো।

খৃস্টধর্মের বিভিন্ন উপদল, যাদেরকে গীর্জা ধর্মচ্যুত বলে ঘোষণা করতো এখানেই তাদেরকে যিন্দা জ্বালানো হতো, আর জনতা মহা-উল্লাসে তা উপভোগ করতো। এখানেই হিংস্রপশু ও মানুষের লড়াই হতো, যা পশু কিংবা মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর মাধ্যমেই শেষ হতো। এটা ছিলো তখনকার সমাজের খুব উপভোগ্য খেলা। ইতিহাসের বড় বড় রাজবিদ্রোহ এখান থেকেই শুরু হয়েছে, যার পরিণতি কখনো হয়েছে সম্রাট ও রাজপরিবারের নির্মম হত্যা, কিংবা বিদ্রোহী-জনতার গণহত্যা। যুগে যুগে এখানে কত রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়েছে, তার খবর কে রাখে!

তুর্কীদের সালতানাতের সময়ও এ ময়দানের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম।

এখানে তিনটি বড় বড় স্মারকস্তম্ভ ছিলো যা খৃস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে এবং পঞ্চম খৃস্টাব্দে এবং দশম খৃস্টাব্দে তিনজন সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণের স্মৃতিরূপে স্থাপন করা হয়েছিলো। সবচে পুরনোটির চিহ্ন এখন আর নেই, বাকি দু'টো এখনো মোটামুটি অক্ষত রয়েছে। দশম খৃস্টাব্দে নির্মিত ছোট স্তম্ভটির গায়ে পাথর খোদাই করে তিনটি অজগর মুর্তি তৈরী করা হয়েছিলো। একারণে এ স্তম্ভকে বলা হয় সারপিন্ট কলাম (অজগর-স্তম্ভ)। ইস্তাম্বুলবিজয়ী মুহম্মদ আলফাতিহ যখন আয়াছুফিয়া হতে বের হয়ে এখানে আসেন তখন নিজের হাতে এগুলোর মথা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন।

***

অমুসলিম পর্যটকদের জন্য, বিশেষ করে ইউরোপের খৃস্টান পর্যটকদের জন্য ইস্তাম্বুলে সবচে আকর্ষণীয় বিষয় হলো আয়াছুফিয়া পরিদর্শন। এখনো এখানে বহু পর্যটককে চোখের পানি ফেলতে দেখা যায়। অনেক পর্যটক তাদের ভ্রমণকাহিনীতে আয়াছুফিয়ার কথা এমন আবেগ-উন্মাদনার সঙ্গে লিখেছেন যে, বোঝা যায়, ইস্তাম্বুল খোয়ানোর বেদনা এখনো তারা ভুলতে পারেনি; এখনো তাদের অন্তরে ধিকি ধিকি জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন, জনৈক পর্যটক লিখেছেন, আমাকে যদি একশ টুকরো করে বসফরাসের পানিতে ফেলে দেয়া হয়, আর বিনিময়ে আয়াছুফিয়া ফিরিয়ে দেয়া হয়, সানন্দে আমি প্রস্তুত আছি।

আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কামাল পাশা সম্ভবত খৃস্টানজগতের সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যেই আয়াছুফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেছিলেন। কিন্তু এই নির্বোধ লোকটি বুঝতে পারেনি, ধর্মান্ধ ক্রশেডারদের মুসলিমবিদ্বেষ এত সহজে দূর হওয়ার নয়। কতকিছুই তো তিনি করলেন, কিন্তু ইউরোপ এখনো তুরস্ককে আপন ঘরানার বলেই মানতে রাজি নয়।

আয়াছুফিয়া কেমন দেখেছি এবং কী দেখেছি সে আলোচনায় যাওয়ার আগে এর জন্মকাহিনী তুলে ধরা ভালো মনে হয়, তাহলে উপরের কথাগুলোর মর্ম অনুধাবন করা সহজ হবে।

পঞ্চম খৃস্টাব্দে খৃস্টানজগত দুটি বিরাট সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। পূর্বসাম্রাজ্যটি গড়ে উঠেছিলো এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, মিশর, আবিসিনিয়া, বলকান, গ্রীক ও আরো কিছু অঞ্চল নিয়ে। এর রাজধানী ছিলো কনস্টান্টিনোপল। এখানকার প্রধান ধর্মনেতাকে বলা হতো পিট্রিক, আর গীর্জাকে বলা হতো দ্য হোলি অর্থডেক্স চার্চ।

পক্ষান্তরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যটি গড়ে উঠেছিলো ইউরোপের বেশীর ভাগ অঞ্চলে, যার রাজধানী ছিলো ইটালীর রোম শহর। এখানকার ধর্মপ্রধানকে বলা হতো পোপ, আর গীর্জাকে বলা হতো রোমান ক্যাথলিক চার্চ, যার কেন্দ্রীয় গীর্জা ছিলো ভ্যাটিকান, পক্ষান্তরে অর্থডেক্স চার্চ-এর কেন্দ্রীয় গীর্জা ছিলো আয়াছুফিয়া, যা ভ্যাটিকানের চেয়ে প্রাচীন ছিলো। কারণ আয়াছুফিয়া তৈরী হয়েছিলো ৩৬০ খৃস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টান্টিনোপলের হাতে। উল্লেখ্য, তিনিই ছিলেন রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খৃস্টান সম্রাট। অনেক ঐতিহাসিক বলেন, আয়াছুফিয়া নির্মিত হয়েছিলো সম্রাট জাস্টিনিয়ানের হাতে। আসল ঘটনা এই যে, সম্রাট কনস্টান্টিনোপল তৈরী করেছিলেন খুব ছোট আকারে কাঠের গীর্জা, যা ষষ্ঠশতকে কোন এক দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। তখন ৫৩২ খৃস্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ান বর্তমান ইমারতটি নির্মাণ করেন। পাঁচবছর দশমাস সময়ে তা নির্মিত হয়েছিলো এবং প্রায় দশহাজার কারিগর নিযুক্ত হয়েছিলো, আর নির্মাণব্যয় ছিলো সে সময়ের হিসাবে দশলাখ পাউন্ড। কথিত আছে, সম্রাটের রাজভাণ্ডার এর নির্মাণব্যয় বহন করার জন্য যথেষ্ট ছিলো না, তাই সমগ্র খৃস্টানজগত তাদের সম্পদ দিয়ে সম্রাটকে সাহায্য করেছিলো। নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার পর সম্রাট যখন গীর্জা পরিদর্শনে আসেন তখন এর বিরাটত্ব ও সৌন্দর্য দেখে তিনি এমনই আত্মহারা হয়ে পড়েন যে, দম্ভভরে বলে ওঠেন, হে প্রভু, আমি পেরেছি, সোলায়মানের ধর্মমন্দিরকে আমি হার মানাতে পেরেছি।

এ দম্ভোক্তি দ্বারা সম্রাট বোঝাতে চেয়েছিলেন, আল্লাহর নবী হযরত সোলায়মান যে বাইতুল মাকদিস তামীর করেছিলেন, আয়াছুফিয়া তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। (নাউযু বিল্লাহ)[5]

সুদীর্ঘ একহাজার বছর সেন্ট ছুফিয়ার গীর্জা খৃস্টান বিশ্বের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ছিলো। এখনো সেন্টছুফিয়ার সঙ্গে তাদের ভাবাবেগের এমনই সম্পর্ক যে, অর্থডেক্স চার্চ-এর প্রধান নিজের পদবি এভাবে লিখে থাকেন-

The Head of the church of the constantinople

(কনস্টান্টিনোপলের গীর্জাপ্রধান)

সুলতান মুহম্মদ আলফাতিহ-এর হাতে যখন কনস্টান্টিনোপল-এর পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে তখন খৃস্টানরা এই বিশ্বাসে সেন্টছুফিয়ার গীর্জায় আশ্রয় নিয়েছিলো যে, মুসলামনরা এ পবিত্র গীর্জা কখনো দখল করতে পারবে না। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গীবন ঐ সময়ের যে চিত্র এঁকেছে তা সত্যি চিত্তাকর্ষক। তিনি বলেন-

এ গীর্জাকে তারা ঈশ্বরের পবিত্র গৃহ বলে বিশ্বাস করতো। কারণ জনৈক সাধু এ মর্মে সুসংবাদ-প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছিলো যে, তুর্কীরা রোমকদের তাড়া করে সেন্টছুফিয়া গীর্জার ঐ স্থান পর্যন্ত উপনীত হবে যেখানে রয়েছে সম্রাট কনস্টান্টাইনকর্তৃক নির্মিত পবিত্র স্তম্ভটি। কিমত্মু এর পর থেকেই শুরু হবে তাদের বিপর্যয়। কারণ তখন আকাশ থেকে স্বর্গীয় দূত তরবারি হাতে অবতীর্ণ হবেন এবং জনৈক সাধুর হাতে তা তুলে দেবেন যিনি ঐ স্তম্ভের গোড়ায় অবস্থান করবেন। স্বর্গীয় দূত সাধুকে বলবেন, যাও প্রতিশোধ গ্রহণ করো। তখন সাধু ঐ তরবারি নিয়ে তুর্কীদের হত্যা শুরু করবেন এবং সমগ্র আনাতুলিয়া থেকে বিতাড়ন করে ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাবেন।

কিন্তু ঐ কথিত স্তম্ভ পার হয়ে তুর্কীরা যখন সেন্টছুফিয়া গীর্জার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেলো তখনো গীর্জার ভিতরে আশ্রয়গ্রহণকারী খৃস্টানরা আসমানী সাহায্যের আশায় বসে ছিলো। শেষ পর্যন্ত নাঙ্গা তলোয়ার হাতে যিনি তাদের সামনে হাযির হলেন তিনি ছিলেন সুলতান মুহম্মদ আলফাতিহ।

তবে এই বিজয়ী সুলতানও তাঁর পূর্বসূরী মুসলিম বিজেতাদের ইসলামী চরিত্র পূর্ণমাত্রায় অনুসরণ করেছিলেন। গীর্জায় আশ্রয়গ্রহণকারী একজন মানুষকেও তিনি হত্যা করেননি, সবাইকে আমান ও নিরাপত্তা দান করেছিলেন।

একটি সুন্দর বাগান পার হয়ে গীর্জার প্রধান ফটক। ফটকের দুপাশে পাথরের উঁচু জায়গা রয়েছে যেখানে দুজন পাহারাদার সর্বদা নিযুক্ত থাকতো। শত শত বছর ধরে এই সশস্ত্র প্রহরার ব্যবস্থা ছিলো, যার ফলে পাথরের গায়ে গর্তের মত হয়ে গিয়েছিলো যা পরিষ্কার দেখা যায়, বলে আল্লামা তক্বী উছমানী উল্লেখ করেছেন, আমরা অবশ্য বিষয়টি খেয়াল করিনি। ভিতরে তখন চুনকামের কাজ চলছিলো। তাই সবটা অংশ ঘুরে ফিরে দেখার সুযোগ ছিলো না। ভিতরে পুরো হলঘরটা প্রায় বর্গাকৃতির। উত্তর-দক্ষিণে ২৩৫ ফুট, মাঝখানের গম্বুজটির ব্যাস হচ্ছে ১০৭ ফুট, আর উচ্চতা ১৮০ ফুট। খুঁটির সংখ্যা ১৭০ এ থেকেই পুরো ইমারতের বিশালতা অনুমান করা যায়। পুরোটা ইমারত তৈরী করা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন বর্ণের অতি মূল্যবান মর্মর পাথর দ্বারা। সবচে বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, সমস্ত দেয়ালে, ছাদে, গম্বুজে বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র পাথরে খোদাই করে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এসব চিত্র আজ এত বছর পরও এমন উজ্জ্বল অবস্থায় রয়েছে যে, মনে হবে, এই সেদিনের কাজ! সুলতান মুহম্মদ আলফাতিহের নির্দেশে সমস্ত চিত্র চুনা দিয়ে লেপে দেয়া হয়েছিলো।

সুলতান মুহম্মদ আলফাতিহ যেদিন ইস্তাম্বুলের উপর চূড়ান্ত হামলা করেন সেদিন ফজরের সময় ঘোষণা করেছিলেন, ইনশাআল্লাহ যোহরের নামায আমরা আয়াছুফিয়ায় আদায় করবো।

আল্লাহ তাআলা এই মর্দে মুজাহিদের লাজ রক্ষা করেছিলেন। দুপুরের আগেই শহরের পতন ঘটেছিলো এবং তিনি আয়াছুফিয়ার ভিতরে যোহর আদায় করেছিলেন। প্রথম জুমাও সেখানেই আদায় করা হয়েছিলো। পরে সুলতান সেন্টছুফিয়া গীর্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। খৃস্টান ঐতিহাসিকগণ এ কারণে সুলতান মুহম্মদ-এর সমালোচনায় সর্বদা সোচ্চার। পক্ষান্তরে স্পেনে বিজেতা খৃস্টানদের সমস্ত অপকর্ম সম্পর্কে তারা একেবারে নীরব। অথচ কর্ডোভার কথাই ধরুন। শহরটি খৃস্টানরা অধিকার করেছিলো সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে এবং চুক্তির অনেকগুলো শর্তের একটি ছিলো কোন মসজিদে কোনরকম হস্তক্ষেপ করা হবে না। পক্ষান্তরে কনস্টান্টিনোপল-এর পতন যখন সুনিশ্চিত তখনো সুলতান মুহম্মদ রক্তপাত এড়ানোর উদ্দেশ্যে নিজে উদ্যোগী হয়ে সন্ধির আহবান জানিয়েছিলেন, যা অত্যন্ত অপমানজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ফলে তলোয়ার দ্বারাই জয়-পরাজয়ের ফয়ছালা হয়। সুতরাং গীর্জা রক্ষা করার দায় সুলতানের উপর কোনভাবেই ছিলো না। তাছাড়া গীর্জা সম্পর্কে খৃস্টানদের যে কুসংস্কার ছিলো তা চিরতরে বিলুপ্ত করার জন্য হয়ত সুলতান এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য মনে করেছিলেন।

যাই হোক, কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর দীর্ঘ পাঁচশ বছর আয়াছুফিয়া মসজিদরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। তারপর যখন মুস্তফা কামাল পাশার হাতে উছমানি খেলাফতের বিলুপ্তি ঘটলো তখন প্রথমে সেখানে নামায আদায় করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। তারপর মসজিদ পরিণত হলো জাদুঘরে।

দুঃখজনক বিষয় এই যে, অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবীও মনে করেন, সুলতান মুহম্মদ আলফাতিহ গীর্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করে ঠিক কাজ করেননি, বরং তাঁর কর্তব্য ছিলো দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রা.-এর আদর্শ অনুসরণ করা, যিনি পাদ্রীদের অনুরোধ সত্ত্বেও গীর্জায় নামায আদায় করেননি এ আশঙ্কায় যে, হয়ত মুসলমানেরা এ অজুহাতে গীর্জাকে পরবর্তীকালে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। কিন্তু ভদ্রলোকেরা শুরুতেই ভুলে যান যে, জেরুজালেম হযরত ওমর রা.-এর অধিকারে এসেছিলো সন্ধির মাধ্যমে।

আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, সুলতান মুহম্মদ আলফাতেহ সাধারণ কোন বিজেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন সেই মহান ও ভাগ্যবান বিজেতা যার সম্পর্কে স্বয়ং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিজয়ের সুসংবাদ দিয়ে এরশাদ করেছিলেন-

لتفتحن القسطنطنيـة, فلنعم الأمير أميرها, ولنعم الجيش ذلك الجيش

অবশ্যই কুস্তুনতুনিয়া বিজিত হবে, তো কত না উত্তম ঐ বিজয়ের সেনাপতি, আর কত না উত্তম বাহিনী সেই বাহিনী! (মুসনাদে আহমাদ)

মুস্তফা কামাল পাশার বড় মেহেরবানি এই যে, আয়াছুফিয়াকে তিনি অর্থোডক্স চার্চ-এর হাতে তুলে দেননি, এমনকি মসজিদরূপে ব্যবহারের জন্য যে মেহরাব তৈরী করা হয়েছিলো সেটিও অক্ষত রেখে শুধু শেকল দিয়ে ঘেরাও করে দিয়েছেন, আর চারটি কোণে ছয় পরতে সুন্দর আরবী হস্তাক্ষরে আল্লাহ, মুহম্মদ, আবু বকর, উমর, উছমান ও আলী নামের যে ফলক যুক্ত করা হয়েছিলো তাও বহাল রাখা হয়েছে।

আল্লামা তক্বী উছমানী মু. লিখেছেন, মুস্তফা কামাল পাশার সময় থেকেই এখানে এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও নামায পড়া নিষিদ্ধ ছিলো, তবে ধীরে ধীরে এই কড়াকড়ি অনেকটা শিথিল হয়ে এসেছে। আমরা আছর নামায এখানেই আদায় করেছি, কেউ বাধা দেয়নি। কিন্তু এটা অবশ্যই এক মর্মান্তিক ট্রাজেডি যে, যে পবিত্র ভূমিতে শত শত বছর আল্লাহর লাখ লাখ বান্দা সিজদা করেছে সেখানে এখন হাজার হাজার পর্যটক  (জুতা পায়ে) ঘুরে বেড়ায়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

তবে অতীব আনন্দের বিষয় যে, আমার তুরস্ক সফরের চার বছর পর এ সফরনামা যখন লিখছি তখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, সম্প্রতি হাজার হাজার মুসলিম আয়াছুফিয়ার সামনে নামায আদায় করে এটিকে আবার নামায আদায়ের জন্য খুলে দেয়ার দাবী জানিয়েছে। আনাতোলিয়া ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রধান ছালেহ তূরান বলেছেন, আয়াছুফিয়ার শেকল ভাঙ্গার জন্য এটি একটি জোরালো পদক্ষেপ, আর এজন্য আমরা দেড় কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছি।

তিনি আরো বলেন, আয়াছুফিয়া হচ্ছে কুসতুনতুনিয়ায় মুসলিম বিজয়ের প্রতীক, কিন্তু আমরা ইস্তাম্বুলবিজয়ী সুলতান মুহম্মদ আলফাতিহের অছিয়তের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছি, যাতে তিনি বলেছেন, আয়াছুফিয়াকে মসজিদ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা গুরুতর অপরাধ হবে।

অন্যদিকে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী[6] রজব তৈয়ব এরদোগান বাইজান্টাইন খৃস্টান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের ৫৬১তম বার্ষিকী উদযাপনকালে বলেছেন, এটি ছিলো দরজা ও হৃদয়ের শেকল ভাঙ্গার বিজয়। পর্যবেক্ষক মহল তার এ বক্তব্যকে আয়াছুফিয়া সম্পর্কে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন।

আমরাও মনে করি, ইনশাআল্লাহ সেদিন খুব বেশী দূরে নয় যখন আয়াছুফিয়া মসজিদের মেহরাব শেকল মুক্ত হবে এবং আবার তা আল্লাহর ঘর মসজিদের রূপ ফিরে পাবে।

অমুসলিম পর্যটকদের বিষয়ে আর কী দুঃখ প্রকাশ করবো, আর সাধারণ মুসলিম পর্যটকদের সম্পর্কেই বা কী বলবো, সম্মেলনে আগত মেহমানদের অনেকেই নির্দ্বিধায় জুতা পায়ে ভিতরে প্রবেশ করে দিবিব ঘুরে বেড়ালেন দেখলাম। কিছু কিছু মেহমান অবশ্য সচেতন ছিলেন, এমনকি কারো কারো চোখ অশ্রুসিক্ত হতেও দেখেছি। একজন আরব মেহমান উচ্চ স্বরে অত্যন্ত দরদের সঙ্গে এই দুআ করছিলেন, হে আল্লাহ, তোমার বান্দারা তোমার ঘরের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, হে আল্লাহ, তুমি নিজে তোমার ঘরের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করো।

সময় ফুরিয়ে আসছে, তাই গাইড সবাইকে তাগাদা দিলেন বাসে গিয়ে ওঠার জন্য। কারণ এখান থেকে যেতে হবে তোপকাপি প্রাসাদে, তারপর মাগরিবের আগে ফিরতে হবে হোটেলে।

***

এর পর কাফেলা রওয়ানা হলো তোপকাপি-এর উদ্দেশ্যে। খুব বেশী দূরে নয়। গাড়ীতে পাঁচ মিনিটের পথ। তবে যেখানে গিয়ে গাড়ী থামলো সেখান থেকে মূল ফটক যথেষ্ট দূরে। বিশাল এক বাগান হেঁটে পার হতে হয়।  বেশ হিমেল বাতাস ছিলো। গাছের পাতাগুলো ঝিরঝির নড়ছিলো। হাঁটা পথের দুপাশে ফুলের কেয়ারি। নানা বর্ণের ফুল ফুটে আছে। সে বড় মনোরম দৃশ্য! এখানেও সেই একই দৃশ্যের অবতারণা হলো, তবে আগের তুলনায় কিছুটা পরিমিত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে। বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন বয়সের লোকজন মুছাফাহার জন্য যেন রীতিমত প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কেউ কেউ খুব ভক্তির সঙ্গে মেহমানের দাঁড়ি ছুঁয়ে নিজের হাতেই চুমু খাচ্ছে! হৃদয়ের ভালোবাসার আরো কত রকম প্রকাশ! কত রকম উচ্ছ্বাস! একজন বয়োবৃদ্ধ, লাঠি ভর করে হাঁটছেন, সম্ভবত বৈকালীন ভ্রমণে বের হয়েছেন। কণ্ঠস্বরও ততটা উচ্চ নয়, বিশেষ কাউকে লক্ষ্য করে নয়, মেহমানদের দিকে তাকিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললেন, তোমাদের দেশের মানুষের কাছে তুর্কী ভাইদের সালাম পৌঁছে দিও।

কী ফল যেন বিক্রি হচ্ছিলো। কয়েকজন মেহমানের ইচ্ছে হলো ফল কিনবেন। অমনি এক তুর্কী মহিলা সেখানে হাজির। মুখের কথায় এবং হাতের ইশারায় বলছেন, নাও যত ইচ্ছা নাও, পয়সা আমি দেবো।

মুখের কথায় না হলেও হাতের ইশারায় এবং চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে বুঝিয়ে দিলেন, তোমরা আমার মেহমানদারি কবুল না করলে দিলে বহুত তকলিফ হবে। শেষ পর্যন্ত সমস্ত ফল তিনি মেহমানদের মধ্যে জোর করে করে বিতরণ করলেন। তার চেহারায় তখন তৃপ্তির কী যে উদ্ভাস! দুহাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী বললেন তা তিনিই জানেন।

আমরা বুঝলাম, এমন অভাবিতপূর্ব সৌভাগ্য দান করায় আল্লাহকে শোকর জানাচ্ছেন। তুরস্কের পথে পথে মেহমানদের কাফেলা এমন কতভাবে যে তুর্কী ভাইদের ঈমানী ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে! লিখতে গেলে এক দফতর হয়ে যাবে, তবু তাদের হৃদয়ের সত্যিকার মানচিত্র হয়ত আঁকা সম্ভব হবে না। তুর্কী জনগণকে আল্লাহ হেফাযত করুন! ঈমানের পথে, মর্যাদা ও নেতৃত্বের পথে এবং মুক্তি ও সফলতার পথে তুর্কী ভাইদের আল্লাহ পরিচালিত করুন! আবার যেন তারা ফিরে আসতে পারে তাদের অতীতের গৌরবের কাছে। সমস্ত ফিতনা-ফাসাদ ও বিপদ-দুর্যোগ থেকে আল্লাহ তাদের হিফাযত করুন, আমীন।

***

প্রধান ফটক এসে গেলো। দরজার উপরে আরবী হরফে কী লেখা বুঝতে পারলাম না, তবে উছমানী ও খিলআত শব্দ দুটি শুধু মনে আছে। সম্ভবত পর্যটকদের ভিতরে যাওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। মেহমানদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় আজ খোলা রাখা হয়েছে। গাইডের কথায় এমনই ধারণা হলো। দরজায় যারা দাঁড়িয়েছিলেন মেহমানদের স্বাগত জানানোর জন্য তাদের আচরণ আমাদের মুগ্ধ করলো। হয়ত বলা হবে, এটা তো পেশাদারিত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু মানুষের আচরণে অন্তরের স্পর্শ আছে কি নেই তা বোঝার মত অনুভূতি আল্লাহর রহমতে এ অভাগার আছে। কৃত্রিম হাসি এবং হৃদয়ের ঝর্ণা থেকে উৎসারিত হাসি একরকম হয় না, উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য থাকে যেমন থাকে গাছের ফুল ও কাগজের ফুলের মধ্যে। ইস্তাম্বুলের পথে পথে যেমন তাজা ফুল ফুটে থাকতে দেখেছি, প্রতিটি মানুষের মুখেও দেখেছি সেই তাজা ফুলের হাসি। তোপেকাপির ফটকের সামনে এই অসময়ে যিনি আমাদের স্বাগত জানালেন তার মুখেও ছিলো সেই ফুলের হাসি।

তোপ মানে কামান। শব্দটি বাংলায় সুপরিচিত। এই তো কালকের পত্রিকায় দেখলাম, ৫ই জানুয়ারীর ভোটার ছাড়া নির্বাচনের মন্ত্রী সাংবাদিকদের তোপের মুখে পড়েছেন। এটা অবশ্য আসল তোপ নয়; প্রশ্নগুলো যেহেতু কামানের গোলার মত ছুটে আসে, আর মন্ত্রী বেচারা ঘায়েল হয়ে যান সেহেতু বলা হয় তোপের মুখে পড়া। শুধু জানা নেই যে, শব্দটি তুর্কিভাষা থেকে এসেছে। কাপে মানে দরোজা। তো তোপকাপে মানে হলো তোপের দুয়ার, আর সরায়ে শব্দটিও বাংলায় ব্যবহৃত হয় একটু চেহারা বদল করে, গায়ে গতরে একটু বড় হয়ে, অর্থাৎ সরাইখানা। তবে তুর্কিভাষায় সরায়ে মানে প্রাসাদ, বালাখানা। প্রিন্সিপ্যাল ইবরাহীম খাঁ, ইস্তাম্বুলযাত্রীর পত্র-এ তরজমা করেছেন, তোপদুয়ারি মহল। আসল ঘটনা এই যে, বাইজান্টাইন আমলে এখানে প্রাচীরঘেরা কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশের একটি ফটক ছিলো, যার নাম ছিলো সেন্ট রোমানুস ফটক। কনস্টান্টিনোপলে চূড়ান্ত হামলা করার সময় সুলতান মুহম্মদ আলফাতিহ এখানে একটি ভারি তোপ স্থাপন করেছিলেন।

মুসলিমবাহিনীর হামলার মুখে এ ফটকটিই সবচে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো এবং বিজয়ের পর সুলতান এ ফটক দিয়েই শহরে প্রবেশ করেছিলেন। ফলে এটি তোপকাপে বা কামান-দুয়ার নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে এখানে একটি শাহীবালাখানা তৈরী হয়। সুলতান মুহম্মদ আলফাতিহ থেকে শুরু করে সুলতান আব্দুল মজীদ পর্যন্ত সবাই এখানেই বাস করতেন। ১৪৭৮ সাল থেকে ১৮৫৩, অর্থাৎ ভারতবর্ষে মহান সিপাহি বিপ্লবের চারবছর আগ পর্যন্ত এই তোপকাপে প্রাসাদে বসেই সুলতান মুহম্মদ, সুলতান সেলিম, সুলতান সোলায়মান কানুনী রাজকার্য পরিচালনা করতেন। এখান থেকেই সুলতানের একটিমাত্র অঙুলিহেলনে ইউরোপ-এশিয়া-আফ্রিকার ভাগ্য নির্ণয় হতো[7]। এ প্রাসাদের প্রতিটি দেয়াল, গম্বুজ ও স্তম্ভ ইতিহাসের কত বড় বড় ঘটনার নীরব সাক্ষী! এখানে বসেই তৈরী হয়েছে কত না দেশজয়ের অভিযান-পরিকল্পনা! এ প্রাসাদ যেমন দেখেছে তুর্কীশাসনের চরম উত্থানকাল, তেমনি দেখেছে তাদের পতনকালের সূচনাও। ১৮৫৩ সালে দোলমাবাগ প্রাসাদ তৈরী হওয়ার পর তুর্কী সুলতান সেখানে বসবার শুরু করেন। এদিক থেকে তোপকাপে প্রাসাদকে ভাগ্যবানই বলতে হয় যে, তুর্কী খলিফা ও উছমানী খেলাফতের ভাগ্যবিপর্যয়ের সাক্ষী তাকে হতে হয়নি।

তোপকাপে প্রাসাদ এখন একটি জাদুঘরমাত্র, তবে দুর্লভ ও মূল্যবান ঐতিহাসিক দ্রব্যসামগ্রীর দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ জাদুঘর বলে স্বীকৃত।

আমরা যে ফটক দিয়ে তোপকাপে প্রাসাদে প্রবেশ করলাম সেটি হলো দক্ষিণ দিকের ফটক, যার নাম বাবে হুমায়ূন, বা শাহী ফটক। এটাই হচ্ছে প্রাসাদের প্রধান ফটক। সামনে সুপ্রশস্ত প্রাঙ্গণ। তা অতিক্রম করার পর প্রথম যে ভবন সেটাই হচ্ছে কাছরে মুহম্মদ আলফাতিহ। ইস্তাম্বুল বিজয়ী সুলতান মুহম্মদ আলফাতিহ-এর প্রাসাদ। যদিও বলা হচ্ছে প্রাসাদ, কিন্তু আসলে তা খুব সাদামাটা একটি ভবন, যা প্রমাণ করে, সুলতান কতটা সাধারণ জীবন যাপন করতেন। পরবর্তী সুলতানদের ক্ষেত্রে মোটামুটি এটাই ছিলো সত্য। জাঁকজমক ও আয়েশ-বিলাস তারা পরিহার করেই চলেছেন। তবে এটাও সত্য যে, উছমানী খেলাফতের পতনের সূচনাও হয়েছে ইতিহাসের চিরন্তন নিয়মে হারেমের আয়েশি ভোগ ও বিলাসী জীবন থেকেই। এ ভবনের সামনে যে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ তার ঠিক মাঝখানে এক খন্ড মেঝেতে রয়েছে পতাকাদণ্ড স্থাপনের জন্য মোটামুটি আকারের একটি ছিদ্র। এখন সেখানে না আছে পতাকা, না পতাকাদন্ড। আল্লামা তক্বী উছমানী তার সফরনামায় এ প্রসঙ্গে যা লিখেছেন তা এখানে উল্লেখ করার লোভ সম্বরণ করা আর সম্ভব হলো না। দেখুন তাঁর ভাষায় কী দরদ-ব্যথা এবং হৃদয়ের কী রক্তক্ষরণ! -

এটা ছিলো ঝাণ্ডা গাড়ার স্থান। উছমানী খেলাফতের লাল হেলালের ঝাণ্ডা শতাব্দীর পর শতাব্দী এখানে পতপত করে উড়েছে। ইউরোপের বড় বড় শক্তি যুগের পর যুগ এ হেলালী ঝাণ্ডার সামনে মাথা নত করে রেখেছে। এই হেলালী ঝাণ্ডাই ছিলো বহু শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামী জাহানের ঐক্য ও ইত্তেহাদের নিশান, যা মুসলিম শক্তির প্রমাণরূপে দুনিয়ার তিন মহাদেশের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে উড্ডীন ছিলো - সেই ঝাণ্ডা কোথায় আজ? স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ রয়ে গেছে শুধু একটা ছিদ্র, যা ঐ ঝাণ্ডা অবনমিত হওয়ার পর এখনো আর ভরাট করা সম্ভব হয়নি।

তক্বী উছমানীর কথা এখানেই শেষ। ভবিষ্যতের গর্ভে কী আছে তা তো আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না, তবে দিগন্তে আলোর ক্ষীণ একটি রেখা হয়ত দেখা যাচ্ছে। হয়ত এই তুরস্কের, এই তুর্কিস্তানের ভূমি থেকেই আবার জেগে ওঠবে কোন মুহম্মদ আলফাতিহ। সে প্রতীক্ষারই প্রহর গুণছে এখন, ইরান-তুরান, আরবজাহান এবং সমগ্র মুসলিমবিশ্ব।l

(চলবে ইনশাআল্লাহ)


[1]  জোশ ও উদ্দীপনায় ভরপুর

[2] সত্যের অনুরোধে এখানে একটা কথা অবশ্য বলে রাখতে হয়, তাঁর চিমত্মার কিছু কিছু অংশ আহলে ইলমের নিকট সংশোধনযোগ্য। কিছু ফিকহী মাসআলায় জুমহূর উলামায়ে কেরামের খেলাফ তাঁর একক মত রয়েছে, যা অনুসরণযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত করা যায় না।

[3] তিনি রাজত্ব করেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে ১৭০৩ ঈ. থেকে ১৭৩০ ঈ. পর্যন্ত।

[4] কর্ডোভা

[5] অথচ সুলতান তৃতীয় আহমদ নিজ খরচে মসজিদুল হারামে একটি মিনার তৈরী করেছিলেন যাতে হারামের মর্যাদা বজায় থাকে!

[6] এখন তিনি তুরস্কের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান।

[7] ভাগ্য তো নির্ধারিত হয় আল্লাহর আদেশে, কিন্তু বাংলায় এভাবে বলা হয়; এটা হলো বাংলাভাষার উপর হিন্দুপ্রভাবের ফল। অবশ্য আরবীতেও أنبت الربيع البقل (বসন্ত সবুজ অঙ্কুরিত করেছে) এর ব্যবহার রয়েছে, যাকে অলঙ্কারের নামে বৈধতা দান করা হয়েছে, তবু মনে হয়, ভাগ্য শব্দটির  ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।

 

 

advertisement