সফর ১৪৩৬   ||   ডিসেম্বর ২০১৪

প্রসঙ্গ : পর্দার বিধান : আল্লাহর সীমারেখা মানুষের স্বভাবজাত

মুহাম্মাদ ফজলুল বারী

মানুষ স্বাধীন, কিন্তু সে স্বাধীনতার সীমারেখা আছে। একটি দেশ স্বাধীন, কিন্তু সে দেশের সীমারেখা আছে। দেশের প্রতিটি নাগরিক স্বাধীন, কিন্তু সে স্বাধীনতার অর্থ যাচ্ছা তাই করে যাওয়া নয়। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলা নয়। সীমারেখা মেনেই মানুষকে দুনিয়াতে চলতে হয়; আল্লাহর সীমারেখা এবং মানুষের সীমারেখা।

আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন স্বাধীন করে। তাকে ইচ্ছা, চিন্তা ও কর্ম সবকিছুর স্বাধীনতাই দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ টেনে দিয়েছেন সীমারেখা। যা লংঘন করলে মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

আল্লাহর দেয়া স্বাধীনতাকে মানুষ চূড়ান্ত স্বাধীনতা মনে করে, ফলে তাঁর সীমারেখা লংঘন করতে চায় এবং করে, ফলে বিপদে পড়ে।

প্রবৃত্তির গোলামীতে আল্লাহর সীমারেখা লংঘন করার জন্য মানুষ বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করায়। কখনো তার নাম হয় প্রগতি, কখনো আধুনিকতা। কখনো অধিকার, কখনো স্বাধীনতা। কখনো মুক্তচিন্তা, কখনো মুক্তবুদ্ধি। কখনো মানবধর্ম, কখনো ধর্মনিরপেক্ষতা। কখনো বা কোনো পোশাক ছাড়া আল্লাহর সীমারেখাকে সরাসরি অস্বীকার করে ‘সেকেলে’ বলে। (নাউযু বিল্লাহ, তোমার পানাহ  হে আল্লাহ)

আল্লাহর সীমারেখা লংঘন করলে বিপদ ঘটবেই, মানুষ বিপথগামী হবেই। যারা হেদায়েতের আলো ছেড়ে ‘অন্য আলো’র পিছে ছুটে, তারা যখন সমস্যার সম্মুখীন হয় তখন তারাও সীমারেখার কথা বলে; আল্লাহ যে সীমারেখা দিয়েছেন, সে সীমারেখার কথাই বলে। কিন্তু বলে না যে, এটা আল্লাহর সীমারেখা; আল্লাহ এটা নিষেধ করেছেন বা এটা ইসলামের নির্দেশনা। কারণ, আল্লাহর নাম শুনলে তাদের গায়ে জ্বালা ধরে। আল্লাহর নাম নিলে প্রগতি বা আধুনিকতা নষ্ট হয়। (শয়তান) প্রভুরা অসন্তুষ্ট হয়। অল্লাহ এদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে- (তরজমা) ‘‘যখন এক আল্লাহর কথা বলা হয়, তখন যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় বিরক্ত ও সংকুচিত হয়। আর আল্লাহ ছাড়া অন্যের কথা বলা হলে তারা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।’’ (সূরা যুমার ৩৯ : ৪৫)

অর্থাৎ তখন মনে করে, এই না জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। এই না উন্নতি, প্রগতি ও মুক্তির কথা বলা হয়েছে!

যাহোক, সমস্যার গোড়া থেকে মানুষ যখন ভাবে এবং সমাধান নিয়ে বাসত্মবতার নিরিখে চিন্তা করে, তখন আপনা হতেই আল্লাহর সীমারেখা মানুষের মনে এসে যায়। কারণ তা মানুষের স্বভাবজাত; মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর দেয়া সীমারেখা। এমনই একটি লেখা পড়ে এ লেখাটি লেখা হয়েছে। [শুধু এ লেখাটিই নয় বরং এর আগেও এমন অনেক লেখাই চোখে পড়েছে, যেখানে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ইভটিজিং, এইড্স, আত্মহত্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং বাস্তব কারণে আল্লাহর সীমারেখার আলোচনাও এসেছে। কিন্তু সন্তর্পণে আল্লাহর নাম, ইসলামের নাম এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। কেমন যেন মুসলিম পরিচয়ধারী একটি শ্রেণী তৈরী হচ্ছে, যারা তাদের লেখা ও বক্তব্যে ইসলামের নাম মুখে আনাকে ‘ডিসক্রেডিট’ মনে করছে। এজন্যই এ প্রসঙ্গ টানা।]

এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। গত ১০ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের বুধবারের ক্রোড়পত্র ‘অধুনা’-এর প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম লেখার শিরোনাম দেখেই পড়া শুরু করলাম; দেখি ভেতরে কী বলে। লেখাটি ছিল পর্দার বিধান অমান্য করার কারণে সমাজে যে বিভিন্ন অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তারই একটি দিক নিয়ে। স্বামীর সাথে নিজের বোনের কোনো অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠলে বা এজাতীয় কারো সাথে কারো এমন সম্পর্ক হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে করণীয় কী? -তাই নিয়েই লেখাটি। এধরনের অনৈতিক সম্পর্ক যে কত সংসার ভেঙে দেয়, কত সম্পর্ক নষ্ট করে! আবার কখনো খুনোখুনির মত আপদও ডেকে আনে।

লেখাটির কয়েকটি শিরোনাম আমার মনোযোগ আকর্ষণ করল। শিরোনাম দেখে মনে হল, আরে এ কথাই তো বাসত্মব কথা, আল্লাহ ও আল্লাহ্র রাসূলের কথা!

একটি শিরোনাম ছিল, ‘সীমারেখা টানুন’। অর্থাৎ দুলাভাইকে দুলাভাইয়ের স্থানেই রাখুন। তার সাথে আচার-আচরণ বা আপনার সাথে তার আচার-আচরণের মধ্যে একটি সীমারেখা টানুন। তার প্রতি নিজের আকর্ষণ বা ভালোলাগা তৈরি হতে পারে বা আপনার প্রতি তার কোনো আকর্ষণ তৈরি হতে পারে, কিন্তু সেটিকে মোটেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। ( লেখাটির আরেকটি শিরোনাম ছিল, ‘প্রশ্রয় নয় একেবারেই’।)

হাঁ, এটিই তো ইসলাম বলে। দুলাভাই দুলাভাইয়ের স্থানে। তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকবে, কিন্তু তার সাথে চলাফেরা, আচার-আচরণ, কথাবার্তা সবকিছুতে আল্লাহর দেয়া সীমারেখা মেনে চলতে হবে। দুলাভাইয়ের সাথে নিজের ভায়ের মত চলাফেরা করতে গেলেই বিপদ ঘটতে পারে। তেমনি ভাবীর ক্ষেত্রেও তা-ই। দেবর যেমন ভাবীর সাথে আচার-আচরণে সীমারেখা মেনে চলবে, তেমনি ভাবীও। একই কথা চাচাতো-মামাতো ভাই-বোন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও।

তোমার ভাবী-ই তো সমস্যা কী? বা তোমার দুলাভাই-ই তো যাও ঘুরে এসো, সমস্যা কী? হাঁ, সমস্যা আছে। আমরা সমস্যা আছে স্বীকার করি, যখন বিপদ ঘটে। তখন আমরা বলি, ওকে তো আমার ছেলের মতই মনে করতাম, ও এমন কাজটা করল। তুই বোন হয়ে বোনের এমন ক্ষতিটা করলি। আসলে এ বিপদটা তো ঘটল আমাদের কারণেই। আল্লাহর সীমারেখা লংঘন করার কারণেই। আর এসবকিছু আগে থেকেই জানেন, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন তার স্বভাব-প্রকৃতি। এজন্যই আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সীমারেখা টেনে দিয়েছেন। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘‘দেবর মৃত্যু সমতুল্য।’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৭২) এর একটি মর্ম এমন হতে পারে যে, এক্ষেত্রে আল্লাহর সীমারেখা মেনে না চললে তোমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের মৃত্যু ঘটতে পারে।

লেখাটির আরেকটি শিরোনাম ছিল, ‘আলাদা সময় কাটানো একেবারেই নয়’। আরে! এ যে একটি হাদীসেরই ভাষ্য! হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

মাহরাম পুরুষ  ছাড়া যেন কোনো নারী কোনো পুরষের সাথে নির্জনে মিলিত না হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৪১

আরেক বর্ণনায় এসেছে,

لا يخلون رجل بامرأة إلا لا يخلون رجل بامرأة إلا كان ثالثهما الشيطان

কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে নির্জনে মিলিত হলে নিঃসন্দেহে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান। (অর্থাৎ, তখন শয়তান তাদের মনে কুমন্ত্রণা দেয়।)

-জামে তিরমিযী, হাদীস নং ১১৭১

আসলে মানবসমাজে কী কী সমস্যা দেখা দিবে এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী তা তো সৃষ্টিকর্তা-ই ভালো জানবেন; যিনি সৃষ্টি করেছেন মানবের স্বভাব-প্রকৃতি, আবেগ-অনুভূতি। এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় হল, তাঁরই নির্দেশনা অনুযায়ী চলা। এর অন্যথা বিভিন্ন ভাবনা-চিন্তা আমাদের মুক্তি দিবে না, তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। তাঁর নির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে এখানে সেখানে সমাধান খুঁজলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্থ হব। সুতরাং আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তার বাতলানো পথেই চলতে হবে। এতেই পরিত্রাণ ও মুক্তি।

 

 

advertisement