মানুষ এক আদিমাতার সন্তান : একটি গবেষণা ও কিছু কথা
মানুষ এক সৃষ্টি। আল্লাহ তার স্রষ্টা। কুরআন মাজীদে কত স্পষ্টভাবেই না এ সত্য বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষের কর্তব্য, আপন স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ করা।
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ . الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
হে মানুষ! তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা আত্মরক্ষা করতে পার। যিনি ভূমিকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন এবং আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে তা দ্বারা তোমাদের জীবিকাস্বরূপ ফল-মূল উৎপাদন করেছেন। সুতরাং তোমরা জেনে বুঝে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করো না। -সূরা বাকারা ২ : ২১-২২
আরো ইরশাদ-
كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
তোমরা কীভাবে আল্লাহকে অস্বীকার কর? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদের জীবন্ত করেছেন, আবার তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনরায় জীবন্ত করবেন। পরিশেষে তাঁর দিকেই তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে। -সূরা বাকারা : ২: ২৮
আল্লাহ তাআলা আরো জানিয়েছেন, মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নর ও এক নারী থেকে। সুতরাং সকল মানুষ - শত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও - একই বংশের, একই মা-বাবার সন্তান। আর আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হল তাকওয়া।
সূরা হুজুরাতের বিখ্যাত আয়াত-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে; পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার।
তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ সকল কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।
-সূরা হুজুরাত ৪৯ : ১৩
অথচ আল্লাহর ঘোষণা ভুলে মানুষ কত বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে এবং জাতপাতের কত ব্যবধান রচনা করেছে! প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বিভেদ-বিভ্রান্তিকেই সত্য মনে করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। অবশেষে ঐ সত্যের দিকেই মানুষকে প্রত্যাবর্তন করতে হচ্ছে যা মহাজ্ঞানী আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। এখানেই মুমিনের জিত, ঈমানের মাহাত্ম্য। যে মহা সত্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে উদঘাটন করা সম্ভব নয়, কিংবা যা উদঘাটনে এক মানবপ্রজন্ম যথেষ্ট নয় মুমিন তার রবের উপর বিশ্বাস রেখে প্রথম দিনেই তার সন্ধান পেয়ে যায়। এরপর তার অবশিষ্ট জীবন সেই সত্যের আলোকে পরিচালিত হয়। এ সৌভাগ্যের কি কোনো তুলনা হতে পারে!
আমাদের চারপাশের পৃথিবীতে আল্লাহর কুদরতের এবং কুরআনের সত্যতার কত নিদর্শন ছড়িয়ে আছে! এরপরও আল্লাহ প্রতিনিয়ত তাঁর নিদর্শন প্রকাশ করে চলেছেন। কিন্তু হেদায়েত তো সে-ই পাবে যাকে তিনি হেদায়েত দান করবেন। হায়! মানুষ তার স্রষ্টার কতই না মুখাপেক্ষী!
দুই.
গত ১৪ আগস্ট ২০১৪ বৃহস্পতিবার দৈনিক নয়া দিগন্তে ‘মানুষ এক আদিমাতার সন্তান’ শিরোনামে জনাব মুহাম্মদ আলী রেজার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষক, যা ঐ প্রবন্ধের লেখক পরিচিতিতে উল্লেখিত ছিল। লেখকের শব্দচয়ন ও উপস্থাপনায় নিজস্বতা আছে, তবে তাঁর তথ্য-উপাত্ত আগ্রহী পাঠকের মনে চিন্তার খোরাক জোগাবে বলে মনে করি। লেখাটি হুবহু তুলে দেয়া হল।
এখানে মনে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞানের অনেক সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত কিছু নয়। আজ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত আসছে, কাল তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। আবার বহু বিষয়ে খোদ বিজ্ঞানীদের মধ্যেই মতভেদ আছে। এসকল বাস্তবতা সামনে রেখেই বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করতে হবে। বিজ্ঞানের সঠিক সিদ্ধান্ত কখনো কুরআনের বর্ণনার বিরোধী হতে পারে না। কারণ কুরআন আল্লাহ রাববুল আলামীনের কালাম।
জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত বন্ধুগণ যদি সচেতন হন, তাহলে তারা তাদের নিজস্ব বিষয়বস্তু দ্বারাও ইসলামের খেদমত করতে পারেন। এমনকি তাদের অধীত বিদ্যার দ্বারাও ‘ইসলামী’ সাহিত্য তৈরি হতে পারে। তা না করে প্রত্যেকেই যদি কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা, ও শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে ‘গবেষণা’র দায়িত্ব নিয়ে নিতে চান তাহলে একদিকে এ অঙ্গনে অরাজকতার সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে অন্যান্য ক্ষেত্রের সেবা থেকে, যা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল এবং যার প্রয়োজনও ছিল, তা থেকে ব্যক্তি নিজেও বঞ্চিত হন, অন্যদেরও বঞ্চিত করেন। তাই যোগ্য ও উদ্যমী বন্ধুদের কর্তব্য, নিজ নিজ অধ্যয়ন, অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞতার সীমানার ভেতরে থেকে দ্বীনী খেদমতের ও ‘ইসলামী’ সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা।
যে কোনো দ্বীনী কাজের আগে দ্বীনী বিষয়ে প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সাথে পরামর্শ করে নিলে খিদমতের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হতে পারে এবং ইসলামী সাহিত্যে আরো বৈচিত্র্য আসতে পারে। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
মানুষ এক আদিমাতার সন্তান
মুহাম্মাদ আলী রেজা
এই সময়ে বিশ্বে জনসংখ্যা ৭২০ কোটিতে পৌঁছেছে। আমাদের মা-বাবা অদ্বিতীয়, এর অর্থ আমরা সবাই ভাই-বোন, নিগ্রো-ককেশিয়ান এক আদিমায়েরই সন্তান। বিশ্ব ইতিহাসে সাড়া জাগানো ডারউইনের বিপ্লবী বিবর্তনবাদের সূত্র ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করে আসছিলেন- মানবজাতির পূর্বপুরুষদের এ ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভাব হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে। বিবর্তনের ধারা হিসেবে তার অর্থ দাঁড়ায় আমাদের পূর্বপুরুষদের সংখ্যা স্বভাবতই হবে অগণিত। বেবুন, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং এমনি সব প্রজাতির এক ধাপ থেকে অপর ধাপে উত্তরণের মাধ্যমে বিবর্তনের শেষ ধাপ ছিল আমাদের। তাই ধরে নেয়া হয়েছিল আমাদের আদি মা-বাবার সংখ্যা ছিল অসংখ্য, যার কারণে বলা হতো জাতিতে জাতিতে, বংশ ও গোত্রের মধ্যে কাঠামোগত, আকৃতিগত, চর্মবর্ণ, চুলের রঙ ইত্যাদিতে এত পার্থক্য। এত দিনের বিবর্তনের এসব জল্পনাকল্পনাকে ভেস্তে দিয়ে বিজ্ঞানাগারে প্রমাণিত হলো, আমাদের মা-বাবা অদ্বিতীয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা কি তা হলে বিবর্তনের ফসল নই? নাকি ভিনগ্রহ, সেই পৌরাণিক বেহেশত থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের আগমন?
সাম্প্রতিক গবেষণায় একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যা এএফপি, আলজাজিরাসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ১৮ লাখ বছরের পুরনো একটি খুলির ওপর গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মানুষের পূর্বসূরি আদি প্রজাতি (হোমিনয়েড) আসলে তিনটি নয়, বরং একটিই ছিল। সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
২০০৫ সালে জর্জিয়ার দামিনিসি প্রত্নস্থলে খুবই ভালো অবস্থায় থাকা পাঁচটি হোমিনিড খুলি উদ্ধার করা হয়। এগুলোর একটির সাথে ২০০০ সালে পাওয়া একটি চোয়ালের হাড় ঠিকঠাক মিলে যায়। এতে একটি পরিপূর্ণ খুলি নিয়ে গবেষণার সুযোগ পান বিজ্ঞানীরা। ওই খুলির ধারকের মস্তিষ্কের আকার ছিল আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
সংশ্লিষ্ট গবেষক এবং সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অবস্থিত অ্যানথ্রোপলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অ্যান্ড মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞ মার্সিয়া পোন্স দো লিয়ঁ বলেন, চোয়ালজুড়ে সম্পূর্ণ করা খুলিটি হচ্ছে ওই যুগের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ করোটি।
গবেষকেরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেন, হোমিনয়েডের পাঁচটি খুলির গঠনে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। অথচ সেগুলো একই সময়ের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। তবে কিছু পার্থক্যের কারণে সেগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। এরা খুলিগুলোর চোয়াল, ভ্রু ও গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক পার্থক্য বিশ্লেষণ করেন। এতে সব খুলি একই প্রজাতিভুক্ত আদি প্রাণীর হতে পারে বলে জোরালো সম্ভাবনা দেখা যায়।
বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল নিউজ উইক জানুয়ারি ১১, ১৯৮৮ সংখ্যায় ‘আদম হাওয়ার অনুসন্ধানে’ শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। (২০০১ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্রে মিডিয়ার একটি টকশোতে জানতে পারি ১১/১/১৯৮৮ সংখ্যার নিউজ উইকের কথাটি। আমি ডাইরিতে নোট করি। স্থানীয় এক লাইব্রেরি থেকে আমি প্রবন্ধটির কপি সংগ্রহ করি।)
প্রবন্ধটির মূল বক্তব্যটির ভাষান্তর করা হচ্ছে:
আমাদের এজমালি মা : ‘পৌরাণিক কাহিনীর বর্ণনাকারীদের উপাখ্যান এখন বিজ্ঞানীদের মৌলিক গবেষণার ফলাফলের সাথে একীভূত হতে যাচ্ছে। আমরা সবাই অতীতের এক স্থানে অভিন্ন পূর্বপুরুষের অংশ ভাগ করি।’ এ আবেগময় বক্তব্যটি করেছেন নিউজ উইকে প্রকাশিত নিবন্ধ ‘The Search for Adam and Eve- এর লেখকেরা। এরা আস্থার সাথে বলেছেন, ‘এই সময়ে কিন্তু এই প্রমাণগুলো উপস্থাপন করা হচ্ছে নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে যারা গবেষণা করেছিলেন আফ্রিকার চিড়ধরা শুষ্ক উপত্যকায় না বসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যামেরিকান ল্যাবরেটরিতে। বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, আমাদের সর্বজনীন মা হচ্ছেন এক মহিলা, যিনি ধরাপৃষ্ঠে দুই লাখ বছর আগে বাস করতেন এবং রেখে গেছেন ‘জিন’, যেটি মানবজাতির সবাই নিজ দেহে বহন করে চলছে। বর্তমান পৃথিবীতে যত লোক বাস করছে সবাই এসেছে তার থেকে। ’
আণবিক জীববিদ্যায় প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানীরা তল্লাশী চালিয়েছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে বিভক্ত বিভিন্ন শ্রেণীর জিনের মাঝে। আর পরীক্ষা করে তাদের মধ্য থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছিলেন একটি ডিএনএ, যেটা আমাদের একজনমাত্র মহিলার দিকেই নিয়ে যায়, যার কাছ থেকে আমরা সবাই এসেছি।
আমাদের এজমালি মাকে খুঁজে বের করার লক্ষ্য গবেষক রেবেকা ক্যান ১৪৭ জন গর্ভবতী মহিলাকে রাজি করান তাদের গর্ভের ফুল বিজ্ঞানকেন্দ্রে দেয়ার
জন্য। তিনি বার্কলের উইলসন ল্যাবে জীববিজ্ঞানী মার্ক স্টোন কিংয়ের সাথে কাজ করছিলেন। ক্যান বাছাই করেন কিছু আমেরিকান মহিলাকে, যাদের পূর্বপুরুষ এসেছিলেন আফ্রিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া থেকে। নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়ায় তার সহযোগী হিসেবে যারা কাজ করছিলেন তারা খুঁজে পেলেন সেখানকার আদিবাসীদের। শিশুরা জন্ম নিল, গর্ভের ফুল সংগ্রহ করে হিমায়িত করা হলো এবং বার্কের উইলসন ল্যাবে বিশ্লেষণ করা হলো। ব্লেন্ডারের সাহায্যে টিস্যুগুলো পরিণত করা হলো স্যুপে। সেন্ট্রিফিউজ কোষ বিভাজন ডিটারজেন্টের সাথে মেশানো হলো, স্ফুর জ্যোতির্ময় দিয়ে শুকিয়ে আবারো সেন্ট্রিফিউজ করা হলো। ফলে পাওয়া গেল স্বচ্ছ তরল পদার্থ, যেটা ছিল ডিএনএ’র খাঁটি উপাদানে তৈরি। বিস্ময়কর ব্যাপার যেটা নজরে পড়ল, তা হচ্ছে- এই ডিএনএ সেই ডিএনএ নয়, যা শিশুর দেহকোষের নিউক্লিয়াসে এবং শিশুর দৈহিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে থাকে। এটি উত্তরাধিকার সূত্রে আসে কেবল মা থেকে। বার্কলের গবেষকরা প্রতিটি ডিএনএ নমুনাকে টুকরো টুকরো করে কর্তন করলেন, যাতে এগুলোকে অপর সব শিশুর ডিএনএন’র সাথে তুলনা করা সম্ভব হতে পারে। যে ফল পাওয়া গেল, তাতে দেখা যায় বিভিন্ন জাতির মধ্যকার পার্থক্যটা বিস্ময়কররূপে অতি সামান্য। স্টোন কিং বলেন, ‘বিভিন্ন জাতির মধ্যে জেনেটিক পার্থক্যটা বাস্তবিকই খুব কম হয়ে থাকে।’
নিউগিনিদের ডিএনএতে দেখা গেল তাদের ডিএনএ অপরাপর নিউগিনিদের চেয়ে বরং আর সব এশিয়ানদের অনেক বেশি কাছের। এটা অদ্ভুত মনে হতে পারে জাতি অথবা বংশগত বাস্তব পার্থক্যসত্ত্বেও। বাস্তবে দেখা যায়, জাতিগত অনেক পার্থক্যই মূলত গতানুগতিক, নিতান্ত সাধারণ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মানুষের ত্বকের রঙ কালো হয়ে থাকে আবহাওয়ার সাথে বড় ধরনের সামঞ্জস্যতা রেখে। আফ্রিকানদের কালো রঙ সূর্যের রশ্মি প্রতিরোধের জন্য হয়ে থাকে। তেমনি ইউরোপিয়ানদের গায়ের রঙ সাদা হওয়ার কারণ হচ্ছে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ যেটা ভিটামিন ‘ডি’ তৈরিতে সাহায্য করে। ত্বকের রঙের পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন হয় কয়েক হাজার বছরের। পক্ষান্তরে শত শত হাজার বছরের দরকার পড়ে ব্রেইন সাইজের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে। প্রতিটি শিশুর ডিএনএ গঠন শেষ পর্যন্ত মিলে যায় একজন মাত্র মহিলার সাথে। জেনেটিক উত্তরাধিকার এমন একটি বিষয়, যেটা এমনকি পরিসংখ্যানবিদদের কাছেও তেমন বিস্ময়কর কিছু নয়। উইলসন ল্যাবের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ‘অবশ্যই একজন ভাগ্যবতী মা ছিলেন।’ ইলোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডগলাস অলেস পরিচালিত গবেষণায় একদল প্রজনন বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন যোগসূত্র থেকে ধারণা করেন, দুনিয়ার প্রথম এই মহিলার আবির্ভাব হয়ে থাকবে এশিয়া মহাদেশে। বিশ্বের চারটি মহাদেশে ৭০০ মানুষের রক্ত থেকে সংগৃহীত মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’র ওপর ভিত্তি করে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। ‘ডিএনএ’ টুকরো টুকরো করে খণ্ডিত করার জন্য তারা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন এবং সেগুলোকে বংশতালিকায় সাজান। এই তালিকা পরিশেষে অতীতের একজন মহিলার কাছে গিয়ে থেমে যায় যিনি দেড় থেকে দুই লাখ বছর আগে এই ধরাপৃষ্ঠে বাস করতেন, তাদের হিসেবে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরর জীবাশ্ম বিজ্ঞানী স্টেফন জে গোল্ডের মতে, ‘এটা আমাদের এই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করে যে, বিশ্বের সব মানুষ তাদের বাহ্যিক ও আকৃতির পার্থক্য সত্ত্বেও একটিমাত্র সত্তা থেকে এসেছে এবং মানব বংশের উৎপত্তি খুব কাছের একটিমাত্র জায়গায়। সব মানুষের মধ্যে জীবতাত্ত্বিক ভ্রাতৃত্ববোধ অনেক বেশি গভীর, যার ধারণা আগে কখনো ছিল না।
দৈনিক বাল্টিমোর সান পত্রিকা Geneticists Reveal Human Family Trees শিরোনামে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করে। আমি এখানে তার ভাষান্তর করছি।
মানবজাতির পিতা : মানবদেহের জীবকোষে যে ‘Y’ ক্রোমোজম রয়েছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে এমন সঙ্কেত পাওয়া যায় যে, গোটা মানবজাতির আদি পিতা মাত্র একজন। গবেষণার এই রিপোর্টটি উদ্ঘাটন করেছে, আজকের প্রত্যেকটি পুরুষ যে ‘Y’ ক্রোমোজম ধারণ করছে, তার লক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট, এটি এসেছে একজন মাত্র পুরুষের কাছ থেকে, যিনি এ পৃথিবীতে বাস করতেন প্রায় এক লাখ নববই হাজার বছর আগে।
এ নতুন গবেষণার ফলাফল এ ধারণাটাই সমর্থন করে, আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল পৃথিবীর মাত্র একটি স্থানে। এ পুরনো ধারণা আর সঠিক নয় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের একাধিক স্থানে মানবজাতির পূর্বপুরুষদের উদ্ভব ঘটেছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা আগে বিশ্বাস করা হতো। ডারউইনের ঐতিহাসিক বিবর্তনবাদ অনুসারে অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন, আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়ে থাকবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে। ‘Y’ ক্রোমোজম হচ্ছে মানব বংশানুগতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক উপাদান ‘জিন’, যে ২৪ ধরনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সুতা দিয়ে গঠিত। তার একটি হচ্ছে, এটা একমাত্র বাবা থেকে ছেলের দেহে সঞ্চারিত হয়। গবেষক মি. হেমার ‘Y’ ক্রোমোজমের অতি ক্ষুদ্র অংশের গঠনের বিশদ তুলনা করেন। সেগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে লালিত আটজন আফ্রিকান, দু’জন অস্ট্রেলিয়ান, তিনজন জাপানি এবং দু’জন ইউরোপীয়দের কাছ থেকে। গবেষকদের মনে যে ধারণাটি কাজ করছিল তা হলো- বিভিন্ন জাতির মধ্যে ক্রোমোজমের সামগ্রিক বিন্যাসের রকমফের কেমন ভিন্নরূপ গ্রহণ করে, তা পর্যবেক্ষণ করা। তারপর নির্ণয় করা, যে বৈচিত্র্য ধরা পড়ল তার বিবর্তনের জন্য কতটা সময়ের দরকার। যে ফল পাওয়া গেল, তাতে দেখা যায়, যত মানবসন্তান আজকের দুনিয়ায় বাস করছে, তাদের সবারই ‘Y’ ক্রোমোজমের যোগসূত্র মেলে কেবলমাত্র একজন পুরুষের সাথে, যিনি জীবিত ছিলেন এক লাখ ৮৮ হাজার বছর আগে।
লেখক : সাবেক পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়