আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস : প্রেক্ষাপট ও করণীয়
আরবী ভাষা কুরআনের ভাষা। মুসলমানদের হৃদয়ের সম্মানিত ভাষা। প্রায় চবিবশ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি মুসলমানকেই অন্তত তার ইবাদত পরিশুদ্ধ করতে আরবী ভাষা শিখতে হয়। আর আলেম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস হতে হলে জানতে হয় আরো ভালোভাবে। দক্ষতা অর্জন করতে হয় ব্যাকরনে, সাহিত্যে।
অন্যদিকে সেমেটিক ভাষাগোত্রের মাঝে অনন্য এক অবস্থান নিয়ে আছে আরবী ভাষা। শুধু সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠিই নয়, পৃথিবীর সকল ভাষার মাঝে আরবী ভাষার রয়েছে সবচেয়ে উচ্চ ও উন্নত আসন। তাই বলা যায় আরবী ভাষা কালজয়ী ভাষা। কালের প্রবাহ কখনো এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। এই ভাষা স্থিতিশীল ও গতিশীল। পৃথিবীর সকল ভাষাতেই কোনো না কোনো সময় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কিন্তু আরবী ভাষা আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় রয়েছে অপরিবর্তনীয় ও অবিকৃত।
আমত্মর্জাতিক আরবী ভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট
এত সম্মান ও উচ্চাবস্থান থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে আরবী ভাষা ছিল অনেকটা অবহেলার স্বীকার। আন্তর্জাতিক সভা সেমিনার ও অধিবেশনগুলোতে অন্যান্য ভাষা ব্যবহার হলেও আরবীর কোনো স্থান ছিল না। তবে ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভার ২৮ তম অধিবেশনে আরবী ভাষাকে এর দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ২০১২ সালে জাতিসংঘের সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক অন্যতম সংস্থা (ইউনেসকো) সেই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৮ ই ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
পিছন ফিরে দেখা ইতিহাস
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর দাপ্তরিক ভাষা ছিল পাঁচটি। ইংরেজি, ফ্রান্স, চীন, রুশ ও স্প্যানিশ। আর বিশ্বের বিভিন্ন দিক থেকে বিশেষ ভূমিকা ও আরবী ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশী হওয়া সত্ত্বেও আরব নেতাদের আরবী ভাষা ব্যবহারের কোনো সুযোগ ছিল না। ভিনদেশী ভাষাতেই তাদের বক্তব্য প্রদান ও শ্রবণ করতে হতো। দাপ্তরিক কাগজপত্র আরবী থেকে অনুবাদ করে তা দাপ্তরিক ভাষায় উপস্থাপন করতে হতো। এ অবস্থা আরবদের জন্য ও বিশেষভাবে আরবী ভাষার জন্য ছিল লজ্জাজনক। তাই শুরু থেকেই আরব নেতারা এদিকে সজাগ ছিলেন। সর্বপ্রথম সাউদিআরব ও মরক্কো সরকার এবিষয়ে কথা বলেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে ৪র্থ ডিসেম্বর তাদের নবম অধিবেশনে ৮৭৮ নং প্রস্তাবে আরবী ভাষায় লিখিত অনুবাদ প্রকাশের বৈধতা প্রদান করে। এবং বছরে চার হাজার পৃষ্ঠা অনুবাদের একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সাথে সাথে এ শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, অনুবাদের ব্যয়কৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট দেশকে বহন করতে হবে এবং নথি ও কাগজপত্র আরব এলাকার রাজনৈতিক ও আইন বিষয়ক হতে হবে।
১৯৬০ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ‘‘ইউনেসকো’’ আরব দেশগুলোতে আরবী ভাষায় সভা সেমিনার ও জাতীয় সম্মেলন পরিচালনা এবং তাদের নিজস্ব নথিপত্র ও প্রচারপত্র আরবীতে প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১৯৬৬ সালে ইউনেসকোর সাধারণ সভাগুলোতে ভিন্ন ভাষা থেকে আরবী ভাষায় এবং আরবী ভাষা থেকে ভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পর্যায়ক্রমে ১৯৬৮ সালে অনুবাদের সাথে সাথে আরবী ভাষাকে ইউনেসকোর সাধারণ সভা ও কর্ম পরিষদের কার্যকরি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এই ধারাবাহিকতার সাথে সাথে আরব বিশ্বের কূটনৈতিক চাপ ও চেষ্টা অব্যাহত থাকে। এতে সাউদি ও মরক্কো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। শেষ পর্যন্ত তারা ১৯৭৩ সালে আরবী ভাষাকে জাতিসংঘের সাধারণ সভার মৌখিক ভাষা হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাতে সমর্থ হয়। পরবর্তীতে আরব লীগে তাদের ষাটতম অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, আরবীকে জাতিসংঘসহ তার অন্যান্য সংস্থাগুলোর দাপ্তরিক ভাষা করতে হবে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের ২৮ তম অধিবেশনে ৩১৯০ নং সিদ্ধান্তে আরবী ভাষাকে জাতিসংঘ ও তার সংশ্লিষ্ট সংস্থার দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
২০১২ সালের অক্টোবরে ইউনেসকোর নির্বাহী পরিষদের বৈঠকের ১৯০ তম অধিবেশনে ১৮ই ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস ঘোষণা করা হয় এবং এর পর থেকে সেই দিনটি ‘আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। আরবী ভাষা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে সাউদিসহ অন্য আরব দেশগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছে।
আমাদের করণীয়
এই লেখার মাধ্যমেই হয়তো অনেকে এ বিষয়টি জানবে যে, আরবী ভাষারও দিবস আছে এবং অন্যান্য দিবস পালনের মত এটিও হয়তো দিবস পালনে উদ্বুদ্ধ করার কোনো প্রয়াস। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে চাই, এই লেখা সেধরণের কোন উদ্দেশ্য প্রচার বা প্রসারের নিমিত্তে নয়। বরং এটি একটি তথ্য -যা আরব বিশ্বসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরবী ভাষাকে নিয়ে প্রচলিত, তা সবার গোচর করা। আর আমরা যেহেতু কুরআনের এই ভাষাকে ভালবাসি তাই এবিষয়ে একটু নতুন করে ভাবা। অথবা বলা যায় আরবী শেখার ক্ষেত্রে ‘তাজদীদুন নিয়্যাহ’ বা নিয়তের নবায়ন করা। এছাড়াও যে বিষয়গুলো আমাদের করণীয় তা হচ্ছে :
আরবী ভাষার খেদমতে সকলকে আত্মনিয়োগ করা এবং এক্ষেত্রে সকল প্রকার চেষ্টা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
জনসাধারণের হৃদয়ে আরবী ভাষার প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা।
মাদরাসার তালিবুল ইলমদের মাঝে আরবী ভাষা শেখার গুরুত্ব তুলে ধরা। এবং আরবী শেখার প্রতি সকলকে উদ্বুদ্ধ করা।
ছাত্রদের আরবী ভাষায় কথা বলায় অভ্যস্ত করা, আরবি ভাষায় লেখালেখি করার সুযোগ প্রদান করা।
আরবীকে শুধু কিতাব বুঝার জন্য না পড়ে জীবন্ত ও ব্যবহারিক ভাষা হিসেবেও শেখা।
উপরোক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে কিছু প্রস্তাবনা
সঠিকভাবে ভাষা শিক্ষা দিতে হলে ভাষা ও বিষয়ের সুসমন্বয় থাকা প্রয়োজন। তাই বেফাক ও সরকারী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের এ বিষয়ে নজর দেয়া দরকার।
আরবী ভাষা শিক্ষাদানে ভাষাবিজ্ঞাননির্ভর ও সুনির্ধারিত নিয়মকানুন মেনে বোর্ড কর্তৃক পুস্তক প্রণয়ন করা। এবং প্রত্যেকেই নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘‘ছাহেবে মানহাজ’’ না হয়ে আরবী ভাষায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ এমন ভাষাবিদ ও আদীবদের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ মানহাজ বা সিলেবাস প্রণয়ন করা।
ভাষাগত চারটি দক্ষতা (বলা, লেখা, পড়া এবং শোনা) পূরণে বর্তমানে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের দিক বিবেচনা করে একটি সুসমন্বিত পাঠ-উপকরণ তৈরী করা বেফাক ও সরকারি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবশ্যকরণীয় কাজ।
সহজে ছাত্রদের আরবী ভাষায় পারদর্শি করে তুলতে ‘‘পরিকল্পিত আরবী ভাষা পরিবেশ’’ সৃষ্টির করা।
আরবী ভাষা বিষয়ে পাঠদান হতে হবে আরবীতে। এর মাধ্যমে ছাত্ররা সার্বক্ষণিক আরবী ভাষা চর্চার সুযোগ পাবে।
লেখালেখির সাথে অভ্যস্ত করতে দেয়ালিকা, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশ করা ।
আরবী ভাষা শিক্ষাদানে নাহু-ছরফ-এর মত কথোপকথন ও ভাষাচর্চার কোর্স বা দাওরার ব্যবস্থা করা ।
মাদরাসায় ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে আরবী পরিভাষা ব্যবহার করা।
আরবী ভাষা শেখাবেন যে সকল শিক্ষক তাঁদের জন্য অভিজ্ঞ আরবী ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষাবিদদের মাধ্যমে ‘‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স’’ আয়োজন করা।
আরবী ভাষাকে নিয়ে আরবীতে সভা সেমিনার ও অনুষ্ঠান আয়োজন করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে কুরানের ভাষার খেদমতে কাজ করার তাওফীক দান করুন। সঠিক ও সুন্দরভাবে আরবী ভাষা শেখার তাওফীক দান করুন। এই ভাষার জন্য আমাদের সবধরনের প্রচেষ্ঠাকে আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমীন।