সফর ১৪৩৬   ||   ডিসেম্বর ২০১৪

মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদ-প্রসঙ্গ দায়িত্বশীলদের উপর ছেড়ে দিন-১৫

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

 

(পর্যালোচনা)

‘স্বওম ও ঈদ’-এর লেখক

মুহাম্মাদ ইকবালের কাছে কিছু প্রশ্ন (২)

১।  তার ঐ মতে হাদীসের অর্থ, সারা দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের জন্য একই দিনে রোযা ও ঈদ এবং কুরবানী করা ফরয। এদিকে আমরা দেখছি যে, তিনি নিজেই এই ফরয তরক করছেন। তো এই ফরয তরক করার ক্ষেত্রে তার শরীয়তসম্মত ওযর কী? আর যদি তিনি দাবী করেন, তিনি এই ফরয আদায় করছেন, অথচ বাস্তবে তিনি নিজ দেশের আগে করছেন- তবুও সকলের সাথে করা হচ্ছে না। আর যদি নিজ দেশের সঙ্গে করেন তবু সবার সাথে করতে পারছেন না। এরপরও যদি তার ফরয আদায় হচ্ছে বলা হয় তাহলে তো সব মানুষের  ফরযই আদায় হচ্ছে! তো এটা কেমন ‘একসাথে করা’ যে একসঙ্গে না করেও তা করা হয়ে যাচ্ছে?! শেষ পর্যন্ত এই ঐক্যের শরয়ী মানদ- কী? দয়া করে তিনি তার বিধি মোতাবিক জবাবে শুধু ‘মা আনযালাল্লাহ’ (কুরআন অথবা হাদীস) উল্লেখ করুন।

          ২। বইয়ের ১৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্বওলী হাদীস (যা তিনি বলেছেন) যখন ফে‘লী হাদীস (যা তিনি করেছেন) -এর বিপরীত হয় তখন ক্বওলী হাদীসই গ্রহণযোগ্য হয়। আর ফে‘লী হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য খাস হয়ে যায়।’

            প্রশ্ন হল, এই যে ‘শরয়ী হুকুমটি’(?) তিনি বয়ান করলেন এটা কুরআন মাজীদের কোন আয়াতের তরজমা কিংবা কোন সহীহ হাদীসে এর উল্লেখ আছে? নিজের পক্ষ থেকে একটি নীতি খাড়া করলেন আর তার ভিত্তিতে বহু সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এই বিধানকে অস্বীকার করে বসলেন যে, রমযানের চাঁদ এক সাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারাও প্রমাণিত হয়।

            যে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, দু’জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলে রোযা রাখ এবং রোযা ছাড়, সেখানে এই কথার উল্লেখ নেই যে, এক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করো না। উপরন্তু বহু ফে‘লী হাদীস দ্বারা রমযানের চাঁদের ব্যাপারে এক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণীয় হওয়া প্রমাণিত। এইসব হাদীস ঐ ক্বওলী হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়; বরং এখানে এমন বিধান পাওয়া যাচ্ছে, যে বিষয়ে ঐ ক্বওলী হাদীস নীরব। অতএব এখানে বিরোধ বা বৈপরিত্য দাঁড় করানোই ভুল।

          ৩। বইয়ের ১৬-২১ পৃষ্ঠায় কুরাইব রাহ.-এর বর্ণিত ঐ হাদীসের উল্লেখ রয়েছে, যেখানে কুরাইব আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-কে বলছেন, আপনি কি মুয়াবিয়া ও তার লোকদের দেখাকে যথেষ্ট মনে করেন না? তিনি উত্তর দিলেন,

لا، هكذا امرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم

            ‘না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এমনটিই আদেশ করেছেন’। এই হাদীস দূরদূরান্তের অঞ্চলের দেখা ধর্তব্য না হওয়ার দলিল। কিন্তু ইকবাল সাহেব এখানে এই বাহানা বের করেছেন যে, কুরাইব একা হওয়ায় ইবনে আববাস তার সাক্ষ্য গ্রহণ করেননি। হাদীসে দুই ব্যক্তির সাক্ষ্য দেওয়ার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ  করতে বলা হয়েছে, যা এখানে পাওয়া যায়নি। তার দাবী হল, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এমনটিই আদেশ করেছেন’ বলে এই হাদীসের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অথচ প্রথম কথা তো রমযান প্রমাণিত হওয়ার জন্য এক ব্যক্তির  সাক্ষ্যই যথেষ্ট, স্বয়ং আব্দুল্লাহ ইবনে আববাসের বর্ণিত হাদীস দ্বারা এই বিধান সাব্যস্ত। দ্বিতীয়ত, কুরাইব এখানে কেবল নিজে দেখেছেন এই খবর দেননি বরং শামে ব্যাপকভাবে সকলের দেখা এবং রমযান প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে আমীরুল মু’মিনীন হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর ফায়সালা ও সেই মোতাবেক সেখানে আমল করা হচ্ছে মর্মে সংবাদ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলের সিদ্ধান্ত পালনীয় হওয়ার জন্য তা কেবল একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির পৌঁছিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। ইকবাল সাহেব এ ক্ষেত্রেও যে একাধিক ব্যাক্তির শর্ত আরোপ করছেন এটা কিন্তু কোনো আয়াত কিংবা হাদীস দ্বারা তিনি প্রমাণ করতে পারবেন না। তৃতীয়ত, খোদ হাদীসের মূল পাঠ নিয়ে চিন্তা করুন, তাতেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।

            দেখুন, এখানে কুরাইব এ প্রশ্ন করেননি যে, আপনি কি আমার সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন না? যদি এমন প্রশ্ন করতেন আর এক ব্যক্তির সাক্ষ্য ইবনে আববাস গ্রহণ করবেন না এমন হত তাহলে তিনি বলতেন, তুমি একা আর আমাদের তো দুই ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।

            যেহেতু কুরাইবের প্রশ্ন এটা ছিল না তাই এমন উত্তরও আসেনি। তার প্রশ্ন তো বরং ছিল, ‘মুয়াবিয়া ও তার লোকজনের দেখাকে যথেষ্ট মনে করবেন না?’ এর উত্তর যা হওয়ার ছিল সে রকমই এসেছে। অর্থাৎ না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের এ আদেশই করেছেন।

            রইলো এ প্রশ্ন যে, এই আদেশ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন কোন হাদীসে? এর প্রথম উত্তর তো এই যে, রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা সাহাবীর এরকম বর্ণনা, যদিও তাতে সরাসরি তাঁর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়নি তথাপি এটি হাদীসেরই এক প্রকার, যা আপন স্থানে দলিলের মর্যাদা রাখে। তবে যেহেতু ইবনে আববাস রা. স্পষ্ট করে ঐ নববী ভাষ্যের উল্লেখ করেননি, তাই আমরা নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না যে, সেটা কোন ভাষ্য যার প্রতি তিনি ইঙ্গিত করেছেন। তবে কুরাইব নিজে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে এই হাদীসও রেওয়ায়েত করেছেন,

أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نصوم لرؤية الهلال ونفطر لرؤيته، فإن غم علينا أن نكمل ثلاثين.

            ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আদেশ করেছেন চাঁদ দেখে রোযা রাখতে এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়তে। আর যদি চাঁদ দৃষ্টি থেকে আড়াল হয়ে যায় তাহলে ত্রিশ পূর্ণ করতে।’ (আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী খ. ৪ পৃ. ২৪৭ এটি কুরাইবের সূত্রে মুহাম্মাদ ইবনে আবী হারমালার বর্ণনা, কুরাইব থেকে শামবাসীর দেখা সম্পর্কিত হাদীস মুহাম্মাদ ইবনে আবী হারমালাই বর্ণনা করেছেন।) এই বক্তব্য আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে কুরাইবসহ তার আরো অনেক শাগরেদ মারফুআন (সরাসরি রাসূলুল্লাহর হাদীস হিসেবে) বর্ণনা করেছেন। ইবনে দাকীকুল ‘ঈদসহ বহু ফকীহ ও মুহাদ্দিসের বক্তব্য এই যে, খুব সম্ভব আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ বলে এই হাদীসের দিকেই ইশারা করেছেন এবং তার মতে হাদীসের অর্থ এটাই যে, দূরবর্তী কোনো অঞ্চলের দেখা অন্য এলাকার জন্য যথেষ্ট নয়।

            যাইহোক, আমি বলতে চাচ্ছিলাম, ‘দু’জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলে রোযা রাখো’ এই হাদীস আমাদের অনুসন্ধান অনুযায়ী আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে আদৌ বর্ণিত নয়। তা সত্ত্বেও (কুরাইব ও তাঁর মধ্যকার আলাপে) তাঁর কথাকে সাধারণ ও পূর্বাপর সমর্থিত অর্থে না নিয়ে কেন এই হাদীসের সাথে জুড়ে দেয়া হবে? বিশেষত যখন তিনি নিজেই বর্ণনা করছেন রমযানের চাঁদ বিষয়ে শুধু একজন বেদুঈনের সাক্ষ্যও গ্রহণ করা সম্পর্কিত হাদীস। আর স্বভাবতই, এই হাদীস অনুযায়ীই তাঁর আমল ও ফতোয়া।

            অতএব যেদিক থেকেই চিন্তা করা হোক ইমাম নববী রাহ. ও ইমাম ইবনুত তুরকুমানী রাহ.-এর এই মন্তব্য খুবই সঙ্গত যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. মদীনায় অবস্থানকালে শামবাসীর দেখাকে গ্রহণ না করার কারণ এটা নয় যে, সাক্ষী এখানে একজন; বরং তা এজন্য যে, দূরবর্তী অঞ্চলের দেখা তার কাছে গ্রহণীয় নয়। (শরহে মুসলিম নববী খ. ৭ পৃ. ১৯৭; আল জাউহারুন্ নাকী আলাল বাইহাকী খ. ৪ পৃ. ২৫১)

            ভাই ইকবালের কাছে প্রশ্ন, হাদীসে কুরাইবের এই স্পষ্ট অর্থ বাদ দিয়ে ঐ দূরবর্তী ব্যাখ্যার পিছনে পড়ার কী দরকার ছিল?

          ৪। বইয়ের ৪৪ পৃষ্ঠায় যারা নিজ অঞ্চলের দেখা মোতাবিক আমল করে তাদের উপর এ আপত্তি  তোলা হয়েছে যে, আপনারা আরাফার রোযা  সৌদিয়ার চাঁদ দেখা অনুসারে কেন রাখেন, যদি আরাফার রোযা ওখানকার দেখা অনুসারে রাখতে পারেন তাহলে ওখানের দেখা অনুসারে কুরবানী এবং রোযা ও ঈদ কেন করতে পারবেন না?

            প্রশ্ন হল, আপনি কার কাছে শুনেছেন যে, আরাফার রোযা আমরা  সৌদিয়ার দেখা অনুযায়ী রাখছি? আমরা তো আরাফার রোযা নিজেদের দেখা অনুযায়ী যেদিন ৯ যিলহজ হয় সেদিন রাখছি! তবে যেহেতু যিলহজের প্রথম নয় দিনের প্রত্যেক দিনেই নফল রোযা রাখা যায়, সেজন্য কেউ কেউ নয় তারিখের সাথে আট তারিখের রোযাও রাখেন। কেউ আরো বেশি রাখেন। কিন্তু এই মাযহাবের লোকেরা এখানের ৯ যিলহজকে এখানকার মানুষের জন্য পুরোপুরি সঠিক এবং উপযুক্ত মনে করে। আমার জানা নেই, কোত্থেকে আপনার এই ভুল ধারণা জন্মালো যে, ৯ যিলহজের রোযা আমরা সৌদিয়ার দেখা অনুসরণ করে রাখছি!

            ভাই ইকবাল! আপনি নিজের ফতোয়া তো বই আকারে আমাদের মাঝে বিলি করছেন, কিন্তু মনীষী আলিমদের কোনো ফতোয়া আপনি একদমই উল্লেখ করছেন না। তারপরও যদি মন চায় তাহলে আলকাউসার রজব ১৪৩৫ হিজরী সংখ্যায় শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছালেহ উসাইমীন-এর ফতোয়া এক নযর দেখতে পারেন। তিনি ঢাকায় অবস্থানকারী সউদী নাগরিকদের এ ফতোয়া দিয়েছেন যে, তাদের ইয়াওমে আরাফা হল সেটি, যখন এখানে ৯ যিলহজ হবে। শায়খ উসাইমীনের ফতোয়ার চেয়ে আপনার ফতোয়া অগ্রগণ্য হবে কী কারণে বলুন তো?

          ৫। জনাব ইকবাল তার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন যে, সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াত অনুযায়ী সকল মতবিরোধ মিটাতে হবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ব্যাখ্যার আলোকে, কোনো আলিমের ফতোয়ার আলোকে নয়। প্রশ্ন হল, আল্লাহ তাআলা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাখ্যা দ্বারা কী উদ্দেশ্য? তাঁদের ব্যাখ্যা আমরা কোথায় পাবো?

          ৬। ভূমিকার শেষে তিনি লিখেছেন, ‘তাই কোন ভাইয়ের যদি মনে হয় যে, আমার উদ্ধৃতির কোন ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে তাহলে অনুগ্রহ করে দলিলভিত্তিক শোধরিয়ে দিবেন’।

            প্রথম সংস্করণে লিখেছিলেন, ‘... তাহলে দয়া করে কুরআন এবং সহীহ হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে শোধরিয়ে দিবেন।’

            এখানে প্রথম প্রশ্ন হল, তার ভূমিকার আলোচনা অনুযায়ী তার বইতে তো কুরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো কিছু থাকারই কথা নয়। এমনকি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আয়াত তো তিনি আল্লাহ ও রাসূলের ব্যাখ্যা থেকেই নিবেন। যদি তাই হয় তাহলে এতে কোনোরকম ভুল-বিচ্যুতি পাওয়াই তো অসম্ভব! আর যদি তিনি নিজের বুঝ ও মতামতের ভিত্তিতে সে সবের ব্যাখ্যা করে থাকেন তাহলে তার ভূমিকায় উল্লিখিত নীতিমালার বরখেলাফ তিনি কেন করলেন?

            দ্বিতীয় প্রশ্ন, নতুন সংস্করণে ভাষা পরিবর্তন করে কুরআন-হাদীসের জায়গায় ‘দলিল’ শব্দ ব্যবহারের রহস্য কী, তিনি তা বলবেন কি?

          ৭। সর্বশেষ প্রশ্নের সম্পর্ক ঐ আলোচনার সাথে যার শিরোনাম: চর্মচোখে বা প্রযুক্তি দিয়ে চাঁদ দেখা উভয় মাধ্যমই শারী’আহ্’তে বৈধ। (প্রথম সংস্করণ পৃ.৯, দ্বিতীয় সংস্করণ পৃ.৭) প্রথম সংস্করণে বলা হয়েছিল, দূরবীন কিংবা টেলিস্কোপ দিয়ে দেখা খালি চোখে দেখার মতই, অর্থাৎ এর মাধ্যমেও চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হবে। এই বক্তব্য সঠিক ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে কথাটি ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং তার পরিবর্তে জ্যোতির্বিদ্যার হিসাবের প্রসঙ্গটি যোগ করা হয়েছে। পরিষ্কার করে কিছু লেখেননি কিন্তু পূর্বাপর দেখে বুঝা যায়, তিনি এটাই বলতে চান যে, জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব দ্বারা আকাশে চাঁদের উপস্থিতির কথা জানাই নতুন চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যেন জ্যোতির্বিদ্যার হিসাবের মাধ্যমে চাঁদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানা চাক্ষুষ দেখারই বিকল্প! জানা কথা, এই দাবী সুন্নাতে নববী ও সালাফের ইজমার (সম্মিলিত সিদ্ধান্তের) পরিপন্থী এবং হাদীসে রোযাকে যে চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে- হিসাবের সাহায্যে চাঁদের উপস্থিতি জানাকে সেই দেখার অন্তর্ভুক্ত করা হাদীসের সরাসরি বিকৃতি।

এখানে এ বিষয়ে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এতটুকু বলতে চাচ্ছি যে, গ্রন্থকার ইজমা পরিপন্থী এই মতবাদকে প্রমাণ করার জন্য অদ্ভুত-উদ্ভট আলোচনার অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেছেন:

            ‘এখানে আরবী শব্দ ‘رأيتم রআইতুম’ শব্দটির মাসদার (মূলশব্দ) ‘ رؤية রুইয়াতুন’ যার অর্থ দেখা। এই ‘ رؤية রুইয়াতুন’ (দেখা) দিয়ে অনেকেই বুঝেছেন সরাসরি চর্মচোখে দেখা, আসলে তাদের দাবী মোটেই সঠিক নয়। কারণ, রুইয়াতুন শব্দটি দ্বারা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির মাধ্যমেও দেখতে বলা হয়েছে।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا...

            ‘কাফিররা কি দেখে না যে, আকাশ এবং পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল। অতপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম...।’-সূরা আম্বিয়া, আয়াত:৩০

এই আয়াতে ‘ير ইয়ারা’ শব্দটিও ‘رؤية রুইয়াতুন’ মাসদার থেকে এসেছে, যার অর্থ দেখা। কিন্তু এখানে আল্লাহ ‘ير ইয়ারা’ শব্দটি দিয়ে সরাসরি চক্ষু দিয়ে দেখতে বলেননি। কারণ শুধুমাত্র চর্মচোখ দিয়ে আকাশ এবং পৃথিবী মিশে ছিল তা দেখা সম্ভব নয়। আর এই দেখাটা আল্লাহ বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মাধ্যমে দেখতে বলেছেন। বিজ্ঞানের বিগ ব্যাংগ আবিষ্কারের আগে কেউ আকাশ এবং পৃথিবী যে ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল তার প্রমাণ পায়নি। বিজ্ঞানের বিগ ব্যাংগ আবিষ্কারের পরে মানুষ তা জানতে পেরেছে। এতএব রুইয়াতুন শব্দটি দ্বারা শুধুমাত্র চর্মচোখ দিয়ে দেখতে হবে তা সঠিক নয় বরং দেখা শুধু চোখ দিয়েও হতে পারে আবার প্রযুক্তির মাধ্যমেও হতে পারে।’ (‘স্বওম ও ঈদ’ পৃ. ৭, ২য় সংস্করণ) সামনে গিয়ে ৯ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন :

‘অতএব, প্রযুক্তির মাধ্যমেও নতুন চাঁদের হিসেব করা শরী‘আতে বৈধ।’

            ‘প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখা’ বলতে তিনি এটা বুঝাননি যে, দূরবীন এবং টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখা যাবে। এমনটি তিনি প্রথম সংস্করণে বলেছিলেন এবং তা সঠিক ছিল। কারণ তা চোখে দেখারই একটি প্রকার। কিন্তু প্রযুক্তিগত মাধ্যম বলে এখানে তার উদ্দেশ্য, জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব। অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের সাহায্যে চাঁদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানাটাও চাঁদ দেখারই শামিল। আমার জানা নেই, হিসাব কবে থেকে প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত হল এবং হিসাবের মাধ্যমে কোনো বস্তুর জ্ঞান লাভ করা সেই বস্তুকে দেখার সমার্থক হল কী করে? রুইয়াত শব্দ কখনো কখনো ‘জানা’র অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এটা ঠিক। কিন্তু এ কারণে এটা বৈধ হয় কীভাবে যে, যে স্থানে রুইয়াত -এর অর্থ ‘দেখা’ সেখানে আপনি তাকে ‘জানা’ অর্থে ব্যবহার করতে শুরু করবেন? যেমন সালাতের এক অর্থ নামায। এক অর্থ দরূদ। এখন যদি কেউ বলে, أقيموا الصلاة -এর অর্থ এটা নয় যে, নামায কায়েম করো; বরং এর অর্থ হল, দরূদ কায়েম করো। অতএব দৈনিক দরূদের মজলিস কায়েম করতে থাকো, নামায পড়ার দরকার নেই...। যদি কেউ এরকম বলে তাকে আপনি কী বলবেন? কোনো শব্দ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হলে সেক্ষেত্রে করণীয় হল, শব্দটি যেখানে যেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে সেই অর্থই উদ্দেশ্য নেওয়া। একটির জায়গায় অন্যটি গ্রহণ করা বিকৃতিরই নামান্তর।

হাদীসে যে ইরশাদ হয়েছে,

صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته

            এখানে রুইয়াতের অর্থ চাঁদকে দেখা। হিসাবের সাহায্যে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা উদ্দেশ্য নয়। যদি অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা উদ্দেশ্য হত

 فإن غم عليكم فأكملوا العدة ثلاثين -

            এর  কোনো অর্থ থাকত না। কারণ চাঁদ দৃষ্টি থেকে আড়াল হতে পারে, কিন্তু তার অস্তিত্ব হিসাবভিত্তিক জ্ঞানের অগোচর থাকতে পারে না। অতএব হাদীসের পূর্বাপর এখানে রুইয়াতের অর্থ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। উপরন্তু এই অর্থ সালাফের ইজমা এবং ধারাবাহিক কর্মতৎপরতার মাধ্যমেও প্রমাণিত। আর যেমনটি আহলে ইলম জানেন, আরবী ভাষার ব্যাকরণের দিক থেকে এখানে ‘জানা’ অর্থ উদ্দেশ্য হতে পারে না। অতএব ভাই ইকবালের এই লেকচার একবারেই অপ্রাসঙ্গিক। হায়! যদি তিনি একটি মুতাওয়াতির সুন্নত, যার অর্থও মুতাওয়াতির- তার বিকৃতি সাধনে না জড়াতেন!

            কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম, এই বিকৃতির সমর্থনে ইকবাল সাহেব যে সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেছেন এবং তাকে কতিপয় বিজ্ঞানীর দয়া-দক্ষিণার উপর ছেড়ে দিয়েছেন- এটা করে তিনি গুরুতর ভুল করেছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি,

            (ক) যদ্দুর আমরা শুনেছি, বিগ ব্যাংগ দর্শন বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯২৯ সালের আগে সম্ভবত এর কোনো আলোচনাই ছিল না। অথচ আপনি কিনা বলছেন, বিগ ব্যাংগ আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ জানতে পেরেছে, আকাশ ও পৃথিবী  ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল। যদি তাই হবে, তাহলে সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াত (আপনি যার গলদ ব্যবহার করেছেন) -এর ব্যাখ্যায় খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রথমার্ধের লোকজন থেকে এ বর্ণনা কীভাবে পাওয়া গেল যে, আসমান ও যমীন প্রথমে পরস্পর মিলিত ছিল। তারপর আল্লাহ তাআলা দুটোকে পৃথক করে দিয়েছেন। তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে কাবীর ইত্যাদিতে এই আয়াতের তাফসীর একটু দেখুন।

            ইমাম আবু জাফর তবারী (৮৩৯-৯২৩ খৃ.) সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. (৬১৯-৬৮৭ খৃ.), তাবেয়ী হাসান বসরী (৬৪২-৭২৮ খৃ.) এবং তাবেয়ী কাতাদাহ (৬৮০-৭৩৬ খৃ.) থেকে পৃথক পৃথক বর্ণনায় উদ্ধৃত করেছেন, এঁরা সবাই বলেছেন, আসমান ও যমীন মিলিত ছিল। আল্লাহ তাআলা একটিকে অপরটি থেকে আলাদা করে দিয়েছেন। (তাফসীরে তবারী ২১:৩০-এর অধীনে খ.১৬, পৃ. ২৫৫-২৫৭)।

            সন্দেহ নেই, আয়াতে কারীমার এই অর্থ চূড়ান্ত নির্ধারিত নয়। এর অন্য ব্যাখ্যাও আছে। কিন্তু সপ্তম শতাব্দীর ঐ মহান ব্যক্তিদের থেকে এ বিষয়ের বর্ণনা পাওয়া সত্ত্বেও ইকবাল সাহেবের এটা বলা কী করে ঠিক হয় যে, বিগ ব্যাংগ দর্শনের বদৌলতেই মানুষ একথা জানতে পেরেছে,  আকাশ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল।

(খ) আল্লাহ তাআলার ইরশাদ:

أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا...

-এর অর্থকে যে সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞানের বিগ ব্যাংগ দর্শনের দয়া-দক্ষিণার উপর ছেড়ে দিলেন এবং আপনার বইয়ের নবম পৃষ্ঠায় বললেন, আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে কাফিরদেরকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার মাধ্যমে এই বাস্তবতায় উপনীত হতে বলেছেন  (যে, আকাশ ও পৃথিবী পরস্পর মিলিত ছিল), তো প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ সময়ের কাফিরদের জন্য এটা সাধ্যাতীত বিষয়ের নির্দেশ দেওয়ার মতো নয় কি? আর এই দর্শন আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত যেহেতু আপনার দাবি অনুযায়ী এই আয়াতের মর্মই অজানা ছিল, তো এতে করে কুরআনের উপর কি এক ধরনের আপত্তি তোলা হয় না? খোদার বান্দা! একটু দেখে তো নিতেন যে, আহলে ঈমান এই

আয়াত থেকে কী বুঝেছেন এবং কী শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। যে সব আয়াতে কাফিরদের সম্বোধন করা হয়েছে সেসব আয়াত বুঝা ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা কি শুধু কাফিরদের কাজ?!

            (গ) ভাই ইকবালের বর্ণনাভঙ্গি থেকে মনে হয়, বিগ ব্যাংগ দর্শনের আবিষ্কারের ফলে আল্লাহ তাআলার ঐ নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়েছে যা তিনি আরবের উম্মী কাফিরদের উদ্দেশ্যে দিয়েছিলেন। ভাই ইকবাল কি একটুও চিন্তা করেছেন, এই দর্শনকে যা কুরআন সুন্নাহয় উল্লেখিত আসমান যমীনের সৃষ্টির বিবরণের সাথে অসামঞ্জস্যশীল, এবং যার আবিষ্কারকগণও স্রষ্টাকে অস্বীকার করে সেই দর্শনকে আল্লাহ তাআলার নির্দেশের বাস্তবায়ন বলা কি উচিত?

            (ঘ) যতদূর আমরা জেনেছি, কুরআন ও সুন্নাহয় যেই সপ্ত আকাশ

 سَبْعَ سَمَوَاتٍ طِبَاقًا ’’ -এর উল্লেখ রয়েছে বিজ্ঞানীরা সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। তারা হয়ত তা অবিশ্বাস করেন কিংবা এ বিষয়ে নীরব। এমতাবস্থায় তাদের আবিষ্কৃত এই দর্শনের উপর ভরসা করে কুরআনে উল্লিখিত আসমান ও যমীনের পরস্পর মিলিত থাকার বিষয়কে ব্যাখ্যা করা; বরং তাকে সরাসরি এই দর্শনের প্রয়োগ সাব্যস্ত করা কীভাবে সঙ্গত হয়? তদুপরি এটা তো যদ্দুর জানতে পারলাম এখন পর্যন্ত একটা Theory মাত্র, প্রতিষ্ঠিত সত্য (Law) -এর মর্যাদা তা এখনো লাভ করেনি। তা সত্ত্বেও এর উপর এই পরিমাণ ভরসা ও নির্ভরতা!!

(ঙ) ভাই মুহাম্মাদ ইকবাল! ‘মা আনযালাল্লাহ’ (আল্লাহর নাযিলকৃত ওহী) কে ‘রিজালুল্লাহ’র শরণাপন্ন না হয়ে নিজে নিজে পড়া বা বুঝার চেষ্টা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যার শুরু আত্মপ্রবঞ্চনা আর শেষ হল বিচ্ছিন্নতা। আর বিচ্ছিন্নতা অবলম্বনের ফলও ‘বিচ্ছিন্নতা’। আল্লাহ তাআলা আপনাকে এবং আমাদের সবাইকে সব ধরনের বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করুন। আমীন!

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement