মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদ-প্রসঙ্গ দায়িত্বশীলদের উপর ছেড়ে দিন-১৪
(পর্যালোচনা)
(৬) একই দিনে সকল মুসলিমকে অবশ্যই স্বওম (রোজা) ও ঈদ পালন করতে হবে
মুহাম্মাদ ইকবাল বিন ফাখরুল
বাক্কাহ ডিটিপি হাউজ, ২৯/৪, কে. এম. দাস লেন, টিকাটুলী, ঢাকা
(প্রথম প্রকাশ, রমযান ১৪৩৩ হি. আগস্ট ২০১২ ঈ., দ্বিতীয় সংস্করণ, শা‘বান, ১৪৩৪ হি. জুন ২০১৩ ঈ.)
গ্রন্থকার বইয়ের ১৯-২০ পৃষ্ঠায় (দ্বিতীয় সংস্করণ অনুযায়ী পৃ. ৪০) ‘একই দিনে স্বওম (রোজা) এবং ঈদ পালন করা ফার্জ’ শিরোনামাধীন আলোচনায় পরিষ্কার লিখেছেন-
১। একই দিনে স্বওম ও ঈদ পালন করা ফার্জ।
২। ভিন্ন ভিন্ন দিনে স্বওম ও ঈদ পালন করলে একটি বা দুটি স্বওম ছুটে যায়।
৩। একই দিনে স্বওম পালন না করলে হারাম দিনে স্বওম পালন হয়ে যায়। অর্থাৎ ঈদের দিন স্বওম পালন করা হয়।
৪। ভিন্ন ভিন্ন দিনে স্বওম বা ঈদ উদযাপন করলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়।
৫। ভিন্ন ভিন্ন দিনে স্বওম ও ঈদ পালন করার বিধান একটি বিদআহ।’
এ বিষয়ে আমরা ভাই মুহাম্মাদ ইকবাল সাহেবকে বিনয়ের সাথে বলতে পারি, আপনি আপনার পুস্তিকার ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় ছাড়া অন্য কিছু মান্য করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَأَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ ‘আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করেছেন কিতাব (কুরআন) এবং হিকমাহ (হাদীস)...’ সূরা নিসা ৪ : ১১৩
এই আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তিনি নাযিল করেছেন কুরআন এবং হাদিস। তাই আমি এই বইয়ে কুরআন এবং গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হাদিসের উদ্ধৃতি ছাড়া কোনো আলিমের ফাতওয়া নিয়ে আলোচনা করিনি।’
আপনার এই ঘোষিত নীতিমালার আলোকে আমাদের বলুন, আপনার উপরিউক্ত পাঁচটি কথা কোন আয়াতে বা কোন হাদীসে আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন? আপনি শুধু আয়াত কিংবা হাদীস লিখে দেন। বেশির বেশি তরজমা করতে পারেন। ব্যস্, শুধু আয়াত কিংবা হাদীস শুনেই যেন এই পাঁচটি বিষয় আমরা পেয়ে যাই। আপনি নিজের বুঝ ও নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে উক্ত আয়াত কিংবা হাদীসের ব্যাখ্যা করবেন না। কারণ সেটা তো হবে আপনার ব্যাখ্যা, সেটা ‘আল্লাহর নাযিলকৃত’ হবে না। তেমনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঐ আয়াত বা হাদীস থেকে কোনো বিধানও আহরণ করতে পারবেন না। কেননা সেটা তো হবে আপনার ফতোয়া। আর যখন স্বীকৃত ফুকাহা (ফিকহ্বিশারদ আলিমগণ), যারা কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ব্যাপারে স্বয়ং শরীয়তের পক্ষ থেকে আদিষ্ট- তাদের ফতোয়া আপনি উল্লেখ করেননি, তো নিজের ফতোয়াই বা কেন উল্লেখ করবেন?
ভাই ইকবালের কাছে দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি একই দিনে রোযা ও ঈদ পালন করাকে ফরয বলেছেন, কিন্তু এই ফরয তো আপনারও ছুটে যাচ্ছে। কারণ সকল মুসলমান একই দিনে রোযা আরম্ভ করছে না এবং ঈদও করছে না। আপনি এক অঞ্চলের মুসলমানদের সাথে রোযা শুরু করছেন তো অন্যেদের সাথে করা হচ্ছে না। কারো সাথে ঈদ করছেন তো আপনার ঈদ হয়ে যাচ্ছে অন্য কারো রোযার দিনে! একই দিনে তো আপনারও হচ্ছে না, অন্যদেরও না। তাহলে ফতোয়া অনুযায়ী আমল করার কী উপায় আপনি চিন্তা করেছেন? এ বিষয়ে তো আপনার লেখা বিলকুল খামোশ! আপনি এবং আপনার সমমনা আরো যারা এই ফরযটি পরিত্যাগ করে চলেছেন; এই ফরয তরক করার কারণে আপনাদের প্রতি শরয়ীভাবে কী উপাধি প্রযুক্ত হচ্ছে, তা কি ভেবেছেন?!
আপনি দয়া করে নিমেণ বর্ণিত বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করুন:
(ক) বিদআত বলা হয় প্রত্যেক ঐ নতুন জিনিসকে, যাকে শরয়ী দলীল-প্রমাণ ছাড়াই দ্বীনের অংশ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এখন এটা তো প্রত্যক্ষ বিষয় যে, প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষ নিজ নিজ দেখা মোতাবেক আমল করাই প্রাচীন ও অনুসৃত ধারা, যা আহদে রিসালাত ও খায়রুল কুরূন তথা নবী-যুগ ও মুসলিম উম্মাহর প্রথম তিন প্রজন্ম থেকে ধারাবাহিক চলে আসছে। অন্যদিকে একই দিন রোযা ও ঈদ করার চিন্তাটিই নতুন, যার বয়স ষাট-সত্তর বছরের বেশি নয়। অতএব বিদআত বলতে হলে একই দিন রোযা ও ঈদ পালনকে জরুরি সাব্যস্ত করা এবং একে দ্বীনী বিধান আখ্যায়িত করাকেই বিদআত বলা উচিত। কিন্তু ইকবাল সাহেব প্রাচীন ও অনুসৃত একটি কর্মকে তো বিদআত বলে দিলেন, অথচ নবোদ্ভাবিত একটি মত বা চিন্তাকে বলছেন ফরয!!
ভাই ইকবাল! আপনার মতো কিছু গবেষক যদিও বলেছেন, পুরনো ও ধারাবাহিক অনুসৃত আমলটি ছিল অপারগতাবশত, কিন্তু এ বিষয়ে সকলেই একমত যে, প্রাচীন ও অনুসৃত ঐ আমলটি একই দিনে রোযা ও ঈদ করা নয়; বরং তা হচ্ছে প্রত্যেকের নিজ অঞ্চলের দেখা মোতাবিক আমল। তো ‘নতুন’কে বাদ দিয়ে প্রাচীন ও অনুসৃত ধারাকে বিদআত বলা কোন যুক্তিতে, কিসের ভিত্তিতে?
থাকলো এ বিষয়টি যে, প্রাচীন ও অনুসৃত আমলটি ওযরবশত ছিল, নাকি এজন্য যে, এটাই শরীয়তের মানশা বা ইচ্ছার অনুকূল-সেটা ভিন্ন কথা। এ বিষয়ে কিছু আলোচনা আগেও হয়েছে। আর কিছু সামনেও হবে, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আপাতত ভাই মুহাম্মাদ ইকবালের কাছে আমার দরখাস্ত, যেহেতু তিনি প্রত্যেক অঞ্চলের লোকদের নিজ নিজ দেখা মোতাবেক রোযা ও ঈদ পালনকে বিদআত বলছেন, তো দয়া করে তিনি বলে দিন, কে কবে এবং কোথায় এই বিদআত আবিষ্কার করেছেন? কোন সাল থেকে এই বিদআতের সূচনা? ভুল বলারও তো একটা সীমা থাকা উচিত! খোদ যেটা নতুন সেই চিন্তাকে সমর্থন করতে গিয়ে তাকে ফরয বানিয়ে দিচ্ছেন, এদিকে প্রাচীন ও অনুসৃত ধারা অনুযায়ী আমলকারীদের বিদআতে লিপ্ত বলে অপবাদ দিচ্ছেন! নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক।
(খ) তাহলে তো ইকবাল বিন ফাখরুল সাহেব বলতে চান, খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন এবং তাদের পরবর্তীগণ সবাই বিদআতের চর্চা করে গেছেন আর সুন্নতের উপর আমল শুরু হয়েছে তাদের সহস্র বছরেরও বেশি সময় পর, এই এখন! সুন্নত ও বিদআতের এক আশ্চর্য ইতিহাস এবং আশ্চর্য মাপকাঠি ইকবাল সাহেবের বদৌলতে আমাদের সামনে এল! অর্থাৎ খাইরুল কুরূন (মুসলিম উম্মাহর প্রথম তিন প্রজন্ম)-এর কর্মধারা, যা স্বয়ং সুন্নত সমর্থিত ও সর্বজনস্বীকৃত সুন্নতের মাপকাঠি সেটা তো বিদআত। আর পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত মতটিই হচ্ছে সুন্নত! তাও আবার সুন্নতের সাধারণ স্তর নয়, একেবারে ফরয পর্যায়ের!! মুসলিম উম্মাহর প্রথম তিন প্রজন্মের অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গ ও তাদের উত্তরসূরীরা হল বিদআতপন্থী, আর নবী-যুগ থেকে প্রায় দেড় হাজার কাল পরের বিচ্ছিন্নতা অবলম্বনকারী কিছু লোকজন হল গিয়ে সুন্নতপন্থী!! নাউযুবিল্লাহ।
(গ) আফসোস শুধু একারণে নয় যে, এখানে একটি অনুসৃত ধারাকে বিদআত এবং না-জায়েয বলা হচ্ছে। অথচ একটি নবোদ্ভূত পন্থাকে (যা এখন পর্যন্ত নিছক একটি মতবাদ, যাকে বাস্তবে রূপ দেয়া যায়নি এবং যেটাকে ফিকহে ইসলামীর আলোকে, শর্তসাপেক্ষে ও উলুল আমর তথা দায়িত্বশীল উলামা ও উমারাদের নির্দেশ মেনে করা হলে বেশির বেশি মুবাহ বলা যেতে পারে) বলা হচ্ছে ফরয। বরং আফসোসের আরো বড় কারণ, এই বিকৃতি সাধন করা হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দোহাই দিয়ে এবং তাকে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে সরাসরি ‘আল্লাহর নাযিলকৃত’ বলে!!
(ঘ) এই আল্লাহর বান্দাদের যদি নিছক তরজমা নির্ভর কিংবা ব্যক্তিগত পড়াশোনা নির্ভর জ্ঞানের ওপর ভরসা করে ইজতিহাদ করতেই হত তাহলে প্রথমে তাদের ভাবা উচিত ছিল, কুরআন-হাদীসের প্রাজ্ঞ ব্যক্তি এবং তার বিধান অনুসারে আমল করার মত মানুষ তো প্রত্যেক যুগেই ছিল। আর এতেও সন্দেহ নেই যে, মুসলিম উম্মাহর প্রথম তিন প্রজন্মের লোকেরা কুরআন-হাদীস বোঝা ও তার বিধান অনুযায়ী আমল করার ক্ষেত্রে পরবর্তীদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর ছিলেন। এমতাবস্থায় এটা কেমন কথা যে, সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা এবং তা ফরয হওয়াকে আমরা তো সরাসরি রাসূলের নির্দেশ সাব্যস্ত করছি, অথচ গোটা দেড় সহস্রাব্দ কালের মধ্যে কোনো একজন ফকীহের যবানে কিংবা তাফসীর, হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও ফিকহ-ফতোয়ার হাজারো কিতাবের কোনো একটিতে, কোথাও এ কথার উল্লেখ নেই! এমনটি কেন হল? কেন হবে? তবে কি পূর্ববর্তীরা কুরআন-হাদীস বুঝতেন না, নাকি তাদের মধ্যে সত্যপ্রকাশের আগ্রহ বা সৎসাহস ছিল না?
ভাই ইকবাল যদি বিষয়টা এভাবে চিন্তা করতেন তাহলে এ বিষয়ে তার ধারণা যে নিছক খেয়ালি মনের ভাবনা, তা সহজেই ধরতে পারতেন।
এবার লক্ষ্য করুন, কোন দলীলের ভিত্তিতে তিনি এই নতুন তরিকা ও নবোদ্ভূত পন্থাকে ফরয সাব্যস্ত করছেন। সুধী পাঠকের হয়ত স্মরণ আছে যে, মুসলমানদের শাসক, উলামায়ে কেরাম এবং সর্বসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারো জন্য রোযা আরম্ভ করা জায়েয নেই। যেমন জায়েয হবে না আগেভাগে নিজে ঈদ করা। উম্মাহর ফকীহগণ এই মাসআলাটি যে হাদীস থেকে বুঝেছিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে মুহাম্মাদ ইকবাল সাহেব ঐ হাদীসের উপরেই এই নতুন অর্থ চাপিয়ে দিয়েছেন যে, এতে নাকি সকল মুসলমানকে একই দিন রোযা ও ঈদ পালনকে ফরয বলা হয়েছে! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি লিখেছেন,
‘আয়েশাহ রা. থেকে বর্ণিত:
قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : الفطر يوم يفطر الناس والاضحى يوم يضحي الناس
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈদুল ফিতর হলো ঐ একদিন যেদিন সকল মানুষ ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করে থাকে এবং ঈদুল আযহা হচ্ছে ঐ একদিন যেদিন সকল মানুষ ঈদুল আযহা পালন করে থাকে’। -তিরমিযী, স্বহীহ, অধ্যায় : ২, কিতাবুস্ স্বওম, অনুচ্ছেদ : ৭৮ (ঈদুল) ফিতর এবং (ঈদুল) আযহা কখন হবে, হাদিস # ৮০২
এই হাদীসে ‘يَوْمَ ইয়াওমা’ শব্দটি একবচন, যার অর্থ একদিন। আর النَّاسُ আন্নাসু’ শব্দটি ‘انْسَانٌ ইনসান’ শব্দের বহুবচন হওয়ায় সকল মানুষ তথা সকল মুসলিমদের বুঝানো হয়েছে।’
তিনি আরো লিখেছেন,
‘অর্থাৎ হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, সকল মানুষ (মুসলিম) একই দিনে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা (কুরবানীর ঈদ) পালন করবে। যদি ভিন্ন-ভিন্ন দিনে ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহা পালন করা শরী‘আহ’র বিধান হত তাহলে রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘يَوْمَ ইয়াওমা’ শব্দটি অর্থাৎ একবচন-এর পরিবর্তে ‘أَيَّامَ আইয়্যামা’ বহুবচন ব্যবহার করতেন। কিন্তু রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘يَوْمَ ইয়াওমা’ শব্দটি একবচন ব্যবহার করার মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন যে, সকল মুসলিমকে একই দিনে ঈদ পালন করতে হবে।’
আরো লিখেছেন,
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত,
أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: الصوم يوم تصومون، و الفطر يوم تفطرون، والاضحى يوم تضحون
নিশ্চয়ই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যেদিন তোমরা স্বওম (রোজা) পালন কর সেদিন হল স্বওম আর যেদিন তোমরা ফিতর (ঈদুল ফিতর) পালন কর সেদিন হল ফিতর (ঈদুল ফিতর), যেদিন তোমরা কুরবানী (ঈদুল আযহা) পালন কর সেইদিন আযহা (ঈদুল আযহা)’ -তিরমিযী, স্বহীহ, অধ্যায়ঃ ২, কিতাবুস স্বওম (রোজা), অনুচ্ছেদঃ ১১, যেদিন তোমরা স্বওম পালন কর সেদিন হলো স্বওম আর যেদিন তোমরা ফিতর পালন কর সেদিন হলো ফিতর, যেদিন তোমরা কুরবানী পালন কর সেইদিন আযহা, হাদীস # ৬৯৭, ইবনু মাজাহ, স্বহীহ, অধ্যায়ঃ ৭, কিতাবুস স্বিয়াম, অনুচ্ছেদঃ ৯, ঈদের মাস, হাদিস # ১৬৬০, বায়হাক্বী (সুনানুল কুবরা), স্বহীহ, অধ্যায়ঃ কিতাবুস স্বওম, অনুচ্ছেদঃ ৬৭, হাদীস # ৮৬০৮ (হাদীসটি তিরমিযীর বর্ণনা)।
‘এই হাদীসেও পূর্বের হাদীসের মতো ‘يَوْمَ ইয়াওমা’ একবচন শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। আর ‘يَوْمَ ইয়াওমা’ দিয়ে একদিনকে বুঝানো হয়, যা পূর্বে হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। আর হাদীসটিতে আরবী শব্দ ‘تصومون তাসুমূনা’ তোমরা স্বওম পালন কর, ‘تفطرون তুফত্বিরূনা’ তোমরা ফিতর (ঈদুল ফিতর) পালন কর, ‘تضحون তুদ্বাহহূনা’ তোমরা কুরবানী (ঈদুল আযহা) পালন কর। এখানে ‘তোমরা’ সর্বনামটি উহ্য রয়েছে। এই ‘তোমরা’ শব্দটি দ্বারা সকল মুসলিমগণকে বুঝানো হয়েছে।’
একটু পরে লিখেছেন,
‘অর্থাৎ রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝাচ্ছেন যে, একই দিনে সকল মুসলিমকে স্বওম ও ঈদ উদ্যাপন করতে হবে। যদি ভিন্ন-ভিন্ন দিনে স্বওম ও ঈদ পালন করা ইসলামের বিধান হতো তাহলে রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘يَوْمَ ইয়াওমা’ একবচন শব্দ ব্যবহার না করে ‘أَيَّامَ আইয়্যামা’ বহুবচন শব্দ ব্যবহার করতেন। কিন্তু রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘يَوْمَ ইয়াওমা’ একবচন শব্দ ব্যবহার করে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, সকল মুসলিমগণকে একই দিনে স্বওম এবং ঈদ পালন করতে হবে।’ [স্বওম ও ঈদ মুহাম্মাদ ইকবাল বিন ফাখরুল : পৃ. ১৩,১৪-১৫, ১৬ প্রথম সংস্করণ এবং পৃ. ১২,১৩-১৪,১৫ দ্বিতীয় সংস্করণ]
ভাই ইকবাল অনেক কষ্ট করেছেন। আরবী ব্যাকরণের বিশ্লেষণ উপস্থিত করে নববী ভাষ্যে অবাঞ্ছিত অর্থ আরোপের বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে কাজ কিছু হয়নি, আর হওয়ার কথাও না। ভাই ইকবাল খেয়ালই করেননি যে, এখানে উভয় হাদীসে ‘يَوْمَ ইয়াওমা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘মুযাফ’ হয়ে ‘মা’রেফা’ হিসাবে। শব্দটা ‘নাকেরাহ’ নয় এবং তার সাথে ‘واحد বা এক’ কথাটিও নেই। সুতরাং এখানে ‘يَوْمَ ইয়াওমা’-এর তরজমা ‘একদিন’ করা মারাত্মক ভুল। যে ভুলের শিকার হয়েছেন ভাই ইকবাল এবং সেই ভুল অর্থ ধরেই ব্যাখ্যা করেছেন হাদীস দু’টির। আর এই ভুলের উপরেই রেখেছেন নবোদ্ভাবিত এই বিধানের ভিত্তি। অথচ আমার ধারণা, আরবী ভাষা এবং হাদীস-ভাষ্য বোঝার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানেন না এমন সাধারণ পাঠকরা পর্যন্ত বুঝতে পারছেন যে, এটি একটি নতুন হাজির করা অর্থ। যা হাদীস ইরশাদ হওয়ার সময়, পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটের সাথে একেবারে বেমানান এবং শরীয়ত ও ‘মাকাসিদে শরীয়ত’ (শরীয়তের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা) এবং শরয়ী বিধি-বিধানের গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে যার সামান্যতম জানাশোনা আছে, তার কাছে তো একেবারেই পরিষ্কার যে, এই ব্যাখ্যা কেবল নতুন উদ্ভাবিতই নয়; বরং শরীয়তের মেযাজ ও স্বভাব-বিরুদ্ধ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এক ব্যাখ্যা।
তবে হাদীস দু’টির সঠিক অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে জানেন না এমনও কেউ থাকতে পারেন। সেক্ষেত্রে বলবো, নিমেণ উপস্থাপিত পরিষ্কার এবং সোজা কথাগুলো একটু খেয়াল করুন :
১. উভয় হাদীসের সমস্ত বাক্যই ‘খবারিয়্যা’ বা সংবাদমূলক। এতে একটি বাক্যও ‘ইনশাইয়্যা’ আদেশ-নিষেধবাচক নেই। প্রত্যেকটি বাক্য শব্দগতভাবে এবং উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে ‘খবারিয়্যা’। এ কারণে প্রথম হাদীসের অর্থ হচ্ছে, ‘যেদিন মানুষ রোযা ছাড়ে সেটা ফিতরের দিন এবং যেদিন মানুষ কুরবানী করে সেদিন কুরবানীর দিন’। এর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা এই যে, মানুষ যেদিন রোযা না ছাড়বে সেটা রোযা ছাড়ার দিন নয়। অতএব কেউ যেন আগে আগে রোযা ছেড়ে ঈদ করতে আরম্ভ না করে। একইভাবে যেদিন সর্বসাধারণ কুরবানী করছে না সেটা কুরবানীর দিন নয়। তাই কেউ যেন আগেভাগে কুরবানী করতে শুরু না করে এবং ৯ যিলহজ্বকে ১০ যিলহজ্ব ভেবে আরাফার রোযা থেকে বিরত না থাকে। এই অর্থ হাদীসের অন্য রেওয়ায়েত থেকে, এমনকি স্বয়ং আয়েশা রা.-এর বর্ণনার মাধ্যমে আরো স্পষ্ট হয়ে যায়।
এই হাদীসের অন্য রেওয়ায়েতটি আসসুনানুল কুবরা বাইহাকীতে এই শব্দে বর্ণিত হয়েছে,
العرفة يوم يعرف الإمام، والأضحى يوم يضحى الإمام والفطر يوم يفطر الإمام
অর্থাৎ ‘যেদিন ইমাম (মুসলমানদের শাসক) আরাফায় উকুফ করে সেটা আরাফা, যেদিন ইমাম কুরবানী করে সেটা কুরবানী এবং যেদিন ইমাম ফিতর করে (রোযা ছেড়ে ঈদ করে) সেটা ফিতর’। আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী ৫/১৭৫, باب خطأ الناس يوم عرفة (‘মানুষ যদি আরাফার দিন নির্ধারণে ভুল করে’ অধ্যায়)।
প্রকাশ থাকে যে, এই রেওয়ায়েতের সনদ তিরমিযীর সনদ থেকে বেশি মানসম্মত। বক্তব্যও পরিষ্কার। অর্থাৎ মুসলমানদের শাসক (বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বশীল) শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় প্রমাণিত হওয়ার ভিত্তিতে যেই দিনকে আরাফা এবং ঈদের দিন নির্ধারণ করবেন সেটাই আরাফা এবং ঈদের দিন বলে গণ্য হবে জনসাধারণ সেই মোতাবিক আমল করবে। ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে কারো এ থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বনের সুযোগ নেই।
এবার স্বয়ং হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আয়েশা রা.-এর বক্তব্য শুনুন :
তাবেয়ী ইমাম মাসরূক রাহ. বর্ণনা করেছেন, তিনি ও তার সাথী আরাফার দিন আয়েশা রা.-এর কাছে গেলেন (ঐ দিনটি এমন ছিল, যা ইয়াওমুন নাহ্র বা কুরবানীর দিন হওয়ারও সন্দেহ ছিল)। আয়েশা রা. খাদেমাকে বললেন, তাদেরকে ছাতুর শরবত পান করাও, আর তা যেন মিষ্টি হয়। আমি যদি রোযাদার না হতাম তাহলে আমিও পান করতাম। মাসরূক ও তার সঙ্গী বললেন, আপনি রোযা রেখেছেন! আজ যদি কুরবানীর দিন হয়ে থাকে?! (মাসরূক একথাও বলেছিলেন যে, আমি তো শুধু এই ভেবে রোযা রাখিনি যে, যদি আজ কুরবানীর দিন হয়?) উম্মুল মুমিনীন বললেন,
إنما النحر إذا نحر الإمام وعُظْم الناس، والفطر اذا أفطر الإمام وعُظْم الناس
অর্থাৎ কুরবানী তো তখন যখন ইমাম (মুসলমানদের শাসক) ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কুরবানী করে থাকে এবং ফিতর (রোযা না রাখা) তো তখন যখন ইমাম ও সংখ্যাগরিষ্ট ফিতর করে (রোযা ছাড়ে)
অন্য বর্ণনায় কথাটি এভাবে আছে,
إنما الأضحى يوم يضحي الإمام وجماعة الناس
অর্থাৎ কুরবানীর দিন তো সেটি যেদিন ইমাম ও সর্বসাধারণ কুরবানী করে।
অন্য আরেক বর্ণনায় আছে,
إنما يوم النحر يوم ينحر الناس، ويوم الفطر يوم يفطر الناس
অর্থাৎ কুরবানীর দিন তো সেটি, যেদিন লোকেরা কুরবানী করে এবং ফিতরের (রোযা ছেড়ে ঈদ করার) দিন তো সেটা, যেদিন লোকেরা ফিতর করে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৪/১৫৭, হাদীস ৭৩১০; মাসাইলু আহমদ, আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ; আহকামুল ইখতিলাফ ফি রুয়াতি হিলালি যিলহিজ্জাহ, ইবনে রজব, পৃষ্ঠা. ৩৪-৩৫; কিতাবুল আছার, ইমাম আবু হানীফা, রেওয়ায়েত: ইমাম আবু ইউসুফ, পৃষ্ঠা. ১৭৯, হাদীস ৮১৮; আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী ৪/২৫২)
ইমাম ইবনে রজব রাহ. লেখেন,
فهذا الأثر صحيح عن عائشة رضى الله عنها، اسناده في غاية الصحة، ولا يعرف لعائشة مخالف من الصحابة.
অর্থাৎ হযরত আয়েশা রা. থেকে এ বার্ণনা প্রমাণিত। এর সনদ সর্বোচ্চ মানের সহীহ সনদ এবং এ সিদ্ধামেত্ম তাঁর সাথে কোনো সাহাবীর দ্বিমত পাওয়া যায় না। (আহকামুল ইখতিলাফ, ইবনে রজব, পৃষ্ঠা : ৩৬)
পূর্বোলিস্নখিত হাদীসের
(الفطر يوم يفطر الناس... - মানুষ যেদিন রোযা ছাড়ে সেটা ফিতরের দিন...) বর্ণনাকারী আয়েশা রা.-এর এই বক্তব্য থেকে আগের হাদীসের মর্ম একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ হাদীসে বলতে চাওয়া হয়েছে, মুসলমানদের শাসক ও সর্বসাধারণ যেটাকে ঈদের দিন বলে স্থির করবে এবং ঈদ পালন করবে সেটাই ঈদের দিন। কেউ যদি দাবি করে, আমি তো চাঁদ দেখেছি, অতএব কালকে নয় আজকেই ঈদ (অথচ কাযী বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার সাক্ষ্য গ্রহণ করেনি), কিংবা যদি বলে, গণনার নিয়ম অনুসারে আজ পহেলা শাওয়াল না; বরং ত্রিশ রমযান কিংবা আরাফার রোযার ব্যাপারে যদি কারো সংশয় সৃষ্টি হয় যে, আজ সম্ভবত আরাফার দিন না; বরং কুরবানীর দিন... এধরনের অজুহাত খাড়া করে যদি কেউ মুসলমানদের শাসক বা সর্বসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করে এবং তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের আগে বা পরে রোযা শুরু করে কিংবা ঈদ উদ্যাপন করতে চায়, তো এরকম কিছু করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। মোটকথা, মুসলমানদের শাসক ও সর্বসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রোযা বা ঈদ করা কোনো যুক্তিতেই বৈধতা পাবে না এটা বলে দেয়াই হাদীসের মাকছাদ।
আয়েশা রা.-এর বক্তব্য থেকে এটাও জানা গেল যে, ‘الناس আন্নাস’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, মুসলমানদের শাসকের আনুগত্যকারী জনগণ এবং এও জানা গেল যে, সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করার সঙ্গে এই হাদীসের কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা যেমনটি আমরা দেখলাম, হাদীসের অর্থ ও মর্মের মাঝে এ বিষয়টি মোটেও অন্তর্ভুক্ত নয়। তাছাড়া এই মাসআলা তো সেই সময় কারো কল্পনাতেও ছিল না যে, এটা আলোচনায় আসার কোনো সম্ভাবনা থাকবে। এমনকি সে সময় যেটা আলোচনায় আসার সম্ভাবনা ছিল, অর্থাৎ এক অঞ্চলের দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য ওয়াজিবুল আমল (অপরিহার্যভাবে গ্রহণীয়) কি ওয়াজিবুল আমল না-তার সঙ্গেও এর হ্যাঁ বা না কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। বরং হাদীসের প্রতিপাদ্য এই যে, নতুন চাঁদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং তা মানা বাধ্যতামূলক। তাতে ব্যক্তিগত মতামত বা সংশয় সন্দেহের কারণে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বনের অবকাশ নেই।
মাসরূক এবং আয়েশা রা.-এর মধ্যে যে সংলাপ হয়েছে তার প্রেক্ষাপটই বিচার করুন। স্পষ্টতই এটা আরাফার ঘটনা নয় যে, তারা দুজন হজ্বে ছিলেন আর সেখানেই এ আলাপ হল। কেননা হাজ্বীদের জন্য আরাফার রোযা মুসত্মাহাব নয়। যদি আরাফায় উকুফরত থাকতেন তাহলে তো রোযা নিয়ে পেরেশানির পরিবর্তে আরাফার উকুফ সহীহ হচ্ছে কি হচ্ছে না এ নিয়ে চিমিত্মত থাকতেন। বোঝা গেল, এটা আরাফাহ নয় বরং অন্য কোনো ইসলামী শহরের ঘটনা। খুব সম্ভব এটা মদীনা মুনাওয়ারার ঘটনা। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর অবস্থান তো ওখানেই ছিল। মাসরূক যদিও কুফার বাসিন্দা ছিলেন, কিন্তু তিনি ইলম হাছিলের উদ্দেশ্যে মদীনা সফর করতেন। আর উম্মুল মুমিনীনের সাথে তো এই ক্ষেত্রে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। যাইহোক, এটা মদীনার হোক কিংবা অন্য কোন ইসলামী শহরের- সেখানে চাঁদের সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা না হজ্বের আমীরের হাতে ছিল, আর না সরাসরি দারুল খিলাফতের দায়িত্বশীলের (আমীরুল মুমিনীনের); বরং তা ন্যস্ত ছিল ঐ শহরেরই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলের, যেখানে মাসরূক এবং উম্মুল মুমিনীনের মধ্যে এই সংলাপটি হয়েছে। ঐ দায়িত্বশীলের সিদ্ধান্ত মোতাবিক আমল করার প্রতি জোর দিয়ে উম্মুল মুমিনীন বলেছেন,
إنما النحر إذا نحر الإمام وعظم الناس والفطر إذا أفطر الامام وعظم الناس
অর্থাৎ ‘কুরবানী তো তখন, যখন ইমাম (মুসলমানদের শাসক, কিংবা তার প্রতিনিধি) ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কুরবানী করে, ফিতর )রোযা না রাখা) তো তখন যখন ইমাম ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রোযা ছাড়ে।’
এজন্য এখানে ইমাম দ্বারা সমগ্র ইসলামী বিশ্বের একমাত্র আমীরুল মুমিনীন উদ্দেশ্য নয় এবং জনসাধারণ দ্বারা সমস্ত মুসলমান উদ্দেশ্য নয়। অন্যথায় মাসরূক ও তার সঙ্গী বলে উঠতেন, আমাদের তো জানা নেই যে, দারুল খেলাফতে আমীরুল মুমিনীন কী ফায়সালা করেছেন, আর অন্যান্য ইসলামী শহরেই বা কবে ঈদ হচ্ছে?
এবার দ্বিতীয় হাদীসটি নিয়ে চিন্তা করুন। তারপর আরো কিছু কথা হবে ইনশাআল্লাহ। দ্বিতীয় হাদীসে বলা হয়েছে,
الصوم يوم تصومون و الفطر يوم تفطرون والاضحى يوم تضحون
অর্থাৎ ‘রোযা সেদিন, যেদিন তোমরা রোযা রাখছ, ফিতর সেদিন, যেদিন তোমরা রোযা ছাড়ছ এবং কুরবানী সেদিন, যেদিন তোমরা কুরবানী করছ।’ এটা হাদীসের শাব্দিক অর্থ, যতক্ষণ হাদীসের পূর্বাপর সামনে না আসবে এবং হাদীসের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে না জানা যাবে ততক্ষণ এর অর্থ পুরোপুরি স্পষ্ট হবে না। কারণ লোকজন যেদিন রোযা রাখবে কিংবা ঈদ করবে সেদিন রোযা হওয়া কিংবা ঈদ হওয়া তো দৃশ্যমান ব্যাপার। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের দরকার ছিল না। তাহলে হাদীসের উদ্দেশ্য বা প্রেক্ষাপট কী? ফুকাহায়ে উম্মত হাদীসের অগ্রপশ্চাত দেখে এবং সম্মিলিত ইবাদতের ক্ষেত্রে শরীয়তের মেযাজ (রুচি-প্রকৃতি) ও খোলাফায়ে রাশেদীন এবং সাহাবায়ে কেরামের কর্মধারাকে সামনে রেখে হাদীসের অর্থ বর্ণনা করেছেন। যার সারমর্ম এই যে, এ হাদীস থেকে বিশেষত দুটি নির্দেশনা পাওয়া যায় :
১. মুসলমান যখন শরীয়তের নির্দেশ মোতাবিক রোযা, ঈদ এবং কুরবানী সম্পন্ন করবে, তো এর মাধ্যমে তাদের যা দায়িত্ব ছিল তা পুরা হয়ে যাবে। এখন যদি বাস্তব ক্ষেত্রে এমন কোনো ভুল হয়ে থাকে, যেটা মূলত গায়েব না জানার কারণে হয়েছে। তো এজন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে না; বরং ঐ আমল সহীহ এবং আল্লাহর কাছে মকবুল বলে গণ্য হবে।
যেমন, শরীয়তের বিধান হল, ঊনত্রিশের রাতে চাঁদ অনুসন্ধান কর। যদি চাঁদ দেখা না যায় তাহলে ত্রিশ পূর্ণ কর। এখন এই সম্ভাবনা থেকে যায় যে, হতে পারে চাঁদ উঠেছিল কিন্তু আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। বাস্তবে যদি এমনটিই ঘটে থাকে তাহলে আমরা যে ত্রিশ শাবান মনে করে রোযা রাখিনি এতে আসলে রমযানের একটি রোযা ছুটে গিয়েছে। একইভাবে ত্রিশ রমযান ভেবে যে রোযাটি রেখেছি সে রোযা হয়েছে মূলত ঈদুল ফিতরের দিন। এমনিভাবে যিলকদকে ত্রিশ ধর্তব্য করায় যিলহজ্ব মূলত শুরু করেছি একদিন পর। ফলে হজ্ব ৯ যিলহজ্বের পরিবর্তে ১০ যিলহজ্বে হয়েছে এবং আরাফার রোযা ৯ তারিখের বদলে কুরবানীর ঈদের দিন হয়েছে।
একইভাবে শরীয়তের আরেকটি বিধান হল, একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাক্ষ্যদানের ভিত্তিতেও রমযানের চাঁদ প্রমাণিত হয় এবং দু’জন বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাক্ষ্য পাওয়া গেলে শাওয়াল ও যিলহজের চাঁদ প্রমাণিত হয়ে যায়। কিন্তু কখনো কখনো বিশ্বস্ত ব্যক্তিরও বিভ্রম হতে পারে। দু’একজনের ভুল হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়।
এখন যদি সত্যিই কোনো মাসে প্রত্যক্ষ্যকারী দৃষ্টিবিভ্রমের কারণে চাঁদ না থাকা সত্ত্বেও চাঁদ দেখেছে মনে করে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেয় এবং সে বিশ্বস্ত হওয়ায় বিচারক শরীয়তের বিধি মোতাবিক তার সাক্ষ্য গ্রহণ করে নেয় ( যেহেতু গায়েবের খবর তার নেই) তাহলে বাস্তবতার বিচারে ফল এই দাঁড়াবে যে, আমরা ত্রিশ শা‘বানকে পহেলা রমযান বানিয়ে ফেলেছি, অথবা ত্রিশ রমযানকে পহেলা শাওয়াল ভেবে একটি রোযা ছেড়ে দিয়েছি।
বাস্তব ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে। কখনো হয়ও।
বিশেষ করে ঊনত্রিশের দিবাগত রাতে চাঁদ ওঠা সত্ত্বেও দৃষ্টিগোচর না হওয়া এবং সময়মত চাঁদ দেখার সাক্ষ্য না পাওয়ার ঘটনা তো ঘটে থাকেই। সাধ্যমত শরয়ী বিধান অনুসারে আমল করা সত্ত্বেও যেসব ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে তা আল্লাহর কাছে ক্ষমাযোগ্য। তাই আল্লাহ তাআলা ইখলাছ ও হুকুম মান্য করার কারণে তাদের অজান্তে ঘটে যাওয়া ভুল-ত্রুটি থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে ঐ দিনকেই রোযার দিন বলে ধরে নেন, যেদিন বান্দাগণ তাঁর হুকুম মোতাবিক রোযা রাখা শুরু করেছে এবং ঐ দিনকেই ঈদের দিন গণ্য করেন যেদিন বান্দাগণ ঈদ উদ্যাপন করেছে এবং ঐ দিনকেই কুরবানীর দিন ধর্তব্য করেন, যেদিন বান্দাগণ কুরবানী করেছে। যদিও বাস্তব ঘটনা ভিন্ন কিছু হয়ে থাকে! বাস্তবে যা ঘটেছে তার বিচারে যেটা সঠিক সে অনুযায়ী আমল না হওয়ায় তাদেরকে গোনাহগার বিবেচনা করেন না এবং সাওয়াব থেকেও বঞ্চিত করেন না। এই প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে :
‘রোযা সেদিন, যেদিন তোমরা রোযা রাখছ’। অর্থাৎ বাস্তবে যদিও সেটা ত্রিশ শা‘বান অথবা দোসরা রমযান হয়। ‘ফিতর সেদিন যেদিন তোমরা রোযা ছাড়ছ’। অর্থাৎ যদিও সেটা বাস্তবে ত্রিশ রমযান কিংবা দোসরা শাওয়াল হয়ে থাকে। ‘এবং কুরবানী সেদিন, যেদিন তোমরা কুরবানী করছ’। অর্থাৎ যদিও সেটা বাস্তবে ১০ যিলহজ্বের পরিবর্তে ৯ যিলহজ্ব কিংবা এগারো যিলহজ্ব হয়ে থাকে। এগারো যিলহজ্ব হয়ে যাওয়ায় তাকে বলা হবে না যে, প্রথম দিন কুরবানী করার ফযীলত তার হাসিল হয়নি কিংবা তার ঈদের নামায কাযা হয়ে গেছে।
হাদীসের এই অর্থ হাদীসের পূর্বাপর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায়। ‘মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক’ ৭৪/১৫৫, ‘আসসুনানুল কুবরা’ বাইহাকী ৪/৪১১, ‘মুসনাদুল বাযযার’ ১৫/২৯৮ এ সকল কিতাবে এই হাদীসের সম্পূর্ণ ভাষ্য আবু হুরায়রা রা.-এর সূত্রে এভাবে বর্ণিত হয়েছে,
"إذا رأيتم الهلال فصوموا، ثم إذا رأيتموه فأفطروا، فإن غُمَّ عليكم فأتموا ثلاثين، صومكم يوم تصومون، وفطركم يوم تفطرون، وأضحاكم يوم تضحون".
অর্থাৎ ‘যখন তোমরা নতুন চাঁদ দেখ তখন রোযা রাখ, তারপর যখন নতুন চাঁদ দেখ তখন রোযা ছাড়। আর যদি চাঁদ তোমাদের থেকে আড়াল হয়ে যায় তাহলে ত্রিশ পূর্ণ কর। যেদিন তোমরা রোযা রাখছ সেদিনই তোমাদের রোযা, যেদিন তোমরা রোযা ছাড়ছ সেদিনই তোমাদের ফিতর এবং যেদিন তোমরা কুরবানী করছো সেদিনই তোমাদের কুরবানী’।
চাঁদ আড়াল হয়ে যাওয়ায় ত্রিশ পূর্ণ করতে বলা হয়েছে। এতে মনে সন্দেহ জাগে, তাহলে আমাদের রোযা ও ঈদের না জানি কী দশা হয়! হয়ত ঊনত্রিশের রাতেই চাঁদ উঠে গেছে, অথচ আমরা খোঁজ পাইনি। তাই পহেলা রমযানকে ত্রিশ শা‘বান ভেবে আমরা একটা রোযা ছেড়ে দিয়েছি। আবার পহেলা শাওয়ালকে ত্রিশ রমযান মনে করে ঈদের দিন রোযা রেখে ফেলেছি ... এই সংশয়-সন্দেহ দূর করার জন্যই চাঁদ দৃষ্টির আড়ালে থাকা অবস্থায় ত্রিশ পূর্ণ করতে বলার পাশাপাশি এই সান্তবনাও দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যেদিন রোযা শুরু করেছ কিংবা যেদিন ঈদ করেছ-যদি সেটা বাস্তব অবস্থার বিপরীতও হয় তবু আল্লাহর কাছে তা সঠিক দিবস বলেই গণ্য হবে। অতএব তোমরা যথাযথ সাওয়াব পাবে এবং তোমাদের কোনো গোনাহ হবে না।
সুতরাং হাদীসের বক্তব্য থেকে একটি বিষয় তো এই জানা গেল যে, আমরা শরীয়তের নির্দেশনার নিরীখে চাঁদ দেখা কিংবা দেখার সাক্ষ্য অনুসারে আমল করতে আদিষ্ট। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার পর যদি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এ ক্ষেত্রে কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে যায় তাহলে সে কারণে তারা যেমন গোনাহগার হবেন না তেমনি তাদের আনুগত্যকারী সর্বসাধারণ। এ কারণে তাদের আমল বাতিলও গণ্য হবে না।
২. আলোচ্য হাদীসে বিদ্যমান দ্বিতীয় নির্দেশনাটি তা-ই, যা প্রথম হাদীসে পরিষ্কারভাবে এসেছে।
অর্থাৎ রমযান ও ঈদুল ফিতরের চাঁদ এবং হজ্ব ও কুরবানীর চাঁদ বিষয়ে সিদ্ধান্তদানকারী দায়িত্বশীল হলেন মুসলমানদের শাসক বা তার প্রতিনিধি।
তিনি এবং তার আনুগত্যকারী মুসলিম সর্বসাধারণ যেই দিনকে রোযা, ঈদুল ফিতর, আরাফা এবং কুরবানীর দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন, তা আল্লাহর কাছেও তেমনি। আর তাই কারো ব্যক্তিগত মতামত কিংবা সংশয়-সন্দেহের কারণে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে রোযা, ঈদ, উকুফে আরাফা কিংবা কুরবানী করা ঠিক নয়। কারণ রোযার সূচনা সেটা নয়, যাকে বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ মনে করছে; বরং তার সূচনা হল সেটা, যাকে মুসলমানদের শাসক শরীয়তের আইন অনুযায়ী নির্ধারণ করেছেন। আর সর্বসাধারণ যাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। এমনিভাবে ঈদের দিন সেটা নয়, যাকে ব্যক্তি বিশেষ ঈদ বলে ভাবছে; বরং সেটা, যা নির্ধারণ করেছে মুসলমানদের দায়িত্বশীল আর যাকে মেনে নিয়েছে মুসলিম সর্বসাধারণ ...।
হাদীসে বিবৃত প্রথম নির্দেশনার প্রতি লক্ষ্য রেখে ইমাম আবু দাউদ এবং ইমাম বাইহাকীর মতো বহু মুহাদ্দিস এই হাদীসের শিরোনাম করেছেন, ‘চাঁদের সিদ্ধান্ত করতে গিয়ে যদি মুসলমানদের ভুল হয়ে যায় তবে তার কী হুকুম’ ... এজাতীয়।
যেমন আবু দাউদে আছে,
باب إذا أخطأ القوم الهلال
বাইহাকীতে শিরোনাম করা হয়েছে,
باب القوم يخطئون في رؤية الهلال
শরহুস্ সুন্নাহ বাগাভীতে,
إذا أخطأ القوم الهلال
আর হাদীসে বিধৃত দ্বিতীয় নির্দেশনার উল্লেখ করেছেন ইমাম তিরমিযী রাহ. হাদীস বর্ণনার মুহূর্তেই, এক বা একাধিক আহলে ইলমের বরাতে। তিনি লিখেছেন,
وفسَّر بعض اهل العلم هذا الحديث، فقال : إنما معنى هذا : الصوم والفطر مع الجماعة وعُظْمِ الناس
অর্থাৎ রোযা ও ঈদ আলজামাআহ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাথে হবে।
(জামে তিরমিযী, ৮০৬ নং হাদীসের অধীনে)
‘আলজামাআহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য, শাসক বা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলের আনুগত্যকারী জনতা।
এই ব্যাখ্যাকেই ইমাম আবুল হাসান সিন্ধি রাহ. সুনানে ইবনে মাজাহ’র টীকায় ঐ হাদীসের অধীনে আরো স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন। যা পাঠকবর্গ ইতোপূর্বে (রজব ’৩৫ হিজরী সংখ্যায়) পড়েছেন। সেখানে শায়খ আলবানী রাহ.-এর বরাতে এ কথাও আলোচিত হয়েছে যে, এই হাদীসের সরল ব্যাখ্যা সেটাই, যা আবুল হাসান সিন্ধি সুনানে ইবনে মাজাহ’র টীকায় উল্লেখ করেছেন। যার সারমর্ম হল, রোযা, ঈদুল ফিতর এবং আযহার মতো সম্মিলিত ইবাদতসমূহের ব্যবস্থাপনা ব্যক্তির হাতে নয়; বরং ইমাম ও আলজামাআহ তথা শাসক ও সর্বসাধারণের হাতে। ব্যক্তির কর্তব্য, এদের অনুগত থাকা।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই হাদীস তো সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর ধরেই বিদ্যমান রয়েছে। মুহাদ্দিসীন তা বর্ণনা করেছেন, ফুকাহা তার ব্যাখ্যা করেছেন, তা থেকে বিধান আহরণ করেছেন এবং প্রত্যেক কালের উলুল আমর (দায়িত্বশীল উলামা ও উমারা) ও উম্মাহর বুযুর্গ ব্যক্তিগণ ঐ সব বিধানকে বাস্তবে রূপদান করেছেন। কিন্তু এ রকম অর্থ কারো কল্পনার ত্রিসীমানাতেও আসেনি, যা এখন বলা হচ্ছে।
ফুকাহায়ে উম্মত, মুফাসসিরীনে কেরাম এবং শারেহীনে হাদীস তথা হাদীসের ভাষ্যকারদের মাঝে এই হাদীস প্রথম থেকেই ব্যাপকভাবে পরিচিত ও প্রচলিত। এমন নয় যে, এটা এখনকার উদ্ভাবিত বা আবিষ্কৃত। এটা যদি পরবর্তীকালের সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে তা নবীর হাদীসই বা হয় কী করে? এখন কথা হল, কোনো ফকীহ, কোনো মুফাসসির, কোনো মুহাদ্দিস কিংবা কোনো নির্ভরযোগ্য আলেমে দ্বীন কি এই হাদীসের ঐ অর্থ বয়ান করেছেন, পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু কিছু ব্যক্তি এখন যে অর্থ দাঁড় করাচ্ছেন?
ফুকাহায়ে কেরাম, মুফাসসিরীন এবং মুহাদ্দিসীনের মধ্যে যারাই এই হাদীস নিয়ে আলোচনা করেছেন তাদের কেউ-ই এ অর্থ করেননি যে, এখানে সারা বিশ্বে একই দিন রোযা ও ঈদ পালন করতে বলা হয়েছে। এমনকি এতটুকুও বলেননি যে, এ থেকে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া প্রমাণিত হয়!
আমি এখানে হাদীস, তাফসীর এবং ফিকহ-ফতোয়ার কিছু কিতাবের শুধু নাম উদ্ধৃত করছি। আগ্রহী পাঠক চাইলে তার শরণ নিতে পারেন।
১ - কিতাবুল উম্ম, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস শাফেয়ী রাহ. (১৫০ হি.-২০৪ হি.) ১/১৬৯
২ - সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩১৮
৩ - জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৯৭
৪ - আহকামুল কুরআন, জাস্সাস ১/২৬৯
৫ - মা‘আলিমুস্ সুনান, খাত্তাবী ২/৮২
৬ - শরহুস সুন্নাহ, বাগাভী ৪/১৪৫-১৪৭
৭ - আস্সুনানুল কুবরা, বাইহাকী ৪/২৫১-২৫২
৮ - মা’রিফাতুস্ সুনানি ওয়াল আছার, বাইহাকী ৫/১১৪
৯ - আত-তামহীদ, ইবনে আব্দুল বার ১৪/৩৫৬
১০ - আরেযাতুল আহওয়াযী শরহে তিরমিযী, আবু বকর ইবনুল আরাবী ৩/২২২
১১ - আলজামে লি আহকামিল কুরআন, কুরতুবী ১২/১১
১২ - জামেউল উসূল, ইবনুল আছীর
৬/২৭৭, কিতাবুস সওম (في الصوم والفطر بالجتهاد)
১৩ - আউনুল মা‘বুদ, শরহু সুনানি আবি দাউদ, শামছুল হক আযিমাবাদী ৬/৩১৬
১৪ - তুহফাতুল আহওয়াযি, আব্দুর রহমান মুবারকপুরী ৩/৩১২
১৫ - সুবুলুস সালাম শরহু বুলুগিল মারাম, আমীরে ইয়ামানী ২/১৯৪
১৬ - শরহু সুনানে ইবনে মাজাহ, আবুল হাসান সিন্ধি ২/৩০৬
১৭ - শরহুল মুহাযযাব, ইমাম নববী ৭/৪৪৩-৪৪৫
১৮ - ফয়যুল ক্বাদীর, আব্দুর রঊফ মুনাভী ৪/৪৪১
১৯ - ইকদুল জীদ ফি আহকামিল ইজতিহাদি ওয়াত তাকলীদ, শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী পৃ. ৩৩
২০ - মাজমুঊল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া ২৫/১০৩-১১১
২১ - ফাতাওয়াস্ সুব্কি ১/২১৫
২২ - আলমুগনী, ইবনে কুদামা ৩/১৩-১৪
২৩ - তাবয়ীনুল হাকাইক শরহু কানযিদ্ দাকাইক ১/৩১৮, ২/৯২
২৪ - ফাতহুল ক্বাদীর শরহুল হিদায়া, কিতাবুল হজ্ব : আরাফা ২/৩২২
২৫ - দুরারুল হুককাম শরহু গুরারিল আহকাম ১/২৬৩
২৬ - বাযলুল মাজহুদ ফি শারহি সুনানি আবী দাউদ ৮/৪৫০
২৭ - মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/২৪২
২৮ - নাইলুল আওতার ৩/৩৮০
২৯ - আলবায়ান ফী মাযাহিবিল ইমামিশ শাফিঈ, আবুল হুসাইন ইয়াহইয়া আল ইমরানী ২/৬৫০
৩০ - তাহযীবুস সুনান, ইবনুল কায়্যিম ৩/২১৩
এখানে আমি উদাহরণস্বরূপ হাদীস, তাফসীর এবং ফিকহ-ফতোয়ার মাত্র ত্রিশটি কিতাবের নাম উদ্ধৃত করেছি। এগুলোর কোনোটিতেই ওই অর্থের কোনো নাম-নিশানাও নেই যা দাবি করা হচ্ছে। বরং কোনো কোনোটিতে হাদীসের পাঠের সাথে সামঞ্জস্যশীল বিভিন্ন মাসআলা আহরণ করা হয়েছে। আর অধিকাংশ কিতাবেই হাদীসটির এ অর্থই বিবৃত হয়েছে যে, রোযা ও ঈদ এবং কুরবানী ও হজ্বের তারিখ বিষয়ক সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের হাতে। যদি তারা শরীয়তের আইন মোতাবিক সিদ্ধান্ত দেয়ার পরও তাদের অজ্ঞাতসারে কোনো ভুল হয়ে যায় তাহলে আল্লাহ তা ক্ষমা করে দেবেন। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্ত অনুসারে মুসলমানগণ যেদিন রোযা ও ঈদ এবং হজ্ব ও কুরবানী করবেন সেটাই আল্লাহর কাছে ঐসব আমলের সঠিক সময় বলে গণ্য হবে। অতএব কারো জন্য এটা বৈধ নয় যে, রোযা ও ঈদ এবং হজ্ব ও কুরবানীর ক্ষেত্রে সে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল (উলামা ও উমারা)-দের থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করবে। যেমনটি এই প্রবন্ধেরই দশম কিস্তিতে (রজব ১৪৩৫ হি. সংখ্যায়) আরবের আকাবির ও মনীষী পর্যায়ের আলেমদের বরাতে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। তারা সবাই তাদের এ ফতোয়ার পক্ষে আলোচ্য হাদীসকেই প্রমাণ পেশ করেছেন।
যাইহোক, এই হচ্ছে হাদীসের সহজাত অর্থ, যা উম্মাহর ফকীহগণ ও মুহাদ্দিস আলিমগণ বুঝেছেন। এখন লক্ষ্য করুন, ভাই ইকবাল হাদীসটির নতুন কী অর্থ আবিষ্কার করেছেন। প্রথম হাদীসের অর্থ তিনি লিখেছেন,
‘ঈদুল ফিতর হলো ঐ একদিন, যেদিন সকল মানুষ ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করে থাকে এবং ঈদুল আযহা হচ্ছে ঐ একদিন, যেদিন সকল মানুষ ঈদুল আযহা পালন করে থাকে।’
এই তরজমায় ‘দিন’ এর সাথে ‘এক’ শব্দটি যোগ করা ভুল। যদি ইচ্ছাকৃত করা হয়ে থাকে তাহলে তো ভয়াবহ! হাদীসে يوم ইয়াওমা (দিন)-এর সাথে সরাসরি যেমন واحد ওয়াহেদ (এক) শব্দ নেই, তেমনি শব্দটি এখানে يومٌ বা يوماً (ইয়াওমুন বা ইয়াওমান) তথা তানবীন সহকারে নেই। তানবীন সহকারে থাকলে তার অর্থ ‘একদিন’ করা সহীহ হত।
এখানে বরং يومَ ইয়াওমা’ শব্দটি مضاف (মুযাফ) হয়েছে। তাই এর অর্থ হবে ‘দিন’, ‘একদিন’ নয়। আর এ কথা বয়ান করাও হাদীসের উদ্দেশ্য না যে, ঈদ একদিন হবে নাকি একাধিক দিন। বরং উদ্দেশ্য এটা বলে দেয়া যে, কোন্ দিনটি ঈদের দিন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে- এক বা একাধিক ব্যক্তির মতামত হিসেবে যাকে ঈদের দিন বলে দাবি করা হচ্ছে সেটা, নাকি যেদিনটিকে ঈদের দিন বলে ফয়সালা করেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বশীল আর তাকে মেনে নিয়েছে মুসলিম সর্বসাধারণ।
দ্বিতীয় হাদীসের তরজমা তিনি লিখেছেন, ‘যেদিন তোমরা স্বওম (রোজা) পালন কর সেদিন হল স্বওম (রোজা), আর যেদিন তোমরা ফিতর পালন কর সেদিন হল ফিতর, যেদিন তোমরা কুরবানী পালন কর সেদিন আযহা’।
হাদীসের ভাষ্যে এখানেও প্রত্যেকবার ‘يومَ ইয়াওমা’ শব্দটি আছে, যা ‘মুযাফ’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য এখানেও একদিন বা দুইদিন এসব কিছু বয়ান করা উদ্দেশ্য না। তরজমায় তো এখানে ‘একদিন’-এর ব্যাপারটি তিনিও লেখেননি, কিন্তু ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনাতে গিয়ে ‘একদিন’ কথাটি লিখেছেন, যা গলদ।
কারণ আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে এতে যেমন ‘একদিন’ অর্থ করা শুদ্ধ হয় না, তেমনি ‘দুই বা তিন দিন’-এর অর্থও করা যায় না। উদ্দেশ্য বরং এটা বলে দেয়া যে, রোযা ও ঈদের দিন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে কোন দিন? শরীয়তের আইন মোতাবিক বিচারক যেইদিনের ফয়সালা করেছেন সেদিনটি, নাকি আমাদের জ্ঞানের আওতা বহির্ভূত বাস্তব ক্ষেত্রে যেদিন আসলে প্রথম রমযান বা পহেলা শাওয়াল- কোনটি? সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বশীলগণ যে দিনের ফয়সালা করেছেন সেদিন, নাকি তাদের থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বনকারীরা যেদিন বলে দাবি করছে সে দিন?
হাদীস বলছে, তোমরা গায়েবের খোঁজ জানতে আদিষ্ট নও। সুতরাং শরীয়তের আইন মোতাবিক যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটার অনুসরণ কর এবং ইমাম ও জামাআহ’র সঙ্গে থাক। তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।
একটি সহজ-সাধারণ কথা
যেমনটি আমি বলে এসেছি, সাধারণ বোধ-বুদ্ধির অধিকারী ব্যক্তিও বুঝতে পারে যে, এ দুই হাদীসের এ অর্থ দাবি করা যে, এখানে সারা দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানকে একই দিনে রোযা, ঈদ ও কুরবানী করতে বলা হয়েছে এবং তা তাদের উপর ফরয করা হয়েছে - এ রকম অর্থ হাদীসের শব্দ ও পূর্বাপর মোটেও সমর্থন করে না। ঠিক তেমনি তা হাদীস ইরশাদ হওয়ার সময়, পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটের সাথেও একদমই খাপ খায় না। কে না জানে, সেই যুগে এবং তার পরবর্তী এক হাজার বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত বর্তমান দ্রুততম আদান-প্রদান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল কল্পনারও অতীত। ফলে তাৎক্ষণিক কিংবা স্বল্পসময়ের মধ্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সংবাদ প্রেরণ ছিল অসম্ভব। আর এটাও জানা কথা যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়েব জানতেন না যে, তার সময় থেকে বারোশ’-তেরোশ’ বছর পর কী পরিস্থিতি তৈরি হবে সেটা তিনি জানবেন।
অতএব প্রথম কথা, যেই নির্দেশ অনুযায়ী আমল করা ঐ সময় অসম্ভব এমনকি কল্পনারও অগম্য -তার নির্দেশ তিনি কীভাবে দেবেন?
যদি মেনে নেয়া হয় যে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে ভবিষ্যতের এই অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন বিধায় তিনি এ রকম বলেছেন তাহলে তো এমন হওয়া দরকার ছিল যে, সাহাবায়ে কেরামের কাছে এই নির্দেশ অনাগত ভবিষ্যতের জন্য আমানত রেখে যেতেন। তাদেরকে এর উপর আমল করতে বলতেন না। কারণ যদি তিনি সাহাবায়ে কেরামকে বলতেন যে, ভূ-পৃষ্ঠে বসবাসকারী তোমাদের সকল মুসলিমকে একই দিন রোযা ও ঈদ পালন করতে হবে তাহলে তো তারা জিজ্ঞাসা করতেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কীভাবে সম্ভব? আপনি আমাদেরকে এর রাসত্মা বাতলে দিন!
আমরা কী করে জানব, মক্কা, নজদ, বাহরাইন এবং ইয়ামান ও অন্যান্য জায়গায় আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা কবে নতুন চাঁদ দেখেছে এবং কোন দিন রোযা শুরু করেছে এবং কোন দিন ঈদ করেছে?! আর তারাই বা কীভাবে জানবে যে, আমরা কবে চাঁদ দেখেছি এবং কবে রোযা শুরু করেছি অথবা ঈদ করছি?!
যেহেতু এসব হাদীসে এ ধরনের কোনো প্রশ্ন কিংবা তার জওয়াব দেখতে পাওয়া যায় না, সেহেতু পরিষ্কার বোঝা যায়, এই হাদীসগুলোতে এরকম কোনো কথা বলাই হয়নি যে, সারা দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানকে একই দিন রোযা ও ঈদ এবং কুরবানী পালন করতে হবে। অন্যথায় এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠত এবং তার সমাধানও হাদীসে উল্লেখ থাকত।
তারপরও যদি কেউ হঠকারিতাবশত দাবি করে, হোক চাই না হোক এই হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সারা দুনিয়ার সকল মুসলমানকে একই দিনে রোযা, ঈদ ও কুরবানী করতে হবে; তাহলে আমাদের প্রশ্ন, এই ফরযের উপর তিনি নিজে আমল করেননি কেন? পরবর্তী হাজার বছর ধরে, এমনকি এখন পর্যন্ত এই ফরযের উপর আমল হচ্ছে না কেন?
এটা তাহলে কেমন কথা যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা বিষয় হাদীসে ফরয করে দিলেন অথচ তিনি নিজে তার উপর আমল করলেন না এবং সেই ফরয আদায়ের কোনো পদ্ধতিও বলে গেলেন না?! তিনিও না, তার খোলাফায়ে রাশেদীনও না! মুসলিম উম্মাহ্র প্রথম তিন প্রজন্মেও এর উপর আমল হলো না, তার পরবর্তী কোনো কালেও না!!
এ রকম হাস্যকর কথা কারো চিন্তায় কীভাবে আসে আর তিনিই বা কীভাবে লেখেন!
যদি কেউ আরো বেশি হঠকারিতার আশ্রয় নিয়ে বলে, তিনি এটা ফরয করেছেন বটে, কিন্তু অপারগতার কারণে ঐ ফরযের উপর আমল করতে পারেননি। এখন যেহেতু এই ফরয পালন করতে কোন অপারগতা নেই; বরং তা খুবই সম্ভব, অতএব করা উচিত ...। এ রকম হঠকারীদের প্রথমত আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং শরীয়তের উপর মিথ্যারোপের শাসিত্মর কথা স্মরণ করাতে চাই। দ্বিতীয়ত তাদের দাবীকে ক্ষণিকের জন্য মেনে নিলেও বলব, কুরআনে নির্দেশ তো হল فاتقوا الله ما استطعتم (তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর) [সূরা তাগাবুন : ৬৪ : ১৬] এই আয়াতের বিধান অনুযায়ী মাসআলা হল, যেই নির্দেশকে পুরাপুরি ও পূর্ণাঙ্গ উপায়ে মান্য করা সম্ভব না তাকে সম্পূর্ণরূপে বাদ না দিয়ে যতটুকু সম্ভব আমল করতে হবে। যেমন দাঁড়িয়ে নামায পড়ার ক্ষমতা না থাকলে এই নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, নামায ছেড়ে দেবে কিংবা শুয়ে শুয়ে পড়বে; বরং বসে পড়ার সাধ্য থাকলে বসেই পড়বে।
এই শরীয়ত স্বীকৃত মূলনীতি অনুযায়ী যদি বাস্তবেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা দুনিয়ার মুসলমানদের একই দিনে রোযা ও ঈদ করার হুকুম দিয়ে থাকেন তাহলে এ সম্পর্কিত বিধান এবং এর বাস্তবায়ন পদ্ধতিও উম্মতকে বলে দিতেন এবং তাঁর কালে বিদ্যমান উপায়-উপকরণ অনুপাতে যতটুকু করা সম্ভব ছিল সেটুকু আমল করতেন। কিন্তু কোথায় সেই বিধান আর কোথায় সেই কর্মপদ্ধতির বয়ান! কোথায় সেই মোতাবিক সামান্য থেকে সামান্য পর্যায়ে আমলের শুধু একটি উদাহরণ?! আর কোথায় তাঁর উম্মতের মধ্যে পনের শতকের প্রথম সময় পর্যন্তও এর কেবল আলোচনাটুকু? কিছুই নেই!
শেষ পর্যন্ত তাহলে একই দিনে রোযা ও ঈদ ফরয হওয়ার মানদ- তারা কোন জিনিসকে বলবেন? বিশ্বের সর্বপ্রথম দেখাকে? মক্কার দেখাকে? মদীনার দেখাকে? কোথায় কোন হাদীসে আছে এই মানদ--র উল্লেখ? যদি একই দিন করার কোনো মানদ- না থাকে, এমনি এমনি তা ফরয হয় তাহলে বলব, এটা তো সবারই জানা যে, নবীযুগ থেকে এ পর্যন্ত কখনো পুরো মুসলিম উম্মাহর না একই দিনে রোযা শুরু হয়েছে, না একই দিনে কখনো ঈদ হয়েছে। অতএব সকলেই এই ফরয পরিত্যাগকারী বলে গণ্য হবে। ভাই ইকবাল কি তাই বলতে চাচ্ছেন?
নবী-যুগ কিংবা মুসলিম উম্মাহর প্রথম তিন প্রজন্মে একই দিনে করার কোনো উদাহরণ উল্লেখ করা থেকে এই বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যে, সে সময় অপারগতার কারণে এটা করা যায়নি- মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়; কারণ যতটুকু করা সম্ভব ছিল সেটুকুও করেননি তারা।
অপারগতার কারণে যদি একেবারেই আমল সম্ভব না হত তাহলে তো একে ফরযই করা হত না। শুধু ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও যদি ফরয হত তাহলে তারও উল্লেখ থাকত এবং প্রত্যেক পূর্ববর্তী প্রজন্ম পরবর্তীদের অসিয়ত করে যেতেন, ‘দেখ! এই যে প্রত্যেক অঞ্চলে নিজ নিজ দেখা মোতাবিক আমল হচ্ছে- এটা ওযরের কারণে। না হয় আসল ফরয তো এই যে, সারা দুনিয়ার সকল মুসলমান একই দিন রোযা ও ঈদ করবে।’ কিন্তু কোথায় উম্মাহ্র প্রথম তিন প্রজন্মের মাঝে এই মাসআলার আলোচনা কিংবা পরবর্তী কালসমূহে, আর কোথায় এ ধরনের অসিয়তের শুধু একটিমাত্র নমুনা?
মোটকথা, একই দিনে রোযা ও ঈদ করাকে শরয়ী ফরয সাব্যস্ত করা নিকৃষ্টতম বিদআত। আর এটাকে ঐসকল হাদীসের অর্থ ও মর্ম বলে দাবি করা সেসব হাদীসের স্পষ্ট বিকৃতি এবং এটা হাদীস জাল করারই একটি প্রকার, আমাদের এই বন্ধু নিজের অজান্তেই যে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন!
আল্লাহ তাআলাই সকলকে রক্ষা করার মালিক।
আজকের মত আলোচনা এ পর্যন্তই। তবে ভাই ইকবালের সাথে আমাদের আরো কিছু কথা হবে সামনে ইনশাআল্লাহ।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)