যিলহজ্ব ১৪৩৫   ||   অক্টোবর ২০১৪

মনীষীদের স্মৃতিচারণ

হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সিলেট বিভাগীয় আলেমদের স্মৃতিচারণ-২

সিলেটের আরেকজন হলেন হযরত শাহজালাল রাহ.-এর দরগাহ মসজিদের ইমাম ছাহেব মরহুম মাওলানা আকবর আলী রাহ.। আমাকে তিনি অনেক মহববত করতেন। তিনি ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। এখানে তিনি একটি মাদরাসা করেন, যা ‘কাসিমুল উলূম দরগাহ মাদরাসা’ নামে মশহুর। মুফতী শফী রাহ. তাকে মহববত করতেন। মাদরাসার নামটি তিনিই তাকে চিঠির মাধ্যমে দিয়েছেন।

সিলেটের আরেক আলেম, শায়েখ তাজাম্মুল আলী ছাহেব। তিনি ছিলেন মাদানী রাহ.-এর খলীফা। তাঁর কর্মজীবন কেটেছে যশোরে। তিনি  মরহুম মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ ছাহেবের উস্তায ও পীর। তাঁর থেকেই কাজী ছাহেব খেলাফত লাভ করেন। তিনি মুফতী ওয়াক্কাস ছাহেবেরও উস্তায ও পীর। তাঁর থেকে  তিনিও খেলাফত লাভ করেন।

      আরেকজন মাওলানা বশীরুদ্দীন (কুলাউড়া) ছাহেব। সিলেট গোলাপগঞ্জ থানার রানাপিং মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন মাদানী ছাহেবের  ভক্ত ও মুরীদ। অনেক বড় ওয়ায়েজ ছিলেন। খেলাফত পেয়েছেন  শাইখে কৌড়িয়া মাওলানা আবদুল করীম ছাহেব  থেকে।

      শাইখে কাতিয়া মাওলানা আমীনুদ্দীন ছাহেব (মৃত্যু : ১৪৩১ হি., ৩০ রমযান) মাদানী রাহ.-এর ছাত্র ও মুরীদ। তবে খেলাফত পেয়েছেন মাদানী রাহ.-এর খলীফা শাইখে কামারগাঁও ডা. আলী আকবর নূরী ছাহেব থেকে। শাইখে কাতিয়ার  সাথে বহুবার বিভিন্ন সফরে সঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। কাতিয়া হল সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার একটি গ্রাম। আশেকে মাদানী হিসাবে তিনিও মাশহুর। তৎকালীন সময়ে দারুল উলূম দেওবন্দে মাদানী ছাহেব যেখানে বসে পড়াতেন সেখানে বসার কোন গদি ছিল না। তখন শাইখে কাতিয়া নিজের একটি কম্বল তিন টুকরো করে একটি মাদানী ছাহেব বসার জন্য দিলেন। আরেকটি মাওলানা এজাজ আলী ছাহেবকে। আরেকটি ইবরাহীম বলিয়াভী ছাহেবকে। তখন মুহতামিম ছিলেন ক্বারী তৈয়ব ছাহেব।

      আরেকজন হলেন, মাওলানা নুরুদ্দীন গহরপুরী রাহ.। শাইখে কাতিয়ার আত্মীয়। একসাথে তাঁরা দেওবন্দে পড়ালেখা করেছেন। গহরপুরী রাহ. দারুল উলূম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদীসের নাম্বারে আউয়াল ছাত্র ছিলেন। তিনি ঢাকা বায়তুল মুকার্রম মসজিদের মারহুম খতীব ছাহেব মাওলানা উবায়দুল হক ছাহেবেরও সাথী ছিলেন। খতীব ছাহেব বলতেন, ‘তিনি আমার ক্লাসমেট’। গহরপুরী রাহ. ছিলেন মাদানী রাহ.-এর শিষ্য ও মুরীদ । তবে খেলাফত পেয়েছেন পূর্বোক্ত মাওলানা হাবীবুর রহমান রায়পুরী রাহ. থেকে।

      আরেকজন হলেন, মাওলানা সিরাজুল হক রাহ. মৌলভিবাজারী। তিনি মাদানী রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। হবিগঞ্জ শহরের নবীগঞ্জ থানাধীন  পুরানগাঁও-এ তাঁর জন্ম। এ গ্রামে মাদানী রাহ.-এর আরেকজন খলীফা আছেন, মাওলানা আব্দুল মুমীন ছাহেব দা. বা.। তিনি এখনো জীবিত।

      গুনই গ্রামে (হবিগঞ্জের পার্শবর্তী একটি গ্রাম) আছেন মাওলানা আব্দুল মান্নান ছাহেব দা. বা.। মাদানী রাহ.-এর খলীফা। তিনিও জীবিত আছেন। বানিয়াচং থানাধীন ধুলিয়াঘাটুয়া  গ্রামে মাদানী রাহ.-এর একজন খলীফা ছিলেন, মাওলানা আব্দুর রহমান শাইখে ধুলিয়াঘাটুয়া। এ নামে চুনারুঘাটের শাহপুরে মাদানী রহ.-এর আরেকজন খলীফা ছিলেন। গুমনাম পীর ছাহেব। অনেকেই তাকে জানত না। এদিকে সফরে আসলে আমার কাছেই আসতেন। অন্য কোথাও যেতেন না।

      মাদানী রাহ.-এর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় সিলেটের বাশকান্দীতে ‘দারুল উলূম বাশকান্দী’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে তিনি  একসাথে ৪০ জনকে খেলাফত দিয়েছেন। এর মধ্যে সিলেটের অনেকেই আছেন। যেমন, শায়খে গাজীনগরী মাওলানা আব্দুল হক, শায়খ আব্দুল মুমীন ছাহেব (পুরানগাঁও, হবিগঞ্জ), মাওলানা সিরাজুল হক মৌলভিবাজারী, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী বলরামপুরী প্রমুখ আলেম।

      ফুলবাড়ির শায়েখ মাওলানা আব্দুল মতীন চৌধুরী। মাদানী রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা। জমিদার বংশের ছিলেন। বিয়ে করেছেন পূর্বোক্ত গেদু মিয়া ছাহেবের বোনকে। মাদানী রাহ.-এর নিকট দুইবার সহীহ বুখারী পড়েছেন। প্রথমবার পড়ার পর তাসাওউফের মেহনতের জন্য মাদানী রাহ. তাকে মদীনায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে বেশ কিছুদিন ছিলেন। সেখান থেকে আসার পর আবার সহীহ বুখারীর দরসে  শরীক হন।

      মাওলানা আতহার আলী রাহ.। কর্মজীবন কেটেছে কিশোরগঞ্জে, তবে জন্ম সিলেট বিয়ানী বাজার এর গুইংগাদি গ্রামে। তিনি ছিলেন থানভী রাহ.-এর খলীফা। (তাঁর আরো আলোচনা আগামীতে বলার ইচ্ছা রইল)

      শ্রীমংগল থানাধীন বরুনার পীর ছাহেব মাওলানা লুৎফুর রহমান বর্ণবী রাহ.। ছোটবেলা থেকেই ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল ছিলেন। তখনি চেহারা-নমুনায়  বুযুর্গির ছাপ পরিলক্ষিত হত। সিলেট সুরমা নদীর পাড়ে গাছবাড়ী মাদরাসায় পড়ালেখা করেছেন। যে বাড়িতে জায়গীর থাকতেন ওই বাড়ির লোকেরা তখনি তাকে পীরের মতো সম্মান করত। অল্প বয়সে মাদানী রাহ. থেকে খেলাফত লাভ করেন। অনেকে তা বিশ্বাস করত না। একবার সিলেটে নয়া সড়কে ইতেকাফে থাকাবস্থায় মাদানী রাহ.-কে কেউ জিজ্ঞাসা করল, ‘কিয়া আপ নে লুৎফুর রহমান বর্ণবীকো ইজাযত দী? মাদানী ছাহেব বললেন, ‘কিয়া তোমকো শুবাহ হায়? আগার তোমকো শুবাহ হায় তো ফের ছুনলো, মায় উছকো ইজাযত দেতা হু’।

      উল্লেখ্য, সিলেট অঞ্চলে মাদানী রাহ.-এর অনেক খলীফা ছিলেন  তবে সিলেট বিভাগে মাদানী রাহ.-এর প্রথম খলীফা হলেন ডা. আলী আকবর নূরী (কামারগাঁও)। খুব সুন্দর চেহারার অধিকারী ছিলেন।

      এ হল মোটামুটি আমার সময়ের সিলেটের আলেমদের আলোচনা। আরো অনেকেই আছেন। তবে বয়সের কারণে এখন সবার কথা মনে পড়ছে না।

অনুলেখক-আব্দুল্লাহ মাসুম

 

 

advertisement