সফর ১৪৩১   ||   ফেব্রুয়ারী ২০১০

জীবন-নদীর বাঁকে বাঁকে - ১

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

ইতিহাস এমন এক সম্পদ, যা পূর্বসূরীর নিকট থেকে উত্তরসূরীর পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এজন্য প্রবীণ ব্যক্তিবর্গের কাছে বিনীত অনুরোধ-তাঁরা যেন তাঁদের পূর্বসূরী ও আকাবির-ব্যক্তিত্বদের বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতি লিপিবদ্ধ করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করে যান। মাখদূমে মুকাররম জনাব মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী যীদামাজদুহুম বৈচিত্রপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যৌবনে আকাবির-উলামা এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার লোকদের সাথে মেলামেশার বিশেষ আগ্রহ তাঁর মাঝে ছিল। এদিক থেকে তার অভিজ্ঞতা বেশ সমৃদ্ধ, যা লিপিবদ্ধ আকারে সংরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। আনন্দের বিষয় এই যে, তিনি তা লিখতেও আরম্ভ করেছেন। আল্লাহ তাআলা সতর্কতা ও ন্যায়-নিষ্ঠার সঙ্গে লেখার তাওফীক দান করুন এবং তাঁকে সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু দান করুন। আমীন। এখানে পাঠকদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইতিহাস ও স্মৃতিচারণমূলক লেখায় সব ধরনের তথ্য বর্ণিত হয়ে থাকে। স্মৃতিচারণে এমন অনেক ব্যক্তির কথাও আলোচিত হয়, যারা চিন্তা ও বিশ্বাসের দিক থেকে অনুসরণীয় নন, কিন্তু তার বিশেষ কোনো ঘটনায় অন্যের জন্য শিক্ষার উপাদান থাকতে পারে, কিংবা দুনিয়াবী জীবন-যাত্রায় কাজে লাগাতে পারে। এজন্য এ ধরনের প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাঠ ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য এই বিচার-বিবেচনাবোধ সক্রিয় থাকা অপরিহার্য যে, কোন বিষয়টি ‘ফা’তাবিরূ’র অন্তর্ভুক্ত, আর কোনটি ‘আনতুম আ’লামু বিউমূরি দুনিয়াকুম’ কিংবা ‘আলহিকমাতু দ-ল্লাতুল মু’মিন-এর অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেক বিষয়কে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রেখেই ফায়েদা হাসিল করতে হবে। তবে অনুসরণ ও অনুকরণের ক্ষেত্রে শুধু ওই সব ব্যক্তিকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে, যারা সিরাতে মুস্তাকীমের উপর অটল-অবিচল ছিলেন এবং চিন্তা-চেতনা, কর্ম ও চরিত্র এবং সূরত-সীরাত সকল বিষয়ে নবী-আদর্শের প্রতিচ্ছবি ছিলেন। এই মৌলিক কথাটি স্মরণ রাখলে এ ধরনের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাঠে অধিক সুফল পাওয়া যাবে। ইনশাআল্লাহ।-তত্ত্বাবধায়ক

মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়ে গেল। বয়স আমার সত্তর ছুঁই ছুঁই করছে। সে হিসাবে যদি বলি, বাতাসের মর্মর ধ্বনিতে যেন বিদায়ের করুণ সুর ধ্বনিত হচ্ছে তবে বোধ হয় খুব বেশি একটা ভুল হবে না। শৈশবে ঘরের গোয়ালে দুধেল গাই ছিল। নিজেদের গাছে আম, কাঁঠাল, নারকেল ছিল। মাছেরও প্রাচুর্য ছিল। মায়ের যত্ন-আত্তিও প্রথম সন্তান হিসাবে একটু বেশিই পেয়েছি। নেককার তাহাজ্জুদ-গোযার পিতার আদর-যত্ন ও শেষরাতের অকৃপণ দুআও পেয়েছি আশাতীতভাবে। সে জন্যেই কি না জানি না, এখনও দেহের তাকৎ একটু কম হলেও মনের তাকৎ একেবারে হারিয়ে বসিনি। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকালেই দেখি, একসাথে যাদের নিয়ে জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল তাদের অনেকেই এখন আর কাফেলায় নেই, পরপারের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। তখন কিছুটা একাকীত্ব বোধ করি। বছর দুয়েক আগে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক বিভিন্ন মনীষীর সাথে আমার সাক্ষাতের স্মৃতি মাসিক আলকাউসারে লিখতে বলেছিলেন। গত সন্ধ্যায় তিনি আবার তাঁর ফরমায়েশের পুনরোক্তি করলেন। বিগত এক সপ্তাহের মধ্যে আরো দু’জন জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি এ কথাটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আমাকে বলেছেন। সেদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা’ শীর্ষক একটি স্মরণিকা প্রকাশ ও উক্ত শিরোনামের আলোচনা বৈঠকে সভাপতির আসনে বসা মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ ঐ আসনে বসা অবস'ায়ই আমাকে কানে কানে এ তাগিদটা দিলেন। ৩/৪ দিন পূর্বে আমার প্রকাশিত মহানবী স্মরণিকার ৩১তম বার্ষিক সংখ্যার প্রথম কপিটি দিতে গেলাম হযরত শাহজালালের বিশেষ ভক্ত, লেখক অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব, বন্ধুবর দেওয়ান নূরুল আনওয়ার হোসায়ন চৌধুরীকে। তাঁকে জানালাম, জীবনের এই শেষ পর্যায়ে এসে আল কুরআনের একখানা যুগোপযোগী ও প্রাঞ্জল সহজ তরজমা ও তাফসীর রচনায় হাত দিয়েছি। এর প্রথম কপিটি এ স্মরণিকার মাধ্যমে আপনার হাতে তুলে দিলাম। বন্ধুবর এজন্য মোবারকবাদ দিলেন এবং এ উদ্যোগের যথেষ্ট প্রশংসাও করলেন। কিন্তু কেন যেন তিনিও বললেন, আপনার আত্মজীবনীটি কবে, কোন মাসে, কত তারিখে পাব? সুনির্দিষ্ট মাস-তারিখের ওয়াদা করতে না পারলেও তাকেও কথা না দিয়ে পারলাম না। মাত্র ১০/১২ দিনের ব্যবধানে তিন তিন জন জ্ঞানী গুণী ব্যক্তির এরূপ গুরুত্ব আরোপে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এঁদের প্রত্যেকেই অনুভব করছেন, আমার আয়ু বা জীবনের স্বচ্ছন্দ-বিচরণের দিনগুলো ফুরিয়ে এসেছে। গাঁটরি বাঁধার সময় হয়ে গেছে। আর দেরী করা সমীচীন নয়। কিন্তু এক মিনিটের দমের বিশ্বাস নেই এর মতো একটা চিরন্তন সত্য আপ্ত বাক্য সকলেরই জানা থাকা সত্ত্বেও কেন যেন প্রত্যেকেই আমরা এ ব্যাপারে খুবই উদাসীন। যেন আমাদের জীবনের হাজার বছর এখনো বাকি রয়ে গেছে। প্রতিদিনই যখন বাইরে থেকে ঘরে ফিরতে অন্তত দু’ একটা নতুন বই হাতে নিয়ে ফিরি তখন ঘরের গিন্নিও টিটকারি দিয়ে বলেন, কোথায় ঘরের রান্নাঘর পর্যন্ত টইটম্বুর করে রাখা বইগুলো বিলিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হবেন, তা না করে নতুন নতুন বই কেনা হচ্ছে! জীবনের শেষ সম্বলটুকু খরচ করে কম্পিউটার কেনা হচ্ছে। ইন্টারনেট নেওয়া হচ্ছে। বলি, একটু আল্লাহ আল্লাহ করে শেষ গাঁটরি বাঁধবেন, নাকি এসব নিয়েই এ বয়সে মেতে রইবেন? গিন্নিকে প্রবোধ দিয়ে বলি, আরে সব বই কি আর কিনি! বন্ধুবর লেখক-প্রকাশক অনেকে তাদের পুরনো লেখক বন্ধুকে তাদের লিখিত-প্রকাশিত পুস্তকাদি দানও তো করেন। আবার আমার সচিবালয় মসজিদে রাখা অনেক পুস্তকের দু’ চারটা পড়ে দেখার জন্য হাতে করে নিয়েও আসি। কথাগুলো আংশিক সত্য হলেও পুরোপুরি নয়। ঘরসংসারের শান্তির জন্যে এরূপ কিছু বলতেই হয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব মরহুম বলতেন, আমার বইগুলো হচ্ছে আমার বিবির সতীন। দুই চোখে ঐ বইগুলো দেখতে পারে না। আমার ঘরের অবস'াও তার চাইতে কম যায় না। তাই এই শেষ বয়সেও সবদিক সামাল দিতে একটু আমতা আমতা করতে হয়। এই যে সবাই বলছেন লেখ, লেখ। কিন্তু আমি লিখবটা কী? আমিই কী, আর আমার আবার আত্মজীবনী! হ্যাঁ, বাল্যের এক বিচক্ষণ ব্যক্তির আশাবাদকে সার্থক করে চীনের মহাপ্রাচীর থেকে নীল নদের তীর আর মিশরের পিরামিড-শৃঙ্গ পর্যন্ত পদচারণা হয়েছে। পূর্ব এশিয়ার গোবী থেকে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির তপ্ত বালির ঝাঁজ নাকে নিয়েছি। অপরদিকে চীনের চিয়াং কাটমোকের পলায়নস'লের সে গুহাটিও দেখেছি-৭০ বছর বয়সে চিয়াং যেখানে লাফ দিয়ে ছয় ফুট উঁচু বাধা ডিঙ্গিয়ে ঢুকে আত্মরক্ষা করেছিলেন তারই বিদ্রোহী বাহিনীর নিকট থেকে। সৌদী বাদশাহ খালিদের রাজপ্রাসাদ থেকে চীনের গ্রেটহলের আতিথ্য ভোগ করেছি। অপরদিকে শায়খুল আযহারের হাত থেকে কায়রোয় যেমন ডিগ্রি নিয়েছি তেমনি ইন্দোনেশীয় আহমদ সুকর্ণও যাকে বুয়া বা পিতা বলে সম্বোধন করতেন অথচ জীবনে একটি দিনের জন্যেও স্কুল-মাদরাসার পাঠাভ্যাস না করেও যিনি দশ হাজার পৃষ্ঠার তাফসীর ইন্দোনেশীয় ভাষায় লিখেছিলেন তার জাকার্তার বাড়িতেও আতিথ্যভোগের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেছি। হজ্বের মওসুমে সৌদী বাদশাহদের ধর্মীয় মুরব্বী ও অভিভাবক শেখ আবদুল্লাহ বিন বাযের তাবুতে হাযির হয়ে তার সাথে মোলাকাতের সুযোগ লাভ করেছি। কায়রোতে বিশ্বের সেরা কারী আবদুল বাসিত আবদুস সামাদের কেরাতের মজলিসে হাযির হয়েছি। কে জানে এতসব কথা লেখার মতো সময়ও বাকি আছে কি না! উপমহাদেশের নামিদামি কম মহাপুরুষকে তো দেখলাম না। মুফতীয়ে আযম পাকিস্তান তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনের বিশ্ববিখ্যাত লেখক মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ., মাওলানা ইউসুফ বিন্নুরী, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মাওলানা আবদুল হক হাক্কানী (আকোড়াখটক), মুফতী মাহমুদ, হাজারার মাওলানা গোলাম গৌছ হাজারভী, মাওলানা আবদুল্লাহ দরখাস্তী, বিখ্যাত ইলাউস সুনানগ্রনে'র লেখক আল্লামা যফর আহমদ উছমানী, ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক খ্যাত আরবী ভাষাবিদ, লেখক ও চিন্তাবিদ ফয়সল পুরষ্কারপ্রাপ্ত আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী, বাংলাদেশের বাহরুল উলূম সিলেটের মাওলানা মুহাম্মাদ হোসেন নিজপাটি, মাওলানা মুহাম্মাদ মুশাহিদ বায়ামপুরী, বি.বাড়িয়ার শায়খুত তাফসীর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, সদর সাহেব মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, অবিভক্ত পাকিস্তানে ইসলামী আন্দোলনের পথিকৃৎ ও পুরোধা হযরত মাওলানা আতহার আলী, সিলেটের শায়খে বাঘা মাওলানা বশীরুদ্দীন, মাওলানা বশীরুদ্দীন গোটকরনী, মাওলানা বদরুল আলম, চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদরাসার প্রাক্তন মুহতামিম হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব, ঢাকার হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব পীরজী হুজুর, রঈসুল উলামা ঢাকার মাওলানা মুফতী দীন মুহাম্মাদ খান, হযরত মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, জৌনপুরের হযরত মাওলানা আবদুল বাতিন জৌনপুরী, সিলেটের হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান বনভী ও মাওলানা আবদুল লতীফ ফুলতলী, তাবলীগ জামাতের আমীর মাওলানা আবদুল আযীয খুলনভী, মাওলানা ফয়জুল্লাহ ও হাজী ইয়াকুব, উর্দু কবি মাওলানা হরমজুল্লাহ মায়দা সিলেটী, পটিয়ার মাওলানা হাজী ইউনুস, হাটহাজারীর মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা আবদুল আযীয, বরিশাল ঝালকাঠির হযরত মাওলানা আযীযুর রহমান কায়েদ সাহেব হুজুর, শর্ষিণা মাদরাসার প্রাক্তন প্রিন্সিপাল মাওলানা তাজাম্মুল হোসেন, যশোর লাউড়িয়া মাদরাসার প্রাক্তন প্রিন্সিপাল শায়খ মাদানীর খলীফা হযরত মাওলানা তজম্মুল আলী সিলেটী, মোল্লা সফিউল্লাহ সাহেব সরহদীর খলীফা ফেনী আলিয়া মাদরাসার মাওলানা উবায়দুল হক সাহেব, মিশকাত শরীফের প্রথম সার্থক বঙ্গানুবাদক ও হাদীস শাস্ত্রের ইতিহাস রচয়িতা ফেনীর হযরত মাওলানা নূর মোহাম্মাদ আযমী, বিপ্লবী আলেম মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী, বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতার জনক মাওলানা আকরম খাঁ, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ, ভাষা আন্দোলনের স'পতি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ, রসরচনায় সিদ্ধহস- সিলেটের মতীন উদ্দীন আহমদ, সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন ও শামসুদ্দীন আবু জাফর, শিক্ষাবিদ লেখক মুসলিম চৌধুরী, প্রাবন্ধিক আবু ফাতিমা মো. ইসহাক, সাপ্তাহিক আরাফাত সম্পাদক মাওলানা আবদুর রহমান বিএটিটি, প্রাচীনতম বাংলা মাসিক আল ইসলাহ সম্পাদক নূরুল হক, জিব্রাইলের ডানা খ্যাত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলী, সর্বোপরি আমার উস্তাদ জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমের খতীবদ্বয় আল্লামা মুফতী আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদী বরকতী ও মাওলানা ওবায়দুল হক, আরবী কবি আল্লামা আবদুর রহমান কাশগরী, মাওলানা আবদুল্লাহ নদভী, মাদরাসা আলিয়ার ইতিহাস-লেখক মাওলানা আবদুস সাত্তার, ঢাকা আলিয়া মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল হাকিম মাওলানা আবদুল হাফিয ও মাওলানা আবদুল লতীফ ফারুকী, মাওলানা আবদুল খালেক নদভী (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম), প্রখ্যাত গবেষক লেখক ডক্টর মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ও তুখোড় লেখক ও বক্তা মাওলানা অলিউর রহমান প্রমুখ যেসব মনীষীর সংস্পর্শ ও স্নেহ লাভে ধন্য হয়েছি, বা যেসব পণ্ডিতদের সাক্ষাত লাভ করেছি তাদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করলেও একটি বিশাল পুস্তকের রূপ ধারণ করবে। যাদের ঘনিষ্ঠ সংসর্গে ধন্য হয়েছি তাদের তালিকায় আরো আছেন খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দীক আহমদ, মাওলানা মোস্তফা আলমাদানী, মাওলানা সৈয়দ মুসলেহুদ্দীন, মাওলানা আবদুল মজীদ খাঁ নাসিরাবাদী, হাকিম হাফিয আযীযুল ইসলাম, দৈনিক নাজাত সম্পাদক আবদুশ শহীদ, প্রখ্যাত আইনবিদ লেখক গাজী শামসুর রহমান,স্থপতি এ এইচ এম আবুল বশর, প্রাক্তন সচিব জমীরুদ্দীন আহমদ, সিলেটের সিনিয়র নেতা জসীমুদ্দীন ও আবদুস সামাদ আজাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ও ডক্টর মুহাম্মদ ইসহাক, বংশালের আহলে হাদীস নেতা মাওলানা মুহাম্মাদ আরিফ, মাসিক আল ইসলাম সম্পাদক মুমিনুদ্দীন আহমদ, প্রখ্যাত সংবাদিক মুদাব্বির, আঞ্জুমানে হিদায়াতুল ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা জয়নাল আবেদীন, তাবলীগী মুরব্বী মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা সফিউল্লাহ চাঁদপুরী, তাঁর ভাই মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ। আরেকটি ছোট ঘটনাও আমাকে কিছুটা উদ্বুদ্ধ করছে। তা হল, ৮/১০ বছর আগে সিলেট বিষয়ক ডজন খানেক গবেষণা পুস্তকের লেখক গ্রুপ ক্যাপ্টেন জনাব ফজলুর রহমান আমার কাছে আমার লিখিত কয়েকটি নির্বাচিত কবিতা চাইলেন। তিনি তখন সিলেটের কাব্যসাধনা শিরোনামে ৫০০ বছরের একটা ইতিহাস দাঁড় করানোর কাজে হাত দিয়েছেন। উদার মন থেকে তিনি প্রস্তাবটা করলেও আমি এই ভেবে অনেকটা চুপসে গেলাম যে, আমি এমন কী-ইবা লিখেছি যে, পাঁচ শ’ বছরের সাহিত্য সাধনার মধ্যে তা স্থান লাভ করবে? দুই তিন বার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও আমি কিছুই তাকে দিলাম না। বছর খানেক পর তিনি কবি মাহমুদ লশকরকে নিয়ে আমার মুহাম্মাদপুরস্থ নুরজাহান রোডের বাসায় এসে হাযির। হাতে তিন শতাধিক পৃষ্ঠার সিলেটের কাব্যসাধনা। আমার বিস্ময়ের অন্ত রইল না যখন দেখলাম, আমার দুটি কবিতাও তাতে স্থান পেয়েছে। তিনি বিগত ৫০ বছরের সিলেটের মাসিক আল-ইসলাহ এর ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে আমাকেও উদ্ধার করে এনেছেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালে আল ইসলাহর শাহজালাল সংখ্যায় প্রকাশিত আমার সর্বপ্রথম কবিতা ‘শাহজালালের ঝরণা’ তাতে স্থান পায়নি। কারণ ঐ কবিতাটিতে আমার নাম কেবল মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ছাপা হয়েছিল। তাতে জালালাবাদী শব্দটি ছিল না। অথচ ঐ কবিতাটির কাব্যমান বা স্মৃতি হিসাবে মূল্য বেশি বৈ কম ছিল না। সাপ্তাহিক যুগভেরীতে প্রকাশিত ‘মানুষ পাওয়া দায়’ কবিতাটিও খুবই উল্লেখযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ফলে আমার কবিতা বা কাব্যপ্রতিভার আংশিক প্রতিফলনই তাতে ঘটেছে। কিন্তু এজন্য তো তিনি দায়ী নন। নিজের আত্মকথা নিজে না লিখলে এ জাতীয় ব্যাপার ঘটতেই পারে। এসব কথা বিবেচনা করে আল্লাহর উপর ভরসা করে আমি একটি কিছু লিখে শুভাকাঙ্খীদের মনরক্ষার চেষ্টা করতেই মনস্থ করেছি। বাকি আল্লাহর মর্জি। লিখতে বসলেই লেখা যায় না, প্রথমে তা গোছাতে হয়। পরিকল্পনার ছক আঁকতে হয়। সব কথা স্মরণ করে অতীতের গহ্বর থেকে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে বের করে আনতে হয়। মুখে বর্ণনা করতে গেলে সেসব ঝামেলা থাকে না। মাওলানা আবদুল মালেককে বললাম, তাহলে শুনুন কিছু ঘটনা। তিনি বললেন, শুনলে কী হবে, এক কানে শুনব অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কারো কোনো কাজে লাগবে না। লিখে দিতে হবে। আসলে তার কথাই ঠিক। তাই ছোটবেলায় শোনা বাংলা কবিতায় আছে- লিখিয়া রাখিলে তা যে শতাব্দে না ধায়/বলিলে মুখের কথা বাতাসে মিলায়। তাই আত্মস্মৃতি বা জীবনস্মৃতি লিখে দেওয়ার অঙ্গীকারে আমি আবদ্ধ হয়ে পড়লাম। সে হিসাবে আমার ‘জীবন-নদীর বাঁকে বাঁকে’ এর ভূমিকা স্বরূপ এ ক’টি কথা নিবেদন করলাম। আল্লাহ তাওফীক দিলে ইনশাআল্লাহ ধীরে ধীরে নানা বাঁকে অর্জিত নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

 

advertisement