যিলহজ্ব ১৪৩৫   ||   অক্টোবর ২০১৪

ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

প্রশংসার ক্ষেত্রে (১)

সৌন্দর্য ও সদগুণের প্রতি মুগ্ধতা মানবমনের চিরায়ত ধর্ম। সেই মুগ্ধতা যখন বোধ-অনুভব ছাপিয়ে ভাষায় রূপায়িত হয় তখন তা হয় প্রশংসা। সুতরাং প্রশংসা মানবমনের এক অনিবার্য দ্যোতনা। স্বভাব-ধর্ম ইসলামে এ দ্যোতনা নিন্দিত নয়- যতক্ষণ তা স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে না যায়। প্রশংসা যখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় তখন আর তা প্রশংসনীয় থাকে না; বরং নিন্দনীয় স্তাবকতায় পরিণত হয়ে যায়। ইসলাম স্তাবকতাকে অনুমোদন করে না। কেননা তা প্রশংসাকারী ও প্রশংসিত উভয়ের পক্ষে ক্ষতিকর। অতএব প্রশংসায় মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া ও মধ্যপন্থা অবলম্বন জরুরি। অর্থাৎ যে যতটুকু প্রশংসার উপযুক্ত ঠিক ততটুকু প্রশংসা করা, তার বেশি নয়।

  তা কে কতটুকু প্রশংসার উপযুক্ত তা কিভাবে নির্ণিত হবে? এ ব্যাপারে প্রথম কথা হচ্ছে, সৃষ্টিমাত্রেরই রূপ-গুণে সীমাবদ্ধতা আছে। অন্তহীন সৌন্দর্য ও অসীম গুণাবলীর মালিক কেবলই আল্লাহ তাআলা। তাই তো ইরশাদ হয়েছে,

وَلَوْ أَنَّمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ شَجَرَةٍ أَقْلَامٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِنْ بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

  যদি ভূ-পৃষ্ঠের গাছ-গাছালি সব কলম হয়ে যায় এবং সাগরের সাথে আরও সাত সাগর মিলে কালি হয়ে যায়, তবু আল্লাহর মহিমাকীর্তন শেষ হবে না।’ (লুকমান : ২৭),

  তাই আল্লাহর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি বলে কিছু নেই। যে যত প্রশংসাই করম্নক, তাঁর অন্তহীন মহিমার সামনে তা কণামাত্রও নয়। দুনিয়ার সকল কবি-সাহিত্যিক, দুর্দামত্ম সব ভাষা-পণ্ডিত স্বীকার করতে বাধ্য-

اللهم لا نحصي ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك

  ‘হে আল্লাহ! আমরা তোমার গুণগান করে কখনও শেষ করতে পারব না। বস্তুত তুমি নিজেই নিজের যেমন গুণগান করেছ, তুমি তেমনই’।

  তো আল্লাহ তাআলার প্রশংসার বাড়াবাড়িমূলক যে প্রান্তিকতা তাতে লিপ্ত হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভবই নয়। তবে শৈথিল্যমূলক প্রান্তিকতা অবশ্যই হতে পারে এবং অহরহ তা হচ্ছে। এক তো অধিকাংশ লোকই এক্ষেত্রে গাফলতির শিকার। প্রতি মুহূর্তে তাঁর অগণ্য নিআমত ভোগ করছে, অথচ একটিবারও মুখে উচ্চারণ করে না الحمد لله ‘আল্লাহরই সকল প্রশংসা’। দ্বিতীয়ত অনেকে তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে এমনসব বিশেষণ তাঁর প্রতি আরোপ করে, যা তাঁর জন্য মেটেই শোভন নয়। অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করে ফেলে। অথচ আল্লাহ তাআলা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন ليس كمثله شيء ‘তাঁর অনুরূপ নয় কোন কিছুই’। উদাহরণত কেউ কেউ তাঁর আরশকে রাজা-বাদশাহর সিংহাসনের মত মনে করে এবং বলে থাকে, রাজা-বাদশাহ যেমন সিংহাসনে সমাসীন হয়, তিনিও সেইরকম আরশে আসন গ্রহণ করে আছেন (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ এর ফলে আল্লাহ তাআলার অসীম সত্তাকে স্থান-কালে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয় এবং তাঁর জন্য দেহত্ব, অনিত্যতা প্রভৃতি মানবীয় গুণ অনিবার্য হয়, যা থেকে আল্লাহ সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। এ জাতীয় বিশ্বাস তাঁর মহামর্যাদার সাথে বিলকুল সংগতিপূর্ণ নয়। এতে তো আল্লাহকে মাখলূকের সাথে তুলনা করা হয়ে যায়।

  কুরআন-সুন্নাহয় আরশের কথা এসেছে এবং তার বিশালত্বের বিবরণ এসেছে। আরশ আল্লাহ তাআলার মাখলূক। আল্লাহর সৃষ্টির দ্বারাই তা অস্তিত্বে এসেছে। আল্লাহ আরশের খালিক এবং রব। আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে ‘রববুল আরশিল আযীম’ গুণটি কুরআন -সুন্নাহয় অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। এই আরশের সাথেই সম্পৃক্ত আল্লাহ তাআলার একটি ক্রিয়া ইসতিওয়া (استواء) -এর কথা কুরআন মজীদের একাধিক আয়াতে উলেস্নখিত হয়েছে। যেমন সূরা ইউনুসের ৩ নং আয়াতে এসেছে,

إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

  (তরজমা) নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশে ‘ইসতিওয়া’ গ্রহণ করেন। তিনি সকল কিছু পরিচালনা করেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ (তাঁর কাছে) কারও পক্ষে সুপারিশ করার নেই। তিনিই আল্লাহ- তোমাদের প্রতিপালক। সুতরাং তাঁর ইবাদত কর। তবুও কি তোমরা অনুধ্যান করবে না?

  হযরত মাওলানা তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম এই আয়াতের অনুবাদের টীকায় লেখেন,

  استواء ‘ইসতিওয়া’ -এর শাব্দিক অর্থ সোজা হওয়া, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, সমাসীন হওয়া ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি-সদৃশ নন। কাজেই তাঁর ‘ইসতিওয়া’ ও সৃষ্টির ইসতিওয়ার মত নয়। এর স্বরূপ আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। এ কারণেই আমরা কোনও তরজমা না করে হুবহু শব্দটিকেই রেখে দিয়েছি। কেননা আমাদের জন্য এতটুকু বিশ্বাস রাখাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা নিজ শান মোতাবেক আরশে ‘ইসতিওয়া’ গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে এর বেশি আলোচনা-পর্যালোচনার দরকার নেই। কেননা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা এর সবটা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। (তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১১)

  কেউ কেউ আল্লাহ তাআলার ‘ইসতিওয়া’ ক্রিয়াটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করে ফেলে যাতে মনে হয় তারা (استوى) ‘ইসতাওয়া’কে সরাসরি جلس (বসা) -এর অর্থে মনে করে। এখানে আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য- কুরআন মজীদে ‘ইসতিওয়া’কে আল্লাহর فعل (ক্রিয়া) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কথা থেকে প্রতীয়মান  হয় যে, তারা এটিকে ‘সিফাতে যাতে’র মত মনে করে। এ সব কিছুই সালাফের অনুসৃত ‘মানহাজের’ পরিপন্থী।

  এ ব্যাপারে মধ্যপন্থা হল আরশের অসিত্মত্বকে অবশ্যই স্বীকার করা এবং ‘ইসতিওয়া’রও আকিদা রাখা। কিন্তু ‘ইসতিওয়া’র বিষয়টাকে অব্যাখ্যাত রাখা। অর্থাৎ ‘ইসতিওয়া’ তো অবশ্যই হয়েছে, কিন্তু সে ‘ইসতিওয়া’ কী রকম তা আমাদের বোধ-বুদ্ধির অতীত। অমত্মত ইহজগতে বসে তা উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

  যা হোক আল্লাহ তাআলার সত্তা ছাড়া আর কেউ সীমার উর্ধ্বে নয়। নবী রাসূলগণ নিঃসন্দেহে মহামানব ছিলেন, কিন্তু সীমার অতীত ছিলেন না কিছুতেই। তাঁরা অবশ্যই মাসূম ও নিষ্পাপ ছিলেন, কিন্তু সর্বাবস্থায় তাঁরা মানুষই ছিলেন। কাজেই তাদের জন্য উপযুক্ত প্রশংসা তাই, যা তাঁদের নিষ্পাপতা ও নবুওয়াতী মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করবে  না, আবার তাদেরকে অপার্থিব ও অতিমানবিক সত্তায়ও পরিণত করবে না, কিংবা তাদেরকে সৃষ্টিকর্তার সত্মরে উপনীত করবে না। বরং মানুষ নবী সর্বাবস্থায় মানবজাতির সর্বোত্তম আদর্শ হয়েই থাকবেন। তাদের প্রশংসা-জ্ঞাপনে এটাই হল মধ্যপন্থা। প্রাণভরে তাদের মহিমাকীর্তণ করুক, তাতে দোষের কিছু নেই, বরং সওয়াবের কাজরূপেই গণ্য হবে। বিশেষত খাতামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুসত্মফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণগানে কিছু বলা বা লেখা তো অত্যন্ত বরকত ও সৌভাগ্যের ব্যপার। সাহাবায়ে কিরাম থেকে আজ পর্যন্ত এ উম্মত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণগানকে তাদের নিত্যদিনের একটি করণীয় হিসেবেই গণ্য করে আসছে। মজলিস-মাহফিলের বয়ান-বক্তৃতার বাইরে এটা লেখনী-চর্চার এক গৌরবজনক বিষয়রূপেও বরিত। বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নবী-প্রশস্তিমূলক গদ্য ও পদ্য রচনার বৈচিত্রপূর্ণ বিপুলতা এক মূর্তিমান বিস্ময়। সন্দেহ নেই সেসব রচনার অংশবিশেষে ভক্তির সীমালংঘনও আছে, কিন্তু মধ্যপন্থার শর্তে উত্তীর্ণ এমন বহু কালজয়ী রচনা আছে, যা তার রচয়িতাকে নাতের জগতে অমরত্ব দান করেছে। চাচা আবু তালিবের লামিয়া, সাহাবী হযরত কা‘ব ইবনে যুহায়রের বানাত সু‘আদ, বূসীরীর কাসীদা বুরদা (দু’চারটি পঙ্তি বাদ দিয়ে যেগুলোতে কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়েছে) প্রভৃতি রচনা নবী-প্রশস্তির অপূর্ব নিদর্শন। মহান সাহাবী কবি হযরত হাসসান ইবনে ছাবিত রা.-এর নাম চিরকাল এ তালিকার শীর্ষস্থানেই শোভা পাবে। সীমার ভেতর থেকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মহাপুরুষের রূপ-গুণ বড় চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। একটা নমুনা দেখুন-

وأحسن منك لم ترقط عيني + وأجمل منك لم تلد النساء

خلقت مبرأ من كل عيب + كأنك خلقت كما تشاء

‘তোমার চেয়ে উত্তম কাউকে কখনও দেখেনি এ চোখ

তোমার চেয়ে সুন্দর কাউকে জন্ম দেয়নি কোনো নারী

তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সম্পূর্ণরূপে দোষমুক্ত করে

যেন তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তোমার চাহিদামত’

  আমাদের কর্তব্য নবী-প্রশস্তিতে এসব আদর্শ পুরুষের অনুসরণ করা, যাতে ভাবাবেগের আতিশয্যে দিশাহারা হয়ে না পড়ি এবং প্রশংসা করতে গিয়ে এমন কিছু না বলে ফেলি, যা আখেরে আমাকে নিন্দিত ও ধিকৃত করে ফেলে। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সমস্ত নবী-রাসূলেরই আবির্ভাব হয়েছিল তাওহীদের বানী প্রচার করার জন্য। সে হিসেবে আমাদের প্রশংসা অবশ্যই তাওহীদী চেতনার সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। তাওহীদের স্থানে শিরকের প্রচারণায় লিপ্ত না হয়ে পড়ি সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। একদা একদল শিশু তাঁর গুণকীর্তনে গেয়ে উঠেছিল  وفينا نبي يعلم ما في غد ‘আমাদের মাঝে আছেন এক নবী - যিনি জানেন আগামী দিনে কী ঘটবে’। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংগে সংগে থামিয়ে দিলেন এবং বললেন, এতক্ষণ যা বলছিলে তাই বল। বারণ করেছিলেন এ কারণে যে, এটা তাঁর মিশনবিরোধী কথা। তাঁর তো প্রচার ছিল ‘আমি গায়েব জানি না’ (হূদ : ৩১)। ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যারা আছে কেউ গায়ব জানে না। কেবল আল্লাহই তা জানেন’ (নামল : ৬৫)।

  তাছাড়া এটা এক রকম মিথ্যাকথনও বটে। কেননা যেখানে কুরআন মজীদ বলছে আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েব জানে না, সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি ভূত-ভবিষ্যতের সবকিছু জানেন বলে দাবি করা মিথ্যা নয়ত কী? সুতরাং প্রশংসার উপযুক্ততা নির্ণয়ের একটা মাপকাঠি সত্যানুগতাও। অর্থাৎ কারও প্রশংসা করার সময় এদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সে প্রশংসা বাস্তবসম্মত কি না? যে কথা বলা হচ্ছে তা আসলেই সেই ব্যক্তির মধ্যে আছে কি না?

  বর্তমানকালে চারদিকে অসত্য প্রশংসার ছড়াছড়ি। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি আর সব সীমালংঘনকে ছাড়িয়ে গেছে। জীবিত ও মৃত কেউ এই বাড়াবাড়ির অত্যাচার থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। মৃত ব্যক্তির প্রশংসার অতিরঞ্জন তুলনামূলক সহজ ও নিরাপদ। তার সত্যতা যাচাই অপেক্ষাকৃত কঠিন। তাই মৃত ব্যক্তির ভক্তকুল তার গুণগানের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। প্রত্যেকের চেষ্টা সকলকে ছাড়িয়ে তাকে কত উচ্চে তোলা যায়। এজন্য আজগুবি ও অবিশ্বাস্য গল্প বানাতেও ছাড়ে না। একবারও চিন্তা করা হয় না এসব বানোয়াট প্রশংসা তার নিজের জন্য তো বটেই, মৃতপ্রশংসিতেরও কতটা ক্ষতিরর কারণ হচ্ছে। হাদীস শরীফে আছে, কেউ মারা যাওয়ার পর শোকার্ত লোকেরা যদি তার গুণগান করে কাঁদে তবে ফিরিশতাগণ তাকে এই বলে তিরস্কার করে যে, তুমি কি এরকমই ছিলে নাকি? কোনও বর্ণনায় আছে, সে কারণে গুনকীর্তনই যখন মৃত ব্যক্তির ক্ষতির কারণ হয়, তখন যারা ঠাণ্ডা মাথায় বুঝে-শুনে অতিরঞ্জন করে তারা তার কী উপকারটা করছে? ভক্ত-অনুরক্তদের অমূলক বাড়াবাড়ি তো হযরত ঈসা আলাআহিস সালামের মত মহান পয়গম্বরকেও কৈফিয়তের সন্মুখীন করবে। কুরআন মাজীদে আছে, আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে বলবেন, ‘হে ঈসা ইবনে মারয়াম! তুমিই কি মানুষকে বলেছ যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাকেও উপাস্যরূপে গ্রহণ কর?’ (মায়িদা : ১১৬) যদিও হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে সক্ষম হবেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলার পাশাপাশি উপাসিত হওয়ার জন্য তাঁর দরবারে কৈফিয়তের সম্মুখীন হওয়াটা একটা লজ্জার বিষয় তো বটে! এর দ্বারা মৃত বুযুর্গদের অনুসারী এবং রাষ্ট্র ও দলনেতা বা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিবর্গের ভক্ত-অনুরক্তদের সবক নেওয়ার দরকার রয়েছে। তারা তো প্রশংসা করে করে তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বকে আসমানে তুলছে, কিন্তু আসমানী আদালতে সেজন্য তাদেরকে কি কঠিন লজ্জার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তা কি একবারও চিন্তা করছে?

  প্রশংসার বাড়াবাড়ি হয় জীবিতদের বেলায়ও। তা উৎকটভাবে হয় দ্বীনী বা দুনিয়াবী নেতৃবর্গের ক্ষেত্রে। উদ্দেশ্য থাকে তাদের নৈকট্য অর্জন করা এবং বেশিরভাগেরই পরম লক্ষ্য কোনো অন্যায় সুবিধা ভোগ করা। এর জন্য প্রশংসার আদলে যা করা হয় তা নিছক তোষামোদ ও চাটুকারিতা। তার সাথে না থাকে ভক্তি-ভালবাসার কোন সম্পর্ক এবং না কোনওরূপ সত্যনিষ্ঠা। কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে সেই আশায় নেতৃপর্যায়ের লোকের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় এবং তাদের খুশি করার জন্য এমনসব বিশেষণে তাদেরকে বিশেষিত করা হয়, বাস্তবে যার ছিটে-ফোঁটাও তাদের মধ্যে উপস্থিত থাকে না। জ্ঞানতাপস, শিক্ষানুরাগী, জনদরদী প্রভৃতি গুনাবলীর গালভরা উচ্চারণে যাদেরকে ফোলানো হয়, লেখাপড়ার ধার তারা ঠিক কতটুকু ধারে? আর্ত-মানবতার বেদনায় তারা কতখানি ব্যথিত হয়? গণমানুষের জ্ঞান-বিমুখতা ও দু:খ-দুর্দশায় যারা সর্বাপেক্ষা বেশি দায়ী, তাদের পক্ষে এ জাতীয় স্তাবকতাকে স্বার্থের ধান্ধা ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি? সুতরাং এরকম প্রশংসা কেবল মিথ্যাচারই নয়, কপটতা ও মতলববাজিও। এর অবৈধতা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর দরকার পড়ে না। তাই এটা আমাদের আলোচনার বিষয়ও নয়। আমাদের আলোচনা সেই প্রশংসা সম্পর্কে, যা সত্যিকারের মুগ্ধতা থেকে উৎসারিত।

  দ্বীনী বা দুনিয়াবী নেতৃবর্গের প্রতি মুগ্ধতাজাত ভক্তি থেকে যে প্রশংসা উচ্চারিত হয়, তার বৈধতার জন্যও সত্যনিষ্ঠা জরম্নরি। অর্থাৎ প্রশংসা কেবল অকপট হওয়াই যথেষ্ট নয়, বাস্তবসম্মতও হতে হবে। ভক্তজনদের অনেক সময়ই সেদিকে লক্ষ্য থাকে না। ভক্তির আতিশয্যে তারা মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দৃষ্টি থাকে কেবলই প্রশংসার দিকে। বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা থাকে না। ফলে যা-ই বলা হয় বাড়িয়ে বলা হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে বানিয়েও বলা হয়। অর্থাৎ কেবল তিলকেই তাল করা হয় না, জিরোকেও হিরো করে তোলা হয়ে যায়। উভয় অবস্থায়ই কমবেশি অসত্য কথন তো হয়ই, কিন্তু প্রশংসার বাতাবরণে সে অনুভূতি আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর এভাবে নিজেকে অহেতুক গুনাহগার বানানো হয়। এই অহেতুক গুনাহে উম্মত যাতে লিপ্ত না হয় তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিক নির্দেশনা দান করেন-

إذا كان أحدكم مادحا صاحبه لامحالة، فليقل : احسب فلانا والله حسيبه، ولا ازكى على الله أحدا، احسبه -ان كان يعلم ذاك- كذا وكذا

তোমাদের কেউ যখন তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রশংসা করবেই তখন তার সম্পর্কে যেন কেবল এতটুকুই বলে যে, ‘আমি অমুককে এমন-এমন মনে করি, তবে বাস্তবে সে কেমন সে হিসাব আল্লাহ তাআলার কাছেই আছে, আমি আল্লাহর জ্ঞানের বিপরীতে কারও সাফাই দিচ্ছি না। এটাও বলবে কেবল তখনই যখন তার সম্পর্কে সেরকম জানা থাকে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৩০০০ )

  চিন্তা করে দেখুন, কী কঠিন সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। এক তো প্রশংসা করা যাবে কেবল এমন বিষয়ে যা জানা আছে, অজ্ঞাত বা আনুমানিক বিষয়ে কিছুতেই নয়। দ্বিতীয়ত জানা বিষয়েও নিশ্চয়তাবোধক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। যেমন, তিনি একজন আমানতদার লোক, ‘অমুক ব্যক্তি পরহেযগার’ ইত্যাদি। বরং বলতে হবে, আমি তাকে পরহেজগার মনে করি বা আমার জানামতে সে একজন আমানতদার ইত্যাদি। তারপরও প্রকৃত অবস্থাকে আল্লাহ তাআলার উপরই ন্যস্ত করতে হবে। যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান তাঁরই আছে, আমরা অতি সামান্যই জানি।

  এ হাদীসে যে والله حسيبه (আল্লাহ তাআলাই তার প্রকৃত অবস্থার হিসাব গ্রহণকারী) বলার তালীম দেওয়া হয়েছে, এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর দ্বারা যেমন সতর্ক করা হয়েছে, সে যেন অসত্য কিছু না বলে, তেমনি প্রশংসা দ্বারা প্রশংসিত ব্যক্তির যে ক্ষতি হতে পারে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার প্রতিকারেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রশংসা দ্বারা প্রশংসিত ব্যক্তির অন্তরে অহংকার অহমিকা জন্মানোর অবকাশ থাকে আর বাস্তবিকই যদি তা জন্ম নিয়ে ফেলে তবে তো প্রশংসা দ্বারা তার মস্তবড় ক্ষতি করে ফেলা হল। সুতরাং হে প্রশংসাকারী! তুমি তোমার প্রশংসায় সীমালংঘন তো করবেই না, অধিকন্তু তোমার জানামতেও যে প্রশংসা করবে, তার সত্যাসত্যও আল্লাহর উপর ন্যস্ত করবে। যাতে প্রশংসিত ব্যক্তির অন্তরে আত্মতুষ্টি জন্ম নিতে না পারে এবং ‘কিছু একটা বনে গেছে’-এই অহংবোধের শিকার না হয়ে পড়ে।

  মানুষ যখন আত্মতুষ্টি ও আত্মম্ভরিতার শিকার হয়ে পড়ে তখন তার অগ্রগতি আপনা-আপনিই থেমে যায়। নেতৃস্থানীয় হলেই  সে যে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে এমন তো নয়; দ্বীনের পথে উন্নতির কোন শেষ নেই। তাই পরিতুষ্টিরও কোন অবকাশ নেই। পরিতুষ্টি কেবল উন্নতিকেই ব্যাহত করে না, অবনতিকেও ত্বরান্বিত করে। কেননা গতিশীলতা সৃষ্টির ধর্ম। তাকে উর্ধ্বমুখী না রাখলে অধ:গামী হবেই। পরিতুষ্ট ব্যক্তি কখনও বাড়তি অর্জনের চেষ্টা করে না, ফলে অর্জিত ধনও ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। সেই সংগে দেখা দেয় আত্মগর্বের সর্বনাশা ব্যধি। যা তার যাবতীয় সদগুনকেও ধ্বংস করে দেয়। প্রশংসিত ব্যক্তিকে সেই সর্বনাশ থেকে রক্ষা করার জন্যই কিছু বনে যাওয়ার ধারণা তাকে না দেওয়া এবং তার প্রকৃত অবস্থাকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য।

     বলাবাহুল্য উচ্চ প্রশংসার এ ক্ষতি কেবল নেতৃস্থানীয়দেরই হিস্যা নয়। সাধারণ শ্রেণীও এর আওতায় পড়ে যায়। সমস্তরের লোক কিংবা বিশিষ্টদের পর্যায়ে পৌঁছায়নি এমন লোকের প্রশংসায়ও সীমা রক্ষা করা উচিত। এমনকি ছোটদের পিঠ চাপড়ানি দিতেও তা তাকে আত্মতুষ্টিতে লিপ্ত করবে কি না সেদিকে লক্ষ্য রাখা কর্তব্য। ব্যক্তি যদি আত্মশক্তিতে বলিয়ান না হয়, তাকওয়া-পরহেযগারিতে যত্নবান না থাকে এবং নিজ অবস্থা সম্পর্কেও যথেষ্ট সচেতন না থাকে, তবে কেবল উচ্চ প্রশংসাই নয়, স্বাভাবিক প্রশংসাও তার অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করতে পারে। একারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এক ব্যক্তি অন্য একজনের প্রশংসা করলে তিনি তাকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, (অর্থ) তুমি তো লোকটার মেরুণ্ড ভেংগে দিলে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৩০০০)। কাজেই প্রশংসা বৈধ হওয়ার জন্য প্রশংসিত ব্যক্তির ক্ষতি হয়ে যায় কি না সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখাও শর্ত।

 

 

 

advertisement