তাযকিয়া ও ইহসান এবং ডা. আবদুল হাই আরেফী রাহ. - ১
মাওলানা সাঈদ আহমদ
পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণ করার সময় হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আ. ও হযরত ইসমাঈল আ. আল্লাহ তাআলার দরবারে এ দুআও করেছিলেন যে, (তরজমা) হে আমাদের রব! তাদের নিকট তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের সামনে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন।-সূরা বাকারা : ১২৯
উপরোক্ত আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রিসালাতের তিনটি উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে : এক. আয়াত পাঠ করা, দুই. কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়া ও তিন. মানুষের স্বভাব-চরিত্রের তাযকিয়া করা।
তাযকিয়ার অর্থ হচ্ছে, বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করা। বাহ্যিক অপবিত্রতার অর্থ তো সাধারণ মুসলমানেরও জানা আছে। আর আত্মিক অপবিত্রতা হচ্ছে, কুফর, শিরক, গায়রুল্লাহর উপর ভরসা, ভুল আকিদা-বিশ্বাস এমনিভাবে অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, দুনিয়ার মোহ ইত্যাদি। যদিও কুরআন ও হাদীসে এসব বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে, তা সত্ত্বেও তাযকিয়াকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি স্বতন্ত্র দায়িত্ব সাব্যস্ত করে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কেবল পুঁথিগতভাবে কোনো বিষয়ের জ্ঞানার্জন দ্বারাই বাস্তব ক্ষেত্রে ঐ বিষয়ের প্রয়োগ-পদ্ধতি জানা যায় না এবং তাতে পূর্ণতা অর্জিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন কোনো মুরব্বির তত্ত্বাবধানে অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে অভ্যাসে পরিণত করা। তাসাওফ ও সুলূকের ময়দানে শায়খে কামেলের তরবিয়তের উদ্দেশ্য এটিই যে, তিনি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব ক্ষেত্রে অনুশীলন করিয়ে তা অভ্যাসে পরিণত করান।
আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির আদিকাল থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত মানুষের হিদায়াত ও সংশোধনের জন্য দুটি ধারা অব্যাহত রেখেছেন : এক, আসমানী গ্রন্থসমূহের ধারা। দুই. তা শিক্ষা দানকারী রাসূলগণের ধারা। এ দ্বারা জানা গেল যে, মানুষের সঠিক শিক্ষা ও তরবিয়তের জন্য শুধু কিতাব বা শুধু মুরব্বী যথেষ্ট নয়; বরং একদিকে খোদায়ী দিকনির্দেশনা ও খোদায়ী বিধানের প্রয়োজন। অপরদিকে একজন শিক্ষক ও মুরব্বীরও প্রয়োজন, যিনি শিক্ষা ও তরবিয়ত দ্বারা মানুষকে খোদায়ী হিদায়াত সম্পর্কে অবহিত করে তা তাদের অভ্যাসে পরিণত করাবেন। কারণ, মানুষের প্রকৃত শিক্ষক একজন মানুষই হতে পারে। এ কারণেই ইসলামের সূচনা যেমন একটি কিতাব ও একজন রাসূল দ্বারা হয়েছে, তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও একদিকে পবিত্র শরীয়ত অপরদিকে আল্লাহ ওয়ালাগণের ধারা অব্যাহত রয়েছে। পবিত্র কুরআনেও এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে।-তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ১/৩৩২-৩৩৬
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর শীর্ষস্থানীয় একজন খলীফা ছিলেন আরেফ বিল্লাহ হযরত ডা. আবদুল হাই আরেফী রাহ.। আর তার অন্যতম দুজন খলীফা হলেন, দারুল উলূম করাচির সদর, মুফতীয়ে আজম পাকিস্তান হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ রফী উসমানী দা.বা. এবং শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উসমানী দা.বা.।
হযরত ডা. আবদুল হাই আরেফী রাহ. প্রচলিত পদ্ধতিতে কোনো মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপনকারী আলেম ছিলেন না; বরং তিনি একজন বড় এডভোকেট এবং পরে সাধারণ পরিচয়ে একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ.-এর সুদীর্ঘ সোহবত ও তালীম-তরবিয়ত এবং তার দিকনির্দেশনায় আত্মশুদ্ধি ও রিয়াজত-মুজাহাদা, সর্বোপরি পূর্ণ ইত্তেবায়ে সুন্নত ও গভীর তাআল্লুক মাআল্লাহ-এর বদৌলতে তিনি এমন সুউচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন যে, মানুষ তাকে আরেফ বিল্লাহ নামেই স্মরণ করে থাকে। তারই কলমে রচিত হয়েছে উসওয়ায়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, মাআরিফে হাকীমুল উম্মত, বাসাইরে হাকীমুল উম্মত, মাআছিরে হাকীমুল উম্মত ও জাওয়াহিরে হাকীমুল উম্মত নামক অতি উপকারী ও ব্যাপক সমাদৃত কিতাবসমূহ।
মাআছিরে হাকীমুল উম্মত গ্রন্থের ভূমিকায় হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. লিখেছেন, ‘আমার শ্রদ্ধেয় বুযুর্গ হযরত ডা. আবদুল হাই সাহেব দা.বা. কে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন দিকে হযরত থানভী রাহ.-এর সাথে বিশেষ নিসবত বা সম্পর্ক দান করেছেন। হযরত রাহ.-এর খলীফা তো আলহামদুলিল্লাহ অনেকেই রয়েছেন, কিন্তু শায়খের রঙ যাদের মধ্যে পরিস্ফুটিত, তাদের সংখ্যা কমই। ডাক্তার সাহেব দা.বা. সেই কমসংখ্যক ব্যক্তিদের অন্যতম।’
শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উছমানী ডা. আরেফী রাহ.-এর হাতে নিজের বাইআত হওয়ার ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, শ্রদ্ধেয় আব্বাজান রাহ.-এর তালীম ও তরবিয়তের কারণে দারুল উলূম থেকে প্রচলিত অর্থে ফারেগ হওয়ার পর মনের মধ্যে অনবরত এ চিন্তা লেগেই থাকত যে, শুধু কিতাবের অক্ষরজ্ঞান মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়; বরং কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো মুর্শিদের সাথে আত্মশুদ্ধির সম্পর্ক স'াপন না করে, সাধারণত তার আমল-আখলাক পরিশুদ্ধ হয় না। কিন্তু একই সাথে এ ভয়ও লাগত যে, এই সম্পর্ক বড় নাজুক বিষয়। এখানে কেবল শায়খের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধাই যথেষ্ট নয়। এখানে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, শায়খের সাথে মুনাসাবাত অর্থাৎ তার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও গভীর মহব্বত। অপরদিকে স্বীয় নফসের মন্দ স্বভাব-আচরণের কারণে এ শঙ্কাও ছিল যে, সম্পর্ক স্থাপন করার পর তার হক ঠিকভাবে আদায় না করা হলে তা বড়ই ক্ষতির কারণ হতে পারে। মোটকথা, এ ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দেই কয়েক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল।
তখন পর্যন্ত অধম স্বীয় পিতা হযরত মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. ছাড়া অন্য কোনো বুযুর্গের মজলিসে নিয়মিত অংশগ্রহণ করিনি। যখন আপন ঘরেই ফয়েযের ঝরনা-ধারা বইছে তখন অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজনও মনে করিনি।
তাছাড়া হযরত আব্বাজান-এর সাথে শুধু পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ছিল না; বরং তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তিতে অন্তর পরিপূর্ণ ছিল। আর মুনাসাবাত বা পূর্ণ আস্থার অবস্থা এমন ছিল যে, তার প্রতিটি কথা হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে যেত। এসব কারণে অধম সর্বপ্রথম হযরত আব্বাজান রাহ.-এর কাছেই বাইআত হওয়ার আবেদন জানাল। উত্তরে তিনি বললেন, যদিও অতীতে পিতার কাছে পুত্রের বাইআত হওয়ার একাধিক দৃষ্টান্ত আছে, কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকা অবস্থায় এ সম্পর্কের হক আদায় করা বড়ই কঠিন। তাছাড়া সাধারণত আত্মীয়তার এ সম্পর্ক ফয়েয আদান প্রদানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
নিজের তরবিয়ত ও আত্মশুদ্ধির জন্য আব্বাজানের পর কেবল একজন ব্যক্তিত্বের দিকে দৃষ্টি পড়ত। তিনি হলেন কামালিয়াতের অধিকারী হযরত ডা. আরেফী রাহ.।
অবশেষে ১৩৮৯ হিজরী মোতাবেক ১৯৬৯ ঈ. সনের একদিন শ্রদ্ধেয় আব্বাজান রাহ. বড় ভাই হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ রফী উসমানী মু.জি. ও অধমকে হযরত আরেফী রাহ.-এর খেদমতে নিয়ে গেলেন এবং আমাদের বাইআত করে নেওয়ার অনুরোধ করলেন। হযরত পূর্বের মতোই উভয়কে আদর মহব্বত করলেন এবং পরের দিন একান্তে হাজির হওয়ার আদেশ দিলেন। আমরা উভয়ে পরের দিন উপস্থিত হলাম এবং আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে হযরতের পবিত্র হাতে বাইআত হওয়ার মহা সৌভাগ্য অর্জন করলাম। এভাবে আল্লাহর রহমতে তাঁর সাথে অধমের দীর্ঘ সতের বছর ইসলাহী সম্পর্ক ছিল।-মাআছিরে হযরত আরেফী রাহ. পৃ. ১০-১২
১৫ রজব ১৪০৬ হিজরীর ভোর বেলা এই মহান বুযুর্গ তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির ময়দানে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করে আপন প্রেমাষ্পদ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্যে চলে যান। তার মৃত্যু শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা তকী উসমানী দা.বা.-এর হৃদয়ে কেমন শূন্যতার অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল তা তার মুখেই শুনুন, ‘হযরত আব্বাজান রাহ.-এর মৃত্যুর সময় আলহামদুলিল্লাহ হযরত আরেফী রাহ.-এর ছায়া বিদ্যমান ছিল। ফলে পিতা হারানোর শোক তখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করেনি। কিন্তু আজ যখন হযরতও চলে গেলেন, তখন যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল শূন্যতা আর শূন্যতাই দেখতে পাচ্ছি।’-মাআছিরে হযরত আরেফী রাহ. পৃ. ৭৩
হযরত আরেফী রাহ.-এর মৃত্যুর পর দারুল উলূম করাচির পক্ষ থেকে শায়খুল ইসলাম তকী উসমানী দা.বা.-এর সম্পাদনায় আলবালাগ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার এই সুবৃহৎ সংখ্যাটি কেবল হযরত আরেফী রাহ.-এর জীবনী আলোচনার জন্য উৎসর্গিত ছিল। এতে হযরত তকী উসমানী দা.বা.-এর দুটি অতি মূল্যবান লেখা স্থান পায়। প্রথম লেখাটিতে হযরত আরেফী রাহ.-এর জীবনের শুধু ঐ দিকগুলো তুলে ধরা হয়, যা ছিল হযরত তকী উসমানী দা.বা.-এর ভাষায় আমাদের সকলের জন্য বড় শিক্ষণীয় ও সর্বদার পথনির্দেশ। আর দ্বিতীয় লেখাটি ছিল হযরত আরেফী রাহ.-এর সংক্ষিপ্ত কিন্তু অতি সুনির্বাচিত একটি বাণী সংকলন। পরবর্তীতে লেখা দুটিকে একত্র করে মাআছিরে হযরত আরেফী নামে গ্রন্থকারে প্রকাশ করা হয়।
পাঠকদের বিশেষ উপকারের কথা বিবেচনা করে উপরোক্ত গ্রন্থের অতি উপকারী কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হল।
হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রাহ.-এর সাথে সম্পর্ক
হযরত আরেফী রাহ. দরসে নেজামীর পথ ধরে ইলমে দ্বীনের জগতে আসেননি; বরং হযরত রাহ. আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিজের জীবন শুরু করেন। তবে ছাত্রজীবন থেকেই হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর সাথে সম্পর্ক হয়ে যায়। অবশেষে হযরতের হাতে বাইআত হয়ে যান। বাইআত করার সময় হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. আদেশ দিয়েছিলেন যে, প্রতি সপ্তাহে নিজের হাল-অবস্থা লিখে চিঠি দিবে। হযরত আরেফী রাহ. বলেন, এরপর থেকে প্রতি মাসে চারটি চিঠিই হযরতকে লিখেছি। হযরতের মৃত্যু পর্যন্ত কখনো এর ব্যতিক্রম হয়নি। এছাড়া বিভিন্ন সময় নিজে থানাভবন গিয়ে কয়েক সপ্তাহব্যাপী হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর খেদমতে থাকতেন এবং ফয়েয লাভ করতেন।
খাঁটি তলব বা চাহিদা ছিল। আল্লাহ তাআলা অন্তরে পূর্ণ যোগ্যতাও দিয়েছিলেন। শায়খের সঙ্গে ইশকের সম্পর্কও ছিল। সর্বোপরি প্রতি কদমে কদমে শায়খ থেকে শিক্ষাগ্রহণের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। ফলে এই মূল্যবান পাথর শায়খের সোহবতের পরশে সোনায় পরিণত হতে থাকল।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)