হজ্ব কথোপকথন
বাইতুল্লাহর দিকে নজর করে হেদায়েত, বরকত, আমন ও রিযকে হালাল লাভের অনুভূতি লালন করা দরকার
বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের বুকে নিয়ে পাঁচ দিন আগে প্রথম বিমান ঢাকার আকাশে উড়েছে। হজ্বের আবেগ হজ্বের মওসুম ঢাকার বাতাসে। নিজের দুর্গন্ধ, নিজের দুর্ভাগ্যের মধ্যেও বিভিন্ন জায়গায় বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের চোখভেজা, দিলভেজা হালের কথা শোনা যায়। তখনই মনে জাগে, কাছাকাছি বসি কোনো বরেণ্য আহলে ইলম-আহলে দিল মুহাক্কিক আলেমে দ্বীনের। তাঁর শফকত, মহববত ও প্রশ্রয়ের কারণেই ৩০ আগস্ট দুপুরে সোনালী সে সুযোগটি হাতে আসে। তাঁর সঙ্গে হযরতপুর যাওয়ার ঘণ্টা দেড়েকের সফরে আমার কিছু জিজ্ঞাসা আর কিছু অজ্ঞতা তুলে ধরি তাঁর সামনে। তিনি হৃদয় খুলে প্রশান্তিদায়ক ভঙ্গিতে উত্তরগুলো দেন। সে প্রশ্ন-উত্তরের একটি নির্যাস হজ্বের সফরের তৈয়ারে নিমগ্ন হাজ্বী সাহেবদের খেদমতে পেশ করা হলো। সামনের কোনো সুযোগে ইনশা-আল্লাহ এ প্রশ্নোত্তরের আরো বিস্তৃত বিবরণ আয়োজনের চেষ্টা থাকবে।
জানতে চাইলাম তাঁর কাছে, বাইতুল্লাহ শরীফের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় বান্দার দিলে কেমন অনুভূতি থাকা দরকার?
তিনি প্রথমে আয়াতে কারীমা তেলাওয়াত করলেন। সূরা আলে ইমরানের ৯৬ ও ৯৭ নম্বর আয়াত। এরপর চারটি শব্দ বললেন, বাইতুল্লাহর দিকে নজর করে বিশেষভাবে হিদায়েত, বরকত, আমন ও রিযকে হালাল লাভের অনুভূতি লালন করা দরকার এবং একই সঙ্গে এ অনুভূতিটির দুআও হবে নিজের জন্য, নিজের নিকটজন, পরিবার ও পুরো উম্মতের জন্য। সূরা আলে ইমরানের ৯৬ ও ৯৭, সূরা কাসাসের ৫৭ আয়াতে এবং সূরা কুরাইশে বাইতুল্লাহর এ সিফাতগুলোর কথাই বর্ণিত হয়েছে।
টেক্সিক্যাব তখন পল্লবীর পিঠ (মিল্কভিটার রাস্তা) ধরে মিরপুর-২-এর দিকে। জমে থাকা একটি প্রশ্ন উচ্চারণ করলাম। বাইতুল্লাহ শরীফের প্রতি বান্দার এই যে তীব্র মহববত ও ইশক, আবেগময় ভালবাসা, এর হাকীকত বা সমীচীন ব্যাখ্যা কী?’
ধীরস্থীর প্রশান্ত ভঙ্গিতে তিনি বললেন, মুহিব ও মাহবুব (প্রেমিক ও প্রেমময়) যদি ভিন্ন জিনস হয় তাহলে মহববতের প্রকাশ কঠিন হয়ে যায়। বিশেষত মাহবুব যদি হয় খালেক আর মুহিব যদি হয় মাখলুক তাহলে তো এই দুরূহতা আরও প্রকট হয়ে উঠে। তখন মাহবুবের প্রতি মুহিবের মহববত প্রকাশের উপযোগী কিছু ক্ষেত্রের প্রয়োজন হয়ে যায়। বাইতুল্লাহ শরীফ বান্দার মহববত প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে। বাইতুল্লাহকে আল্লাহ তাআলা তার তাজাল্লির মারকায বানিয়েছেন। তাই বাইতুল্লাহর প্রতি বান্দার ওয়ালিহানা মহববত মূলত আল্লাহর জন্যই বান্দার মহববতের প্রকাশ।
মদীনা শরীফে মসজিদে নববী এবং রওযা শরীফের কাছাকাছি আদব বজায় রাখার কিছু কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে গেলেন তিনি।
বললেন, আওয়াজ উঁচু করা হয়। আয়াতে কারীমায় তো এ বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। না-মুনাসিব আর অত্যন্ত বেয়াদবিপূর্ণ আচরণও করা হয়। ছবি তোলা, শোরগোল করা। মদীনায় গেলে এসব দেখে খুব কষ্ট হয়। রওযা শরীফের আদব হচ্ছে সুন্দরভাবে সালাত ও সালাম পেশ করা। আর দুআ আল্লাহ তাআলার কাছে করা। রওযা শরীফের জালের ফাঁক দিয়ে উঁকি-ঝুকি দেওয়ার চেষ্টা একদমই না করা চাই।
কোনো উম্মত যদি রওযার সামনে থাকা অবস্থায় এই কল্পনা করে যে, পর্দার ওই পাশে নবীজী শুয়ে আছেন, আমি তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছি। তিনি আমার সালাত ও সালাম শুনছেন। এ চিন্তা করে সালাম পেশ করে এবং নিজের অনুভূতিকে জাগ্রত করে তাহলে সেটি কি সঠিক হবে?’
মুহূর্তেই এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, সঠিক। কোনো সমস্যা নেই। নবীগণের বরযখি হায়াত খুব শক্তিশালী, ‘আল আম্বিয়াউ আহইয়াউন ফী কুবূরিহিম’
তিনি স্মিত হাসিমুখে উত্তর দিলেন, এটি উত্তম আমল। এমনটি করতে কোনো অসুবিধা নেই।
তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, শোনা যায়, হজ্বের মূল সময় যিলহজ্বের ৮ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত, ভিড় ইত্যাদির কারণে কোনো কোনো সময় ঝগড়া-কলহ সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক ছাড়ের মনোভাবও কমে যায় কারো কারো মধ্যে। এ পরিস্থিতির সংশোধনে কিংবা এ জাতীয় প্রবণতা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য কী করা চাই?
তিনি বললেন, যার ব্যাপারে মনে রাগ আসতে চাইবে বা ছাড় না দেয়ার অনুভূতি আসবে তার ব্যাপারে এই চিন্তা করা যে, তিনি তো আল্লাহর মেহমান। আমি জানি না, হয়তো তার মেহমানি আল্লাহ তাআলার কাছে বেশি কবুল হয়ে আছে। সুতরাং তার প্রতি আমার সম্মান ও রেআয়াত বজায় রাখা উচিত।
জিজ্ঞাসা ছিল, বিভিন্নজনের কাছে শুনেছি, হজ্বের সফরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একশ্রেণীর মানুষের অসতর্কতার কারণে পর্দা বজায় রাখার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। এটা থেকে বেঁচে থাকার উপায় কী হতে পারে?
এ জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেন, আগের চেয়ে এখন জায়গার প্রশস্ততা বাড়ানোর কারণে এ সমস্যা অনেক কমে গেছে। এরপরও অনিচ্ছাকৃতভাবে পর্দার মাসআলায় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে গেলে হারামাইনের বরকতে সেখানে তার কোনো বদ প্রভাব পড়ে না। তবে চিন্তা ও কাজে না-মুনাসিব কোনো কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে ইস্তেগফার, তাআউউয ও লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা... উচ্চারণের আমল করা চাই।
টেক্সিক্যাব তখন মিরপুর-১ নম্বর থেকে টেকনিক্যাল মোড়ের দিক বাঁক নিয়েছে। দ্বিধা ঝেড়ে প্রশ্নটি করেই ফেললাম, প্রতিবছর আপনি কেন হজ্বের সফরে যান না?’
প্রশ্নের উত্তরে একটু যেন দিধাগ্রস্ত হলেন তিনি। একটু স্মিত হাসলেন। বললেন, প্রতি বছর হজ্বের সফরে যাওয়া আসলে প্রফেসর হযরত এবং তাঁর মতো তবকার মানুষের কাজ। যারা প্রতিবছরই তীব্র আগ্রহ ধরে রাখতে পারেন এবং কিছু হাসিলও করতে পারেন। আমাদের মতো দুর্বলদের জন্য প্রতিবছর হজ্বে না গিয়ে দু-তিন বছর ওয়াকফা (বিরতি) দেয়া উচিত। বাইতুল্লাহ শরীফে উপস্থিত হওয়ার আগ্রহ বৃদ্ধির জন্যই এই ওয়াকফা দেয়া দরকার।
আলোচনার এক প্রসঙ্গে বললেন, নবীজীর প্রতি তাঁর উম্মতির পরিচ্ছন্ন মহববতের বিভিন্ন উপমা তো অতীতেও রয়েছে। আর মদীনা শরীফে থাকাকালে সাধারণভাবে সবচেয়ে বেশি করার মত আমল হচ্ছে, বেশি বেশি দরূদ শরীফ পাঠ করা’।
একসময় গাবতলী, আমিনবাজার, বলিয়ারপুর হয়ে গাড়িটি হেমায়েতপুরের কাছাকাছি চলে এল। একটু পর আমাদের নামতে হবে। হজ্বের মওসুমে তার হৃদয়জাত কথাগুলো ওই দুপুরে আমার হৃদয়ের ভেতরে একটি সফেদ আকাশ তৈরি করে দিল। আলহামদু লিল্লাহ।
শরীফ মুহাম্মদ