তুরস্কে, তুর্কিসত্মানের সন্ধানে
بسم الله الرحمن الرحيم
***
আল্লাহ তা‘আলা আমার ভাঙ্গা বুকে একটি স্বপ্ন দান করেছিলেন; বহুদিনের স্বপ্ন ছিলো তুরস্কে যাবো, তুরস্কের আকাশ দেখবো, ভূমি দেখবো এবং তুরস্কের সেই মানুষ দেখবো যারা একদিন ইসলামী খেলাফতের ঝান্ডা ধারণ করে বিশ্ব শাসন করেছে।স্বপ্ন ছিলো ইসত্মাম্বুলের বাতাসে বুকভরে শ্বাস নেবো, ইসত্মাম্বুলের বাগানে ফুলের ঘ্রাণ নেবো; সেই ইসত্মাম্বুল, যা সুদীর্ঘ আটশ বছর ইসলামী খেলাফতের রাজধানী ছিলো; সেই ইসত্মাম্বুল যা জয় করেছিলেন ২৪ বছরের যুবক মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ, যার বিজয়ের খোশখবর দিয়েছিলেন স্বয়ং পেয়ারা নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
কিন্তু আমার মত এক গরীব তালিবে ইলম যদিও বা হৃদয়ের গভীরে কোন স্বপ্ন লালন করে, বাসত্মবে ঐ স্বপ্নের ছোঁয়া পাবে কীভাবে?
আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নাদাবী রহ. ১৯২০ খৃস্টাব্দে খেলাফত-রক্ষার সর্বশেষ জিহাদ হিসাবে একটি প্রতিনিধিদলের অংশ হয়ে ইংলেন্ড গিয়েছিলেন, যখন তুরস্কে উছমানী খেলাফতের মৃত্যুঘণ্টা প্রায় বেজে উঠেছে এবং বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তি গ্রেটব্রিটেনের নেতৃত্বে তুর্কী খেলাফতের বিভিন্ন এলাকা, এমনকি খোদ ইসত্মাম্বুলেরও ভাগবাটোয়ারায় মেতে উঠেছে। সৈয়দ সোলায়মান নাদাবী রহ. তখন ইউরোপ থেকে যত পত্র লিখেছিলেন তা ‘বারীদে ফিরাঙ্গ’ (ইউরোপের ডাক) নামে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি একটি নির্মম সত্য কথা বলেছেন, যার মর্ম-
‘কল্পনা, আর বাসত্মবতা দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগত। অর্থ ও সামর্থ্য ছাড়া স্বপ্ন ও কল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। ....
তাওয়াক্কুলকে বিশ্বাস করেও বলতে হয়, আসলেই দুনিয়া হচ্ছে দারুল আসবাব। আর আমার না আছে অর্থ, না আছে সামর্থ্য; না পরিচয়, না পরিচিতি। সুতরাং বহু বছর হৃদয়ের স্বপ্ন হৃদয়েই ঘুমিয়ে ছিলো। স্বপ্নেও ভাবিনি, এ স্বপ্ন কখনো বাসত্মব হবে।
***
মনে পড়ে, ১৯৯৭ সালে তুরস্কের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান সোলেইমান ডেমিরেল বাংলাদেশসফরে এসেছিলেন। তখন বুকের ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস অনুভব করেছিলাম। দীর্ঘশ্বাস; সেই সঙ্গে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠা অদ্ভুত এক বেদনার অনুভূতি! একবার শুধু মানচিত্রটা দেখেছিলাম, কোথায় তুরস্ক?! কোথায় তুরস্কের ইসত্মাম্বুল?! এখান থেকে কত দূর?!!
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন পেলাম আমার প্রিয়তম, আমার আদর্শ-পুরুষ হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রা.-এর ছোট্ট সফরনামা, ‘দু’সপ্তাহ তুরস্কে’। ছোট্ট, কিন্তু হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং মনকে নাড়া দেয়; চিমত্মাকে জাগ্রত করে এবং চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। তখন আমার ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নটা যেন হয়ে উঠলো আধফোটা কলির মত। মনে হলো, অসম্ভব কী! আল্লাহর ইচ্ছায় আমিও হয়ত একদিন যাবো তুরস্কে, আমার প্রিয় ইসত্মাম্বুলে!
***
দীর্ঘ একযুগ পর ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশ সফরে এলেন তুরস্কের ‘বর্তমান’ প্রেসিডেন্ট ড. আব্দুল্লাহ গুল। তাঁর দু’দিনের সংক্ষিপ্ত সফরটি অতিবাহিত হলো অত্যমত্ম কর্মব্যসত্মতার মধ্যে। সফরের শুরুতে ছিলো লালগালিচা সম্বর্ধনা, আর দ্বিতীয় দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হতে এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রী ডক্টর অব লজ দ্বারা ভূষিত করা হলো।
তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তুরস্ক যথাসাধ্য অবদান রাখবে। আমাদের পণ্যরফতানির জন্য তুরস্ক তার দুয়ার খুলে দেবে। শুভেচ্ছাস্বরূপ একশকোটি ডলারের ঋণ ঘোষণা করে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হলো; যদিও আমাদের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে তা তেমন প্রচার পেলো না। আশ্চর্য, যারা কঠিন শর্তে দেয়া ভারতের একশকোটি ডলার ঋণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তারা তুরস্কের এই উদারতার কথা বলতে গেলে মুখেই আনলো না!
কারণ অবশ্য ছিলো, বিরোধী-দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তুর্কী প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের যে গভীর সম্পর্ক, এর সূচনা করে গিয়েছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তাই তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রাজধানী আঙ্কারায় তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সড়কটি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে। তাই প্রতিদিন আমার নজরে পড়ে এবং আমি তাঁকে স্মরণ করি।
তিনি বিদায় নিলেন, আর আমি বুকের ভিতরে সেই ব্যথা ও দীর্ঘশ্বাস নতুন করে অনুভব করলাম। আবার মানচিত্র খুলে দেখলাম। এই তো তুরস্ক! এই তো ইসত্মাম্বুল!! কত যেন কাছে, চোখের এবং হৃদয়ের!!
কী সৌভাগ্য! এর মধ্যে পেয়ে গেলাম আল্লামা তাক্কী উছমানীর[1] তুরস্কসফরের সংক্ষিপ্ত সফরনামা ‘মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ-এর শহরে’। সংক্ষিপ্ত, কিন্তু দিলের দরদে এবং হৃদয় ও আত্মার আবেদনে এমনই পরিপূর্ণ যে, তোমারও হৃদয়সাগরে ভাবের, আবেগের এবং ব্যথা-বেদনার তরঙ্গজোয়ার সৃষ্টি হবে! তখন আমার স্বপ্নের আধফোটা কলিটা যেন ফুটনোন্মুখ হলো! আর হৃদয়ের গভীর থেকে একটি মিনতি উচ্চারিত হলো, ‘হে আল্লাহ, আমার স্বপ্নের কথা তুমি জানো এবং জানো আমার উপায়হীনতার কথাও। হে আল্লাহ, তুমি গায়ব থেকে ব্যবস্থা করো; আমার বহুবছরের এ স্বপ্নটি তুমি পূর্ণ করো।’
এবং .. এবং দয়াময় আল্লাহ বান্দার মিনতি পূর্ণ করলেন। কল্পনায়ও ছিলো না, এমন এক উপায়ে আমার এতদিনের স্বপ্নটি বাসত্মব হলো। ২০১০ সালেই তুর্কী প্রেসিডেন্ট বিদায় নেয়ার মাত্র সাতমাস পর মধ্যসেপ্টেম্বরে পাঁচদিনের সফরে তুরস্কে গেলাম। তুরস্কের আকাশ দেখলাম, ভূমি দেখলাম এবং দেখলাম তুরস্কের মানুষ। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও আমার প্রিয় ইসত্মাম্বুলকে একামত্ম কাছে পেলাম; ইসত্মাম্বুলের বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিলাম এবং ইসত্মাম্বুলের বাগানে ফুলের ঘ্রাণ নিলাম। বড় মধুর ছিলো জীবনের দীর্ঘ স্বপ্নের সেই পাঁচটি দিনের প্রতিটি মুহূর্ত।
স্বপ্নটি পূর্ণ হলো, তারপর তা ছোট্ট সুন্দর একটি স্বপ্নের মতই অতীত হয়ে গেলো। আমিও হারিয়ে গেলাম কর্ম ও দায়-দায়িত্বের কঠিন ব্যসত্মতার জগতে।
***
সুন্দর কোন স্বপ্ন যখন বুকে থাকে, বুকটা তখন কত সজীব থাকে! যেন সবুজ বাগানের তাজা ফুল! সেই স্বপ্নটি যখন জীবনের অঙ্গনে পেখম মেলে, জীবনটা তখন হয়ে ওঠে এমন সুন্দর সুরভিত, যেন শুধু একটি ফুল নয়, বসমেত্মর পূর্ণ একটি পুষ্পিত উদ্যান!
মানুষ মানুষকে ভালোবাসে বলেই নিজের স্বপ্নের কথা অন্যকে বলতে চায়; স্বপ্নটি যখন বুকের উদ্যানে লালিত হয় তখনো, স্বপ্নটি যখন জীবনের উদ্যানে প্রস্ফুটিত হয় তখনো।
তুরস্কে যাওয়ার, তুরস্কের আকাশ, ভূমি ও মানুষকে দেখার এবং আমার প্রিয় ইসত্মাম্বুলকে কাছে পাওয়ার স্বপ্নটি যখন বুকের উদ্যানে আমি লালন করেছি, তখন কাউকে বলিনি; কেন জানি বলতে ইচ্ছে করেনি, কিমত্মু জীবনের উদ্যানে স্বপ্নটি যখন প্রস্ফুটিত হলো, সত্যি সত্যি যখন তুরস্কে গেলাম এবং ইসত্মাম্বুলকে কাছে থেকে দু’চোখ ভরে দেখলাম তখন ইচ্ছে হলো, স্বপ্নের সেই পাঁচটি দিনকে কাগজের বুকে কলমের অাঁচড়ে ধরে রাখি এবং আমাকে যারা ভালোবাসে, আমার জীবনের সজীবতা যারা প্রার্থনা করে, সেই স্বপ্নের, সেই আনন্দের মুহূর্তগুলো তাদের উপহার দিই। ইচ্ছে ছিলো, কিমত্মু তার বাসত্মবায়ন আর হয়ে উঠলো না। সময়ের বরফ গলতে থাকলো, জীবনের স্রোত সাগর-অভিমুখে বইতে থাকলো। দিনের আলো ও রাতের অাঁধারে সেই ইচ্ছেটা উঁকি দেয়, কিমত্মু আলো-অাঁধারির সীমা আর পার হতে পারে না। মানুষ ইচ্ছে করতে পারে, কিন্তু আকাশ থেকে আলোর ইশারা যদি না আসে, ইচ্ছেটা সে পূর্ণ করতে পারে না।
***
এর মধ্যে একদিন আমাদের জন্য একপশলা আনন্দ নিয়ে তুরস্কের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগান, সুদূর বাংলাদেশ থেকে যাকে আমি আল্লাহর জন্য ভালোবাসি, বাংলাদেশের সফরে এলেন। আমি তখন ফিরে গেলাম জীবনে অতীত হয়ে যাওয়া সেই স্বপ্নের সুখস্মৃতির কাছে।
অতীতের স্মৃতি বড় রহস্যময়, দুঃখের স্মৃতি হোক, বা সুখের; বিস্মৃতির হালকা একটা আবরণ পড়ে থাকে তার উপর। অনেক সময় ভুল করে ভাবি যে, তা ভুলে গিয়েছি, কিন্তু যখন কোন উপলক্ষ সামনে আসে, বিস্মৃতির আড়াল থেকে তা উঁকি দেয়, ধীরে ধীরে জেগে ওঠে এবং এমন সজীব জীবমত্ম রূপ ধারণ করে, যেন কালকের ঘটনা, যেন মাত্র দু’দিন আগের আনন্দ, বা বেদনা! এভাবেই চলতে থাকে মানুষের জীবনে স্মৃতি ও বিস্মৃতির আশ্চর্য এক রহস্যলীলা!
আমার প্রিয় এরদোগানের বাংলাদেশ সফর ছিলো তেমনি একটি উপলক্ষ যা আমার জীবনের সেই সুন্দর স্বপ্নের পাঁচটি দিনের সুখের স্মৃতিকে নাড়া দিয়েছিলো। তাতে পাঁচটি দিনের প্রতিটি মুহূর্ত চোখের সামনে এমন জীবমত্ম হয়ে উঠলো যেন ইচ্ছে করলেই স্পর্শ করতে পারি! ইচ্ছে করলেই তার ঘ্রাণ নিতে পারি! এমনকি ইসত্মাম্বুলের যে হোটেলে ছিলাম সেখান থেকে বের হয়ে একটু দূরে পথের ডানদিকে যে সুন্দর বাগানটি ছিলো সেই বাগানের ফুলগুলো এবং ফুলের মত একটি শিশুর মুখের লাজুক হাসিটি পর্যমত্ম মূর্ত হয়ে উঠলো।
যে কোন শিশুর মুখের হাসি এমনিতেই সুন্দর, কিন্তু সেই তুর্কী শিশুটির মুখের হাসিটি ছিলো আশ্চর্য রকম সুন্দর! তুরস্কে প্রভাতে সবুজ ঘাসের ডগায় শিশির ঝিলমিল করে না, অমত্মত আমি দেখতে পাইনি। বাংলাদেশে শীতের ভোরে সবুজ ঘাসের ডগায় শিশির ঝলমল করে। বাগানে অনেক ফুলের মাঝে তুর্কী শিশুটির মুখের হাসিতে যেন ছিলো ঐ রকম ‘শিশিরঝলমল’ সৌন্দর্য। আমার মনের আঙ্গিনায় এখনো তার মুখটি এমন উদ্ভাসিত, যেন ইচ্ছে করলেই চিবুক ছুঁয়ে তাকে আদর করতে পারি।
যাই হোক, সফরশেষে তুর্কী প্রধানমন্ত্রী এরদোগান বিদায় নিলেন। বিমানবন্দরে তিনি অত্যমত্ম আবেগপূর্ণ ভাষায় বললেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য তিনি তুর্কী জনগণের ভালোবাসা নিয়ে এসেছিলেন, এখন তুরস্কের জন্য বাংলাদেশের ভালোবাসা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আর এ ভালোবাসার ভিত্তি জাগতিক কোন স্বার্থ নয়, বরং ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, যা চিরকাল অটুট থাকবে।
কথাগুলো তিনি হৃদয় থেকে বলেছিলেন, তাই আমাদের হৃদয়কে তা আপ্লুত করেছিলো। মনে মনে ভেবেছিলাম, আমি খুব সাধারণ মানুষ, তবে আমিও বুক ভরে ভালোবাসা নিয়ে গিয়েছিলাম এবং বুক ভরে ভালোবাসা নিয়ে ফিরে এসেছি, কিন্তু এত সুন্দর করে বলতে পারিনি। বড় হৃদয়ের বড় মানুষ যেভাবে বলতে পারেন, একজন সাধারণ মানুষ তো আর সেভাবে বলতে পারে না! তবু তাঁর বিদায়মুহূর্তে আবার ইচ্ছে হলো, আমার মত সাধারণ করেই না হয় স্বপ্নের সেই পাঁচটি দিনের সুখস্মৃতি সম্পর্কে কিছু কথা বলি, কিছু কথা লিখি। কিন্তু হলো না। সেই একই কথা; আকাশের করুণা ছাড়া আমাদের কোন আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না।
দেশের বিশিষ্টজনেরা তুর্কী প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে বিদায় জানালেন। আমি বিমানবন্দরে না গিয়েও তাঁকে আমত্মরিক বিদায় জানালাম, আর হৃদয়ের গভীর থেকে কামনা করলাম, তিনি ও তাঁর দল যেন তুরস্কের মুসলিম জনগণের ইসলামী চেতনাকে আরো জাগ্রত, আরো উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম হন। শয়তানি চক্রের সমসত্ম বাঁধা অতিক্রম করে তারা যেন ইসলামের পথে সুদৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারেন।
***
তিনি বিদায় নিলেন। প্রকৃতির নিয়মে আবার দিন-রাত পার হতে লাগলো। ধীরে ধীরে সেই সুখের স্মৃতিগুলো আবার যেন বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে গেলো।
বছর শেষ হলো; ফিরে এলো বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টিকারী ৩১শে মে। ইহুদীনিয়ন্ত্রিত বিশ্বপ্রচারমাধ্যমে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে আবার শুরু হলো তুর্কীবিরোধী প্রবল প্রচারণা। ইসরাইলের সন্ত্রাসবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সদম্ভে ঘোষণা করলেন, তার দেশ কোনভাবেই তুরস্কের কাছে ক্ষমা চাইবে না।
আমার মনে হয়েছে, এটা হলো মুসলিমবিশ্বের তাজা ঘায়ে লবণের ছিটা!
আধুনিক বিশ্বের সর্বসন্ত্রাসের আখড়া ইসরাইল ফিলিসিত্মনের গাজা অঞ্চলের পনেরো লাখ মুসলিম নরনারী ও শিশু-বৃদ্ধকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে কয়েক বছর ধরে। পানি, খাদ্য, ঔষধ ও চিকিৎসাসামগ্রীর অভাবে শাব্দিক অর্থেই সেখানে দেখা দিয়েছে চরম মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব নির্বিকার; নির্বিকার মানবাধিকারের স্বঘোষিত রক্ষক (ও ভক্ষক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে থাকবে গাজার অসহায় মুসলমানদের উপর ইহুদিদের এ পাশবিকতা ও বর্বরতা। সবচে’ মর্মামিত্মক বিষয় ছিলো, মিশরের মূর্তিমান অভিশাপ হুসনি মোবারক,[2] যিনি মিশরের মুসলিম জনগণের উপর বসে আছেন জগদ্দল পাথরের মত, তিনি গাজা অবরোধের ক্ষেত্রে ইসরাইলকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন, গাজার দিকে মিশরীয় সীমামত্ম বন্ধ করে দিয়ে। ফলে গাজার অসহায় মানুষগুলো যেন যাঁতার দুই পাটার মাঝখানে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে।
এতদিন ফিলিসিত্মনী যুবকেরা সুড়ঙপথগুলো দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচানোর যৎসামান্য উপকরণ যোগাড় করে আসছিলো, কিমত্মু এখন একটি দানা, বা একটি ফোঁটা পানিও মিশর থেকে গাজায় যাওয়ার উপায় নেই। ইহুদীরা এখন একটা বোমাও যদি না ফেলে, গাজার পনেরো লাখ বনী আদম ক্ষুধা-পিপাসায় ধুঁকে ধুকেই হয়ত মারা যাবে।[3]
এই যখন পরিস্থিতি তখন গত বছরের এই সময় ইসলামপন্থী দল একেপি-শাসিত তুরস্ক এগিয়ে এলো এবং সমসত্ম আমত্মর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে এক সাহসী ও নির্ভীক পদক্ষেপ গ্রহণ করলো। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মহান প্রেরণায় অনুপ্রাণিত প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগান ঘোষণা করলেন, ইসরাইলী অবরোধ উপেক্ষা করে গাজার অসহায় মুসলমানদের জন্য তুরস্ক ত্রাণসামগ্রী পাঠাবে।
জাহাজবহর রওয়ানা হলো তুরস্কের বন্দর থেকে। কিমত্মু সমসত্ম মানবিক ন্যায়নীতি ও আমত্মর্জাতিক নিয়মকানুনের কোন তোয়াক্কা না করেই ইসরাইল ত্রাণবাহী জাহাজে বর্বর হামলা চালালো। তাতে তুরস্কের নয়জন নাগরিক সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় নিহত হলো।
সবকিছু ঘটলো ‘শামিত্মবাদী’ বিশ্বমোড়লদের চোখের সামনে। আর জাতিসঙ্ঘ! তার তো একটা চোখ খোলা, অন্য চোখে পট্টি বাঁধা, ঠিক যেন মোসে দায়ান![4] তাই এক চোখে সে কিছু দেখতে পায় না, অন্য চোখে দেখে শুধু হিন্দু-ইহুদি-খৃস্টান স্বার্থ। কিন্তু বেদনার বিষয় এই যে, মুসলিমবিশ্ব যেমন ছিলো, তেমনি ঘুমের ঘোরেই রয়ে গেলো। একটা দেশও সাহসের সঙ্গে তুরস্কের পাশে দাঁড়ালো না। কোন একজন রাষ্ট্রপ্রধান শুধু মুখের কথা দিয়েও, আধুনিক কূটনীতির ভাষায় যাকে বলে ‘লিপসার্ভিস’ বা ঠোঁট-সমর্থন, তাও জানালেন না, হারামাইনের বৃদ্ধ খাদেম সাহেবও না।
এভাবে নিঃসঙ্গতার আবর্তে ডুবে গেলো ইহুদিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মুসলিম তুরস্কের একটি সাহসী পদক্ষেপ। শহীদানের কফিন এসে পৌঁছলো ইসত্মাম্বুলে। প্রধানমন্ত্রী এরদোগান লাখ লাখ শোকার্ত জনতাকে নিয়ে শহীদানের জানাযা পড়লেন।
সেই মর্মামিত্মক ঘটনার একবছর পূর্তি উপলক্ষে নেতানিয়াহু এরূপ দম্ভোক্তি করলেন। আমি ক্ষুদ্র বাংলাদেশের অক্ষম এক মানুষ। আমার পক্ষে আর কী করা সম্ভব খবরের কাগজে চোখ রেখে ক্রোধ ও আক্রোশ প্রকাশ করা ছাড়া! কিমত্মু অসহায়ের ক্রোধ, আর অক্ষমের আক্রোশে কার কী এসে যায়!
অমত্মরের গভীরে তখন তুরস্কের প্রতি অদ্ভুত এক মমতা জাগ্রত হলো। মনে হলো, তুরস্ক আমার স্বদেশ, ইসত্মাম্বুল আমার বাসভূমি; সেই ইসত্মাম্বুল যার আলোবাতাস ও খাদ্য-পানি আমি গ্রহণ করেছি জীবনের অমত্মত চারটি দিন।
অক্ষম মানুষের অক্ষম হৃদয়ের সান্ত্বনা হিসাবে তখন আবার ইচ্ছে হলো, কলম ধরি; কিছু কথা লিখি। কলম নিলাম, কাগজ নিলাম, কিমত্মু লেখা হলো না। ভিতর থেকে কোন লেখা এলো না। মনে হলো, কী হবে লিখে?! কলম থেকে কালি ঝরবে, চোখ থেকে অশ্রু ঝরবে; হয়ত একটি সফরনামা তৈরী হবে। কিমত্মু ফিলিসিত্মনে, কাশ্মীরে, ইরাকে, আফগানিসত্মানে মুসলমানদের রক্ত ঝরা কি বন্ধ হবে?!
***
সময়ের স্রোতে আবার বয়ে যেতে লাগলো দিন-রাত, সপ্তাহ-মাস। এর মধ্যে তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলো। সাংবিধানিকভাবেই তুরস্কের আসল ক্ষমতা এতকাল ছিলো সেনাবাহিনীর হাতে। ধর্মনিরপেক্ষবাদী সেনানায়কদের ক্ষমতা ছিলো এমনই অপ্রতিহত যে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকেও যে কোন সময়, যে কোন অজুহাতে তারা অপসারণ করতে পারে এবং করে। এমন কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বিচক্ষণ ও দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী এরদোগান এবং তাঁর ইসলাম-পন্থী দল ইতিমধ্যে পরপর দুই মেয়াদ শাসনক্ষমতায় ছিলো। এমনকি তুরস্কের ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি সামরিক অভ্যুত্থানের অপচেষ্টা এরদোগান সরকার সফলভাবে প্রতিহত করেছে এবং দোষী সামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের সম্মুখীন করেছে, এককথায় ইতিপূর্বে যা ছিলো অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়।[5]
সব অনুমান, জরীপ ও বিশ্লেষণে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো যে, নির্বাচনে একেপি তৃতীয় মেয়াদের জন্য নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছে। তাসত্ত্বেও তুরস্কের ভিতরে ও বাইরে উৎকণ্ঠার শেষ ছিলো না। কারণ গণতন্ত্রের নির্বাচন সবসময় গণমত দিয়ে হয় না। তার জন্য রয়েছে দৃশ্য-অদৃশ্য বহুবিধ উপকরণ। তুরস্কের ভিতরে বাইরে একেপি সরকারের শত্রুর অভাব ছিলো না এবং ষড়যন্ত্র-চক্রামেত্মরও কমতি ছিলো না। ভিতরে সবচে’ বড় শত্রু ছিলো সেনাবাহিনী; বাইরে ছিলো আমত্মর্জাতিক ইহুদিচক্র।
আল্লাহর শোকর, ভিতরের ও বাইরের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে তুর্কী জনগণের বিপুল ভোটে একেপি তৃতীয় মেয়াদের জন্য বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। যদিও ভোটের হার বেড়েছে আগের উভয় মেয়াদের চেয়ে বেশী, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কারসাজিতে আসন-সংখ্যা কমেছে আগের তুলনায়।
বাংলাদেশে এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে যারা স্বপ্ন দেখছে তুরস্কের একটি সমুজ্জ্বল ভবিষ্যতের; যারা স্বপ্ন দেখছে তুরস্কের নেতৃত্বে মুসলিমবিশ্বের নবজাগরণের এবং ইসলামী খেলাফতের পুনরুত্থানের, তারা এ বিজয়ে যেমন আনন্দে উদ্বেলিত হলো তেমনি হলো নব-উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত। আমারও হৃদয়তটে এ বিজয়-আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়লো। তখন আবার মনে পড়লো মধুর স্বপ্নের সেই পাঁচটি দিনের কথা। বিস্মৃতির আবরণ সরে গিয়ে আবার জেগে উঠলো সুখের স্মৃতিগুলো। প্রতিটি স্মৃতি এমন সজীব জীবমত্ম যেন তারা হাসছে, কাঁদছে; কথা বলছে। আবারও ইচ্ছে হলো ছোট্ট করে হলেও একটি সফরনামা লেখার; সেই সুখের দিনগুলো কাগজের বুকে কলমের অাঁচড়ে ধরে রাখার এবং যারা আমাকে ভালোবাসে তাদের তা উপহার দেয়ার। কিমত্মু এবারও হলো না। কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম এবং কিছুদূর লিখেও ফেললাম, কিন্তু স্পষ্ট মনে হলো, এ লেখা সেই লেখা নয় যা কলবের ভিতর থেকে আসে, কলমের মুখ থেকে নয়। আসল কথা, তাকদীরের পক্ষ হতে সবকিছুর জন্য রয়েছে নির্ধারিত সময়। সময়ের আগে কিছুই হয় না। তাই বলা হয়েছে
كل أمر مرهون بوقته
আমার কলমের ক্ষেত্রে একথা আরো বেশী করে সত্য। কত সময় লিখতে বসি, লিখতে চাই, কিন্তু লেখা হয় না, লেখা আসে না। জোর করে কাগজের বুকে কিছু অাঁচড় যদিও বা কাটি, তাতে কিছু শব্দ জড়ো হয়, কিছু বাক্য তৈরী হয়, কিন্তু লেখা সৃষ্টি হয় না, সেই লেখা যাতে রয়েছে হৃদয়ের উষ্ণতা এবং প্রাণের উত্তাপ।
***
কয়েক দিন আগে হঠাৎ নয়াদিগমেত্ম ভিতরের পাতায় একটি লেখা পড়লাম তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের ভবিষ্যত স্বপ্ন সম্পর্কে। বিশ্বাস করো ভাই, লেখাটি পড়ে আমার হৃদয়সমুদ্রে এমন ঝড় উঠলো যে, সব হতাশা, সব অবসাদ যেন ভেসে গেলো; জোয়ারে জলোচ্ছ্বাসে সবকিছু যেন ডুবে গেলো। আমি শুধু শুনতে পেলাম ঢেউয়ের গর্জন, আর ঝড়ের হুঙ্কার।
১৯২৪ সালের ৩ মার্চ। মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে বড় অভিশপ্ত দিন ছিলো সেটা। আমাদের জন্য ছিলো শোকের, বেদনার; শত্রুর জন্য ছিলো আনন্দ-উল্লাসের। কিসমতের গর্দিস, আর তাকদীরের জাম্বিশ[6] ইহুদি-খৃস্টানচক্রের ক্রীড়নক মুসত্মফা কামালকে নিয়ে এলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বসত্ম তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতায়, আর তিনি কলমের এক খোঁচায় ঘোষণা করলেন উছমানী খেলাফতের বিলুপ্তি।
সেই দুর্দিনের করুণ কাহিনী কিতাবে যেমন পড়েছিলাম একে একে সব যেন জীবমত্ম হয়ে উঠলো মনের পর্দায়। খেলাফত রক্ষার আন্দোলনে উপমহাদেশের মুসলমানদের সে কী জোশ-উদ্দীপনা! (মাওলানা) মুহাম্মদ আলী-শওকত আলীর সে কী জ্বালাময়ী ভাষণ! মনে পড়ে রত্নগর্ভা মায়ের সেই অমর উক্তি, ‘জান বেটা খেলাফত পে দে দো’।
‘বি আম্মা’ তাঁর পুত্রদের জান দিতে বলেছিলেন; তাঁরাও জান বাজি রেখেই লড়াই করেছিলেন, কিমত্মু খেলাফত রক্ষা পায়নি। খেলাফতবিলুপ্তির পর নববই বছর পার হয়ে গেছে। হেলালী ঝান্ডা যেমন ছিন্নভিন্ন হয়েছে তেমনি মুসলিমবিশ্বের মানচিত্র হয়েছে টুকরো টুকরো।
আবার কি আমরা ফিরে পাবো ইসলামী খেলাফত?! আবার কি আকাশে উড্ডীন হবে সবুজ হেলালী ঝান্ডা?! সেই ঝান্ডাতলে আবার কি ঐক্যবদ্ধ হবে মুসলিম উম্মাহ?!
নয়াদিগমেত্ম রজব তৈয়ব
এরদোগানের বক্তব্য পড়ে আমার ভাঙ্গা বুকে নতুন করে এমন স্বপ্নই জেগেছে। নতুন প্রেরণায়, নতুন উদ্দীপনায় আমি আবার উদ্দীপ্ত হয়েছি। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান করুণ অবস্থার দিকে যদি তাকাই এবং যদি চিমত্মা করি সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত ইহুদি-খৃস্টান শক্তির সাজসাজ উন্মাদনার কথা তাহলে তো মনে হয়, এ অসম্ভব! কিন্তু যদি ভাবি আল্লাহর অসীম কুদরতের কথা, তাঁর গায়বী মদদ ও নুছরতের কথা তাহলে তো কোন কিছুই অসম্ভব মনে হয় না; সবকিছু মনে হয় সম্ভব এবং সহজেই সম্ভব। আমার বিশ্বাস, রজব তাইয়েব এরদোগান, আল্লাহর কুদরত ও গায়বী মদদের উপর ভরসা করেই এমন ঘোষণা দেয়ার সাহস করেছেন।
কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হয়েছে তুরস্কের ক্ষমতাসীন একেপি’র চতুর্থ সাধারণ সম্মেলন, যার মূল শ্লোগান ছিলো-
great nation, great power, target 2023
(বৃহৎ জাতি, বৃহৎ শক্তি, লক্ষ্য ২০২৩)
২০২৩ সালের তাৎপর্য এই যে, দুর্ভাগা মুসত্মফা কামাল যে উছমানী খেলাফতের বিলুপ্তি ঘোষণা করেছিলেন, আগামী দু’হাজার তেইশ সালে তার একশ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, একেপির সাধারণ সম্মেলনের উপরোক্ত শ্লোগান পশ্চিমা বিশ্বকে সচকিত করে তুলেছিলো। কারণ এর একমাত্র অর্থ তো এই যে, ইসলামপন্থী এ দলটি তার অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করতে চাচ্ছে বিলুপ্ত উছমানী খেলাফতের গৌরব পুনরুদ্ধার করার চেতনায়! ‘উদার গণতান্ত্রিক’ তুরস্কের জন্য তো এ বড় অশুভ ইঙ্গিত!
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের রীতিমত গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেলো যখন ঐ সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে একে দলের প্রধান, প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগান তুরস্কের তরুণসমাজের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন-
insa allah we will build 2023, you will build 2071
(ইনশাআল্লাহ আমরা গড়ে তোলবো ২০২৩, আর তোমরা গড়ে তোলবে ২০৭১)
তুর্কী তরুণদের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত এরদোগানের এ বার্তা পশ্চিমা বিশ্বের কেন গাত্রদাহ সৃষ্টি করেছে তা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বহু দূর অতীতে, ১০৭১ খৃস্টাব্দে। তুরস্কের বর্তমান মানচিত্রের পূর্বাংশে তাকালে দেখা যাবে, একটি অঞ্চলের নাম হলো মানযিকার্ট। আজ থেকে সাড়ে নয়শ বছর আগে সেখানে সঙ্ঘটিত হয়েছিলো এক ভাগ্যনির্ধারণী যুদ্ধ, ইতিহাসে যা মানযিকার্ট যুদ্ধ নামে খ্যাত। ঐ যুদ্ধে তুর্কিসত্মানের মহান সেলজুকী সুলতান আলেপ্ আরসেলান মাত্র বিশহাজার যোদ্ধা নিয়ে বাইজান্টাইন সম্রাট রোমানূসকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিলেন, যার সৈন্যসংখ্যা ছিলো দু’লাখেরও বেশী। শুধু তাই নয়, স্বয়ং সম্রাট রোমানূস আরসেলানের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। ঐ যুদ্ধের পর বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য আর কখনো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। অবশেষে কয়েক শতাব্দী পর ১৪৫৩ খৃস্টাব্দে উছমানী খলীফা মুহাম্মদ আল-ফাতিহ-এর হাতে রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের পতনের মাধ্যমে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের কবর রচিত হয়েছিলো। এরদোগান তাঁর জাতিকে ২০৭১-এর যে ভবিষ্যত স্বপ্ন দেখিয়েছেন সেই সুন্দর সোনালী ভবিষ্যতের শুভকামনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমি আজ কলম ধরেছি। তুরস্কের ইসত্মাম্বুলে আমার জীবনের যে পাঁচটি দিন এক মধুর স্বপ্নের মত অতিবাহিত হয়েছে, যে সুখের মুহূর্তগুলো এখনো আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে তা আমি কাগজের পাতায় ধরে রাখতে চাই আগামী প্রজন্মের জন্য। আল্লাহ যেন কবুল করেন, আমীন।
***
তুরস্ক-সফরের কথা যখন উঠলো তখন আমাকে যারা জানেন এবং জানেন আমার সফরভীতির কথা তাদের একজন বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, কী উদ্দেশ্যে এত কষ্ট করে তুরস্কে যাবেন? কোন কিছু চিমত্মা না করেই উত্তর দিলাম; বলা যায়, অদৃশ্য শক্তি আমার মুখে উত্তরটা যুগিয়ে দিলো; বললাম, ‘আমি তুরস্কে যাবো আমাদের হারিয়ে যাওয়া তুর্কিসত্মানের সন্ধানে!’
মুসলিম জাহানের প্রাচীন মানচিত্রে তুর্কিসত্মান ছিলো এক বিশাল ভূখন্ড, যা ধীরে ধীরে খন্ড খন্ডরূপে পরিণত হয়েছে শত্রুর গ্রাসে। এখন তুর্কিসত্মানের বিশাল ভূখন্ড চীন ও রাশিয়ার দখলে। এই যে ইমাম শামেলী ও জাওহার দাউদের চেচেনিয়া-দাগিসত্মানে রুশবাহিনীর হাতে এত রক্ত ঝরলো, এখনো ঝরছে, তা সেই বিশাল তুর্কিসত্মানেরই অংশ।[7] অন্যদিকে চীনের ঝিনঝিয়াং প্রদেশ পুরোটাই পূর্বতুর্কিসত্মানের অংশ যেখানে এখনো রক্ত ঝরছে উইঘোর নামে পরিচিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর।
মানুষ দেশভ্রমণে যায় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে। কেউ যায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও তেজারতের উদ্দেশ্যে, কেউ যায় নিছক আনন্দ-বিনোদনের জন্য; কেউ যায় খেলতে, কেউ খেলা দেখতে। মনে পড়ে, ১৯৮২ সনে স্পেনে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসেছিলো। তো তখন আমাদের এই গরীব দেশটি থেকে কয়েক হাজার দর্শক স্পেন গিয়েছিলো নিছক দর্শক সেজে খেলা দেখতে। একটা বদনাম অবশ্য আছে; যতজন যায় ততজন ফিরে আসে না; এমনকি কিছু কিছু খেলোয়াড়ও ‘পথ ভুলে’ সেখানেই থেকে যায়। দু’একজন আবার ধরা পড়ে কানমলা খেয়ে দেশের ছেলে দেশে ফিরে আসে।
প্রাচ্যের দার্শনিক কবি, মুসলিম নবজাগরণের নকীব আল্লামা ইকবালও স্পেন গিয়েছিলেন। কেন, কী উদ্দেশ্যে, তা তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি স্পেন গিয়েছিলাম আমাদের হারিয়ে যাওয়া উন্দুলুসের সন্ধানে! সেই উন্দুলুস যা মুসলিম উম্মাহ শাসন করেছে সুদীর্ঘ আটশ বছর এবং গড়ে তুলেছে ‘কুরতুবা ও গারনাতাহ’- এর মত জ্ঞান ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র।’
স্পেনের মাটিতে বসে তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেন কলমের কালিতে নয়, চোখের পানিতেও নয়, একেবারে কলিজার খুনে এমন কিছু কবিতা যা মুসলিম তরুনদের রক্তে উন্মাদনা সৃষ্টি করে। ‘মিল্লি তারানা’ কবিতায় উন্দুলুসের গুলবাগিচাকে সম্বোধন করে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন-
‘আয় গুলিসত্মানে উন্দুলুস! তোমার কি মনে পড়ে সেই সোনালী দিনগুলোর কথা যখন তোমার ডালে ডালে ছিলো আমাদের ‘আশিয়ানা’?!’[8]
আল্লামা তাক্কী উছমানীও গিয়েছিলেন স্পেনে সেই হারিয়ে যাওয়া উন্দুলুসেরই সন্ধানে। তাই তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত সফরনামায় দিলের দরদ-ব্যথা ঢেলে লিখতে পেরেছেন-
‘আমাদের হারিয়ে যাওয়া উন্দুলুস, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিম উম্মাহর সুদীর্ঘ আটশ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সেই উন্দুলুসের পবিত্র ভূমি দেখার স্বপ্ন ছিলো শৈশব থেকে .... পঞ্চাশ মিনিটে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে উন্দুলুসের উপকূলীয় শহর মালেকার বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম এবং সেখানেই যোহর আদায় করলাম। এটা ছিলো সেই ভূখন্ড যার প্রতিটি কোণে সুদীর্ঘ আটশ বছর পর্যমত্ম ধ্বনিত হয়েছে আযানের তাকবীরধ্বনি, কিমত্মু আজ কেবলার দিক বলে দেয়ার মত একজন মানুষও এখানে নেই। এমনকি আমাদের নামায পড়ার দৃশ্যও ছিলো সবার জন্য তাজ্জবের বিষয়। ইউরোপ-আমেরিকার বহুস্থানে, এমনকি বিভিন্ন পাবলিক প্লেসেও নামায পড়ার সুযোগ হয়েছে, কিমত্মু নামাযের প্রতি অপরিচয়ের এমন নমুনা স্পেন ছাড়া আর কোথাও আমি দেখিনি। .... যাই হোক, ব্যথা-বেদনা এবং ইবরত ও শিক্ষাগ্রহণের আবেগ-অনুভূতি অমত্মরে নিয়ে উন্দুলুসের পবিত্র ভূমিতে প্রথম নামায আদায় করলাম। .... গ্রানাডার পথে যখন রওয়ানা হলাম, পথের দু’পাশে আমাদের চোখের সামনে ছিলো অমত্মহীন সবুজ উপত্যকা, আর কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম অতীত ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা। যে জাতি এখানে তলোয়ারের ছায়ায় তাকবীর বুলন্দ করেছিলো তারাই একসময় সুরা ও সঙ্গীতে এমন বেহুঁশ হলো যে, আজ তাদের নামনিশানা পর্যমত্ম বাকি নেই। ... কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম, তারিক বিন যিয়াদ তাঁর সাত হাজার মুজাহিদীনের ক্ষুদ্র বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে সেই ঈমানোদ্দীপক জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছেন যা ইতিহাসের পাতায় আজো অমর হয়ে আছে। কল্পনার চোখে দেখলাম, তিনি বলছেন- ‘হে লোকসকল, কোথায় পালাবে?! তোমাদের পিছনে সমুদ্র, আর সামনে শত্রুদল, আল্লাহর কসম, বিজয় কিংবা শাহাদাত ছাড়া তোমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। .... ইতিহাসের সেই সব মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো কল্পনার চোখে দেখতে দেখতে আমরা গ্রানাডার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেলাম। .... সুদীর্ঘ পথে প্রতিটি বসিত্মতে পাহাড়ের চূড়ায় প্রাচীন গীর্জা নজরে পড়লো, কিমত্মু সুদৃশ্য ও সুউচ্চ মিনারগুলো যেন এই বলে আর্তনাদ করছে, ‘এগুলো গীর্জা নয়, তোমাদের মসজিদ। আমরা মসজিদের মিনার ছিলাম, এখান থেকে প্রতিদিন আযান ধ্বনিত হয়েছে, কিন্তু তোমাদের গাফলতে সেই তাকবীরধ্বনি আজ সত্মব্ধ। বলো হে মুসাফির, কবে আবার ফিরে আসবে মিনারে মিনারে আযানের সুমধুর ধ্বনি?!
কিমত্মু আমার কাছে এ প্রশ্নের কোন জবাব ছিলো না। .... গ্রানাডা শহরে প্রবেশ করে আমার হৃদয় বেদনায় বিহবল হয়ে পড়লো। আজকের গ্রানাডা তো আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া ‘গরনাতাহ’ যেখানে একদিন আমরা জ্ঞান ও সভ্যতার আলো জ্বেলেছিলাম, যার কোন তুলনা তখনকার পৃথিবীতে ছিলো না। এমনকি ইউরোপের যুবরাজরা এখানে ছুটে আসতো জ্ঞানের সন্ধানে। তারা ছিলো ছাত্র, আমরা ছিলাম শিক্ষক। কিমত্মু সম্পদের প্রাচুর্য যখন আমাদের নিয়ে গেলো ভোগ-বিলাসের দুনিয়ায়, আর আমরা ভুলে গেলাম আমাদের মাকছাদে হায়াত তখন জ্ঞান ও সভ্যতার উন্নতি আমাদেরকে পতন ও অধঃপতন থেকে বাঁচাতে পারেনি। ....
আরো অনেক কিছুই লিখেছেন আল্লামা তাক্কী উছমানী কলমের কালি ও দিলের দরদ দিয়ে। থাক সেসব কথা। আল্লাহ যদি কখনো উন্দুলুসের পাক যমীনে যাওয়ার তাওফীক দেন। নিজের চোখে যদি দেখতে পাই গারনাতাহর সেই জামে মসজিদ যেখানে পাদ্রীদের প্রার্থনা অনুষ্ঠান দেখে তাক্কী উছমানীর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছে; যদি দেখতে পাই কুরতুবার সেই জামে মসজিদ যেখানে বসে কবি ইকবাল লিখেছেন-
‘তোমার মাটিতে রয়েছে কত সিজদার নিশান! কত আযানের ধ্বনি এখনো প্রতিধ্বনিত হয় নীরবে তোমার ভোরের বাতাসে।’
যদি আল্লাহ তাওফীক দেন তখন না হয় আবার কাঁদবো, আবার কিছু লিখবো, যদিও জানি, শুধু কান্নায় কখনো পাতা উল্টায় না তারীখের[9] এবং তাকদীরের।
স্পেনের পর চীনসফরেও গিয়েছিলেন আল্লামা তাকী উছমানী; তবে চীনের মহাপ্রাচীর দেখার জন্য নয়, তিনি গিয়েছিলেন চীনের দখলাধীন তুর্কিসত্মানের মজলুম মুসলমানদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য। সেই সফরনামায় তিনি লিখেছেন-
‘বরফঢাকা বিভিন্ন পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পার হয়ে দুপুর একটার সময় যখন আমরা লিনশা শহরে প্রবেশ করলাম তখন শহরের মুসলমানদের আনন্দ ছিলো দেখার মত। এমন মুহববতের সঙ্গে তারা মুছাফাহা করছিলো যে, মন চাচ্ছিলো প্রত্যেকের সঙ্গে হাত মিলাই। যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে তারা নিজেদের ঈমানের হিফাযত করেছেন এবং দ্বীনের বাতি জ্বালিয়ে রাখার জন্য যে তুলনাহীন ত্যাগ ও কোরবানি পেশ করেছেন তাতে নিশ্চয় করে বলা যায়, আমাদের মত রসমী মুসলমানদের চেয়ে ঈমানের স্বাদ ও লযযত তারা অনেক বেশী হাছিল করেছেন। তাই মন চাচ্ছিলো, তাদের প্রত্যেকের হাতে চুমু খাই। .... হয়ত আজকের আগে তারা চীনের বাইরের কোন মুসলমানের চেহারা দেখেনি; হয়ত আমিই প্রথম কোন বিদেশী মুসলমান যার মুখ থেকে এই জামে মসজিদে তারা বয়ান শুনেছে। ... সালার কাউন্টি নামে আরেকটি অঞ্চলে যাওয়া হলো। সেখানেও একই অবস্থা। মুছাফাহার সময় অনেকের চোখ ছলছল করছিলো, যা দেখে আমারও চোখে পানি এসে গেলো। পাকিসত্মান সরকার প্রতিবছর চীনা মুসলমানদের হজ্বের ব্যবস্থা করছে, এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে এক বৃদ্ধ এমন জারজার হয়ে কাঁদলেন যে, আমি সত্মব্ধ হয়ে গেলাম। সেই যৌবনকাল থেকে তিনি হজ্বের তামান্না দিলে লালন করছেন, কত মানুষ তাঁর চোখের সামনে হজ্বের তামান্না দিলে নিয়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন পাকিসত্মানী ভাইদের উছিলায় হজ্বের রাসত্মা খুলেছে, তাই তিনি আনন্দে উদ্বেলিত, কিন্তু ভাষা জানা নেই বলে শুধু চোখের পানি দিয়েই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। .... তাদের চোখের পানিতে একদিকে যেমন ছিলো শোকর ও মুহববতের জযবা তেমনি অন্যদিকে ছিলো অতীতের হাজারো জুলুম-সিতামের দাসত্মান ও বেদনাপূর্ণ কাহিনী, যা কল্পনা করতেও কলজে ছিড়ে যায়। ... একটি মসজিদের চত্বরে পাশাপাশি দু’টি কবর দেখতে পেলাম। প্রসিদ্ধ এই যে, এগুলো সমরকন্দ থেকে আগত দুই সহোদর ভাইয়ের কবর, যারা উটের পিঠে সওয়ার হয়ে এসেছিলেন। এখানে একটি ঝরণা দেখতে পেয়ে তাঁরা বিশ্রাম করার জন্য নেমেছিলেন। পরে যখন রওয়ানা হতে চাইলেন তখন দেখেন, উট আর কিছুতেই সামনে যেতে চায় না। তখন তাঁরা এটিকে গায়বের ইশারা মনে করে এখানেই বসবাস শুরু করেন এবং তাঁদেরই দাওয়াতের বরকতে এ অঞ্চলের মানুষ ইসলামের আলো পেয়েছে। ... সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পূর্বে চীনে বড় বড় মাদরাসা এবং দ্বীনী তা‘লীমের সুসংহত ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু বিপ্লবের সময় মুসলমানদের উপর এমন মুছীবতের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছিলো যে, ব্যস আল্লাহ পানাহ। অবস্থা এমন ছিলো যে, ঘরে কোরআন রাখাও ছিলো মৃত্যুদন্ডতুল্য অপরাধ। এখন অবশ্য অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে এবং মুসলমানরা যথেষ্ট ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করছে। ...[10]আল্লামা তাক্কী উছমানী তুরস্ক সফর করেছেন ১৯৮৪ সালের গোড়ার দিকে, আর হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ, সফর করেছেন, আরো আগে ১৯৫৬ সালের দিকে। উভয়ে নিজ নিজ সফরনামায় দিলের দরদ-ব্যথা ঢেলে অনেক কথা লিখেছেন, যা পড়ে দিল কাঁদে, চোখে অশ্রু ঝরে।
আল্লামা তাক্কী উছমানী তাঁর তুরস্কের সফরমানার প্রথম পাতায় ইসত্মাম্বুলের স্মরণে রচিত যে কবিতাটি উদ্ধৃত করেছেন সেটাই তাঁর মনের কথাটি বলে দেয়। অংশবিশেষ দেখুন-
নাকহাতে গুল কী তারাহ পাকীযা হায় ইস্কি হাওয়া/তুরবাতে আইয়ূব আনছারী সে আতী হায় ছাদা।
ফুলের সুবাস পাবে তুমি এর বাতাসে/আইয়ূব আনছারীর সমাধি থেকে আসছে এ আহবান।
আয় মুসলমানো! মিল্লাতে ইসলাম কা দিল হায় ইয়ে শহর/ সাইকাড়োঁ ছাদিয়োঁ কী কাশতো খুঁ কা হাছিল হায় ইয়ে শহর।
হে মুসলিম! ইসলামী উম্মাহর হৃদয় হলো এ শহর/ বহু শতাব্দীর খুন-কোরবানির ফল এ শহর।
সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী, আল্লামা তাক্কী উছমানী, এঁরা হলেন এ যুগের ইবনে বাতূতা, আলবেরূনী, তাঁদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করার আস্পর্ধা, বা নির্বুদ্ধিতা কোনটাই আমার নেই। তবু বলতে চাই, তাঁদের মত আমিও তুরস্কে গিয়েছিলাম হারিয়ে যাওয়া তুর্কিসত্মানের সন্ধানে; গিয়েছিলাম সেই ইসত্মাম্বুলকে কাছে থেকে দেখতে, যেখান থেকে একদিন মুসলিম খলিফা সারা বিশ্ব শাসন করতেন; সেই দরবারে খেলাফতের চিহ্নগুলো নিজের চোখে একবার দেখতে যার সম্পর্কে ইউরোপের রাষ্ট্রদূত লিখেছেন-
‘সুলতান কৃষ্ণসাগরকে মনে করেন তার নিজস্ব অধিকার, যেখানে অন্যকারো নেই প্রবেশাধিকার।’
আমি গিয়েছিলাম দেখতে যে, তুর্কীরা কি এখনো মনে রেখেছে তুর্কিসত্মানের কথা? এখনো কি তারা কাঁদে তাদের অতীতের গৌরব স্মরণ করে? এখনো কি তারা স্বপ্ন দেখে তাদের হারানো মর্যাদা ফিরে পাওয়ার? তাদের প্রিয় নেতা রজব তাইয়েব এরদোগান ২০৭১-এর যে ভবিষ্যত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন তা কি তারা গ্রহণ করেছে মনেপ্রাণে?
***
আল্লামা তাক্কী উছমানী ইসত্মাম্বুল সফরের দাওয়াত পেয়েছিলেন ঠিক ঐ সময় যখন তিনি দারুল উলুম করাচীর দারুলহাদীছে তিরমিযি শরীফের দরসে মশগুল ছিলেন, আর সৌভাগ্যক্রমে তাঁর সফর শুরু হয়েছিলো মক্কা-মদীনা ও হিজাযের পবিত্র ভূমি থেকে। আল্লাহর শোকর, আমার ক্ষেত্রেও সফরের দাওয়াতটা এসেছিলো বড় মুবারক সময়ে, অতি পবিত্র স্থানে এবং এমন একজন নেক মানুষের মাধ্যমে যাকে আমি আল্লাহর ওয়াসেত্ম মুহববত করি।
১৪৩১ সালের রামাযানে হারাম শরীফে ইতিকাফের অবস্থায় ছিলাম। হঠাৎ মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেবের ফোন এলো। তিনি তখন ঢাকায় হযরতপুরে মারকাযুদ্-দাওয়াহ’র মসজিদে ইতিকাফ করছেন। কোন ভূমিকা ছাড়াই বললেন, তুরস্কসফরের যদি কোন ব্যবস্থা হয়, আপনি কি তৈয়ার আছেন?
‘তুরস্ক’ শব্দটি যখনই শুনি, আমার কানে বড় মধুর হয়ে বাজে তুর্কিসত্মান! যদিও আমি জানি, বিশ্বের আধুনিক মানচিত্রে এ নামের কোন অসিত্মত্বই নেই। এবারও তাই হলো, তিনি বললেন, তুরস্ক, আমি শুনলাম, তুর্কিসত্মান! ভিতরে অদ্ভুত এক কম্পন সৃষ্টি হলো। বে-ইখতিয়ার মুখ থেকে বের হলো, ‘অবশ্যই ইনশাআল্লাহ’।
তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, আলহামদু লিল্লাহ। পরে অবশ্য তিনি বলেছেন, এভাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যাবো, তিনি আশা করেননি। আর এ আশঙ্কা তাঁর মনে শেষ পর্যমত্ম ছিলো যে, যে কোন সময় আমি আমার কথা থেকে পিছিয়ে আসতে পারি।
তাঁর ভাবনা অমূলক ছিলো না। ফোন রেখে দেয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে গেলো আমার মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সেই পরিচিত অবস্থা, সেই সফরভীতি। শেষ পর্যমত্ম প্রায় স্থির সিদ্ধামেত্ম পৌঁছে গেলাম, দেশে ফিরে তাঁকে বলবো, না ভাই, এত বড় সফর আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
দেশে এলাম। কয়েকদিন পর দেখা হলো। দিলের হালাত তাঁকে বললাম। তিনি বিচক্ষণ মানুষ; সরাসরি কিছু না বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এমন কিছু কথা তুলে ধরলেন যে, দিলটা গলে গেলো, আর বলে উঠলাম, ঠিক আছে আলহামদু লিল্লাহ।
***
পরে এক মজলিসে সম্মেলন সম্পর্কে তিনি বিসত্মারিত বললেন, যা মোটামুটি এই-
মদীনা শরীফে বসবাসকারী সিরিয়ার বিশিষ্ট আলিমে দ্বীন শায়খ মুহম্মদ আওয়ামাহ, তাঁর সঙ্গে মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবের আমত্মরিক সম্পর্ক, বরং স্নেহ-শফকতের সম্পর্ক। তাঁর পুত্র মুহীউদ্দীন আওয়ামাহ, ইলমমনস্ক, উদ্যমী ও প্রাণবমত্ম এক যুবক। তিনি তুরস্কের ইসত্মাম্বুল শহরে আগামী ১৫ই যিলকাদ শুক্রবার থেকে তিনদিনব্যাপী একটি আমত্মর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করছেন। পৃথিবীর বহু দেশের প্রায় চারশ ওলামা মাশায়েখ ও ইসলামী চিমত্মাবিদ ঐ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে আসছেন।
সম্মেলনের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে তুরস্কের শীর্ষস্থানীয় বয়োবৃদ্ধ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও দ্বীনী শাখছিয়াত শায়খ মাহমূদ আফেন্দীকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা। এক্ষেত্রে তাঁর আহবানে এগিয়ে এসেছে ভারতের হায়দারাবাদস্থ উচ্চতর ইসলামী ইনস্টিটিউট, যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে দারুল উলুম দেওবন্দ-এর প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী রহ.-এর জীবন ও কর্মের উপর গবেষণা করা। ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হলেন ভারতের সুপরিচিত আলিম মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানী, যিনি সেখানকার ইসলামী ফিকাহ একাডেমির বর্তমান মহাসচীব। ইনিস্টিটিউটের পক্ষ হতে ‘জাইযাতুল ইমাম মুহাম্মদ কাসিম’ নামে একটি আমত্মর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে, যা প্রতিবছর মুসলিমবিশ্বের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে প্রদান করা হবে। তো এই সম্মানজনক পুরস্কারটির জন্য প্রথম ব্যক্তিরূপে নির্বাচন করা হয়েছে তুরস্কের শায়খ মাহমূদ আফিন্দী-কে। এভাবে বলা যায়, মুহিউদ্দীন আওয়ামাহ ও মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানী-এর যৌথ উদ্যোগে ইসত্মাম্বুলের সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আসলে সার্বিক আয়োজন, ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের পিছনে রয়েছেন মুহীউদ্দীন আওয়ামাহ একা, কিমত্মু প্রচারবিমুখ এই যুবক নিজেকে আড়াল করে সামনে রেখেছেন মাওলানা রাহমানীকে।
***
এদিকে মুহীউদ্দীন আওয়ামাহ মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবকে অনুরোধ করেছেন, বাংলাদেশ থেকে পাঁচজন বিশিষ্ট আলিমের নাম পাঠাতে। তিনি নাম ঠিক করেছেন। প্রথম হলেন আমার প্রিয় উস্তায হযরত মাওলানা সুলতান যাওক ছাহেব। যথাযোগ্য নাম। আমত্মর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী রহ. প্রতিষ্ঠিত
رابطة الأدب الإسلامي العالمي
(বিশ্ব ইসলামী সাহিত্য সংস্থা)
এর বাংলাদেশ শাখার তিনি প্রধান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাবেতার নিয়মিত সম্মেলন হয় এবং হযরত যাওক ছাহেব তাতে অংশগ্রহণ করেন। এ সুবাদে আগেও তিনি ইসত্মাম্বুল সফর করেছেন।
দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন মাওলানা মুফতি আব্দুল্লাহ। তাঁর পরিচয়ের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, তিনি বাংলাদেশের সুস্বীকৃত উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্-দাওয়াহ’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। আধুনিক ফিক্হের উপর তাঁর গবেষণাপূর্ণ লেখাগুলো যথেষ্ট সমাদর লাভ করছে। বাংলাভাষার উপর স্বতন্ত্র চর্চা না করলেও তাঁর লেখা ও শৈলী বেশ ‘একাডেমিক ও অভিজাত’। সুতরাং আলোচ্য সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য, বলাই বাহুল্য তিনি অতি উপযুক্ত ব্যক্তি।
তৃতীয় ব্যক্তি মাওলানা আব্দুল মালিক। (মুফতি আব্দুল্লাহ ছাহেবের ছোট ভাই।) তাঁর সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তিনি ‘আব্দুল মালিক’। যারা ইসম অতিক্রম করে ‘মুসাম্মায়’ যেতে চান তাদের বলবো, হাদীছ শাস্ত্রের উপর তাঁর গবেষণাগ্রন্থ المدخل إلى علوم الحديث الشريف পড়ুন। আর যারা মুসাম্মা অতিক্রম করে সনদ ও মুসনাদের উর্ধ্বসত্মরে যেতে চান তাদের জন্য এতটুকু জানাই যথেষ্ট যে, আরবজাহানের সর্বজনমান্য মুহাদ্দিছগণের অন্যতম ফযীলাতুশ্-শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গোদ্দাহ রহ. এক পত্রে তাঁকে লিখেছেন-
لا تغفلوا عن محبكم الذي دخل إلى قلبكم ودخلتم قلبه
তুমি তোমাকে মুহববতকারী এই মানুষটিকে ভুলে যেয়ো না, যে তোমার দিলের ভিতরে দাখেল হয়েছে, আর তুমিও তার দিলে দাখেল হয়েছো। (সংক্ষেপিত) তাছাড়া সম্মেলনের যিনি আয়োজক তিনি তাঁকে শুধু উপযুক্তই মনে করেননি, আরো চারজন উপযুক্ত সদস্য নির্বাচনের দায়িত্বও তাঁর উপর অর্পণ করেছেন।
চতুর্থজন হলেন ঢাকা তেজগাঁও জামেয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়্যাহ -এর অন্যতম মুহাদ্দিছ মাওলানা আব্দুল মতীন। পুরো সফরে নিজের আচরণ ও উচ্চারণ দ্বারা তিনি তাঁর নির্বাচনের উপযুক্ততা প্রমাণ করেছেন।
তালিকার শেষে হলেও পঞ্চম মানুষটি হিসাবে মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেব কোন্ বিবেচনায় আমাকে নির্বাচন করলেন, এর কৈফিয়ত তো তাঁরই দেয়ার কথা। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলে বলবো, এটা তিনি করেছেন সম্ভবত ‘মুহববতের হাতে মজবূর’ হয়ে। যেভাবেই করুন, আল্লাহ তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন। কারণ তাঁর উছিলায় আমার জীবনের এত বড় স্বপ্ন এত সুন্দরভাবে পূর্ণ হয়েছে, আর প্রায় চারবছর বিলম্বে হলেও ‘তুরস্কে, তুর্কিসত্মানের সন্ধানে’ শিরোনাম ধারণ করে একটি সফরনামা আমার কলমের কালি দ্বারা তৈরী হয়েছে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা; সুতরাং শুরু ও শেষ শুধু তাঁরই প্রশংসা।
***
সব তো হলো, কিন্তু কয়েকদিন পর মনের অবস্থা হঠাৎ করে বেশ পরিবর্তন হয়ে গেলো। বিশেষ একটি পরিস্থিতির কারণে নিজের কাছেই আমি এ প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম যে, আমার এ অনুপস্থিতি মাদরাসার জন্য ক্ষতির কারণ হবে না তো? তদুপরি এ বছরটি হচ্ছে আমার ছেলের তা‘লীম ও তারবিয়াতের জন্য অত্যমত্ম গুরুত্বপূর্ণ মারহালা। আমার অনুপস্থিতিতে যদি তাতে ব্যাঘাত ঘটে! আশ্চর্য, এমন গুরুতর বিষয়টি আগে কেন চিমত্মায় আসেনি! বেশ পেরেশান হলাম, এখন কী করা?
এর মধ্যে একদিন মাওলানা আব্দুল মালিক বললেন, ওদিক থেকে আর কোন খবর আসেনি, মনে হচ্ছে সফর নাও হতে পারে। ভাবলাম, যাক, বাঁচা গেলো। মাথাও গেলো, ব্যথাও গেলো!
অস্বীকার করবো না যে, সেই সঙ্গে আফসোসও হলো, যেন মনের অজামেত্মই খানিকটা। আমার স্বপ্নের ইসত্মাম্বুলে সত্যি তাহলে যাওয়া হচ্ছে না! মানবমনের চিমত্মা ও গতিপ্রকৃতির রহস্য বোঝা সত্যি বড় কঠিন! হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও সুখ-দুঃখের মিশ্র অনুভূতির এত বিচিত্র অভিজ্ঞতা মানুষ তার জীবনের বাঁকে বাঁকে অর্জন করেছে যে, সে নিজেই নিজের সম্পর্কে ভেবে অবাক হয় এবং নিজের কাছেই নিজেকে অনেক সময় অপরিচিত মনে হয়। তাই পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্যেই ‘দুঃখের হাসি, সুখের কান্না’ কথাটি এত সমাদৃত।
***
দু’দিনের মাথায় পরিস্থিতির আবার পরিবর্তন। মাওলানা আব্দুল মালিক ফোনে জানালেন, সফরের বিষয় মোটামুটি চূড়ামত্ম। আর তখনই বলে ফেললাম, ‘আমার মন কিছুতেই আগে বাড়ছে না।’ কারণও তাঁকে জানালাম।
তিনি বললেন, এ আশঙ্কা তো আমি শুরু থেকেই করছি। আপনি যে সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়েছিলেন তাতেই বরং অবাক হয়েছিলাম। যাক, আমার মনে হয়, এখনই সিদ্ধামত্ম না নিয়ে আরেকটু চিমত্মা করে দেখলে ভালো হয়।
চিমত্মা করলাম এবং অগ্র-পশ্চাৎ সবদিক থেকেই চিমত্মা করলাম। কিন্তু মনের অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো না।
এর মধ্যে একদিন ফোন করে তিনি বললেন, যাওক ছাহেব পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর আপনার কথা শুনে বলেছেন, তাকে আমার পক্ষ হতে বলবেন, সে যেন অমত্মত আমার ছোহবত হাছিল করার নিয়তে সফরটা করে।
এত বড় সৌভাগ্যের কথা শোনার পর আমার আর বলার কিছু থাকে না। কিন্তু কী করি, পোড়া মন তাতেও অস্থিরতা থেকে মুক্ত হয় না!
এক বিকেলে মারকাযুদ্-দাওয়ায় গেলাম। মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবের হাতে পাসপোর্ট দিলাম, আর যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ে খুব অনুনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘আমার পরিবর্তে অন্য কাউকে দলভুক্ত করুন। বাকি, আমি যেহেতু আল্লাহর ঘরে হারামে বসে কথা দিয়েছি সেহেতু আপনার সিদ্ধামত্মই মেনে নেবো।’
এর মধ্যে একদিন তিনি ফোনে জানালেন, শারীরিক অসুস্থতা এবং উদ্ভূত কিছু প্রতিকূলতার কারণে যাওক ছাহেব হুযূর সফর বাতিল করেছেন।
পরে অবশ্য পুরো সফরেই আল্লাহর শোকর আদায় করেছি যে, তিনি সফরে আসেননি। এলে অনেক দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হতো, যা আমার জন্য খুব পেরেশানির কারণ হতো। চোখে দেখতাম, অথচ কিছু করার থাকতো না।
যাওক ছাহেব হুযূরের খবর শুনে একদিকে যেমন বিচলিত হলাম, তেমনি অন্যদিকে অবচেতন মনে হলেও কিছুটা যেন স্বসিত্মও অনুভব করলাম যে, এটা আমার জন্য সফর থেকে বিরত থাকার গ্রহণযোগ্য ওযর হতে পারে। মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেবকে বললাম, এখন তো আমাকে মাযূর মনে করুন এবং অব্যাহতি দান করুন!
তিনি এমনই এক কথা বললেন যে, আমি লজ্জায় একেবারে চুপ! কিন্তু ঘটনা এখানেই থেমে থাকলো না। দু’দিন পর তিনি খুব নিরীহ চেহারা নিয়ে বললেন, ‘আমারও যাওয়া হচ্ছে না।’
আচ্ছা ভালো মানুষ! কেন, আপনার যাওয়া হচ্ছে না কেন?!
কারণ হজ্বের ভিসা গ্রহণের জন্য তাঁর পাসপোর্ট এখন সউদী দূতাবাসে, যা সহসা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে এখনই তুর্কী দূতাবাসে ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে হবে।
এখন বুঝুন অবস্থা, ‘বর ছাড়া বরযাত্রী যাবে ইসত্মাম্বুল’!
কথাটা যে পরিহাস নয়, বাসত্মব তা পদে পদে অনুভব করেছি ইসত্মাম্বুলে গিয়ে। সে প্রসঙ্গ যথাস্থানে আসবে ইনশাআল্লাহ।
এ কথা শুনে আমি যাকে বলে, একেবারেই ভেঙ্গে পড়লাম। সফরের প্রতি এরপর আর কোন আকর্ষণই বাকি থাকলো না। তাই পরিষ্কার ভাষায় বললাম, আপনাকে ছাড়া আমি এ সফরে যেতে প্রস্ত্তত নই।
তিনি কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন, এককাজ করি, বিষয়টি পাহাড়পুরী হুযূরের কাছে পেশ করি, তিনি যা বলেন তার উপর আমল করি।
তাই তো! এর চেয়ে উত্তম কথা আর কী হতে পারে! এদিকে আমার বিশ্বাস ছিলো, সব অবস্থা শোনার পর হুযূর বলবেন,
‘তাহলে থাক’।
কিন্তু মাওলানা আব্দুল মালিক জানালেন, হুযূর বলেছেন, ‘আপনার যখন যাওয়া হচ্ছে না তখন তো ‘মাওলানা’র যাওয়া লাযিম’।
সুতরাং এদিক থেকেও ‘কিচ্ছা খতম’! ওদিকে মুদীরুল মারকায মুফতী আব্দুল্লাহ ছাহেব দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। আয়োজকদের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ চলছে। তারা জানিয়েছেন, তুর্কী দূতাবাসে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পৌঁছে গেছে। আপনারা যোগাযোগ করলেই ভিসা হয়ে যাবে। মঙ্গলবার পাসপোর্ট নিয়ে দূতাবাসে যাওয়া হলো। সেখানে দেখা গেলো অন্যরকম পরিস্থিতি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এমনভাবে কথা শুরু করলেন যেন কিছুই তার জানা নেই; অর্থাৎ ফের সে বিসমিল্লাহ!
ভদ্রলোকের প্রথম এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কেন আপনারা তুরস্কে যেতে চান? বেশ তো! দাওয়াত পাওয়া ‘বরযাত্রী’কে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, কেন বিয়েবাড়ীতে যেতে চান?!
(১৪ই যিলকাদ) বৃহস্পতিবার রওয়ানা হওয়ার কথা। শুক্রবার হলো সম্মেলনের উদ্বোধন। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যা পর্যমত্ম ভিসা সম্পর্কে কোন অগ্রগতি নেই। সুতরাং আগামীকাল ভিসা যদি হয়ও শুক্রবারটা যাবে পথে।
শেষ পর্যমত্ম দূতাবাস থেকে জানানো হলো, কী একটা তথ্য তাদের জানা দরকার। আয়োজক সংস্থা যদি সেটা আগামীকাল কর্মসময়ের মধ্যে জানাতে পারে তাহলে ভিসা দেয়া হবে।
আমার মনে হলো, ধীরে ধীরে পরিস্থিতি সফর না হওয়ার দিকেই যাচ্ছে। তাতে মনের ভিতরে খুশি-অখুশি দু’রকমেরই প্রতিক্রিয়া হলো। অদ্ভুত একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এর জন্য বাংলায় সবচে’ সুন্দর শব্দ হলো
‘অম্লমধুর’ অনুভূতি। অন্য ভাষায় এমন সুন্দর শব্দ আছে কি না আমার জানা নেই।
মুদীর ছাহেবের জন্য সত্যি মায়া হলো। আমি তো ঘরে বসে আছি চুপচাপ; দৌড়ঝাঁপ যা করার করছেন তিনি, আর সঙ্গে আছেন মিঠো ভাই।
পরে সুযোগ হয় কি না, তাই এখানেই মিঠো ভাই সম্পর্কে বলে রাখি। মাওলানা আব্দুল মালিক এবং মারকাযুদ্-দাওয়াহ’র সঙ্গে আমত্মরিক সম্পর্ক হলো শামসুল আরেফীন-এর। তিনি কত ভালো মানুষ তা দূর থেকে এবং সাদা চোখে দেখে বোঝার বড় একটা সুযোগ নেই; দেখতে হবে কাছে থেকে এবং ভিতরের চোখ দিয়ে। তবে আমার জন্য এটা বোঝার সহজ উপায় এই যে, মাওলানা আব্দুল মালেক তাকে মুহববত করেন, আর তিনি তাঁকে। সেই শামসুল আরেফীনের বন্ধু হলেন মিঠো ভাই। এখনকার যুগে মানুষের দু’টো নাম থাকে। একটা হলো ভালো নাম, আরেকটা ... যাই হোক, লোকে বলে ডাকনাম। তো এটা হলো তার ডাক নাম। ভালো নাম একটা আছে নিশ্চয়; আমার জানা নেই। তার সঙ্গে জীবনে আমার প্রথম দেখা এবং একবারই দেখা হারাম শরীফে উম্মে হানিতে। আমি আল্লাহর ঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। মাওলানা আব্দুল মালিকের আরেক প্রিয় মানুষ মাওলানা হাবীবুর-রহমান খানকে সঙ্গে করে ভাই শামসুল আরেফীন দেখা করলেন। সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু মিঠো ভাই। তখনই জানলাম, ইনি তুরস্কের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। তুর্কী বলতে পারেন, একেবারে অনর্গল নয়; মাঝে মধ্যে কিছুটা ‘অর্গল’ থাকে, তবে কাজ চলে যায় বেশ। এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা নয়, মুদীর ছাহেবের কাছ থেকে শোনা।
তো এই মিঠো ভাই মনেপ্রাণে চাচ্ছেন আমাদের সফরটা যেন হয়। তাই তিনিও সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষটায় তিনিও হাল ছেড়ে দেয়ার অবস্থায় উপনীত হলেন। প্রথম সমস্যা হলো সময়ের স্বল্পতা, আর দ্বিতীয় সমস্যাটা হলো, আমার ধারণায়, আমাদের সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে দূতাবাসের কারো কারো স্বচ্ছ ধারণার অভাব।
পরদিন বৃহস্পতিবার দাপ্তরিক সময়ের মধ্যে আয়োজকদের পক্ষ হতে কাঙ্ক্ষিত ই-মেইলটি পৌঁছলো না। তবু দূতাবাসের পক্ষ হতে সৌজন্য প্রদর্শন করে বলা হলো, আমরা সন্ধ্যা ছয়টা পর্যমত্ম তোমাদের জন্য অপেক্ষা করতে পারি। সবাই যখন ধরে নিয়েছে, ভিসা আর হচ্ছে না, তখন কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা ছ’টায় ই-মেইলটি এসে হাজির!
রাত্রে মাওলানা আব্দুল মালিক জানালেন, ‘শেষ মুহূর্তে ভিসা হয়ে গেছে। সুতরাং আপনার সব ‘বাহানা’ বাতিল এবং সফর লাযিম।’
এত কথা বলার উদ্দেশ্য এটা মোটেই নয় যে, এ সফরের প্রতি আমার আগ্রহের কোন কমতি ছিলো, বরং এটা তো আমার জন্য ছিলো অত্যমত্ম সৌভাগ্যের সফর, তারপরো সফরের প্রতি স্বভাবভীতি সবসময় আমার মধ্যে আশ্চর্য এক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন এবং ফায়ছালা করেন, তখন সমসত্ম প্রতিকূলতার মধ্যেও যা হওয়ার তা কেমন করে যেন হয়েই যায়!
এখানে আমি মনে করি, আমার ছেলের প্রতিও কিছুটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কর্তব্য। সন্ধ্যার পর, ভিতরে ভিতরে আমি তখন খুব পেরেশান, ছেলে কাছে এসে খুব নরম করে বললো, আববু, তুমি মনে হয় আমার জন্য চিমত্মা করছো। নিশ্চিমত্ম থাকো, তোমার অনুপস্থিতিতে সব কাজ আমি ঠিক মত করে যাবো, ইনশাআল্লাহ।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন করে উঠলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, জাযাকাল্লাহ।
অনেক বারের মত এবারও মনে হলো, সময় ও পরিবেশের বিচারে আমাদের ছেলেরা আমাদের শৈশবের চেয়ে অনেক ভালো, নিজেদের অযোগ্যতা অবহেলার কারণে আমরাই ওদের ভালো রাখতে পারি না।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
[1] আল্লাহ তাঁকে বরকতপূর্ণ দীর্ঘজীবন ও হায়াতে তাইয়েবাহ দান করুন, আমীন।
[2] হায়রে হুসনি, হায়রে মোবারক!
[3] এগুলো অনেক আগের কথা, যখন এ সফরনামা মাত্র লিখতে শুরু করেছি। এখন গাজা ও মিশরের রক্তঝরা পরিস্থিতির এত দ্রুত ও আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে যে, ভাবতেও অবাক লাগে! তাহরীরস্কয়ারে বহু প্রাণ ও বহু তাজা রক্তের বিনিময়ে সৃষ্ট গণবিপ্লবের মাধ্যমে মিশর হোসনি মোবারকের দীর্ঘ একত্রিশ বছরের দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। তারপর গণতন্ত্রের বিশ্বমোড়লদের হতবাক করে পূর্ণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে গণবিপ্লবের মূল শক্তি ইখওয়ানুল মুসলিমীন রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেছে। কিন্তু মাত্র একবছর! আবার সব তছনছ হয়ে গেলো। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডঃ মুরসী ক্ষমতাচ্যুত হলেন এবং বন্দী হলেন। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নিলো। সেনাপ্রধান জেনারেল সিসি সারা মিশরে, বিশেষ করে রাবেয়া আদাবিয়া মসজিদে এমন ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালালেন যে, একসময় যাকে বলা হতো মিশরের নতুন ফেরাউন, সেই জামাল আব্দুন-নাসেরের প্রেতাত্মাও বুঝি লজ্জা পায়! মিশরে এখন চলছে গণহত্যা, আর (ইহুদী নারীর সমত্মান) মিশরের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল সিসির পূর্ণ সহযোগিতায় অবরুদ্ধ গাজাভূখন্ডে ইহুদী হায়েনারা যা ঘটিয়ে চলেছে তার জন্য গণহত্যা শব্দটিও যথেষ্ট নয়। বলা যায়, রীতিমত একটি পুরো জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার নিষ্ঠুরতম হত্যা-অভিযান।
আল্লাহ জানেন আগামীকালের পাতায় কী লেখা রয়েছে! আর কত কাল চলবে, ‘ওয়া উমলী লাহুম’? কবে শুরু হবে ‘ইন্না কায়দী মাতীন’?
[4] ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরাইলের যুদ্ধমন্ত্রী, তার একটি চোখ ছিলো না, তাতে কালো পট্টি বাঁধা ছিলো ।
[5] বিষদাঁত ভেঙ্গেছে, তবে এখনো ফনা ধরে ছোবল দিতে চায়। ওঝারা বলে. বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়ার পর, কিছু দিন গেলে আবার নাকি বিষদাঁত গজায়। তাই এরদোগান সরকারকে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে।
[6] গর্দিশ মানে দুর্গতি, আর জাম্বিশ মানে নড়াচড়া, পদক্ষেপ
[7] আল্লাহর শোকর, দীর্ঘ সত্তর বছর রুশদখলে থাকার পর মধ্যএশিয়ার ছয়টি মুসলিম রাজ্য নববই-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে। ইসলামের কাছে না হলেও এগুলো এখন মুসলমানদের কাছে ফিরে এসেছে। রাজ্যছয়টি হচ্ছে উজবেকিসত্মান, তাজিকিসত্মান, কিরগিজিসত্মান, কাযাকিসত্মান ও তুর্কমেনিসত্মান। এই সমগ্র ভূখন্ড একসময় তুর্কিসত্মান নামে পরিচিত ছিলো। ইলমের বড় বড় মারকায বুখারা, সমরকন্দ, তিরমিয, ফারগানা, তাশকান্দ ইত্যাদি উজবেকিসত্মানে অবস্থিত। আল্লামা তাক্কী উছমানী এসব দেশ সফর করেছেন এবং সফরনামা লিখেছেন, যা অবশ্যই আমাদের পড়া উচিত।
[8] পাখীর বাসা, নীড়।
[9] বাংলায় তারিখ মানে মাসের দিন-সংখ্যা; উর্দূতে তারীখ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়, আরেকটি অর্থ হলো, ইতিহাস। শব্দটি বাংলায় এবং উর্দূতে আরবী থেকে এসেছে। পার্থক্য এই যে, বাংলাভাষা একটি অর্থের ক্ষেত্রে উর্দূ থেকে পিছিয়ে পড়েছে।
[10] আল্লামা তাক্কী উছমানী ১৯৮৫ সালে চীন সফর করেছেন, কিন্তু এ সফরনামা যখন লিখছি তখন অবস্থা এই যে, পূর্বতুর্কিসত্মানে উইঘোর মুসলমানদের উপর নেমে এসেছে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। উইঘোর মুসলিম যুবকদের ধরে ধরে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে। আমত্মর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর খুব কমই আসে, তবে ছিটেফোঁটা যা পাওয়া যায় তাতেই বোঝা যায়, কী ভয়াবহ দমন নিপীড়ন চলছে। আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন সাহায্যকারী নেই।